শূন্য, এক এবং অনন্ত সন্ধান

শূন্য, এক, এবং অনন্ত সন্ধান

 “Your eyes see what your mind knows” 

কিছু প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। কারণ বেশিরভাগ উত্তর আসে দর্শন থেকে। তাই আলাদা আলাদা রংয়ের আতশ কাচ ফেললেই বদলে যায় দৃশ্যপট। যদি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ট্রাফিকের ভিড়ে জিজ্ঞেস করা হয়, “কী দিয়ে সবকিছু গড়া? কি আমাদের এই সভ্যতার চাবিকাঠি?” উত্তরগুলো হবে বেজায় বৈচিত্র্যময়। টাকা পয়সা থেকে ভালোবাসা, বিজ্ঞান থেকে আধ্যাত্মিকতা ছুঁয়ে মোক্ষ, আবুল হাসান থেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ …অজস্র কাচের টুকরো পেয়ে যাবেন আপনি, যারা প্রত্যেকে সঠিক। আবার সকলেই ভুল। মেকি। একটাই নীরস, রঙচটা বিষন্ন সত্যকে তারা ঢাকতে চাইছে নানান বর্ণচ্ছটায়। আসল উত্তরটা আমার আপনার সবারই জানা, তবে সেটা এতটাই সাধারণ যে আমরাই তাকে এতবড় মর্যাদা দিতে সাহস পাই না।  

আমাদের এই অস্তিত্ব, এই ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালোবাসা, আট বিলিয়ন মানুষের এই সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে একটাই জিনিসের ভিত্তিতে – তথ্য। তথ্য মানেই জ্ঞান, জ্ঞান মানেই শক্তি আর অমরত্ব। কয়েক লাখ বছর আগের Homo floresiensis-দের সাথে সেখানেই আমাদের বিরাট একখানা তফাৎ গড়ে ওঠে স্পষ্ট দেওয়ালের মত অমোঘ হয়ে। ওরা তথ্য পেয়েছে কিন্তু কাজে লাগাতে শেখেনি, হয়তো বা কাজেও লাগাতে চেয়েছে কিন্তু তথ্যের মূল্য বোঝেনি, কিন্তু আমরা, এই homo গণের sapiens অর্থাৎ জ্ঞানী মানুষরা নিজের জীবন দিয়ে হলেও তথ্যের মূল্য বুঝি। 

 (১) 

তথ্য না কি সত্য? তথ্য মানেই স্রেফ সত্য না। তথ্য অমোঘ এক অস্ত্র, হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও কয়েকশো গুণ প্রাণঘাতী। তথ্য আহরণ করা, তথ্য ব্যবহার করার সাথে সাথে শুন্য থেকে নতুন তথ্য তৈরিও করতে পারি আমরা, তথ্য বদলে দিয়ে পরিবেশন করতে পারি নিজের সুবিধে মত। শত্রুর সম্মন্ধে স্রেফ ছোট্ট একটা খবর বা “ইন্টেল” এর জন্য যে কত রক্তক্ষয় হয়েছে ইতিহাস তার সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা কোল্ডওয়ার যুগের espionage’-এর গল্প বলার পরিসর এখানে নেই। তবে, উদাহরণ খুঁজতে অত বেশি দূরেও যাওয়ার দরকার নেই। ইন্টারনেটের দৌলতে উইকিলিক্স এর নাম মোটামুটি আমরা অনেকেই জানি।

তারিখ ৪ঠা অক্টোবর, সাল ২০০৬। “সেনসিটিভ ইনফো” এবং জাতীয় সুরক্ষার ধুয়ো তুলে যে কত ঘৃণ্য, বিশ্রী ষড়যন্ত্র আর হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ কারচুপি’কে রাতারাতি ঢেকে ফেলে ভালোমানুষ সাজে “জনদরদী” সরকারগুলো, জুলিয়েন অ্যাসাঞ্জ নামের অস্ট্রেলিয়ান সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ, হ্যাকার তথা সাংবাদিক তাঁর নতুন সাইটে বিশদে লিখলেন তার হাঁড়ির খবর। রীতিমত সাড়া পড়ে গেল নেট দুনিয়ায়। আর খুব তাড়াতাড়িই ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে সত্যিকারের রাজনীতির জগতেও কাঁপন ধরিয়ে দিল তাঁর পরবর্তী কাজগুলো। ২০১০ সাল নাগাদ উইকিলিক্স দুটি ধাপে আস্তে আস্তে প্রায় সাত লাখ আঠেরো কোটি গোপন নথিপত্র তুলে দিল নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান সহ পাঁচটি সংবাদ সংস্থার হাতে। তথ্যসূত্র অজ্ঞাত। প্রতিটি নথিই বিতর্কিত তথ্য ঠাসা, কনস্পিরেসি থিওরির সোনার খনি প্রায়। দুনিয়াকে অবাক করে সামনে এল ইরাকের উপসাগরীয় যুদ্ধ কিংবা আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কলঙ্কিত অধ্যায়, দিনের আলোর মুখ দেখল কেনিয়ায় কুখ্যাত গণহত্যার লজ্জাজনক ইতিহাস।  

অ্যাসাঞ্জ তাই বলে নায়কের সম্মান পাননি, বরং মিলেছে খুনের হুমকি । নিষিদ্ধ হয়েছেন একের পর এক দেশে, গুপ্তঘাতকের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতেই জীবন কেটে যাচ্ছে তাঁর। তাদের প্রকাশিত খবরগুলোর মত উইকিলিক্স এবং অ্যাসাঞ্জ নিজেও ধূসর এক চরিত্র। অনেক সাংবাদিকের কাছে তিনি প্রায় idol, এদিকে বিভিন্ন সময়ে বহু বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর নিজের নিরপেক্ষতা নিয়েই। ২০১৬ সালের পর থেকেই তাল কেটে যায়। বিপুল জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যতই কালিমালিপ্ত হোক না কেন অ্যাসাঞ্জের উইকিলিক্স, এটা না মেনে কোনো উপায় থাকে না যে মুক্ত সাংবাদিকতার pioneer তিনিই। আজকের এই প্রোপাগান্ডা, ফেক নিউজ আর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার ভিড়ে যেখানে কে ঠিক, কতটা ঠিক সেটা বোঝাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একদম চোখে আঙ্গুল দিয়ে সাদা-কালোর তফাৎ করে দেওয়ার অসীম স্পর্ধা তিনি ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারেননি, অন্তত তখনও। 

ওপেন জার্নালিজম মুভমেন্ট কিন্তু এখানেই থেমে নেই, বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। হালের বেলিংক্যাট (Bellingcat) থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের “ভিজুয়াল ইনভেস্টিগেশন,” ওয়াশিংটন পোস্টের “ভিজুয়াল ফরেনসিক,” টিমগুলো তৈরি করেছে নতুন এক ধরনের সাংবাদিকতা, যার নাম OSINT বা open source intelligence। এর মূল কথাই হচ্ছে ইন্টারনেটের সমুদ্রে ছড়িয়ে থাকা অজস্র আপাত অবান্তর তথ্য থেকে জরুরি সূত্রগুলো উদ্ধার করে আনা। তাই বলে এর জন্য হ্যাকিং বা ডার্ক ওয়েবের দরকার নেই। আমাদের চোখের সামনে, বলতে গেলে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব প্রশ্নের উত্তর। শুধু জানতে হবে কোথায় দেখতে হবে, কী ভাবে খুঁজতে হবে। এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা, কিছু বিশেষ কি-ওয়ার্ড আর একটা সামান্য গুগল সার্চ দিয়েই হঠাৎ ফাঁস হয়ে গেছিল ইউরোপে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের গোপন লোকেশন। 

ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার অনুপ্রবেশ আর ধ্বংসলীলা চাপা দেওয়ার জন্য যখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে দেশের সরকার, এই OSINT গোয়েন্দারাই কিন্তু স্যাটেলাইট ইমেজ আর টুইটারের মতো পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তুলে ধরেছিলেন আসল যুদ্ধের শিউরে ওঠার মত ভিডিও, রক্তাক্ত সব ছবি। নগ্ন নির্মমতা। অবিকৃত, দ্বর্থ্যহীন সত্য। দিনের শেষে সেই সার সত্যিটুকু বের করে আনাই তো সংবাদমাধ্যমের কাজ। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যে!

(২) 

এক আর শূন্যের বাইনারি সিস্টেমে গড়া কম্পিউটার বলে, তথ্যই আমাদের শক্তিশালী করেছে, সবসময় দু’ধাপ এগিয়ে রেখেছে পশুদের থেকে, আর সেইসব মানুষদের থেকেও যারা এখনও তথ্যকে নিজেদের কাজে লাগাতে শেখেনি। কিন্তু আবার ঘুরে ফিরে চলে আসে দর্শনের এই অমোঘ প্রশ্ন। “কী? কেন?” সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম হেডলাইনস দেখা আর রাতে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করতে করতে ঘুমানো – এই দুইয়ের মাঝে দিনের যে বাকি সময়টুকু, একজন নিতান্ত ছাপোষা মানুষের জীবনেও সেই ঘণ্টাগুলো কয়েক লাখ GB’র সমান তথ্য দিয়ে ঠাসা। সেটা বিলাসিতা নাকি প্রয়োজনীয়তা? প্রশ্নটা করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আবার সেই রঙিন কাচের উপমাটাই ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। কারণ উত্তরগুলো হবে বেজায় বৈচিত্র্যময়, বিশ্রী রকমের পরস্পর-বিরোধী। পুরোপুরি কোয়ান্টাম যুগে পা দেওয়ার কয়েক দশক আগে দাঁড়িয়ে আজ এই দু’হাজার তেইশের দুর্গাপুজোর সময় কখনও কি আপনার মনে হচ্ছে না, আসলে ঠিক কতটুকু দরকার আমাদের? কী বললেন, সভ্যতার বিকাশ? প্রগতি? জ্ঞান আমাদের এগিয়ে রেখেছে? হ্যাঁ তা বলতে পারেন।

এরোডায়নামিক্সের জ্ঞান ছাড়া উড়োজাহাজ আবিষ্কার হতো না, চাঁদের বুকে পড়ত না মানুষের পায়ের চিহ্ন। সেমিকন্ডাকটর পদার্থবিদ্যার গবেষনা না হলে প্রিয় মোবাইলটা পর্যন্ত থাকত না আপনার হাতে। কিন্তু ভালো রেখেছে কি? কয়েক মিলিয়ন বছরের জটিল বিবর্তনের গোলকধাঁধায় ঘুরে মরার পর ঠিক কী পেয়েছি আমরা? যে উন্নতিকে উন্নতি বলেই চালাই আমরা, সেই ‘উন্নতি’টা আমাদের অতিরিক্ত কী এনে দিয়েছে?

কথাটা ভীষণ নিহিলিজম এর মত শোনাচ্ছে। সেই যে একদল মানুষ বলেন, nothing matters- কিছুতেই কিছু এসে যায় না, মোবাইল না থাকলেই বা কী হতো, আমরা তো বেঁচেই থাকতাম তাও। ঠিক সেইরকম। তেমন চরম উদাসীনতা এই লেখার উদ্দেশ্য না। তবু ভীষণ ভয় করে যখন শুনি, হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড আর ফেসবুক কাজে লাগিয়েই বদলে দেওয়া যাচ্ছে ভোটের ফলাফল, সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে পরিকল্পনামাফিক তৈরি হচ্ছে দাঙ্গা। মনে প্রশ্ন জাগে যখন পড়ি, তিরিশ হাজার বছর আগে আফ্রিকান সাভানা কিংবা আমাজন রেনফরেস্টে ঘুরে বেড়ানো আমাদের পূর্বসূরীদের মস্তিষ্কের আকার আমাদের চেয়েও বড়ো ছিল! নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের মতে একজন নিতান্ত সাধারণ গুহামানবের শারীরিক দক্ষতার সাথে একমাত্র তুলনা করা যায় অলিম্পিকের ম্যারাথন রানারদের, বনবাসী “অসভ্য” আদিম sapiens মানসিক ভাবে যতখানি চৌখস ছিল, একবিংশ শতাব্দীর কোনো জেদি মানুষ একশো বছর চেষ্টা করলেও সেই জায়গায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা বেজায় ক্ষীণ। আমরা উন্নতি করেছি নিশ্চিতভাবেই। আকাশ বাতাস স্থলভাগ জয় করার পর আজ মানবসভ্যতার জ্ঞানের পরিধি মহাকাশ ছুঁয়েছে, দেবতার অভিশাপকে এখন আমরা বন্যা, বজ্রপাত বলেই জানি, বান মারা নয় আমরা এখন বাইপোলার ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা করি। আমরা এখন জানি রূপকথায় বা পুরাণেই না, সত্যি সত্যি আকাশে উড়তে পারে মানুষ, ডুব দিতে পারে মহাসাগরের গভীরতম অন্ধকারে। কিন্তু এইসবই তো collective knowledge, সমগ্র জ্ঞানভাণ্ডার যাকে বলে। ব্যক্তি হিসেবে কতটুকু জানি আমরা?

একজন চিকিৎসক মানুষের রোগ সারাতে দক্ষ হতে পারেন কিন্তু তিনি হিমযুগে কিভাবে টিকে থাকতে হয় তা জানেন না, একজন প্রাণীবিজ্ঞানী হাজারখানেক প্রজাতির ডিএনএ সজ্জা মুখস্থ রাখতেই পারেন, অথচ তিনি মোটেও বোঝেন না জঙ্গলে পাতার নড়াচড়া শুনেই কিভাবে বলে দেওয়া যায় ঝোপের আড়ালে ওটা দুষ্টু খরগোশ না কোনো ক্ষুধার্ত বাঘ। আমাদের সামগ্রিক জ্ঞান যত বেড়েছে, যত হাত বাড়িয়েছি আমরা বাইরের দিকে, ততই বেগে কমেছে individual knowledge, নিজের চারপাশের পরিবেশ আর পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের জানার বোঝার পরিধি। তাতে কোনো সমস্যায় পড়তেও তো হয়না আমাদের। বেঁচে থাকার তাগিদে এইসব শেখারও তাড়া নেই আমাদের। কারণ আমরা বিশাল এক সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে এক অর্থে আমার আপনার মত অসংখ্য ‘আনাড়ি’ মানুষ টিকে আছেন একে অন্যের উপর ভর করে। আমাদের শিকার করতে না জানলে শুকিয়ে মরতে হয় না, নিজের খাবার নিজে জোগাড় করার সামর্থ্য না থাকলে পরিবারের অন্যরা যোগান দেন ভালোবেসে। শারীরিকভাবে পঙ্গু হলে সিংহের পেটে যেতে হয় না, ঘরে বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে পড়াশোনা থেকে ব্যবসা সবই করা যায় সফলভাবে। উন্নতির ধারণাটা আপেক্ষিক, কিন্তু এইগুলো যে প্রকৃত অর্থেই সভ্যতার বিকাশ সেটা বলে দিতে হয় না। 

বিপদের সময় হাতে ফোন না থাকলে, এবং সেই ফোনে নেটওয়ার্ক না থাকলেই আমরা অচল, অসহায়, মূর্খ এক প্রাণী। রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরটা তুলে নিয়ে তাকেই কিভাবে অস্ত্র বানিয়ে নিতে হয়, সেটা তো জানা নেই আমাদের! ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারলে সামান্য জ্বরেও প্রাণ যেতে পারে যে কোনো দিন। বাড়ির পিছনের ওই জঙ্গলে ফুটে থাকা মাশরুম আর বুনোগাছের ভিড়ে ওষধি লতা কিভাবে চিনতে হয় সেটা তো ভুলেই গেছি আমরা! 

(৩)

ডিমেনশিয়া (Dementia) স্নায়ুতন্ত্রের একটি বাজে রোগ, শুধু আমাদের দেশেই প্রতি বছর দশ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এতে। গোটা পৃথিবীর নিরিখে পরিসংখ্যান আরও মারাত্মক। এই রোগে স্মৃতি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। কারোর ক্ষেত্রে সেটা হয়তো anterograde, অর্থাৎ নতুন স্মৃতি আর তৈরি হয় না, আবার কেউ কেউ retrograde ডিমেনশিয়ায় ভোগেন, তাঁদের মন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে ফেলে আসা দিনের মধুর স্মৃতি। অ্যালজাইমার্স নামের যে রোগটার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি সেটাও বলতে গেলে একরকমের ডিমেনশিয়া। এখন এরই নতুন একটি প্রকারভেদ হচ্ছে ফ্রন্টো টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল আর টেম্পোরাল লোব আমাদের দেখতে, শুনতে, কথা বলতে সাহায্য করে, বুদ্ধিমত্তা বলতে যা বুঝি আমরা সেগুলো মূলত এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই অংশেই ক্ষতি হওয়ার ফলে মানুষের বৌদ্ধিক ক্ষমতা, তার স্থান-কালের বিশদ (detailed perception) ধারণাকে পুরোমাত্রায় ঘেঁটে দেয় এই রোগ। ম্যাপ দেখে ঠিকানা বুঝতে না পারা, প্রায়শই রাস্তা হারিয়ে ফেলার মতো ছোটখাটো সমস্যাগুলোই এই অসুখের শুরুর লক্ষণ। পরবর্তীকালে স্বপ্ন আর জেগে থাকার মধ্যেও তফাৎ করতে পারেন না অনেক রোগী, বরাবরের মতো বাস করেন অতিলৌকিক এক দুনিয়ায়! আর অসুস্থ মানুষটির বাস্তবের সঙ্গে যোগসূত্র যতই দূর্বল হতে শুরু করে, কোনো এক আশ্চর্য জাদুবলে হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে তাঁর কল্পনাশক্তি, বিমূর্ত চিন্তাভাবনা করার বিরল ক্ষমতা। আর বাস্তবকে মনের রঙে রাঙিয়ে অন্য আকারে প্রকাশ করার নামই তো শিল্প। 

সম্প্রতি জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী ঘটনাটার একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। এই থিয়োরি অনুযায়ী, আমরা প্রত্যেকেই এক একজন শিল্পী। আমাদের সবার মাথার মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় বেঁচে রয়েছে সেই সত্তা। সুপ্ত কেন? কারণ ফ্রন্টাল আর টেম্পোরাল লোবের বেশ কিছু অংশ ধামাচাপা দিয়ে রাখে তাদের। এখন অসুস্থ মানুষটির ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যায় এই প্রতিরোধ, বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে বেরিয়ে আসে সবটুকু সৃজনশীলতা। আর একই সাথে আকারে বেড়ে ওঠে মস্তিষ্কের বাম দিকের অংশ, যা ডান হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। বহু বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আলো-ছায়া, রূপ-রঙ-আকারের উপর যে নিয়ন্ত্রণ রপ্ত করা যায়, তার তুলনায় প্রায় দেখতে দেখতেই সেই সবকিছু শিখে ফেলে এই রোগে আক্রান্ত মানুষটি। দিব্যি অভ্যাস করে fine finger movement, তুলি চালানোর ক্ষেত্রে যেটা ভীষণ দরকারি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্লেষণ, যুক্তি তর্ক আর সমালোচনার উর্দ্ধে গিয়ে নিজের সবটা ক্যানভাসে ঢেলে দেয় তারা। বাইরের দুনিয়া তাতে কি বলল কিছুই যায় আসে না! 

 তাহলে ছবি আঁকতে শেখা  কি আসলে ডিটেইল এর প্রতি মস্তিষ্কের এই অতিরিক্ত পক্ষপাতটাই কাটিয়ে উঠতে শেখা ? 

পিকাসো থেকে ভ্যান গঘ, মুনখ থেকে মোনে – ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল শিল্পীদের জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায় তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো স্নায়বিক রোগে ভুগতেন – সেটা মাইগ্রেন হোক বা মৃগী। যে কোনো মেডিক্যাল জার্নাল একটু ঘাঁটলে পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত অনেক রোগীর মধ্যেও হঠাৎ শিল্পী সত্ত্বা জেগে ওঠার আশ্চর্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সৃজনশীলতা আসলে তথ্যের ভিড়ে ভারাক্রান্ত না হয়ে তার মধ্যেই নিজের পথ বানিয়ে নেওয়ার স্বকীয়তা।  

আদিম মানুষ শিল্পী ছিল, মুখের ভাষার আবিষ্কারের লক্ষ বছর আগেই আলতামিরার গুহায় আঁকা হয়েছিল বিশাল এক বাইসন আর একদল শিকারীর ছবি। আমরা সিন্ধু লিপি পড়তে এখনও হিমশিম খাচ্ছি অথচ আজ এই এত বছর পেরিয়েও সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্র কি আশ্চর্য অর্থবোধক। “A picture is worth a thousand words.”

কথা বলা বা পড়তে শেখা নয়, এই ছবি আঁকার ভিজুয়াল কাজটাই হচ্ছে মস্তিষ্কের সবচেয়ে জটিল ক্ষমতা। গান শুনতে শুনতে বা বিরিয়ানির স্বাদ পেলে আপনা থেকেই চোখ বুজে আসে আপনার। ভাববেন না সেটা তৃপ্তিতে, বরং চোখ না বুজলেই তৃপ্তি অনুভব করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে রীতিমত। দৃষ্টিশক্তিকে না থামালে মস্তিষ্কের সাধ্য কী অন্যদিকে নজর দেয়! 

পরবর্তীকালে ভাষার উদ্ভবের সাথে সাথে এই ক্ষমতার অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি আমরা, বিবর্তনের দীর্ঘ পথ পেরোতে গিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মস্তিষ্কের অন্য অংশগুলো আর চাপা পড়েছে আমাদের ভিতরের ‘দা ভিঞ্চি,’ অপেক্ষা করছে জেগে ওঠার।  

স্রেফ জ্ঞানের তেষ্টা নয়, নিজের মনোজগতের অনন্ত সন্ধানই sapiensকে আলাদা করেছিল neanderthal সহ অন্য সমস্ত hominid গোত্রের প্রাণীদের থেকে। শিকারি, সংগ্রাহক সবকিছুর উপরে আমরা জীবজগতের এক, অন্যতম এবং শ্রেষ্ঠতম স্রষ্টা।  

তথ্যকে বাদ দিয়ে বিবর্তনের স্রোতে উল্টোমুখে সাঁতার কাটা হয়তো সম্ভব না আর, সেটা কাম্যও নয়। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের নিয়মেই যখন আজকের এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছি আমরা, সেই একইভাবে বিবর্তনই পথ দেখাবে আমাদের। প্রকৃতিই ঠিক করবে শেষমেষ কে ঠিক, কে ভুল; কার নাম উঠবে ইতিহাসে আর কে ধুলোয় মিলিয়ে যাবে। তেমনি আবার তথ্য এবং পরিসংখ্যানকেই নিজের সত্তা বানিয়ে ফেলাটা বোধহয় ভালো কথা নয়। অন্য কেউ আমাদের কী ভাবে দেখছে তার চেয়েও বড়ো কথা আমাদের পরিচয় আমরা নিজেরাই। আমরা প্রত্যেকেই আসলে একই ধাতুতে গড়া, সেটা মাঝেমাঝেই ভুলে যাই আমরা। কেউ কেউ একটু বেশি চকচকে আর বাকিদের উপরে পড়েছে পাতলা জংয়ের আস্তরণ। সমালোচনার উর্ধ্বে উঠে নিজের সবটুকু ক্ষমতা ব্যবহার করতে না শিখলে কেমন যোগ্যতম আমরা, কোথায় আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব? চলতি পথ ছেড়ে নিজের মত হাঁটলে তাতে বিবর্তনের পথে পিছিয়ে যাওয়া হয় না, বরং আবার কয়েক হাজার বছর পর শেষমেষ এইবার সঠিক রাস্তায় ফিরে আসব আমরা। 

 “One piece of paper can not decide our future”

———————-

তথ্যসূত্র

1. The Wired

2. Bellingcat.org 

3. Journal of American Medical Association 

4. Sapiens : a brief history of humankind – Yuval Noah Harari 

5. Scientific American 

সাগ্নিক সিনহা পেশায় ডাক্তারি ছাত্র, বর্তমানে এমবিবিএস ফাইন্যাল ইয়ারে পাঠরত এবং নেশায় লেখক, তার চেয়েও বেশি করে একজন পাঠক। পছন্দের জনরা'র মধ্যে রয়েছে থ্রিলার, কল্পবিজ্ঞান এবং নন ফিকশন। অবসর সময়ে ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে, বেড়াতে এবং ঘুমোতে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Sanchita Sinha , October 16, 2023 @ 6:36 am

    Very informative and intellectual writing on an interesting topic. Carry on. Wait for more in future.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *