পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘তুষারসিংহের পদতলে’

পাঠপ্রতিক্রিয়া: 'তুষার সিংহের পদতলে'

সমরেশ বসু

পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘তুষার সিংহের পদতলে’
লেখক: কালকূট

কালকূট ও তাঁর লেখা আমার কাছে সুপরিচিত নয়, আমার অজ্ঞতার কারণেই। তাঁকে জানতেই আমার এই পাঠপ্রতিক্রিয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং ‘তুষার সিংহের পদতলে’ আত্মসমর্পণ।

আমার ছাত্রজীবনের লব্ধ জ্ঞানে এটুকুই জানা ছিল যে সমরেশ বসু’র ছদ্মনাম ‘কালকূট।’ রচনা সমগ্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে পঞ্চম খণ্ডে চোখে পড়ল একটি উপন্যাস। ‘তুষার সিংহের পদতলে।’ নামটি পড়ে খানিক বিস্মিত হলাম। নামটিতে ‘সিংহের’ আছে, কথাটি কি ‘শৃঙ্গের’ হবে? আরও কিছুক্ষণ ইতিউতি পড়াশুনোর পর নিশ্চিন্ত হলাম, কথাটি ‘সিংহের’ই।

পাহাড় নিয়ে আমার আবেগ, স্পর্শকাতরতা ছেলেবেলা থেকেই। আমি যখন ক্লাস ইনফ্যান্ট বা ওয়ানে সেই সময়ে বাবা দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে পড়াতেন। বাড়ি আসতেন মাসে একবার। আশুতোষ কলেজে কর্মরতা মা ও আমার সর্বক্ষণের বন্ধু ঠাকুমার সঙ্গে আমি থাকতাম কলকাতায়। বাবা যখন আসতেন, তাঁর মুখে শুনে শুনেই আমার ‘কাঞ্চন’দৃশ্যের প্রেমে পড়া, অথবা বলা ভালো, মোহে পড়া। ঠিক যেভাবে কালকূট ‘বরফ-বড়-পাঁচ-খাজাঞ্চিখানা’র মোহে পড়লেন। হ্যাঁ, এই নামেই ডাকতেন তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। তার সূর্যস্নাত অপূর্ব রূপের সাক্ষী হতে বার বার ছুটে যেতেন দার্জিলিং।

একটি সরস ভ্রমণকাহিনি উপন্যাসে উপনীত হয়, যখন বিভিন্ন রঙের বা নানান বৈশিষ্ট্যযুক্ত চরিত্ররা সেখানে ঢুকে পড়ে। কালকূট এই উপন্যাসে পাহাড়ি প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ, পাকদন্ডির বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা অমূল্যরতন, এবং সূর্যোদয়কালে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম রূপপরিবর্তন, একদিকে যেমন ভাষার অসীম নৈপুণ্যে ব্যক্ত করেছেন, ঠিক তেমনই চা-বাগান অঞ্চলের মেয়ে, মেজর ঘোষাল, কুন্দনন্দিনী, টোমবে ইত্যাদি নানা চরিত্ররা অনেকটা সময় নিয়ে নিজ নিজ রূপ-রস-গন্ধে প্রতিভাত হয় পাঠকের চোখের সামনে, পাঠকের মননে।

দার্জিলিং-এর চা-বাগানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে শহরের বাবুদের দ্বারা প্রতারিত একাধিক বামা-কাহিনি। কালকূট গল্পের শুরুতে এরকমই একটি মেয়ের কথা লিখেছেন। ইচ্ছা থাকলেও সামাজিক বাধা অন্তরঙ্গতার বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সেই বার্তালাপের প্রেক্ষাপটে একাধিকবার কাঞ্চনজঙ্ঘার ঈষৎ উল্লেখ প্রসঙ্গে অন্য মাত্রা দান করে। পঠন হয় মনোগ্রাহী।

সদর্পে রঙ্গমঞ্চে আসেন মেজর ঘোষাল ও তাঁর বোন কুন্দনন্দিনী। কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে লেখকের কথোপকথন এবং যাত্রাপথে তার ‘বিশেষ’ সান্নিধ্যলাভের বর্ণনায় মদিরার প্রভাবকে কালকূট এত মনোগ্রাহীভাবে এনেছেন, যা তাঁর লেখনীর মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়৷ আমার ব্যক্তিগতভাবে গাড়িতে দার্জিলিং থেকে সিকিমের যাত্রাপথের বর্ণনায় কথালাপ প্রথমদিকে একটু একঘেয়েমির উদ্রেক করলেও তা চরম উৎকণ্ঠায় বদলে যায় ‘তুষার সিংহ’র প্রসঙ্গ আসার পরে। পাঠক হিসেবে আমার, অর্থাৎ শিশু বয়স থেকে কাঞ্চনের সৌন্দর্যের ছবি আঁকে মনে মনে যে মেয়েটি, তার ক্ষেত্রে বইয়ের শুরু থেকেই মূল চালিকাশক্তি ছিল এই প্রশ্নগুলি – কী এই তুষার সিংহ; এই শব্দবন্ধের অর্থই বা কী? বেশ কিছুক্ষণ অ্যাড্রিনালিন রাশএর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যাওয়ার পর উল্লেখ আসে তুষার সিংহের, প্রায় অর্ধেক উপন্যাস পড়ার পর। তুষার সিংহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলেও সে প্রকৃতপক্ষে জীবনের এক নতুন পর্যায় এবং সংগ্রামের প্রতীকী। নামটির চয়ন কালকূট অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করেছেন, যা দুই অর্থ বহন করেছে।

মেজর ঘোষালের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে জানা যায় যে কালকূট কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহে আবিষ্ট। ঠিক যেমন আমি ছিলাম ছোটবেলায়। সিকিমের আপন দেশেই এই পর্বতমালার বাস। এখানে আরও উঠে আসে তু্ষার পুজোর কথা। বরফকে সিকিমবাসীরা পুজো করেন এবং নাচ-গানের মাধ্যমে উৎসব পালন হয়। এই স্নো রেঞ্জের বা সুবিস্তৃত পর্বতমালার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন তুষার সিংহ। এটি যেন সিকিমিদের একটি বিশ্বাস। কিন্তু পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারে যে এটি পর্বতমালার এক অনন্য সুন্দর রূপ, যা মূলত সূর্যোদয়কালে প্রতিভাত হয়। এই কথা জানার পরেই কালকূট মনে মনে ঠিক করে নিলেন, এই তুষার সিংহ তাঁকে দেখতেই হবে। কিন্তু তা দার্জিলিং বা কালিম্পং থেকে দেখা যায় না। তার জন্য পাড়ি দিতে হবে সিকিম। কাঞ্চনজঙ্ঘারূপী ধন, মোক্ষ ও সৌভাগ্যের দেবতাকে অতন্দ্র প্রহরায় পিছনে দাঁড়িয়ে পান্না সবুজ রঙের কেশর নিয়ে তুষার সিংহ। তাই সিকিম হল তুষার সিংহের দেশ৷ এই বক্তব্য শোনা ইস্তক মেজর ঘোষাল এবং আর এক সেনাধিকারিক দম্পতিকে নিয়ে লেখক বেরিয়ে পড়লেন তুষার সিংহের খোঁজে।

কালিম্পং থেকে সিকিমের যাত্রাপথের বর্ণনায় কুন্দনন্দিনীর চরিত্র-আখ্যানে কালকূট এনেছেন এক একাকী সুন্দরী মহিলার আর্তি, রূপের অব্যক্ত আস্ফালন এবং নিরাপত্তাহীনতা। ভ্রমণকাহিনির মোড়কে এই উপন্যাস হয়ে ওঠে জীবনবোধের গল্প, সমাজের গল্প। দার্জিলিং থেকে কালিম্পং, সেখান থেকে তুষার সিংহ দর্শনে সিকিমের এক অখ্যাত গ্রামে যাত্রাপথের মধ্যে দিয়ে এক নারীচরিত্র নিজেকে সমর্পণ করে স্বল্পপরিচিত কিন্তু মিতভাষী এক পুরুষের কাছে। নিজের সর্বস্ব ব্যক্ত করে, অনুভূতি ও আবেগের মিশেলে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি পাঠক তথা লেখকরূপী সহযাত্রীর কাছে উন্মোচিত হয়।

বহু কাঙ্ক্ষিত তুষার সিংহের দেখা মেলে শেষে। সেই অধ্যায়ের বর্ণনায় যে উৎকণ্ঠা, আবেগ ও পাহাড়ি সৌন্দর্য লেখকের কলমে উঠে এসেছে তা ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে রেশ রেখে যায় বই কী।

সিকিমের প্রত্যন্ত গ্রামে যে নদীর কলরোল শোনা যায়, মনে প্রশ্ন জাগে, তা সমতলের সর্বনাশের, নাকি স্তব্ধ পাহাড়ের নি:শব্দ উল্লাসের। পাঠকের যাত্রাপথে হিমালয়ের সুদূর গভীরে মহিমার বিশালত্বে ভ্রুকুটি-ভয়াল ছায়া এসে দাঁড়ায়। একাকীত্ব ঘিরে ধরে,কিন্তু হিমালয়ের বিশালত্বের সামনে অবনত হতেই হয়।

এই উপন্যাসে কালকূটের লেখনীশৈলী এবং ভাষার ব্যবহার ব্যতিক্রমী। বিশেষত কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে লেখকরূপী কথকের চুম্বনদৃশ্য বর্ণনায় এবং শেষে এক সিকিমি গ্রামে তিনভাইয়ের একই তরুণীর সঙ্গে ঘরকন্নার ক্ষেত্রে বাড়ির একটি দৃশ্য বর্ণনায় যে অপরূপ শব্দচয়ন এবং ভাষাশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়, তা উপন্যাস পড়া শেষ হওয়ার পরেও মনে প্রভাব রেখে যায়।

সম্পূর্ণ উপন্যাসেই ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত সাবলীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক নির্যাস শব্দপ্রয়োগে থাকলেও ঘটনার গতি বা সাবলীলতা বিঘ্নিত হয় না৷ লেখকের শৈলী অনেকটা বিশ্লেষণাত্মক ও মনস্তাত্ত্বিক, যেখানে প্রতিটি বাক্য চরিত্রগুলির এবং কথকেরও আবেগ ও অনুভূতিকে তুলে ধরেছে। এই শৈলী উপন্যাসটিকে একদিকে সহজ, এবং অন্যদিকে গূঢ় অর্থে পূর্ণ করে তোলে। পড়তে পড়তে অনেকক্ষেত্রেই পাঠক ভুলে যান যে এটি একটি পাহাড়ভিত্তিক ভ্রমণ উপন্যাস। বরং মনে হয় এটি বেশ একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক আখ্যান। একাধিক নারীচরিত্র পুরো উপন্যাসে উল্লিখিত হলেও প্রত্যেকের নিজস্ব মনের অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থান আলাদা আলাদাভাবে পাঠকের সামনে বিশ্লেষিত হয়। এটি অনেক আঙ্গিকে স্মৃতিকথামূলক হলেও পড়তে গিয়ে বার বারই মনে হয় এটির মধ্যে সামাজিক এবং সম্পর্কের টানাপোড়েনের উপাদান লুকিয়ে আছে।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় আর এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘মেঘলোকের দেশে’ উপন্যাসের কথা। এক্ষেত্রেও মূল উপপাদ্য বিষয় হল কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং দার্জিলিং-যাত্রা৷ তবে এক্ষেত্রে উপন্যাসটি সামাজিক হয়নি, স্মৃতিকথামূলকই রয়েছে। কিভাবে বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে, সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে লেখক ও তাঁর পরিবারের লোকজন দার্জিলিং পৌঁছলেন এবং টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়কালে কাঞ্চনের রং বদলাতে দেখলেন, নারায়ণ সান্যালের ক্ষুরধার লেখনীতে তা অন্য মাত্রা পায় বটে। তবে এই জায়গায় তুষার সিংহের স্রষ্টা ব্যতিক্রম। একাধিক চরিত্রের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে কালকূট যে বাস্তব এবং ম্যাজিক রিয়েলিজমের মিশেল ঘটিয়েছেন, আবার পাশাপাশি এক যাত্রাপথে প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে গেছেন স্বাদু গদ্যের আকারে, এ পাঠকের কাছে এক পরম প্রাপ্তি৷

প্রেম বা সম্পর্ক সব সময়ে পরিণতি পায় না, আকাঙ্ক্ষা- প্রত্যাশারা অনেক সময়ে শুধু মুহূর্তের সাক্ষী হয়েই রয়ে যায়; ভবিষ্যতে আর কোনও অবয়ব তাদের থাকে না। তাও লেখকের মুন্সিয়ানায় অনুভূতিরা রয়ে যায় অশরীরী হয়েই, পাঠকের মনে। যোগ্য সঙ্গত দেয় প্রকৃতি, তার অনাবিল উদারতা এবং হিমালয়ের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। অনেক ভ্রামণিকই হিমালয়ে প্রায়ই ছুটে ছুটে যান, অনেকসময়েই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই, সমর্পণের আশায়, সিদ্ধিলাভের আশায়। বরফাবৃত পর্বতরাজি যেন তাদের দুহাতে আলিঙ্গন করে নেয়, স্থান দেয় পদতলে।

উপন্যাসের নামটিও যে যথাযথ তা পাঠক বুঝতে পারেন একদম শেষে এসে। বন্ধুভগিনী, পরস্ত্রী কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে লেখকের আপাত নৈকট্য ম্লান হয়ে যায় তুষার সিংহ দর্শনে, উদীয়মান সূর্যের নরম আলোয় তাঁর কেশরের রং বদলানো দেখে। পাঠক সমাবেশে লেখক নতজানু হন অবিনশ্বর হিমালয়-সম্মুখে, তুষার সিংহের পদতলে।

**অবসর গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা।

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।

সুমেধা চট্টোপাধ্যায় পেশায় জৈব-প্রযুক্তিবিদ, TCG Lifesciences Pvt.Ltd এ গত ১৭ বছর ধরে কর্মরতা। তাঁর ভালোবাসার দুই পাত্র হল বই ও শাস্ত্রীয় নৃত্য। সঙ্গে ভালো লাগে নানা জানা অজানা জায়গায় বেড়াতে যেতে এবং সেখানকার স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে। অনেক ছোটোবয়সে মা-বাবার সঙ্গে দার্জিলিংএর পাহাড় দেখে প্রকৃতিকে ভালবাসতে শেখা। তাতে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল বাবা'রই কিনে দেওয়া প্রথম বই 'চাঁদের পাহাড়'। তারপর থেকে দু'পা থেমে থাকেনি। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবই ছুঁয়ে দেখেছেন এবং তা পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। আড়াই বছরের পুত্রকে সঙ্গে নিয়েও করেছেন ট্রেকিং। বেড়ানোর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় 'ছুটি' নামে একটি ভ্রমণ-পত্রিকায়, বছর তিনেক আগে। তারপর রংরুট, চল যাই, ভ্রমণপিপাসু ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট-বড় পত্রিকা, ওয়েবজিনে ও ব্লগে ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। লিখেছেন ব্যক্তিগত গদ্য, রম্যরচনা এবং ছোট গল্প। গল্প ও প্রবন্ধ লিখে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রকৃতি-সান্নিধ্য মানুষের মনকে বিস্তৃতি দেয় এমনটাই মনে করেন সুমেধা। ভ্রমণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম তিনটি বই 'কল্প-পায়ে' (লিপিঘর), 'আশ্চর্য দ্বীপভূমি আন্দামান' (রংরুট) এবং 'ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া' (ভ্রমণপিপাসু)। এই বছর বইমেলায় এসেছে কলকাতার খাবার-দাবার নিয়ে পঞ্চম বই। পাঠকসত্ত্বার পাশাপাশি লেখক সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় গত ছয় বছর ধরে ব্রতী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *