বর্ষায় নির্জন সৈকতে

বর্ষায় নির্জন সৈকতে

“আমি শুনেছি সেদিন তুমি 
সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো। 
আমি শুনেছি সেদিন তুমি 
নোনাবালি তীর ধরে 
বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছো। 
আমি কখনো যাইনি জলে,
কখনো ভাসিনি নীলে
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে। 
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে,
আমাকেও সাথে নিও
নেবে তো আমায় বল নেবে তো আমায়?”

বাড়ির কাছের দীঘা-পুরী হোক কিংবা মুম্বাই, গোয়া, কেরালা, আন্দামান, ভাইজ্যাগ, কন্যাকুমারী অথবা বিদেশের পাটায়া – বেশ কয়েকবারই সমুদ্রস্নান, সাদা কিংবা হলদে বালির সমুদ্রতট ধরে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছে।  যেখানেই গিয়েছি যতবার গিয়েছি প্রত্যেকবারই সমুদ্র নতুন নতুনরূপে ধরা দিয়েছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে না,  এভাবে তো আগেরবার পাইনি তাকে! আবার যেতে হবে তার কাছে নোনা হওয়ায় ভিজতে…

কাজের ফাঁকে দৈনন্দিন জীবনের একটু অবকাশেই সমুদ্রের কাছে ছুটে যাওয়া এক সময় নিয়মিত অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রের কাছে যতবারই গেছি একাত্ম হয়েছি তার সঙ্গে। সমুদ্রের শান্ত জলরাশি দেখে কিংবা চিত্ত শুদ্ধ করে দেওয়া হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কবির মতোই অন্তরে বেজে ওঠে “অরূপ তোমার বাণী অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি।” বেশ কিছুদিন পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে মনে হল বহুদিন সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি না। নির্জনে ছড়ানো-ছিটানো পাথরগুলোর উপর বসে বিন্দু বিন্দু জলকণা স্নেহধারার মতো ঝরে পড়বে চোখে, মুখে, সারা দেহে – সেই অনুভুতি পাচ্ছি না। ফেনিল ঊর্মিমালার লবণাক্ত জলে আরাম করে পা ভেজাই না। নরম বালিতে নগ্ন পদে হাঁটতে হাঁটতে সাগরের জলকণায় সিক্ত বাতাসের স্পর্শ মাখি না। ‘সমুদ্র’ শব্দটা শুনলেই প্রত্যেক সমুদ্রপ্রেমী মানুষের মানসপটে ভেসে ওঠে দিগন্তবিস্তৃত স্বচ্ছ সফেন নীল জল, সাদা কিংবা সোনালী বালুতট, নারকেল অথবা ঝাউগাছের সারি। দিগন্তে সমুদ্রের নীলের সঙ্গে মিশে গিয়ে মেঘহীন নীল আকাশ অথবা কালো মোষের মত মেঘময় সমুদ্র সৈকতে প্রিয় মানুষটির পাশে বসে নিস্তব্ধতাকে উপভোগ করতে করতে হারিয়ে যাওয়া এই অনাবিল সুখানুভূতিতে বিভোর হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমিও হয়েছি বারবার। কিন্তু এবার সমুদ্র মানে থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়-এর মত সেই একঘেয়ে দীঘা-মন্দারমনিতে যেতে মন চাইছিল না কিছুতেই। চাইছিলাম একটু নির্জন কোন সাগরপাড়। সাগর তো অবিরাম ডাকেই আয় আয় বলে, কিন্তু ছোট্ট দুদিনের ছুটিতে কোথায় যাব? পুরী-দিঘা-মন্দারমনিতে তো থইথই করবে লোক! কিন্তু এমন এক জায়গায় যেতে চাই যেখানে ভিড় এড়িয়ে থাকা যাবে, কিন্তু মনোরম সকাল,পড়ন্ত বিকেল, সাঁঝবেলা আর রাতেরবেলায় সে শুধুই বলবে – it’s all yours. যেখানে কোনো মনিহারি দোকান, কোনো ঝালমুড়ি, ফুচকাওয়ালা বা মাছভাজার দোকান থাকবে না, কানের কাছে সারাক্ষণ কেউ “চায়ে চায়ে” বলে হাঁকডাক করে অস্থির করে তুলবে না। সেখানে থাকবে শুধু অন্তহীন ঢেউ ভাঙার শব্দ আর ঢেউ গোনার অবসর, নীলচে সমুদ্রে কখনো আলো কখনো ছায়া, সাদা কিংবা সোনালী বালুতটে সফেদ ঢেউয়ের আছড়ে পড়া। লিস্টি মিলিয়ে তাড়াহুড়ো করে এ স্পট থেকে সে স্পট গাড়ি চড়ে ঘোরাঘুরি না করে দুদণ্ড জিরিয়ে সেখানে অন্তহীন সুখযাপনে অংশীদার হয়ে দেখব কেমন করে সমুদ্রের কোল থেকে দিনমণির উদয় হয়, আবার পড়ন্ত বিকেলে সূর্যডোবার পালা এলে পৃথিবীটা যখন সাঁঝবাতির রূপকথার মতো চুপকথার দেশে চলে যাবে তখন মনের গোপন কুঠুরিতে লুকোনো যাবতীয় অ-সুখ ভুলে ফেরারি মন গেয়ে উঠতে বাধ্য হবে “কী চাইনি, কী পাইনি, সবই ভুলে যেতে চাই।” প্রতিদিনের জমা-খরচের হিসাব ভুলে প্রিয়জনের সঙ্গে নিশ্চিন্তে বসে তখন মনের দুটো কথা বলা যাবে। 

হঠাৎই মনে হল এমন জায়গা হিসেবে বকখালিই তো আছে যা একেবারেই “ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।” কিন্তু সেখানে তো যখন তখন যাওয়া যায় বলে আজ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ – উঠল বাই তো বকখালি যাই। দুদিনের মধ্যে ঠিক করে ফেললাম এবার গন্তব্য বকখালি। সঙ্গী হাজব্যান্ডের এক কলিগ ও তার স্ত্রী। বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেভাবে সুযোগ হয়ে উঠছিল না। আসলে ঘরের কাছের  “শিশিরবিন্দু”-গুলোই তো দেখা হয় না। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই কাছে-দূরে যে জায়গাই হোক না কেন, একজন পর্যটকের তাতে কিছু আসে যায় না। রক্তে আমার ভ্রমণের নেশা। বেড়ানোর অসুখের সিনড্রোম মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। তখন সেই অসুখের নিরাময় করতে ছুটে যেতে হয় পাহাড়, নদী, ঝর্না, সমুদ্র, জঙ্গল যেখানেই হোক না কেন। মৌমাছির মধু খাওয়ার মতই এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদন করি। মাধুকরীর মত প্রকৃতির সব দান ভ্রমণ ঝুলিতে সঞ্চয় করে রাখি আর তাতে আচ্ছন্ন হয়ে ক্রমশ তলিয়ে যাই নতুন নতুন জায়গার ভ্রমণের নেশায়। 

সেই উদ্দেশ্যে সকাল সকাল দুধসাদা জাইলো ভাড়া করে রওনা দেই। ঘনঘোর বর্ষাকাল। আকাশ ফুটো হয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। আমার বেড়ানোর সঙ্গে বৃষ্টির একটা অন্তরঙ্গ যোগাযোগ আছে। পাহাড় হোক কিংবা সমুদ্র নাছোড়বান্দা প্রেমিকের মত সে সবসময়ই যেন আমার পিছু পিছু আসবেই। যাত্রাপথেই মাঝে মাঝে ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে। প্রবল বর্ষণে গাড়ির কাচ, জানালা, রাস্তা সাদা ওড়নার মত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ঘন্টা কয়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বকখালি। আগে ভেসেলে করে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরোতে হত। কিন্তু এখন ব্রিজ হয়ে যাওয়ার ফলে সেই ঝামেলা নেই। সপ্তাহের মাঝখানে হওয়ায় টুরিস্টদের সেরকম কোন চাপ নেই। তাই হোটেল আগাম বুকিং করে না এলেও দেখেশুনে বেশ ভালো একটি হোটেল পছন্দ করতে অসুবিধা হল না।

হোটেলে স্নানাহার সেরে একটা টোটো ভাড়া করে স্থানীয় জায়গাগুলো দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম বকখালির আশেপাশে ঘুরে দেখতে। বৃষ্টি তখন অনেকটাই কম। প্রথমে গেলাম জম্বুদ্বীপ ফেরিঘাটে। কিন্তু আবহাওয়া খারাপের জন্য সেখানকার ফেরি সার্ভিস বন্ধ ছিল। এরপর গেলাম নির্জন কোলাহলহীন প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতাপূর্ণ এক জায়গা হেনরিজ আইল্যান্ডে। ছোট্ট দ্বীপটি সৌন্দর্যের দিক থেকে ভারতের অন্যান্য যেকোনো দ্বীপকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। একে বাংলার একটি রহস্যময় ঐতিহাসিক দ্বীপও বলা যেতে পারে। নামখানা ব্লকের ফ্রেজারগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত এই দ্বীপটি বকখালি থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। ফ্রেজারগঞ্জ নামটি হয় বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যান্ড্রিউ ফ্রেজারের নাম অনুসারে। ১৮৭১ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৫ সালে ফ্রেজার এবং হেনরি দুজন সাহেব বাংলায় আসেন এবং বসতি গড়েন। ফ্রেজার সাহেবের নামে ওই জায়গাটির নাম হয় ফ্রেজারগঞ্জ আরেকটি দ্বীপ হেনরি সাহেবের নাম অনুসারে হয় হেনরি আইল্যান্ড। জেটি ঘাট থেকে হেনরি যাওয়ার একটি সোজা রাস্তা রয়েছে সেটির বার্নার রোড বলে পরিচিত। এটি হেনরি সাহেবের স্ত্রীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। আগে হেনরি আইল্যান্ড ফ্রেজারগঞ্জ থেকে আলাদা ছিল। যোগাযোগ রক্ষা করা হত একটি ব্রিজের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে দ্বীপটি বনদপ্তরের হাতে যাওয়ার ফলে ফিশারিজ দপ্তর হেনরি আইল্যান্ডের যাবতীয় জমি নিজেদের দখলে নেয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে হেনরি আইল্যান্ড ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের মনে জায়গা করে নেয়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছায়াঢাকা রাস্তায় যেতে যেতে শুধু একটা কথাই মনে হয়, “আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/ আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”  

একদম নির্জন এলাকাটি চারিদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। গ্রাম্য পথ ধরে হাঁটতে থাকি। দু’পাশে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মাঝখান দিয়ে বাঁধানো সরু পথ সোজা এগিয়ে গেছে সমুদ্রের দিকে। চলে যাই বিচের একদিকে। আশেপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। একটি ওয়াচ টাওয়ারের টিকিট কেটে ওপরে উঠে দেখতে পাই বকখালির সমুদ্রে ভাসমান নৌকোগুলোকে। মাঝে মাঝেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিরাট পরিমাণে ক্ষতি হলেও সরকারি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স এবং ম্যানগ্রোভ ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স তৈরি করে সেগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা জারি রেখেছে বনদপ্তর। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একটা বড় মৎস্য প্রকল্প যা প্রায় ১৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত। বিভিন্ন প্রকার মাছ দেখা ছাড়াও মাছের স্বাদও নেওয়া যায়। প্রতিটি মাছের পুকুরে বোট রাইডিং করা যায়। সেভাবে পর্যটকদের আনাগোনা নেই বলে এখনো এখানে লাল কাঁকড়ার দর্শন পাওয়া যায়। ছোট ছোট কাঁকড়াগুলো বালি থেকে বের হচ্ছে আর কাঁকড়াদের যা স্বভাব – কাছে গেলে মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বালির ভেতরে। এই এলাকা প্রকৃত অর্থে সুন্দরবনেরই সম্প্রসারিত অংশটি। হেঁতাল, গরান ও বাইন গাছে সমৃদ্ধ ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং বেশ কয়েকটি খাঁড়ি এই দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ঘন ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বন্য শুয়োর, হরিণ দেখা যায়। খাঁড়িতে কুমির, কাঁকড়া এবং সমুদ্রে নানারকম মাছের দেখা মেলে। টোটোর ড্রাইভার অমিতের কাছেই শুনলাম এই জঙ্গল পাখিদের স্বর্গরাজ্য। গাছের ডালে ডালে নানা রকম পাখিদের দেখা গেল। শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখিরা গড়ে তোলে তাদের একান্নবর্তী সংসার। 

সুন্দর নির্জন এই বিচে মিহি ধূসর বালি। সমুদ্র এখানে ভীষণই শান্ত। একান্ত নিরিবিলি  বিচে সাদা বালুকণার উপর স্বচ্ছ নীল জলের আছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউগুলোর সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।  পা ভেজাতে তাই নেমে পড়লাম সাগরজলে। ঠান্ডা জলের স্পর্শে শরীর, মন শিহরিত হচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ পায়ের কাছে এসে মাথা নত করছে আর তারপরেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সহস্র জলবিন্দুতে। তারপরই আবার ফিরে যাচ্ছে তাদের আপন ঠিকানায়। আবার আসছে দলবদ্ধ হয়ে। অভিমানী প্রেমিকটির মতো যেন অভিযোগ জানাতে চায়, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে?’ আমিও ঘোরলাগা এক ভালোবাসার মোহে তাকে বলে চলি, ‘ভালোবাসি বলেই তো তোমার কাছে আসি বারবার।’ মন গেয়ে ওঠে, ‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই বারে বার।’ হয়তো বিরহ থাকে কিছুদিনের। কিন্তু নয়ন সার্থক করতে চলে আসি তো ঠিকই এক অমোঘ আকর্ষণে। মন ভরে ওঠে অজানা ভালোবাসায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বললাম ঢেউয়ের সঙ্গে। সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় দেখার সুযোগও রয়েছে। 

পরের দ্রষ্টব্য ফ্রেজারগঞ্জ। বকখালি থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে এই সৈকত। এখানে সমুদ্র অশান্ত। চারিদিকে এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো। বিচ বলে কিছু নেই। হয়তো অনেক আগে ছিল। সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় তার অস্তিত্ব মুছে গেছে। পাশে আছে ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের গড়ে তোলা সৈকতাবাস। তবে তার অনেকাংশই আজ সাগরের গর্ভে বিলীন। কিছু ধ্বংসাবশেষ বিগতকালের স্মৃতি বহন করে চলেছে মাত্র।  

এরপর গেলাম কার্গিল বিচে। জনশূন্য নীলজলের সমুদ্র আর ব্যাকড্রপে নীল আকাশের এই বিচটি দেখে মনে হল এ যেন গোয়ায় চলে এসেছি! একদম ফাঁকা নির্জন বিচ ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। উত্তাল হাওয়া শরীর ও মনকে স্নিগ্ধ করে দেয়। একের পর এক ঢেউ এসে এই নির্জন সমুদ্রতটকে সিক্ত করছে,আবার ফিরে যাচ্ছে কোন্ অজানায়। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম বালুকাবেলায়।  এবার ফেরার পালা।

বাসস্ট্যান্ডের কাছে পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগ দপ্তর দ্বারা সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে এগোতেই একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। পাশে পাঁচিল আর তারজালি দিয়ে ঘেরা বাদাবন সুন্দরবনের মতই। জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়েই দেখা যায় সমুদ্র দর্শন করা যায়। তবে এখানকার কুমির প্রকল্পটি ‘বুলবুল’ ঝড়ে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যেরও। কিছুটা গেলেই দেখা গেল বিশালাক্ষী মায়ের ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দির দর্শন করে ফিরে এলাম বকখালি বিচে। এই বিচের একটি বৈশিষ্ট্য হল যখন ভাটা চলে তখন সমুদ্রের জল অনেকটা দূরে চলে যায়। অনেকটা চাঁদিপুর বিচের মত। এখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই জানা গেল কিছুক্ষণ বাদেই জোয়ার জল আসতে শুরু করবে। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। সূর্যের সোনালী রঙ ধীরে ধীরে কমলা হচ্ছে। সেই রংয়ের আবির ছড়িয়ে পড়ছে সাগরজলে। তারই সঙ্গে আরেকদিকের আকাশে দেখা যাচ্ছে মেঘের ভ্রুকুটি। একই সঙ্গে প্রকৃতির দুই বৈপরীত্য লক্ষ্য করলাম। কিছুক্ষণ বাদেই প্রবল বৃষ্টি। তার সঙ্গে প্রচন্ড হাওয়া। এই প্রবল হাওয়া উপেক্ষা করতে না পেরে সমুদ্রের ধারে পর্যটকদের বসার জন্য পেতে রাখা শূন্য চেয়ার উড়ে যেতে দেখলাম। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিই এক চায়ের দোকানে। এক ফোঁটা দু ফোটা করে ক্রমশ ভারী হতে থাকে পরিবেশ। বাঁধনছাড়া পাগলপারা অনাসৃষ্টি ঝড়-বৃষ্টিতে বানভাসি হয় হৃৎপ্রান্তর। সেখানে চা পান করতে করতে বৃষ্টি কিছুটা কমে এল। ফিরে আসি হোটেলে।

যেকোন জায়গায় গেলে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার একটা অদ্ভুত আনন্দ রয়েছে। পরদিন ভোর পাঁচটায় সূর্যোদয় দেখার জন্য বিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সমুদ্র এখন খুবই শান্ত। পূর্ব আকাশে হালকা লালচে একটা আভা দেখা দিলেও মেঘলা আকাশে পুরোপুরিভাবে সে দৃশ্যমান হল না। এ যাত্রায় বকখালির সূর্যোদয় দেখা তাই অধরাই রইল। আজকেই চলে যাব। এখান থেকে ফিরে যাব সেই নাগরিক একচালার রোজকারের ভুল বোঝাবুঝির ক্লাসিক জগতে যেখানে প্রতিটি সময় নিক্তি দিয়ে পরিমাপ করা হয় ডেবিট-ক্রেডিটের ব্যালেন্সে। কোন একটা সময় এমনই এক শান্তির পরিবেশে সুখের সন্ধানে জীবনের দুটো একটা দিন নোঙর ফেলতে আবার বেরিয়ে পড়ব কোন এক জায়গায়।

কীভাবে যাবেনঃ নিজস্ব গাড়ি ছাড়া শিয়ালদা থেকে নামখানা ষ্টেশনে নেমে বাসে করে অথবা এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে করে যাওয়া যায়। 

কোথায় থাকবেনঃ এখানে নানা মানের ও দামের হোটেল, রিসোর্ট, লজ আছে।

 
পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, বেড়ান আর সিনেমা দেখা। পছন্দের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম স্থানে আছে পাহাড়িয়া ছোট ছোট গ্রাম। আরও শখ সময় ও সুযোগ পেলেই পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখা। বেড়িয়ে এসে মনের আনন্দে টুকটাক ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন, প্রবচন পত্রিকা, ‘পর্যটকের ডায়েরি’ নামক ভ্রমণ সংকলনে। পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং আর রশিদ খানের গান সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সফট রোম্যান্টিক গান বিশেষ পছন্দ। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *