আমাদের দখলনামা

আমাদের দখলনামা

সেপ্টেম্বর ১৪ তারিখে রাত দখলের ডাক

১০ই অগাস্ট ২০২৪ তারিখে যে লেখা এক ওয়েবজিন-এ লিখেছিলাম তা ছিল তাড়াহুড়োর প্রসব (লেখাটি পড়তে আগের শব্দবন্ধে ক্লিক করুন)। তা বলে প্রসবযন্ত্রণা কম ছিল না৷ অনেক যন্ত্রণা আর ক্ষোভ থেকে সে লেখা বেরিয়েছিল। ৯ই অগাস্ট আর. জি. কর হাসপাতালে কর্তব্যরত এক ডাক্তার মেয়ে ধর্ষিত হয়, খুন হয়। সে খবর ন’তারিখ ভোর-রাত থেকে প্রচার হতে থাকে কানাঘুষোয় সরকারি হাসপাতাল পরিমণ্ডলে। ন’তারিখ সকালে অন্য মেডিকাল কলেজ থেকে আর. জি. করে ছাত্রী ও ছাত্ররা ছুটে যায়। টের পায়, কিছু একটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ন’তারিখ বিকেল নাগাদ খবরটি গণমাধ্যমে আসে। নানা ওয়েব পোর্টাল খবর পেশ করে। কেঁপে যাই৷ ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটি শেষে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিল মেয়েটি! দশ তারিখ খবরের কাগজ খবর প্রকাশ করে। দশ তারিখেই শুনতে পাই, বিকেলে নানা জায়গা থেকে মিছিল রওনা দেবে আর. জি. করের উদ্দেশ্যে৷ স্থির করি, যাব।

আমি কাজ করি কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়মন্ড হারবারে। ১০ তারিখ ছিল শনিবার। হাফ ছুটি৷ দীর্ঘ ট্রেনপথ। দু’ঘণ্টা লাগবে শিয়ালদহ পৌঁছতে। সেখান থেকে আমাকে বাস বা ভাড়ার গাড়ি নিতে হবে আরজিকরের উদ্দেশ্যে৷ ট্রেনে ওঠার আগে, প্রথম বাক্যে উল্লিখিত ওয়েবজিনের অন্যতম সম্পাদকের ফোন পাই। লেখা চাইছিলেন এই বিষয়ে। বুঝে যাই, শিয়ালদা পর্যন্তই সময় আছে হাতে। দু’ঘণ্টা। তারপর প্রতিবাদ মিছিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। অতএব, যা মনে ছিল, তাই লিখে ফেললাম। উক্ত সম্পাদক, যিনি ঘটনাচক্রে নারী, আমাকে আর. জি. কর-এর পড়ুয়াদের হাতে ধরা রাগী পোস্টার দেখিয়েছিলেন৷ পোস্টারে লেখা ছিল: ‘প্রিন্সিপাল বলেছে, মেয়েটি রাতে একা ছিল কেন? নির্লজ্জ প্রিন্সিপাল।’ এই পোস্টার ‘আসুন রাতের দখল নিই’ শিরোনামের একটি লেখার জন্ম দেয়। লেখাটি জমা করে আমি শিয়ালদায় নেমে উবার মোটো চড়ি। রঁলা বার্থস বলেছিলেন লেখার রাশ লিখিত হওয়ার পর আর লেখকের হাতে থাকে না। এক্ষেত্রে সে কথাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মিলে যেতে দেখলাম কীভাবে, তা পরে লিখছি।

আপাতত আর. জি. করে পৌঁছে দেখি, পুলিস ও জনতার সংঘাত চলছে। পুলিসের পক্ষে ‘আর. জি. করের ছাত্র’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া কিছু লোকও দাঁড়িয়েছে। তারা কেউ কেউ অবশ্যই আর. জি. করের ছাত্র, কিন্তু তারা একই সঙ্গে শাসকদের পোষিত ছাত্রদলটির নেতা। দেখা গেল, পুলিসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, তারা যে কোনো মূল্যে সাধারণ মানুষের তো বটেই, অন্য ডাক্তারি কলেজের ছাত্র ও অধ্যাপকদেরও আর. জি. করে প্রবেশ আটকাবেই। ধর্ষণের দায়ে ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ও গ্রেফতার হয়েছে এক সিভিক ভলান্টিয়ার। ওরকম চুনোপুঁটিকে বাঁচাতে যে এত পুলিসি ও সরকারি তৎপরতা থাকতে পারে না, তা বুঝতে পারছিল সকলেই৷ খুব বড় কিছু চেপে যাওয়া হচ্ছে এবং ভিক্টিম ব্লেমিং সে কারণেই ব্যবহার করা হচ্ছে, এইটুকু বোঝাপড়া নিয়ে অসহায় ভাবে বাড়ি ফিরি৷ বাড়ি ফিরি এই বোধ নিয়েও যে আন্দোলনকে একটা বিরাট, রাক্ষুসে চেহারা না দিলে এই অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া আমরা আটকাতে পারব না৷ বাড়ি ফিরে দেখি, সম্পাদিকা প্রকাশিত লেখার লিংক পাঠিয়েছেন৷ ফেসবুকে সেটি শেয়ার করে দিই৷ তারপর অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

১১ তারিখ সকালে উঠে ইনবক্সে অজস্র মেসেজ আবিস্কার করলাম৷ সোশাল মিডিয়ায় লেখাটি যেখানে শেয়ার করেছি, তার তলাতেও নানা কমেন্ট। সব বার্তার একই সার: ‘এসো, সত্যি রাত দখল করি। এ ভাবনার বাস্তবায়ন হবে না?’ ওই ১১ তারিখই, স্থান-কাল উল্লেখ করে, ১৪ই অগাস্ট তারিখ যথাক্রমে যাদবপুর ও কলেজ স্ট্রিটে রাত দখলের ডাক দিয়ে দিয়ে দেন দু’জন নারী, ফেসবুকেই৷ আমি তাঁদের চিনি না এবং তাঁরাও পরস্পরকে চেনেন না৷ দশ তারিখের লেখাটি পড়ে আমাকে যাঁরা রাতদখল-কে বাস্তবায়িত করার জন্য অনুরোধ করছিলেন মেসেজে বা কমেন্টে বা ফোন করে, তাঁদের সবার কথা ভেবে একই রাতে আমিও অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে রাতদখল-এর কর্মসূচির কথা ভাবি। এর ঠিক পরেই মাথায় আসে, শহরের তিন প্রান্তে তিনজন এই কর্মসূচি করবেন যখন, তখন তাঁদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তোলা দরকার৷ আমি সেই সম্পাদিকাকে ফোন করি৷ তিনি খোঁজখবর করে ওই ব্যক্তিদ্বয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। আরও একটি পরিকল্পনা মাথায় আসে৷ একটি যৌথ পোস্টার যদি ছাড়া যায়, তিন জায়গাকে মিলিয়ে, তাহলে শহর জুড়ে নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষ রাত দখল করছেন, এমন অভিঘাত তৈরি হবে। এই পোস্টার, রাতদখলের প্রথম ভাইরাল পোস্টার, উক্ত সম্পাদিকা তাঁর বন্ধুর সাহায্যে বানিয়ে দেন।

এর পর যা ঘটে, তা ঐতিহাসিক এবং কল্পনাতীত। ১২ তারিখ যৌথ পোস্টার ছাড়া হয়। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সেই পোস্টারের টেমপ্লেট ব্যবহার করে সারা পশ্চিমবঙ্গের আড়াইশর অধিক জায়গায় রাতদখলের কর্মসূচি ঘোষণা করে মূলত মেয়েরা৷ আরও দেখা বাকি ছিল৷ এগিয়ে আসে দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদের বাঙালি মেয়েরা — তারাও একই দিনে একই সময়ে একই কর্মসূচি নেয়। অবশেষে জানা যায়, রাতদখল হচ্ছে ইউকে, পোল্যান্ড, এবং স্টেটসেও। একই রাতে, একই সময়ে। ১৪ তারিখ সন্ধেবেলা যখন আমরা কর্মসূচির শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন দেখলাম, তিনশ-র অধিক জায়গার খবর আমাদের কাছেও এসে পৌঁছেছে। রচনা একবার রচিত হয়ে গেলে তা আর সত্যি লেখকের হাতে থাকে না৷ এক্ষেত্রে লেখার প্রভাব স্বনিয়ন্ত্রণে না থাকায় লেখক যারপরনাই খুশি হয়েছিল।

মহিলা এবং প্রান্তিক লিঙ্গগোষ্ঠী জোট বেঁধেছে অধিকার স্থাপনের

লেখক হিসেবে সেই লেখাতেই আমি স্বীকার করেছিলাম, আমার এই পরিকল্পনার পিছনে ইউকে এবং মার্কিন মুলুকের সত্তর দশকের অনুরূপ কর্মসূচির প্রভাব আছে। শুধুই যে পশ্চিমেই এমন হয়েছে, আর প্রাচ্যে বা ভারতে আমি প্রথম ভাবছিলাম, তাও নয়। ২০১২ সালে নির্ভয়াকাণ্ডের পর দিল্লিতে রাতদখল হয়েছে৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণ করে ধর্ষিতাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার পর হায়দ্রাবাদেও ঘটেছে রাতদখল। কিন্তু ২০২৪ সালে কলকাতা থেকে যে রাতদখল শুরু হল, তার মতো ব্যাপক আকার নেয়নি ভারতের পূর্ববর্তী উদ্যোগগুলো।

শুধুই যদি লেখক হতে পারতাম, তাহলে এখানেই ভূমিকা শেষ হত। আয়োজকরা, আহ্বায়করা ভাবনা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু আয়োজনেও যেহেতু সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাই এটাও স্বীকার করতে হয়, আমার কিংবা কোনো আহ্বায়কেরই সুদূর কল্পনাতেও ছিল না যে, সেই রাতে প্রায় এক কোটি নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষ পথে নেমে আসবেন। তার আগের আটচল্লিশ ঘণ্টায় আমাদের ফোন এক মুহূর্ত নীরব থাকেনি। সহস্রাধিক অংশগ্রহণেচ্ছু নারীর / প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষের, এমনকী পুরুষের ফোন ধরতে হয়েছিল। নারীবাদীদের সম্পর্কে ভারতীয়দের যা গড় মনোভাব, তাতে মূলধারার নারীবাদী স্লোগানে শিরোনামাঙ্কিত এক কর্মসূচিতে এত সাড়া কেউই আশা করিনি।

১৪ তারিখের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছি, আন্দোলনের সাথী এক অনুজ মেয়ে বলল, ‘কী করেছ বলো তো? এটা কোনোদিন হয়নি৷ মা-পিসি কোনোদিন মিছিল হাঁটেনি। খুব পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার। আজ আমাকে বলছে: স্লোগান দে, পোস্টার লিখব।’ একই সময়ে, আমাদেরই টেমপ্লেট ব্যবহার করে ইন্টারনেটে নতুন নতুন অনুষ্ঠানের ঘোষণা হচ্ছে জেলায় জেলায়। আমাদেরই কায়দায় সেখানে যোগাযোগের নম্বর থাকছে। সেখানে কোনো এক জেলার পোস্টারে নিজের বাবার নম্বর ও নাম দেখে কলকাতায় বসে রেগে যাচ্ছে আমাদের সহযোগী আরেক মেয়ে। বাপের সঙ্গে মেয়ের ঝগড়া হচ্ছে এই মর্মে, ‘পুরুষ শুধু অ্যালাই হতে পারে। পোস্টারে তোমার নাম থাকবে না। মেয়েদের নিজেদের কাজ করতে দাও। বাবা, তুমি পিছনের সারিতে দাঁড়াও।’ কোথাও একটা চেতনার স্তরে আলোড়ন শুরু হয়েছিল। অলক্ষ্যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল অনেককিছু। বাবা পিছোচ্ছেন অগত্যা।

তাই রাতদখলের লড়াই মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গের লড়াই — একথা বললে যথেষ্ট হয় না। এ মুষ্টিমেয় সচেতন মেয়ের লড়াই নয়। এ গৃহবধূ কাকিমা-মাসিমাদের লড়াই, জীবনে মিছিল-না-হাঁটা কর্মরতা মেয়েদেরও লড়াই। আর. জি. করের অধ্যক্ষ কর্তৃক ভিক্টিম-ব্লেমিং যে অসহায়তা ও ক্রোধ সৃষ্টি করেছিল নারী হিসেবে আমার মধ্যে, তেমনই ক্ষোভ তাহলে গ্রাস করেছিল আপামর নারীকে, যদিও হয়ত ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ শব্দটাও তাঁরা কখনও শোনেননি!

‘ভিক্টিম ব্লেমিং,’ অর্থাৎ নির্যাতনের জন্য নির্যাতিতকেই দায়ী করা৷ এক্ষেত্রে মেয়েটির রাতে একা থাকাকে দায়ী করা হয়েছে৷ দিনের বেলায় নির্যাতন হলে হয়ত দায়ী করা হত তার পোশাক বা প্রেমসম্পর্ককে৷ যুগ যুগ ধরে আমাদের যৌন নির্যাতন হলে বাপ-জ্যাঠারা তো বটেই, মা-কাকিমারাও এভাবে আমাদেরই দায়ী করেছেন৷ অথচ, এইবার তাঁরাই নাছোড়। কিছুতেই মানবেন না নির্যাতনের কারণ সংক্রান্ত এহেন পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা। পরিষেবা দিতে গিয়ে খুন হওয়া এবং খুনের পর দোষারোপিত হওয়া মেয়ে তাঁদের আত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মা-ঠাকুমারাও গর্জন করে উঠেছিলেন: ‘রাতে বেরোব না মানে? বেরোলে রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে না মানে?’ সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল ট্রান্স-কুইয়ার মানুষ। সকলের মধ্যেই ছিল দীর্ঘদিন পুষে রাখা ক্ষোভের বারুদ। যে কথা নাকি অধ্যক্ষ বলেছিলেন, সেরকম কথা প্রায়শই কি শোনা যায় না পাড়ার রকে, খাবার টেবিলে? ভিক্টিম-ব্লেমিং আমাদেরই সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল৷ সেই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার রাতদখলের আন্দোলন সজোরে ছুড়ে ফেলল আস্তাকুঁড়েয়। ইতিহাস তাই ‘রাতের দখল’ আন্দোলনকে হয়ত মনে রাখবে, ভারতের সেই প্রথম ব্যাপক গণ-আন্দোলন হিসেবে, যা ছিল ভিক্টিম-ব্লেমিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে৷ 

অভিজাত মেয়েদের আন্দোলন হিসেবে একে কখনই ভাবা হয়নি বলেই, সর্বপ্রথম ফোন গিয়েছিল গিগ কর্মীদের কাছে। আরবান কোম্পানির মেয়েরা আসতে চেয়েছিল ক্লায়েন্টের বাড়িতে যৌন নির্যাতনের কথা বলতে। অশোকনগরে এসেছিলেন মিড-ডে-মিল কর্মীরা। আশাকর্মীরা আকাদেমিতে শুধু আসেননি, তাঁদের একজন প্রতিনিধি সভা-পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। এসেছিলেন আইটি কর্মী মেয়েরা। মেয়ে ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক৷ তাঁরা সকলেই এসেছিলেন নিজের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে। স্লোগানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ট্রান্স-মেয়েরা। আশ্চর্য ব্যাপার হল, যে মা-মাসিরা এতদিন তাঁদের উদ্ভট ভেবেছেন, তাঁরা সেদিন কিন্তু সোৎসাহেই তাঁদের গলাতে গলা মেলালেন।

আমরা রাত্রিব্যাপী প্রতিবাদ সভা ভেবেছিলাম, যাতে মাঝরাতে মেয়েদের বাড়ি ফেরার পথে অসুবিধে না হয়৷ সেদিন সারারাত খোলা ছিল মহিলা শৌচালয় — যা থেকে উঠে এল নতুন নতুন দাবি। কেন রাত ন’টায় শহর জুড়ে নারী শৌচালয় বন্ধ হয়ে যায়? কেন মোড়ে মোড়ে নেই ট্রান্স মানুষের শৌচালয়? কেনই বা চব্বিশ ঘণ্টা সরকারি গণপরিবহণ চলবে না?

বিচার চাই, বিচার

এ আন্দোলনের আরেক বৈশিষ্ট্য, কোনো রাজনৈতিক দলীয় ব্যানারের প্রয়োজন হল না৷ কোনো সামাজিক সংগঠনেরও ব্যানারও এখানে ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু দলীয় রাজনীতির সঙ্গে এই আন্দোলনের সম্পর্ক বা সমীকরণটি বলে রাখা বিশেষ দরকার। আহ্বায়করা যখন অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের ফোন ধরেছেন, তখন খেয়াল করেছেন যে প্রথম প্রশ্নটি করা হয় তা হল, ‘আপনারা কোনো রাজনৈতিক দল নয় তো?’ দলীয় ব্যক্তিরা হয়ত বলবেন, ‘এ সাধারণ মানুষের ভীরুতা যে তাঁরা দলীয় হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না।’ ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, যে মানুষ রাজপথে ঢল নামাতে পারে, পুলিসি ভয় জয় করে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশ’ জায়গায় রাতভর সমাবেশ সংগঠিত করতে পারে, তাদের ভীরু ভাবা মূঢ়তা৷ তাঁদের দলের মিছিলে যাওয়ার অনাগ্রহকে বিতৃষ্ণা হিসেবে দেখছি। এবার শাসক-বিরোধী-ডান-বাম-মধ্য নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের উগ্র সমর্থকরা ভেবে দেখুন, কেন এ বিতৃষ্ণা? একে অ-রাজনৈতিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনে হয়, এ বিতৃষ্ণাও রাজনৈতিক। দলীয় রাজনীতির স্বার্থানুসন্ধান ও দুর্নীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল বলেই সাধারণ মানুষ দলীয় পতাকা বর্জন করলেন। এটাই তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গযৌন গোষ্ঠী সরাসরি কথোপকথন শুরু করেছে রাষ্ট্রের সঙ্গে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের নিজের সুরক্ষার অধিকার নিয়ে কথোপকথন সততই রাজনৈতিক।

আহ্বায়করা যখন রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চে উঠতে দেন না, তখন তাঁরা স্রেফ সাধারণ মানুষের চাহিদার বাস্তবায়ন ঘটান। সাধারণ মানুষই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের কাঁধের উপর চেপে রাজনৈতিক আখের গোছাতে তাঁরা কাউকে দেবেন না৷ পরেও আন্দোলনের মিছিল থেকে ঘোষিত হয়, মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় জনতা পার্টিতে এই আন্দোলনের ফায়দা তুলতে দেওয়া হবে না। মনে করিয়ে দেওয়া হয় সিপিএম যুগের বানতলা আর তৃণমূল যুগের কামদুনি, একই সঙ্গে৷  

চোখের সামনে এই গণজাগরণ দেখাটাই এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। বিহ্বল অবস্থা কাটার পর, আয়োজকরা বোঝেন, এই গণজাগরণ একরাতে থেমে গেলে চলবে না। কর্তব্য হল, তাকে সঠিক দিশা দেওয়া৷ এটাই গরম লোহায় হাতুড়ি মারার সময়। এই সুযোগেই বুঝে নিতে হবে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ব্যাপারে আইসিসি কেন অধিকাংশ জায়গায় ঘুমন্ত? বুঝে নিতে হবে কেন রাতে নারী শৌচালয় বন্ধ থাকে শহর ও রাজ্য জুড়ে? কেন রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো ও নারী-শৌচালয় নেই? নেই প্রান্তিক লিঙ্গযৌনগোষ্ঠীর শৌচালয় – স্রেফ নেই? কেন থানায় গেলে এখনও পুলিশ বলে, ‘রাতে বেরোনো উচিত হয়নি?’ কেন সাইবার থানায় বলে, ‘ছবি পাব্লিক রেখেছিলেন কেন? ট্যাম্পার তো হবেই।’ সুরক্ষার দায় কি নারী বা ট্রান্স-কুইয়ার মানুষের একার? রাষ্ট্রের দায় নেই? সুরক্ষার উপায় কি পর্দানশীনতা? রাতে না বেরোনো? দিনে না বেরোনো? নির্দিষ্ট পরিধিতে ঘোরাফেরা? পুরুষের ছায়ায় সেঁটে থাকা? সোশাল মিডিয়ায় নিজের ছবি পাব্লিক না করা? সব, সব দায় তাঁদেরই? রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ও প্রশাসন দায় নেবে না? কর্মস্থলে সে দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ?

এরপরে জল গড়িয়েছে আরও কিছুদূর। ‘রাতদখল’ আন্দোলন এরপর ‘রাতদখল, অধিকার দখল’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৭ অগাস্ট ঢালধারী র‍্যাফকে প্রতিহত করছে সাধারণ মেয়ে, ট্রান্স আর ক্যুইয়ার মানুষের দলের মহামিছিল। ১৯ তারিখ তারা মানববন্ধন করেছে। ২৫ তারিখে আবারও করেছে একাধারে তৃণমূলের নারীবিদ্বেষ এবং বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নারীঘৃণার বিরুদ্ধে মিছিল, যাতে বিজেপি তাদের আন্দোলন ‘হাইজ্যাক’ করার সাহস না দেখায়। প্রতি সুপ্রিম শুনানির আগের রাতে রাতদখলের কর্মসূচি নিয়েছে তারা। মেয়েরা এই প্রক্রিয়া চলাকালীন বারাসাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। ১৪ তারিখে আন্দোলনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে প্রেস মিট করে তারা জানিয়েছে তাদের পরবর্তী কর্মসূচি: বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন পেশার মেয়েদের মধ্যে ‘রাতের মিটিং’ করে তাদের দাবিদাওয়া তুলে আনা।

প্রিয়াঙ্কা হাঁসদা নামের বর্ধমানের মেয়েটি ধর্ষিত হল রাতে বাড়ির বাইরে শৌচকর্ম করতে গিয়ে। শহরে বসে ভাবা সম্ভব নয় কোনো অঞ্চলের মেয়েরা হয়তো যৌন নির্যাতন নিবারণের উপায় ভাবছে বাড়ির লাগোয়া শৌচাগার গড়ে দেওয়াকেও! তাই দরকার নানা প্রান্তের মেয়েদের দাবিদাওয়া শোনা। অতএব রাতের মিটিং। নানা মিটিং-এ উঠে আসা সেই সব দাবি আদায় করতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দিল ‘রাতদখল, অধিকার দখল’ আন্দোলন। ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর তারিখকে প্রীতিলতা শাহাদত দিবস চিহ্নিত করে, সেই দুই দিনকে তারা ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালনের বার্তা পাঠাল স্কুলে স্কুলে। কলকাতা, সোদপুর, বহরমপুর, হালিশহর, ক্যানিং, ডায়মণ্ড হারবারের মোট ত্রিশটি স্কুলে তা পালিতও হল। কীভাবে? ‘রাতদখল, অধিকার দখল’ আন্দোলনের পাঠানো ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি বিরোধী শপথবাক্য’ পাঠ করল সেদিন আট থেকে আঠারোর শিশু-কিশোর। কী সেসব শপথবাক্য? ‘যৌন হেনস্থা হলে নির্যাতিতকে লজ্জা দেব না।’ ‘নির্যাতিত হলে লজ্জা পাব না।’ ‘নির্যাতিতর পাশে দাঁড়াব।’ ‘নির্যাতন ঘটলে প্রকাশ্যে বলব।’ এই রকম সাত আটটি খুব সাধারণ শপথ। চোখে জল আসে যখন সোদপুরের শিক্ষিকা জানান, উপরে উল্লিখিত চারটির মধ্যে চতুর্থটি এক পঞ্চম শ্রেণির বালিকাকে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে যে সে ভরা ক্লাসে, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ঠিক পরেই, নিজের গোপন নির্যাতনের কথা বলেছে।

এইসবই চলছে, চলবে ‘রাতদখল, অধিকার দখল’ আন্দলনের তত্ত্বাবধানে। ‘আ টেল অফ টু সিটিজ’ উপন্যাসের প্রথম দুটি বাক্যই আমাদের যাপনের সার এখন। ‘এ হল অসহনীয় দু:সময়। আবার এই হল সবচেয়ে সুসময়।’

———-

পোস্টারগুলি লেখকের ফেসবুক পাতা থেকে সংগৃহীত।

গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত বই অ-নান্দনিক গল্পসংকলন, লাস্ট অ্যাক্টিভ বসন্তে, নারীবাদী চিঠি ও অন্যান্য, শরীরের সীমারেখা, মানবী ম্যানিফেস্টো, শূন্যপুর ইত্যাদি। সম্পাদিত গৃহহিংসা বিষয়ক বই: খাদের ধারে ঘর। পেশায় ইংরেজি ভাষাশিক্ষক৷ পছন্দের চর্চার বিষয় লিঙ্গরাজনীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *