উপন্যাস 'কামসূত্র' এবং তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসঃ একটি আলোচনা
কামসূত্র দেবতোষ দাশের লেখা একটি থ্রিলার উপন্যাস এবং এটিকে একটি সিক্যুয়েলও বলা যেতে পারে। কয়েক বছর আগে এই লেখকের অপর একটি জনপ্রিয় বই ‘বিন্দুবিসর্গ’ এর পরবর্তী অংশ হল এই আলোচ্য উপন্যাসটি। তবে সর্বার্থে এটি ঠিক সিক্যুয়েলও নয়। কারণ ঘটনার পরম্পরা এক থাকলেও বদলে গেছে ঘটনা ও প্রেক্ষাপট। বিন্দুবিসর্গ পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে তুলনা করলে বলতে পারা যাবে থ্রিলার ঘরানার দিক থেকে দুটি উপন্যাসই কিছুটা সমগোত্রীয় হলেও কামসূত্র যেমন থ্রিলার তেমনই এটি প্রবলভাবে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। বিন্দুবিসর্গের চরিত্ররা এই উপন্যাসে উপস্থিত থাকলেও কামসূত্র পড়তে গিয়ে বিন্দুবিসর্গ না পড়া থাকলেও কোনো অসুবিধা হয় না, তবে পড়া থাকলে চরিত্রগুলো আরও কাছের বলে মনে হয়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কবীর খান, ডিকে অর্থাৎ ধরণী কয়াল, নিবেদিতা এবং দাওয়া লামা। কাহিনীর গতি দুর্দমনীয়। উল্কার বেগে ঘটনাবলী টেনে নিয়ে গেছে পাঠককে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
পড়তে পড়তে মনে হয় এই উপন্যাস রচনা করার সময় লেখক একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়েছেন। তাঁর ভাষা স্পষ্ট অথচ সংযত। ভাবনায় গতি আছে তবে আবেগের আতিশয্য নেই। কেবল একটি ক্ষেত্র ছাড়া, সেটা হল তিব্বতের অধিবাসীদের স্বাধীনতা হীনতার যন্ত্রণার বিবরণ-বর্ণনা। এখানে ঔপন্যাসিকের রাজনৈতিক চেতনার উদ্গীরণ দেখা যায়, আর পাঠকের এতে দ্বিগুণ লাভ। দেবতোষের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক চেতনা এখানে ছাপ রেখেছে। ছাপ রেখে গেছে তাঁর মনস্বীতা। লেখার ভাষা অনেক জায়গায় যেন ছবি এঁকেছে। একটুখানি অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা গেল না।
“হিমালয়ের কাঁখে তাঁর দেশ। বছরের অধিকাংশ সময় বরফের চাদরে মোড়া। তাদের ভাষায় পো-দিউল। বরফের দেশ। যখন রোদেলা হয় পাহাড়, গ্রীষ্ম আসে, পাহাড়ে পাহাড়ে রুক্ষ ঢালে গড়িয়ে চলে তাদের জীবন। সেইসব নুড়ি ও পাথর, জীবনের উপলখণ্ড নিতান্তই আটপৌরে। চাহিদাহীন। নীল আকাশ, সফেদ মেঘ আর হরিৎ বুগিয়ালের কোলে ছবির মতো লেপ্টে থাকে আটপৌরে গ্রামগুলো। চাষবাস কিছু হয় বটে, পশুপালনই প্রধান বৃত্তি ছোটো ছোটো জনপদের। অজস্র ইয়াক, ভেড়া আর বুনো তিব্বতি ছাগল চরে বেড়ায় সবুজ উপত্যকায়।
পাইন, বার্চ, তিব্বতি সাইপ্রেস, ওক, চাইনিজ জুনিপারসহ অসংখ্য সরলবর্গীয় গাছের মেলা। গাঁয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে রঙিন দার-চেন ধ্বজা। পাইন গাছ থেকে অপর প্রান্তের পাইনে ঝোলান অজস্র রঙিন লুংদার। কাষায় বস্ত্রাবৃত লামা গুরুগম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করেন মন্ত্র। ওঁ মণিপদ্মে হুঁ।”
দেবতোষ লিখেছেন চিনের দখলের লিস্টে আছে আরও বিস্তীর্ণ পরিধির অঞ্চল, যাকে বলা হয় চিনের ফাইভ ফিঙ্গার পলিসি। ফাইভ ফিঙ্গার অর্থাৎ নেপাল, লাদাখ, অরুণাচল, সিকিম ও ভুটান। সেটা যে মিথ্যা নয়, চিনের ধীর অথচ প্রবল আগ্রাসন নীতি আমাদের এখন সে সম্পর্কে ক্রমশঃ ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। সেদিন বুঝি আর দূরে নেই যেদিন শত্রু আমাদের ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলতে শুরু করবে। দেবতোষ এ কথা শুনিয়ে আমাদের শুধু সাবধান করেননি, বরং তিব্বতের সমাধানহীন অবস্থার প্রতি আমাদের আরও মনোযোগী করে তুলেছেন। বরফের দেশ তিব্বতের সমস্যা তখন হয়ে উঠেছে আমার আপনার ঘরের সমস্যা। এ উপন্যাসের চরিত্র তাই ঠিক থ্রিলারের নয়। এখানে আছে রাজনীতি, আছে তীব্র স্বদেশপ্রেম এবং আছে বিশ্বমানব প্রেমের ইঙ্গিতও। তিব্বতের অতীত ও বর্তমান ইতিহাসও এসেছে এ প্রসঙ্গে তবে তা থ্রিলার লিখতে গিয়ে যতটা দরকার ঠিক ততটা নয়, বরং তারচেয়ে ঢের বেশি করে এখানে এসেছে তিব্বতের অস্থিরতার প্রসঙ্গ।
এর আগে এমনটা আর কোনো বাংলা বইতে লেখা হয়েছে নাকি আমার জানা নেই। এইক্ষেত্রে দেবতোষই মনে হয় ঋত্বিক। তিনিই প্রথম পথ দেখালেন। লিখতে গিয়ে তিনি যে প্রচুর পড়াশুনো করেছেন তার প্রভাব উপন্যাসে স্পষ্ট। তবে তথ্য থাকলেও পড়তে অসুবিধা হয়নি বা একঘেয়ে লাগেনি। তথ্যগুলি বোঝা হয়ে চাপেনি একটুও।
তন্ত্রের একটি ব্যাখ্যায় কবীর খানের একটি উক্তি বিষয়ে বলা যেতে পারে ‘ভগবান’ কথার অর্থ হল যিনি ‘ভগ’ অর্থাৎ যোনিতে বান রূপী লিঙ্গ চালনা করেন, তিনিই ভগ-বান। এর নিদারুণ গভীর একটা অর্থ আছে। আমাদের কূটস্থ চক্রে সাধক জ্যোতি দর্শন করার সময় আলোকিত তিনকোণ বিশিষ্ট ত্রিকোণ-যোনি দর্শন করেন। সেখানে মধ্যস্থলে নীলকান্ত মণি সদৃশ আত্মনারায়ণ দর্শন হয়। সেখানে তখন হীরক খণ্ডের মত একটি নক্ষত্র দেখা যায়। তাকেই বামাক্ষ্যাপা বলেছেন তারা। সেই নক্ষত্রের ভেতর যিনি বানরূপ স্থিরপ্রাণকে স্থিত বা স্থির করতে পারেন তিনিই হলেন ভগবান। এর ফলেই জ্ঞানরূপী পুত্রলাভ হয়। তখনই তিনি প্রকৃত পুরুষ পদবাচ্য হয়ে ওঠেন। ভগবান এই কারণে সর্বদা পুংলিঙ্গ। তবে এখানে বাহ্যিক দুনিয়ার মতো কোনো নারী পুরুষ ভেদ নেই। স্থিতপ্রজ্ঞ নারী বা পুরুষ উভয়েই এই পদ প্রাপ্ত হতে পারেন।
তিব্বতের বর্তমান অবস্থান এবং বিশ্ব রাজনীতিতে তিব্বতের অবস্থান খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। ধর্মচেতনায় আচ্ছন্ন একটি নিরীহ শান্তিপ্রিয় দেশ ছিল তিব্বত। তীব্র আগ্রাসী মনোভাব সম্পন্ন চিন তিব্বতের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে অবস্থানগত সুবিধার জন্য তিব্বতের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। তিব্বত এখন চিনের সম্পত্তি। বিশ্বের তাবড় দেশের মাথারা এই ঘটনার নিন্দা করলেও তিব্বতের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি কোনো দেশ। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির সন্মিলীত আক্রমণের মুখে চিন হয়তো নতি স্বীকার করতো! কিন্তু নিঃস্ব ও শান্তিপ্রিয় তিব্বত দেশটির জন্য কেউই নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন করতে চায়নি। তাই তিব্বতিরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে পরাধীনতার দুর্ভাগ্য।
ভারত প্রাথমিকভাবে তিব্বতকে কিছুটা সহায়তা করলেও শক্তিশালী চিনের বিপক্ষে একা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই, তাই সেই উদ্যোগে ভারত সামিলও হয়নি। তিব্বতের অধিবাসীদের ইতিহাস তাদের বৌদ্ধধর্মের প্রতি যে ঐকান্তিক নিষ্ঠা সবই চিনের হস্তক্ষেপে ধীরে ধীরে আজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে তিব্বতের অনুবাদকেরা ভারতের সংস্কৃত ও পালি বহু প্রাচীন পুঁথিপত্রের অনুবাদ করেছিল। ভারতের রাজনৈতিক ডামাডোলে শক, পাঠান, মুঘল এমনকী হিন্দু শাসকেরাও এখানকার বৌদ্ধ পুঁথিপত্র বিনষ্ট করেছিলেন। সেইসব তাই বহুকাল আগেই ভারত থেকে হারিয়ে গেছে। একমাত্র তিব্বতের প্রাচীন বিহারগুলিতে সেগুলি সযত্নে সংরক্ষিত ছিল বহুকাল। চিনের ক্ষমতায়নের পর সে সবও প্রায় ধ্বংস হতে চলেছে। তিব্বতিরা তাদের ধর্মকে বাঁচাতে অনেক পুঁথিই নাকি আবার ভারতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। লাদাখ ও অরুণাচলের দুর্গম অঞ্চলে কিংবা তিব্বতের ধ্বংস না হওয়া কোনো প্রাচীন বিহারে এরকম অনাবিষ্কৃত কিছু পুঁথি এখনও থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।
এই বইয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে তিব্বতের আদি বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। তিব্বতে কীভাবে ও কেন ভারতের ভাষা অনুবাদ হয়েছিল সে কথা বলতে গেলে আমাদের আবার পিছন ফিরে তাকাতে হয় একবার। এক্ষেত্রে কিছুটা অতিরিক্ত সংযোজন বা আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বোধহয়। বিশেষত এটি যখন একটি পর্যালোচনা, তাই তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস এসে পড়ছে আলোচনায়। ভারতবর্ষের সঙ্গে তিব্বতের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল।
তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের সূচনা হয় খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে সেই সময় ৬১৭ থেকে ৬৫০ খৃষ্টাব্দে তিব্বতের রাজা ছিলেন স্রোং-সাং-গাম-পো। তিনি ছিলেন তিব্বতের তেত্রিশতম রাজা, এবং তিনিই সেখানে প্রথম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নেপাল ও চিনের কিছু অঞ্চল দখল করে নেন এবং সেখানে তাঁর রাজ্য বিস্তার করেন। প্রথা অনুযায়ী পরাজিত রাজ্যের রাজকন্যাকে বিবাহ করেন তিনি। এবং সেই অঞ্চলের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হন। চিনের রাজকন্যার নাম ছিল ‘হুম-শিন-কুন-জি’ এবং নেপালের রাজকন্যা হলেন ‘পাল-শহ-থি’। রাজকন্যা দুজনের কাছ থেকেই রাজা প্রথম জানতে পারলেন বৌদ্ধধর্মের কথা। চিনের রাজকুমারী চিন থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন শাক্যমুনি বুদ্ধের একটি মূর্তি। লাসাতে এটিই ছিল বুদ্ধের প্রথম মূর্তি। রাজা রাজকন্যার জন্য সেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির তৈরি করে দিলেন। তার নাম হল ‘রা-মো-ছো’। এরপর যখন নেপালের রাজকুমারী এলেন তিনি অক্ষভ্য’র মূর্তি নিয়ে এসেছিলেন। সেই মূর্তিকে ‘জো-খাঙ্’ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করা হল। রাজার নাম ‘গাম-পো’ থেকে মন্দিরগুলি বৌদ্ধ-গুম্ফা নামে পরিচিত হল।
এরপর রাজার আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। এবার তিনি বৌদ্ধবিদ্যা ও পুঁথি সম্পর্কেও জানতে আগ্রহী হলেন। তিনি রাজসভার বিদ্বান মন্ত্রী থোন্-মি-সম-ভোট্’কে ষোলোজন সঙ্গী সহকারে পাঠালেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষ হল সেই দেশ যেখানে তথাগত বুদ্ধের জন্ম হয়েছে এবং বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। তিনি থোন-মি সাম-ভোট’কে তিব্বতে শিক্ষার প্রচলনের জন্য লিপি তৈরি করার জন্যেও নির্দেশ দিলেন। থোন-মি বহু কষ্ট করে কাশ্মীর ও বঙ্গদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হলেন। অনেক বছর ধরে তিনি বৌদ্ধদর্শন এবং ধর্মের গূঢ়-রহস্য সম্পর্কে অবহিত হন ও ভারতীয় ভাষা ও ব্যাকরণ ইত্যাদি শেখেন। তদানীন্তন বাংলায় তখন তন্ত্রসাধনার বিশেষ প্রভাব ছিল। তিনি বাংলাবর্ণ ও কাশ্মীর প্রদেশ থেকে ব্রাহ্মীলিপির বর্ণমালা দেখে অনুপ্রাণিত হলেন। তাঁর নাম থেকেই তিব্বত ভোটদেশ হিসেবে খ্যাত হয়েছিল।
এরপর দেশে ফিরে ব্রাহ্মী ও বাংলা এই দুটি বর্ণমালা মিলিয়ে মোট উনত্রিশটি বর্ণের মাত্রাযুক্ত ‘উ-চেন’ বর্ণমালার সৃষ্টি করেন। বলা হয় ভারতে থাকার সময় তিনি ষোলোটি বর্ণ সৃষ্টি করেন বাকি কয়েকটি দেশে ফিরে গিয়ে করেন। এভাবেই প্রথম তিব্বতে বর্ণমালার উদ্ভব হয়। ভারতবর্ষে বসেই তিনি যে ষোলোটি বর্ণ তৈরি করেন, তা বাংলার বর্ণমালার সঙ্গে হুবহু এক।
তিনি পাণিনির ব্যাকরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ব্যাকরণ বই লেখেন, লিখিত তিব্বতি ভাষার নিয়ম ও প্রণালী তাতে বর্ণনা করেন। বইটির নাম হলঃ ‘সুম-ছু-দাগ-য়িগ’। রাজা সাধারণ মানুষের ভেতর শিক্ষার প্রসারের জন্য এরপরেই ভারতীয় গ্রন্থগুলির অনুবাদের আদেশ দেন।
এত চেষ্টার পরেও তিব্বতের আদি ও প্রাচীন ধর্ম ‘বোন্’ এর প্রভাবের ফলে তিব্বতিদের মধ্যে মন্ত্র, জাদু ও পাহাড় ও প্রকৃতিপুজো ইত্যাদি বিষয়ে কিছু লৌকিক বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। ফলে তখন তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে আরও একজন রাজা ‘থি-সাং-দে সাং’ তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেন তাঁকেই তিব্বতে বুদ্ধের মঞ্জুশ্রীর অবতার বলা হয়। তিনিই প্রথম অনুভব করেন ভারত থেকে বৌদ্ধ-আচার্যদের তিব্বতে আনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তিনি নালন্দা মহাবিহারের আচার্য শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। কিন্তু শান্তরক্ষিতকে ধর্ম প্রচার করতে বোন্ ধর্মের উপাসকেরা প্রচণ্ড বাধা দেন। তিনি তাঁর গুরুদেব পদ্মসম্ভবকে তখন তিব্বতে আহ্বান জানালে পদ্মসম্ভব তিব্বতের উগে প্রদেশে এসে পৌঁছান। সেখানে বোন্ ধর্মের উপাসকেরা কালো জাদুর মাধ্যমে তাঁকে বন্দি করে তুষারগুহায় লুকিয়ে রাখেন। দুমাস সেখানে ধ্যানমগ্ন থাকার পরে আপন সাধনশক্তির বলে সেখান থেকে তিনি উদ্ধার পেয়ে লাসাতে এসে উপস্থিত হন। এবার তিনি বোন্ পুরোহিতদের তাঁর নিজের সৃষ্ট ভয়ানক শক্তিশালী জাদু দেখান। এর ফলে তাঁরা পদ্মসম্ভবকে মেনে নেন। পদ্মসম্ভব তাদের বজ্রযানী তন্ত্রের কথা বলেন। তাঁরা সকলেই এতে মুগ্ধ হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এইভাবে পদ্মসম্ভবের সহায়তায় তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার হয়। তিনি রিন-পো-চে হিসেবে কথিত হন। তাঁকে তিব্বতে বুদ্ধের থেকেও শক্তিশালী বলে মনে করা হয়।
সপ্তম শতকে ভারতীয় পণ্ডিতেরা তিব্বতে ধর্মপ্রচারে গেলে তিব্বতি অনুবাদ শুরু হয়। প্রথম অনুবাদ শুরু হয়েছিল পদ্মসম্ভবের নেতৃত্বে সামিয়ে বিহারের দ্বিতলে। চারটি পর্যায়ে অনুবাদ হত। প্রতিটি পর্যায়ে একটি করে কার্যনির্বাহী দল থাকত। তাতে ভারতীয় পণ্ডিত এবং তিব্বতি লো-চা-বা’ রা থাকতেন। এভাবে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সংশোধন হত। তাই এই অনুবাদগুলি ভারতীয় মূলগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ হয়ে উঠত। অনুবাদ সাহিত্যে শিক্ষাক্ষেত্রে তাই তিব্বতি অনুবাদ বহুল সমাদৃত।
এরপর তিব্বতি রাজা লাঙ-দার-মা নামক একজন রাজার আমলে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের অন্ধকার যুগ শুরু হয়। তিনি বোন্ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তিনি তদানীন্তন রাজা রাল-পা-ছেন’কে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। তিনি তিব্বতের সমস্ত বৌদ্ধমঠ ও মন্দির বন্ধ করে দেন এবং সমস্ত পুঁথিপত্র পুড়িয়ে দেন। তিব্বতে এই রাজা লাঙ-দার-মা’কে মার অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রাজা ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের বিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। এরপর সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে একসময় এই রাজাকে হত্যা করেছিলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা ধর্মকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই একসময় এমন হিংসার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এরপর তিব্বতে বড় কোনো রাজার রাজত্ব ছিল না। অসংখ্য সামন্ত রাজ্য গড়ে ওঠে। সেই সময়ের একজন গুণী রাজা ছিলেন ইয়ে-সে-ওদ্। তিনি ভারতবর্ষে বাইশজন পণ্ডিতকে ধর্মশিক্ষার জন্য পাঠান। তাঁদের মধ্যে ‘রিন-চেন-জাঙ-পো’ এবং ‘লেগ্-বে-শেরাব’ ৯৭৮ সালে ভারতবর্ষ থকে শিক্ষালাভ করে তিব্বতে ফিরে আসেন। ‘রিন-চেন-জাঙ্-পো’ পরে বহু তন্ত্রের বইপত্র রচনা করেছিলেন। তিনি মোট তিনবার ভারতবর্ষে আসেন। পরবর্তীকালে তিব্বতরাজ চং-ছুপা’র আমন্ত্রণে ষাট বছর বয়সে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বত যাত্রা করেন। এখনও পর্যন্ত অতীশ দীপঙ্করের রচিত ও অনূদিত ২৪০টি গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি লাসার কাছে নার্থাৎ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এভাবেই ভারতীয় পণ্ডিতদের সহায়তায় মূলত তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই হল মোটামুটি তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন ইতিহাস।
দাওয়া লামার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা-প্রসঙ্গে কামসূত্রে এসেছে লামাদের ধর্মের সুরক্ষায় অস্ত্রধারণের প্রসঙ্গ। যার এমন অতি প্রাচীন ইতিহাস আছে। সব শেষে দাওয়া লামার জন্য পাঠকের মনে সমবেদনা জেগে উঠতে বাধ্য। স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল কেউ কি পরতে চায়? ভয় জাগানো তুষারচিতা কেতুকেও পাঠকের বেশ ভাল লেগে যায়। ভাল লাগে শব্দ নিয়ে কবীর খানের অভিনব বিশ্লেষণ পড়তে।
বইটি সম্পর্কে আমার অভিযোগ হল, উপন্যাসের তথাকথিত ‘কামসূত্র’ নামক পাণ্ডুলিপিটিকে নিয়ে। যদিও সেটি পরবর্তীকালে জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবুও বলবো সেখানে উপন্যাসটির ভাষা দুর্বল এবং জোর করে লেখা বলে মনে হয়েছে। বইটির অন্যান্য অংশের তুলনায় যেন কিছুটা আরোপিত এবং কৃত্রিম বলেও আমার মনে হয়েছে। যৌনতাও যেন সেখানে আমদানি করে আনা হয়েছে, এতটুকুও অনায়াসসাধ্য মনে হয়নি। আরও একটা বিষয় ঠিক মনে ধরেনি। তা হল, নিবেদিতাকে ভিক্ষুণী বানানোর অপচেষ্টা। সেটাও কেমন যেন কৃত্রিম মনে হয়েছে। অভিজ্ঞ সাংবাদিক হয়ে তার অনায়াসে শত্রুর ডেরায় একা এগিয়ে যাওয়াটাও আমার কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি বেশ সুখপাঠ্য। ইতিহাস ও রহস্য এখানে হাত ধরাধরি করে পথ চলেছে।
লেখকের কাছে ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রত্যাশা রইল।