পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘শাম্ব’

পাঠপ্রতিক্রিয়া: 'শাম্ব'

পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘শাম্ব’
লেখক: কালকূট

তাঁর ক্লান্ত দুটো পা গরম বালির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। ঝড় উঠেছে। অবাধ্য বালির কণা চোখ, নাক, মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। বালি? নাকি হাজারটা বেগবান ঘোড়া? এক্ষুনি পাশ‌ দিয়ে গেল বিষাক্ত সাপ। নিরস্ত্র হতভাগ্য রাজকুমার! তাঁকে এগিয়ে যেতেই হবে, খুঁজে পেতে হবে সেই নদী, যার টলটলে জল ধুইয়ে দেবে অভিশাপ। নিজের বিকৃত অঙ্গের দিকে তাকান তিনি। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গরাশি দাঁত বের করে হাসছে। রাজকুমার নিজেকে বলেন, তাঁর সকল প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ নির্দেশ নিশ্চয়ই আছে‌। একদিন ঠিক তিনি তা পাবেন।‌ ক্লান্ত পা দুটো আবার টেনে তোলেন তিনি। এগিয়ে চলেন শাপিত কুমার শাম্ব।

অনাদি অনন্তকাল ধরে পৃথিবীতে মানুষ গল্প বলেছে। লিখিত কাহিনি বা তারও আগে লোকশ্রুতিনির্ভর সেই গল্পের বীজ যেমন প্রয়াগের গাছতলায় ছিল, তেমন‌ই প্রাগেও শোনা যায় তার ধুকপুকানি। ভারতে যে আখ্যানের নাম পুরাণ, ইউরোপে তাই হল মিথ। কিংবদন্তিমূলক এই কাহিনিগুলোর বেশিরভাগ‌ই অলৌকিকতার আস্তরণে তাদের বুক ভারী করে রেখেছে। টুক করতেই স্বর্গের দেবতারা নেমে আসেন, অসীম তাঁদের ক্ষমতা। দৈত্য, দানো, মায়াবী রাক্ষসীরাও ঘুরে বেড়ায়। এদের বিভার ছটায় কখনও আলোকিত, কখন‌ও তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায় সেই larger than life এর গল্পগুলো।

তবে এমন শিল্পীও আছেন, যিনি অলৌকিকতার ধাঁধার সংকেতটুকু অনায়াসে পেরিয়ে তার মধ্যে থেকে বের করে আনেন মানবজীবনের সত্যরূপ। তাঁর ব্যক্তিগত হৃদয় নিংড়ানো আলো এবং আত্মচেতনায় রঙ মিশিয়ে এই কাহিনিগুলোকেই নবযুগের পটে আরেকবার আঁকেন। ঠিক তখন‌ই গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে আলবার্ট কামুর কলমে উঠে আসে ‘মিথ অফ সিসিফাস‌।’ আজীবন পাথর ব‌ইতে থাকা অভিশপ্ত এক রাজাই absurdity of life এর জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন কিংবা মহাভারতের অখ্যাত রাজকুমার কালকূটের সৃজনলীলায় হয়ে ওঠেন কালজয়ী উপন্যাসের নায়ক ‘শাম্ব।’ অলৌকিকতার পরত সরিয়ে এই শাম্ব অথবা সিসিফাসের মতো‌ মিথিক্যাল চরিত্ররাই নিয়ে আসে শাশ্বত জীবনসত্য।

‘শাম্ব‌’ কালকূটের সর্বোচ্চ আলোচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি। এটি ১৯৭৮ সালে দেশ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। দু’বছর পর ১৯৮০ সালে অ্যাকাডেমি পুরস্কার পায়। ‘শাম্ব’ উপন্যাসের‌ প্রেক্ষাপটে লেখক বলেছিলেন –

মনে হচ্ছে আমি যুগ থেকে যুগান্তরে এক লীলাক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি। এই রূপের মধ্যে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে হাজার হাজার বছর আগের নানান ঘটনা। যেন এক আবছায়ায় আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি।

সত্যিই বোধহয় এমন মাপের লেখক এভাবেই দেখতে পান, তাঁর সৃষ্টি মহাদর্শনে পরিণত হয়। ‘শাম্ব’ সেই দর্শনের নাম।

কে এই শাম্ব? শাম্ব হলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং জাম্ববতীর পুত্র। মহাভারতের মৌষল পর্বে যদুবংশে ধ্বংসের জন্য যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেই মুষলের জন্মবৃত্তান্ত সূত্রেই শাম্বর কাহিনি এসেছিল। তবে এই উপন্যাসে নায়ক শাম্বকে আনার আগে কালকূট এক বিস্তৃত গৌরচন্দ্রিকা করেছেন। তাতে মিশেছে ইতিহাস, দার্শনিকতা, জীবনবোধ আর এক আশ্চর্য ভ্রমণ। সেই ভ্রমণ কখন‌ও ক্ষীণধারা সরস্বতী কূলে বাঁশঝাড়ের ছায়ায়, কখনও পাঁচমুড়ার গাঁয়ে‌। লেখক সেখানে সাঁওতাল মেয়েদের থেকে পায়রা কিনে মাংস রেঁধে খান। আবার জগৎ সংসারের সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে উদাসী বাউলের মতো বলে ওঠেন, “স্বর্গ মর্ত্য পাতাল – ভ্রমণের এই ত্রিভুবন এবার আমাকে ডাক দিয়েছে‌, আর এই ত্রিভুবনে যেতে হলে ঝোলা কাঁধে নিয়ে কোনও যানবাহনে চেপে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।”

কী ভাবে তবে যাওয়া সম্ভব? আরে, তাঁর কাছেই যে আছে সেই বেগবান অশ্বযুক্ত পুষ্পকরথ। এই রথ ঠিক রথ নয়, বরং যেন টাইম মেশিন, যাতে উঠে তিনি বলেন,

“আমার যাত্রা কৃষ্ণের দ্বারকায়। আমি হালের ভারতীয় ম্যাপে, মথুরা থেকে, বর্তমান দ্বারকার একটা দূরত্বের হিসেব কষেছি। না, রেলপথ বা আধুনিক রাস্তা ধরে না। মথুরা থেকে একেবারে সোজা দক্ষিণ পশ্চিমে নেমে যাওয়া। তার মধ্যে পাহাড় পর্বত নদনদী আছে। রেখাটা টেনেছি সরল রেখায়, তার উপর দিয়েই। হিসেব আছেই সাড়ে ছ’শো মাইলের মতো। কিন্তু এই দ্বারকা সেই দ্বারকা বলে জানি না। সেই নগরীকে খুঁজে নিতে হবে পশ্চিম সাগরের জলের তলায়।”

হ্যাঁ, লেখকের জীবন্ত বর্ণনায় জলের তলা থেকেই উঠে আসে প্রায় দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বের হারিয়ে যাওয়া দ্বারকাপুরী। পাঠক পৌঁছে যায় কালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ নগরীর সিংহদুয়ারে। বৃষ্ণিবংশাবতংসাবতার বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ যেখানে নৃপতি, রৈবতক পর্বতে কুলস্থলীপুরীতে রাজত্ব করেন। মহাভারতের যুদ্ধ শেষ। প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত। কৃষ্ণ, লীলাময় নীলোৎপল পুরুষটি তখন বাহান্ন বর্ষীয়।

তাঁর‌ই রাজ্যে একদিন হঠাৎ উপস্থিত হন মহর্ষি নারদ। বৃষিবংশীয় সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁদের সন্তানসন্ততিরা ছুটে আসেন। এমনকি অন্তঃপুরে খবর যাওয়া মাত্র কৃষ্ণ‌ও, “ত্বরিত গতি উত্তাল জলস্রোতের ন্যায় নানা সম্ভাষণ করতে করতে” এসে জড়িয়ে ধরেন। মহর্ষি উপভোগ করেন এই অভিবাদনটুকু কিন্তুঃ

তাঁর তীক্ষ্ণ ভ্রুকুটি চোখে একটি জিজ্ঞাসা জেগে উঠল। বাঁদিকে, কিছু দূরে একটি ছায়াঘন, বিবিধ বর্ণাঢ্য ফুলের কেয়ারি ও লতাপাতায় কিছুটা আচ্ছন্ন, কানন মধ্যে অপরূপ রূপবান কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে সম্মুখে দেখলেন, তিনি একবারের অধিক মহর্ষির দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন না। কেন, এত ব্যস্ততা কিসের?

আসলে শাম্ব, “যাঁর কাঞ্চনের অধিক উজ্জ্বল বর্ণে পারিপার্শ্বিক সকল‌ই প্রতিবিম্বিত হয়,” “যাঁর রতিকুশলতা বিষয়ে রমণীগণ নানা কাহিনি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, অতি কামনায় অবশাঙ্গ ও মুর্ছিত হয়ে পড়েন,” যিনি “নগরীর পথে বের হলে, মাতা ও মাতৃপ্রতিম দুই চারি মহিলা ছাড়া সকল যাদবরমণীগণ‌ই, প্রছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন যে কোন অলিন্দে গবাক্ষে বা সোপানে তাকে একটিবার দেখবার জন্য ছুটে আসেন,” তিনি সেইসময় তাঁর “কাননবিহারিণী সহচরীদের মধ্যে একজনের মদির চোখের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। দেহসম্ভোগ বিষয়েই আমোদজনক নানা কূট তর্ক হচ্ছিল।” তাই দ্বিতীয়বার মহর্ষির দিকে তাকাবার অবকাশ পাননি।

অপমানে ক্রুদ্ধ মহর্ষি কীভাবে কৃষ্ণের সব থেকে রূপবান পুত্রটিকে শাস্তি দেওয়া যায় সেই ফন্দি আঁটতে থাকেন, সুযোগ‌ও আসে।‌ শ্রীকৃষ্ণকে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন যে শাম্ব তাঁর রূপের মহিমায় পিতার রমণীদের‌ও আকৃষ্ট করেছেন। মহর্ষি মিথ্যে বলে কৃষ্ণের প্রমোদকাননে শাম্বকে জোর করে টেনে নিয়ে এসে প্রায় হাতেনাতে প্রমাণ করে দেন এই অভিযোগ। স্নানরত ষোলসহস্র কৃষ্ণপ্রিয়ারা শাম্বকে দেখামাত্র তাঁদের রূপলাবণ্যরাশি অনাবৃত করে তাঁকে পেতে চাইল, ভুলে গেল তাদের নাথ শ্রীকৃষ্ণকে। কিন্তু এতে শাম্বর দোষ কোথায়?

ততক্ষণে অবশ্য বাসুদেব‌ও তাঁর সমস্ত যুক্তিতর্কবোধ হারিয়েছেন।‌ পুরুষের অহংকার আহত হয়েছে। তিনি তখন পিতা নন শুধুই ষোলসহস্র রমণীর রক্ষক। ভগবান আর মানুষে কতটুকুই বা তফাৎ? হিংসার ছোবলে নীল হতে হতে নিজের ছেলেকে অভিশাপ দিলেন, “তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠ রোগের কুশ্রীতা তোমাকে গ্রাস করুক।”

অভিশাপ জিনিসটা পুরাণ বা মিথে প্রায়‌ই ব্যবহৃত হয়। কখনও কারণে, কখনও অকারণেই একদম অতর্কিতে নেমে আসে। শকুন্তলাকে ভুলে যান দুষ্মন্ত, অহল্যা হয়ে যায় পাথর, শাপিত মেডুসার চুল পরিণত হয় সাপে। অরূপকান্তি শাম্ব হারিয়ে ফেলেন তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য। এরপরেই শুরু হয় আসল গল্প।

পৌরাণিক চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ পুত্র অভিশপ্ত শাম্ব হয়ে ওঠেন এক আশ্চর্য মানুষ। গলিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো‌ই তার গা থেকে একে একে খসে পড়ে ভোগবিলাস, নারীলিপ্সা, কামনাবাসনার যাবতীয় পার্থিব চাহিদা। তবে নিজের স্ফীত হয়ে ওঠা বিকৃত শরীর দেখে একবার‌ও কৃষ্ণকে দায়ী করেন না শাম্ব, ববং ভাগ্যের অমোঘ লিখন হিসেবেই মেনে নেন‌‌ রোগকে। “জীবন প্রবাহ কী আশ্চর্য স্বপ্নবৎ!” এই যে সঙ্কটের বিহ্বলতাকে মাথায় ঠেকিয়ে নিলেন রাজকুমার, এখান থেকে‌ই তার আত্ম উন্মোচন শুরু।

শাম্ব এককথায় ছেড়ে দিলেন দ্বারকার বিলাস। এককালে পথে বের হলে যাঁর রূপের ছটায় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠত, তিনিই নিজের বিকলাঙ্গ দেহটা নিয়ে পাহাড়ের গুহার ভিতর থাকতে লাগলেন। এই দুর্জ্ঞেয় আত্মনুসন্ধান‌ই শাম্বকে প্রকৃত শাম্ব করে তুলেছিল। আসলে দুঃখের ওই আগুনটুকু দরকার, যাতে ঝলসে হৃদয় নিকষিত হেম হয়ে ওঠে। একটানা সুখ পাঁকের মতো বেঁধে ফেলে মানুষকে, গ্রাস করে‌। শাম্ব‌ও গ্রাস হতে হতেও বেঁচে গিয়েছিলেন।

মহর্ষি নারদ একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন শাম্বকে, সে ঠিকানা সূর্যালোকের। বলেছিলেন, “তুমি যাবে মহানদী চন্দ্রভাগা তীরে, সেখানে মিত্রবনে সূর্যক্ষেত্র বর্তমান। সেখানে তিনি পরমাত্মারূপে অতি উজ্জ্বল পুরুষরূপ নিয়ে রয়েছেন।” শাম্ব সেই দীর্ঘপথ হাঁটার আগে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ততদিনে ব্যাধি আক্রান্ত শাম্বর, “নাসিকা মধ্যস্থল দুই গিরি শৃঙ্গের ন্যায় ভগ্ন। তার ভ্রূযুগল কেশহীন, সমস্ত মুখমণ্ডল মলিন কালিমালিপ্ত এবং তাম্রাভ।” কৃষ্ণ কি তখন ককিয়ে ওঠেননি মনে মনে? তিনি বলেন, “এত দূরবর্তী পথ তুমি অশ্ব চালিত রথ অথবা অশ্বারোহণ ব্যতিরেকে কেমন করে যাবে? ক্ষুধা তৃষ্ণা ছাড়াও পথ চলতে আরো কত রকমের প্রয়োজন থাকে।” কিন্তু কিছুই নিলেন না শাম্ব। কারণ ততদিনে অন্তঃস্থলে এক পূতঃ মন্ত্র ধারণ করেছেন তিনি, মন্ত্রটি হল, “আমি অভিশপ্ত, মুক্তির সন্ধান ছাড়া কিছুই আমার গ্রহণীয় নয়।” যখনই অনতিক্রম্য পাহাড় দেখেছেন, বন্য শ্বাপদ তেড়ে এসেছে, মানুষ ঘৃণায় পাথর ছুঁড়ে মেরেছে, এই বীজমন্ত্র তাঁকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

চন্দ্রভাগা নদীর খোঁজ করতে করতেই শাম্ব পেয়েছিলেন তাঁর‌ই মতো আর‌ও সত্তরজন‌ কুষ্ঠরোগীদের। গ্রহরাজ সূর্যের অস্তাচলমানস্থানে তারাও রোগমুক্তির জন্য এসেছিল, কিন্তু রোগ সারেনি। তারা ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে। কালকূট লিখলেন সেই সত্তরজন মানুষের এক আশ্চর্য কলোনির কথা যারা বলে, “আমরা সবাই একদিন পচে-গলে মরে যাব। রোজ একটু একটু করে আমাদের হাত-পা খসে যাচ্ছে।” এমত অবস্থায় কী করে তারা?

সম্ভোগ করে‌।‌ কী অদ্ভুত ট্রাজেডি! ওটুকুই তাদের সুখ। নীলাক্ষি তাই এগিয়ে আসে শাম্বর দিকে। তার “পুচ্ছহীন রক্তাভ চোখ, ভগ্ন নাসা, ক্ষয় ক্ষত ঠোঁট, স্ফীত পাংশু মুখ” নিয়ে আবেদন জানায় তার পুরুষ হ‌ওয়ার জন্য। মরতে মরতেও যতটুকু জীবন পাওয়া যায় তাই বুভুক্ষুর মতো খেয়ে নেয় এরা। নীলাক্ষী বলে – 

আমার এই যে শরীরটা, এর বাইরে কোন সাড়‌ই এখন আর নেই। তুমি যদি আমার বুকে হাত দাও, আমি টের পাবো না। এখন শুধু শরীরের ভেতরেই সাড় আছে। যেমন জিভ দিয়ে এখন‌ও খাবারের স্বাদ পাই। হয়তো মরার আগে পর্যন্ত এই সাড়‌ই থাকবে। এই সুখটাকে তুমি কেন আমাকে দেবে না?

শাম্ব কিন্তু পেরেছিলেন। হতাশাগ্রস্ত এই কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে আশার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরও নিজের যাত্রাপথের সঙ্গী করলেন তিনি। বিশ্বাস সঞ্চারিত হল, খুঁজে পাওয়া গেল “সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য” গ্রহরাজ সূর্যের মন্দির আর প্রভাযুক্ত ঋষিকে। শুধু নিজের নয় রাজকুমার শাম্ব বাকি কুষ্ঠরোগীদের‌ও মুক্তির দিশা দেখালেন। কামনা জর্জরিত বিকৃত নীলাক্ষিও হয়ে উঠল ধ্যানমগ্না পূজারিণীর মতো পবিত্র, সুন্দর।

‘শাম্ব’ উপন্যাসটা বস্তুত ভ্রমণকথা‌ই। তবে পার্থক্য হল এই ভ্রমণপথ শুধুমাত্র বাইরে নয় অন্তরে‌ও বিস্তৃত। কুষ্ঠ রোগী শাম্ব যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিল, সেই পথে কখন যেন যুদ্ধবিশারদ শাম্ব, রতিবিশারদ শাম্ব নিজেরই ভিতরে অলৌকিক চিতা সাজিয়ে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। ফিনিক্স পাখি যেমন তার ছাই থেকে আরেকবার উঠে আসে, শাম্ব‌রও তেমনই নবজন্ম হয়েছিল। যেমন ভাবে মানুষ শোক ত্যাগ করে, তেমনভাবে তিনি ভুলে গেলেন রাজৈশ্বর্যের সুখ। এক বৃহত্তর সুখ এখন তাঁকে মাতিয়ে রাখে। অপ্রাপ্তিই তাঁকে শিখিয়েছে সেই সুখের মহিমা।

‘শাম্ব’ উপন্যাসটি শেষ হয় মহর্ষি নারদ এবং শাম্বর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। এটাও যেন একটা বৃত্ত। উপন্যাসের শুরুতে ছিল তাঁদের দ্বন্দ্ব। যে শাম্বর দিকে মহর্ষি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন, তাঁর দিকেই তিনি চেয়ে থাকেন মুগ্ধ, বিস্ময়াপন্ন চোখে। রমণীমোহন রূপের অধিকারী শাম্ব এবার পুজো করছেন। সিন্ধু ও চন্দ্রভাগা সঙ্গমে যে দারুমূর্তি শাম্ব পেয়েছেন, তাই গ্রহরাজের বিগ্রহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কৃতাঞ্জলিপুটে গ্রহরাজকে সম্বোধন করে মহর্ষি উচ্চারণ করলেন, “হে সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য, হে শাম্বাদিত্য!”

শাম্ব শিহরিত হন, শিহরিত হয় পাঠক‌ও। কারণ এই অভিনব যাত্রা পথ যে নিশান বাঁশি বাজিয়ে শেষ হয়, সেখানে এক পৌরাণিক চরিত্রের খোলস ছেড়ে শাম্ব হয়ে গেছেন সর্বস্বান্ত ব্যক্তির প্রতিনিধি, যিনি তাঁর অদম্য মানসিক শক্তিতে বিজয়কেতন উড়িয়েছেন। রৈবতক পর্বতের কৃষ্ণনীল মহীরুহের মাথা ছাড়িয়ে যা পাঠকের আকাশেও পতপত করে ওড়ে, স্পর্শ করে।

**অবসর গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা

রুমি বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর স্নাতক এবং ম্যানেজমেন্টের স্নাতকোত্তর। লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে। কয়েকটি মুদ্রিত‌ সংকলনে গল্প এবং কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘পুরাণকথা পরণকথা’, ‘শেষ চিঠি’, ‘বরফকাঠি জমজমাটি’, ‘কবিতা তোমায় ভালোবেসে’, ‘অণুতে অসীম’, ‘ফ্যান্টাসায়েন্জা’ এমন কয়েকটি সংকলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *