বাটেশ্বরের আশ্চর্য ইতিকথা
আগ্রা থেকে ছেচল্লিশ কিলোমিটার দূরে, মোরেনা শহরের উত্তরে, মধ্যপ্রদেশের এক আশ্চর্য মন্দির-শহর বাটেশ্বর। প্রাচীনকালে এর নাম ছিলো ধারণ বা পদাভলি। পঁচিশ একর জুড়ে দুশোটি মন্দিরের সমাহার! এক চত্ত্বরে এতোগুলি মন্দির আঙ্কোরভাট ছাড়া কোথাও নেই। মন্দিরগুলির কথা কালের গর্ভে বিলীন ছিলো বহু শতাব্দী।
বুন্দেলখন্ডের কুখ্যাত ডাকাত-অধ্যুষিত পূর্ব-চম্বলের এই অংশ রুক্ষ উঁচুনিচু পাহাড়, ঢিপি, দুর্গম জঙ্গল এবং গিরিখাতে পরিপূর্ণ। তার মধ্যেই পায়ে চলা পথ। প্রতিটি ধূলিকণায় পৌরাণিক যুগ থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাস। কথিত আছে আনুমানিক অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে গুর্জর-প্রতিহার রাজারা তৈরী করেন এই অসংখ্য মন্দির। ঐতিহাসিকদের একাংশের মতানুসারে এই রাজবংশ সরাসরি রামানুজ লক্ষ্মণের বংশজাত। রাম রাজা হওয়ার পর লক্ষ্মণ প্রতিহারী হিসাবে শয়নকক্ষের বাইরে পাহারা দিতেন বলে তাঁর বংশ প্রতিহার বংশ। রাজস্থান, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের একাংশ নিয়ে প্রাচীন গুর্জরদেশে বাস করতো প্রতিহারবংশ। অপর এক ঐতিহাসিক মতে গুর্জররা ছিলো আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। পরে তারাই শক্তিবলে এই অঞ্চল দখল করে রাজা হন।
শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের রাজ্য ছিলো এখানে। প্রাচীন শিলালিপিতে কিছু চিত্র পাওয়া যায় যেখানে বাসুদেবের বিয়ের মিছিল যাচ্ছে, অথবা দেবকী কারাগারে সদ্যোজাত পুত্রকে খাওয়াচ্ছেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সভায় আগত গ্রীক দূত মেগাস্থেনিস এই অঞ্চল দিয়ে গিয়েছেন সে কথা লিপিবদ্ধ আছে। জৈনরা বিশ্বাস করেন তীর্থংকর নেমিনাথও বাটেশ্বরেই জন্মগ্রহণ করেন।
বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিলো। ষোড়শ শতাব্দীতে সিকন্দর লোদি এবং শেরশাহ সুরি বাটেশ্বরে সৈন্য-ঘাঁটি তৈরী করেন। ভাদাওয়ারের রাজপুত রাজা বদন সিং, আকবরকে বাটেশ্বরে আমন্ত্রণ করেন। যমুনা পেরোনোর অসুবিধা দূর করতে, বাঁধ তৈরী করে যমুনাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। বাটেশ্বরে যমুনা হঠাত দিক পরিবর্তন করে বেঁকে গেছে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে এখানে বারংবার মারাঠা আক্রমণে মুঘলদের অধিকার বজায় রাখা মুশকিল হয়। দুর্বল দেশীয় রাজারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। কিংবদন্তী আছে, ১৬৪৬ সালে ভাদাওয়ার ও মণিপুরী বলে দুটি ছোট রাজ্যের মধ্যে অহরহ যুদ্ধ লেগে থাকতো। দুই রাণী সন্তানসম্ভবা হলে, যুদ্ধ-মীমাংসার জন্য রাজারা স্থির করেন, যার ছেলে হবে তিনি অন্যজনের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দেবেন। কিন্তু দুজনেরই মেয়ে হয়। ভাদাওয়ারের রাজা সে কথা লুকিয়ে বলেন যে তাঁর ছেলে হয়েছে। মেয়ে বড়ো হয়ে বাবার সম্মান বাঁচানোর জন্য শিবের তপস্যা শুরু করে। বিয়ের সময় হলে ভাদাওয়ারের রাজা মেয়েকে ছেলের বেশে পাঠান। মণিপুরী রাজ্যে প্রবেশের আগেই আত্মগ্লানিতে জলাশয়ে ঝাঁপ দেন রাজকন্যা। তখন জলাশয় থেকে শিবের আবির্ভাব হয় এবং শিবের বরে মেয়েটি ছেলের রূপ লাভ করে। বিবাহ হয়। আনন্দে দুই রাজা ভূতেশ্বর শিবের মন্দির তৈরী করেন। ভূতেশ্বর থেকেই জায়গাটির নাম হয় বাটেশ্বর। মন্দিরে স্থানীয় মানুষ পুত্রসন্তান মানত করে ভাঁড় ঝুলিয়ে রাখেন।
তেরোশো শতাব্দীতে এক সাঙ্ঘাতিক ভূমিকম্পে, মতভেদে মুসলিম আক্রমণে, দুশোটি গুর্জর-প্রতিহার মন্দির সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে সেই ধ্বংসাবশেষ কয়েক শতাব্দী পড়ে থাকে! ক্রমে জঙ্গল-অধ্যুষিত এই দুর্গম অঞ্চল ডাকাতদের আস্তানা হয়ে ওঠে।
১৮৭২ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার আলেকজান্দার কানিংহ্যামকে এই অঞ্চলে পাঠানো হয় ব্রিজ তৈরির কাজে। তিনি জঙ্গলের মধ্যে এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন এবং ১৮৮২ সালে তাঁর রিপোর্টে তা লেখেন। তারপরেও আঞ্চলিক দুর্গমতা ও ডাকাতদের ভয়ে কেউই মন্দিরগুলির পুনরুদ্ধারে আগ্রহী হননি।
আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিন্টেডিং ইঞ্জিনিয়ার কে কে মেহমুদ, ২০০৫ সালে মোরেনা অঞ্চলে পোস্টিং পান। বাটেশ্বরের কথা শুনে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্থানীয় মানুষজন তাঁকে বারণ করে ডাকাত অধ্যুষিত জঙ্গলে যেতে! ডাকাতি, অপহরণ ও পুলিশসহ বহু মানুষ খুন ছিলো সেখানে নিয়মিত ঘটনা। ডাকাতদের নেতা ছিলেন প্রথমে মান সিং এবং পরে কুখ্যাত নির্ভয় সিং গুর্জর, যার বিরুদ্ধে একশো-আশিটি খুন ও অপহরণের অভিযোগ ছিলো। মাথার দাম ছিলো আড়াই লাখ! কুখ্যাত ডাকাত সর্দারকে অন্যান্য ডাকাতদলও সমঝে চলতো। মেহমুদ কারো সাবধানবাণী না শুনে জঙ্গল ভেদ করে সেই অঞ্চলে গেলেন। মাইলের পর মাইল টিলার মধ্যেই দেখলেন বিশাল অঞ্চল জুড়ে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ! তিনি বুঝলেন, মন্দিরগুলি খাড়া না থাকলেও, মন্দিরের টুকরোগুলি সবই ছড়িয়ে রয়েছে! ডাকাতদের ভয়ে এক টুকরো জিনিসও সেখানে থেকে চুরি যায়নি! নইলে হয়তো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে শোভা পেতো মন্দিরের কারুকার্যসম্বলিত অংশগুলি! তিনি স্থানীয় মানুষের সাহায্যে ডাকাতদের খবর পাঠালেন যে তিনি তাদের সহযোগিতায় মন্দিরগুলিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে চান। অনেক অনুরোধের পর ডাকাতরা চার মাস সময় দেয় শুধু দিনেরবেলা কাজ করার জন্য।
মেহমুদজী মুসলমান হলেও হিন্দু শাস্ত্র, দেবদেবী, মন্ত্র ছিলো তাঁর নখদর্পণে। স্থাপত্যবিজ্ঞান ও বাস্তুশাস্ত্রের জ্ঞানও ছিলো। তিনি মন্দিরগুলির শিল্পশৈলী, গঠনকৌশল বিশ্লেষণ করে দেখলেন বেশীরভাগই শিবমন্দির। তবে বিষ্ণু ও শক্তিমন্দিরও আছে। মাঝখানে একটি হনুমান মন্দির। প্রকৃত প্রত্নতত্ত্ববিদের সঙ্গে প্রাচীন স্থান যেন কথা বলে, বুঝিয়ে দেয় বহু শতাব্দী পূর্বে কেমন ভাবে দাঁড়িয়েছিলো এই মন্দিরস্থান। সেভাবেই তিনি খুঁজে পান মন্দিরে প্রবেশের তোরণদ্বারের একটি ভিত্তিপ্রস্তর। তাঁর বিশেষজ্ঞের চোখ বলে দেয় যে কাছাকাছিই পড়ে আছে তোরণের বাকী টুকরোগুলি! মন্দিরচত্ত্বরে প্রবেশের দুটি অপূর্ব নক্সাখোদিত তোরণদ্বার খাড়া করেন প্রত্নতত্ত্ববিদের দল। ক্রমে ছোট ছোট মন্দিরগুলির ভগ্নাবশেষ জোড়া লাগাতে লাগলেন তাঁরা। মাথা তুলল একের পর এক অপূর্ব সুন্দর মন্দির। বেশীরভাগের “শিখর” আছে, আবার কতগুলি শুধুই মান্ডবিগয়া অর্থাৎ শিখরবিহীন। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে বিবিধ কারুকার্যসম্বলিত খোদাই! চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী থেকে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী মন্দিরসূত্র মেনে মন্দির তৈরী হতো। গুপ্তযুগের পূর্বে মন্দির তৈরীতে, মানসারা বা মায়ামদা সূত্র ব্যবহার হতো। এ ক্ষেত্রে মায়ামদা সূত্রের ব্যবহার হয়েছিলো। যে মন্দিরগুলি গুপ্ত যুগের পরে তৈরী সেখানে সমরাঙ্গনাসূত্র প্রয়োগ হয়। মন্দিরে দেবতার মূর্তিতে যদি জটা, চন্দ্রচূড়া বা চর্মবস্ত্র থাকে তবে সেগুলি শিবমন্দির, আর যদি দেবতার মূর্তি না পাওয়া যায়, তবে মন্দিরের সামনের ছোট নন্দীস্থান দেখে বা ত্রিশূল দেখে সেগুলি শিবমন্দির কিনা বুঝেছিলেন মেহমুদজী।
ডাকাতেরা চারমাস পরে এসে যখন দেখলো চার পাঁচটি অপূর্ব মন্দির ও তোরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। খুশী হয়ে, আরো কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলো। কোথাও বা মন্দিরের পাঁজর দিয়ে শিকড় নামিয়েছে বিশাল বটের ঝুড়ি, কোথাও মাটির নীচে খুঁড়ে পাওয়া গেলো প্রতি সারিতে ছটি থেকে আটটি করে মন্দির! বহু পরিশ্রমে গাছ কেটে নতুন করে লোহার শক্ত ভিত তৈরী করে, আঠা দিয়ে প্রতিটি অংশ লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো মন্দিরের পর মন্দির! ধ্বংসস্তুপ কিছুদিনের মধ্যেই অপূর্ব মন্দির-সমাহারের রূপ নিলো!
হঠাত এক জায়গায় চোখে পড়লো বিস্তৃত প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেলো সুদীর্ঘ সোপান! বোঝা গেলো একটি বিশাল মন্দির রয়েছে ভিতরে! অথচ, দেখতে যেন খানিকটা দুর্গের মতো! ক্রমে বোঝা গেলো দুর্গের মধ্যেই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।
কাজ চলাকালীন ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা! মন্দিরচত্ত্বরে একটি লোককে বিড়ি খেতে দেখেন মেহমুদজী। অত্যন্ত রেগে তাকে চলে যেতে বলেন। এমন সময় স্থানীয় মানুষ এসে তাঁর হাত ধরে বলে লোকটিকে কিছু বললে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে! সেই লোকটিই ডাকাতসর্দার নির্ভয় সিং গুর্জর! মেহমুদজী বুঝলেন তিনি কী ভুল করেছেন! ডাকাতসর্দারকে শান্ত করার জন্য বললেন, সর্দার না থাকলে মন্দিরের টুকরোগুলি কবেই চুরি হয়ে যেতো! মন্দিরগুলি গুর্জর-প্রতিহার রাজারা বানিয়েছিলেন আর সর্দারের পদবীও গুর্জর! সেই বংশের উত্তরপুরুষ হিসাবে মন্দির রক্ষার জন্য ভগবানই তাকে পাঠিয়েছেন! ডাকাতের মন নরম হলো। মেহমুদজী তাকে বলেন যে বিশাল মন্দিরটির পুনর্নির্মাণ করতে গেলে চান্দেরি থেকে মন্দিরের কাজ জানা কর্মী আনতে হবে যা ডাকাতদল থাকলে সম্ভব নয়। সর্দার যেন অন্য পাহাড়ে গিয়ে ডাকাতি করেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ডাকাতরা হনুমানজির মন্দিরে পুজো দিতো। অবশেষে ঠিক হলো সন্ধ্যা ছটার পর তারা হনুমানজির পুজো দিতে পারবে।
ক্রমে বিশাল মন্দিরটি গড়ে ওঠে। গায়ে অজস্র প্যানেলে অপূর্ব সব মূর্তি! তৈরী হয় গর্ভগৃহ ও বিশাল ছাদ। গর্ভগৃহে আবিষ্কৃত হয় শিব-দুর্গার বিবাহের যুগলরূপের কল্যাণসুন্দর মূর্তি!
কিছুদিন পরেই পুলিশের গুলিতে নির্ভয় গুর্জর মারা যান। ভেঙ্গে যায় ডাকাতের দল। তার নামে সেই মন্দিরটির নাম হয় নির্ভয় গুর্জর মন্দির! দুশোটির মধ্যে আশিটি মন্দির পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয় মাত্র তিন কোটি টাকায়!
গুর্জর-প্রতিহারদের সামন্ত রাজবংশ চান্দেলাদের তৈরী বিখ্যাত খাজুরাহো মন্দিরগুলি পরবর্তীকালে একই ডিজাইনে করা হয়।
ডাকাতের ভয় চলে যাওয়ায়, বেআইনি খনি-মাফিয়ারা রাতের অন্ধকারে মন্দিরচত্ত্বরের বাইরে খনন শুরু করে। কম্পনে খসে পড়তে থাকে পাথর! মেহমুদজী সরকারী সাহায্যের জন্য চিঠি লিখেও প্রার্থিত সাড়া পান না। অবশেষে আর এস এসের সাহায্যে খনি-মাফিয়াদের অত্যাচার বন্ধ হয়। আজ এই অঞ্চলটি ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট। মেহমুদজির চেষ্টায় স্থানটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আগ্রা থেকে বাটেশ্বর রাস্তা নির্মাণ হয়। বাকী একশো কুড়িটি মন্দিরের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। বাটেশ্বরের মন্দির-সমাহার দেখতে গোয়ালিয়র বা আগ্রা থেকে আসছেন বিদেশী পর্যটকেরা। অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য কে কে মেহমুদ সার্ক পুরস্কার ও পদ্মশ্রী পান।
তথ্যঋণঃ
talesoftravel.in : Untold story of Bateshwar group of temples
Outlook india: A temple run
culturalsamvaad.com : Batwswar temples : chambal’s lost and found heritage
The Hindu : The legend of Bateshwar, The temple guardian
atlasobscura.com : Bateshwar temple complex
India Today: Uttarpradesh gets rid of dreaded Chambal dacoit Nirbhay Gujjar
2 Comments