আটপৌরে জীবন… উন্নততর মানুষ…

আটপৌরে জীবন... উন্নততর মানুষ...

‘দেখবেন আমাকে যেন লার্জার দ্যান লাইফ করে তুলবেন না।’ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এই কথাগুলো বলে সতর্ক করে দিতেন সাংবাদিককে। ওই শর্তেই তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হতেন। কেমন উলটো পথের পথিক বলে মনে হচ্ছে না? বিশেষত আজকের দিনে। এখন তো ছবির প্রচারেই বেশি আলো ফেলা হয়। ছবির প্রচারে এসে অভিনেতারা পরিচালকের মুন্সিয়ানা আর পরিচালক অভিনেতাদের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে যান তাঁর ছবিতেই শ্রেষ্ঠ কাজ করে ফেলেছেন অভিনেতারা। সবসময় শিকে ছেঁড়ে না এতে, দর্শক শেষ কথা বলেন, তবুও বাড়িয়ে চড়িয়ে ফাঁপিয়ে নিজেদের ঢাক পেটানো এবং প্রচারের নানা কৌশল এখন চলচ্চিত্র পরিক্রমার অঙ্গ।

পরিচালক তরুণ মজুমদার লার্জার দ্যান লাইফ ছবি বানাননি আর নিজে থেকেছেন আড়ালে, বাংলার শিকড়ে প্রোথিত। চলেও গেলেন গীতবিতান আর নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের নিশান গায়ে জড়িয়ে- গান স্যালুট, ফুল, মালা, মিছিল, গুণকীর্তন উপেক্ষা করে। তিনি আজীবন চেয়েছেন, তাঁর ছবি দেখার পর হল থেকে বেরিয়ে প্রত্যেকটি মানুষ যেন একটু উন্নততর মানুষ হয়ে ওঠে। অহেতুক খারাপ ভাষা, অশ্লীল শব্দ, অশৈল্পিক দৃশ্যে ভরিয়ে রাখা পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালকরা এসবে প্রণিপাত করবেন নাকি ভাববেন,  ধুস এসব চিন্তাধারা ডাইনোসোর আমলের! অথচ তারা জানেন, আমরা দর্শকরাও জানি শিল্প ও বাণিজ্য দুই উল্টোমুখী স্রোতকে শ্রী মজুমদার মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন অনায়াসে। নিটোল গল্প, গান, মূল্যবোধ, প্রেম, ভালোবাসা সব মিলিয়ে তরুণ মজুমদারের ছবি। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির ওই দেশের বাড়ির উঠোন আর দুটি মাটির দাওয়ার কথা খুব মনে হয় আমার… কেমন রূপক যেন! শহরের ছেলে হীরু গ্রামে আসে পিসির বাড়ি, শিক্ষিত ছেলে। তার ঘরটি একটু উঁচুতে, পিসি নিচের দাওয়ায় রান্না করছে, গ্রাম নিয়ে ভাইপো হীরু আর্টিকেল লিখতে চায়… পিসি বোঝে না সে কথার অর্থ। গ্রামের লোককে জিগ্যেস করে গ্রামের আয়তন, তারাও বোঝে না… কিন্তু উত্তর দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে কী  কীআছে জানিয়ে দেয়… হীরু লিখে নেয় কিন্তু কুমির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সে বুঝে যায় মাঠ, ঘাট, মানুষ, নদী, জ্যোৎস্না, আলেয়া এসব তথ্য নয়, এসব নোটবুকে দাখিল করা হিসেব নয়… হৃদয়ঙ্গম করে নিতে হয়… প্রাণ ভরিয়ে।

বরং পরের দিকে তিনি নিজেকে পুনরাবৃত্তি করেছেন বলেই মনে হয়েছে আমার। বদলানো সময়ের সঙ্গে, নগর-গঞ্জের জটিলতার সঙ্গে তিনি তাল মেলাননি। নিবিড় তালগাছ ঘেরা গ্রামীণ জলাশয়, পানকৌড়ি, পাতিহাঁস ডানা ঝাপটায়… জলে ছায়া পড়ে বনানীর, দুঃখ জর্জরিত ছেলে মেয়ে স্নান করে, জল ভরে নেয় কলসে… এই তালপুকুর তাঁর বুকের মধ্যে ছিল… তিনি ছাড়তে চাননি কোমল জলাশয়কে। বীরভূমে, বোলপুরে এখনও এরকম দৃশ্যাবলী, গোলাপি, সাদা, নীল শালুকের সহজ টলমল আয়োজন দেখলে মনে পড়ে তরুণ মজুমদারের ছবির কথা। গ্রামজীবনে ঘটে চলা রোজকার অন্যায়, জুলুম, সর্বকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয় গণদেবতার দেবু পণ্ডিতের চরিত্রটিকে। খুব ছোটোবেলায় দেখেছি কিন্তু এখনও মনে আছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের দিকে, চোখ দুটো জ্বলছে… তারপর জোরদার প্রতিবাদ ও সোচ্চার হওয়ার দৃশ্যগুলো একের পর এক ভেসে ওঠে… বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকে। প্রতিবাদী অনির গ্রেফতারের পর দেবু পন্ডিত বলেছেন, ‘মানুষ চাইলে কী হতে পারে?’ এই উন্নততর মানুষের সন্ধান দিতেই চেয়েছেন তরুণ মজুমদারও। বিরাট কোনো মেসেজ সরাসরি ছুঁড়ে দেননি কোনোদিন দর্শকদের উদ্দেশ্যে, তাঁর ছবি ঘিরে সাঙ্ঘাতিক বৌদ্ধিক চর্চার অবসর গড়ে উঠল কি না তিনি কেয়ার করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন চার্লি চ্যাপলিনে। আর তাই জানতেন ভালো ছবি এবং জনপ্রিয় ছবি হওয়া সম্ভব।

এখন যে এই কন্টেন্ট ইজ কিং বলা হয়, এ সত্য বাণিজ্যিক ছবিতে তরুণ মজুমদার অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ছবিতে যে অভিনেতাকে প্রয়োজন, তাঁকেই নিয়েছেন বরাবর। বক্স অফিসের ছায়া কখনও নিয়ন্ত্রণ করেনি তরুণবাবুর চিন্তাধারাকে। যাত্রিকের ব্যানারে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটিতে ‘চাওয়া পাওয়া’ এবং সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘স্মৃতিটুকু থাক’ অত্যন্ত সফল হওয়ার পরও তিনি স্টারডম সেইভাবে ব্যবহার করার চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলেন। তাঁর ছবির নায়কদের তিনি রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সুপার হিরো ইমেজের বেড়াজালে বন্দি তারা নয়। এমনকি উত্তম- সুচিত্রা জুটির ‘চাওয়া পাওয়া’ অন্যরকম লেগেছিল। ফর্মুলায় থেকেও যেন একটু আলাদা ফ্লেভার। একটু বেশি স্মার্ট। তিনি বলতেন, “স্টার নেওয়া মানেই দর্শকদের মনে আগাম প্রত্যাশা উস্কে দেওয়া। যে প্রত্যাশা নতুন কিছু চায় না। চায় এক ধরণের বাঁধা পথ, বাঁধা শুরু, বাঁধা শুরু, বাঁধা শেষ ব্যস।” আর ‘পলাতক’ ছবির গল্প সবাই জানেন। আংটি চাটুজ্জের ভাই-এর চরিত্রে অনুপকুমারকেই তিনি চান, কোনো প্রযোজক রাজি নন। এমনকি যখন ভি শান্তারাম চিত্রনাট্য শুনে মুগ্ধ হন তখনও তরুণ মজুমদার জানিয়ে দেন অনুপকুমারই নায়কের ভূমিকায় থাকবেন, অন্য কেউ নয়। চিত্রনাট্য শুনে অভিভূত শান্তারাম রাজি হয়ে যান। দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, অয়ন বন্দোপাধ্যায়, তাপস পাল সবাই তাঁর পরিচালিত ছবিতে চরিত্রের প্রয়োজনে এসেছেন এবং দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে গেছেন। তাঁর মতো করে অনুপকুমারকে কেউ ব্যবহারই করেননি ছবিতে। এবং সন্ধ্যা রায়। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কাচের শোকেসে রাখা পুতুল পুতুল নায়িকা নয়। পুতুল পুতুল চেহারা, পানপাতা মুখের নায়িকাকে জল, হাওয়া, মাটি, কাদা দারিদ্রে লেপ্টে থাকা চরিত্রে তিনি কাস্ট করেছেন এবং সন্ধ্যা রায় নিজের দক্ষতায় সেসব চরিত্র উতরে গেছেন। তিনি নায়ককে সর্বগুণ সম্পন্ন দেখাতেই চাননি। তারা নিখুঁত নয়, পর্দার চেয়ে বড়ো তাদের ইমেজ নয়। তাদের না পারা আছে, ব্যর্থতা আছে। স্বাভাবিক, ত্রুটিযুক্ত নায়কদের মানবিক গুণ, সততা, বোহেমিয়ান জীবন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে উপস্থাপনার গুণে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর ছবিতে প্রাণ পেত। বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকা করতে বসলে সফলতার নিরিখে তরুণ মজুমদারের ছবিতে যে গানগুলি চিত্রায়িত হয়েছে সেগুলিই তালিকার শীর্ষে থাকবে নির্দ্ধিধায় বলা যায় এ কথা। তরুণ মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জুটি সর্বকালের সেরা। সহজ কথা, সুর অথচ প্রতিটি গান ছবির দৃশ্যাবলীকে ধনী করে তুলেছে। ভারতীয় ছবিতে গানের প্রয়োজন তখনই হয় যখন সংলাপের বদলে গান মারফত প্রকাশিত হয় আবেগ। অনেক অনেক সংলাপের বদলে একটি সুন্দর গান বলে দিতে পারে না বলা কথা, অনুচ্চারিত আবেগ। চাওয়া পাওয়া ছবিটির গানের কথা ভাবুন, সংলাপের মতোই যেন রচিত হয়েছিল গানটি। গোটা ছবিতে একটিই গান। প্রশ্ন আর উত্তর গানে গানে। পলাতক ছবিতে তো গানই বলে দেয় না বলা কত কথা। তরুণ মজুমদারের বাকি সব ছবিতেই গানের কাঁধে চেপেছে অনেক গুরু দায়িত্ব আর গানগুলো সে দায়িত্ব পালন করে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে পথ এবং মাইলফলক।

সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বেশি। কিন্তু সাহিত্যকে উপেক্ষা করে নয়। চিত্রনাট্যকে চলচ্চিত্রের উপযোগী করে তোলার জন্য যেটুকু বদল করার সেটুকুই করেছেন। যে গল্প নিয়ে তিনি ছবি করতে চান সেই গল্পটি কী বলতে চাইছে সেটি যেন ফুটে ওঠে পর্দায়। এই শাশ্বত মূল্যবোধ নিয়ে চলতে চেয়েছেন। তাঁর ছবিতে চরিত্রগুলির মধ্যেও সেই মূল্যবোধ জারিত হত। তাঁর শেষের ছবিগুলি হয়তো পরিবার কেন্দ্রিক, যৌথ পরিবারের গল্প বলে কিন্তু কাচের স্বর্গ, নিমন্ত্রণ, পলাতক, আলোর পিপাসা, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ঠগিনী, ফুলেশ্বরী, সংসার সীমান্তে, গণদেবতা, অমরগীতি, মহৎ মানবিক গুণের কথাই বলতে চেয়েছে। সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই তত্ত্বই হয়তো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সফল হয়েছেন কারণ আপামর সাধারন মানুষ তাঁর ছবি ভালোবাসত। পরবর্তীকালে যখন বাণিজ্যিক ছবি করার নামে হিন্দি ছবির কিছু নিকৃষ্ট ফর্মুলা, দক্ষিণী ছবির গল্প শুধু নয় আদব কায়দা, পোষাক, অঙ্গভঙ্গি নকল করে পটবয়লার তৈরির নামে দর্শকদের ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছিল তখন আমার মনে পড়ত তরুণ মজুমদারের ছবিগুলোর কথা। মানুষ পছন্দ করে এই অজুহাতে দীর্ঘদিন অক্ষম পরিচালকরা ও কিছু অসাধু প্রজোজক অসংখ্য খারাপ ছবি তৈরি করে গেছেন। কিন্তু এখন ওই ফর্মুলাও অচল কারণ আসল দক্ষিণী ছবিটি ওয়েব প্ল্যাটফর্মে দেখে ফেলছে দর্শক খুব সহজে। উন্নতমানের ভালো ছবি, ভালো গল্প, সুন্দর অভিনয়, অভিনব নির্মাণ এখন তাদের হাতের মুঠোয়। তাই খারাপ নকল দিয়ে ভালোকে ভুলিয়ে দেওয়ার গল্প এখন অচল।

তরুণ মজুমদার ছবি তৈরির ব্যাপারে তাঁর না বদলানো মানসিকতা নিয়ে বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে ব্যক্ত করেছিলেন নিজের মনোভাব। সর্বগ্রাসী টেকনোলজি এসেছে, বদল ঘটেছে বহিরঙ্গে, কিন্তু প্রকৃত মানবিকগুণাবলী একই আছে, সততা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা, এসব গুণ যখন বদলে যায়নি তখন তাঁর ছবির বিষয়, নির্মাণ, আঙ্গিক কেন বদলে যাবে! তিনি আসলে ভালোবাসার, বেদনার, মূল্যবোধের কথাই তো বলতে চেয়েছেন সেলুলয়েডে। কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন তরুণ মজুমদার সে সব গল্প তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণে সবাই তুলে ধরেছেন। শৃঙ্খলাপরায়ণ শিক্ষিত পরিচালকদের শেষ প্রতিনিধি তিনিই ছিলেন। সময়ানুবর্তিতাও সাঙ্ঘাতিক। এসব চারিত্রিক গুণ এবং শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা একজন শিল্পী মানুষকে সফল করে তোলে। কৃতী করে তোলে। তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়নি এমন পাঠক নেই। এত সুন্দর করে বাংলা ভাষা বলা ও লেখা, সত্যিই শিক্ষনীয়। তাঁর গল্পের বইয়ের নাম, ‘বাতিল চিত্রনাট্য।’ প্রবন্ধের বইটি- ‘নকশি কাঁথা।’ আর সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের নাম তো সর্বজনবিদিত, ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে।’ সমগ্র বই জুড়ে তাঁর সিনেমা যাপনের স্মৃতিকথা।

চিত্রঋণ: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা। যাদবপুর থেকেই স্প্যানিশ ভাষা এবং মাস কমিউনিকেশনে ডিপ্লোমা। লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিলই কিন্তু পরবর্তীকালে লেখাটাই জীবন জুড়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা, দি ওয়াল, এশিয়ানেট বাংলা, আরেক রকম, বিতর্ক, ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম, পান্থজন, ষান্মাসিক রবীন্দ্রনাথ, এবং সইকথা, কবিতাউৎসব, রংরুট, দক্ষিণের জানালা, পূর্বাশা এখন, গুটিপোকার সুতো, বাতিঘর অনলাইন, প্রবচন পত্রিকা, ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকা, মকটেল পত্রিকা, পেট্রোনাস, রা প্রকাশনের অভয়া, রায়ান, অভিব্যক্তি নিউ জার্সি, উদ্ভাস, ও কলকাতা, সৃজন ব্লগজিন, তিতিক্ষা প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ভালোবাসেন লিখতে, পড়তে, বেড়াতে, সিনেমা দেখতে আর আড্ডা মারতে। প্রকৃতির কাছে উদারতা শেখেন আর মানুষের কাছে খোঁজেন গল্প। দেবব্রত বিশ্বাস আর মহম্মদ রফির গান তাঁর সুখ দুঃখের সহচর। আবেগ আর রোমান্সে ভরপুর সমর্পিতা সবচেয়ে ভালোবাসেন বাংলা অক্ষর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *