পিতৃচ্ছায়া

পিতৃচ্ছায়া

বাবা কথাটা যতই ছোট হোক, আসলে তো সৃষ্টির আধার। বাবাকে অনেকেই বনস্পতির সঙ্গে তুলনা করেন যা ফল দেয়, তীব্র দহনে ছায়া দেয়, রোদ ঝড় উপেক্ষা করে। কিন্তু আমার মনে হয় বাবা হল বনস্পতির সেই মূল শিকড়, যা কঠিন মৃত্তিকা বিদীর্ণ করে অতলে প্রবেশ করে সুধারস শোষণ করে নিয়ে আসে, যে সুধারস শিরায় শিরায় অতিবাহিত হয়। যে সুধারস জন্ম দেয় নবপল্লবের। তাই তো সে তীব্র দহনের তেজকে উপেক্ষা করতে পারে। ছায়া প্রদান করতে পারে পরিশ্রান্ত পথিককে। বাবা হল সেই অসীম আকাশ যার বুকে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র আলোকিত হয়, কিন্তু সেই আলোক দীপ্তিতে অগোচরে রয়ে যায় নভোনীল।

বাবা বলতেই মানসপটে হয় এক দোর্দন্ডপ্রতাপ ব্যক্তির অবয়ব ভেসে ওঠে, যার স্নেহ অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো। সন্তানের সামনে তিনি ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। নয়তো এক মাটির মানুষ, যিনি আয় খুকু আয় বলে সন্তানকে বুকে টেনে নেবেন। কিন্তু আমাদের কেন মনে হয় না, সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা যার মা কাজে বেরোনোর সময় সে এগিয়ে দেয় একটা ছাতা! বা সেই বড় দাদার কথা, যে ছোট ভাই বোনের স্বপ্ন সফল করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলে! সেই প্রেমিকের কথা, যে নিজের গায়ের জ্যাকেট প্রেমিকার গায়ে জড়িয়ে দেয়! অথবা সেই মায়ের কথা, যিনি একা হাতে মায়ের ভূমিকায় সন্তান মানুষ করতে করতে কবে যেন বাবাও হয়ে ওঠেন! আসলে বাবা কথাটির সঙ্গে কোন সম্পর্কের বাঁধনের প্রয়োজন পড়ে না। বাবা প্রোথিত থাকে মননে, চিন্তনে, শিক্ষায়, আদর্শে। বাবা হল এক পিতৃসত্ত্বা, যা যে কোনও বয়সে বা যে কোনও অনাত্মীয়তার আধারে নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। আমার কাছে বাবা কথার অর্থ শীতল ছায়া ও ভরসার স্থল। বাবা মানে শুধুই  জন্মদাতা বা কোনও পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি বোঝায় কি? 

একটি চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা যাক।  

চলচ্চিত্র: সাদমা (হিন্দি)

চরিত্র: সোমপ্রকাশ

——————————————–

বহু চলচ্চিত্রে নানান অভিনেতা সুনিপুণভাবে পিতার চরিত্র ফুটিয়েছেন। বাবা চরিত্রটি কখনও মুখে পাইপ টেনে কোট প্যান্ট পরে রাশভারী মেজাজে অবতীর্ণ হয়েছেন, কখনও আবার নিপাট সাধারণ বেশে। তবে যে সিনেমার কথা বলব, তাতে কমল হাসান পিতৃত্বকে অন্য রূপ প্রদান করেছেন। ‘সাদমা’ চলচ্চিত্রটি প্রথম যখন দেখেছি তখন আমি বেশ ছোট। কিন্তু পরবর্তীকালে পুনরায় যখন দেখি, তখন আমার কাছে বাবা শব্দটির অর্থই বদলে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এই সিনেমার দুই মুখ্য চরিত্র সোমপ্রকাশ ও রেশমিকে প্রেমিক প্রেমিকা মনে হলেও তাদের সম্পর্ক এক ঐশ্বরিক জটিলতায় বাঁধা। কোন প্রেমিকও পিতৃত্বের আবরণে তার প্রেমিকাকে আচ্ছাদিত করে রাখতে পারে।

সোমপ্রকাশ উটিতে একটি গ্রামের স্কুল শিক্ষক। সাত্ত্বিক জীবন পালন করে সে। বন্ধুর জোরাজুরিতে মুম্বাইতে এক পতিতালয়ে গিয়ে তার সাক্ষাৎ হয় রেশমির সঙ্গে। রেশমির রূপযৌবনে সে আকৃষ্ট হলেও তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে, বয়সে তরুণী হলেও সে তার অতীত বিস্মৃত হয়েছে। মননে ও আচরণে রেশমি এখন এক ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে। তার দুর্দশার কথা শুনে সোমপ্রকাশের পিতৃসত্তা জেগে ওঠে। রেশমিকে সে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। সমাজের কুকথা অগ্রাহ্য করে যত্নে, আদরে তাকে ভরিয়ে রাখে। তার একাকী জীবনে সে জীবনসঙ্গিনী চায়, যে তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদা নিরসন করবে। কিন্তু নিজের অগোচরে সে কবেই রেশমির বাবা হয়ে উঠেছে। নিজে হাতে রান্না করে তাকে খাইয়ে দেয়। তার চুল বেঁধে দেয়। তার নতুন জামা কিনে আনে। ছড়া শেখায়, কোলে বসিয়ে গল্প বলে। ঘুমপাড়ানিয়া গান গেয়ে তার চোখে ঘুম আনে।

“সুরমাই আঁখিও মে নান্না মুনহা / এক সপনা দে যারে।”

এই গানের দৃশ্যটি নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। এক স্বর্গীয় দৃশ্য রচিত হয়েছে। দুই যুবক যুবতীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে কামনা বাসনার কোন স্থান নেই। সোমুর কোলে মাথা পেতে নিরাপদ আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে রেশমি। সোমু তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট শিশুর মত বুড়ো আঙুল চুষছে রেশমি। স্নেহশীল পিতার মতোই সোমু তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছে।

তার অনাবিল হাসির জন্য সোমু কখনও হনুমান সাজে, কখনও মাথায় হাঁড়ি ঢুকিয়ে নাচে। এ দৃশ্যগুলো  আমাদেরকে শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ছোট্ট মেয়ের মুখে বেদনার ঘনঘটা সরিয়ে দিতে যে কোনও শিশুর বাবা তো এমনই করে।

রেশমির মতো লাবণ্যময়ী তরুণী তাই সোমুর প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারে না। কাহিনি যত এগোয়, সন্তান তুল্য রেশমির প্রতি সোমুর পিতৃস্নেহের উদগ্রতা বাড়ে।

এই সিনেমার শেষ দৃশ্যটি বড় মর্মান্তিক। এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের ওষুধে স্মৃতি ফিরে পায় রেশমি তথা স্নেহলতা।  সোমুকে ভুলে যায় সে। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া যে রেশমিকে সোমু পিতৃত্বের ছায়ায় আগলে রেখেছিল, তার হাসি কান্নার অংশীদার হয়েছিল, চারপাশের লোভী পুরুষদের থেকে রক্ষা করেছিল, সেই সোমুকে রেশমি অনায়াসেই ভুলে যায়। বাবা মায়ের সঙ্গে উটি ছেড়ে  চলে যাওয়ার জন্য স্টেশন রওনা হয়। 

পুলিশের ভয়ে সোমু প্রথমে রেশমির বাবা-মার সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে দ্বিধা করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হয়, রেশমিকে সে হয়ত চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। যে কোনও পিতার কাছে তার সন্তান হারানোর ভয় সর্বাধিক। সন্তানকে নিজের কাছে আটকে রাখার জন্য কোনও বেপরোয়া পিতা সকল বাধা, বিঘ্ন, ভয়কে উপেক্ষা করতে পারে। ঠিক সেটাই করেছিল সোমু। পথচলতি গাড়ির ধাক্কা খেয়ে, কর্দমাক্ত হয়ে, আহত শরীরে স্টেশনে উপস্থিত হয়েছিল। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল রেশমিকে ফিরে পাওয়ার। চিৎকার করে ডেকেছিল তাকে। কপালের ক্ষতস্থান বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে নেমেছিল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না তার। প্রেমিকাকে ফেরাতে আসেনি সে, ফেরাতে এসেছিল তার আদরের ছোট্ট রেশমিকে। কিন্তু রেশমি তো তখন এক তরুণী স্নেহলতা। প্ল্যাটফর্মের আহত যুবককে উন্মাদ ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এক পিতা হেরে যেতে চায়নি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সন্তানের অপেক্ষা করেছে। ছোট্ট মেয়ে বাবার উপর রাগ করলে বাবা যেমন ছলে বলে তাকে ভুলায়, ঠিক তেমনি করে সোমু ডিগবাজি খেয়েছে, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে রেশমিকে তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মরণ করানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছোট্ট রেশমি যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তাই ব্যর্থ হয়েছে এক দুর্ভাগা পিতা।

স্নেহলতা রেশমির খোলস ত্যাগ করে ফিরে যায় তার পরিচিত পরিবেশে। এক অসহায় পিতা সোমু পড়ে থাকে এক বৃষ্টিস্নাত স্টেশন চত্বরে। চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলে তার কন্যাসম রেশমিকে।

কোন প্রেমিকের অন্তরেও যে তার প্রেমিকার জন্য পিতৃসত্তা জেগে উঠতে পারে, সোমু তা প্রমাণ করেছে। রেশমিকে হারিয়ে ফেলার যে আকুতি ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে, তা এক সর্বহারা পিতার থেকে কোন অংশে কম নয়। যে বিচ্ছেদের আগুনে সোমু পুড়ল, তার কণাটুকু আঁচ যদি লাগত স্নেহলতার গায়ে!

<অবসর পিতৃদিবস ইভেন্টে পুরস্কৃত লেখা>

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *