পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘নির্জন সৈকতে’

পাঠপ্রতিক্রিয়া: 'নির্জন সৈকতে'

পাঠপ্রতিক্রিয়া: ‘নির্জন সৈকতে’
লেখক: কালকূট

মানব জীবন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একাকী বলেই হয়তো বুকের মাঝে যে পদচিহ্ন আজ গভীর ও স্পষ্ট কালের নিয়মে সেটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সহজে। এই যে মুছে যাওয়ার সময়কাল সেটাও কি একান্তে অনুভব করার উপায় আছে? নাহ্, সে অবকাশও জীবন দেয় না, নতুন কোন পদচিহ্ন আঁকা হয়ে যায় জীবনের পটভূমিতে। প্রতিটি পদক্ষেপ জন্ম দেয় এক একটি নতুন গল্প বা উপন্যাসের। তারা কেন জন্মায় বা কীভাবে জন্মায় কেউ জানে না।

সমরেশ বসুর কালকূট ছদ্মনামে লেখা ‘নির্জন সৈকতে’ উপন্যাসটিও তেমনি কিছু মুহূর্তের জন্ম দেয়। কোনো ভূমিকা ছাড়াই হুড়মুড় করে শুরু হয়ে যায় গল্প বলা। শেষও হয় হঠাৎ করেই পাঠকের মনে বহু সম্ভাবনার বীজ জিইয়ে রেখে।

উপন্যাসের নায়ক রবীন হৃদয়বান নবীন লেখক, কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে নিরিবিলি খুঁজতে যে চলেছে পুরীধাম, উদ্দেশ্য জীবনদর্শন। যে দর্শনের প্রতিটি অন্ধকারময় রন্ধ্র উন্মুখ হয়ে থাকে আলোর অপেক্ষায়, চেনায় আপন মনের গতিপ্রকৃতি। নিজের দেশ, নিজের সমাজ এবং তার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি অনুসন্ধান করতে মানুষ তাই খুঁজে বেড়ায় নির্জনতা।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা লক্ষ্য করি, সেই নির্জনতার খোঁজে জনসমুদ্র ঠেলে রবীন কীভাবে ভিড়ে ঠাসা রেলগাড়ির বদ্ধ কামরায় একফালি জায়গা করে নেয়। অচেনা পরিস্থিতির হাতে সঁপে দেয় নিজ অস্তিত্ব। এখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চার বিধবা মহিলা এবং রেণুর। তাঁরা চলেছেন জগন্নাথ দর্শনে এবং অল্পবয়সী তরুণী ভাইঝি রেণুর মনের ভার লাঘব করার উদ্দেশ্যে। এই চারজন নিঃসন্তান বিধবা মহিলা সাময়িক বাকবিতণ্ডার পর আপন করে নিয়েছেন রবীনকে, সঙ্গে প্রার্থনা করেছেন এই বলে, “আমরা চারজন বিধবা একা…”

রেলগাড়ির মতো ঘটনার চাকা যত গড়িয়েছে আমরা দেখেছি রবীনকে ঘিরে সন্তান সুখ, সংসার সুখ বঞ্চিত এই চার রমণীর আকুলতা। কখনও তারা বলেছেন, “সংসারে তোরা শুধু কাঁদাতেই আসিস।” কখনও আবার আক্ষেপ করে বলেছেন, “তোর মতো যদি একটা ছেলে থাকত!”

তাদের একাকী জীবনের যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা কর্তব্যের চাকায় পিষ্ট হয়ে সরলরৈখিক বলেই বুঝি সংসার নামক রেলগাড়ির বদ্ধ কামরা থেকে মুক্তি মিলতেই নব আনন্দের ঢেউ, দোলা দিয়ে গেছে প্রাণে।
জগন্নাথধামের এটাই মাহাত্ম্য, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, আস্তিক-নাস্তিক সকলকে মিলিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে মানবজাতি মাত্রই নীরব দর্শক। ঢেউয়ের তালে তালে তিনিই ওঠাবেন, নামাবেন, দূরে সরিয়ে দিয়েও কাছে টেনে আছড়ে ফেলবেন পায়ের গোড়ায়।সেই জন্যই বুঝি ঐ চার রমণী রবীনের বন্ধনহীন জীবনের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেও তাকে বাঁধতে চান স্নেহের বন্ধনে।

ঘটনা এগিয়ে চলে। পরিচয়পর্ব সারা হলে লেখক সুনিপুণ দক্ষতায় পর্দা উন্মোচন করে আলো ফেলেন প্রতিটি চরিত্রের উপর। নজরে আসে রেণুর বিষণ্ণতা, ছোট বৌদির আকুলতা, সেজদির রসিকতা, অবুদির সরলতা বা শিবিদির প্রসন্ন রসিকতা। ধবধবে সাদা কাপড়ে শরীর আড়ালে রেখে তাঁরা পরিচয় দেন রঙিন হৃদয়ের, যেখানে সবুজের সতেজতা থেকে আকাশের নীলাভ বিশালতা একাকার হয়ে যায়। টুকরো মেঘের মতো ভেসে বেড়ায় আপনহারা লেখক রবীন। পথের নেশায় ছুটে বেড়ায় বিশাল জনসমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত, কখনও জলভরা মেঘ হয়ে বৃষ্টি ঝরায় তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে, মুছে দেয় রুক্ষ মনের ফুটিফাটা আবার কখনও শরতের মেঘের মত দূর করে দেয় উদাসী মনের নিঃসঙ্গতা।

জীবন প্রতিনিয়ত হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানায়, চেষ্টা করেও অস্বীকার করতে পারে না রবীন। উড়িষ্যার ব্রাহ্মণ মহিমবাবুর হাত ধরে এগিয়ে চলে কাহিনি।

বিষাদপ্রতিমা রেণুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে রবীন জানতে পারে তার ব্যথাভরা জীবনকাহিনির খণ্ডবিশেষ। আলাপপর্ব কিছুটা গাঢ় হলে ছোটবৌদি জানান বাকিটুকু। রবীনের সংবেদনশীল মনে অনুরণন তোলে সে কাহিনি। বোহেমিয়ান জীবনের অভিযাত্রী লেখক বন্ধনে জড়াতে চান না বলেই বাসস্থান পরিবর্তন করেন, তবুও নিয়তির টানে দেখা হয়ে যায় আবারও।

সমুদ্রতটে চারজন বয়স্কা রমণীর আন্তরিক রঙ্গরসিকতা পরিস্থিতি সহজ করে তোলে, সমুদ্রের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুঃখটুকু অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয় রেণুরও, বঙ্গোপসাগরের হাওয়ার দাপট উড়িয়ে নিয়ে যায় যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তাই বুঝি রেণু নামক এক তরুণী প্রায় অচেনা এক যুবকের কাছে মেলে ধরে নিজের অন্ধকারময় করুণ ইতিহাস। হয়তো মেলে ধরে বলেই, খোলা হাওয়ার পরশ পেয়ে সেই দুঃসহ যন্ত্রণা ক্রমশ বিলীন হতে থাকে। ফিকে হতে হতে একসময় মুছে যায় রেণুর মন থেকে। সেই কারণেই রেণু বলে ওঠে, “আজ আমার কোনো বেদনা নেই, অনুশোচনা নেই, নিখিল আমার কাছে অচেনা।”

অচেনা লাগে সিদ্ধকামবাবুকেও। আপাদমস্তক ভোগ বিলাসে মত্ত সিদ্ধকামবাবু নির্দ্বিধায় নিরীহ পাখি শিকার করে হেসে ওঠেন “হা হা” করে। তিনি উল্লেখ করেন স্থানীয় রীতির কথা। পুণ্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় নির্জন, গাছপালাবিহীন, রুক্ষ দ্বীপে এসে মানুষ মানত করে, মুরগি, ছাগলের মত নিরীহ প্রাণীদের ছেড়ে দিয়ে যায়। জল এবং খাদ্যের অভাবে তিল তিল করে মারা যায় প্রাণীগুলো। সিদ্ধকামবাবুর বক্তব্য এও এক ধরনের বলি। মানুষের জীবনও তেমনি, ঈশ্বরের কাছে বলিপ্রদত্ত। সেইজন্যই আমরা নিজেকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিজস্ব বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে পড়ি। আপন চাওয়া পাওয়ার তাগিদে ঘুরে মরি প্রতিনিয়ত।

এই চাহিদার কারণেই পরিবার ত্যাগ করেছেন সিদ্ধকামবাবু, জীবনকে একাকী ভোগ করবেন বলে। সুরা পান বা নর্তকীর লাস্য যাঁর নিত্যসঙ্গী, সেই তিনিও রেণুকে একঝলক দেখে অনুভব করেন জীবনের প্রতি তার নির্লিপ্ততা, পড়তে পারেন অচেনা যুবতীর অব্যক্ত মুখের ভাষা। রবীনের কাছে বলে ফেলেন, “এমন মুখ আমার চেনা।” সেইজন্যই বোধহয় সিদ্ধকামবাবুর কিছু কিছু কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে না পেরেও রবীন অস্বীকার করতে পারে না তাঁর আন্তরিকতা। অসুস্থ হয়ে পড়ার সংবাদ পাওয়া মাত্র ছুটে যায় আগুপিছু না ভেবেই।

এদিকে উদার প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে রবীনের উৎসাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকেন বিধবা রমণীরা। রেণু ছুটে চলে সুউচ্চ পাথরের স্তরে পা ফেলে। উদয়গিরি, খণ্ডগিরি হাজারো বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ নিশ্চল হয়ে, উপভোগ করে ইহকালের পদধ্বনি।

রাতে পূর্ণ চাঁদের আলো মেখে কখনও গুনগুনিয়ে ওঠে শিবিদি আর অবুদি। পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোলাকার টিপ পরে রেণু। জ্যোৎস্না রাতে পিকনিকে মাতে সকলে, রেণু রঙিন শাড়ি পরে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে জীবনের জয়গান। তার স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, পবিত্র মুখ দেখে লেখকের মনে পড়ে সমুদ্রের শুভ্র তরঙ্গের কথা। মনে হয় যে ছায়া ছায়া আবেশে আকাশ সমুদ্র একাকার, সেই কুহেলি অস্পষ্টতা, নিরন্তর চলমানতার উপস্থিতি রেণুর মধ্যেও বিদ্যমান।

রেণু রবীনের কাছে দীক্ষা নিতে চায়। বলে, ঘরকে বাইরে আনার যে সাধনা, সে সাধনাতেই ব্রতী হতে চায়। রবীন তাকে বোঝায় প্রকৃতির তত্ত্ব – 

প্রকৃতি জয় করা বলতে আমরা বুঝি কেবল মাত্র প্রকৃতিকে আর এক ভাবে কাজে লাগানো। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধতা করা চলে না তাকে নতুনভাবে আয়ত্তে নিয়ে এসে তার হাত ধরেই পথ চলা যায়। তাই জীবন যদি হাত বাড়িয়ে রাখে তা উপেক্ষা করা চলে না।

সেইজন্যই বোধহয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অমৃতানন্দ ওরফে খেঁকিয়ানন্দ রবীনকে ডেকে অনুরোধ করে যান, তাঁর কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার যাঁকে ত্যাগ করে তিনি পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঈশ্বর দর্শনের সাধনায়। ঈশ্বরের দেখা পাননি কিন্তু সর্বদা যে মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, তিনি আর কেউ নন, তাঁর ফেলে আসা পরিবার ননীবালা।

এখানে লেখক অনুভব করিয়েছেন, মানুষের চিরচেনার গণ্ডি ছাড়িয়ে চির-অচেনা হয়ে ওঠা এবং সমুদ্রের নিরন্তর ফেনিলোচ্ছল শুভ্র হাসির ঝলক কোথায় যেন একাকার।

শুধু মাত্র সমুদ্র নয়, সূর্যমন্দির নিয়েও লেখক মানুষের বিশ্বাসকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। চরিত্রদের মধ্য দিয়ে পাঠককে কোনারকের সূর্যমন্দির ভ্রমণ করিয়ে প্রথমেই শুনিয়েছেন পৌরাণিক কাহিনি। পরক্ষণেই আবার বলেছেন, ”পুরাণে আমরা বাস্তব খুঁজে পাই না, মানুষের বিশ্বাসে পাই, ইতিহাস তার সাক্ষী দেয়।”

পুরাণ থাক, ইতিহাসও থাক, সূর্য পূজার মাধ্যমে আমরা আসলে পবিত্র হতে চাই। আমরা কেউ শাম্ব নই, আমরা কেউ শ্রীকৃষ্ণের অভিশপ্ত সন্তান নই, কিন্তু যে ক্ষণিক জীবন নিয়ে আমাদের সংসার যাত্রা, সেখানে ব্যাধি নিত্য মুহূর্তের সঙ্গী। মানুষ তার ক্ষণিক জীবন নিয়ে তাই সূর্যের পবিত্র জীবনকে প্রার্থনা করে। অবশেষে যে জীবন লেখক খুঁজতে গিয়েছিলেন নির্জন সৈকতের বুকে, তারই দেখা পেলেন কোনারকের মন্দিরগাত্রে। লেখকের মনে হয়নি এ মন্দির অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ। বরং মনে হয়েছে, যে বিশ্বাসের আনন্দ নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই শিল্পকর্ম, তা কোনও অশিল্পীর কাজ হতে পারে না।

মন্দির চত্বরে সাবলীল রেণুকে দেখে এক কিন্নরী মূর্তি বলেই মনে হয়েছে রবীনের। রেণুকে ডেকে তার বলতে ইচ্ছে করেছে জীব ধর্মের কথা, নিজের বুকে হাত রেখে তৃষ্ণার মূলকে স্বীকার করার কথা। তাই বুঝি ফেরার সময় অবুদি, শিবিদির দেখা না পেয়ে চোখে জল আসে রবীনের। রেণু এসে আমন্ত্রণ জানিয়ে যায় চিরদিনের। জানিয়ে যায় নিখিলের ফিরে আসার কথা। বলে যায় নিখিলের স্মৃতির সঙ্গে তার অভিমান ধুয়ে মুছে যাওয়ার কথা। রবীন ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের পানে যেখানে উজ্জ্বল নীল আকাশ, সমুদ্রের মুখোমুখি হয়ে ছড়িয়ে যায় অমলিন হাসি। অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে শেষ হয় উপন্যাস।

**অবসর গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা

মধুমিতা রায় পেশায় একজন শিক্ষিকা। বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার নেশা ছোটোবেলা থেকেই, যেটা পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মধুমিতা নিজেকে খুব একটা বাকপটু বলে মনে করেন না। একদিন খেয়াল করলেন যে প্রচুর বক্তব্য জমে গেছে যা বলে উঠতে পারেননি! তখন থেকেই নিয়মিত লেখা শুরু করেন। স্কুল ও কলেজের ম্যাগাজিনে লিখতেন। বর্তমানে বিভিন্ন লেখালেখি সংক্রান্ত ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে সফলতা এসেছে এবং লেখার উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু শারদীয় পত্রিকা এবং যৌথ সংকলনে মধুমিতার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *