স্বর্ণকুমারী দেবী – উনিশ শতকের প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক

স্বর্ণকুমারী দেবী - উনিশ শতকের প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক

প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের এই কন্যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আজকের আলোচ্য বিষয় তাঁর আত্মজীবন নিয়ে। কিভাবে তিনি মেয়েদের জন্য শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন, অন্ত্ঃপুরবাসিনীদের মনের কথা তুলে এনেছিলেন তাঁর কলমে। স্বর্ণকুমারী দেবী যে সময়ে কলম ধরেছিলেন, যখন মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গে এক পুরুষ কবি কলম শানিয়ে দিব্যি লিখেছিলেন—

“যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে / তখন এ বি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে।”

উনিশ শতক রেনেসাঁর সময়। অথচ তখনও স্ত্রী শিক্ষার অনিবার্য পরিণতি বৈধব্য মনে করা হত। সেই সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখের সামনে দিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন স্কুলে পড়তে যেতেন।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর তিন দিদির নাম ছিল সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। তাঁর ছোটবোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে স্বর্ণকুমারী পাঁচ বছরের বড় ছিলেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র-কন্যাদের খুব সচেতনভাবেই পড়াশোনা ও গানবাজনায় উত্সাহ দেবার পাশাপাশি শিক্ষিত করে তোলার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতেই তিনি তাদের জন্য শিক্ষক রেখেছিলেন। তত্কালীন ব্রাহ্ম সমাজের উপাচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশী মেয়েদেরকে পড়াতে আসতেন। অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃত, ইংরাজি স্কুলপাঠ্য বই পড়াতেন। স্বর্ণকুমারী দেবী এই পাঠাভ্যাসে নিজেকে এতটাই তৈরী করেছিলেন যে সেই সময়ের ঠাকুরবাড়ির আর পাঁচজন নারীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরের মেয়েদের মধ্যে তিনি ছিলেন একখানি হীরকখণ্ড। প্রতিভার দীপ্তিতে দিনকে দিন তিনি উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন।

উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলাসাহিত্যে যেসব প্রতিভাময়ী লেখিকার আবির্ভাব হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম নক্ষত্র স্বর্ণকুমারী দেবী। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই প্রতিভাময়ী নারী বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জগতেও তাঁর অসামান্য অবদানের কথা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ঠাকুর পরিবার ছিল শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরির পরিশীলিত কেন্দ্র। গৃহের নিয়ম-শৃঙ্খলা, উত্সব অনুষ্ঠান প্রভৃতি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল স্বর্ণকুমারী দেবীর মানস গঠনের সহায়ক ছিল, সেই সঙ্গে ছিল তার আপন প্রতিভা। পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল সুগভীর নৈকট্য। ‘সাহিত্য স্রোত’ গ্রন্থে পিতা সম্পর্কে স্বর্ণকুমারী লিখেছেনঃ

“তিনি মধ্যে মধ্যে অন্তঃপুরে আসিয়া আমাদিগকে সরল ভাষায় জ্যোতিষ প্রভৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। তিনি যাহা শিখাইতেন তাহা আমাদের নিজের ভাষায় লিখিয়া তাঁহারই নিকট পরীক্ষা দিতে হইত। ছাত্রীদিগের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বাপেক্ষা ছোট নগণ্য ব্যক্তি। সেজন্য পরীক্ষাতেও সকলের সমান হইবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মিত। কিন্তু পরীক্ষার নম্বর আমরা কেহ জানিতে পারিতাম না। এইরূপে পিতৃদেব অন্তঃপুরিকাদের মধ্যে শিক্ষার বীজ বপন করিয়াছিলেন।”

পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল সুগভীর নৈকট্য

বড়দিদি সৌদামিনীর স্নেহ-প্রীতি-অনুরাগ-ভালোবাসা তেমনি বর্ষিত হয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর উপরে। স্বর্ণকুমারী দেবীর জীবনে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি স্ত্রী জাতির উন্নতির জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর ‘সাহিত্য স্রোত’ প্রবোধ গ্রন্থে বলেছিলেন, “বাড়ির মেয়েরা সকলেই জানিত, মেজদাদার মত সহায় বন্ধু তাহাদের আর কেহ নাই; তাঁহার উপর সকলের বিশ্বাস ছিল অসীম।

ঠাকুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তেরো বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। জানকীনাথ ছিলেন নদীয়া জেলার জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালী ব্রাহ্মণ। পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিবাহ করার জন্য জানকীনাথ পরিবারচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব জমিদারী গড়ে তুলে ‘রাজা’ উপাধি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী (থিওজফিস্ট)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঠাকুরবাড়িতে বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীসহ বাপের বাড়িতে থাকবার প্রথা হলেও জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবী তা করেননি। বিয়ের আগেই স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখকজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাহিত্যে তাঁর প্রতিভার পূর্ণতা প্রকাশ পায় বিয়ের পর। তাঁর সাহিত্যসেবা ও সঙ্গীত চর্চায় উদার হৃদয় স্বামীর উত্সাহ ও উদ্দীপনা কম ছিল না। স্বর্ণকুমারী তাঁর নিজস্ব জীবনের বিকাশে স্বামীর সহায়তার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, “আমার প্রিয়তম স্বামীর উত্সাহ ও সাহায্য ব্যতিরেকে আমার পক্ষে এতদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হইত না। আজ বহির্জগত আমাকে যেভাবে দেখিতে পাইতেছে, তিনিই আমাকে সেভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ উপদেশে ঝটিকা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রেও যেমন সন্তরননিপুণব্যক্তি সহজে ও অবলীলাক্রমে সন্তরণ করিয়া যায়, সাহিত্যজীবনের ঝটিকাময় ও উত্তাল তরঙ্গের মধ্য দিয়া আমিও সেইরূপ অবলীলাক্রমে চলিয়া আসিয়াছি।”

জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিনটি সন্তান ছিল। প্রথমজন হিরণ্ময়ী দেবী (১৮৭০-১৯২৫). দ্বিতীয় জ্যোত্স্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১-১৯৬২) এবং কনিষ্ঠ ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫)। পুত্র জ্যোত্স্নানাথ আই সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পশ্চিম ভারতে কর্মে বহাল হয়েছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবী উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্প, রম্যরচনা, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, বিজ্ঞানমনস্কতা, সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্ম, সমিতি স্থাপন প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমকালীন স্বদেশী ও বিদেশী বহু বিদ্বানের কাছে তিনি উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক বিদুষী পথিকৃত হিসেবে খ্যাত হন। স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল অপরিসীম। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জীবন স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, “আমি সন্ধ্যাবেলা মেয়েদের একত্র করিয়া ইংরাজি হইতে ভালো ভালো গল্প তর্জমা করিয়া শুনাইতাম—তাহারা সেগুলি বেশ উপভোগ করিতেন। ইহার অল্পদিন পরেই দেখা গেল যে, আমার এক কনিষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী কতগুলি ছোট ছোট গল্প রচনা করিয়াছেন। তিনি আমায় সেগুলি শুনাইতেন।আমি তাঁহাকে খুব উত্সাহ দিতাম, তখন তিনি অবিবাহিতা। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যোগ্য সঙ্গী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন বিখ্যাত সুরকার। পিয়ানো বাজিয়ে নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করতেন। তাঁর প্রভাবে স্বর্ণকুমারী দেবীর সুর সাধনার প্রকাশ ঘটে।

দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠিতে তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছেঃ

শান্তিনিকেতন
২৬ শে কার্তিক ১৩৩০

“স্নেহের বোনটি আমার – আমার হাতে এখনো কতগুলি করনীয় কার্য অবশিষ্ট আছে। সেগুলি শীঘ্র চুকাইয়া ফেলিতে আমি নিতান্তই আগ্রহান্বিত। যমের দুয়ারে কাঁটা দিবার এখানে তুমি বই আর কেহই নাই; সুতরাং তোমার এবারকার ভাইফোঁটা ঠিক আমার সময়োপযোগী, আর সেইজন্য তাহা আমি অতিশয় যত্ন সমাদরের সহিত ললাটে বরণ করিলাম। ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করিয়া সুখ স্বচ্ছন্দে রাখুক ইহাই আমার আন্তরিক আশীর্বাদ। দিব্যধামন্থিত আমাদের প্রাণের ভাই সতুর (সত্যেন্দ্রনাথ) বিরচিত একটি ব্রহ্মসঙ্গীত এখানে আমার জপের মালা হইয়াছে। সে গীতটি এই—

“কেহ নাহি আর আমার সব তুমি।
লয়েছি শরণ তব চরণে দীননাথ। যদি
পাই তোমার ছায়া নাহি ডরি করাল কালে।
হায়! বিষ্ণু নাই”
– কে এটা গাইয়া আমাকে শুনাইবে।

তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী
বড়দাদা”

দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ

তিন সন্তানের জন্মের পর স্বর্ণকুমারী দেবী আঠেরো বছর বয়সে উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ১৮৫১ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস “ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত” প্রকাশ করে বাংলা ভাষায় প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবী হলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক। স্বামী জানকীনাথের প্রেরণা স্বর্ণকুমারীর জীবনে আলো হয়ে দেখা দিয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়, জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। এই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহিত্যের নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় মেতে ওঠেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন পরিবারের প্রাচীন প্রথাগুলিকে ভেঙ্গে নারী স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করছিলেন, সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন।

সাহিত্য সাধনায় মগ্ন থাকার কারণেই সাংসারিক কাজে তাঁকে পাওয়া যেতনা। এই প্রসঙ্গে কন্যা সরলা দেবী চৌধুরানী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেনঃ

সরলা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিকথা

“তরকারী কোটার আসরে বড়ো-মাসিমা, সেজ-মাসিমা ও ছোট-মাসিমা, বড়-মামী, নতুন-মামী, ন-মামী এবং সরোজা দেবী, সুশীলা দিদি—এই ক’জনের নিত্য উপস্থিতি দেখতে পেতুম। দিদিও যেতেন। আমার মা কখনো আসতেন না। মাসিমারাই ঘরকন্নার কাজে নিযুক্ত থাকতেন। দৈবাৎ কোনো উপলক্ষ উত্সবাদি ছাড়া এদিকে নামতেন না।”

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে সরলা দেবীর মাতৃদেবী স্বর্ণকুমারী দেবী ঘরকন্নার কাজে তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন না বা হতেন না। এখানে একটু আলাদা করে সকলের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। বড়-মাসিমা হলেন সৌদামিনী দেবী, সেজ-মাসিমা শরৎকুমারী দেবী, ছোট-মাসিমা বর্ণকুমারী দেবী, বড়-মামী সর্বসুন্দরী দেবী, নতুন-মামী কাদম্বরী দেবী এবং ন-মামী প্রফুল্লময়ী দেবী। সরোজা দেবী হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা, সুশীলা দেবী হলেন শরৎকুমারী দেবীর কন্যা এবং দিদি হলেন সরলা দেবীর অগ্রজা হিরণ্ময়ী দেবী। মা হলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর লেখা-পড়ার কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ঘরের কাজে সময় দিতে পারতেন না।

বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব গভীরভাবে পড়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর জীবনে। বাবা ও মেয়ের মধুর সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে তাঁর স্মৃতিচারণায়। বালিকা স্বর্ণকুমারী ভোর না হতেই বাগানে ফুল তুলতে যেতেন। ঘরে এসে অঞ্চলের ফুল থালায় সাজিয়ে ফুল ভরা থালাটি নিয়ে এসে দাঁড়াতেন প্রথমে মায়ের সামনে, তারপর উপাসনার পর বাবার সামনে। মহর্ষি সেই ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে স্বর্ণকুমারীর মন ভরিয়ে দিতেন। সেই সময় স্বর্ণকুমারী তাঁর বাবার কাছে ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে পাঠাভ্যাস করেন, সংস্কৃত কবিতা শেখেন। মহর্ষির কাছ থেকে শেখা অনেক উপমা তিনি পরে নিজের লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী তাঁর প্রথম উপন্যাসটি উত্সর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথকে। স্বর্ণকুমারী তাঁর ‘গাথা’ কাব্যটি উত্সর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ অসীম স্নেহ পেয়েছেন দিদি স্বর্ণকুমারীর কাছ থেকে। উত্সর্গ পত্রটি পড়লেই সেটি বোঝা যায় –

“যতনের গাথা হায় কাহারে পরাব আর?
স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পরাই,
যেন রে খেলার ভুলে, ছিঁড়িয়া ফেলো না খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই- তাইতে ডরাই।”

স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবে অনুপ্রাণিত এক উপন্যাস। ১৮৭৬ সালে এই উপন্যাসটি প্রকাশের পরপরই সাহিত্য সমাজে বিপুল আলোড়ন দেখা দেয়। অতি আশ্চর্যের বিষয়, সেই সময় এই বইটিতে লেখকের নাম ছিল না। তাই পাঠকসমাজে নানারকম জল্পনা শুরু হয়েছিল। কার লেখা বই এই নিয়ে অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি ঠাকুরবাড়িতে স্বর্ণকুমারী দেবীর মেজদাদা বিলাতে বসে যখন এই বইটি হাতে পান, তখন তিনিও উপন্যাসটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা ভেবে তাঁকে একটি অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন— “জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?” তবে ‘সাধারণী’ কাগজে এই উপন্যাস বিষয়ে লেখা হয়েছিল, ‘শুনিয়াছি এখানি কোন সম্ভ্রান্তবংশীয় মহিলার লেখা। খুবই আহ্লাদের কথা। স্ত্রীলোকের এরূপ পড়াশোনা, এরূপ রচনা, সহৃদয়তা, এরূপ লেখার ভঙ্গি বাংলাদেশ বলিয়া নয়, অপর সভ্যতার দেশেও অল্প দেখিতে পাওয়া যায়’।

স্বর্ণকুমারী দেবী

এরপর স্বর্ণকুমারী অনেক উপন্যাস লিখেছেন। তিনি মোট তেরোটি উপন্যাস, চারটি নাটক, গীতিনাট্য ‘বসন্ত উত্সব’, অসংখ্য গান ছাড়াও বিজ্ঞানভিত্তিক সাতাশটি প্রবন্ধের সংকলন ‘পৃথিবী’ লিখেছেন। ‘পৃথিবী’ সংকলনটি তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। শৈশবে বিজ্ঞানপাঠ শুরু হয়েছিল যাঁর কাছে, সেই মহর্ষি পিতাকেই নিজের লেখা বিজ্ঞান প্রবন্ধের বইটি উত্সর্গ করেছিলেন। এমন পিতৃঋণ শোধ সকলকে প্রাণিত করে। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লেখা শুরুর আগে তাঁর শিক্ষা মজবুত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিজ্ঞান-রহস্য’ অধ্যয়ন করে। এর সঙ্গে দেশ-বিদেশের বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের ইংরিজিতে লেখা বিজ্ঞানের নানা বিষয়ক প্রবন্ধ তিনি নিবিড় ভাবে পাঠ করেন। তারপর নিজেই লিখতে শুরু করলেন সে জাতীয় লেখা। প্রথমে সাতটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ভুবিজ্ঞান বিষয়ে। বলা যায়, তিনি এইভাবে বাংলার মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা ঘটিয়ে দিলেন। 

ঐতিহাসিকরা বলেন তাঁর আর এক মৌলিক কাজ হল বাংলায় বিজ্ঞানের পারিভাষিক শব্দ তৈরী করা। বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে দেখলেন বিজ্ঞান বিষয়ের প্রবন্ধ ও আবিষ্কারের বিষয়গুলিতে লিখিত ইংরেজি শব্দগুলোকে বোঝাবার জন্য সাধারণের সহজবোধ্য বাংলা শব্দের অর্থাৎ পরিভাষার একান্ত অভাব। সুন্দর, শ্রুতিনন্দন এবং যথোপযুক্ত বাংলা শব্দচয়ন বা নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে তিনি ‘বিজ্ঞানের পরিভাষার’ এক উল্লেখযোগ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। এই পরিভাষার সৃষ্টি হওয়াতে সেইসময়ে এবং পরবর্তীতে অনেক বিজ্ঞানবিষয়ক বই বা প্রবন্ধ বাংলাভাষাতে অনুবাদের কাজ শুধু সহজ নয়, সহজবোধ্যও হয়ে উঠেছিল।সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবী বা কামিনী রায়ের মতো মহিলা সাহিত্যিকদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত বাঙালি নারী সমাজের প্রথম যুগের প্রতিনিধি।

১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) বসন্ত উত্সব রচনা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর অনুজ রবীন্দ্রনাথ এই ধারাটিকে গ্রহণ করে সার্থকতর গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন। লেখক থেকে সম্পাদকে উত্তীর্ণ হতেও বেশি সময় লাগেনি স্বর্ণকুমারীর। ১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ‘ভারতী’ চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হত। এর ভাষাও ছিল সহজ সরল। সমালোচকরা এই পত্রিকার উচ্চ প্রশংসা করতেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। আবার আট বছর স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার সম্পাদক হন। তারপর নয় বছরের ব্যবধানে আবার এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন তিনি। এরপর দুই বছর সম্পাদনার পর ভারতী পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন তিনি। এইভাবে ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়।

স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। স্বর্ণকুমারী নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯-১৮৯০ সালে রামাবাই রানাডে ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৯৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ‘সখিসমিতি’ স্থাপন করেন। ১৮৯৮ সালে ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সখিসমিতির প্রধান উদ্দেশ্য হল অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা। এই কাজ দু’ভাবে করা হয়। যেসব বিধবা ও অনাথদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই, বা থাকলেও তাদের ভরণপোষণের ক্ষমতা আত্মীয়দের নেই তাঁদের ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সখীসমিতি নেবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সখীসমিতি তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবে। সখীসমিতি যেসব মেয়েদের পূর্ণ দায়িত্ব নেবে, তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটাবে। তারা লেখাপড়া শেষ করে অন্য মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেবেন। সমিতি এইজন্য তাদের পারিশ্রমিক দেবে। এইভাবে দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। হিন্দু বিধবারা হিন্দুধর্মের অনুমোদনক্রমেই শ্রমদানের মাধ্যমে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠবেন।

সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। এই মেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীর, মোরাদাবাদ, বারানসি, আগ্রা, জয়পুর, ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতার সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এই দূরদর্শিতার মধ্য দিয়েই এদেশের বুকে ‘শিল্পমেলা’র বীজ বপন হয়েছিল যা আজ আমরা প্রায় সারা বছর ধরেই শহর ও শহরতলিতে দেখতে পাই। ১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল। তারপর স্বর্ণময়ী দেবীর প্রথম কন্যা হিরণ্ময়ী বিধবা আশ্রয় এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। হিরণ্ময়ী দেবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি বিধবা আশ্রয় চালু করেন।এই আশ্রমের নাম ছিল ‘মহিলা বিধবা আশ্রম’। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমের নতুন নামকরণ হয় ‘হিরণ্ময়ী বিধবা আশ্রম’। মহিলা বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যনির্বাহী সমিতিতে ছিলেন স্বর্ণকুমারী, ময়ূরভঞ্জের মহারানী সুচারু দেবী, কোচবিহারের মহারানী সুনীতি দেবী, (উভয়েই ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা), লেডি হ্যামিলটন, প্রিয়ম্বদা দেবী, শ্রীমতী চ্যাপম্যান ও শ্রীমতী সিংহ। হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন আশ্রমের সচিব। হিরণ্ময়ী দেবীর কন্যা তথা পরিচালিকা কল্যাণী মল্লিকের লেখা থেকে জানা যায় ১৯৪৯ সালেও এই আশ্রম সফলভাবে চালু ছিল। প্রসঙ্গত ‘সখীসমিতি নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখিসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ করেছিলেন।

সাহিত্যের সমস্ত সংরূপেই সাবলীলতা থাকলেও স্বর্ণকুমারীর কলম সেরা হয়ে উঠেছিল উপন্যাসের ক্ষেত্রে। মোট তেরোটি উপন্যাস লিখেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বর্ণকুমারীকে বলেছিলেন তাঁর লেখার উপর যেন পুষ্পবৃষ্টি হয়। সমালোচক মহলের একটা সাধারণ প্রবণতা হল স্বর্ণকুমারী দেবীকে ‘মহিলা সাহিত্যিক’ তকমা দেওয়ার। কিন্তু তিনি উনিশ শতকের একজন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডার বিপুল। যে নারী এক অন্ধকার সময়ে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন নিজের সৃষ্টির অন্দরলোকে, তিনি পাঠকের কাছে এক উজ্জ্বল সৃজনশীল সত্তা। পাঠক তাঁর লেখার আড়াল থেকে খুঁজে পেতে পারেন এক রোম্যান্টিক কিশোরী মন, যাকে ঘিরে আছে বিদ্রোহের উত্তাপ। ঠাকুরবাড়ির প্রবাদপ্রতিম পুরুষদের মত তিনি প্রবল প্রচারের আলো পাননি। কিন্তু মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে, মনে রেখেছে সময়। তাই হয়ত চেয়েছিলেন স্বর্ণকুমারীঃ

“এ ফুলের মালাগাছি
বহুদিন ধরে—
লুকানো রয়েছে গাঁথা
হৃদয়ের পরে।
আজ ধরিতেছি খুলি
ছিন্নভিন্ন দলগুলি
অনাদরে লবে তুলি
অথবা আদরে?”

অনাদরে নয় আদরে স্বর্ণকুমারীর লেখাকে স্থান দিয়েছে সাহিত্য, যা কালোত্তীর্ণ। বিচিত্রমুখী সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। ঊনবিংশ শতকে স্বর্ণকুমারী দেবী শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের মর্যাদা পেতে পারেন অবিতর্কিতভাবে। স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাসগুলি হল দীপনির্বাণ (১৮৭৬), মিবার রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭), বিদ্রোহ(১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে(১৮৯৮), ফুলের মালা (১৮৯৫), বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১), মিলনরাতি (১৯২৫), সাব্বিরের দিনরাত (১৯১২)।

স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত নাটক-প্রহসনঃ 
বসন্ত উত্সব (১৮৭৬), বিবাহ উত্সব (১৮৯২), কৌতুক নাট্য ও বিবিধ কথা (১৯০১), দেব-কৌতুক (১৯০৬), কনে বদল (১৯০৬), পাকচক্র (১৯১১), নিবেদিত (১৯১৭), যুগান্ত (১৯১৮)। স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত গল্পগ্রন্থ – গল্পস্বল্প (১৮৮৯), নরকাহিনী (১৮৯২)।

তিনি শিশুপাঠ্য বইও রচনা করেছিলেন। সচিত্র বর্ণবোধ (১৯০২), বাল্যবিনোদ (১৯০২), আদর্শনীতি (১৯০৪), প্রথম পাঠ্য ব্যাকরণ (১৯১০), বিদায় গ্রহণ (১৯১৫)। কাব্য-কবিতাও লিখেছিলেন স্বর্ণময়ী দেবী। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।গাথা (১৮৮০), হাসি ও অশ্রু (১৮৯৫), কবিতা ও গান (১৮৯৫)।

ঠাকুর পরিবারের অন্তপুঃরের মেয়েদের মধ্যে তিনি ছিলেন একখানি হীরকখণ্ড। নিজের প্রতিভার দীপ্তিতে দিন দিন উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন। উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্প, রম্যরচনা, গীতিনাট্য ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। বিজ্ঞানমনস্কতা, সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, সমাজসংস্কার মূলক কাজকর্ম, সমিতি স্থাপন—প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। সমকালীন স্বদেশী ও বিদেশী বহু বিদ্বানের কাছে তিনি উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক বিদুষী পথিকৃত হিসাবে খ্যাত হন।

তিনি নিজেকে সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ভারতের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হবার প্রয়াস তীব্র ছিল তাঁর। কাশিয়াবাগানে থিয়জফিক্যাল সোসাইটির অধিবেশনে তিনি যোগ দিতেন। ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত এই সোসাইটির আসন অলংকৃত করেছিলেন তিনি।

স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পর্কে গোপাল হালদার লিখেছেন—

“বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রায় Matriarch;
সত্যই রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ মনে, মতে, লেখায়; সাহিত্যে
আধুনিক যুগের নারীর জীবন্ত আবির্ভাব।”

তিনি শুধু নিজের কথাই বলেননি, বলেছেন সেই সময়কালের সব মেয়েদের কথা।

১৯৩২ সালের ৩রা জুলাই ৭৭ বছর বয়সে স্বর্ণকুমারী দেবী পরলোকগমন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *