সৃষ্টি আর ধ্বংস এগিয়ে চলে হাত ধরে পরস্পর
আমরা জানি প্রাচীনকালে ছাপানো বইয়ের বিকাশ পর্বের আগে পুথি সংরক্ষণের রীতি চালু ছিল। গাছের বাকল বা পাতায়, পশুর চামড়ায়, কাপড়ের উপর হাতে লেখা হতো সেসব পুথি। এছাড়া পাথর বা মাটির ফলকেও লিপিবদ্ধ করা হতো অজস্র পুথি। বিশেষ সংরক্ষণাগার বা পুঁথিশালায় সেই পুথি সংরক্ষণের রেওয়াজ ছিল। সেসময় অনেক মন্দির বা গির্জার গোপন কক্ষে মূল্যবান পুথি সংরক্ষণের নজির ইতিহাসে পাওয়া যায়। কখনও কখনও মূল্যবান পুথি, ফলক রাজপ্রাসাদের বিশেষস্থানে সংরক্ষিত থাকতো। বহিঃশত্রুর হাত থেকে মূল্যবান পুথি-পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য অনেক মন্দিরে ‘ভাণ্ডার’ তৈরি করা হতো। সম্ভবত জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এটির অধিক প্রচলন ছিল। ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায় বহিঃশত্রুর আক্রমণের লুণ্ঠন পর্বে মূল্যবান ধন-সম্পদের তালিকায় ‘পুথি’ও ছিল একটি আদরণীয় উপাচার। এরকম আক্রমণের মুখে বহুবার ভারতকে পড়তে হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে অনেক বৌদ্ধভিক্ষু জীবন বাঁচানোর তাগিদের পাশাপাশি মূল্যবান পুথি সঙ্গে নিয়ে পালাতে দ্বিধা করেননি। মূলত তাঁরা পালিয়ে তিব্বতে আশ্রয় নেন। মন্দের ভালো, তাঁদের কারণে অনেক পুথি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। পশ্চিম ভারতেও সমকালের কিছু জৈন পুথি লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল মন্দিরের গোপন ‘ভাণ্ডারে’ রক্ষিত থাকার কারণে।
স্ক্রল বই, পুথি যেভাবে সংরক্ষণ করা হতো বই সংরক্ষণের শুরুটাও অনেকটা তেমনই ছিল। লাইব্রেরি সৃষ্টির ইতিহাস বইয়ের মতোই সুপ্রাচীন। সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কবে কখন গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তার সঠিক দিনক্ষণ জানা সম্ভব হয়নি। অনেক ঐতিহাসিকের অনুমান মিশরের এক গির্জায় বই সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের সূচনা। অন্যদিকে, ইতিহাসের নানা উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একদল বিশেষজ্ঞ এই ধারণায় পৌঁছেছেন যে, প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় গ্রন্থাগারের উন্মেষ ঘটেছিল। তার পথপ্রদর্শক হিসেবে উঠে আসে সম্রাট প্রথম টিগলাথ পাইলেসারের নাম। অ্যাসিরিয়ান সম্রাট প্রথম টিগলাথ পাইলেসার (Tiglath Pileser I, reigned 1115-1076 BCE) শুধুমাত্র সাম্রাজ্য সুরক্ষায় এবং বিস্তারে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে মনোযোগী ছিলেন তা নয়। রাজ প্রাসাদের বাগানের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে দুষ্প্রাপ্য গাছপালা, এবং জীবজন্তু সংগ্রহশালার জন্য বিরল প্রজাতির পশুপাখি সংগ্রহের বিষয়ে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তৎকালীন প্রথম চিড়িয়াখানা নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি আশেপাশের রাজ্য থেকে পশু-পাখি সংগ্রহ করতেন বলে ধারণা। একই সঙ্গে পুস্তকের আদিরূপ কিউনিফর্ম সংগ্রাহক হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। এর সপক্ষে আমরা চট করে ঐতিহাসিক গুয়েন্ডোলিন লেইক (Gwendolyn Leick) এর মতামত জেনে নিতে পারি। তাঁর মতে প্রথম টিগলাথ পাইলেসার “তার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসিরিয়ান রাজাদের একজন ছিলেন, মূলত তাঁর বিস্তৃত সামরিক অভিযান, প্রকল্প নির্মাণের উত্সাহ এবং কিউনিফর্ম ট্যাবলেট সংগ্রহে তাঁর আগ্রহের কারণে তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন।”
তাঁর সংগ্রহশালা বা লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত কিউনিফর্ম ফলকগুলোতে অভিধান, প্রশাসনিক হিসেবে-নিকাশের খতিয়ান, বিভিন্ন দৈববাণী, গাছপালার পরিচিতি, পশুপাখির বিবরণ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সংগৃহীত ফলকগুলো টিগলাথ পাইলেসার কর্তৃক প্রথম চিরিয়াখানা নির্মাণের সাক্ষ্য বহন করে। প্রাপ্ত ফলকগুলো থেকে আরো পাওয়া গেছে অ্যাসিরীয় সভ্যতায় প্রচলিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, সঙ্গীত এবং জীবনযাপনের নানা উপকরণ; যা অ্যাসিরীয় সভ্যতার ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
টিগলাথ পাইলেসারের কিউনিফর্ম সংগ্রহশালাটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও সেটিকে ঠিক গ্রন্থাগার বলা যায় না। তাঁকে বরং সুমেরীয় সভ্যতায় প্রথম গ্রন্থাগার তৈরির চিন্তক হিসেবে অভিহিত করা যায়। হয়তো তাঁর সংগ্রহের তথ্যউপাত্ত পরবর্তী অ্যাসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপালকে (Assurbanipal – ruled 668-627 BC) পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থাগার নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সচরাচর রাজরাজড়াদের রাজসিক যেসব তকমার পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি সেদিক থেকে সম্রাট আসুরবানিপালের খেতাবের ক্ষেত্রে অন্তত একটি জায়গাতে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। তাঁর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে “Assurbanipal was first of all a warrior, then an administrator, and finally a librarian.” ইতিহাসের পাতায় অন্য কোনো সম্রাটের পরিচিতি কিংবা গুণগানে ‘লাইব্রেরিয়ান বা গ্রন্থাগারিক’ এধরনের তকমা চোখে পড়েনি। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অ্যাসিরিয়ান সম্রাট আসুরবানিপালকে প্রথম লাইব্রেরি নির্মাণের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাঁর লাইব্রেরিতে আক্কাদিয়ান এবং সুমেরীয় ভাষায় লিখিত কমপক্ষে ৩০.০০০ হাজার কিউনিফর্ম বা মাটির তৈরি ফলকের নথিপত্র পাওয়া গেছে। নিনেভেহ নামের প্রাচীন অ্যাসিরীয় শহরে তার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো অ্যাসিরিয়ান শহর নিনেভাহ’র ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। নিনেভাহ বর্তমান ইরাকের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নগরী মসুলের বিপরীতে টাইগ্রিস নদীর তীরে অ্যাসিরিয়ার একটি প্রাচীন শহর। অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে এটি বিশেষ করে সুনাক্রিব (Sennacherib) এবং আসুরবানিপালের অধীনে (খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী) ব্যাপক প্রভাব ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষটি টেল কৌয়ুনজিক (Tell Kouyunjik) নামে পরিচিত।
আসুরবানিপালের লাইব্রেরি নিনেভেহের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রাসাদ এবং উত্তর প্রাসাদ, এই দুটি পৃথক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ছিল। উদ্ধারকৃত অন্যান্য কিউনিফর্ম ট্যাবলেটগুলো ইশতার এবং নাবু মন্দিরে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলিকে গ্রন্থাগারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। নিনেভাহ শহরটি ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলোনিয়া এবং তার মিত্রদের দ্বারা দখল ও ধ্বংস হয়েছিল। দখলকৃত নিনেভাহর গ্রন্থাগারগুলো লুট করে ভবনগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল।
১৮৪৬-১৮৫১ পর্যন্ত অস্টিন হেনরি লেয়ার্ড (Austin Henry Layard) এবং ১৮৫২-১৮৫৪ পর্যন্ত হেনরি ক্রেসউইক রলিনসন (Henry Creswicke Rawlinson) ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অর্থায়নে নিনেভহে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ পরিচালনা করেন। তাঁদের মাধ্যমে আসুরবানিপালের লাইব্রেরির মূল্যবান সংগ্রহের হদিশ পাওয়া যায়। যেহেতু প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্যোগে ব্রিটিশ মিউজিয়াম জড়িত ছিল সেকারণে লাইব্রেরি থেকে উদ্ধারকৃত প্রায় সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রয়েছে। উল্লেখ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক রলিনসনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ইরাকী প্রত্নতাত্ত্বিক হরমুজদ রাসাম (Hormuzd Rassam) উক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কয়েক হাজার ট্যাবলেট উদ্ধারে তাঁর কৃতিত্ব রয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ ভবনের যেখানে লাইব্রেরিটি ছিল সেখানকার মেঝেতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একফুট গভীরে ভাঙা এবং অক্ষত ট্যাবলেট, মোমযুক্ত কাঠের লেখার বোর্ডের হদিশ পান। অক্ষত বড়মাপের ট্যাবলেটগুলো ছিল সমতল বৈশিষ্ট্যের, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ছিল ৯x৬ ইঞ্চি ( ২৩x১৫ সেন্টিমিটার)। সবচেয়ে ছোটোগুলো ছিল সামান্য উত্তল এবং লম্বায় ১ ইঞ্চি (২ সেন্টিমিটার) এর বেশি হবে না।
প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে মানুষ ও গাছপালার রোগ নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং কোন পাথর ধারণ করলে কোন রোগের নিরাময় সম্ভব তার উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র, রাষ্ট্রীয় প্রচারপত্র, সম্রাটদের চিঠিপত্র, রাজকর্মকর্তারা সম্রাট বরাবর যেসব চিঠি লিখতেন তার কিছু নমুনা। জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত নানা ভবিষ্যদ্বাণী, গ্রহ, নক্ষত্র এবং তাদের গতিবিধির বর্ণনা, প্রাচীন শব্দ তালিকা, ব্যাকরণগত পাঠ্য ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় ট্যাবলেটগুলো থেকে। তাছাড়া প্রভূত সাহিত্যমূল্য সম্বলিত মহাকাব্য গিলগামেশ, আনজু মিথ, সৃষ্টির মহাকাব্য, আসুরবানিপাল সম্পর্কে সাহিত্যিক মিথের সন্ধান পাওয়া যায় সম্রাট আসুরবানিপালের ধ্বংসপ্রাপ্ত লাইব্রেরির প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্ধারকার্য থেকে।
তাহলে আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরির গোড়াপত্তনের কৃতিত্ব অ্যাসিরিয় সম্রাট আসুরবানিপালের। যদিও এই সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া। হয়তো ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে নতুন অনুসন্ধানের মাধ্যমে আজকের পাওয়া সিদ্ধান্ত উল্টে গেল। কারণ মানব সভ্যতার শুরুর দিককার সবটা আজও আমাদের অজানাই থেকে গেছে। মহাকালের গর্ভ থেকে কবে কখন কোন সত্যি আমাদের সামনে উপস্থিত হয় সেটা আমরা জানিনা। নতুন কোনো সত্যি উদঘাটনের সম্ভাবনা তাই থেকে যাচ্ছে। যতদিন সেটি না হচ্ছে ততদিন পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অ্যাসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপাল গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবেন।
বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায় জুড়ে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে অযুত-নিযুত লাইব্রেরি। পাশাপাশি চলেছে সেসব সৃষ্টি ধ্বংসের হোলিখেলা। এই লেখা, বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন লাইব্রেরি এবং তার মনকাড়া ইতিবৃত্ত বয়ানে তেমন একটা গড়াবে না। আলোচনাতে বরং তিলতিল করে গড়ে তোলা অমূল্য সম্পদ লাইব্রেরি ধ্বংস নিয়ে অল্পবিস্তর বলার চেষ্টা থাকবে। লাইব্রেরি সৃষ্টির পেছনে যেমন মানুষের শুভবুদ্ধি, শ্রম আর হাত রয়েছে, প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া ধ্বংসের পেছনেও রয়েছে এই মানুষেরই অশুভবুদ্ধি আর হাত। পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরি তৈরির পেছনে থাকা মানুষটির সুলুকসন্ধান প্রাপ্তির পর কৌতূহল জাগা হয়তো খুব স্বাভাবিক লাইব্রেরি ধ্বংসের পেছনে প্রথম কার অশুভবুদ্ধি কাজ করেছিল?
যে কোনো সভ্য জনপদের জন্য লাইব্রেরি অমূল্য সম্পদ। ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি প্রধান বেন হোয়াইটের মন্তব্যটি এখানে স্মরণ করা যাক, “জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রবেশদ্বার হিসেবে গ্রন্থাগার সমাজে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে।” আর সে কারণেই যুদ্ধকালীন সময় কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র বিনাশের পরিকল্পনায় লাইব্রেরি ধ্বংসের অশুভ চিন্তা বাদ যায় না। জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিনাশ মানে জাতি হিসেবে যে কোনো রাষ্ট্রের সভ্য দুনিয়ার কাতার থেকে বহুগুণ পিছিয়ে পড়া। বহুকাল ধরে এই কদাকার রীতিটি ক্ষমতাপাগল উন্মত্ত মানুষ বিপক্ষকে ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সভ্যতা বা আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতিতে মটমট করতে থাকা বহু দেশ আজও এই অসভ্য চর্চায় নিমগ্ন। মানুষ হত্যার পাশাপাশি জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিনাশের মর্মন্তুদ কাহিনি ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। যার সবটা কখনোই আমাদের সামনে আসে না। কারণ ক্ষমতাশালীরাই লিখেন সেই ইতিহাস। নিজেদের অপকর্ম আড়ালের আটঘাট তাদের নখদর্পণে। তারপরও যেটুকু প্রকাশ্যে আসে, তা পাঠ করে সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা শিউরে উঠি একই সাথে লজ্জায়, ঘৃণায় মন বিষিয়ে ওঠে। কারণ আমরা জানি ধ্বংসকারী গোষ্ঠী ভিনগ্রহ থেকে আগত এলিয়েন নয়, আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ।
পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থাগার ধ্বংসের পেছনে যে নামটা সর্বাগ্রে উঠে আসে তিনি হচ্ছে রোমান সাম্রাজ্যের শক্তিমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার (Julius Caesar)। তার নামের সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্বখ্যাত এক গ্রন্থাগার ধ্বংসের কালিমা। গ্রন্থাগারটির নাম আলেকজান্দ্রিয়া। বহুলচর্চিত আরেক বিখ্যাত মানুষ যার গোড়াপত্তনে জড়িত রয়েছেন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (Alexander the Great)।
পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম সামরিক প্রধান হলেও আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট শুধুমাত্র রাজ্য জয়ের জন্য প্রায় গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াননি। ভুলে গেলে চলবে না শৈশবে তিনি কার সান্নিধ্যে শিক্ষা অর্জন করেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে। তাঁর সান্নিধ্যে থাকার মেয়াদ মাত্র তিন বছর। তা সত্ত্বেও যে শিক্ষা তিনি গুরু মারফত পেয়েছিলেন তার ছাপ ছিল সুদূর প্রসারী।
গ্রন্থাগারের ইতিহাসে দ্য গ্রেট লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া( Alexandria) একটি আলোচিত এবং সমৃদ্ধ নাম। এই গ্রন্থাগারের বহুল এবং সমৃদ্ধ সংগ্রহের জন্য একসময় এটির ছিল জগৎজোড়া খ্যাতি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে আলেকজান্ডার জয়কৃত আলেকজান্দ্রিয়াকে রোমান ও বাইজেন্টাইনের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চলকে গড়ে তোলার ভাবনা সুপ্ত ছিল তাঁর মনে। পরবর্তীতে সেই ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য টলেমি রাজবংশের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেন দ্য গ্রেট লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। এটি তাঁর শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটলের বক্তৃতা কক্ষ লাইসিয়ামের (Lyceum) আদলে তৈরি করা হয়েছিল।
সেই বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারটি ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বের ভেতর পড়ে গিয়ে একাধিকবার ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রথম আঘাতটা দেন জুলিয়াস সিজার। ক্ষমতা সংহত করতে জুলিয়াস সিজার নিজের মেয়ের সাথে সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ পম্পেই’এর বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুবিধা হয়নি তেমন। কন্যার মৃত্যুর পর শ্বশুর-জামাইয়ের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। শ্বশুরের শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পম্পেই উঠেপড়ে লাগেন। সিনেটের অধিকাংশ সদস্য তার পক্ষে থাকায় সিজারের নতুন করে কন্সাল নির্বাচনে দাঁড়ানোর আশার গুড়ে বালি পড়ে। উপরন্তু সিনেট তাকে জনগণের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। পম্পেইয়ের উপর সিজারকে টাইট দেওয়ার ভার পড়ে। শুরু হয় ক্ষমতার লইয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিজার পম্পেইকে অনুসরণ করে মিশরে পৌঁছান। পম্পেই মিশরের রাজা টলেমির সাহায্য পাবেন সেই আশায় গিয়েছিলেন। তাকে তাড়া করে সিজারও পৌঁছে যান। তারপর আলেকজান্দ্রিয়ায় মিশরীয় নৌবহরের আক্রমণে দলছুট হয়ে পড়েন। যুদ্ধের কৌশল এবং জীবন বাঁচানোর তাগিদে সিজার তখন পোতাশ্রয়ের ভিড়ে থাকা জাহাজগুলোতে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন। এমনকি তার নিজের জাহাজেও আগুন ধরানো হয়। সেই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া আগুন একপর্যায়ে আলেকজান্দ্রিয়ার সংগ্রহশালা লাইব্রেরির অনেকটা অংশ ধ্বংস করে। লাইব্রেরিটির যে অংশ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল পরে তার দ্রুত পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। যেভাবে কিংবা যে কারণেই হোক- এটি স্বতঃসিদ্ধ যে তৎকালীন পৃথিবীর বিস্ময় আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের প্রচুর দুষ্প্রাপ্য অমূল্য সম্পদ ধ্বংসে ক্ষমতালিপ্সু জুলিয়াস সিজারের হাত রয়েছে। রোমান খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ টাইটাস লিভিয়াস (Titus Livius), যিনি আমাদের কাছে লিভি (Livy) নামে পরিচিত, রোমান নাট্যকার এবং স্টোইক দার্শনিক সেনেকা দ্য ইয়াংগার (Seneca the Younger), প্লেটোনিস্ট দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, জীবনীকার, প্রাবন্ধিক এবং ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের পুরোহিত প্লুটার্ক (Plutarch), রোমান ইতিহাসবিদ ক্যাসিয়া ডিও (Lucius Cassius Dio) প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ আগুন লেগে আলেকজান্দ্রিয়া ধ্বংসের জন্য সিজারকে দায়ী করেছেন। ইতিহাসে সরাসরি জুলিয়াস সিজারের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে – “The first person blamed for the destruction of the Library is none other than Julius Caesar himself.”
দ্য গ্রেট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয় ৪০,০০০ এর মতো স্ক্রোল তাতে ভস্মীভূত হয়েছিল। একাধিকবার ধ্বংস হয়েছিল এই লাইব্রেরি। একদল ধ্বংস করে, অন্য আরেক দল এগিয়ে আসে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে পুনর্নির্মাণের শুভ ইচ্ছা নিয়ে। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। গ্রেট লাইব্রেরি নির্মাণের প্রায় পনেরশ’ বছর পর ১৯৭৪ সালে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থায়নে লাইব্রেরিটি আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। ২০০২ সালে ১২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয়।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আশ্চর্যজনকভাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি রক্ষা পেলেও মানুষের জিঘাংসা থেকে রক্ষা পায়নি। মানুষের এই ধ্বংসযজ্ঞের ধারাবাহিক খতিয়ান ইতিহাস লিখে রাখছে। সেরকম একটি খতিয়ান সমৃদ্ধ বই, জেমস র্যাভেন সম্পাদিত “লস্ট লাইব্রেরিজ: দ্য ডেসট্রাকশন অফ গ্রেট বুক কালেকশনস সিন্স অ্যান্টিকুইটি।” এ বইটি পাঠ করা একজন বইপ্রেমী-শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে অত্যাচারের সামিল। বইটি পাঠ করে জানা যাবে মানুষের সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি ধ্বংসাত্মক চেহারার ইতিবৃত্ত।
আলেকজান্দ্রিয়ার পরে এই উপমহাদেশীয় দুটি গ্রন্থাগার তথা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীময় গৌরব ছড়িয়েছিল। প্রথমটি তক্ষশীলা (Taxila)। ধারণা করা হয় তক্ষশীলার সূচনা সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে হয়েছিল। তক্ষশীলাকে অনেক বিশেষজ্ঞ পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করেন। যদিও আরেক দল সেই মতামতের বিপক্ষে বক্তব্য পেশ করেন। তাঁদের মতে আধুনিক ধারণায় তক্ষশীলাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাঠদানের কার্যক্রম চালু ছিল না। প্রাচীন জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে তক্ষশীলার নামডাক ছিল সন্দেহ নাই। বহু বিদেশী জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি তক্ষশীলায় এসেছিলেন। তথ্যসূত্র জানাচ্ছে, শিক্ষক হিসেবে প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত ভাষা-ব্যাকরণবিদ পাণিনি (Pāṇini), প্রজ্ঞাবান চাণক্য (Chanakya), কুমারালতা (Kumāralāta) প্রমুখেরা নিযুক্ত ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ এবং পরে রাজা বিম্বিসার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবক, সম্রাট কনিষ্কের চিকিৎসক চরক এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন। অন্তত আঠারোটি বিষয়ে এখানে জ্ঞানচর্চা হতো বলে উল্লেখ আছে। অধীত বিষয়গুলো ছিল: চিকিৎসা, যুক্তিবিদ্যা, হস্তিচালনা, স্থাপত্যবিদ্যা, সংস্কৃতভাষা ইত্যাদি। এক সময়কার প্রসিদ্ধ এবং ঋদ্ধ এই শিক্ষাকেন্দ্রটি বার বার পারস্য গ্রীক, রোমান, শক কুষাণ ইত্যাদি শক্তির আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ে। তক্ষশীলার কফিনের শেষ পেরেকটি মারা হয় হুন আক্রমণের মাধ্যমে, ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে।
তক্ষশীলার পর বিশ্বের আরেকটি প্রাচীন এবং প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নালন্দা। আটশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নালন্দা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ছিল। ইতিহাসের প্রাপ্ত সূত্র মতে ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত রাজবংশের শাসনামলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়কাল অনুযায়ী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট কুমার গুপ্ত। পরবর্তীতে ওই অঞ্চলের শাসনক্ষমতা পাল রাজাদের হাতে যায়। সেই সময় নালন্দার শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। পাল রাজাদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রন্থাগারটি আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। তৎকালীন বিশ্বের সেরা এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করতে সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন। কেননা সেইসময় বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞানচর্চার জন্য জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীদের কাছে নালন্দা ভিন্ন অন্য কোনো বিকল্প পীঠস্থান ছিল না। নালন্দার গ্রন্থাগার রত্নসাগর (Ratnasagara), রত্নদধি (Ratnadadhi) এবং রত্নরঞ্জক (Ratnaranjaka) এই তিনটি ভবনে বিস্তৃত ছিল। প্রতিটি ভবন ছিল নয়তলা বিশিষ্ট। এই তিনটি ভবন জুড়ে ছিল সংগৃহীত অমূল্য সম্পদ। যার মধ্যে ছিল: ধর্ম, সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ। নালন্দা গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকা পুস্তক,পাণ্ডুলিপির সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয় গ্রন্থাগারে লক্ষাধিক গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। পড়াশোনার জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত কঠোর। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তিনস্তরের পরীক্ষা দিতে হতো। গ্রন্থাগার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানতে হতো কিনা সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। এটি ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপান, কোরিয়া, চীন, পারস্য, তিব্বত, গ্রীস, বৃহত্তর ইরান ইত্যাদি দেশ থেকে আগত পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত অংশগ্রহণকারী ছিলেন। নালন্দায় পড়াশোনা করা উল্লেখযোগ্য পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন হর্ষবর্ধন, বাসুবন্ধু, আর্যদেব, পদ্মসম্ভব, জুয়ানজাং, হুই লি প্রমুখ। এই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন এত বিশাল ছিল যে ১০,০০০ এরও বেশি শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা অনায়াসেই হয়ে যেত। স্থাপত্যকলার দর্শনীয় নির্মাণ হিসেবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার গ্রন্থাগার বিবেচিত ছিল।
সমৃদ্ধ এই বিদ্যাপীঠ স্বভাবতই ক্ষমতাশালীদের চক্ষুশূল এবং লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তথ্যানুসারে তিনবার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের শিকার হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির পর দুবার এটি পুনর্নির্মিত হয়েছিল। স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) মিহিরাকুলের অধীনে হুনদের মাধ্যমে প্রথম ধ্বংস হয়েছিল। তবে স্কন্দগুপ্তের উত্তরসূরিরা লাইব্রেরিটি দ্রুত পুনরুদ্ধার করে সেটিকে আরো বড় ভবনে উন্নীত করেছিলেন।
৭ম শতকের প্রথম দিকে গৌড়দের আক্রমণে দ্বিতীয়বারের মতো এটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। ওই সময় বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার করেন। তৃতীয় এবং সর্বশেষ আক্রমণটি ছিল ব্যাপকমাত্রার ধ্বংসাত্মক। ১১৯৩ সালে তুর্কি নেতা বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে তৎকালীন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার গ্রন্থাগারটিকে ধ্বংস করা হয়। লুণ্ঠিত হয় প্রচুর সম্পদ। ওই হামলায় শুধু স্থাপত্য নিদর্শন ধ্বংস হয়নি, একই সাথে ধ্বংস হয়েছে দুষ্প্রাপ্য সব পুস্তক, পাণ্ডুলিপি। একই আদলে না হলেও ভবন নির্মাণ করা হয়তো সম্ভব হয়। কিন্তু বিনাশ হওয়া প্রাচীন অমূল্য পুস্তক, পাণ্ডুলিপির হদিশ আর পাওয়া সম্ভব হয় না।
ধ্বংসের আটশ’ বছর পর আবার নতুন করে ঐতিহ্যবাহী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্নির্মাণে ভারত সরকার পদক্ষেপ নেয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এ.পি.জে. আব্দুল কালাম এই উদ্যোগের পেছনে ভূমিকা রাখেন। সারাবিশ্ব থেকে ১,০০০ আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকে মাত্র ১৫ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য নির্বাচন করা হয়। গবেষণামুখী শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪তে আবার সচল হয়েছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।
যুদ্ধের নামে, দখলবাজির নামে, ক্ষমতার দম্ভে এভাবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে শত শত গ্রন্থাগার, স্ক্রোল, ফলক, পুস্তক, পাণ্ডুলিপি মতো দুষ্প্রাপ্য সাতরাজার ধন। দুই বিশ্বযুদ্ধে জুড়ে পৃথিবীতে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসেব যেমন পাওয়া সম্ভব হয়নি। একই ভাবে সম্পদ, বিশেষ করে লাইব্রেরি ধ্বংসের সঠিক হিসেব জানাও অসম্ভব। দু একটি রাষ্ট্রের খতিয়ানে চোখ রাখলে কতটা ভয়াবহ পরিমাণ মানুষের জীবন আর সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল তার সামান্যতম আঁচ পাওয়া যায়।
গ্রন্থাগার এবং তার সংগ্রহে থাকা বইপুস্তক একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেগুলো জাতিগত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী উপাত্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী আক্রমণকৃত প্রায় প্রত্যেকটি দেশের লাইব্রেরি ও বই ধ্বংস করে জাতিগত সংস্কৃতি বিলোপের চেষ্টা চালিয়েছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে অধিকৃত পোল্যান্ডের কিছু লাইব্রেরি তারা অক্ষত রেখেছিল। ইহুদি জাতির সংস্কৃতি বা আচরণ বিশ্লেষণ করে তাদের বিনাশের সহজ পথ অনুসন্ধানের জঘন্য মতলবে। ইউরোপের মূলভূখণ্ড যখন নাজিরা কব্জায় নিয়েছিল লন্ডনের লাইব্রেরিগুলো সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সংগৃহীত সম্পদ রক্ষার জন্য সেগুলো সুরক্ষিত কোথাও সরিয়ে ফেলতে হবে। কার্যক্ষেত্রে তাই করা হয়েছিল। তারপরও নাজিবাহিনীর আক্রমণে ব্রিটিশ গ্রন্থাগারগুলোর ক্ষয়ক্ষতি একেবারে কম হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধে নাজি বাহিনী বোমা ফেলে ধ্বংস যজ্ঞ চালানোর আগে ব্রিটিশ ন্যাশনাল সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে ১৭০,০০০ ভলিউম সংরক্ষিত ছিল। এয়ার রেইডে ক্ষতিগ্রস্ত লাইব্রেরির সংগ্রহ পরে গিয়ে দাঁড়ায় ৭২,৬০০ ভলিউমে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরি যুদ্ধের(১৯৩৩) ভেতর মূল্যবান সংগ্রহগুলো সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মতো দু’দফায়(১৯৩৯) প্রথমবার দশটন, পরের দফায় একশ টন, মূল্যবান সংগ্রহ সরিয়ে ফেলা হয়। যার মধ্যে ১২,০০০ বই এবং ১২০০ পাণ্ডুলিপি ছিল। ১৯৪০ সালে জার্মান বাহিনীর আক্রমণে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ক্ষতির পরিমাণ তুলনায় কম ছিল। প্রায় ১৫,০০০ ভলিউম ক্ষতির শিকার হয়েছিল। যার কপি অন্যান্য লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করে ক্ষতিপূরণ সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালের মে’এর ১০ তারিখে পরবর্তী আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ ছিল মারাত্মক। মিউজিয়ামের ছাদে জার্মান বাহিনী লাগাতার ডজনখানেক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে মিউজিয়ামে আগুন ধরে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সংগৃহীত বইয়ের। আনুমানিক ২৪০,০০০ ভলিউম যার মধ্যে ১৭৫,০০০বই অন্তর্ভুক্ত ছিল। একইভাবে জার্মান বাহিনীর মাধ্যমে সেন্ট ক্যাথিড্রাল লাইব্রেরি আক্রান্ত হয়েছিল। লাইব্রেরিতে আগুন লেগে ভবনের ক্ষতি হলেও সংগ্রহের অধিকাংশ সুরক্ষিত স্থানে পাঠিয়ে দেবার কারণে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি।
অক্ষ শক্তি জাপানের আক্রমণের আগে (১৯৩৬) এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় গোটা চীনে ৪,৭৪৭টি লাইব্রেরি ছিল। যার মধ্যে পাবলিক লাইব্রেরি, স্কুল লাইব্রেরি, প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরি এবং কাউন্টি ও মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৩ সাল নাগাদ, জাপানি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের পর লাইব্রেরির সংখ্যা কমে ৯৪০ দাঁড়ায়। গ্রন্থাগারের চার-পঞ্চমাংশ হয় ধ্বংস বা লুট করা হয়েছিল।
যুদ্ধের আগে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন ভলিউম বই-পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। যুদ্ধের পর তা নেমে দাঁড়ায় ১৫ মিলিয়নে। যুদ্ধের আঁচে অক্ষশক্তি ইতালির মিলানে ২০টিরও বেশি মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরি ধ্বংস হয়েছিল। অনেক পাবলিক লাইব্রেরিকে বরণ করে নিতে হয় একই পরিণতি। অনুমান করা হয় ২ মিলিয়ন মুদ্রিত বই এবং ৩৯,০০০ দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ধ্বংস হয়েছিল।
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট নাজি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড আর লাইব্রেরি ধ্বংসের বীভৎসতা দেখে বলেছিলেন- “আমরা সবাই জানি বই পুড়ে যায়। আবার এটাও ভালো করে জানি যে আগুন দিয়ে বইকে হত্যা করা যায় না। মানুষ মরতে পারে, কিন্তু বই কখনো মরে না। কোনো মানুষ বা কোনো শক্তি -স্মৃতির বিনাশ ঘটাতে পারে না। আমরা জানি, এই যুদ্ধে বই হলো একটা অস্ত্র।”
নাৎজিবাহিনী হাড়েমজ্জায় তা বিশ্বাস করতো। সেই আতঙ্ক বুকে নিয়ে নাজিবাহিনী যুদ্ধের সময় হত্যা আর ধ্বংসের মরণ নেশায় মেতে ছিল। খোদ জার্মানিতেও সংঘটিত হয়েছিল বই পোড়ানোর মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। ১৯৩৩ সালের ১০ মে বার্লিনের অপেরা চত্বরে প্রায় ৭০,০০০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল বই পোড়ানোর ধ্বংসলীলায় অংশ নেবার জন্য। তাদের স্লোগান ছিল, “যা কিছু অজার্মান তা আমরা আগুনে বিসর্জন দিচ্ছি।” বিসর্জনের বেদীতে সেদিন ২০,০০০ এর বেশি বই পোড়ানো হয়েছিল। শুধু বার্লিনেই এই ধ্বংসযজ্ঞ সীমাবদ্ধ ছিল না, গোটা জার্মানি জুড়েই দৃশ্যায়িত হয়েছিল এই জঘন্য কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে যা কিছু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের চিন্তাধারার সাথে সাংঘর্ষিক ও অ-জার্মান সেসব বই বাছাই করে পোড়ানো হয়েছিল। বেশির ভাগ বই ছিল ইহুদি এবং কমিউনিস্ট লেখকের লেখা। জাতীয় শুদ্ধির অংশ হিসেবে সেই কর্মকাণ্ড চালানো হলেও তাকে সমাজতান্ত্রিক দলের অন্তর্গত আতঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ তারা জানতো সংশ্লিষ্ট লেখকদের বইগুলো ঘাতক বুলেটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একেকটা বই যেন শক্তিশালী অস্ত্র। মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত সেরকম ৩,০০০ বইয়ের ওপর সেন্সর জারি করা হয়। বিশ্বযুদ্ধে এমন ধ্বংসের নজির ভুরিভুরি। এই স্বল্প পরিসরের লেখায় বিশ্বযুদ্ধে গ্রন্থাগার ধ্বংসের সবটা আনা অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে যতটুকু উল্লেখ করা গেল তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না দুই যুদ্ধে কত প্রাণহানি আর মূল্যবান সম্পদের বিনাশ ঘটেছে।
যুদ্ধবাজদের লক্ষ্যই থাকে একটি জাতিকে সর্বতোভাবে ধ্বংস করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেবার কোনো কসুর রাখেনি বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী। ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্তে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলকে সিক্ত করার পাশাপাশি অজস্র ভবন, নিদর্শন, গ্রন্থাগার ধ্বংস করেছিল। যখন টের পেয়েছিল বাঙালিকে দমিয়ে রাখার সাধ্য তাদের নেই তখন তাদের মেধাশূন্য করার চূড়ান্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটায় ১৪ ডিসেম্বর। ‘৭১ এর শুরুতে ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক হত্যার পাশাপাশি জগন্নাথ হলের গ্রন্থাগারটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকটি হলের গ্রন্থাগারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমন কী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটিও ২৫ মার্চের রাতে পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাঁর লাইব্রেরি থেকে সংগৃহীত মূল্যবান বইপত্র লুটপাট করা হয়েছিল। লুণ্ঠিত কয়েকটি বই এক হকারের হাতে পড়লে তিনি সেগুলো যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে তিনি সেগুলো ফেরত দেন। ১৯৭২ সালের ৮ মে, তারিখের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু সেই হকার হারুন রশিদকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, এমন একটা ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর থাবা থেকে রক্ষা পায়নি ঢাকার পাটুয়াটুলীর ঐহিত্যবাহী রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাগার। সেখানে সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল কুড়ি হাজারের মতো। সমৃদ্ধ সেই সংগ্রহ পাকিস্তানী বাহিনী লুট করে নেয়। একইভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের গ্রন্থাগারকে ধ্বংস করা হয়। যুদ্ধ যত এগিয়েছিল ধ্বংসের আগুন ততই ছড়িয়েছিল। রাজশাহী, রংপুরসহ সারা বাংলার কতশত গ্রন্থাগার যে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়েছিল তার সম্পূর্ণ হদিশ আজও অজানা।
১৯৮১ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ জাফনা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসের ধারাবাহিকতায় ৩১ মে সেখানকার ঐহিত্যবাহী জাফনা পাবলিক লাইব্রেরিটিতেও আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করা হয়। ১৯৩৩ সালে বার্লিনে নাজিবাহিনী যাবতীয় অজার্মান চিহ্ন সমূহ ধ্বংসের উৎসবে মেতেছিল। ওই এক বছরে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে জন্ম নিয়েছিল জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটির জন্মলগ্নে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ কাহিল ছিল। মাত্র ৮৪৪টি বই আর ৩০টির মতো সংবাদ পত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। কালক্রমে সেটি হয়ে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যের গর্বিত এক অংশ। জাফনার পাবলিক লাইব্রেরি তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়ার- অতি আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত মূল্যবান সংগ্রহে সমৃদ্ধি একটি লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৮৩ সালে গর্বের সাথে এটির সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা যেত – যদিনা ১৯৮১ সালের ৩১ মে জাতিগত দাঙ্গার জিঘাংসায় আগুন লাগিয়ে এটিকে ধ্বংস না করা হতো। জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি ধ্বংসের সেসময় জাফনার সাধারণ জনগণ লাইব্রেরিটি ঘিরে যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল সে রেশ এখনও তাদের বুকে জমা আছে। যুদ্ধের জিঘাংসার আগুনে জাফনা পাবলিক লাইব্রেরি প্রায় ৯৫,০০০ ভলিউম, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
যে দেশের প্রেসিডেন্ট বই নিয়ে আন্তরিক-মানবিক মন্তব্য করেন সেদেশ অন্যদেশে আগ্রাসন চালানোর সময় কতটা মনে রাখে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বাণী? ইতিহাস বলছে মোটেও তার তোয়াক্কা করা হয়না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে তো কোনো যুদ্ধই হবার কথা নয়। প্রাণহানি আর ধ্বংসও না। শিক্ষা নেবার ব্যাপারটা কেবলই কথার কথা। তাই বিশশতকে মানবতাবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুয়া অজুহাতের ছুতোয় ইরাকে হামলা চালায়। সভ্যতা, সংস্কৃতি আর শিল্পকলার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করে। এ আগ্রাসনের কারণ হিসেবে জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, “ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুতও আছে।” এ কারণে ইরাক যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই বানোয়াট অজুহাতের ছুতোয় ২০০৩ এ যুক্তরাষ্ট্র ও তার তাবেদার রাষ্ট্রগুলো ইরাকে হামলা চালায়। আগ্রাসন পরবর্তী সময়ে পরিদর্শকরা ইরাকে কোনো ধরনের রাসায়নিক বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পাননি। সেই অহেতুক যুদ্ধে দেড় লাখের বেশি ইরাকি প্রাণ হারান। সম্পদ ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ তথ্য জানা প্রায় অসম্ভব। জানা যায়, এপ্রিল ২০০৩ এ আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ইরাকে আগ্রাস চালানোর ৪৮ ঘন্টার ভেতর অসংখ্য বেসামরিক ও সামরিক মানুষের প্রাণ হানি ঘটে। শুধু নয়, দেশটির বহুমূল্যবান ঐতিহ্য ধ্বংস হয়। ইরাকের জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৭০,০০০ এরও বেশি প্রত্নসামগ্রী লুট হয়। জাতীয় গ্রন্থাগার এবং মিনিস্ট্রি অফ রিলিজিয়াস এনডাউমেন্ট তছনছ হয়। মুসল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যের সূত্রে তথ্যগুলো পাওয়া, বানোয়াট যে নয়- আজকের বিধ্বস্ত ইরাক তার সাক্ষী। ৩,০০০ ডিগ্রি তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যায় শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। যৌথবাহিনী সেই লুটপাটের নীরব সাক্ষী হওয়া ছাড়া প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাতে যায়নি। ১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের আক্রমণে বাগদাদ শহর ও তার লাইব্রেরি ধ্বংস হয়েছিল। ২০০৩ সেই শহর-তথা গোটা দেশ উস্কানিতে মত্ত লুটেরা জনগণের হাতে আরো একবার শুধু লুণ্ঠিতই হয় না- তার পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের সব পথ বন্ধ করে সমৃদ্ধ এক নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সেনারা ২০০৩ সালে ইরাকে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সে তুলনায় ইউক্রেনে কম ক্ষয়ক্ষতি করেছে রুশ বাহিনী। সম্প্রতি(৬ মার্চ, ২০২২) এমন বক্তব্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) ডগলাস ম্যাকগ্রেগর। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। ইতিহাস এমন আরো বহু নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত নীরবেই বহন করে চলেছে।
এই দেশটিকেই আবার মানবতাবাদী হয়ে সম্পদ ধ্বংসের কষ্টে হাহাকার করতে শোনা যাচ্ছে অধুনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে এক “বিশেষ সামরিক অভিযান” চালানোর ঘোষণার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধ ঘিরে গোটা বিশ্বে তৈরি হয়েছে নানামুখী জটিলতা। এ পর্যন্ত যুদ্ধে কত প্রাণহানি ঘটেছে তার সঠিক হিসেবে পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হচ্ছে ১৩,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সম্পদ ক্ষয়ের হিসেবও অজানা।
গত ২৫ জুন, ২০২২-এ, আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন (ALA) কাউন্সিল রাশিয়ান ফেডারেশন সরকারের দ্বারা ইউক্রেনে ক্রমাগত দখলের ফলে ইউক্রেনীয় সাংস্কৃতিক সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে৷ জানতে ইচ্ছে করে একই আকুলতা কী তারা দেখিয়েছিল ইরাক তথা বাগদাদ ধ্বংসের সময়? কিংবা সিরিয়া, কিংবা অন্যান্য যুদ্ধ নামের তাণ্ডবে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে? করা হলে অবশ্যই তা ন্যায়সঙ্গত। না হলে দুঃখজনক। কেননা অন্যায় যুদ্ধ কখনও শান্তি আনতে পারে না বরং গোটা বিশ্বে তৈরি করে জটিলতা। ইউক্রেন জুড়ে চলছে হত্যা আর ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা। এরই মধ্যে দেশটির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ইউক্রেনীয় বুক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ওলেক্সান্দ্রা কোভাল বলেছেন, রাশিয়ান সেনাবাহিনী কমপক্ষে ৪টি পাবলিক লাইব্রেরি ধ্বংস করেছে এবং ৩৫টি বই সংগ্রহশালার ক্ষতি সাধন করেছে। ইউক্রেনের আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের মতে, ৪,০০০ লাইব্রেরি দখলের অধীনে রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী সংস্কৃতি, থিয়েটার, লাইব্রেরি এবং ঐতিহাসিক ভবনের ৬৬টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে। ১৩মে পর্যন্ত, রাশিয়ান সেনাবাহিনী ২৭টি লাইব্রেরি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে।
প্রবাদ আছে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। দাঙ্গাবাজ কতিপয় মানুষ নিজের নিজের ক্ষমতা বগলদাবা করতে বার বার যুদ্ধ বাধাবে। হত্যা লুটপাট ধ্বংসযজ্ঞের ধারাবাহিকতাও চলবে। ইতিহাসে যুক্ত হবে নতুন নতুন ধ্বংসের অধ্যায়। তারপরও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ শেষপর্যন্ত সুন্দরের আরাধনায় নিমগ্ন থাকতে চায়। সেটাই আশার। তাইতো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াতে জীবন তুচ্ছ করে খুঁজে খুঁজে বই জোগাড় করে স্বপ্নবাজ কিছু মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝেই গড়ে তোলেন ছোট্ট গ্রন্থাকার। যে গ্রন্থাগার মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। ছাইস্তূপ সরিয়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তি যোগায়। পৃথিবীতে অশুভ সত্তা মিস্টার হাইড যেমন আছে, তারচে’ বহুগুণ বেশি আছে মিস্টার জেকিল। সাধু আর শয়তানের লড়াইয়ে আমরা শুভবুদ্ধির জয় যাচনা করি। ধ্বংসের মনোবাঞ্ছা যদি অন্ধকার হয়- সৃষ্টির মনোবাঞ্ছা নিশ্চিতভাবে আলো। আলো আর আশার বীজ অঙ্কুরিত হয় বইয়ের পাতা ফুঁড়ে। সেই আলোকময় বই ধারণ করে গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের অযুত নিযুত বই আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ভ্রমণ করতে হাতছানিতে ডাক দিয়ে যায় গ্রন্থাগার।
তথ্যসূত্র:
1. The Library of Ashurbanipal: A 2600-Year-Old Neo-Assyrian Library, by K. Kris Hirst, July 22, 2018.
2. World History Encyclopedia
3. The Earth Alive by Francois Derrey
4. The Library Of Alexandria by Jordan N.
5. আক্রমণের লক্ষ্য যখন গ্রন্থাগার: বাশার খান, প্রথম আলো , ২৫ মার্চ, ২০২২.
6. Edited by J. Raven, “Lost Libraries: The Destruction of Great Book Collections Since Antiquity”, Palgrave Macmillan Ltd 2004.
7. United Kingdom Libraries during World War II by Matthew Leavitt.
8. The Diplomat: The Burning of Jaffna Public Library: Sri Lanka’s First Step Toward Civil War
9. The New York Review: The Vanished Library by Bernard Lewis, Hugh Lioyed-Jones, Sept. 27, 1990 issue
10 The Ancient Indian University
11. A requiem for the Jaffna Library by Sundar Ganesan, Jan. 14, 2014.
12. WIPO MAGAZINE : Guaranteeing Access to Knowledge: The Role of Libraries, Ben White, August, 2012.
13. বই পোড়ানোর ঐতিহাসিক দিন: মার্ক ল্যুপকে
14. Hunting for books in the ruins: how Syria’s rebel librarians found hope by Delphine Minoui, 16 mar, 2021.
15. শিরোনাম ভাবনা: শামসুর রাহমানের কবিতা।