রণথম্ভোরে জঙ্গল সাফারি
ছোটোবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা হত – পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল, কার কোনটা বেশি ভালো লাগে। অন্যদের কথা মনে নেই, কিন্তু আমি বরাবরই বলতাম – “সমুদ্র আমার সবচেয়ে ভালো লাগে।”
তখনও সমুদ্র দেখিনি আমি, শুধু ছবিতে দেখেছি, আর, মনে মনে ভেবেছি কবে দেখব সমুদ্র! কলেজে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেলাম দিঘায়। সেই প্রথম সমুদ্র দর্শন আমার। মুগ্ধতায় ভরে গেল ভেতরটা। তারপর একে একে পুরীর সমুদ্র, পণ্ডিচেরীর সমুদ্র দেখলাম। তবে অচিরেই সেই ভালোলাগা ফিকে হয়ে গেল। কারণ, ততদিনে পাহাড় গ্রাস করেছিল আমাকে। তারপর একসময় সেই পাহাড় ঢেকে গেল জঙ্গল-এ। এখন জঙ্গল বেশি টানে আমাকে। এক একটা জঙ্গলের এক একরকম আবেদন। ‘সুন্দরবন’ টানে একরকম। আবার উত্তরবঙ্গের গরুমারা কিংবা চিলাপাতা ফরেস্ট যেন একেবারেই আলাদা। আর, জঙ্গল মানেই বিচিত্ররকম জীবব্জন্তু দেখতে পাওয়ার একটা সম্ভাবনা। অন্তত তাদের দেখতে না পেলেও ওই যে একটা থ্রিল, এক্ষুনি বোধহয় কিছু দেখতে পাওয়া যাবে, সেটাই বোধহয় জঙ্গলের প্রতি আমার টানের কারণ। তাই ঠিক করেছিলাম, এবার রণথম্ভোর ফরেস্ট সাফারি করব। আমার একসময়ের কম্পিউটারের ছাত্র শুভকে বলাতে ও কথাটা যেন লুফে নিল সঙ্গে সঙ্গে।
শুভ ফরিদাবাদ থাকে। ওর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি অনেক জায়গায়। ফরিদাবাদেই ওর বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে দুর্গাপুজো কাটিয়েছি দু-দুবার। ওর সঙ্গে আমার এই বেড়ানোর ব্যাপারটা জমে ভালোই।
ভেবেচিন্তে চার পাঁচ মাস আগের থেকেই সাফারি বুকিং এর জন্য প্ল্যান করা হল মার্চের ১৫ থেকে ১৭ তারিখ। ফরিদাবাদ থেকে রওনা দেব শুভ’র সঙ্গে। তিন মাস আগে রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হল। কলকাতা টু নিউ দিল্লি। শুভ আসবে ফরিদাবাদ থেকে নিউ দিল্লি আমাকে রিসিভ করতে।
মাঝখানে অন্য আরেকটা ব্যাপার ঘটে গেল।
একটু আগের থেকেই বলতে হয় তাহলে। গত অক্টোবরেই আমাদের সাফারি বুকিং করে রেখেছিল শুভ। এই সাফারি বুকিং দু রকমের হয় – এক নম্বর, জিপসি গাড়ি করে যাওয়া। দু’নম্বর, ক্যানটারে যাওয়া। জিপসি ছোটো সাইজের এবং ক্যানটার বেশ বড় সাইজের। এই দুটোর মধ্যে জিপসিটাই বেশি থ্রিলিং। আর, শুভ বুক করেছিল সেটাই। বিকেলের দিকে। বিকেলের দিকে হওয়াতে মনটা একটু কেমন যেন হয়ে গেল। বিকেলের দিকে তো আলো কমে আসবে, বাঘ দেখা যাবে তো! শুভকে বলেওছিলাম আমার এই মন খারাপের কথা। শুভ বলেছিল, কিছু করার ছিল না। কারণ, সকালে বুকিং পুরো ভর্তি ছিল। যাই হোক, কী আর করা যাবে!
সম্ভবত শুভর মনেও একটু যেন খোঁচা লেগেছিল। কারণ, ও আমার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটাকে অত্যন্ত মূল্য দেয়। ১৪ তারিখ অর্থাৎ রণথম্ভোর যাওয়ার আগের দিন বিকেলের দিকে শুভর বাড়িতে ছিলাম আমার থাকার ঘরটাতে। কিছু একটা লেখালেখি করছিলাম। তখন মার্চ মাসের ইয়ার এন্ডিং-এর কাজ ওর পুরোদমে চলছে। দম ফেলার সময় নেই একদম। ও অন্য ঘরে নিজের কাজ করছিল কম্পিউটারে বসে। হঠাৎ এক সময় আমার ঘরে এসে একটু হেসে বলল, “১৬ তারিখ আমাদের সাফারি বুকিং বিকেলের দিকে।”
বললাম, “হ্যাঁ, তা তো জানি। তো?”
“চেষ্টা করছি সকালেও যদি একটা বুকিং করা যায়।”
আমি বসা অবস্থা থেকে একরকম দাঁড়িয়ে উঠলাম। বললাম, “সেটা করা যাবে? বললে তো সব ভর্তি। ইস কনফার্মড হয়ে গেলে বড়ো ভালো হয়।”
আসলে রণথম্ভোর আসার মূল উদ্দেশ্য তো বাঘ দেখা। বিকেলের সাফারিতে যদি তাদের দেখা না মেলে তবে সকালের সাফারিতে মিলতেও পারে। অর্থাৎ দুটো সাফারি বুকিং থাকলে সম্ভাবনা বেশি।
শুভ বলল, “ও অলরেডি যোগাযোগ করেছে। ওরা সন্ধের দিকে জানাবে।”
কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল না। সকালের সাফারি হল না শেষ পর্যন্ত। কী আর করা যাবে! চেষ্টা তো করা হল।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। অযাচিতভাবে চোদ্দ তারিখ বিকেলবেলা আমার ভাই বুকু (আমার থেকে দেড় বছরের ছোট) ওর কলকাতার অফিস থেকে ফোন করে জানাল, “শুনলাম তুই রণথম্ভোর যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, আগামীকাল ভোরবেলায় রওনা দিচ্ছি। আমি তো এখন শুভ’র বাড়িতে!”
বুকু চেনে শুভকে। বলল, “সাফারি বুকিং হয়ে গেছে?”
“সে তো হয়ে গেছে পাঁচ মাস আগে।”
“কোনটার করেছিস? সকালের না বিকেলের?”
“বিকেলের। কেন?”
“সকালের পেলি না?”
“না, সব ভর্তি।”
“যেতে চাস সকালে?”
বুকু প্রশ্ন করে চলেছে, আর আমি উত্তর দিয়ে চলেছি। কিন্তু শেষের প্রশ্নে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত! মানে! কী বলছে বুকু! সকালের বুকিং সব ভর্তি! আর, ও কিছুর মধ্যে নেই, অথচ যেন সবটাই ওর হাতে! আমি বেশ উত্তেজিত তখন।
তবুও সংযত হয়ে বললাম, “চেষ্টা তো করা হয়েছিল, কিন্তু …”
বুকু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুই যেতে চাইলে আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
বুকু কলকাতায় থেকে কীভাবে সব ব্যবস্থা করে দেবে, বুঝলাম না! আমি উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দে আত্মহারা!
বললাম, “কীভাবে?”
বুকু বলল, “আমার চেনাজানা লোক আছে। শুধু বল, তোরা কজন যাবি?”
বললাম, “আমি, শুভ, ওর স্ত্রী আর মেয়ে।”
বুকুর চটজলদি উত্তর, “তাহলে তোদের আধার কার্ড এক্ষুনি ফরওয়ার্ড করে দে আমার হোয়াটসঅ্যাপে।”
বুকু একটা প্রাইভেট সংস্থায় খুব উঁচু পজিশনে কাজ করে। বুঝলাম, ওর ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক কিছু করতে পারে। ফলে, আমি আর দেরি করলাম না। শুভকে বলাতে ওদের সকলের আধার কার্ডের ছবি ফরওয়ার্ড করে দিল আমার হোয়াটসঅ্যাপে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমারটা সহ ওদের তিনজনের আধার কার্ডের ছবি বুকুর হোয়াটস্যাপে পাঠিয়ে দিলাম। মিনিট পনেরোর মধ্যে বুকু প্রায় একরকম কনফার্ম করে দিল ১৬ তারিখ সকালের সাফারি বুকিং। ১৫ তারিখ সকালে কনফার্মড টিকিট চলে এল আমার হোয়াটসঅ্যাপে। জঙ্গল সাফারি জোন ২। আমি আনন্দে আত্মহারা তখন।
১৬ তারিখ ভোর পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটে গেস্ট হাউসের বাইরে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ফলে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম ভোর তিনটে নাগাদ।
ঠিক দুটো ৫৯ মিনিটে ঘুমটা ভেঙে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল অ্যালার্ম বেজে উঠল। প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। একটু লেখালেখি নিয়ে বসলাম। মোবাইলে গুগল সার্চ করলাম রণথম্ভোর জঙ্গল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে।
গুগল তথ্য অনুযায়ী রণথম্ভোর ফরেস্টে মোট দশটা জোন থাকে। জোন-১ ওয়ান থেকে জোন-১০। প্রত্যেক বছর এই পার্ক অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে খোলা হয়। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই পার্ক দেখার সবথেকে ভালো সময়। কারণ, এই সময়ের মধ্যে আবহাওয়া বন্যপ্রাণী সাফারির জন্য বেশ আরামদায়ক হয়। বাঘ দেখার উপযুক্ত সময় তাই অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। তবে অবশ্যই গ্রীষ্মের সময় দেখা যায় ভালোই। কারণ, প্রচণ্ড গরমের সময় তাদের প্রায়ই জলাশয়ের কাছে দেখা যায়। আমরা মার্চ মাস বেছে নিয়েছি এবং গাইডদের মতে এবং লোকমুখে প্রচলিত – জোন-২ এবং জোন-৪ বাঘ দেখার উপযুক্ত অঞ্চল। সেই হিসেবে আমাদের সকালের সাফারি ছিল জোন-২ অঞ্চল দর্শন এবং ওই একই দিনে বিকেলের জোন-১ দর্শন।
ঠিক ভোর ৫:৫০ নাগাদ আমি আর শুভ হোটেলের বাইরে এসে অপেক্ষা করলাম। ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে। বেশ ঠান্ডা। আমি হাফহাতা গেঞ্জি, ফুলহাতা জামা এবং সোয়েটার চাপিয়েছি গায়ে, কানটা ঢেকেছি একটা কান-চাপা দিয়ে, মাথায় গরম টুপি, গলায় মাফলার। বাঁদিকে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলছে। ভেতরে রয়েছে ক্যাননের ডিএসএলআর, আর, ছোটো একটা ডিজিটাল ক্যামেরা।
সামনে পিচের রাস্তা। সাঁই সাঁই করে ক্যানটার আর জিপসি ছুটে যাচ্ছে। বটল গ্রীন ক্যানটার গাড়িগুলো বেশ বড়ো। অনেক লোক ধরে। জিপসি গাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট, ৬ জনের বেশি ধরবে না। সবার লক্ষ্য রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্ক। দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো ক্যানটার বা জিপসিতে লোক ভর্তি, আবার কোনো কোনো ক্যানটার বা জিপসি আংশিক ভর্তি কিংবা একেবারে ফাঁকা। আমাদের সাফারি জোন-২’তে। আমরা এরকম একটা ক্যানটারের অপেক্ষায়।
৫:৫৫ কিংবা ছ’টা হবে, একটা ফাঁকা ক্যানটার রাস্তার ওপরেই ঠিক আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ি থেকে আমাদের ইশারা করল একজন স্বাস্থ্যবান লোক। বুঝলাম, ও-ই আমাদের গাইড। আমরা দৌড়ে কাছে যেতেই নাম জিজ্ঞেস করল। শুভ আমাদের নাম বলে দিল। গাইড ভদ্রলোক কাগজ দেখে নাম মিলিয়ে নিয়ে বাকিদের তাড়াতাড়ি ডাকতে বললেন। শুভ ওর স্ত্রী দীপাকে ফোন করল। দু’মিনিটের মধ্যে দীপা এবং ওদের মেয়ে এসে গেল। আমরা ক্যানটারে চেপে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িতে তখন শুধুই আমরা চারজন। বুঝলাম, বিভিন্ন স্পট থেকে এইভাবেই লোক তোলা হবে। সত্যিই তাই। কিছুদূর গিয়ে আবারও দাঁড়িয়ে গেল ক্যানটার। দুজন চলে এলো ছুটতে ছুটতে। এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যানটার ভর্তি হয়ে গেল লোকে। তারপর মেইন রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগল গাড়ি। একসময় টার্ন নিল ডানদিকে এবং দাঁড়িয়ে গেল একটা জায়গায়। দেখলাম, আরও কিছু ক্যানটার এবং জিপসি দাঁড়িয়ে আছে। লোকে লোকারণ্য। পাশেই চেকিং স্পট। সেখানে মিলিয়ে নেওয়া হয় ক্যানটারে বা জিপসিতে যারা যাচ্ছে তাদের নাম। ওখান থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেলে তখন আমরা জঙ্গল এরিয়াতে ঢুকতে পারি। আমাদের গাইড সেই কাজটা সেরে ফেললেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
জঙ্গল এরিয়াতে ঢুকে গেলাম আমরা। একটু বাদেই কোর এরিয়াতে প্রবেশ করলাম। দুপাশে বন্য গাছগাছালি, তার মাঝখানের সরু রাস্তা ধরে আমাদের ক্যানটার এগিয়ে চলছে সামনের দিকে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে। জঙ্গলের ভেতরে গাড়ির গতিবেগ বোধহয় এমনই থাকে। আমি ক্যামেরা বার করে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। সূর্য উঠে গেছে। কিন্তু জঙ্গল এরিয়াতে আলোর প্রবেশ কম। ফলে বেশ ভালো রকম ঠান্ডা অনুভব করলাম। চলার পথে ডানদিকে বাঁদিকে হনুমান আর বিভিন্ন জাতের হরিণের ছড়াছড়ি। আগের থেকেই ডিএসএলআর ক্যামেরায় বড়ো লেন্স (৭৫-৩০০) লাগিয়ে রেখেছিলাম। ডিজিটাল ক্যামেরাটা পকেটে নিয়ে নিলাম। আমাদের সামনে পেছনে আরও ক্যানটার চলেছে। সবারই লক্ষ্য বাঘ দেখা।
গাড়ি চলেছে। আমাদের গাইড গাড়ির মধ্যেই তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় আছেন। তার দৃষ্টি চারপাশে ঘুরছে। তেমন কিছু দেখতে পেলে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে। গাড়ি চলছে, একটু দাঁড়াচ্ছে, আবার চলছে, দাঁড়াচ্ছে। ক্যামেরা সেট করে আছি। বেশ দূরে উঁচুতে দুটো পাখি দেখলাম। কী পাখি জানি না, ছবি নিলাম।
একসময় সত্যিই গাড়িটা ভালোরকম দাঁড়িয়ে গেল। গাইড বলে উঠল, “একদম চুপচাপ থাকবেন। টাইগার বসে আছে সামনে।“ বলা মাত্র আমরা সকলে উঠে দাঁড়ালাম। প্রপার সেটিং সহ ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে আমি রেডি তখন। দেখলাম, একটা বাঘ বসে
আছে ঘাসের উপর। আমাদের গাড়ি থেকে ২০-২৫ মিটার দূরে। তবে বাঘের শরীরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। আমরা সবাই তখন উত্তেজনায় ফিশফিশ। কিন্তু এত লোকের মিলিত ফিশফিশ বোধহয় কিছু শব্দ সৃষ্টি করে। আমি নতুন করে মোবাইলের ম্যানুয়াল সেটিং-এ তখন ব্যস্ত। বাঘটার বোধহয় কিছুটা বিরক্তি হল। সেটা বোঝা গেল একটু বাদেই। সে উঠে পড়ল জায়গাটা থেকে। তারপর গদাইলশকরি চালে ঢুকে গেল সেখান থেকে ১০ ফুট দূরত্বে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। তারপর সেখানে গিয়ে নিরাপদে বসল। তাকে ভালো দেখা যাচ্ছিল না তখন। গাইড বলে উঠল একটু বাদেই, “খেয়াল করুন, ওই বাঘটার পাশেই একটা বড়োসড়ো বাঘ চুপটি করে শুয়ে আছে। ওটা হচ্ছে বাঘিনী। তারই বাচ্চা এই বাঘটা, যেটা এতক্ষণ দেখলেন।”
ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে তাদের কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র।
আমাদের সামনে একটু দূরে আরও দুটো ক্যানটার দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবারই দৃষ্টি তখন ঝোপঝাড়ের আড়ালে থাকা বাঘিনী এবং তার সন্তানের দিকে। একটু যদি তারা নড়াচড়া করে তবুও মনের শান্তি হয়। একটু ছবি তোলা যায়।
ক্যানটারটা মাঝে মাঝে আগুপিছু করছে ঠিক পজিশন নেওয়ার জন্য। কখনও বাঘের লেজ কিংবা পিঠের একটা অংশ দৃশ্যমান হচ্ছে, তাও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে। ফলে মন ভরছে না যেন। আমি কখনও ডিজিটাল আবার কখনও ডিএসএলআর ব্যবহার করছি। কিন্তু অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে। এইভাবে কেটে গেল ঘন্টাখানেক। তারপর ফেরার পথ ধরা হল।
গাইড সম্ভবত কিছুটা অতৃপ্ত। থেকে থেকেই বলছেন, “এমনও হয়েছে পাঁচ-ছটা সাফারি করেও অনেকে বাঘ দেখতে পায়নি, আমরা তো তবুও…!” আবার কখনও বলছেন, “দারুণ গরমের সময় বাঘ দেখার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, এখন তো ঠান্ডা চলছে…”
এইসব কথা হচ্ছে, আর গাড়ি চলছে। মানে, ফেরার পথে আমরা তখন।
গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ করে। সামনে ছোট্ট একটা গোলাকৃতি জলাশয়। গাইড বলে উঠলেন, “চুপ চুপ!” আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়লাম ক্যামেরা নিয়ে। গাইড বললেন, ডানদিকে তাকান। দেখলাম, একটা বিশাল বাঘ সামান্য আওয়াজ করে একটু গা-ঝাড়া দিল। আমাদের মধ্যে একজন বলল, “ওই তো, বাঁদিকে গাছের আড়ালে আরেকটা!” সবার চোখ তখন সেইদিকে। একটু বাদেই প্রথম বাঘটা দ্বিতীয় বাঘটার ওপর গিয়ে পড়ল। বোধহয় খেলছে ওরা। আমাদের সকলের বোধহয় দম-বন্ধ করা অবস্থা তখন। চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখেছি অনেকবার, কিন্তু মন ভরে না তাতে। জঙ্গলের বাঘের চেহারাই অন্যরকম।
গাড়িটা একটু ঘুরিয়ে অন্য জায়গায় রাখা হল, যদি-বা আরেকটু ভালোভাবে দেখা যায়। আগের তুলনায় এই জায়গাটা আরও ভালো। তবে একেবারে পরিষ্কার দৃশ্যমান নয়। গাছের আড়ালেই কিছুটা অংশ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা হল সেখানে। তবে ওদের লীলাখেলা তেমন আর দেখা গেল না। সময় বোধহয় ফুরিয়ে আসছিল। গাইডের মুখে তখন যেন কিছুটা তৃপ্তির হাসি। এক ট্রিপে দুবার তো অন্তত দেখানো গেছে!
জঙ্গল সাফারি – জোন-১
——————————
সকালের সাফারি শেষ করে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নিলাম। কারণ, বিকেলে জোন-১-এ সাফারি ভিজিট আছে। দুপুর দুটোর সময় রেডি থাকতে বলেছে।
দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট নাগাদ শুভ ডোরবেল বাজালো আমার ঘরের। দরজা খুলতেই বলল, “গাড়ি এসে গেছে, হোটেলের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে।” বললাম, “বাবা! এ তো ভয়ানক পাংচুয়াল!”
“হ্যাঁ, খুব তাড়া দিচ্ছে।”
আমি তৈরি ছিলাম। হোটেলের গেটের সামনে চলে গেলাম। দেখলাম একটা জিপসি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। শুভ ওর মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দীপা কই? শুভ বলল, “ও যাবে না। শরীরটা ঠিক নেই ওর।”
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই তো আমরা একটা সাফারি করে এসেছি। ফলে একটু ক্লান্ত থাকা স্বাভাবিক। তবে আমি তো উশুল করে নিতে চাই যতটুকু সম্ভব।
আমরা তখন গাড়িতে ওঠার অপেক্ষায়। এবার জিপসি। সেটাতে ম্যাক্সিমাম ছ’জন চাপতে পারে। সামনের সিটে তিনজন, পেছনের সিটে তিনজন। ড্রাইভারের পাশের সিটে গাইড। সকালের গাইড ছিল বেশ হাসিখুশি। কিন্তু এই গাইডকে দেখে আমার তেমন মন ভরল না। কেমন যেন খটমটে মনে হল। বেড়াতে যাওয়ার সময় এমন গম্ভীরমুখো মানুষ দেখলে ভেতরের চার্জটা যেন কমে যেতে থাকে। বোধহয় ওর প্রতি আমার ভাবনা ট্রান্সমিটেড হয়েছিল ওর মধ্যে। শুভ এবং ওর মেয়ে পেছনের সারিতে বসেছিল। আমি সামনের সারিতে উঠতে যাচ্ছিলাম। গাইড সাহেব বসেছিলেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। বোধহয় আমার মাথার পাকাচুল দেখে বেশ খটমটে ভাষায় বললেন, “আপনি পেছনে চলে যান।”
তাই গেলাম অগত্যা। আমাদের জিপসিতে আরও দুজনকে তোলা হবে। বোধহয় তাদেরকে সামনের সারিতে পেতে চাইছে গাইড সাহেব।
দুপুর রোদে ঝলমল করছে চারিদিক। গাড়ি ছুটছে তীব্র গতিতে। আমি একটা সোয়েটার পরে আছি, কিন্তু গরম বোধ হচ্ছে না। বরং আরামই লাগছিল। জঙ্গলে ঢোকার মুখটা এসে গেল কিছুক্ষণ বাদেই। এখান থেকেই ডানদিকে বাঁক নেওয়ার কথা ছিল, যেটা সকালে হয়েছিল। কিন্তু তা হল না। সেটা ছাড়িয়ে আমরা আরও এগিয়ে চললাম সামনে। তার মানে, আরও দুজনকে তোলা হবে! ভাবলাম, এত দূরে থাকে সেই দুজন, একেবারেই আমাদের উল্টো রাস্তায়!
প্রায় আড়াইটা নাগাদ আমরা এলাম সেই অজানা দুজনের গেস্ট হাউসে। গাইড গাড়ি থেকে নেমে ওদের খুঁজতে গেল। আমরা গাড়িতেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদে গাইড ফিরে এসে বলল, “ওদের খুঁজে পাওয়া গেল না!”
এমনও হয় তাহলে! ওরা তো নিশ্চয়ই ফুল পেমেন্ট করেছিল আমাদেরই মতো! যাই হোক, জিপসিতে আমরা তিনজন শেষমেষ। গাড়ি ছুটল শুধু আমাদেরকে নিয়ে।
পথে দুটো জলের বোতল কিনে নিলাম। একটা স্প্রাইট, কয়েকটা চিপসের প্যাকেট। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম জঙ্গলে ঢোকার চেকিং কাউন্টারে। আমাদের খটমটে গাইড নেমে গেল তার কাগজপত্র নিয়ে পারমিশনের জন্য। বিশাল লম্বা লাইন। অনেক সাধারণ মানুষ লাইনে। সকালে এতটা ভিড় দেখা যায়নি, বোধহয় খুব সকাল ছিল বলে। তবে গাইডদের জন্য বোধহয় আলাদা ব্যবস্থা থাকে। আমাদের জিপসির চারপাশে তখন রণথম্ভোরের বাঘ-মার্কা টুপি বিক্রি হচ্ছিল। সকালের সাফারিতেও এরকম টুপি বিক্রি হয়েছিল। কিনিনি তখন। পরে আপশোশ হচ্ছিল ভেতরে। এখন আর দেরি করলাম না। কিনে নিলাম একটা ১৫০ টাকা দিয়ে। রণথম্ভোরের একটা স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাক।
গাইড তার প্রয়োজনীয় কাজ সারতে অনেক সময় নিল। ও চেষ্টা করছিল, আরও দুজনকে (যে দুজন যেতে পারল না তাদের বদলে) যদি নেওয়া যায়। বোধহয় ওদের আর্থিক কিছু লাভ হয় তাতে। কিন্তু পেল না কাউকে। তারপর গাড়ির কাছে এসে নিজেই হাসতে হাসতে ড্রাইভারকে বলল, “জোন-১-এ কেউ যেতে রাজি হল না।” তখনই বুঝলাম, এবার বোধহয় বাঘ দেখার আশা নেই। সবাই বুঝে গেছে। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস, সকালে জোন-২ সাফারি করতে পেরেছি! সবই বুকুর দৌলতে। শুভকে বললাম সেকথা। ও বলল, “আমার বিশ্বাস, জোন-১-এ আমরা বাঘ দেখতে পাব।” মনে মনে বললাম, “শুভ, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক।”
চেকিং কাউন্টার ছেড়ে আমাদের জিপসি তীব্রগতিতে ছুটল এবার কোর এরিয়ার দিকে। দুপুর তিনটে বেজে গেছে তখন। উল্টোদিক থেকে হাওয়া ধাক্কা মারছে ভালোই। হঠাৎ একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমার মাথার টুপিটা উড়ে গেল হাওয়ার দাপটে। রণথম্ভোরের স্মৃতিচিহ্ন জন্য মুছে যাবে, তা কি হয় এত সহজে! আমি হই হই করে উঠলাম, “আমার টুপি উড়ে গেল!”
গাড়ি থামিয়ে দিল ড্রাইভার সাহেব। বেশ অনেকটা দূরেই গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল। অন্য সময় হলে আমি নিজেই লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতাম টুপি আনতে। কিন্তু জঙ্গল এরিয়াতে সেটা করা খুব রিস্কি। ফলে গাড়ি ব্যাক করল আস্তে আস্তে। গাইড ভদ্রলোক নেমে টুপিটা এনে আমার হাতে দিলেন। একটু যেন ধারণা পাল্টালো ভদ্রলোকের সম্পর্কে।
কোর এরিয়াতে ঢুকে গেলাম একটু বাদেই। তারপর জোন-১-এর মুখটাতে এসে গাড়ি দাঁড়াল। ওখানে সিকিওরিটির লোকের সঙ্গে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এবং গাইড গাড়ি থেকে নেমে কিছু কথা বলতে গেল। আর, তখনই ঘটল আবার একটা মজার ব্যাপার। একটা হাড়িচাচা পাখি আমাদের গাড়ির রডের ওপরে এসে বসল। কলকাতায় যে-অঞ্চলে আমি থাকি সেখানে এই পাখি মাঝে মাঝে দেখা যায় বটে, কিন্তু অনেক দূরে কোনো গাছে বা কারুর বাড়ির কার্নিশে। জুম করে ক্যামেরায় ছবি তুলেছি বটে। কিন্তু এক হাত দূরত্বে চুপটি করে এসে বসবে, এমন দৃশ্য দুর্লভ। কী মনে হল, হাতে চিপস ছিল, সেটা সামনে ধরতেই পাখিটা হাত থেকে কুটুস করে খেয়ে নিল। আমরা এক্সাইটেড তখন। শুভ আর শুভ’র মেয়ে বসুধারাও মজা পেয়ে গেল দারুণ। তারাও হাতে চিপস ধরাতে দুতিনটে হাড়িচাচা কোথা থেকে চলে এসে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে গেল চিপসগুলো। দুএক মিনিট এই মজার খেলা চলল বেশ। গাইড এবং ড্রাইভার সাহেব এসে উঠে পড়লেন গাড়িতে।
জোন-১-এর ঠিক পাশে এবং উলটোদিকে আরও দুটো জোন দেখতে পেলাম। এইরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও কত জোন আছে এই বিশাল জঙ্গলে। ভাবতে অবাক লাগে বাঘেরা কেমন করে তাদের পছন্দমত জোন বেছে নেয়, কে জানে! এই জোন নির্বাচন কি তারাই করে থাকে নাকি মানুষের হাত রয়েছে এটাতে! এর সঠিক উত্তর আমার জানা নেই।
জোন-১-এ ঢুকে গেছি। গাড়ি চলছে কখনো ধীরে কখনো একটু বেশি গতি নিয়ে। চারপাশটা দেখছিলাম বড় বেশি রুক্ষ। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই বললেই চলে। অথচ জোন-২ ছিল বেশ সবুজে ভরা। এরকম কেন হয় কে জানে! গাড়ি চলছে, আর, চারদিকটা দেখে মনে হচ্ছিল, একটা ভয়ংকর ঝড় যেন বয়ে গিয়েছিল গত রাতে। ডালপালা সব ভাঙ্গা, ছিন্নভিন্ন অবস্থা। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। লম্বা লম্বা গাছ ন্যাড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কালের মতো। ২০২০ সালের ২০ মে যে ‘আম্ফান’ বয়ে গিয়েছিল, সেটার কথা মনে এল তখন।
হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। ঠিক বুঝলাম না। গাইড সাহেব বললেন, বাঁদিকে দেখুন। কী দেখব, কিছু তো নজরে আসছে না। গাইড বলল, দূরে ওই গাছের গর্তটায়। শুভ বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা প্যাঁচা। দুর্দান্ত চোখ বটে! প্রায় ২৫-৩০ মিটার দূরত্বে রয়েছে বাছাধন! জুম করে ছবি নিলাম।
মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ধরনের হরিণের দেখা মিলছিল। স্পটেড ডিয়ার, বড় শিংওয়ালা হরিণ, কখনো-বা ধূসর বর্ণের কিছু একটা। সামনে-পেছনে কোনো জিপসি বা ক্যানটারের দেখা নেই। বোধহয় কেবলমাত্র আমরাই জোন-১-এ ঢুকেছি। তবে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য এই জঙ্গলের, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এইভাবে বেশ
কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের জিপসি একটা বিরাট গোলাকৃতি জলাশয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সামনে তখন আরেকটা জিপসি উল্টো দিক থেকে এসে আমাদের পথ আগলে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। আমাদের জিপসির ড্রাইভার এবং গাইড উল্টোদিকের জিপসির ড্রাইভার এবং গাইডের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। যেন কারুরই কোনো তাড়া নেই। বিরক্তি লাগছিল পুরো ব্যাপারটাতে। প্রত্যেক মুহূর্তে ভেবে চলেছি, এই বুঝি ওদের গল্প শেষ হবে, আমরা আবার সামনে এগোবো। কিন্তু ওদের যেন গল্পতে পেয়েছে। ওদের এইভাবে সময় নষ্ট করার কি কোনো মানে হয়? আমি শুভকেও বললাম কথাটা। ও কিছু একটা বলল ড্রাইভারকে। কিন্তু ওরা যেন শুভ’র কথা শুনেও তেমন কিছু রিঅ্যাক্ট করল না। দূরে নজরে এল, দুটো ক্যানটার দাঁড়িয়ে। কেনই বা এরকম দাঁড়িয়ে বুঝলাম না। চারপাশটা ভারী সুন্দর, নিস্তব্ধ, নির্জন। মাঝখানে ওই গোলাকৃতি বিরাট জলাশয়। দু-একটা অজানা পাখি এল জল খেতে। কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল, একটা সম্বর হরিণ জলাশয় থেকে ১০-১৫ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আর, বেশ সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে। তারপর অত্যন্ত সাবধানী এবং ধীর পদক্ষেপে এক পা এক পা করে জলাশয়ের কাছে যাচ্ছে। বুঝলাম, ও বেশ ভয়ে আছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল, এই জলাশয়ে বাঘ জল খেতে আসে, তাই সম্বরের এই সাবধানী পদক্ষেপে হেঁটে আসা। আশপাশে তখনই নজরে এল, আরও দু তিনটে ক্যানটার এসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার আমাদের জিপসির দাঁড়িয়ে থাকার কারণটা বুঝতে পারলাম। সময় তখন চারটের কাছাকাছি। তার মানে, এই বিকেলের দিকেই বাঘের এই জলাশয়ের কাছে আসার সম্ভাবনা।
বোধহয় প্রায় এক ঘন্টার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম জলাশয়ের কাছটাতে। কিছু পাখি দেখলাম, কিন্তু বাঘের দেখা মিলল না। একসময়, বিকেল পাঁচটা হবে তখন, ফেরার পথ ধরলাম। বুঝলাম, এ যাত্রা আর বাঘ দেখা সম্ভব নয়। ফিরে চললাম। তবে জঙ্গল এরিয়াতে বুঝি দেখার শেষ নেই। হনুমানের দেখা মিলল প্রচুর।
চলতে চলতে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল দুম করে। সবাই উঠে দাঁড়ালাম। বিকট দর্শন কী যেন একটা পড়ে রয়েছে সামনে। ঠিক বুঝলাম না। সম্ভবত কোনো এক গাড়ির তলায় চাপা পড়ে অদ্ভুত দর্শন প্রাণীটির এই অবস্থা!
ফেরার পথে কয়েকটা ক্যানটারকে আসতে দেখলাম আমাদের দিকে। একসময় তারা ছাড়িয়ে গেল আমাদেরকে। আমরা হাত নাড়লাম। ওরাও হেসে হাত নাড়ল। শুভকে বললাম, “দেখেছ, ওরা কিন্তু এখনও আশা ছাড়েনি বাঘ দেখার। নিশ্চয়ই ওরা জলাশয়ের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করবে। আর, আমরা ফিরে চলেছি!”
মজা করে বললাম শুভকে, “এদের কারুর সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যতে যেন দেখা না হয়।”
শুভ বলে উঠল, “কেন?”
হেসে বললাম, “দেখা হলে কেউ যদি বলে আমরা বাঘ দেখেছি, তাহলে আমাদের দুঃখের সীমা থাকবে না।”
শুভ হাসল আমার কথায়।
একটু অতৃপ্তি তো থেকেই গেল, যদিও সকালের সাফারিতে জোন-২-তে আমরা বাঘ দেখতে পেয়েছি। যারা চার পাঁচটা সাফারি করেও বাঘ দেখতে পাইনি, আমরা সেই তুলনায় নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। তাছাড়া, একটু অতৃপ্তি থাকা বোধহয় জীবনে খুব দরকারি। কারণ, ‘সব পেলে নষ্ট জীবন’ – এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে খুশি থাকলাম মনে মনে।
2 Comments