নিষ্ঠাবান নাবিকের হাতে
সে কি একটা চরিত্র! কত চরিত্র আসে দৃশ্যপটে। বাবা নিয়ে লিখতে বসে দিশেহারা হই। কিন্তু এক অমোঘ বাবাকে আমি ভুলতে পারি না। সে বাবার আদল আপাতভাবে কমল মিত্রের মতো হলেও তাঁর ভেতরে পাহাড়ি সান্যালের ফল্গুধারা। তিনি হলেন ‘সাহেব’ ছবির উৎপল দত্ত অভিনীত ‘বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়’।
কেন তিনি? দায়িত্ব, কর্তব্যে অনড়, বটগাছের মতো বাবাকে তো আমরা কতই দেখেছি, পড়েছি। যে বাবা চান না ছেলে ফুটবল খেলুক, গান শিখুক, শিল্পী হয়ে উঠুক। বরং চান ছেলে পড়াশোনা করে একখানা চাকরি করুক। শখ-আহ্লাদকে পেশা করলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়, এমনটাই তাঁদের বিশ্বাস ছিল। এখানেও ঠিক তাই, বারবার বি এ পরীক্ষায় ফেল করে সাহেব এই ফুটবলের চক্করে পড়েছে। বাবা হতাশ হন – ওয়ার্থলেস ছেলে। গোলকিপার ছেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে গোল পোস্ট সামলায়! দিনের শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত পিতার মতোই মা-মরা ছেলের খোঁজ নেন। সাহেব ফিরেছে কি না, খেয়েছে কি না! সাহেব তাঁকে মনে করে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কিন্তু টাইগারের কোমল হৃদয় আবিষ্কার করার মতো ঘনিষ্ঠতা পিতার সঙ্গে তার হয়নি।
আর ঠিক এইখানটায় ওই সময়কার বাকি বাবাদের থেকে বিপ্রদাসবাবু আলাদা হয়ে যান। আমাকে যা সবচেয়ে মুগ্ধ করে তা হল মানুষ চিনে নেওয়ার ক্ষমতা। বড়ো বৌমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন তিনি। বিশ্বাস করেন নিজের সন্তানদের থেকে বেশি। সংসারের যাবতীয় হাল বড়ো বৌমার হাতে। কেবলমাত্র সেবা-যত্নের মধ্যে সে সম্পর্ক আটকে নেই। শ্বশুরমশাই বাড়ি, সংসার, সন্তানদের নিয়ে তাঁর চিন্তা-উদ্বেগ ভাগ করে নেন বৌমার সঙ্গে। পরামর্শ করেন সাংসারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। অতিরিক্ত খাটুনির জন্য তিনি ধমক দেন পুত্রবধূকে। অন্যদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার অন্যায় আপোষ দেখে নিজের ছোটো মেয়েকে ডেকেও তিরস্কার করেন। আবার কখনো অতিরিক্ত ভাবতে গিয়ে অজান্তেই আঘাত দিয়ে ফেলেন নিঃসন্তান পুত্রবধূকে। কিন্তু সব মিলিয়েই শ্বশুর-পুত্রবধূর সম্পর্কটি বাবা-মেয়ের চিরন্তন সম্পর্ক হয়ে ওঠে। শ্বশুরমশাই যখন বাবা হয়ে উঠতে পারেন, তখনই পিতৃত্বযাপনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
যাঁরা এমন পিতৃকূলকে দেখেননি, যাঁরা ভেবে এসেছেন এমন বাবার শাসনেই ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ যেতে হয় ‘কাঞ্চন’-এর মতো, তাদের ভাবনা বদলে যেতে থাকবে ছবি যত এগোবে। সাহেবের বাবার চরিত্রে উৎপল দত্তকে কাস্ট করাটা যে কী প্রচণ্ড সঠিক সিদ্ধান্ত তা নিয়ে কেউ কি দ্বিমত হবেন! শেডসগুলো তিনি ওই চরিত্রে এমন এনেছেন যে বুকের মধ্যে থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে… বাবা! সাহেব তো চচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্র! তবু ওই বাবা চরিত্রটি ছাড়া ছবি ফিকে। পরিচালক বিজয় বসুর ক্ষুরধার চলচ্চিত্র-মস্তিষ্ক ধরতে পেরেছিল ব্যক্তিত্বে, শরীরী ভাষায়, চোখের অভিনয়ে কে হয়ে উঠতে পারবেন সাহেবের চরিত্রের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা দৃঢ় অথচ স্নেহশীল বাবা। উৎপল দত্তের শরীরী ভাষায়, অভিনয়ে, পোশাকে, আচরণে যে প্রবল ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে, সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই চরিত্রটির অসহায়ত্ব দর্শকের বুকে এসে বাজে। এই জেন-নেক্সটের বাবাদের থেকে বিপ্রদাস আলাদা। এখনকার বাবা স্নেহ, ভালোবাসা, সন্তানের কৃতিত্ব সব প্রকাশ করেন, প্রচার করেন উল্লাসে। পিঠ চাপড়ে দেন নিজেরাই। তাতে হয়তো মনোবল বাড়ে সন্তানের। সন্তানের বুঝতে সুবিধে হয় বাবা আছেন সঙ্গেই, বন্ধুর মতো। আবার বড়ো বেশি দেখানেপনা, জাহির-করার অনিয়ন্ত্রিত আবেগ সংক্রমণের মতো মনে হয় মাঝমধ্যে। আর সাহেবের বাবা! সব আবেগ তাঁর লুকনো, শাসনটুকুই প্রকট। বড়ো বৌমা যে তার ছোটো দেওরকে প্রশ্রয় দেয় তাতে তিনি বাধা দেন না কিন্তু ফুটবল খেলে কি সাহেব টিকে যেতে পারবে বিবর্তনবাদের পরম্পরায়? নাকি অন্য দাদা-বৌদির ফাইফরমাশ খেটে ওর জীবন চলবে অক্ষম, অসহায়ের মতো? তিনি আশঙ্কিত! তাঁর প্রবল মর্যাদাবোধে আঘাত লাগে যখন সাহেবকে অন্য দাদা বৌদিরা সহজলভ্য মনে করে, অসম্মানজনক কাজ করায়। কিন্তু যেকোনো মূল্যে ছেলের প্যাশন, নিজস্ব চিন্তাধারায় বাধা দিতে হবে, ছেলে বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে না মেনে চললে তাকে ত্যাজ্য করতে হবে – পূর্বজ ঘরানার এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল সত্তরের শেষ কিংবা আশির দশকের বাবা সম্প্রদায়। সাহেবের বাবা রাশভারী হলেও পাষাণ-হৃদয় নন।
বিপ্রদাস ছোটো মেয়েকে উচ্চশিক্ষা দেন আবার বিয়ের জন্য নিজেকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ভাবেন। টাকার জন্য হন্যে হয়ে হাত পাতেন ছেলেদের কাছে। চিন্তায় অনিদ্রা, উদ্বেগ আসে। বাড়ি বন্ধক দিতে চান। এই ধরণের বাবা বিগত দু-তিন দশক আগে বিপুল সংখ্যায় ছিলেন। অনেক বৈপরীত্য ছিল তাঁদের চরিত্রে। এখন তেমন আর নেই মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে। ছোটো ছেলের চাকরির জন্য তদ্বির করেন সব জায়গায়। বি এ পাশ করলেই চাকরি পাবে, এই আশায় তিনি পরীক্ষার ফলাফলের গেজেট হাতে থরথর করে কাঁপেন। মেয়ের উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার খবর তিনি যেন জানতেন, তাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন না… কিন্তু সাহেব! নিশ্চিন্তির ঘেরাটোপে পৌঁছয় না সাহেব। সেও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে চায় কিন্তু পারে না! পারে না মন দিয়ে পড়াশোনা করতে, মাঠ তাকে ডাকে।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়, সাহেবের কোচের ভূমিকাও পিতৃপ্রতিম। কোচ লড়ে যান খেলোয়াড়-ছাত্র সাহেবের জন্য। তিনি বুঝতে পারেন সাহেবের প্রতিভা। সাহেবকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান, প্রাণিত করেন মাঠে এবং মাঠের বাইরে – এখনকার ভাষায় যাকে বলে পেপ টক। বাকি সবটুকু দর্শক এবং পাঠকের জানা।
‘সাহেব’ একটি মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি। মেলোড্রামাও যথেষ্ট। কিন্তু বিপ্রদাস মুখার্জির চরিত্র দর্শককে ছুঁয়ে যায়। ছুঁয়ে যায় তাঁর চরিত্রের স্তর। তখনকার সমাজ। মধ্যবিত্তের দায়। স্বপ্ন। আশা। আশাহীনতা। ভঙ্গুর পথে বাবা কেমন প্রখর, অবিচল, আবার অসহায় ডানা ভাঙা পাখি কিংবা শুকতারা খুঁজে ফেরা, সন্তানের, সংসারের মঙ্গল কামনায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল সমুদ্রে এক নিষ্ঠাবান নাবিক।
<অবসর পিতৃদিবস ইভেন্টে পুরস্কৃত লেখা>