‘যত’ শুনিয়েছিলেম গান

'যত' শুনিয়েছিলেম গান

গায়ক বন্ধুর সঙ্গে গান নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। তারপর আমাদের যা হয়, ঘুরেফিরে দেখি সেই “আমড়াতলার মোড়ে”, অর্থাত্‍‌ রবীন্দ্রসঙ্গীতে পৌঁছে গেছি।
“ব্যান্ড-পপের যুগেও সর্বসাকুল্যে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডিই আবার বেস্ট সেলার!”
“রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘জগত্‍‌ কবিসভায়’ গর্ব করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন ‘বাঙালি আজ গানের রাজা, বাঙালি নয় খর্ব!’ একশো বছরের ওপর হয়ে গেলো, সে সনদ আজও বহাল।”
“সৌভাগ্যের কথা বাংলাদেশীরাও এসেছেন সে রাজত্বে।”
“গানে গানে সে রাজত্ব ছয়লাপ। এই দেখো না, ‘গান’ শব্দ পাচ্ছি চারশো অষ্টাশিটা গানে, ‘গীত’ যোগ করলে আরো একশো আঠাশটা।”
“এই মরেছে, এই ‘বর্ষামুখর রাতে’ এ কী আরম্ভ করলে?”
‘”আরে দাঁড়াও, এই তো কলির সন্ধ্যে। এখনো তো ‘তান’, ‘লয়’, ‘সুর’ …”
“থামো, থামো। শোনো, গান শোনো– ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’।”

“যত গান”! কতো গান? কতো গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ?
বেশীর ভাগ মানুষের পক্ষে “অনেক”জানলেই যথেষ্ট। কিন্তু আজকের Slumdog Millionaire বা “কৌন বনেগা ক্রোড়পতি”-র যুগে আপনারা কখনো কোনো গেম-শোতে এই প্রশ্নে হঠাত্‍‌ যদি ফেঁসে যান, সেই ভেবে এ নিয়ে একটু গবেষণা করলাম। সেই গবেষণা থেকে খারাপ খবর যা পাচ্ছি তা হোলো এই যে এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর বলে তেমন কিছু নেই যেটাকে সঠিক উত্তর বলা যায়। তর্কচুঞ্চুরা বলবেন, খারাপ কী হে, এ তো ভালো খবর, তাই যদি হয় তাহলে প্রশ্নকর্তারাই বা কোন্‌ সাহসে প্রতিযোগিতায় এই প্রশ্ন তুলবেন? তার্কিকদের কথায় কান দেবেন না, পড়ে দেখুন, কিছু না হোক মজা পাবেন। “কৌন বনেগা ক্রোড়পতি”-র অন্য সম্ভাব্য কিছু প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যেতে পারেন।
তিনটি নিঃসন্দেহে প্রামাণিক আর একটি সাম্প্রতিক নির্ভরযোগ্য উত্‍‌স থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে রবীন্দ্র-রচিত গানের সংখ্যার হিসেব করা হোলো। রবীন্দ্রকৃতির ক্ষেত্রে ঠিক গান বলতে কী বোঝায় তা একটু জটিল, রচনার দ্বিতীয়াংশে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অব্যবহিত নীচে যে তালিকাটি আছে সেখানে চারটি উত্‍‌সের ক্ষেত্রেই গানের সংজ্ঞার যতোটা সম্ভব সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে।

(ক) “গীতবিতান”ও তত্‍‌সংশ্লিষ্ট সূত্রাদি –-২১৫০
(খ) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রণীত “গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী”– ২১৭৮
(গ) বিশ্বভারতী প্রকাশিত স্বরবিতান (১-৬৫) ও তত্‍‌সংশ্লিষ্ট সূত্রাদি
(১) প্রথম রীতি –– ২০৯১
(২) দ্বিতীয় রীতি — ২২৩২
(ঘ) সুভাষ চৌধুরী প্রণীত “গীতবিতানের জগত্‍‌ — ১৯১৫

 

স্বরবিতান যেখানে তথ্যের উত্‍‌স সে ক্ষেত্রে (তালিকার গ) দুভাবে গান গণনা করা হয়েছে: (১) প্রথম ছত্রের বর্ণানুক্রমিক সূচীপত্র থেকে আর (২) স্বরলিপির অভ্যন্তরের বিভাজন থেকে। এই দুই রীতির পিছনে যে কারণ, ওপরের পাঁচটি সংখ্যার মধ্যে ব্যবধানের মুখ্য কারণও তাই। ভিত্তিতে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ওপরের তিনটি রীতি থেকে বেশ কাছাকাছি সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, এটা আশ্চর্যের কথা। এ নিছক সমাপতন বলে আমাদের বিশ্বাস।

অখণ্ড গীতবিতানের (১৩৮০ সংস্করণ) “প্রথম ছত্রের সূচী”-তে গান তিনভাবে দেখা দিতে পারে। প্রথম, সরাসরি একটি গানের প্রথম ছত্র আর তার পৃষ্ঠাঙ্ক। দ্বিতীয়, একটি গানের প্রথম ছত্র, বন্ধনীর মধ্যে একটু পরিবর্তিত অন্য একটি প্রথম ছত্র আর একটিই পৃষ্ঠাঙ্ক। আর তৃতীয়, সরাসরি একটি গানের প্রথম ছত্র, কিন্তু একাধিক পৃষ্ঠাঙ্ক। প্রথমটি বোঝা সহজ কিন্তু বাকী দুটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

 

কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে যার প্রথম লাইনে সামান্য পাঠভেদ দেখা যায়, যেমন “আলোকের এই ঝর্ণাধারায়” আর “আজ আলোকের এই ঝর্ণাধারায়”। গানটির দুই নামই প্রচলিত। যেহেতু বর্ণানুক্রমিক সূচীতে পাঠক দুটি নামের যে কোনটি নিয়ে খুঁজতে পারেন, সে কারণে সূচীতে গানটি দুবার দেখানো হয়েছে, যদিও তাদের পৃষ্ঠাঙ্কও এক আর গানও এক। কিছু কিছু গানের তো তিনটি নাম দেখা যায়, যথা, “আমার মন, যখন”, “ও আমার মন যখন”আর “ওরে মন যখন”গানটি। প্রায় সব ক্ষেত্রে গীতবিতানের দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পাদনা করার কালে কবি নিজেই এই পরিবর্তন করেছিলেন। গানের আগের নামটি ততোদিনে সাধারণ্যে চালু হয়ে গেছে কাজেই তা আর মুছে ফেলা যায়নি। সূচী থেকে পাওয়া তালিকায় এই রকম দ্বিত্ব-গানের সংখ্যা ১০২।
তৃতীয় শ্রেণীর গানগুলির হিসেব একটু গোলমেলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন নাটক বা রচনায় একই গান বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন। গীতবিতানে সেসব গান উপস্থিত হয়েছে নানা ভাবে। “কালমৃগয়া”আর “বাল্মীকিপ্রতিভা”, “শ্যামা”আর “পরিশোধ”(“পরিশিষ্ট”-র অন্তর্ভূত), “মায়ার খেলা”আর “নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা”(“পরিশিষ্ট”-র অন্তর্ভূত)– এদের জোড়ায় জোড়ায় বহু গান পুনর্ব্যবহৃত। কিছু নাটকের গান আবার “পূজা”, “প্রেম”ইত্যাদি পর্যায়েও রাখা আছে। “প্রথম ছত্রের সূচী”-তে এই শ্রেণীর সব গানের পৃষ্ঠাঙ্কেকাধিক , প্রতিটি পৃষ্ঠায় গানটি মুদ্রিত– প্রথম লাইন এক কিন্তু গানের বাকী অংশ এক হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যথা “অলি বার বার ফিরে যায়”গানটি সূচীতে উঠেছে একবারই, কিন্তু তার পৃষ্ঠাঙ্ক দেখানো হয়েছে ৩৯৭।৬৭৪।৯২৯– যথাক্রমে প্রেম, মায়ার খেলা ও নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা পর্যায়ে। এরকম পৃষ্ঠাঙ্কের উপস্থিতি সর্বসাকুল্যে ২৬৬ বার।

এই সব একই নামধারী একাধিক পৃষ্ঠাঙ্কের গান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে সাধারণত তাদের বিন্যাসে, অর্থাত্‍‌ লাইন ভাগ বা শব্দের মধ্যেকার ফাঁক ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য আছে, নাটকের গান হলে তা গাইছে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু গানের স্বরলিপি হুবহু এক। এসব গানকে নির্দ্বিধায় দ্বিত্ব বলে মেনে নেওয়া যায়। মুস্কিল হয় যখন কোনো জোড়া গানে পাঠভেদ দেখা যায়, সে পার্থক্য একটি-দুটি শব্দের তুচ্ছ তফাত্‍‌ থেকে স্তবককে স্তবক পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এখন ঠিক কতোটা পার্থক্য থাকলে গানের নাম এক হলেও তাদের আলাদা করে ধরতে হবে, তার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো নির্দেশ নেই। আমরা সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে দেখছি যে ওই ২৬৬-টি উপস্থিতি থেকে আমরা ১৩৪-টি আলাদা গান সনাক্ত করতে পারি। এখানে বলে রাখা উচিত যে রবীন্দ্রনাথের বহু গানে একাধিক পাঠান্তর আছে, তার খতিয়ান পাওয়া যায় স্বরবিতানের খণ্ডে খণ্ডে। সেগুলিকে একই গানের বিবর্তন বলে ধরে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। উদাহরণ: “অলি বারবার ফিরে যায়” গানটির তিনটি পৃষ্ঠাঙ্ক কিন্তু স্বতন্ত্র গান বলতে একটি। এদিকে আবার “আঃ বেঁচেছি এখন” গানের দুটি পৃষ্ঠাঙ্কে যে দুটি গান মুদ্রিত তাদের মধ্যে তফাত্‍‌ এতো যে তাদের দুটি গান বলতেই হয়।
আমরা যদি গীতবিতানের “প্রথম ছত্রের সূচী”থেকে প্রতিটি পৃষ্ঠাঙ্ক গুনি তাহলে তার সংখ্যা ২৩৮৪। তারপর সহজ গণিত:

রবীন্দ্রনাথ-রচিত গানের সংখ্যা = (সূচীর সমগ্র পৃষ্ঠাঙ্ক সংখ্যা – ভিন্ন নামের দ্বিত্ব-গানের সংখ্যা – এক নামে একাধিক পৃষ্ঠাঙ্ক বিশিষ্ট গানের উপস্থিতি সংখ্যা + এক নামে একাধিক পৃষ্ঠাঙ্ক বিশিষ্ট গানের মধ্যে আলাদা বলে ধরা যায় এমন গানের সংখ্যা)

= (২৩৮৪ – ১০২ -২৬৬ + ১৩৪) = ২১৫০

প্রসঙ্গত, একই বাণীতে কবি দুটি সুর দিয়েছেন এমন চল্লিশটি গান পাওয়া গেছে। এদের কি ভিন্ন গান বলে ধরা হবে? আমরা তা ধরিনি।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে একমত হবার পথে যে বিরাট বাধা সেটি তাঁর গীতি বা নৃত্যনাট্যের গানগুলিকে ঘিরে। এদের মধ্যে কোনটি গান আর তার বাণীর বিস্তার কতোটা, আর কোনটিই বা সুরাশ্রিত সংলাপ এ নিয়ে বিশারদরা একমত হতে পারেন না। এরকম কিছু গান পাওয়া যাচ্ছে গীতবিতান তৃতীয় খণ্ডে। রবীন্দ্রনাথ সে বই তৈরির ব্যাপারে জড়িত ছিলেন না, কাজেই সমস্যাপূরণের জন্য তাঁর কাছে যাওয়া যাবে না। একটা উদাহরণ দিলেই সমস্যাটি বোঝা যাবে। নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার একটি দৃশ্যে প্রকৃতি আর তার মায়ের পরপর কথোপকথন:

(১) প্রকৃতি। ফুল বলে, ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির প’রে। … (১০ লাইন)
(২) মা। তুই অবাক ক’রে দিলি আমায় মেয়ে। … (৩ লাইন)
(৩) প্রকৃতি। হাঁ মা, আমি বসেছি তপের আসনে। (১ লাইন)
(৪) মা। তোর সাধনা কাহার জন্যে। (১ লাইন)
(৫) প্রকৃতি। যে আমারে দিয়েছে ডাক, দিয়েছে ডাক, … (৮ লাইন)
(৬) মা। কিসের ডাক তোর কিসের ডাক। … (৪ লাইন)
(৭) প্রকৃতি। আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে– …(২ লাইন)
(৮) মা। পোড়া কপাল আমার! … (৩ লাইন)
(৯) প্রকৃতি। হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব’লে গেলেন তিনি, … (১৭ লাইন)

চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যে সব সংলাপ সুরে বাঁধা, তাহলে এই ন’টি অংশে কটি আলাদা আলাদা গান আছে বলে ধরা হবে? রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে তিনটি নির্ভরযোগ্য সূত্র কী বলে?
প্রথম অবশ্যই গীতবিতানের সূচী। সেখানে ওপরের ১, ২, ৫, ৬ ও ৯-সংখ্যক নাট্যাংশকে সূচীতে পরিষ্কার গান বলে দেখানো হয়েছে, বাকীগুলি সূচীতে অনুপস্থিত। অবশ্য এটা বলা যেতে পারে যে ২ হোলো ২+৩+৪ আর ৬ হোলো ৬+৭+৮ তবে যুক্তি হিসেবে তা দুর্বল। গীতবিতানের সূচীর সঙ্গে মেলালে চণ্ডালিকার গান সংখ্যা ৫৩।

১৩৪৫ সালের চৈত্র মাসে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার পাঠ ও স্বরলিপির প্রথম প্রকাশ। স্বরবিতানের ১৮ নং খণ্ডটি তার সঙ্গে অভিন্ন, রবীন্দ্র-অনুমোদিত বলে ধরে নেওয়া যায়। আশ্চর্যের কথা যে এই বইয়ের সূচীতে গান বলে কেবল ওপরের তালিকার ১ ও ৫ নং অংশের উল্লেখ আছে। এদিকে স্বরলিপি অংশে ১-৯ নং প্রতিটি অংশ সংলগ্ন কিন্তু স্বতন্ত্র শীর্ষনামে দেখানো হয়েছে। স্বরবিতান ১৮-র পুরো সূচীতে মাত্র ২৩টি গান আর স্বরলিপি অংশে পাওয়া যাচ্ছে ৮২টি গান আর সংলাপ অংশ।

রবীন্দ্র-জীবনীকার বলে খ্যাত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত বই, “গীতবিতান: কালানুক্রমিক সূচী” আজ প্রায় প্রবাদোপম। যত্নকৃত গবেষণালব্ধ তথ্যসমৃদ্ধ এই বই ১৩৭৬ সালে প্রথম প্রকাশ, প্রভাতকুমারের মৃত্যুর পর সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৯৭ সালে। এ বইতে রবীন্দ্রনাথ-রচিত গানের তালিকা বিশদ তথ্যসহ প্রভাতকুমার কালক্রমে সাজিয়েছেন। আমাদের এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মন্তব্য: প্রথম, প্রভাতকুমার তাঁর তালিকায় যে কোনো গানের ও তার পাঠান্তর যদি থাকে তাদের জন্য কেবল একটিই ক্রমিক সংখ্যা ধার্য করেছেন। দ্বিতীয়, নাটকের গানে প্রভাতকুমার ছোটো ছোটো সংলাপের টুকরোকেও স্বতন্ত্র গানের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন ওপরের চণ্ডালিকার উদাহরণ থেকে তিনি ১-৯ সব অংশকেই গান বলে ধরেছেন, অনেকটা স্বরবিতানের স্বরলিপি অংশে যেমন দেখা যাচ্ছে তার মতো। তাঁর তালিকা মতে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার গান আর সংলাপের সংখ্যা ১২৪।

প্রভাতকুমারের রীতি মেনে নিলে সমস্ত গানের সংখ্যা ২১৭৮ (অন্তিম সংখ্যা ২১৭৫ আর তিনটি সংযোজন)।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রামাণ্য স্বরলিপিবাহী ছেষট্টি খণ্ডের স্বরবিতান গ্রন্থমালা রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চায় অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকতে গোড়ায় নানা নামে ষোলোটা স্বরলিপির বই প্রকাশিত হয়– কেতকী, গীতলিপি ইত্যাদি। তারপর ১৩৪২ সাল থেকে শুরু করে স্বরবিতানের প্রকাশ, এদের চারটি রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বরবিতানের কয়েকটি খণ্ডে তো পূর্বপ্রকাশিত স্বরলিপি-গ্রন্থই নতুন নাম আর অলঙ্করণে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্বরবিতান গ্রন্থমালা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা স্থির করার আগে কয়েকটা কথা জানা থাকা দরকার। স্বরবিতানের বিভিন্ন খণ্ড বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকে সম্পাদনা করেছেন তাই শৈলীতে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। প্রথম তো ওই গান আর সুরবদ্ধ সংলাপের মধ্যে বেছে নেওয়ার ব্যাপার। সোজা কথায়, স্বরবিতানে শৃঙ্খলার সঙ্গে তেমন কোনো নিয়ম ব্যবহার করা হয়নি। ফলে এই গ্রন্থমালার একই খণ্ডে কিছু গান যাদের নিশ্চিত গান বলা উচিত তারা সূচীতে ওঠেনি, এদিকে কিছু ছোটো সংলাপ উঠে গেছে। এ ছাড়া সম্পাদন-প্রমাদ আছে, যথা গীতবিতান সূচীর মতো ভিন্ন নামের গান একই সূচীতে একাধিক স্থান পেয়েছে (সবসময় নয় কিন্তু)। কিছু গান অপরিবর্তিতভাবে একাধিক খণ্ডে যুক্ত করা হয়েছে। একটা রক্ষা যে স্বরবিতানে যদিও সুরান্তরিত কিছু গানের স্বরলিপি আছে কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র নাম দেওয়া হয়নি।
স্বরবিতানের ১-৬৫ খণ্ডের সামগ্রিক সূচীতে উল্লিখিত গানের সংখ্যা যোগ করলে আমরা পাই ১৯৪৯টি গান। আর যদি স্বরলিপির অভ্যন্তরে গিয়ে গান আর সুরবদ্ধ সংলাপ গণনা করি তাহলে সেই সংখ্যা ২০৯০। এর থেকে আমাদের বাদ দিতে হবে: রবীন্দ্রনাথের সুর কিন্তু অন্যের রচিত গান, ভিন্ন নামের অভিন্ন গান আর একাধিক খণ্ডে একই স্বরলিপি মুদ্রিত হয়েছে এমন সব গান — এদের মোট সংখ্যা ৬১। তাহলে স্বরবিতানে যে সব আলাদা গান বা গান ও সংলাপের স্বরলিপি আছে তাদের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ১৮৮৮ ও ২০২৯। তারপর যেসব গানের স্বরলিপি নেই, বা থাকলেও এখনো স্বরবিতান গ্রন্থমালায় প্রকাশিত হয়নি, গীতবিতানের সূত্র ধরে দেখলে সেই সব গানের সংখ্যা ২০৩। তা যোগ দিলে স্বরবিতান মাফিক স্বতন্ত্র গানের সংখ্যা ২০৯১ আর গান ও সুরবদ্ধ সংলাপের সংখ্যা ২২৩২।
সুভাষ চৌধুরী তাঁর “গীতবিতানের জগত্‍‌” গ্রন্থে “গান”-এর সংজ্ঞা নিয়ে এই যে সমস্যা যার জন্য সুরবদ্ধ সংলাপ গান হিসেবে গণ্য হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়, তার এক সমাধান বিবৃত করেছেন। তিনি গোড়াতেই ধরে নিচ্ছেন যে গান বলে গণ্য হতে গেলে “গানে স্থায়ীর সঙ্গে একটি অন্তরা থাকতে হবে এবং স্বতন্ত্র গান হিসেবে তা গীত হবার যোগ্য হতে হবে।”এই সংজ্ঞার ফলে স্বর-১২ (তাসের দেশ), স্বর-১৭ (চিত্রাঙ্গদা), স্বর-১৮ (চণ্ডালিকা), স্বর-১৯ (শ্যামা), স্বর-২৯ (কালমৃগয়া), স্বর-৪৯ (বাল্মীকি প্রতিভা) থেকে স্বতন্ত্র বলে গণ্য হবার গানের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সুভাষ চৌধুরী তাঁর বইতে এই সব স্বরবিতানের গান বা সংলাপ ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন। উদাহরণ: চণ্ডালিকার ৮২টি গান আর সুরবদ্ধ সংলাপের অংশ থেকে তাঁর সংজ্ঞা অনুসারে তিনি মাত্র আটটি স্বতন্ত্র গান পেয়েছেন। এই রীতি অনুসরণ করলে সমগ্র স্বরবিতান (১-৬৪ খণ্ড) থেকে স্বতন্ত্র গান বলে গণ্য হতে পারে ১৭১২টি। এর সঙ্গে স্বরবিতানে স্বরলিপি নেই এমন ২০৩টি গান যোগ দিলে যোগফল দাঁড়াচ্ছে ১৯১৫।
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে অন্যের রচিত কিছু গানে সুরসংযোগ করেছিলেন: সংস্কৃত মন্ত্র — ৬, পালি স্তোত্র – ১৩, বৈষ্ণব পদাবলী – ২, সংস্কৃত জাতীয় সঙ্গীত – ১, বাংলা গান – ৪, সর্বসমেত ২৬টি। তাঁর রচিত সঙ্গীতের তালিকায় এদের ধরতে গেলে তাঁর কিছু গানে যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সুর দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে তা ঠিক বা কতোটা ঠিক, সেই তর্কে জড়িত হবার আশঙ্কা আছে। তা এড়াবার জন্য আমরা এদিকে কেবল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ক্ষান্ত দিলাম।
গোড়ায় দেওয়া তালিকার এই হোলো ভেতরের কথা। তা সমুদ্রের জল ঘটি দিয়ে মাপতে গেলে দুচার ঘটি এদিক ওদিক হবেই, তাই “সে তর্কে কাজ নাই”। তার চেয়ে নুনের পুতুল হয়ে ঘটি হাতে সাগরে যেতে অনেক বেশী মজা, “ভালো আমার লেগেছে যে রইলো সেই কথাই”। হোক না সে শেষ কথা!
এদিকে আবার আজকের টিভি সভ্যতায় গেম-শোতে হেরে গেলে অনেক টাকা লস। হায় ঈশ্বর!

 

উৎস:

১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অখণ্ড গীতবিতান, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৩৮০
২) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী, টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট, পৌষ ১৪১০
৩) সুভাষ চৌধুরী, গীতবিতানের জগৎ, প্যাপিরাস, আশ্বিন ১৪১১

আমাদের সুমিতদা বা সুমিতবাবু
প্রয়াত সুমিত রায় (12/10/1940-5/26/2021) ছিলেন পাঁচ দশক আমেরিকাবাসী। চাকরিজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী। www.gitabitan.net - রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। মার্কিন মুলুক থেকে প্রকাশিত "অবসর" ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত, তার মধ্যে কিছু লেখালেখিও আছে। "পোনুসংহিতা" একটি প্রকাশিত রচনা-সঙ্কলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *