ঈশ্বরের আপন দেশে
‘গড’স ওন কান্ট্রি’ এই কথাটির প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করেছিলাম কেরলে গিয়ে। বলা যায় ঈশ্বর খুব যত্নসহকারে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক ধৈর্য আর সময় নিয়ে এই জায়গা তৈরি করেছিলেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, আয়ুর্বেদ, ব্যাকওয়াটার্স, জলপ্রপাত, ট্র্যাডিশনাল নৃত্য, ইতিহাস সব মিলে কেরল এক অনন্যসুন্দর রাজ্য। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া সত্যিই এতকিছু একসঙ্গে পাওয়া যায় না।
আমরা কেরল ট্যুর শুরু করেছিলাম কোচি থেকে। ইতিহাসের গন্ধমাখা এই শহর কেরলের সব থেকে উন্নত এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য কোচি সমুদ্রের রানিও। এখানকার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত সারাজীবন মনে রাখার মতো। প্রায় দশটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কোচি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর। এখানকার মূল আকর্ষণ কোচি ফোর্ট আর মাত্তানচেরি। একসময় পর্তুগিজদের রাজত্ব ছিল বলে এখানকার বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে বাড়ি তৈরির শৈলীতে পর্তুগিজদের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। লঞ্চ ট্যুরে হ্রদে ভাসতে ভাসতে আমাদের ট্যুর গাইডের কেরল সম্পর্কে বর্ণনা শুনছিলাম। মাঝে মাঝে দেখা যায় ছোট ছোট ডলফিনের আনন্দময় নৃত্য, সামুদ্রিক আরও নানাপ্রকারের প্রাণবন্ত প্রাণীদের দেখে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের জলজ জীবন জীবন্ত হয়ে উঠছে। যেতে যেতেই চোখে পড়ল একটি বিলাসবহুল জাহাজ। গাইডের মুখে শুনলাম সেই জাহাজে শপিং সেন্টার, সুইমিং পুল, কমিউনিটি হল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ সবই আছে এমন কি হেলিপ্যাডও। বিষয়ে হতবাক হতে না হতেই পৌঁছে গেলাম বন্দরে। হ্রদের মাঝে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কোচি ফোর্ট, মাত্তানচেরি, বোলগেটি। ১৫৫৭ সালে পর্তুগিজরা বানিয়েছিল মাত্তানচেরি যা ডাচ প্রাসাদ নামেও পরিচিত । এর অভ্যন্তরে হিন্দু পুরাণের ম্যুরাল চিত্র এককথায় অসাধারণ। কোচির রাজার ব্যবহৃত কিছু জিনিসও এখানে রাখা আছে। আশেপাশে রয়েছে বেশ কিছু কিউরিও শপ আর কোচির বিখ্যাত স্পাইস সেন্টার। দেখতে সুন্দর প্রাসাদটিতে প্রায় ৪০০ বছরের বেশি ইতিহাসকে যেন আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। হাতে আঁকা চীনে টালির মেঝে, বেলজিয়াম গ্লাসের ঝাড়লন্ঠন, আর সোনালি প্ল্যাটফর্ম দেখার মতো। বেশ কিছু সিমেট্রি আর চার্চ ছাড়াও কোচির আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হল চাইনিজ ফিশিং নেট। দড়ি, পাথর আর বাঁশ দিয়ে তৈরি এই জাল দিয়ে মাছ ধরার অভিনব কৌশল দেখলে অবাক হতে হয়। কেরালা নামটির উৎপত্তি নিয়েই নানাজনের নানা মত আছে। অনেকের মতে কোচি নামটা নাকি চীনাদের দেওয়া। একথা অবশ্য স্থানীয়রা মানতে চান না। তাদের মতে এই নাম এসেছে মালয়ালাম ‘কোছাচি’ থেকে যার অর্থ ছোট্ট কিংবা ‘কেরা’ এবং ‘লাম’ থেকে যার অর্থ ‘নারকেল’ এবং ‘দেশ’ বা ‘ভূমি’। তবে এই মাছের জাল চীনের বাইরে কোচি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। ভারতের সবচেয়ে পুরনো চার্চ ইউরোপিয়ান চার্চটি পরিচর্যার অভাবে কিছুটা আকর্ষণহীন এবং ম্লান। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য গথিক স্টাইলে তৈরি ফোকলোর মিউজিয়াম আর কেরল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ভীষণ আকর্ষণীয় জায়গা। ভারতের ইতিহাসে ভাস্কো-দা-গামার নাম উল্লেখযোগ্য। কারণ পশ্চিম প্রদেশ থেকে ভারতে এসে সমগ্র বিশ্ববাসীকে তিনিই প্রথম একটি নতুন ধরনের জলপথের সন্ধান দিয়েছিলেন। কোচিতেই প্রয়াত হন এবং সেই জায়গায় একটি সৌধ নির্মিত রয়েছে। সুন্দর নির্জন সমাধিস্থল দেখে ভালো লাগে। লঞ্চে করে আবার কোচি শহরে ফিরে আসি। রাতের কোচি শহরের রূপ প্রত্যক্ষ করতে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করতে থাকি। আধুনিক নাগরিক সভ্যতার প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। আর রয়েছে আয়ুর্বেদ সেন্টার যা কেরলে একটা বিশিষ্ট জায়গা দখল করে আছে।
পরের দিন একটু অন্যরকম প্রতিশ্রুতিময় সকালের শুরু। কোচি থেকে খুব সকাল সকালই রওনা দিয়েছি মুন্নারের উদ্দেশ্যে। শহরের মতোই মুন্নার যাওয়ার রাস্তাও খুব সুন্দর। কিছুদূর চলতে চলতেই শহরের ছবি উধাও হয়ে গিয়ে শুরু হল গ্রামীণ দৃশ্য। চোখ জুড়ানো সবুজ রঙে চেয়ে রয়েছে চারপাশ। আসলে গোটা রাজ্যটাই তো সবুজে সবুজ। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে এসেও মনে হয়নি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কোথাও আছি। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার উঁচুতে মনোরম এক জায়গার নাম মুন্নার। চারিদিকে ঘন সবুজ পাহাড় যেদিকেই তাকানো যায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নরম গালিচার মতো নেমে এসেছে চা-বাগান। ভরা দুপুরেও একটা হালকা শিরশিরে ঠান্ডার আমেজ ছড়িয়ে রয়েছে মুন্নারের চারপাশে। এই সুন্দর পথে যেতে যেতেই শুরু হল সবুজের সঙ্গে গল্পগাছা। কোচি থেকে মুন্নারের দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। এখানে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থাপনা হয়েছে। সবচেয়ে ভালো এবং জনপ্রিয় টি ভ্যালি টুর। চতুর্দিকে ঢেউখেলানো পাহাড়ের গায়ে সবুজ গালিচা পাতা। নীল আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সবুজ জগত। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দু’একটি বাড়ি। বাহারি এক সবজে ইস্তেহারের নাম মুন্নার। কোচি শহর থেকে মাত্র ঘন্টা চারেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কেরলের জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় হিল স্টেশনের স্বপ্নময় জগতে। খাঁজে খাঁজে উঠে গেছে পাহাড়। পাকদন্ডী পথ ঘিরে শুধুই সবুজের সমাহার। সবুজের যে এতরকম ডাইমেনশন থাকতে পারে সেটা এখানে না এলে টের পাওয়া যেত না। কোথাও গাঢ় কোথাও নীলচে কোথাও বা পান্না রঙের। দেখে মনে হয় কোন শিশু যেন রংতুলি দিয়ে ইচ্ছেমতো আঁচড় কেটেছে প্রকৃতির ক্যানভাসে।
মশলার দেশ কেরালা। ভাস্কো-দা-গামা থেকে শুরু করে অনেক ইয়োরোপীয় বণিকই একসময় এখানে এসেছিলেন সুগন্ধি মশলার সন্ধানে। পথে চলতে চলতেই দেখা যায় নানারকম মশলার গাছ। এ পথ সবুজ এলাচ, গোলমরিচ, তেজপাতা, গরম মশলার গাছ আর চায়ের অলংকারে সজ্জিত হয়ে থাকে সারাবছর। গাড়ি থামিয়ে এখানকার সেই বিখ্যাত সুগন্ধি মশলাদার চায়ের স্বাদ নিলাম। পথ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সাথে সাথে উন্মুক্ত হতে থাকে সবুজ রহস্য। সবুজ হৃদয় চিরে একসময় পৌঁছে যাই মোহময়ী সুন্দরীর ঠিকানায়। মুন্নার গ্রীষ্মকালে একসময় সাহেবদের প্রিয় ঠিকানা ছিল।
মুন্নারকে এককথায় ‘স্বর্গের নন্দনকানন’ বললেও চলে। যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখতে পাওয়া যায় ঢেউখেলানো চা-গাছের উঁচু-নিচু সারি। দূরে যেখানে পাহাড় শেষ হয়েছে বলে মনে হয় ঠিক সেখানেই যেন আকাশের নীল নেমে এসেছে সবুজের বুকে। সেখানে আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঘবালিকার দল। চা-বাগানের ঝোপে-ঝোপে মেঘেদের হঠাৎ হঠাৎ হানাদারি। সবুজ আঁচল বিছানো চায়ের জমি। সবজে নীরবতার কাছে জমা রাখা যায় যাবতীয় মনখারাপ। এই উপত্যকায় পা রাখলেই মনের সব বিষণ্ণতা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। এমনই মন ভালো করার ম্যাজিক দাওয়াই আছে মুন্নারের মোহময়ী চা-বাগিচাদের। চা-বাগান ঘিরে বয়ে যায় হিমেল বাতাস। খুনসুটিভরা পাখিদের সোহাগী নিবিড় আলাপ, ভোরের স্নিগ্ধতাপূর্ণ কুয়াশা, মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা – এগুলোই মুন্নারের সহজ সরল নিত্যদিনের চেনা রাজপাট। এখানকার প্রকৃতিতে সবুজ আর নীলের সহবাস। নীল মেঘের ব্যাকড্রপে সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। আমার প্রকৃতিপ্রেমী মন মুন্নারের চা-বাগানের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে থাকে। ঠান্ডা বাতাসকে জব্দ করতে উষ্ণতার ওম আনার জন্য বিশেষ বার্তা পাঠাই সোনালী রোদের কাছে। সেই বার্তা এলে গরম কফি আর উষ্ণতার পরশে মাখামাখি হয়ে লুটেপুটে নিতে থাকি অনাবিল আনন্দকে আর মনের চোরাকুঠুরিতে তা অনন্তকালের জন্য বন্দি করে রাখি।
পাহাড়ের পর পাহাড় জুড়ে কার্পেটের মতো বিছিয়ে রয়েছে চা-বাগান। চা তোলা থেকে শুরু করে তার প্রসেসিংও দেখা যায়। টাটা টি মিউজিয়াম এখানকার অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা। আধঘন্টা ফ্রি ট্যুরে এখানে এসে জানা যায় কীভাবে মুন্নার চায়ের জনপ্রিয় সেন্টার হয়ে উঠল। চোখভরে সবুজ সোহাগ দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাই পান্নিভাসাল নদীর ওপর অবস্থিত মাত্তুপেটি ড্যামের কাছে। বেশ বড় ড্যাম। চারিদিকে গাছে চাওয়া পথ পাক খেয়ে একদম ড্যামের কাছে চলে গেছে। পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে জঙ্গল। দূর থেকে অপূর্ব লাগে। ড্যামের জলে সূর্যের আলো আর গাছের প্রতিফলনের দৃশ্য যেন ডেক্সটপের ওয়ালপেপার। এদিক-ওদিক ছুটে চলেছে স্পিডবোট। তাদের ধাক্কায় শান্ত স্থির জলে ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। সবুজ মুন্নারের শরীর বেয়ে যুবতী নর্তকীর মতোই উচ্ছল ভঙ্গিমায় বয়ে চলেছে তিনটি পাহাড়ি ঝর্ণা–মুদ্রাপূজা, নাল্লাথাল্লি আর কুণ্ডলা। ভরা বর্ষাকালে পূর্ণ যৌবনবতী হয়ে ওঠে এই ঝর্ণাগুলি। তখন উচ্ছল, চপলা কিশোরীর মতোই বয়ে যায় তারা আপনমনে, আপনছন্দে। হ্রদের জলে বোটিংও করা যায়। মুন্নারের আবহাওয়া সারাবছরই চমৎকার থাকে। সকালে এখানে যদি হয় তীব্র ঠান্ডা তো দুপুরেই দেখা যায় মেঘ কিংবা রোদ্দুরের সোহাগভরা প্রেমালাপ – আবার হয়তো বিকেলে বৃষ্টি। সন্ধ্যায় আবার বৃষ্টি থামলেই মেঘের আঁচল থেকে উঁকি দিয়ে যায় তারাদের মিটিমিটি অথবা চাঁদের মায়াবী আলো। চন্দ্রালোকিত মুন্নার যে কোনও রোমান্টিক কবির কাব্যময় জগতের সেরা ঠিকানা। বর্ষাকাল এখানে সবচেয়ে মোহময়ী। ওক, রাবার গাছের সারির মাঝে সদ্য বর্ষাস্নাত সবুজ আভরণে মায়াবি মুন্নারের রূপ মনের অন্দরমহলে থেকে যাবে সারাজীবন। মুন্নারের কিছুদূরে অবস্থিত এরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক। এখানেই বারো বছর অন্তর নীল কুরুঞ্জি ফুল ফুটে থাকে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হোয়াইট গার্ডেন মশলা এবং আয়ুর্বেদিক গাছের জন্য বিখ্যাত কুমিলি। রাস্তায় দেখি বড় বড় উনুনে কি যেন ভাজাভুজি চলছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া মানে ঘন ঘন খিদে পায়। কাছে গিয়ে দেখি পাকা কলার বেসন ফ্রাই হচ্ছে। একটা অন্যধরনের খাবারের স্বাদ পাবো বলে সবাই খেলাম। বেশ নতুনত্ব লাগল। মশলার বাগানে পৌঁছে টিকিট কেটে বাগানে প্রবেশ করতেই এক জন মহিলা গাইড প্রত্যেকটি গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। রান্নায় ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় মশলার গাছ দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টাখানেকের উপর সময় চলে গেল। বাগানের ভেতরে একটি দোকান থেকে কিছু মশলার প্যাকেট কেনা হল কেরল ভ্রমণস্মৃতি এবং উপহারের জন্য। সন্ধেবেলায় হোটেল কর্তৃপক্ষ আয়োজন করেছিলেন কথাকলি নৃত্যকলা প্রদর্শনের। লুপ্তপ্রায় এই প্রাচীন শিল্পকলাকে কিছু মানুষ বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন। এই নাচে বাজনার ছন্দের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার সুন্দরতম প্রয়াস সবচেয়ে বেশি মন টানে।
পরের দিন খুব ভোরে রওনা দিলাম পেরিয়ার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি দেখতে। গ্রামের নাম থেকাড্ডি আর ফরেস্টের নাম পেরিয়ার। ভরে গেছে সবুজ পাহাড়, সমুদ্র ব্যাক ওয়াটারের সাথেই কেরলের বন্য জীবনেরও একটা আলাদা আকর্ষণ যে রয়েছে তারই সবচেয়ে বড় প্রমাণ পেরিয়ারের জঙ্গল। খুব ভোরের ট্রিপ যদি ধরা যায় তাহলে বেশ কিছু বন্যপ্রাণী দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে কুমিলিতে থাকলে সুবিধা হয় পেরিয়ার জঙ্গলে যেতে হলে। কুমিলির তাপমাত্রা বেশ নেমে গেছে রাতের হালকা বৃষ্টি হওয়ায়। আমরাও খুব ভোরে রওনা হয়ে গেলাম। একটু একটু করে দিনের আলো ফুটে উঠছে। হালকা মেঘ থাকলেও দেখে মনে হচ্ছে না সেভাবে বৃষ্টি হবে। পাখিদের ঘুমজাগানিয়া প্রভাতী কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা নির্জন রাস্তায় উড়ে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের প্রজাপতি। এমন স্নিগ্ধ ভোর দেখলে স্বভাবতই মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। এখানে নানা রকমের পাখি থাকায় বার্ডওয়াচারদের ভীষণ সুবিধা। নীল রঙের টিয়া যা প্রায় বিলুপ্ত সেটা এখনো চোখে পড়ে এখানে, সেটা গাইডের মুখেই শুনলাম। পেরিয়ার লেক আসলে মানুষেরই তৈরি। একসময় কেরলের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীতে বন্যা হতো। প্রতিবছর ঘরবাড়ি ভেসে গিয়ে মানুষের দুঃখ কষ্টের শেষ থাকত না। ১৮৯৫ সালে এই নদীর উপর প্রথম বাঁধ দেওয়া হয় এবং সেই বাঁধের জল ধরে রাখার জন্যই একটি জলাধারের সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে ত্রিবাঙ্কুরের রাজা পেরিয়ার অভয়ারণ্য গড়ে তোলেন। সেই অভয়ারণ্যই কেরলের বৃহত্তম জঙ্গল। কার্ডামম হিলসের ঘন জঙ্গলের আঁচলের তলায় বেড়ে ওঠা এই অভয়ারণ্য ১৯৩৪ সালে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজার তৈরি। একসময় এটি ছিল ত্রিবাঙ্কুর রাজবংশেরই ব্যক্তিগত শিকারক্ষেত্র। ভাগ্যিস শিকারপ্রেমী রাজবংশেরই একজন একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা নিয়ে পশুপ্রেমী হয়ে উঠেছিলেন! তাই তো আমরা এমন একটি অভয়ারণ্য পেয়েছি। প্রায় হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পেরিয়ার ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে বয়ে যায় পেরিয়ার এবং পাম্বা নামের দুটি বড় নদী। জঙ্গলের ভিতর থেকেই উৎপত্তি হয়েছে এই দুটো নদীর যার আশীর্বাদেই চারপাশে এত সুন্দর ঘন জঙ্গল। হাতিদের স্বর্গরাজ্য এই জঙ্গল। কিন্তু বিধ্বংসী এক বন্যায় পেরিয়ার অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক বন্যপ্রাণী সেই বন্যায় ভেসে যায়। লঞ্চে করে যেতে যেতেই পেরিয়ারের অপার সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে গেলাম।
মুন্নারে দেখে আসলাম এক ধরনের সবুজ রং। এখানেও সবুজের সেই তীব্রতা এতখানি কমেনি। জঙ্গলকে ঘিরে রয়েছেই সহ্যাদ্রি পাহাড়। সমতল বেয়ে জঙ্গল ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের বুকে। লঞ্চে যেতে যেতেই চোখে পড়লো কিছু হরিণ আর হাতির পাল আর মায়াবী চোখে তাকিয়ে রয়েছে হরিণের দল। সাথে কিছু পানকৌড়ির ঝাঁক। হঠাৎ করে মাছরাঙা জল থেকে তুলে নিল তাদের খাদ্য বস্তু। পাহাড়ের গায়ে দূরে দেখা যায় বাইসন। চিতাবাঘ থাকলেও ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন না হলে তাদের দেখা পাওয়া খুব কঠিন। সত্যিই পেরিয়ার তুলনাহীন। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল গাছের গুঁড়িগুলো। শয়ে শয়ে বছরের বেশি কঙ্কাল হয়ে জলের তলায় নির্বিকার রয়েছে। তারা গাইড জানালেন এইগুলোই নাকি জঙ্গল কেটে নিয়ে আসা হয়েছিল। স্মৃতিচিহ্ন বুকে করে আজও তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। পেরিয়ার লেকের চারপাশে চিরসবুজ অরণ্য আর মাঝখানে একদম পরিষ্কার স্বচ্ছ নীল জলে বেষ্টিত এমন অভয়ারণ্য দেখে মোহাবিষ্ট হতেই হয়। এই অভয়ারণ্য সৌন্দর্য উপভোগ করার অন্য কোন উপায় নেই। লঞ্চে করে প্রবাহিত খালের মধ্যে দিয়েই দেখতে হবে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আলেপ্পি। ভালোবেসে অনেকেই আলেপ্পিকে ‘ভেনিস অফ দ্য ইস্ট’ বলে থাকেন। এখানেই রয়েছে কেরালার বিখ্যাত ব্যাকওয়াটার। লাঞ্চের পরে সবাই চলে গেলাম ব্যাকওয়াটার ভ্রমণে। সমুদ্রের জল মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ব্যাকওয়াটারের সৃষ্টি করেছে। হাউজবোটে করে ভাসতে ভাসতেই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে অভিভূত হতে হয়। এই বোটগুলোকে বলা হয় কেট্টুভল্লোম। শান্ত, সুস্থির অনন্ত জলরাশির মাঝে এদিক-ওদিক সারিবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় সাদা পাখিদের। চারিদিকের তীর জুড়ে তালগাছ, নারকেলগাছে ছাওয়া সবুজের বিজ্ঞাপন। আশেপাশে রয়েছে এখানকার বিখ্যাত হাউজবোট আর দেখা যাচ্ছে ক্যানো যা অনেকটা নৌকার মতো দেখতে। এখানকার লোকাল ট্রান্সপোর্ট। ঘন্টা বাজাতে বাজাতে দ্রুতগতিতে ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ক্রমেই জীবন্ত হয়ে উঠছে। আলেপ্পি থেকে আমাদের গন্তব্য কোভালামের দিকে। এই যাত্রাপথ অসাধারণ চারিদিক সবুজে ঢাকা আর সেই সবুজের আবার নানারকম শেডস। দুপাশের জঙ্গল ভেদ করে চলে গেছে। কোভালামের দিকে যেতে রাস্তায় পড়ে একটি রাজবাড়ি। সেটা দেখে পথে এক জায়গায় কেরালিয়ান ট্র্যাডিশনাল থালি দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। রাস্তায় বিরাট সাইজের ডাব দেখে আন্দামানের জায়ান্ট বা কিং কোকোনাটের কথা মনে পড়ে গেল। হোটেলে পৌঁছিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে একদম সোজা চলে গেলাম নারকেল, কলা, পেঁপে গাছে ছাওয়া ধনুকের মতো দেখতে ভারতবর্ষের অন্যতম সুন্দরতম কোভালাম বিচের ধারে। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ লাইটহাউজ বিচ, হাওয়া বিচ এবং অশোকা বিচ। আয়তনে খুব বেশি বড় না হলেও সামুদ্রিক মাছ পমফ্রেট, ম্যাকারেল, চিংড়ি, হেরিং-এ পূর্ণ ছোট ছোট শ্যাকের সামনে কিংবা বিচের ওপর শুয়ে শ্বেত অঙ্গে সানবাথ নিতে থাকা বিদেশীদের ভিড় দেখলে মনে হয় বিদেশের কোনো এক জায়গায় চলে এসেছি। কেরলের অনেক জায়গাতেই নারকেল তেলে রান্না হয়। অভ্যাস না থাকায় প্রথম প্রথম একটু অন্যরকম মনে হলেও খুব একটা খারাপ লাগেনি পরের দিকে। এবার ফেরার পালা। দেখতে দেখতেই কয়েকদিন কেটে গেল। কেরালা ছোট রাজ্য হলেও এখানে দেখার জায়গার কোন অভাব নেই। এ যাত্রায় সেইসব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হল না। তবে ঈশ্বরের আপন দেশে যা দেখলাম তার অনন্যসুন্দর কিছু মুহূর্তের ছবি মনের অন্দরমহলে বন্দি করে সেই চললাম নিয়মে বাধা কোলাহলে ভরা তাসের দেশে। আবার বছরভর অপেক্ষায় থাকব আর সময় সুযোগ পেলে ক্লান্ত মনের মুক্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়ব অন্য কোন অচেনা জায়গায়।
1 Comment