“…চূড়ায় পেয়েছ শুধু অন্তহীন শীত!”

“…চূড়ায় পেয়েছ শুধু অন্তহীন শীত!”

চারটি তিব্বতি শব্দ জুড়ে ওর নাম সৃষ্টি হয়েছে; উচ্চারণে ‘ইয়াং-চেন-জো-ঙ্গা’ বা ‘খান-চেন-জো-ঙ্গা’! সিকিমে যার মানে হলো ‘ঈশ্বরের আকর পঞ্চক’ (Five great treasuries of God)। আর সেই পাঁচটি তোষাখানায় সঞ্চিত পাঁচটি সম্পদ হলো সোনা-রূপা-মণিমাণিক্য-শস্য আর পবিত্র গ্রন্থাদি। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামখানি এসেছে সংস্কৃত ‘কাঞ্চন’ আর ‘গঙ্গা’ থেকে; সেই যা-ই হোক, লিম্বু ভাষায় ওকে যে নামে ডাকার চল, তাতেই এতদঞ্চলে ওর মাহাত্ম্য স্পষ্ট বোঝা যায়–– ‘সেনজেলুংমা’ বা ‘সেওয়ালুংমা’, যার সোজা মানে হলো সর্বশক্তিময়ী দেবী ‘ইউমা সাম্মাঙ’-এর খাসতালুক, অর্থান্তরে ‘সকল দেবতার থান’! তাই ওর চুড়োয় পা রাখা যায় না, দেবতার মাথায় মানুষ পা রাখবে কোন সাহসে ? ওকে জয় করা মানে শীর্ষদেশ (সর্বোচ্চ অর্থাৎ প্রধান শৃঙ্গটির উচ্চতা ৮৫৮৬ মিটার, অর্থাৎ ২৮,১৭০ ফুট) থেকে কয়েক মিটার নীচ অবধি পৌঁছনো, তার উপরে যাওয়া যায় না।

Kanchenjunga from Lamune Goecha La Trek 2012
Kanchenjunga from Lamune Goecha La Trek 2012

কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি চুড়োর তিনটি— প্রধান, মধ্য (৮৪৮২ মিটার) আর দক্ষিণ চুড়ো (৮৪৯৪ মিটার) উত্তর সিকিমে আর বাকি দু’টি (পশ্চিম— ইয়েলুং কাং, ৮৫০৫ মিটার; এবং আরো উত্তর-পশ্চিমে কাঙবাচেন, ৭৯০৩ মিটার) পড়ে নেপালের তাপলেজঙ জেলায়। আদতে সমগ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালের একান্নবর্তী সংসারে উত্তর-পশ্চিমে হোনক-চু (Lhonak Chu), গোমা-চু (Goma Chu) আর জঙসাঙ-লা (Jongsang La) থেকে দক্ষিণ-পূবে শিঙালিলা গিরিশিরার কাবরু-১, ২, ৩ এবং ৪ হয়ে রাথোং (৬৬৮২ মিটার) অবধি নয় নয় করে ষোলটি সাত হাজারি (মিটার) চূড়ার সমাহার (‘চু’ মানে নদী আর ‘লা’ হলো গিরিবর্ত্ম বা ‘পাস’) । 

এ হেন বরতনুটির বিস্তার প্রায় ৩১৪ বর্গ কিমি, তাতে চারটে প্রধান হিমবাহ, পশ্চিমে ইয়েলুং ও কাঙচেন নেপালের অরুণ ও কোশি নদীতে (কোশি আবার গঙ্গার অন্যতম প্রধান উপনদী) জলসিঞ্চন করে; দক্ষিণে জেমু আর টলুঙ হিমবাহ তিস্তাকে জল যুগিয়ে এসেছে।

মোট ১২০টি হিমবাহ এই কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালের গা বেয়ে বয়ে চলেছে, পরম দুঃখের বিষয় ২০১৫ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে এদের অর্ধেকের বেশি দৈর্ঘ্যে সংকুচিত হয়ে আধাআধির কম হয়ে গিয়েছে মূলতঃ বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে! তর্কযোগ্য ভাবে হিমালয় তথা দুনিয়ার সবচেয়ে দুরারোহ শৃঙ্গ হিসেবে যদিও কে-টু বা গডুইন অস্টেনের কুখ্যাতি রয়েছে, অনেক পোড়-খাওয়া পর্বতারোহীর মতে সে খ্যাতি আসলে কাঞ্চনজঙ্ঘারই প্রাপ্য। এ আকাশলীনার খাপখোলা তলোয়ারের মতো ধারালো ফিগারে বহু জায়গাতে বরফের মেদটুকুও জমতে পারে না, এতটাই খাড়াই! তবে যেটা নিয়ে কোনো তর্ক নেই, সেটা সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র পাঁচটি কোম্পানির চেয়ারম্যান রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরীই বলে গিয়েছেন সেই কবে,— “The most beautiful snow-range of the world”!

“The most beautiful snow-range of the world!”

যদ্দূর জানা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি প্রথম এই অঞ্চলের মানচিত্র আঁকবার প্রয়াস করেছিলেন রিনচেন নামগিয়াল (Rinzin Namgyal), যিনি একজন ‘পণ্ডিত’ বটেন। এই ‘পণ্ডিত’-রা হ’লেন স্থানীয় পাহাড়িয়া মানুষ, যাঁদের ব্রিটিশ সরকার রীতিমত ট্রেনিং দিয়ে সামান্য প্রকরণের সাহায্যে জরিপ করা, নক্ষত্রমণ্ডল দেখে দিকনির্ণয় ইত্যাদি শিখিয়ে দুর্গম হিমালয়ের আনাচকানাচ ও নিষিদ্ধ দেশ তিব্বত অভিযানে পাঠাতো। এঁদের মূল কাজ ছিল হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত অবধি অসম্ভব দুর্গম এবং অনেকাংশে চিরতুষারাবৃত এই বিশাল অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, নদনদী, আবহাওয়া, মানুষজন, প্রাকৃতিক ও জৈব সম্পদ ইত্যাদির যতদূর সম্ভব খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করা। হিমালয়ের অন্যপারে প্রাকৃতিক দুর্গমতার কারণে তিব্বত তো এক সম্পূর্ণ অজানা ভূখণ্ড ছিলই, তার উপর তিব্বতে গোর্খা আগ্রাসন হয় ১৭৯২তে। যদিও চীনের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত নেপালের রাজাকে পরাস্ত করে সে আক্রমণ প্রতিহত করেছিল তিব্বত, কিন্তু ফল হ’ল যে তিব্বতে প্রবেশের গিরিপথগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল বহিরাগতদের জন্য।

 চিরতুষারের দেশটি নিজের চারিধারে আগল তুলে দিয়ে নিজেই নিজেকে অনতিক্রম্য এক বিচ্ছিন্নতার একাকীত্বে লুকিয়ে ফেললো। লাদাখের রেশম পথ (পুরোনো রেশমপথটি পূর্ব সিকিমের জেলেপ-লা বেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে, সে পথের দুর্গমতা কহতব্য নয় আর তাতে প্রায় মধ্য তিব্বতে অবস্থিত লাসা-র পাল্লা অনেকখানি বেশি পড়ে; বরং দক্ষিণের শিগাৎসে এদিক থেকে অপেক্ষাকৃত কাছে) ধরে ভারতের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য কিছু চলতো তখনো। ভারত আদতে ভগবন তথাগতর দেশ কিনা, সেই সূত্রে কড়াকড়ির শিথিলতা ভারতীয়দের খানিকটা প্রাপ্য ছিল বোধহয়! কিন্তু ভারত থেকে আগত বানিয়াদের উপরেও কড়া নজরদারি চলতো, বেচাকেনা সেরে কেউ যাতে ফিরে না গিয়ে কোনোভাবেই এদেশে ভিড়ে যেতে না পারে! ভিনদেশী কেউ কোনভাবে যদি সে নিষিদ্ধ দেশে ঢুকে ধরা পড়ে যায়, শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সে মৃত্যুদণ্ডের ভয়াবহতার যেটুকু বর্ণনা পাওয়া যায়, তা আর এইখানে না-ই বা বললাম।

 ওদিকে বাংলায় কোম্পানির শাসন জেঁকে বসতে না বসতেই গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দ্রুত বুঝে গিয়েছিলেন তিব্বতকে চিনে উঠতে না পারলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চীনসহ পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যবিস্তার অসম্ভব। আর হিমালয়কে পাশ কাটিয়ে তিব্বতকে চেনাও অসম্ভব। ওদিকে উত্তরের দিক থেকে রাশিয়াও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্যে এই একই খেলায় নেমে পড়েছে। ব্রিটিশ-রাশিয়ার তিব্বত সহ মধ্য এশিয়া নিয়ে টানাটানির এহেন ‘Great Game’এর প্রেক্ষাপটে এই ‘পণ্ডিত’দের, যাকে বলে, ‘মঞ্চে’ আবির্ভাব! পাহাড়িয়া এই মানুষগুলোকে নৃতাত্ত্বিকভাবে তিব্বতিদের থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব, জন্মগত ভাষাও প্রায় এক। এঁরা বেশিরভাগই ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। ফলে, তিব্বতি জনগোষ্ঠীর মাঝে গুপ্তচর হিসেবে এঁদের চট করে চিহ্নিত করা অপেক্ষাকৃত শক্ত। এঁদের যে কয়েকজনের নাম ইতিহাসের বিস্মৃত পাতা ঘাঁটলে পাওয়া যাবে এখনো, রিনচেন নামগিয়াল ওঁদেরই একজন। এই দুঃসাহসীর দলকে শুধু ব্রিটিশের প্রশিক্ষিত গুপ্তচর বললে স্রেফ অপমান করা হয়। কি স্বীকৃতি পেয়েছেন ওঁরা, পরিবার-পরিজন ফেলে জীবন-হাতে করে সম্পূর্ণ অজানা দুর্গম পাহাড়-অরণ্যে নির্মম বরফরাজ্যে দিনের পর দিন অমানুষিক এইসব অভিযানে গিয়ে? কিচ্ছু নয়, বেশিরভাগের নামই মুছে গেছে চিরতরে, অথবা এতোই ঝাপসা যে আজ আর ভালভাবে পড়া যায় না। মাত্র দু’একজনের কথা জানা যায়, যাঁরা কাজ সেরে দেশে ফিরে ব্রিটিশের পারিতোষিকে বাকি জীবন সুখে স্বচ্ছন্দে কাটিয়েছেন। হিমাচলের (অধুনা উত্তরাখণ্ড) মিলামের জোহার গাঁয়ের ‘পণ্ডিত’ নাইন সিং রাওয়াত বা তস্য ভাইপো মান সিং রাওয়াত যেমন। কাজ সুষ্ঠুভাবে সেরে ফিরে এসে ব্রিটিশের কাছে রায়বাহাদুর উপাধি ও জমিজিরেত পেয়ে নাইন সিং সুখে বাকি জীবন কাটিয়েছেন বলে জানা যায়, এমনকি ২০০৪ সালে ভারত সরকার ওঁর নামে একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছেন। আরেকজন বাঙালী প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র শরৎচন্দ্র দাশ, ১৮৭৯তে যাঁর তিব্বত অভিযানে সঙ্গী হয়েছিলেন সিকিমের রিনচেনপঙ মঠের লামা উগেন গ্যাৎসো। শরৎচন্দ্র ফিরে এসে দার্জিলিং-এই ইংরেজসমাজের গা ঘেঁষে দিব্য বাড়িগাড়ি সাজিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। আবার উলটোদিকে, এই ‘পণ্ডিত’ রিনচেন, খাস ‘এভারেস্ট’-এর মানচিত্র-আঁকিয়ে ‘পণ্ডিত’ হরিরাম, অথবা কিন্টুপ ‘পণ্ডিত’! এঁদের বঞ্চনার কাহিনী নিয়েই আলাদা একটি গ্রন্থরচনা সম্ভব শুধু নয়, উত্তরপুরুষের দায়ও বটে।

তা আপাতত যাক সে সব কথা। ‘পণ্ডিত’ রিনচেন নামগিয়ালের আগে পূব হিমালয়ের ওই অঞ্চলে চরে বেড়িয়েছেন প্রখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ডাল্টন হুকার, তাঁর বিখ্যাত ‘Himalayan Journal’এর রসদ কুড়োতে (১৮৪৮-৪৯)। কখনো একা, কখনো বা তাঁর সঙ্গী হতেন দার্জিলিং-এর সুপারিন্টেনডেন্ট ডক্টর ক্যাম্পবেল। এর পরে ব্রিটিশ রেভেনিউ অফিসার ক্যাপ্টেন শেরউইল শিঙালিলা গিরিশিরা টপকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালের পাদদেশে পৌঁছাবার চেষ্টা করেন। তারপর মিউনিখের স্লাজেনওয়েহ ভ্রাতৃত্রয়ের জ্যেষ্ঠ হার্মান রুডলফ ভন স্লাজেনওয়েহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে পূর্ব ও মধ্য এশিয়ায় হিমালয়, কারাকোরাম আর কুনলুন পর্বতে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বিষয়ে তলিয়ে দেখতে এসে এক কাণ্ড করে বসেন। দার্জিলিং-এর ওই ডক্টর ক্যাম্পবেলের উস্কানিতে হার্মান শিঙালিলা বেয়ে টংলু হয়ে ফালুট পৌঁছান। পৌঁছে সায়েবের চক্ষু চড়কগাছ— আকাশজোড়া ওই রূপ মনের চোখে দেখলে মরমানুষের পার্থিব অনুভূতিগুলো ইস্তফা দেওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। তা সায়েব সেখানে বসেই এঁকে ফেলেছিলেন ওকে; একদম পুব দিক থেকে সিনিয়লচু, নরসিং থেকে জুপনু, পান্ডিমএর পরে রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তারপরে তিন-বোন চূড়া (Three Sisters) হয়ে পশ্চিমে মাকালু আর মাউন্ট এভারেস্ট! এটি একটি ঐতিহাসিক প্যানোরামা চিত্র যা বহুযুগ ধরে কাজের লোককে গবেষণামূলক তথ্য আর অকাজের পাহাড়প্রেমীকে স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছে। এর পরে ব্রিটিশ আর্মির ক্যাপ্টেন জে হার্মান; সিকিমের দিক থেকে প্রায় ওর পায়ের গোড়ায় পৌঁছে গেছিলেন (১৮৭৮-৮১); কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সুউচ্চ ও চূড়ান্ত দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে অসুস্থ হয়ে পড়ে মারা যান হার্মান। প্রায় একই সময়ে শরৎচন্দ্র দাস আর উগেন গ্যাৎসো সিকিমের জোঙরি, কাঙ লা, ইয়েলুং, কাংবাচেন হয়ে তিব্বত পৌঁছে যান। রিনচেন নামগিয়াল প্রায় এই পথেই সিকিমের উত্তরে জঙসাঙ লা, চর্তেন নিমা লা ধরে এগিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে প্রদক্ষিণ করে হোনক নদী উপত্যকা বেয়ে লাচেন হয়ে দার্জিলিং ফিরে আসেন (১৮৮৪)। সর্বপ্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রদক্ষিণকারী ওই রিনচেন নামগিয়ালের আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার ম্যাপ (১ ইঞ্চি = ১৬ মাইল স্কেলে) তারপরেই প্রকাশিত হয়।

১৮৯৯ সালে নেপালের দিক থেকে ডগলাস ফ্রেশফিল্ডের (Douglas Freshfield; ইনি প্রায় এক যুগ লন্ডনের রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন।) অভিযানটিকে সব দিক থেকেই বলা যেতে পারে মানবের প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল অভিযান। ব্রিটিশ পর্বতারোহী ডগলাস সেকালে যথেষ্ট দুঁদে পাহাড়ি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এ তল্লাটে পা দেওয়ার তিরিশ বছর আগেই নিজের মাত্তর তেইশ বছর বয়েসে রাশিয়ায় ককেশাস পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এলব্রুস-এ (নির্বাপিত আগ্নেয়গিরি; দ্বৈত চূড়ার দু’টিই সামান্য কমবেশি ৫৬০০ মিটার) প্রথম আরোহণের পালক তাঁর মুকুটে! কিন্তু সে সাড়ে পাঁচ হাজারি এলব্রুস তো এ দীঘলসুন্দরীর পাশে নেহাতই লিলিপুট! কোনো তুলনাতেই আসে না! তাই ফ্রেশফিল্ডের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা-কামী’ ব্রিটিশ দলের হয়ে অভিযানে যাওয়ার সময় অঞ্চলটি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে গিয়ে এক সদস্যের ভাষ্যে—

“It is guarded by the Demon of Inaccessibility… for the express purpose of defense against human assault, so skillfully is each comparatively weak spot raked by ice and snow batteries.”

অলঙ্ঘনের প্রেত আগলাচ্ছে ওর শিশমহলের দরোজা, বরাঙ্গনার দেহের প্রতিটি আপাত-কমনীয় কন্দরেই ওঁত পেতে আছে হিমেল মৃত্যু!

ফ্রেশফিল্ডের এই ব্রিটিশ দলের চিনিয়ে-দেওয়া ইয়েলুং উপত্যকার পথে ১৯০৫এর অ্যাংলো-সুইস দলের অভিযানটি মারাত্মক হিমানীসম্প্রপাতে পরিত্যক্ত হয়, দলের চারজনের মৃত্যু ঐ পর্বতের অজেয়তাকেই যেন আরো স্বীকৃতি দেয়। সিকিমের দিক থেকে বহুকাল পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ নিষিদ্ধ ছিল, তবু তারই মধ্যে ব্যাভেরিয়ার পল বাওয়ের (Paul Bauer) ১৯২৯ ও ১৯৩১— পর পর দু’বার উত্তর সিকিমের জেমু হিমবাহের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান করে ব্যর্থ হন। মধ্যে ১৯৩০এ জার্মান-সুইস দলের গুন্টার ডায়রেনফোর্থ (Günter O. Dyhrenfurth) কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমবাহের দিক থেকে আরোহণের চেষ্টা করেন ও অনিবার্যভাবে ব্যর্থ হন। পর পর তিনবছর তিনটে অভিযানে মোট আটজনের মৃত্যু পরের বিশ বছর কাউকে আর ও-মুখো ঘেঁষতে দেয়নি, যদিও ১৯৩১এর অভিযানটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ো থেকে হাজার মিটার নীচ অবধি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। এ যাবৎকালের মধ্যে ওটিই ছিল ওই ‘দেবীর থান’এর গা বেয়ে মানবের সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছনো। গোঁড়া নাৎসি আদর্শে বিশ্বাসে বিশ্বাসী পল বাওয়ের ১৯৩৬এ সিনিয়লচু জয় করেন ঠিকই, কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা তাঁর আর্যত্বের অহং ভালো মতো তুবড়ে দিয়েছিল। বহুকাল পরে এই সেদিন ২০০০ সালে তাঁর নাতি উইলি বাওয়ের অস্ট্রিয়ার বাড়িতে বসে স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁর দাদু প্রাণপণে চেয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়ের গ্লানি কাঞ্চনজঙ্ঘার সমুন্নত চ্যালেঞ্জকে পদানত করে খানিক মোচন করবেন! বিশ্বখ্যাত জার্মান আত্মাভিমান আরকি! তা সেই কারণেই পল বাওয়ের নাকি তাঁর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা অবধি (১৯৯০) কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতে দু’-দু’বার হেনস্থার কথা ভুলতে পারেননি! তিনি নাকি থেকে থেকেই বলতেন, আট-হাজারি শৃঙ্গগুলোর মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্যতম হলো কে-টু, আর তারপরেই এই রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘা! 

তাই ১৯৫৩এ এভারেস্ট জয় করে ফেরবার পরে যখন সাংবাদিকরা সে অভিযানের নেতা স্যার জন হান্টকে প্রশ্ন করেন— What next?
মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে হান্ট উত্তর দিয়েছিলেন,— কাঞ্চনজঙ্ঘা!
সঙ্গে এক নিশ্বাসেই বলেন,— “There is no doubt that those who first climb Kanchenjunga will achieve the greatest feat in mountaineering. For it is a mountain which combines in its defenses not only the severe handicaps of wind, weather and very high altitude, but technical climbing problems and objective dangers of an order even higher than those we encountered on Everest.” 

অর্থাৎ, বাওয়ের-এর মতো হান্টও মনে করেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ হবে পর্বতারোহণের ইতিহাসে চূড়ান্ত মাইলফলক, কারণ কাজটা মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের চেয়েও ঢের শক্ত!

আগেই বলেছি, ৩১-এর জার্মান দলের দুর্ঘটনার পরে বিশ বছর কেউ আর ওদিক পানে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। ১৯৫৪ সালে জন কেম্প আর গিলমোর লুইস মিলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উনিশ হাজার ফিট পর্যন্ত ঠেলে ওঠেন। তাতে বোঝা যায়, দক্ষিণ-পুবে সিকিমের মৃত্যুময় খাড়াইপথে নয়, বরং আরো খানিক পশ্চিমে নেপালের দিক থেকেই হয়তো ভবিষ্যতে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ সম্ভব হলেও হতে পারে। এই সব তথাকথিত ব্যর্থ অভিযানগুলোতে একটা উপকার তো হয়েইছিল, ‘দেবীর থান’এর প্রায় বিশ হাজার ফিট উচ্চতা পর্যন্ত হালহকিকতের হাতে-গরম (গরম! না বোধহয়, বরং বলা যায় মৃত্যুহিম ঠান্ডা!) খবরাখবর পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সব তথ্যাদি জড় করে স্যার জন হান্টের নেতৃত্বে ‘আলপাইন ক্লাব’ ও ‘রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’র একটি যৌথ কমিটি গঠিত হলো ১৯৫৪এর শেষদিকে। কারণ হান্ট নিজেই চেয়েছিলেন, দুরারোহ এই শৃঙ্গজয়ের জন্য একান্ত প্রয়োজন সক্কলে মিলে আটঘাট বাঁধা— reconnaissance in force। বলে রাখা যাক, এই জাতীয় যৌথ কমিটি গঠনের চল কিন্তু এই প্রথম নয়, দু’বছর আগে ১৯৫২তেও এই ‘অ্যালপাইন ক্লাব’ আর ‘রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’র ‘জয়েন্ট হিমালয়ান কমিটি’ গঠিত হয়েছিল, উদ্দেশ্য একই – reconnaissance, কিন্তু টার্গেট ছিল পৃথিবীর মুকুটশীর্ষ— ‘সাগরমাথা’, অ্যালিয়াস মাউন্ট এভারেস্ট! সেবারের ‘জয়েন্ট হিমালয়ান কমিটি’ পরিচালিত এভারেস্ট অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল সেকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান পর্বতারোহী এরিক শিপটনের, কিন্তু ঘটনাক্রম কিছুটা আকস্মিকভাবেই নেতৃত্বে নিয়ে আসে ব্রিটিশ আর্মির কর্নেল জন হান্টকে! হয়তো ঠিক আগের বছরই চো-ইয়্যুর (৮,১৫০ মিটার) ব্যর্থতা শিপটনের এই ব্রিটিশ দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রশ্নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫১এর এভারেস্ট সার্ভে (reconnaissance) অভিযানে ইয়েতির (!) পায়ের ছাপের ছবি-তোলা এরিক শিপটনের আর কোনোদিন এভারেস্ট জয় করা হয়ে ওঠেনি। দেবাদিদেবের ওই খাসতালুকে শিপটনের মতো কত অভিযাত্রীরই অব্যক্ত হাহাকার ঘন্টায় একশো কিমি বেগে বওয়া শিখরবাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে শনশনিয়ে উড়ে বেড়ায়!

সে যাই হোক, ১৯৫৪র ‘যৌথ কমিটি’ বেছে নিল এবারের কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযাত্রীদল, নেতৃত্বে ব্রিটিশ সার্জেন চার্লস ইভান্স, যিনি ১৯৫৩এর প্রথম সফল এভারেস্ট অভিযানে কর্নেল হান্টের ডেপুটি ছিলেন। সহনেতা এভারেস্ট-অভিজ্ঞ নর্ম্যান হার্ডি। সঙ্গে অভিযাত্রীদলের চিকিৎসক হিসেবে যাবেন ডা. জন ক্লেগ। এছাড়া যাবেন ম্যানচেস্টারের পোড়-খাওয়া পর্বতারোহী জো ব্রাউন, যাবেন নীল মাথ্যর, টম ম্যাককিনন, ইয়র্কশায়ারের স্কুলশিক্ষক জন জ্যাকসন, আগের দু’টি বড় অভিযানের অমূল্য অভিজ্ঞতা জোগাতে সঙ্গে যাবেন টনি স্ট্রেইদার আর, জর্জ ব্যান্ড। শুধু ইভান্স নন, জর্জ ব্যান্ডও ১৯৫৩এ কর্নেল হান্টের নেতৃত্বে সফল এভারেস্ট অভিযানের দলে ছিলেন।

১৪ই মার্চ দার্জিলিং থেকে রওয়ানা দিয়ে আজকের শখের ‘মাউন্টেইন-লাভার-ট্রেকার’দের চেনা পথে মানেভঞ্জন, টংলু, ফালুট টপকে অভিযাত্রীদল আরো এক মাস ধরে পদব্রজে শিঙালীলা গিরিশিরা বরাবর দুর্গম ঝর্ণা-জঙ্গল-চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আরও পশ্চিমে ইয়েলুং হিমবাহের (১৫০০০ ফিট) উপরে পৌঁছলেন। এই বেসক্যাম্পের ৩৬০º ঘিরে কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল রাজদরবারের ‘উচ্চপদস্থ’ আমীর-ওমরাহরা, আর সামনে মুখ তুলে তাকালে আকাশ ঢেকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজনন্দিনীর সিংহাসনের দক্ষিণ-পশ্চিম খাড়া বরফের দেওয়াল! স্বর্গছোঁয়া শৃঙ্গগুলির সান্নিধ্যে এসে তাদের বিশালত্বের অকল্পনীয় মাত্রায় আপনা থেকেই মন কেমন যেন নতজানু হতে চায়— পার্থিব সব অনুভূতি এমন কি মৃত্যুভয়ও নির্বাপিত হয়ে শুধু পড়ে থাকে এক ভাষাহীন আপ্লুতি, এক শ্রদ্ধামিশ্রিত আত্মসমর্পণেচ্ছা!

কিন্তু এবারই তো খেল শুরু— সামনে পড়ে আসল পরীক্ষা! সম্পূর্ণ অজানা রুট, প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বরফের ঢাল, দুর্দান্ত খামখেয়ালি আবহাওয়া, যখনতখন ঝুরো বরফের অ্যাভেলাঞ্চ, আর থেকে থেকেই একশো-দেড়শো কিমি বেগে বয়ে-চলা ব্লিজার্ডের ঝাপট! সামনে ২০০০ ফিটের লোয়ার আইসফলের (প্রায় সম্পূর্ণ জমে যাওয়া ঝর্ণা) ঝুরো বরফের রাশি আর অসংখ্য অতল ক্রিভাসের মৃত্যুফাঁদ এড়িয়ে এগোতে পারলে মিলবে আপার আইসফলের ৩৫০০ ফিট বেয়ে উঠবার চ্যালেঞ্জ। তাতে সুতীক্ষ্ণ বর্ষাফলকের মতো ঝুলছে জমাট বরফের বিরাট বিরাট চাঁই! তার ঠিক উপরে একটা প্রশস্ত বরফের তাক যেটা কেম্প আর গিলমোর খুঁজে পেয়েছিলেন এক বছর আগের অভিযানে এসে। প্রথম লক্ষ্য সেই তাকটায় চড়া। সেখানে পৌঁছাতে পারলে তারপর চুড়োর দিকে যাবার কথা ভাবা গেলেও যেতে পারে! এক সপ্তাহ ধরে জর্জ ব্যান্ড আর নর্ম্যান হার্ডি লোয়ার আইসফলের মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে শেষে বরফের দেওয়াল বেয়ে খানিক বরফ খুঁড়ে পথ করে নিয়ে সেই প্রশস্ত বরফের চাতালের নীচে পৌঁছে দেখলেন— আর এগোবার পথ নেই! সামনে অলঙ্ঘনীয় বরফরাজ্য! কেম্প-গিলমোরের বাৎলানো পথে এগিয়ে আখেরে মিলল সাত দিনের পণ্ডশ্রম, আবার সমস্ত কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে!

হার মানবেন বলে তো আসেননি, গভীর পর্যবেক্ষণে ওই লোয়ার আইসফলের একপাশে একটা ছোটো হিমবাহ দেখতে পেলেন নর্ম্যান; পথই চেনাবে পথের হদিস— লোয়ার আইসফলের দুর্লঙ্ঘ্য মৃত্যুফাঁদ পাশ কাটিয়ে জর্জ আর নর্ম্যান ওই হিমবাহ বেয়ে উপরে উঠে পড়লেন! তারপর অপেক্ষাকৃত সহজে আপার আইসফল বেয়ে চড়ে বসলেন কেম্প-গিলমোরের চিনিয়ে-দেওয়া সেই বরফের তাকে (ice shelf)! সেইখানে ১২ই মে ১৯৫৫, অভিযাত্রী দল ৭,২০০ মিটার (২৩,৫০০ ফিট) উচ্চতায় চার নম্বর ক্যাম্প পাতলেন। এই অভিযানের আগের সমস্ত সার্ভে অভিযানগুলোর দৌড় এই পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। কোনো মরমানুষ এর আগে রাজনন্দিনীর দরবারে এত উপর অবধি পৌঁছাতে পারেনি।

পরের দিন ১৩ই মে শুক্রবার ১৯৫৫— ‘ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ’, জর্জ ব্যান্ড তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন— অভিযানের এক অবিস্মরণীয় দিন! সক্কাল সক্কাল দলনেতা ইভান্স আর হার্ডি বেরিয়ে পড়লেন শৃঙ্গজয়ের রুটটি নির্দিষ্ট করতে। বেশ অনায়াসেই তাঁরা ২৫,৩০০ ফিটে একটি মোটামুটি নিরাপদ ও চওড়া জায়গা পেয়ে গেলেন, যেখানে পরের ক্যাম্প (পাঁচ নম্বর ক্যাম্প) করা যাবে। ক্যাম্পের আবহাওয়া এতদিনে আশার সূর্যকিরণে ঝলমলিয়ে উঠল— কারণ পঞ্চম ক্যাম্পের জায়গা মিলেছে আর সেই ক্যাম্প থেকে আর মাত্র ২৯০০ ফিট উঠতে পারলেই চুড়ো!


রেইকি সেরে ক্যাম্পে ফিরে চার্লস ইভান্স ধোঁয়া-ওঠা চায়ের মাগে চুমুক দিয়ে সঙ্গীদের চূড়ান্ত পরিকল্পনাটি খুলে বললেন। একদল নীচের ক্যাম্প থেকে মালপত্তর ফেরি করবে, আরেকদল এগিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পাঁচ নম্বর ক্যাম্প ফেলবে; শীর্ষজয়ের জন্য প্রথম জুড়ি হিসেবে বেছে নেওয়া হলো জর্জ ব্যান্ড আর জো ব্রাউনকে— এঁদের সঙ্গে দলনেতা ইভান্স আর নীল মাথ্যর চারজন শেরপাকে নিয়ে পঞ্চম ক্যাম্প থেকে আরো এগোবেন ফাইন্যাল সামিট ক্যাম্প তৈরি করতে। যেখান থেকে প্রথম শিখর-জুড়ি ‘ফাইন্যাল অ্যাসল্ট’এ যাবেন! স্ট্রেইদার আর হার্ডি নীচের ক্যাম্পে অপেক্ষা করবেন পরের জুড়ি হিসেবে, যদি প্রথম জুটি শৃঙ্গারোহণে ব্যর্থ হয় তাহলে ওঁরা এগোবেন।

এই ‘শৃঙ্গারোহণ’ বা ‘শৃঙ্গজয়’ জিনিসটাকে পর্বতারোহণ সম্পর্কিত ইংরেজি লেখাপত্রে কেন যে ‘ফাইন্যাল অ্যাসল্ট’ বলা হয়! কিন্তু কই, মন্দির-মসজিদ-গির্জেতে পূজা-প্রার্থনায় উপনীত হওয়াকে তো ভুলেও ‘আক্রমণ’ বলা হয় না! ‘ওয়ারশিপ’ বুঝি কেবলমাত্র চার-দেওয়ালের ঘেরাটোপের মধ্যে কাল্পনিক দেবমূর্তি বা প্রতীকের সামনে, আর খোলা আকাশের সামিয়ানার নীচে ‘ওয়ার’ আর ‘অ্যাসল্ট’? সিকিমি বৌদ্ধদের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা মহা পবিত্র দেবস্থান, লিম্বু জাতির কাছে সাক্ষাৎ দেবী ইউমা সাম্মাঙ! সিকিমের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ জনপ্রিয় হয়নি শুধু দুর্গমতার কারণেই নয়, ও পথে বিদেশীদের সিকিম সরকারের অনুমতি মেলে না বলে। সিকিমের দ্বাদশ ও শেষ চোগিয়াল (রাজা) পলডেন থোন্ডুপ নামগিয়াল কখনো বিদেশীদের সিকিমের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান করতে দেননি। ১৯৭৭এ কর্নেল নরিন্দরকুমারের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সফল অভিযানটিও চুড়ো থেকে ৬ ফুট নীচে জয়পতাকা পুঁতে ফিরে এসেছিল। ২০০০ সালের এপ্রিলে অস্ট্রিয়ান অভিযানটি নিয়ে তুমুল হট্টগোল উঠেছিল, সিকিম জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে যে রাজ্য সরকার বিদেশী মুদ্রার কাছে নিজের ধর্মকে বিকিয়ে দিচ্ছে (সূত্রঃ দা গার্ডিয়ান পত্রিকা, ১৩ই জুলাই, ২০০০)! এমন কি বিদেশীদের কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় পা রাখাকে (“…trampling on Kanhenjunga”) স্বয়ং প্রভু যীশুর মূর্তির উপরে ময়লা-ফেলার মতো (“…leaving rubbish on a statue of Jesus”) পাপকর্ম হিসেবে অভিহিত করে তার চূড়ান্ত বিরোধিতা করা হয়। সেই ২০০০ সাল থেকে সিকিম সরকারের আপত্তি মান্য করে ভারত সরকার সিকিমের পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন এই সেইদিন পর্যন্ত। প্রায় আঠেরো বছর পরে ২০১৯এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড ও সিকিম হিমালয়ের মোট ১৩৭টি শৃঙ্গে বিদেশীদের আরোহণের অনুমতি দেবেন বলে স্থির করেন, তালিকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ সিকিমের ২৪টি শৃঙ্গ ছিল। এবারেও সিকিম জুড়ে তীব্র আপত্তি ওঠে, এমনকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সিকিম শাখাও ভারত সরকারের এই পদক্ষেপে সিকিমের আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাসে ঘোর আঘাত লাগবে বলে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। হামরো সিকিম পার্টির কর্ণধার প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবল অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ে নিজে কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবী দিয়ে তদবির করেন। অচিরেই ভারত সরকার সিকিমের দাবী মেনে ওই ২৪টির মধ্যে ১৪টি শৃঙ্গকে সিকিমের দিক থেকে আরোহণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, প্রথম নামটি পবিত্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশান (IMF) এর গভর্নিং কাউন্সিলও সেই মতো বিদেশীদের ওই শৃঙ্গগুলি আরোহণের পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট তিক্ততা ও প্রতিবন্ধকতা থাকায় আধুনিক কালে সমস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান নেপালের দিক থেকেই হয়ে থাকে।

ধান ভানতে ঈষৎ শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো, কারণ ওদিকে সায়েবরা চতুর্থ ক্যাম্পে বসে রাজনন্দিনী কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরাজিত অহংকে জয় করবেনই করবেন বলে ছক কষছেন অনেকক্ষণ ধরে! এমনিতে মনে হচ্ছে, ‘অ্যাসল্ট’ প্ল্যানে কোনো ভুলচুক নেই, তবে একটি আননোন এলিমেন্ট থেকেই যাচ্ছে, দা ‘এক্স’-ফ্যাক্টর! আর সেটা হলো, স্বয়ং রাজনন্দিনীর মর্জি! তিনি নিজে কখন কোন নীহারমায়াজাল বিস্তার করবেন, কোন অবগুণ্ঠনে নিজেকে লুকিয়ে অভিযাত্রীদের পদে পদে ছড়িয়ে দেবেন হিমশীতল মৃত্যু, আগেভাগে তা জানা শিবেরও অসাধ্য যে!

ঠিক তাই হলো, পরের দিন সকালটা দারুণ ঝকঝকে ছিল, টেন্ট থেকে বেরিয়ে সেকেন্ডের জন্য মনের ভুলে জন জ্যাকসন তাঁর রোদচশমাটা খুলে ফেলতেই তিনি স্নো-ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত হলেন! মাল ফেরি করতে লোক কম পড়ে গেল! ওদিকে আবহাওয়া তার খামখেয়াল দেখানো শুরু করল, পাক্কা তিনদিন সকলে ওই চতুর্থ ক্যাম্পের বাইরে বেরোতেই পারলেন না! বুকে কাঁপন ধরানো সাঁ সাঁ শব্দে সমস্ত দিন রাত জুড়ে একশো-একশো বিশ কিমি বেগে বইল বরফ-বাতাস! শেষ আশ্রয় টেন্টগুলো আঁকড়ে বিনিদ্র কাটালেন সবাই— ব্লিজার্ডে মাথার উপরের ক্যানভাসের ছাউনিটুকু উড়ে গেলে আর দেখতে হবে না! চতুর্থদিন একটু পরিষ্কার দেখে বাইরে বেরিয়ে পঞ্চম ক্যাম্পে পৌঁছলেন তাঁরা; জ্যাকসন তখনো চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেন না, সুতীব্র যন্ত্রণায় কাতর তিনি, তাঁকে রেখে আসা হলো নীচের ক্যাম্পে! উপরে আবার আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ, হিমালয়ে বর্ষা কি এবার একটু আগেই চলে এল! ততদিনে অভিযাত্রীদের উদ্দীপনার ভাঁড়ারে টান পড়তে শুরু করেছে, দশদিন যাবৎ পঞ্চম ক্যাম্পের উপরে আর এগোতে পারা যায়নি! ‘অ্যাসল্ট’ চিন্তা শিকেয় তুলে তখন কি তাঁরা রাজনন্দিনীকে প্রার্থনা করে মনে মনে বলেছিলেন,— ‘চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি/ গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি’!

কে জানে! তবে শেষ পর্যন্ত দশ দিন পরে মানিনীর মানভঞ্জন হলো, ২৪শে মে পঞ্চম ক্যাম্পের আশ্রয় থেকে চার্লস ইভান্স পরিকল্পনামাফিক নীল মাথ্যর, জর্জ ব্যান্ড আর জো ব্রাউনকে নিয়ে এগোতে পারলেন ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত ক্যাম্প ফেলতে। প্রত্যেকের ঘাড়ে চল্লিশ পাউন্ডের বোঝা, সামনে যে খাড়া ৪৫° সঙ্কীর্ণ গিরিশিরা… ২৬,৯০০ ফিট (৮,২০০ মিটার) অবধি উঠে ওঁরা দেখলেন, ক্যাম্প পাতবার মত সামান্য সমতল কোনো জায়গা পাচ্ছেন না! অনন্যোপায় হয়ে বরফকুড়ুল দিয়ে দু’ ঘন্টা ধরে সেই খাড়া গিরিশিরার বরফ কেটে কেটে একটা সাড়ে চার ফুটের খাঁজের মত বানালেন তাঁরা, যার উপরেই পাঁচ ফুটের টু-মেন টেন্ট পাতা হলো! কাজ সেরেটেরে ব্যান্ড ও ব্রাউনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেরপাদের নিয়ে নীচে নেমে গেলেন ইভান্স আর মাথ্যর। ব্যান্ড আর ব্রাউন ঢুকে পড়লেন সেই চূড়ান্ত অপ্রশস্ত টেন্টে তাঁদের স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে— যে টেন্টের একাংশ শূন্যে ঝুলে আছে, ব্যান্ডের স্মৃতিচারণায়— ‘hung over the abyss below!”

জর্জ ব্যান্ড আর জো ব্রাউনের পরেও দেখা গেছে, ও সব যুদ্ধটুদ্ধ-অ্যাসল্টের জঙ্গিপনা নয়, নিখাদ প্রেম নিয়ে যাও তার দরবারে, নতজানু হয়ে বসো নীরবে ওর পায়ের কাছে, দু’চোখে জ্বালো প্রতীক্ষার দৃষ্টিপ্রদীপ— দেখা না দিয়ে সে পারবে না! কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে কি মানুষ নয়! নিঠুরা দেবীর হৃদয়ও যে প্রেমিকের প্রাণঢালা প্রেমে বিগলিত হয়! ২৫শে মে ভোরটা তাই ঝলমলে হয়ে এল, সকাল ৮টায় একেক জন পিঠে ২৪ পাউন্ড বোঝা, যার বেশিটাই অক্সিজেন সিলিন্ডার— নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বেরোলেন ব্যান্ড আর ব্রাউন। নীচ থেকে বাইনোকুলারে দেখে যতটুকু বোঝা গিয়েছিল, টানা ছয় ঘন্টা তার চেয়ে ঢের ঢের দুর্গম খাঁজ-খোঁজ বেয়ে, একবার ভুল পথে গিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়ে, বেলা দু’টোয় নিতান্ত বাধ্য হয়ে দু’জনে পরিস্থিতিটা মেপে নিতে সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রামে বসলেন, বিশ্রামের সঙ্গে কিছু মুখে দেওয়াও তো দরকার। পিঠের সিলিন্ডারে বাকি যেটুকু অক্সিজেন আছে তার হিসেব কষে বুঝলেন, বেলা তিনটের মধ্যে নীচের দিকে নামা শুরু না করতে পারলে ১২০০ ফুট নীচে সামিট ক্যাম্পের আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া যাবে না, অক্সিজেন শেষ হয়ে যাবে আর এই উচ্চতায় খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো মানে স্রেফ আত্মহত্যা। তাই, হাতে সময় আর মাত্র এক ঘন্টা! মুখ তুলে দেখেন উপরের পথ আটকে একটা বিশ ফুটের খাড়া পাথরের দেওয়াল! ওটা পার হতে পারলেও চুড়ো আর ঠিক কত দূর, এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না! তবে কি এবারেও স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, এবারেও স্বপ্নসুন্দরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘প্রকাশি’ কওয়া হবে না ‘কত ভালবাসি’?

সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মিনিট, কয়েকটি দুর্মূল্য মুহূর্ত ও ততোধিক দুর্মূল্য অক্সিজেন খরচ হলো। যা থাকে কপালে, শরীরে শেষ শক্তিটুকু অবশিষ্ট থাকতে চেষ্টায় কসুর করবেন না বলে ঠিক করে নেওয়ামাত্র ব্রাউন অমানুষিক কসরত করে সটান ওই দেওয়াল বেয়ে উঠে পড়লেন উপরে… ব্যান্ডও পত্রপাঠ তাঁকে অনুসরণ করলেন। উঠতে উঠতেই ব্যান্ড শুনতে পেলেন ব্রাউনের আবেগে গলা-বুজে-আসা চাপা চিৎকার— ‘জর্জ, উই আর দেয়ার!’ হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে কোনোক্রমে সেই দেওয়ালের উপরে উঠে এসে জর্জ ব্যান্ড দেখলেন, তাঁর দোস্ত ব্রাউন ততক্ষণে নতজানু… ক্লান্তিতে ? নাহ, ব্রাউনের হাত দু’টো যে জড়ো করা বুকের কাছে… সামনে ফুট বিশেকের প্রায় সমতল সরু চত্বরের শেষে পাঁচ ফুটের বরফের পিরামিড— কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষ! ওঁরা পৌঁছে গেছেন তাঁদের স্বপ্নসাধন চূড়ায়— ঘড়িতে তখন তিনটে বাজতে পনেরো মিনিট বাকি!

সিকিমিদের ভাবাবেগে আঘাত দেবেন না বলে ওখানেই থামলেন দু’জন। পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখলেন। অপার্থিব শব্দটা এখানেই বুঝি সুপ্রযুক্ত হয়— সত্যিকারের অপার্থিব দৃশ্যই তো চারিধারে! আশি মাইল পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে আর মাকালু; চারদিকে আরো সব সুউচ্চ শৃঙ্গদের দল! নীচে মেঘের সমুদ্র। যেন মনে হচ্ছে সাদা সমুদ্রের মধ্যে মাথা তুলে জেগে আছে পাথুরে ডুবোপাহাড়গুলো! এ হেন অপার্থিবতার সামনে আবার, আবার সেই ন্যুব্জ হয়ে পড়া; মস্তিষ্ক ঝিম ধরে আসে, অক্ষয়কুমারের ‘মধ্যাহ্নে’ কবিতার সেই ‘চেয়ে চেয়ে শুধু চেয়ে রয়েছি পড়িয়া’-র মতো!   

 

কিন্তু না, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন দু’জনেই, দ্রুত নীচে নামতে হবে এবার। আরোহণের চেয়ে সেটা আরো অনেক কঠিন কাজ, ওই সময়েই শ্রান্ত শিথিল অভিযাত্রীর পদস্খলনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি! নামতে নামতে অক্সিজেন ফুরিয়ে আসে, মাথার মধ্যে নেমে আসে বোধহীন শূন্যতা। ঝুরো বরফে হড়কে পা মচকে যায় জর্জের, পিছলে পড়ে যেতে যেতে কোনোক্রমে বরফে কুড়ুল গেঁথে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান তিনি। শেষ অবধি সেই অপরিসর সামিট ক্যাম্পে এসে পৌঁছলেন দু’জন, তখন রাত নেমেছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সামিট ক্যাম্পে এসে পৌঁছে গেছেন ব্যাক-আপ সামিট-টিম নর্ম্যান হার্ডি আর টনি স্ট্রেইদার। চারজনে মিলে সেই সাড়ে-চার-ফুটিয়া, খানিক শূন্যে-ঝুলে-থাকা টু-মেন টেন্টে রাত কাটালেন তাঁরা আর, সেলিব্রেশানে খুব করে লেমোনেড পান করলেন; ব্যান্ড লিখেছেন, এত তৃষ্ণা প্রাণে জমে ছিল!— “I don’t believe that I ever felt so thirsty in all my life!”

 
পরের দিন জর্জ ব্যান্ড আর জো ব্রাউন নীচে পাঁচ নম্বর ক্যাম্পের দিকে নেমে গেলেন আর হার্ডি ও স্ট্রেইদার চললেন শীর্ষের দিকে। আগের দিন জর্জদের শীর্ষগমনের পথ খুঁজতে অনেক সময় লেগেছিল, তুলনায় হার্ডিরা অনেক কম সময়ে সেই বিশ ফুটের দেওয়ালটাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে চুড়োয় চড়ে বসলেন। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা কি তার প্রাপ্য নেবে না? নেবেই, তাই স্ট্রেইদারের পিঠের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে হারিয়ে গেল বড় একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার! ফলে চুড়ো থেকে প্রায় ২৯০০ ফিট নীচের ক্যাম্প ফাইভে ফিরতে গোটা পথটাই স্ট্রেইদারকে চলতে হলো সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেন ছাড়া। বিকেলের দিকে ক্যাম্প ফাইভের বাইরে থেকে নেতা ইভান্স দেখেন দু’টি কালো বিন্দুর মতো বরফের শির বেয়ে নেমে আসছেন দু’জন; বাইনোকুলারে দেখেন স্ট্রেইদার যেন অসংলগ্ন, স্খলিত পদ, যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটবে!… আতঙ্কের মুহূর্ত গোনা শুরু… কিন্তু প্রবল শ্বাসকষ্টে কাতর হয়েও শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই নেমে এলেন হার্ডি আর স্ট্রেইদার, ক্যাম্প ভেসে গেল প্রবল উচ্ছ্বাসে!

এ কাহিনিটা এখানেই শেষ। বা, এখান থেকেই কাহিনি শুরু। ১৯৫৩র প্রথম শীর্ষজয়ের পর থেকে আজ অবধি মাউন্ট এভারেস্ট চড়ে ফেলেছেন ছয় হাজারের বেশি মানুষ, মাউন্ট এভারেস্টকে এখন ‘ট্যুরিস্ট পিক’ বলে ডাকেন দুনিয়ার পর্বতপ্রেমীরা। কিন্তু ১৯৫৫ এর ২৫শে মে-র পর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় আরোহণ করেছেন খুব বেশি হলে সাড়ে তিন শ’ জন। কে-টু বিজিত হয় এক বছর আগে ১৯৫৪এ, ওতে চড়েছেন ৩৭৭ জন! নিখাদ পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত, কেন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পর্বতারোহীরা চূড়ান্ত পরীক্ষা বলে ধার্য করে রেখেছেন প্রথম শীর্ষারোহণের দিনটি থেকেই।

মনে পড়ে অনেক নীচে পনেরো হাজার ফিটে ইয়েলুং হিমবাহের পাশে সেই বহু প্রাচীন শ্যাওলা-পড়া পাথুরে স্তূপটি। তার উপরে এলোমেলো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে সারি সারি মন্ত্রনিশান। ওই নিশানগুলোয় যেন লেখা আছে বহু মানুষের অসমাপ্ত প্রেমের কাব্য… নিষিদ্ধ অভিসারে গিয়েছিল তারা, কিন্তু প্রেমিকার কাছে পৌঁছাতে পারেনি, ঘরেও ফেরা হয়নি আর। আকাশের বুকে রাশি রাশি প্রেমপত্র উড়িয়ে দিয়ে তারা সবাই ঘুমিয়ে আছে পৃথিবীর সেরা শয্যায়!
এত ভালোবেসে কি পেলে সখা… কি পেলে ? শুধুই অন্তহীন শীত ?

পেশা - কলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনা, নেশা - হিমালয় আর থিয়েটার। বাংলায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা - না-থাকার মত, ইদানীং দু'চারটি পত্রপত্রিকায় অনিয়মিত কিছু লেখা ছাপা হয় বলে উত্তরোত্তর স্পর্ধা বাড়ছে। তবে সময়ের দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকায় উত্তরণ হ'বার নয়। একটা পাহাড়-জঙ্গল জায়গায় হলুদ পাতায় ছাওয়া বনে মরবার ইচ্ছে।

16 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Snehangshu Chakraborti , July 16, 2022 @ 11:12 am

    এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। টানটান উত্তেজনার সাথে স্বাদু বাচনভঙ্গি। হিমালয়ে পথচলার সাথে ভারতীয়দের বহুযুগের সখ্যতা। কিন্তু এই অভ্রংলিহ শীর্ষ জয়ের দুর্নিবার আকর্ষণ সায়েবদের হাত ধরেই এসেছে। শুধুই বিস্ময় নয় শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নতজানু হয়ে আসে সেই সব মানুষগুলোর অতিমানবিক সাহসের কাছে। তোর লেখায় যেন সে ইতিহাস চলমান ছবি হয়ে আঁকা হয়ে গেছে পাঠকের চোখে।

    ভাবতে ভয় হয় একশো বছর পর আর এই বরফ, হিমবাহ সব থাকবে কি না। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

    আমার মোবাইলের খামতি কি না বলতে পারব না। শেষের অংশটায় ছন্দা গায়েনের ছবি লেখার উপরেই রয়েছে, ফলে ওটুকু পড়তে পারি নি। ভালোই হয়েছে হয়তো, সে যে আরেক দুঃখের কাহিনী।

    • admin , July 16, 2022 @ 11:44 am

      অনেক ধন্যবাদ মন্ত্যব্যের জন্য। ছন্দা গায়েনের ছবির জায়গা পালটে ঠিক করে দেওয়া হল।

  • Shubh Brat Sarkar , July 16, 2022 @ 12:33 pm

    হিমালয়ন থিয়েটার! অসাধারণ লেখা, খুব ভালো লাগলো। 👌💯💐

  • শুভাংশু বসু , July 16, 2022 @ 1:13 pm

    একটানা পড়ে ফেল্লাম….স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গী….. প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা বিজয়ের ঐতিহাসিক দলিল বললে কি খুব বাড়িয়ে বলা হবে? জানি না….. বাংলায় গিরিশৃঙ্গঅভিযান ও বিজয়ের ওপর এমন সাবলীল লেখা পড়েছি বলে মনে পড়ছে না! ভীষণ ভাল লাগল 🙏

  • Amit , July 16, 2022 @ 2:01 pm

    রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেললাম তোর লেখাটা। অসাধারণ বললে কমই হবে, এমন যত্ন নিয়ে গবেষণা করে এত সুন্দর করে লিখেছিস, খুব ভালো লাগলো।
    সবচেয়ে বড় কথা হলো এমন তথ্যনিষ্ঠ লেখা এত সুন্দর বর্ণনাত্মক হতে পারে এটা লেখাটা না পড়লে বোঝা দুষ্কর হতো। পর্বতারোহণের গল্প তো আরো অনেক পড়েছি কিন্তু এ লেখা না পড়লে এই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। এটা একটা অনন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা।
    এখন এটা আমি তোর লেখার ফ্যান বলে, নাকি তোর লেখাটাই এত সুন্দর যে আমি ফ্যান হয়ে গেছি সেটাই ভাবছি।

  • Rupsa Roy Chowdhury , July 16, 2022 @ 3:41 pm

    টানটান উত্তেজনার সাথে পড়লাম , বিশেষ করে ফাইনাল শৃঙ্গজয়ের গল্পটা।
    আমি শরৎ দাস , কিন্তুপের তিব্বত অভিযানের ইতিহাস প্রথম জানতে পারি পরিমল ভট্টাচার্যের শাং গ্রীলার খোঁজে পড়ে। নাইন সিং বা মান সিং দের কথা এই প্রথম পড়লাম।কিন্তুপ আর শরৎ দাসের ফিরে আসবার পরের ঘটনা গুলো বড়ই বেদনাদায়ক।
    যদিও এখানে স্ট্রেইদার সাহেব ভালোয় ভালোয় ফিরে এলেন শেষ অবধি কিন্তু কত মানুষ ওখানেই থেকে গেলেন , হয়তো কিছুটা স্বেচ্ছায়। বিশ্ব উষ্ণায়নে বরফ গলে গেলে তাদের কারো কারো দেহ হয়তো খুঁজে পাবে তাদেরই মতো কোনো শৃঙ্গগামী পর্যটক!!

    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে।

  • Samarpita Sarker , July 17, 2022 @ 11:02 am

    অসাধারণ… রুদ্ধশ্বাস… অসমসাহসী… একখানি লেখা পড়লাম।সেই সাথে সংখ্যাটাকে সাড়ে তিনশ প্লাস এক করে ফেল্লুম মানসিক সংযোজনে!! তবে এর হার্ডকপি হওয়া উচিত।। আরও ছড়ানো দরকার লেখাটি।।

  • দেবাশিস , July 17, 2022 @ 11:32 am

    অলঙ্ঘনের প্রেত আগলাচ্ছে ওর শিশমহলের দরোজা, বরাঙ্গনার দেহের প্রতিটি আপাত-কমনীয় কন্দরেই ওঁত পেতে আছে হিমেল মৃত্যু..

    নিছক পরিসংখ্যান নয়, একটা বড় টাইম-স্কেলে পাহাড়িয়া বল্গাহীন তৃষ্ণাতুর প্রাণের আখ্যান হয়ে উঠেছে এ লেখা। তাই উপজীব্য তো বটেই, হিমানীসম্প্রপাতের মতোই ভয়ানক সুন্দর।

    শেষ প্যারাগ্রাফের পরের গ্রাফে, যেভাবে লেখার শেষে হারিয়ে যাওয়া ছন্দা গায়েন এসেছেন দু’চোখে না হারানো অসীম স্বপ্ন নিয়ে.. তাও তারিফযোগ্য।

  • Ritabrata Chattopadhyay , July 17, 2022 @ 2:15 pm

    স্বাদু গদ্য আর দরকারি তথ্যের জাদুকরী মিশেল। টানটান এবং সরস। আপনার লেখা বরাবরই আনন্দ দেয়, এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। আরও অনেক লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

  • Saurav Mazumder , July 17, 2022 @ 3:06 pm

    আহা! বিদগ্ধ ও প্রাঞ্জল লেখা। সংগ্রহে রেখে দেওয়ার মতো। লেখকের পাহাড়প্রেম তাঁকে দিয়ে এরকম গুরুত্বপূর্ণ আরো লেখা লিখিয়ে নিক, এটাই চাই।

  • সৌম্যকান্তি জানা , July 17, 2022 @ 5:06 pm

    বন্ধুপ্রেমে সামান্যতম অতিশয়োক্তি করছি না, বিভোর হয়ে পুরোটা পড়লাম। সামনে টিভিতে ভারত ইংল্যান্ড তিন নম্বর ওয়ান ডে চলছে, টান টান উত্তেজনা। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার মনোযোগ পুরোপুরি এই কাহিনিপাঠে। এমন সুন্দর , সুললিত ভাষায় তথ্যসমৃদ্ধ কিন্তু রোমাঞ্চকর লেখা শেষ কবে পড়েছি মনে করতে পারি না। স্যালুট ভাই। আরও এমন লেখা চাই।

  • mousumi Sengupta , July 18, 2022 @ 9:32 am

    POST

  • Ruchira Chakraborty , July 18, 2022 @ 7:41 pm

    কয়েকবার পড়লাম লেখাটা, তথ্যবহুল ও হৃদয়গ্রাহী।চোখের সামনে ভেসে উঠছিল পাকদণ্ডী পথ আর পাহাড়ি জঙ্গল। ভয়ংকর সুন্দরের ডাক, তার মাদকতা, আর মৃত্যুর হাতছানির যে অনায়াস সহবস্থান তোমার লেখনীতে ফুটেছে, তা অনবদ্য।

  • Debasree Bhattacharyya , July 19, 2022 @ 5:01 am

    স্বাদু বাংলায় লেখা টানটান থ্রিলার। রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেললাম। “অলঙ্ঘনের প্রেত আগালাচ্ছে ওর শিশমহলের দরজা…” ভাব-অনুবাদটাও অনবদ্য। লেখার সহজাত মুন্সিয়ানা, পাহাড়কে এক বুক ভালবাসা— এইগুলো ছাড়াও লেখাটাকে এমন তথ্য সমৃদ্ধ করে পরিবেশন করতে অনেক পরিশ্রমও আছে। সবমিলিয়ে এমন লেখাই নন-ফিকশনের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

    আর শেষটা যেখানে হ’ল যেইভাবে হ’ল ঠিক সেখান থেকেই যেন এর পরবর্তী লেখাটা পাওয়ার প্রত্যাশা তৈরী হয়ে থাকল।

  • Nilanjana Sen , August 9, 2022 @ 4:17 pm

    খুবই ভালো লাগলো।অপূর্ব… আমার কাছে আক্ষরিক অর্থেই.. কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে পৌঁছনোর এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস আগে পড়িনি।ধন্যবাদ। এভারেস্টের কথার অপেক্ষায় রইলাম।ছবিগুলোও মনে রাখার মত।

    • Pradipta Bhattacharya , August 10, 2022 @ 7:17 pm

      অনেক ধন্যবাদ৷
      মাউন্ট এভারেস্টের একটু অন্য রকমের কথা লিখেছি এবারের শারদীয় “অন্তরীপ” পত্রিকায়। শিগ্রিই প্রকাশিত হবে বলে জেনেছি।
      অবসরএ পরের সুযোগেও নিশ্চই লিখব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *