ছিন্নপত্রঃ এক ছিন্ন পাঠ

ছিন্নপত্রঃ এক ছিন্ন পাঠ

আমি তখন ছুটিতে, হাঁটছিলাম পল্টনের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল একটি বইয়ের স্তূপে, রাস্তার এক সংকীর্ণ এক পারে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন হয়ে। পাড় ধসে যে কোন সময় নিচের ড্রেনে পতিত হওয়ার শংকায় বইগুলি কাঁপছিল যেন! অবশ্য তাদের জন্য তেরপলের বিছানা পেতে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেও ছিল শতচ্ছিন্ন, আর রাস্তার কংক্রিট থেকেও নীরস। আমি তাকাতেই তারা যেন কথা কয়ে উঠতে চাইল, পাতায় পাতায় চাপা পড়ে আছে তাদের কত কাহিনি! একটি ধূলি-মলিন গেঞ্জি পরা, বছর দশেকের ছেলে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল বিরতিহীনঃ “মাত্র পনের টাকা…বাইছা লন…পনের টাকা…যেইডাই লন…পানির মত সস্তা!” লোভ ধরে গেল, শিডিউলকে বিঘ্নিত করে প্রায় গোটা দশেক বই বগলদাবা করে ফেললাম। এদের মধ্যে ছিন্নপত্রও ছিল, রবীন্দ্রনাথের সেই গ্রন্থটি যার ভিন্নধর্মী নামটি ঠিক ঠিক মনে থাকত স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে।  

বইটার ছিল খুবই দুরবস্থা, ছারপোকার দল ছিন্ন করেছিল তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, সঙ্গে নিজেরাও ছিন্ন হয়ে পড়ে ছিল পাতাগুলোর আনাচে-কানাচে। কিন্তু বাসায় বয়ে নিয়ে এসে তো আর ফেলে দেয়া যায় না, হেক্সাজল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিলাম তাকে। কখনোই পড়া হবে না এইরকম ভাবতে ভাবতে আলমারির একদম নিচতলায় নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলাম তাকে, হঠাৎ কী যে হল, থেমে গেলাম। আর ঐ অবস্থাতেই পাতা উল্টে প্রথম ছিন্নপত্রটি চোখের সামনে মেলে ধরলাম, তারপর তাকিয়ে রইলাম জানালার বাইরে স্তব্ধ হয়ে। মনে নেই, কতটা সময় ছিলাম ওভাবে… কিন্তু যখন হুঁশ ফিরে এসেছিল, আলমারির ঝাঁপিটা বন্ধ করে তাকে হাতে করে শুয়ে পড়েছিলাম, এভাবে কত রাত অবধি পড়েছিলাম এক নাগাড়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মত, মনে নেই। পরের দিন থেকে অবশ্য একটি করে ছিন্নপত্রই হাতে নিয়েছি – সারাটা দিন আকর্ষণকে জ্বালিয়ে জাগিয়ে রাতে আস্তে আস্তে নিভতে দিতাম।  এভাবে বইটা প্রায় চার মাসের জন্য জীবনধারণের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল আমার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য যুগিয়েছিল পরম এক রসদ।    

সবাই জানে, বাংলাদেশের মানুষ ভাষার জন্য লড়াই করেছিল। অনেকেই জানে না যে, বাংলাদেশের মানুষ একজন কবির জন্যও লড়াই করেছিল। গেল বছর মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পাড়ি দিচ্ছিল যখন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী লড়াইগুলোর ইতিহাস আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে আন্দোলনও। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন আর রবীন্দ্রনাথ- জাতীয় ইতিহাসের এই পালকগুলোর কোন একটিকে বিচ্ছিন্ন করলে যেন খসে যাবে অন্য পালকগুলোও, কংকালসার এক বাংলাদেশ পড়ে থাকবে চোখের সামনে। কিন্তু কেন তিনি নাড়ি ছেঁড়া ধন আমাদের? কেনই বা তার ‘সোনার বাংলা’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত? বাংলাদেশের একটি নদীর উপর একটি নৌকোয় চড়ে বসুন আর ক্ষণিক ছিন্নপত্র ও ক্ষণিক চারপাশের জীবন ও প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকুন। আস্তে আস্তে একটি ছবি ভেসে উঠবে আপনার অক্ষিপটে; অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করবেন, পুরো বাংলাদেশটাই রাবীন্দ্রিক! 

“ভারি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে।’’এ দিয়েই শুরু হয়েছে ছিন্নপত্র। বন্দোরা সমুদ্রতীরে ২৪ জুন ১৮৮৬ সালে তিনি যখন সমুদ্র দেখছিলেন, তাকে খাঁচার উন্মত্ত বাঘ মনে হচ্ছিল, যার অদূরে দাঁড়িয়ে মানুষ মজা দেখতে থাকে। তিনি লিখলেন, “পৃথিবীর সৃষ্টির আরম্ভ থেকে এই ডাঙায় জলে লড়াই চলছে – ডাঙা ধীরে ধীরে নীরবে এক-এক পা ক’রে আপনার অধিকার বিস্তার করছে, আপনার সন্তানদের ক্রমেই কোল বাড়িয়ে দিচ্ছে – আর পরাজিত সমুদ্র পিছু হটে হটে কেবল ফুঁসে ফুঁসে বক্ষে করাঘাত করে মরছে।”

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা চিরন্তন বিরোধ সম্পর্ক যেন আঁকা হল এখানে; অথচ এ ছিন্নপত্রের খুবই বিচ্ছিন্ন এক উপাখ্যান। আসলে পুরো ছিন্নপত্র জুড়েই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অমোঘ প্রেম চিত্রায়িত হয়েছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা ভাষা, ভাব ও আবেগের এক উন্মত্ত ঘূর্ণিজলে। যারা অবগাহন করতে পেরেছে সেই জলে, তাদের যেন আর কিছু চাইবার থাকে না এই ধরণীতে, জানার থাকে না কিছু বাকি, জীবনের উদ্দেশ্য তাদের পূর্ণ,  ধরণীতলের অনন্ত যাপন তাদের সার্থক। 

রবীন্দ্রনাথ তখন সাজাদপুরের জলপথে। ২০শে জুন, ১৮৯১ সনের এক চন্দ্রালোকিত রাত। যখন সব নৌকা ডাঙায় বাঁধা ছিল, হাওয়ার অভাব বোধ করায় একটি পাড় দেখে এক হাঁটু জলের মাঝে নৌকা বাঁধতে বললেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই ঝড় উঠল, আর রবীন্দ্রনাথের “বোটটা যেন একটি শিকলি-বাঁধা পাখির মতো পাখা ঝাপটে ঝট্‌পট্‌ ঝট্‌পট্‌  করছিল –  ঝড়টা থেকে থেকে চীঁহি চীঁহি শব্দ করে একটা বিপর্যয় চিলের মতো হঠাৎ এসে পড়ে বোটের ঝুঁটি ধরে ছোঁ মেরে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চায়, বোটটা অমনি সশব্দে ধড়ফড় করে ওঠে।” রবীন্দ্রনাথ হাওয়া খেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে  যেন কেউ ঠাট্টা করে বলে যাচ্ছিল, ‘এইবার পেট ভরে হাওয়া খেয়ে নাও, তার পরে সাধ মিটলে  কিঞ্চিৎ জল খাওয়াব – তাতে এমনি পেট ভরবে যে ভবিষ্যতে আর কিছু খেতে হবে না!’ রবীন্দ্রনাথের মনে হল, “জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত – কারণ, যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে তেমন গ্রহণ করতে পারে না।” এই যে ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিনিয়ত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বিঁধে থাকে… নৌকোটিকে নিয়ে  যেমনটা হয়েছিল, তেমনি টুঁটি ছিড়ে নিতে উদ্যত থাকে অহর্নিশি… সে কিন্তু একেবারে সমাপ্তি টানে না কখনোই, আনন্দে-সম্মোহনে মাতোয়ারা মানুষকে একটু থামিয়ে দেয় মাত্র। আর এ তো এক প্রকার রসিক তাই! বেশিরভাগ মানুষই যখন বুক চাপড়াতে থাকে, তখন প্রকৃতির রুদ্র রূপ থেকেও রস খুঁজে নেয়ার মৌন এক আহবান জানায় আলোচ্য ছিন্নপত্রটি।   

ছিন্নপত্র যতই পেখম মেলতে থাকে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক যোগাযোগ একটু একটু করে অবগুণ্ঠন খুলতে থাকে। সাজাদপুরেই, ২২ শে জুন, ১৮৯১ সালে, কবি মাথাটা বোটের জানালার উপর রেখে দিয়ে ডুবে রয়েছেন জ্যোৎস্নারাত্রির অনন্ত শান্তি ও সৌন্দর্যের মধ্যে। দুনিয়ায় এক শ্রেণীর মানুষ এর সন্ধান পায় না, তাদের খালি হা-হুতাশ, ‘জগতের সকল কথা জানতে পারছি নে কেন’, আর এক শ্রেণীর অভিযোগ, ‘মনের সকল ভাব প্রকাশ করতে পারছি নে কেন?’ কিন্তু প্রকৃতির সব কথা যেমন জানার নয়, তেমনি মনের সব কথাও জানানোর নয়। ভাব-ভাষার খোঁজ না করে তাই একে অপরে মিশে যাওয়ায়াই শ্রেয়, ও সুখকর। যখন প্রকৃতি জ্যোৎস্না আলোকিত রাতে তার নদী বক্ষে পরম স্নেহমমতায় কবির ‘চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দেয়, জল ছল্‌ ছল্‌ শব্দ করে বয়ে যায়, জ্যোৎস্না ঝিক্‌ ঝিক্‌ করতে থাকে এবং অনেক সময় ‘জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়’”, কবির সামনে প্রতিভাত হয় আরো একখানি অমূল্য জীবন দর্শন – “এই অপরিতৃপ্ত জীবনের জন্য প্রকৃতির উপর আমাদের আজন্মকালের অভিমান আছে, যখনি প্রকৃতি স্নেহমধুর হয়ে উঠে , তখনি সেই অভিমান অশ্রুজল হয়ে নিঃশব্দে ঝরে পড়তে থাকে।” যেন এক নিগূঢ় তত্ত্বকথায় বলে দেয়া হল মানুষের সমস্ত জীবনটা – প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আবেগ, আবদার,  নালিশ আর মানভঞ্জনের নিরন্তর গল্প।   

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘কিন্তু আমি বেদুইন নই, বাঙালী। আমি কোণে বসে বসে খুঁৎ খুঁৎ করব, বিচার করব, তর্ক করব, মনটাকে নিয়ে একবার ওলটাব একবার পালটাব – যেমন করে মাছ ভাজে, ফুটন্ত তেলে একবার এ পিঠ চিড়বিড় করে উঠবে, একবার ও পিঠ চিড়বিড় করবে’, তখন বাঙালীর অবরুদ্ধ জীবনকে তিনি মেলে ধরেন, যা আজো যে খুব পাল্টিয়েছে, তা নয়। তিনি জানতেন, আমাদের এখানে ‘প্রথার সঙ্গে বুদ্ধির, বুদ্ধির সঙ্গে ইচ্ছার, ইচ্ছার সঙ্গে কাজের’ দিনরাত খিটিমিটি লেগে আছে। তাই আরব বেদুইনদের মত বলিষ্ঠ বুনো ঘোড়া হয়ে ‘লঘুত্বের আনন্দে-আবেগে’ ছুটতে চেয়েছেন, ‘বিচার-আচার বিবেক-বুদ্ধি’র খাঁচায় দেহমনকে বুড়ো না করে একটা বেদুইন গোছের ‘সুস্থ সবল উন্মুক্ত  অসভ্যতা’ দিয়ে জীবনকে পরম আনন্দে ভরে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। বাঙালী যখন সভ্য হতে চাইছে, রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, জ্যৈষ্ঠ ১৮৯২-এর এক ছিন্নপত্রে তখন ‘অসভ্যতার’ আহবান জানাচ্ছেন। আসলে তিনিও সভ্যতা চাইছেন, কিন্তু তা স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়।   

“অনেক পুরনো শুকনো কবিতা, কলকাতায় যাকে উপহাসানলে জ্বালিয়ে ফেলবার যোগ্য মনে হয়, তারা এখানে আসবামাত্র দেখতে দেখতে মুকুলিত পল্লবিত হয়ে ওঠে।” শিলাইদহে ৩ ভাদ্র ১৮৯২ শরতের সকালবেলা ‘চার দিক থেকে আকাশ আলো বাতাস এং গান একরকম মিলিতভাবে এসে’ কবিকে অত্যন্ত লঘু করে আপনাদের সঙ্গে যেন মিশিয়ে ফেলছে।” রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কাছে এভাবে বরাবার লঘু হয়েছেন, তাঁর এই লঘুত্ব আসলে বৃহৎ কোন রঙের উপাদান, যেখানে ‘নব-যৌবনা ধরণীসুন্দরীর সঙ্গে কোন এক জ্যোতির্ময় দেবতার ভালবাসাবাসি চলছে।’ আর সে কারণেই সব কিছুর মধ্যে ‘এমন অগাধ পরিপূর্ণতা, স্থলের মধ্যে এমন শ্যামশ্রী, আকাশে এমন নির্মল নীলিমা ’ পাবনার পথে, ৯ জুলাই, ১৮৯৫ সনে, ইছামতি দিয়ে চলছিলেন কবি। তখন ছিল বর্ষাকাল , নদীটির দুইপারের সবুজ, কাশবন, ক্ষেত, আর গ্রামের সারি তাঁর কাছে মনে হল “এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন, … আমি বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছি এবং বারবারই ভালো লাগছে ” ছিন্নপত্রের ক্যানভাস জুড়ে খালি এমন সব ছবি আর কবিতা।  

‘’অনেক সময়ে ছবি দেখলে মনে হয়, ‘আহা, এইখানে যদি থাকতুম’, ঠিক সেই ইচ্ছাটা এখানে পরিতৃপ্ত হয়; মনে হয়, একটি জাজ্জ্বল্যমান ছবির মধ্যে আমি বাস করছি’’, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন শিলাইদহে ২০ আগস্ট, ১৮৯২ এর ছিন্নপত্রে। মজার ব্যাপার হল, পাঠকও ছিন্নপত্র পড়ে এমন ছবিতেই ডুবে থেকেছেন আগোগোড়া। শিলাইদহের নদী, আর প্রকৃতি উদাসীন রাখতো কবিকে, তখন তার মনে হত কেবলি “এর যে কী মানে ঠিক ধরতে পারি নে, এর সঙ্গে যে কী একটা আকাঙ্ক্ষা জড়িত আছে ঠিক বুঝতে পারি নে,” কিন্তু সত্যটা ঠিকই ধরা দেয়, এই বিশাল পৃথিবী যার গর্ভ থেকে তার সৃষ্টি, সে কেবলি তাকে উদাস করে তুলে – “এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম – যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত – আমি কত দূর-দূরান্তের কত দেশ-দেশান্তরের জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম…,” কবি এরপর আর কোন দূরত্ব রাখেন না, স্থান-সময় সব একাকার হয়ে যায় – ‘’আমার এই – যে মনের ভাব এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে …”  

২০২১ এর জুলাই মাসে যখন ছিন্নপত্রে ডুবে ছিলাম,  শহর ডুবে ছিল হাঁটু-জলে, রিমঝিম তান বেজে চলেছিল বিরতি দিয়ে দিয়ে। সোয়া শত বছর পূর্বে, ৩ জুলাই, ১৮৯৩ সনে  শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথও ছিন্নপত্র লিখছেন বর্ষাকে নিয়েই, “কাল সমস্ত রাত তীব্র বাতাস পথের কুকুরের মত হুহু করে কেঁদেছিল -আর বৃষ্টিও অবিশ্রাম চলছে…।” এরপর লিখছেন, ”চাষারাও পারের চর থেকে ধান কেটে আনবার জন্যে …একখানা কচুপাতা মাথার উপর ধরে ভিজতে ভিজতে খেয়া নৌকোয় পার হচ্ছে – বড়ো বড়ো বোঝাই নৌকোর মাথার উপর মাঝি হাল ধরে বসে বসে ভিজছে – আর মাল্লারা গুণ কাঁধে করে ডাঙার উপর ভিজতে ভিজতে চলেছে – এমন দুর্যোগ তবু পৃথিবীর কাজকর্ম বন্ধ থাকবার জো নেই।” পাখিদের বিমর্ষ মনে নীড়ে থাকা, ছেলেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া ইত্যাদির পর তিনি দেখছেন রাখাল পালের গোরুগুলিকে, “তাদের পিঠের উপর বৃষ্টি এবং রাখাল বালকের যষ্ঠি অবিশ্রাম পড়ছে, দুই-ই তাদের পক্ষে সমান অকারণ অন্যায় এবং অনাবশ্যক!” 

পরদিন ৪ঠা জুলাই ১৮৯৩ সন।  বৃষ্টি বিদায় নিয়েছিল, রোদের দেখা মিলছিল, আকাশে এত মেঘ ছিল যে, ”ঠিক যেন মেঘের কালো কার্পেটটা সমস্ত আকাশ থেকে গুটিয়ে নিয়ে এক প্রান্তে পাকিয়ে জড়ো করেছে, এখনই একটা ব্যস্তবাগীশ বাতাস এসে আবার সমস্ত আকাশময় বিছিয়ে দিয়ে যাবে, তখন নীলাকাশ ও সোনালি রৌদ্রের চিহ্নমাত্র দেখা যাবে না।” কিন্তু এমন কাব্যিক উপমা টানার পরই কবির চোখে পড়ল চাষীদের নৌকা, ” আমার বোটের পাশ দিয়ে তাদের নৌকো যাচ্ছে আর ক্রমাগত হাহাকার শুনতে পাচ্ছি – যখন আর কয়দিন থাকলে ধান পাকত তখন কাঁচা ধান কেটে আনা চাষার পক্ষে যে কী নিদারুণ তা বেশ বুঝতেই পারা যায়। যদি ঐ শিষের মধ্যে দুটো চারটে ধান একটু শক্ত হয়ে থাকে এই তাদের আশা। প্রকৃতির কার্যপ্রণালীর মধ্যে দয়া জিনিসটা কোনো এক জায়গায় আছে অবশ্য, নইলে আমরা পেলুম কোথা থেকে – কিন্তু সেটা যে ঠিক কোনখানে খুঁজে পাওয়া শক্ত। এই শতসহস্র নির্দোষ হতভাগ্যের নালিশ কোনো জায়গায় গিয়ে পৌচচ্ছে না, বৃষ্টি যেমন পড়বার তেমনি পড়ছে, নদী যেমন বাড়বার তেমনি বাড়ছে…।” কবি এরপর দুঃখের সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন এক অত্যাশ্চর্য সত্যের সামনেঃ  ”খ্রিস্টানরা বলে, দুঃখটা খুব উচ্চ জিনিস, ঈশ্বর স্বয়ং মানুষ হয়ে আমাদের জন্য দুঃখ বহন করেছেন। কিন্তু নৈতিক দুঃখ এক, আর পাকা ধান ডুবে যাওয়ার দুঃখ আর।” বর্ষাকালীন ডাঙা ও জলের প্রণয় কবিকে মাতাল করে তুললেও শুধুমাত্র সেই রোমান্টিক ভাবালুতায় বন্দী থাকেননি, জীবনের কঠিন বাস্তবতাকেও দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।  

রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য বিশিষ্ট লেখক প্রমথনাথ বিশী উচ্ছ্বসিত ছিলেন ‘ছিন্নপত্র’ নিয়ে, তার মতে, ছিন্নপত্রের নায়িকা হচ্ছে বাংলাদেশের উপর বয়ে যাওয়া পদ্মা নদী, আর নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তখন ইছামতি নদীতে, ৭ জুলাই, ১৮৯৩। বেশ কদিন পর মেঘের দেখা মিলেছে, রৌদ্র করোজ্জ্বল বিকেল, “প্রকৃতি যেন স্নানের পর নতুন-ধোওয়া বাসন্তী রঙের কাপড়টি প’রে পরিচ্ছন্ন প্রসন্ন প্রফুল্ল মুখে ভিজে চুলটি মৃদুমন্দ বাতাসে শুকোচ্ছিলেন!” সুতরাং, বোট ছেড়ে দিলেন, আর তারপরেই একটুখানি বাতাস ও বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চলতে চলতে যে সূর্যাস্ত এল, কবি তার বর্ণনা-চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে চেয়েও যেটুকু লিখলেন, তা থেকেই পাঠক পেয়ে গেলেন এক অবিস্মরণীয় ছবিঃ “বিশেষত আকাশের অতিদূর প্রান্তে পদ্মার জলরেখার ঠিক উপরেই মেঘের যেখানে ফাঁক পড়েছে, সেখানটা এমনি অতিমাত্রায় সূক্ষ্মতম সোনালিতম হয়ে দেখা দিয়েছিল, সেই স্বর্ণপটের উপর সারি সারি লম্বা কৃশ গাছগুলির মাথা এমনি সুকোমল সুনীল রেখায় অঙ্কিত হয়েছিল – প্রকৃতি সেখানে যেন আপনার চরম পরিণতিতে পৌঁছে একটা কল্পলোকের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে।“ কিন্তু সেই কল্পলোকের নিশানা পেয়ে কেউ কি আর স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? তাইতো মাঝি যখন চরের কাছারিঘাটে বোট রাখার জন্য আকুলিবিকুলি করছে, কবি মানছেন না, “না, পদ্মা পেরিয়ে চল!”

প্রকৃতি তো প্রেমিকা, তার চাই নিরবচ্ছিন্ন এক নির্জনতা, নীরবতা। তার চাই শুধু একজন মাত্র একান্তই আপনার লোক। তাইতো ভীড়ে সে কুঁকড়ে যায়। কিন্তু ‘দিনের পর দিন যখন একটি কথা না কয়ে কাটে তখন হঠাৎ টের পাওয়া যায়, আমাদের চতুর্দিকেই কথা হচ্ছে।“ তখন নদীর ‘কলধ্বনির প্রত্যেক তরলল’কার’ কবির ‘সর্বাঙ্গে যেন কোমল আদর বর্ষণ করছে’, তার মধ্যে স্থিরভাবে বিরাজ করছে  ‘মেঘমুক্ত-আলোক-উজ্জ্বল শস্যহিল্লোলিত জলকল্লোলিত চতুর্দিকটার সঙ্গে মুখোমুখি বিশ্রদ্ধ প্রীতিসম্মিলনের উপযুক্ত একটি নীরব গোপনতা।‘ ৮ আগস্ট ১৮৯৪ -এর ছিন্নপত্রে শিলাইদহের নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির মধ্যেই যেন নিজেকে চিনেছেন কবি, কারণ ‘জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গুপ্ত, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখানকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে।“ 

পদ্মার প্রতি কেন এই প্রেম কবির? কুষ্টিয়ার পথে, ২৪ আগস্ট, ১৮৯৪ এর ছিন্নপত্রে তার দেখা মেলে। কবি যখন পদ্মাকে বুক ফুলিয়ে চলতে দেখেন, তখন একটি সত্য এসে যায় তার সামনে, তিনি লক্ষ্য করেন, মানুষ বা অন্যন্য প্রাণীর খানিক চলে, খানিক থামে; কিন্তু পদ্মার শুধু চলছেই, একটুও বিরাম নেই, যেমন করে আমাদের মনেরও বিরাম নেই, শরীর জিরোলেও। আর তাই পদ্মা ‘মনের ইচ্ছার মতো ভাঙছে-চুরছে এবং চলেছে, মনের ইচ্ছার মতো সে আপনাকে বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গে এবং অস্ফুট কলসংগীতে নানা প্রকারে প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে।“ আর এই দৃশ্যই কবির মনে বৈষ্ণব কবির ছন্দোঝংকার বাজিয়ে দেয়, শেষমেশ আবিষ্কৃত হয়, “প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার কাছে শূণ্য সৌন্দর্য নয়ঃ এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে, এর মধ্যে অনন্ত বৃন্দাবন।“ কেউ যদি ছিন্নপত্র পাঠ করেন, কবির চোখ দিয়ে সেই অমর লীলা, সেই অভুতপূর্ব অভিনয় কখনোই মিস্‌ করবেন না মনে হয়। 

শিলাইদহের এক চরে বাঁধা কবির বোট নভেম্বর, ১৮৮৯ সনের কোন এক দিনে। সেই ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি ও কোথাও কোথাও সাদা বালির ধু ধু চরে “উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পান্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।‘’ কবি আবিষ্কার করেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।“ হয়ত কলকাতায় এই ছবিগুলোকে কবিতার  মত শোনাবে, কিন্তু এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপর যখন ‘সূর্য আস্তে আস্তে ভোরের বেলা পূর্ব দিক থেকে কী এক প্রকান্ড পাতা খুলে দিচ্ছে এবং সন্ধ্যায় পশ্চিম থেকে ধীরে ধীরে আকাশের উপর যে-এক প্রকান্ড গ্রন্থের পাতা উলটে দিচ্ছে’ তখন এই ‘বৃহত নিস্তব্ধ নিভূত পাঠশালা” আর মিথ্যে বিভ্রম মনে হচ্ছে না। 

দিগন্তের বৃক্ষরাজির মধ্যে একদিন সূর্যকে হারিয়ে যেতে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ, “সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল – নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে এল – মনে হল ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ঐখানে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিল ভাবে এলিয়ে দেয়, আপনার সন্ধ্যাতারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে, আপন নির্জনতার মধ্যে সিঁদুর পরে বধূর মত কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে, এবং বসে বসে পা দুটি মেলে তারা মালা গাঁথে এবং গুন্‌ গুন্‌ স্বরে স্বপ্ন রচনা করে।‘’ কিন্তু এরপরেই মাঠজুড়ে একটি বিষাদের ছায়া চোখে পড়ে কবির, “ঠিক যেন অশ্রুজল নয়, একটি নির্নিমেষ চোখের বড়ো বড়ো পল্লবের নীচে গভীর ছল্‌ছলে ভাবের মত।“ পতিসরে ৬ মাঘ ১৮৯১ সালে এই ছবি আঁকার সময় কবির মনে হল, সারাদিন ছেলেপুলে-ঘরকন্না করে মা যখন নিশুতিতে একটু সময় পায়, একটু স্থান পায় নিজের  করে, তখন তার মধ্যে যে বৈরাগ্য, যে চাপা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সঙ্গের হতাশা – সব মিলিয়ে যে হাহাকার, তাই যেন ব্যাপ্ত হয়েছে বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে দিনের কোলাহল ছাড়িয়ে রাত্রির এই অনন্ত শূন্যতার মাঝে। এই যে বধু থেকে মাতৃরূপে রূপান্তর, তাও প্রকৃতির এক পরিপূর্ণ ও বিশ্বস্ত ছবি আঁকার প্রয়াস মনে হয়।   

সাজাদপুরের দুপুরবেলা, ২৩ শে জুন, ১৮৯১। রবীন্দ্রনাথ  সাধারণ মানুষের কর্ম-নিমগ্ন জীবনপ্রবাহের  মধ্যে কেমন একটা মন্থরতা লক্ষ্য করেন, কেমন এক মন ব্যাকুল করা বিষাদের বীণ বেজে উঠে তার মাঠ, ঘাট, আকাশ আর রোদ্দুরে! অনন্তে ডুব দিয়ে কবির মনে হয়, মানুষ এই সংসারে নিয়ত খেয়া নৌকার মত পারাপার হচ্ছে, তাদের ছোটখাট সুখদুঃখের আনাগোনা, কলরব শোনা যাচ্ছে, কিন্তু ‘এই অনন্ত-প্রসারিত প্রকান্ড উদাসীন প্রকৃতির মধ্যে সেই মৃদুগুঞ্জন, সেই সেই একটু-আধটু গীতধ্বনি, সেই নিশিদিন কাজকর্ম কী সামান্য, কী ক্ষণস্থায়ী, কী নিষ্ফল-কাতরতা-পূর্ণ মনে হয়!” শীতের দেশে প্রকৃতি যেখানে জমাট বেঁধে সংকুচিত, যেখানে মানুষের কীর্তিকলাপের চিহ্ন প্রকটভাবে দৃশ্যমান, সেখানে হয়ত জয় আছে, কিন্তু তা জোর আর জবরদস্তির। অন্যদিকে, বাংলাদেশের আদিগন্ত অবারিত উদারবক্ষ প্রকৃতির সামনে মানুষের ক্ষুদ্রতা বেদনা জাগাতে পারে, কিন্তু সেখানে জোর নেই, বরং নিবেদনের মহত্ব আছে।  

রবীন্দ্রনাথ বোটে ঘুরতেন যখন, তখন একাই থাকতেন না, সঙ্গে একদল লোকও থাকত, যারা তাদের জমিদারকে জগতের সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে সদা সতর্ক থাকত। গ্রামের ছেলেদের খেলাধূলো এই রক্ষাকর্তাদের কাছে বেয়াদবি, মাঝিদের নিজেদের মধ্যে হাসিগল্প তাদের কাছে রাজার প্রতি অসম্মান, চাষাদের ঘাটে আসা গরুকে জল খাওয়াতে এদের কাছে রাজমর্যাদার চরম হানি। আর তাই “রাজার চতুর্দিকটা হাসিহীন খেলাহীন শব্দহীন জনহীন ভীষণ মরুভূমি করতে পারলে তাদের মনের মতো রাজসম্ভ্রম রক্ষা হয়য়!” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো সংসারের রাজা ছিলেন না,  প্রকৃতি যে ভীষণ খেলাপ্রিয়, স্বাধীনচেতা, তার সঙ্গেই যে ছিল তাঁর নিত্যসংসার! তাই তিনি তার রক্ষকদেরই উল্টো তাড়া করতেন আর নিবিষ্ট হয়ে ছেলেমেয়েদের খেলায় ডুবে যেতেন। এমন এক খেলার বর্ণনা পাওয়া যায় সাজাদপুরের ছিন্নপত্রে, জুন ১৮৯১ সনে। একটি ছেলেকে অন্য সব ছেলেরা চ্যাং দোলা করে ভাসাচ্ছিল শূন্যে, হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা ঘটে, ছেলেটি অন্যদের হাতের বাঁধন ছিঁড়ে প্রবল গতিতে পতিত হয় মাটির বিছানার উপর, তার শরীর খুব আঘাত না পেলেও মন পায়, ‘সেই অভিমানে সে সঙ্গীদের ত্যাগ করে বহুদূরে গিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে তৃণশয্যায় শুয়ে পড়ে।”তার ভাব দেখে মনে হল, সে আকাশের তারা গুনবে বা মেঘের লুকোচুরি দেখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে, কিন্তু সঙ্গীদের কাছে আর ভিড়বে না। দলের সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য তখন তাকে অনুনয় করতে শুরু করলে এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে এক কাড়াকাড়ি, ঠেলাঠিলি শুরু হয় যা যেন এক খেলা! অনতিবিলম্বে ছেলেটিকে আবার দুলতে দেখা যায় চক্রাকারে বন্ধুদের মাঝের শূন্যে। “এমনি মানুষের প্রতিজ্ঞা! এমনি তার মনের বল! এমনি তার বুদ্ধির স্থিরতা! খেলা ছেড়ে একবার দূরে গিয়ে চিৎ হয়ে শোয়, আবার ধরা দিয়ে হেসে হেসে মোহদোলায় দুলতে থাকে!”- কবি এইভাবেই একটি নিতান্ত সাধারণ খেলা থেকে মানবজীবনের এক পরিপূর্ণ গল্প বের করে আনলেন, বলে দিলেন যাপিত জীবনের সব রহস্য, ফাঁস করে দিলেন ধরাধামের সব রহস্য!  

শিলাইদহ, অক্টোবর, ১৮৯১। কবি বোটের জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন, একটা জেলেডিঙ্গিতে একজন মাঝি গাইতে গাইতে চলেছে। ছেলেবেলার পদ্মাভ্রমণের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর – রাত তখন দুটো, ঘুম ভাঙতেই তিনি জানালাটা তুলে মুখ বাড়িয়ে এক স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে পান, একটি ক্ষুদে ডিঙ্গিতে এক কিশোর ঠিক এখনকার মতই গান গাইতে গাইতে চলছিল। সেই নিস্তরঙ্গ নদীর উপর ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হল কবির, তার সাধ হল এমনি করে পৃথিবীর পথে নৌকা ভাসিয়ে দিতে। সবকিছুকে জানার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও জানান দিতে মন চাইল কবির। এ কাজেই যৌবনের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে পরে বৃদ্ধ বয়েসে ঘরে এসে খিল দেয়ার পরিকল্পনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল! অনেকে হয়ত এই ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দিতে চাইবেন না, কিন্তু কবি তো চিরকালই আদর্শবাদের বাইরে থেকেছেন, “পৃথিবী যে সৃষ্টিকর্তার একটা ফাঁকি এবং শয়তানের একটা ফাঁদ তা না মনে করে একে বিশ্বাস করে, ভালবেসে, ভালবাসা পেয়ে, মানুষের মতো বেঁচে এবং মানুষের মতো মরে গেলেই যথেষ্ট”। দেবতা হতে চাননি কবি; আর আজ যখন পৃথিবীর সব আদর্শবাদের মৃত্যু ঘটছে একে একে, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্টবিজ্ঞানী সবাই যখন বলছেন প্রকৃতিবাদের কথা, তখন রবীন্দ্রনাথকে দেবতার থেকে কম কিছু মনে হয় না, কারণ তিনি তো সেই কবেই দেখেছেন বাঁচার মৌলিক উদ্দেশ্যটা, সত্যিকারের যাপন-কৌশলটা।   

শিলাইদহ, অক্টোবর, ১৮৯১ রোববারের ছিন্নপত্রে যে বাংলাদেশে ‘মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশী’ মনে হল কবির, সেখানেই পেয়ে যাই হয় এক আশ্চর্য দর্শন, “যেমন নানা দেশ দিয়ে নদী চলেছে, মানুষের স্রোতও তেমনি কলরব-সহকারে গাছপালা গ্রাম নগরের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চিরকাল ধরে চলেছে – এ আর ফুরোয় না। … মানুষও নানা শাখা প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে – তার এক প্রান্ত জন্মশিখরে, আর-এক প্রান্ত মরণসাগরে, দুই দিকে দুই অন্ধকার রহস্য, মাঝখানে বিচিত্র লীলা এবং কর্ম এবং কলধ্বনি;” প্রকৃতির মাঝে মানুষকে অনুভবের এই মনোমুগ্ধকর  কীর্তি ছিন্নপত্রের পাতায় পাতায়। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের ভাষায় এমন একজন জন্মেছিলেন যিনি প্রকৃতিকে এমনি করে পড়তে পারতেন, এত নিবিড় করে তার সঙ্গে কথা কইতে পারতেন, আর সেই কথা, সেই গুপ্তধনের রহস্যদ্বার খুলে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। 

কবির সঙ্গে প্রকৃতির প্রণয় তো রয়েছেই, কোথাও যেন কবি নিজেই প্রকৃতি। শিলাইদহ, অক্টোবর, ১৮৯১, সোমবারের ছিন্নপত্রে পাই “নদীতে একটি রেখা মাত্র ছিল না; ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে … মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূন্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্প এই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে, আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, … আমি যেন সেই মুমূর্ষু পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম!”  

প্রকৃতির নিঃশব্দ ক্রীড়ার মাঝে রবীন্দ্রনাথ সব কিছু খুঁজে পেয়েছেন। শিলাইদহ, ৭ এপ্রিল, ১৮৯২ সনে এক নদীঘাটে মেয়েদের কাপড় কাচতে, জল তুলতে, স্নান করতে এবং উচ্চহাস্যে গল্প করতে দেখেন। কবি আবিষ্কার করলেন, “মেয়েদের যেন জলের সঙ্গে বেশি ভাব। … জল ও মেয়ে উভয়েই  বেশ সহজে ছল্‌ছল্‌ জ্বল্‌জ্বল্‌ করতে থাকে – একটা বেশ সহজ গতি ছন্দ তরঙ্গ, দুঃখতাপে অল্পে অল্পে শুকিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আঘাতে একেবারেই জন্মের মতো দুখানা হয়ে ভেঙে যায় না। সমস্ত কঠিন পৃথিবীকে সে বাহুবন্ধনে আলিঙ্গন করে আছে…” 

কবির কাছে, ‘ছায়াময় নদীস্নেহবেষ্টিত প্রচ্ছন্ন’ বাংলাদেশটা মারামারি, হানাহানির জায়গা নয়, কারণ বাংলাদেশটা ‘বেশ নারকেল পাতার ঝুর্‌ঝুর্, কাঁপুনি, আমবাগানের ঘন ছায়া এবং প্রস্ফুটিত শর্ষে ক্ষেতের গন্ধের মতো – বেশ সাদাসিধে অথচ সুন্দর এবং শান্তিময়, অনেকখানি আকাশ আলো নিস্তব্ধতা এবং করুণতায় পরিপূর্ণ।“ জানি না, আমার দেশের এর থেকে সার্থক বর্ণনা হতে পারে কিনা। কিন্তু আমরা আমাদের না চিনলে সে আমাদেরই দুর্ভাগ্য! কবি যখন শিলাইদহে ৮ এপ্রিল, ১৮৯২ নদীর মাঝখানে বসেছিলেন, তখন ‘দুই দিকের দুই পার পৃথিবীর দুটি আরম্ভ-রেখার মতো বোধ হচ্ছে – ওইখানে জীবনের কেবল আভাস দেখা দিয়েছে, জীবন সুতীব্র ভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি; যারা জল তুলছে, স্নান করছে, নৌকো বাইছে, গোরু চরাচ্ছে, মেঠো পথ দিয়ে দিয়ে আসছে যাচ্ছে, তারা যেন যথেষ্ট জীবন্ত সত্য নয়!”প্রকৃতির মাঝে মানুষের এমন এক আদিম ছবির স্বপ্নই এঁকে গেছেন রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন।  

বোলপুর, ২ মে ১৮৯২, এর ছিন্নপত্রে একটি প্যারাডক্‌সে্‌র কথা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘যেখানে বৃহৎ দৃশ্য, অসীম আকাশ, নিবিড় মেঘ, গভীর ভাব, অর্থাৎ যেখানে অনন্তের আবির্ভাব সেখানে তার উপযুক্ত সঙ্গী একজন মানুষ…। অসীমতা এবং একটি মানুষ উভয়ে পরস্পরের সমকক্ষ, আপন আপন সিংহাসনে পরস্পর মুখোমুখি বসে থাকার যোগ্য!” যেখানে অনেক মানুষ সেখানে যতটুকু ফাঁক মেলে, মেপে মেপে ঠিক ততখানিতেই মাথাটা গলে দিতে হয়, ফলে দুই বাহু সম্পূর্ণ মেলে দিয়ে অঞ্জলি পূর্ণ করে প্রকৃতির প্রসাদ সবটুকু গ্রহণ করা একান্তই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়! একটি মানুষের মধ্যে পুরো প্রকৃতিকে ধরার এই যে ব্যাকুলতা, আকাঙ্ক্ষা, তার স্পর্শ ছিন্নপত্রের শিরায় শিরায়, অনুভবের বিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় উপত্যকায়। 

প্রকৃতির সঙ্গে এই যে সখ্যতা, তা যে একজনের একান্তই নিজস্ব, তার আরো একটি আশ্চর্য অনুভব ফুটে উঠে শিলাইদহ, ২ আষাঢ়, ১২৯৯ এর ছিন্নপত্রে। কবি লিখছেনঃ “সেই বিলেত যাবার পথে লোহিতসমুদ্রের স্থির  জলের উপর যে-একটি অলৌকিক সূর্যাস্ত দেখেছিলুম সে কোথায় গেছে। কিন্তু ভাগ্যিস আমি দেখেছিলুম, …. অনন্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি অত্যাশ্চর্য সূর্যাস্ত আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কবি দেখেনি!” এই যে সৌন্দর্য যারা তার স্বাদ পায় না, তারাই ইন্দ্রিয়ের নিরিখে বিচার করতে বসে যায়। কিন্তু ”…সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত; কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাক্‌, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না!”

শিলাহদহ, ১৬ জুন, ১৮৯২ এর ছিন্নপত্রে কবি লিখলেন, ‘মাঠের তৃণ থেকে আকাশের তারা পর্যন্ত … কেউ গায়ের জোরে আপনার সীমাকে অত্যন্ত বেশি অতিক্রম করবার জন্য চেষ্টা করছে না… প্রত্যেকে যেটুকু করছে সেটুকু বড়ো সামান্য নয়- ঘাস আপনার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ করে তবে ঘাসরূপে টিকে থাকতে পারে, তার শিকড়ের শেষ প্রান্তটুকু পর্যন্ত দিয়ে তাঁকে রসাকর্ষণ করতে হয়। সে যে নিজের শক্তি লঙ্ঘন করে বটগাছ হবার নিস্ফল চেষ্টা করছে না, এইজন্যই পৃথিবী এমন সুন্দর শ্যামল হয়ে রয়েছে।“ এরপর প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়ম, স্বর্নসূত্রকে যেন মানব সমাজে প্রতিফলিত করার চেষ্টা হল, ‘বাস্তবিক , বড়ো বড়ো উদ্যোগ এবং লম্বাচড়া কথার দ্বারা নয়, কিন্তু প্রাত্যহিক ছোটো ছোটো কর্তব্যসমাধা দ্বারাই মানুষের সমাজে যথাসম্ভব শোভা ও শান্তি আছে!” 

সাজাদপুর, ২৯ জুন, ১৮৯২। কবি বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে চেয়ারটি টেনে কালিদাসের বই হাতে বসেছেন, সেই কালিদাস যে কবিকে আগাগোড়া দখল করেছিল, যার রেফারেন্স বারবার এসেছে ছিন্নপত্রে। কিন্তু স্থানীয় পোস্টমাস্টার হঠাৎই উপস্থিত হল সেখানে, কবি তাকে চলে যেতে বলতে পারলেন না, কারণ “মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোস্টমাস্টারের দাবি ঢের বেশি ”রবীন্দ্রনাথের সব থেকে সার্থক ছোটগল্পটির একটি ‘পোস্টমাস্টার’-এর অনুপ্রেরণা এই লোকটিই। এই ছিন্নপত্রটি খুবই ব্যতিক্রমী, এই অর্থে যে, অন্য সবখানে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় প্রেমে মগ্ন কবিকে এই পত্রে পাওয়া যায় লৌকিক সত্তায়। 

রবীন্দ্রনাথ একবার ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন। শিলাইদহ, ২০ জুলাই ১৮৯২ এর ছিন্নপত্রে সে সম্পর্কে জানা যায়। গড়াই নদীর ব্রিজে তার বোটের মাস্তুল ঠেকে গেলে বোট উল্টে যেতে থাকে। অন্য একটি নৌকা অবশ্য দ্রুত দাঁড় বেয়ে কবিকে উদ্ধার করেন। পরে লোকজন যখন ভিড় করতে থাকে তাঁর চারপাশে, আর বলতে থাকে, “আল্লা বাঁচিয়ে দিয়েছেন, নইলে বাঁচবার কোনো কথা ছিল না,” তখন এক অত্যাশ্চর্য অনুভবের সঙ্গে পরিচিত হই আমরা, “সমস্তই জড়পদার্থের কান্ড কিনা – আমরা হাজার কাতর হই, চেঁচাই, … তখন যা হবার তা হবেই। জল এক মুহূর্তে থামল না, মাস্তুলও এক চুল মাথা নিচু করল না, লোহার ব্রিজও যেমন তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।” এই যে নিত্য প্রবহমান পৃথিবী, এই স্থান, কাল, পাত্র-পাত্রী, দৃশ্যকল্প, চিত্রাভিনয় – সব কিছুর জন্য দায়ী কে? বা, কেউ আছে আদৌ? যে-ই থাকুক, সেখানে কোন প্রাণ নেই, পরিবর্তন নেই; শুধু আছে নিয়ম, সূত্র, আর প্রথা। আর এই নিয়ম সূত্রের খাঁচা থেকে বেরিয়ে মুক্তির পরম স্বাদ নেয়ার মধ্যে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথকে, এই অনুভবের নামই রবীন্দ্রনাথ, সিন্ধু সেঁচে এমন মুক্তির মুক্তো তুলে আনলেই না আমি রবীন্দ্রনাথ! 

ছিন্নপত্র শেষ হয়েছে নীল আকাশ ও ধূসর পৃথিবীর পরে এক সোনার-চেলি-পরা বধূর অনন্ত প্রান্তরের মধ্যে মাথায় একটুখানি ঘোমটা টেনে চলার গল্প দিয়ে, যে “ধীরে ধীরে কত শতসহস্র গ্রাম নদী প্রান্তর পর্বত নগর বনের উপর দিয়ে যুগযুগান্তরকাল সমস্ত পৃথিবীমন্ডলকে একাকিনী ম্লাননেত্রে মৌনমুখে শ্রান্তপদে প্রদক্ষিণ করে আসছে।” কবি এই বৌটির বরকে জানতে চেয়ে শেষ করেছেন ছিন্নপত্র। বৌটি যে প্রকৃতি তা তো আভাসে বলেই দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বরটিও যে এক শক্তি, সুন্দরের অজেয় দেবতা, সে পাঠক ১৫৩ টি ছিন্নপত্র ভ্রমণ করে একটুখানি ধারণা পেয়েই গেছে।  

ছিন্নপত্রের পুরো পাঠ সম্ভব না, এটি একটি ছিন্ন পাঠ। ছিন্নপত্রের মাঝে পৃথিবীর তাবত দর্শন পোরা আছে, এর মধ্যে ধরণীর সব সৌন্দর্য ফুটে আছে, মাখানো আছে সব ভুবনের আনন্দ; আর তাই একে বারংবার পড়েও তলের দেখা মেলে না। কিন্তু মহাসমুদ্রে অবগাহন থেকে মানুষকে বিরত রাখা গিয়েছে কখনো? আর তাই ‘বাহির পানে চোখ’ মেলতে মেলতে ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়ে’ থাকা রত্নের খোঁজে ছিন্নপত্রের অতলান্তিক সাগরে মানুষের অভিযান চলবে চিরটা কাল! 

 
মোহাম্মদ কাজী মামুনের জন্ম ফরিদপুরে। শৈশবের আনন্দমুখর সময় কেটেছে মাদারিপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আর্থিক বিষয়াদির উপর প্রবন্ধ, লিখেছেন, সাহিত্য পত্রিকায় ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বাবার একটি ব্যক্তিগত ছোট লাইব্রেরী ছিল যার বই-পাঠ শৈশবেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে, আর কৈশোরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যোগযোগ সেই সাহিত্যপ্রেমকে আরো উস্কে দেয়। লেখালিখির মাধ্যমেই সমাজ-জীবনে নিজের ভূমিকাটি রেখে যেতে চান।

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • গীতা দাস , October 21, 2022 @ 12:45 pm

    লেখাটি সাহিত্য নিয়ে গবেষণাধর্মী ।লেখকেরঅন্য লেখার সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে লেখাটি বেশ ভালো। মূল পাঠে অর্থাৎ “ছিন্নপত্র” পাঠে বা পুনঃ:পাঠে আগ্রহ জাগাবেই।এখানেই লেখাটির সার্থকতা।লেখা অব্যাহত থাকুক।

  • Debasish Sengupta , November 8, 2022 @ 6:37 am

    লেখাটি গবেষণাধর্মী। মনোগ্রাহী। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় কথা অত্যন্ত যত্নে লেখা। কোথাও তাড়াহুড়ো নেই, থেমে যাওয়ার দায় নেই। এক কালজয়ী কবির কালজয়ী রচনাকে সামনে রেখে মনের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া। সেখানে ভালোলাগার প্রকাশ যেমন আছে তেমনই আছে আস্বাদনের বিস্ময়, অনুধাবনের তৃপ্তি। এমন লেখা বা প্রকাশ সাহিত্যের অঙ্গনে খুব জরুরী।

  • নয়ন বসু , November 8, 2022 @ 2:45 pm

    এটা তোমার সেরা তিনটে লেখার মধ্যে আসতে পারে। কারণ যে কোনো লেখার মূল অংশটুকু হলো লেখকের আবেগ, বিস্ময় এবং সত্য। ক্ষণিকা বা গীতাঞ্জলিতে এক কবিকে, এক ঋষিকে পাওয়া যায়। সত্যদ্রষ্টা কবি অনেকটা সামবেদের হোতা, তাঁর সঙ্গে একলা অন্তরীক্ষ ভ্রমণে যাওয়া চলে, জীবননদীর পাড়ে হাত ধরে চুপটি করে বসে থাকা চলে। কিন্তু ছিন্নপত্র, জীবনস্মৃতির লেখক একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাঁর কোমরে ব্যথা হয় এবং তিনি ছারপোকাকে ভয় পান। এনার সঙ্গেও শ্রদ্ধামিশ্রিত দূরত্ব আসে, কিন্তু এনার সঙ্গে দুটো সুখ দুঃখের গল্পও করা যায়। তুমি সেই বিস্ময়াহত পূর্নাঙ্গ মানুষটিকে ধরতে চেয়েছ। অনেকটাই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো হয়েছে। কিন্তু লেখার আন্তরিক খোঁজটুকু, মুগ্ধতাটুকু এবড়ো খেবড়ো জায়গাগুলো ভরাট করার অবকাশ পেয়েছে। সেজন্যই এতোবড় লেখাটা পড়ার সময় ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে না। আরেকটা কথা লিখেছিলাম, ব্যক্তিজীবনে ওনার বিচ্ছেদের জায়গাগুলো খুঁজো। সেখান থেকে বুঝতে পারবে ওনার মানবিক বিচ্ছেদজনিত যন্ত্রণা এবং সেখান থেকে উত্তরণের অতিমানবিক ক্ষমতা। একুশ থেকে একাত্তরের কবি অসংখ্যবার প্রিয়মুখ বিচ্ছেদের বেদনা পেয়েছেন। সাধারনত এই জায়গাগুলো নিয়ে আমরা কথা বলি না। তোমার প্রিয় মানুষ, সেজন্য বললাম, খুঁজে দেখো। চিনতে পারবে। আর সাহিত্য, শিল্প যাই বলো না কেন, সব তো এক অর্থে নিজেকে অন্বেষণেরই পন্থামাত্র, রবীন্দ্রনাথকে দেখলে আসলে নিজেকে চেনা যায়। বৃহদের ধর্মই তাই। নিজের ক্ষুদ্র পরিসরটুকুর আকাশসম উপলব্ধি। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়া। ওনাকে নয়, নিজেকে খুঁজে পেতে। “কী অপরিসীম ধৈর্য্য ছিল মানুষটার! সবাই রবীন্দ্রনাথ হয় না।” কেউই হয় না সত্যি বলতে। সেজন্যই তোমার লেখাটা পড়তে ভালো লাগে। মানুষ রবীন্দ্রনাথের অন্বেষণ। ভালো থেকো।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *