পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’

পাঠপ্রতিক্রিয়া: 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে'

পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’
লেখক: কালকূট

কুম্ভ নিয়ে খুব হইচই পড়েছে চারিদিকে। ভক্তির ঢেউয়ের উথাল পাথাল অবস্থা। কুম্ভে যেতে না পারি, ঘরে বসে রসাস্বাদন তো সম্ভব! তাই এই মাসের গোড়াতেই ধুলো ঝেড়ে নামিয়ে ফেলেছিলাম পোকায় কাটা আগস্ট ১৯৭৫-এ প্রকাশিত ‘কালকূট রচনা সমগ্র।’ আর পড়ার মাঝেই চোখে পড়ল অবসর-এর এই ইভেন্ট।

‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ পড়ে যা বুঝলাম, এটা কোনো ট্রাভেলগ নয়। ভ্রমণোপন্যাস বললেও তার পুরো পরিচয় দেওয়া হয় না। লেখক কালকূটের রচনার মূল কথাটিই হল ‘মানুষ।’ পুণ্যের লোভে কিংবা তীর্থ করতে তিনি কুম্ভে যাননি। গিয়েছিলেন মানুষ খুঁজতে, মানুষের মেলায়। তাই তো কত বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র ঘটনা তাঁর রচনায় বিচিত্রতর ছায়া ফেলে গেছে। যাকে আবার কেবলই ছায়াও বলা চলে না। কিছু পটভূমিকা তৈরি করেছেন তিনি। আর তাঁর সৃষ্ট পটভূমিকাগুলির সংস্পর্শে অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যক্তিপাত্রগুলি নতুন নতুন স্তর পেয়েছে। পট ও পাত্রের মিশ্রণে রচনাটি স্বাদে হয়ে উঠেছে অভিনব।

‘কালকূট’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রাণঘাতী বিষ। এই ছদ্মনাম ধারণ করে বিষ ও বিষজর্জর ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেন এক হয়ে আছেন। এমন মানুষকেই তো অমৃত পিপাসা সাজে। যে পিপাসা দিয়ে তিনি দেশকে, বিশাল ভারতবর্ষকে চিনতে চেয়েছিলেন পরম মমতায় এবং জিজ্ঞাসায়। কালকূটের নিজের কথাটিই স্মরণ করি:

“চোখের সামনে কল্পনা এঁকে দিল একটি ছবি। প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে মহামানবের মেলা। বলতে কি, কেমন যেন একটা শিহরণ ঢেউ দিল প্রাণে। বাঁশির ডাক শুনতে এবার ভুল হল না। সারা দেশের মূর্তিখানি যদি দেখতে হয় তবে এই মেলার প্রাঙ্গণে চলো।”

তাঁর হৃদিকুম্ভ ভরে গিয়েছিল মানুষরসের স্বাদে। কোলাহল, ব্যস্ততা, ব্যাকুলতা, ঊর্ধ্বশ্বাস মানুষ তাঁর মনের মধ্যে বাজিয়ে তুলেছিল সহস্র রাগিণী, একই তারের ঝঙ্কারে। মনে হয়েছিল –

একলা চলছি নে। শত শত লক্ষ লক্ষ চলেছে। যেন আমারই সঙ্গে চলেছে সবাই। যেন চলেছে আমারই পায়ে পায়ে, আমারই হৃদস্পন্দনের তালে তালে, ছায়া ফেলে আমারই হৃদয়-সরসী-নীরে।

খাঁটি সোনায় যেমন গহনা নির্মাণ হয় না, তেমনি সংগৃহীত অভিজ্ঞতা বিশুদ্ধ সাহিত্যের একমাত্র উপকরণ হতে পারে না। তার জন্য চাই লেখকের অন্তর্দৃষ্টি। যা চরিত্রের শরীর ভেদ করে পৌঁছে যাবে অন্তরাত্মায়। আর তা প্রকাশের জন্যে চাই অনুভবি কল্পনাশক্তি। কালকূটের এই সহজাত গুণটিই ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ রচনাটিকে নিয়ে গেছে সকল পাঠক হৃদয়ের অন্তরমহলে। কী নিপুণ মায়াবী চোখ তাঁর। তাই তো প্রতিটি চরিত্রের জ্বালা যন্ত্রণা অন্তর্দ্বন্দ্বকে অমন সূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন ছত্রে ছত্রে।

হরেক চরিত্রের মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে পঙ্গু নুলা বলরামের চরিত্রটি। যদিও চরিত্র কেন বলছি, সে যে মানুষ! রক্ত মাংসের বাউলপ্রাণ সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ। যেমন মানুষদের পথে ঘাটে দেখে আমরা ভিখারি ভেবে এড়িয়ে চলি। স্বয়ং লেখকও বলরামের ভক্তপ্রাণকে প্রথমে চিনতে পারেননি, কিন্তু ট্রেনের কামরায় বলরামের গান তাঁকে বেঁধে ফেলেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। ট্রেন থেকে নেমে লেখকের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও বলরাম কিন্তু তাঁকে খুঁজে চলেছিল অন্তর থেকে। তাই তো যমুনার ধারে লেখকের চলতে চলতে কিসে যেন আটকে গেল পা। না কোন ভিক্ষুক নয়, বিকলাঙ্গ বলরাম। পাগলের মত গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠল সে –

তুমি কে-এ, পাগলপারা হে!
বহুদিনের চেনা বলে মনে হতেছে,
পাগলপারা হে!


তার সেই কাতর ‘ঠাকুর’ ডাক, মাথার গামছাখানি খুলে বালু-সৈকতে পেতে দেওয়া আর গেয়ে ওঠা –

ভুঁয়ে নি সে বইসবেরে ধন?
বইসবে হিয়ের মাঝখানে।

তারপর নিজের খোলা বুক দেখিয়ে বলা, “ওই গামছা আমার মনে হিদয় কইরে দিলাম, বইসতে হইবে।” বলরামের কথার বাগানে লেখকেরও নিজেকে দীন বলে মনে হতে থাকে।
শুধু বলরাম নয় তার আমঘাটার আখড়ার অধ্যক্ষা লক্ষ্মীদাসী, আর তাদের মধ্যেকার প্রেম লেখকের সঙ্গে আমাকেও বিস্মিত করে।

দীনহীন গরিব অভাবী মানুষের মধ্যে প্রেমের বাস যে চিরস্থায়ী, তা লেখক টের পেয়েছেন মেলায় পরিচিত এমনই বহু মানুষের সঙ্গে মিশে। যেমন, সাপুড়ে সন্ন্যাসী ভূতানন্দ আর ভৈরবীর প্রেম। যেমন, মেলার বিখ্যাত নারী চোর আর তার রুগ্ন স্বামীর প্রেম। যেমন, প্রহ্লাদ আর তার মিষ্টি বাচ্চা বৌ ব্রজবালার প্রেম। যেমন, রঘুনন্দন আর রুক্মিণী অথবা রামজীদাসীর প্রেম। আর শ্যামা? বিবাহিতা শ্যামার হৃদয় তো প্রেমেরই চরাচর। এই সকল মানুষের জীবনে যত অভাব, তত প্রেম, তত সন্ন্যাস। প্রেমের ঘোরে এরা সহজ আর অসীমকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যা বড় যন্ত্রণার, বড় ব্যথার, মহা সুখের, মহা আনন্দের। আর কোনটাই যে সহজে কেউ খুঁজে পায় না।

লেখক মনে করেন, তাঁর কোন অধ্যাত্মবাদের অনুভূতি নেই। নিতান্তই বিজ্ঞানাশ্রিত মানুষ তিনি। জীবনে আছে অনেক বিড়ম্বনা। তার মাঝে ফাঁকতালে তিনি ছুটে এসেছেন জনসমুদ্রের মহাসঙ্গমে। অথচ সেখানে গিয়ে পেয়েছেন রক্তমাংসের উচ্চ-নীচ মানুষ আর বেদাশ্রিত সন্ন্যাসীর প্রেম। যা বিচিত্র। সেখানে পরিচিত হয়েছেন অবধূতের সঙ্গে। কারা এই অবধূত? এরা জ্যোতমার্গের সাধন করে। অনেক যার ক্রিয়াকাণ্ড। বালাসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব হল মূল কামনা। ঘৃত-কর্পূরের প্রদীপকে তারা পূজা করে। প্রদীপের চারিপাশে সাক্ষী থাকেন কালী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, হনুমান আর ভৈরব। পূজার উপাচার হল প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, মতি ও চক্রী। যার গুপ্ত শব্দ হল মদ, মাংস, মাছ, অন্ন আর পুরি। এছাড়া আছে সপ্তমী, ষষ্ঠী। মানে গাঁজা আর তামাকু। এই হল তাঁদের জ্যোতমার্গে প্রবেশের পন্থা। সাধকের সিদ্ধিলাভের বিচিত্র লীলা। যে লীলার কথা না বুঝলেও পড়ে অবাক হই বৈকি!

লেখকের সঙ্গে পাঠক আমি আরো অবাক হই পুণ্য ক্ষেত্রে অসাধুতা, চৌর্যবৃত্তি এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটে শুনে। পাঁচুগোপালের কাছে লেখক জানতে পারেন,

“‘এই গেলবারের হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় তিনজন এরকম খুন হতে দেখেছি। তারা সবাই তোমার মত ভদ্দরঘরের ছেলে।’
‘কিন্তু এই তীর্থক্ষেত্রে?’
‘এইখানেই তো সহজ। তীর্থক্ষেত্তর বলে তো আর কারুর আসতে মানা নেই।’”

বুকে লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েও মানুষ তীর্থে আসে। একসময় যে লক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াত, সে-ই সাধুর পিছনে পিছনে ঘুরে শহরে এক ছোট্ট খুপরি ঘর নিয়ে দোকান করে বসে। পাথরের ছোট ছোট কটা শিবলিঙ্গ, মহাদেব, বিষ্ণু বেচেই দিনে দিনে লাখপতি হয়ে ওঠে। আসলে তো লক্ষ মনে লক্ষ কামনা, বাসনা, প্রবৃত্তি। সকলেই পাগলের মত ছুটে চলেছে ঈপ্সিত বস্তুর পেছনে। অথচ যে ছোটা আসলে মরীচিকার পিছনে ছোটা। তাই তো লেখক বলেন,

“জীবনভর হয়তো সে এমনি ‘পেয়েছি’ ‘পেয়েছি’ বলে উল্লাসে বুক বেঁধে ছুটে চলেছে। ছুটবেও ওই ভয়ঙ্করী মরীচিকার পিছনে। তারপর একদিন আসবে, হয়তো শেষ দিন। তার পলকহীন চোখে ফুটে থাকবে অভাবিত বিস্ময়, তীক্ষ্ণ ভ্রুকুটি। দু ফোঁটা জল।”

চোখে লোভের চশমা এঁটে যেমন মানুষ তীর্থ করতে আসে, তেমনই কেউ তীর্থক্ষেত্রে আসে কেবলই কুসংস্কারের বশে। যেমন লেখকের চোখে দেখা শিবপিয়ানী। শিবপিয়ানী সদ্য বিধবা। এক সদ্যোজাত সন্তানের মা। বিধবা শিবপিয়ানী এসেছে তার সকল স্বর্ণ অলঙ্কার সঙ্গমের জলে ভাসিয়ে দিতে আর তার পিতৃহারা সন্তানকে পুণ্যস্নান করাতে। তাতে নাকি শিশুর পরমায়ু বাড়বে। লেখকের মনে পড়ে যায় ট্রেনে আসার সময় দেখা তাঁর এক সহযাত্রীর মৃত্যুর কথা। তিনি লেখেন,

“এক সঙ্গীকে হারিয়েছিলাম পথে আসতে। সে আসছিল তার ব্যাধিমুক্তি ও আয়ু সন্ধানের জন্য। আমরা একজন মরি, আর একজন জন্মাই। দিবানিশি এই যাওয়া আসার মধ্যে আমরা নতুন থেকে নতুনতর। একজনের আকাঙ্ক্ষা পুরাই আর-একজন। একজনের পথের শেষে শুরু করি আর একজন। সেজন্য আমরা মানুষ, আমরা বন্ধু।”

কখনো মুষলধারে বৃষ্টি, কখনো অসহ্য শীত প্রকৃতির রোষানলে পড়ে মানুষ পুণ্যস্থানেও দুর্ভোগ পোহায়। যেমন অভিজ্ঞতা স্বয়ং লেখকেরও হয়েছিল। তখন তিনি দেখেছেন একটু আগুনের জন্য কাড়াকাড়ি, মারামারি। লকড়ি বা কাঠের জন্য হাহাকার। সাধুও তখন চোর হয়। আর দেখেছেন মৃত্যু। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল।

“মানুষে সাধুতে দলে পিষে প্যারেড গ্রাউন্ডে হনুমানজির মন্দিরের কাছে মৃতদেহের স্তূপ জমেছে। তাকে ঘিরে রয়েছে পুলিশ-বাহিনী। অপরিচিত নারী ও পুরুষ কণ্ঠলগ্ন হয়ে পিষে মরেছে। শিশু চেপটে লেপটে রয়েছে মায়ের বুকে। যে দেহ ও রূপ নিয়ে অনেক লজ্জা, তা আজ ঠাণ্ডা, স্পন্দনহীন স্তূপীকৃত। রঙিন ওড়না আর সিল্ক শাড়ি, নাগরা জুতো আর কলিদার পাঞ্জাবী, মাথার টিকুলি আর গলার চন্দ্রহার, তারই সঙ্গে ছন্নছাড়ার ছিন্ন বেশ, সব একাকার।”

সেই মৃত্যুর মিছিলে হারিয়ে যায় বিকলাঙ্গ বলরাম। যে বলরাম তার কথা ও গানের ফুলবাগান নিয়ে সঙ্গমে এসেছিল। যার মালিনী ছিল লক্ষ্মীদাসী। সেই বাগান দগ্ধ হয়ে যায় সঙ্গমে। তাকে ছেড়ে লক্ষ্মীদাসী ফিরতে চায় না। বলে, “চিতা নিভুক ঠাকুর, পরে যাইবা।” মূলগায়েন বলরামেরই গান গায় বসে, “তুমি যেথায় আছো সেথায় আছি। আমার মিছে ভাবনা নাই মনে। তুমি ডাকলে আপনি কপাট খোলে, তোমার বাতাসে বাতাসে তাল দিয়া নাচি।”

কুম্ভে কি শুধুই অমৃত মেলে? বিষও মেলে অনেক। যেমন বহু বিষ লেখক কালকূটও ধারণ করে ফিরেছিলেন নিজের শরীরে। জমাট দুঃখে নীল হয়ে উঠেছিলেন। তারপর মনের সেই সকল দুঃখ-সুখ উগরে দিয়েছিলেন কলমের কালির সঙ্গে মিশিয়ে সাদা পাতায়। আমরা পাঠক হৃদয় যার সন্ধানে আজীবন মেতে থেকেছি, থাকবও। অগুনতি সমরেশ বসু জন্মশতবার্ষিকী পার হয়ে গেলেও…

**অবসর গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছোটোবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কলেজ জীবনে কবিতা লিখলেও, বহুকাল হল পুরোপুরি গদ্যে চলাচল। গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি লেখাটাই প্রধান পছন্দ। প্রথম প্রকাশিত অণুগল্পের বইয়ের নাম 'খুদকুঁড়ো কথা।' লেখা ছাড়াও ভালোবাসেন সংগীত এবং ঘুরে বেড়াতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *