আমাদের নিবিড় দূরত্ব – টমাস সালামুন এবং তুষার চৌধুরীর কবিতা

আমাদের নিবিড় দূরত্ব – টমাস সালামুন এবং তুষার চৌধুরীর কবিতা

তুষার চৌধুরীর (১৯৪৮-২০১১) কবিতার সঙ্গে অনেকেই হয়তো পরিচিত, [১] তাই প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিই টমাস সালামুনের (১৯৪১-২০১৪) সঙ্গে। সালামুনের জন্ম যুগোস্লাভিয়ায় (এখন স্লোভেনিয়া), তাঁর কবিতা লেখা স্লোভেনিয়ান ভাষায়। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি সালামুন কবিতার বই প্রকাশ করেছেন বাহান্নটি। যাঁদের ধারণা বেশি লিখলে কবিতা তার গুণমান হারায়, তাঁরা চমকে যাবেন সালামুনের কবিতা সংগ্রহ পড়লে।

সম্প্রতি ব্রায়ান হেনরি একটি বিশাল এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন – সালামুনের কবিতার একটি বড় অংশ সরাসরি স্লোভেনিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে।[২] কবিতার অনুবাদ অত্যন্ত শক্ত কাজ আর তার ওপরে তিন ভাষা ঘোরা অনুবাদে আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। তাই এই সরাসরি অনুবাদ পেয়ে আমি উৎসাহিত হয়ে পড়ি।

সালামুনের দেশ যুগোস্লাভিয়া বহু বছর ধরে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রথমে নাৎসি আগ্রাসন, তারপর মার্শাল টিটোর একনায়কত্ব, এবং তারপর ৮০’র দশকে জাতিগত সংঘর্ষ, এবং তার থেকে বহু দেশে (তার মধ্যে একটা হচ্ছে এখনকার স্লোভেনিয়া) যুগোস্লাভিয়ার ভাগ হয়ে যাওয়া। ২৩ বছর বয়েস থেকেই সালামুন তাঁর দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেন – তাঁর কথায় এই বুদ্ধিজীবীরা হলেন “প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী” যাদের একটুতেই “নার্ভাস হয়ে হাতের তালু ঘেমে যায়।” সালামুনের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্যে টিটো সরকার তাঁকে সরকারি চাকরি দিতে রাজি হয় না। তাই একসময় সালামুনকে বাড়ি বাড়ি পায়ে হেঁটে ঘুরে বই বিক্রি করতে হত। এই রকম এক বাড়িতে বই বিক্রির সময় বাড়ির কর্ত্রী জানতে পারেন তিনি কে এবং বলেন যে “আমি শুধু তিনজনের লেখা পড়ি, প্রাউস্ট, কাফকা, আর আপনার।”[৩]

টমাস সালামুন (১৯৪১-২০১৪)

অন্যদিকে তুষার চৌধুরী যখন কবিতা লিখছেন (সত্তরের দশক থেকে শুরু) তখন তিনি পরিচয় পাচ্ছেন অন্য এক টালমাটাল সময়ের, অন্য এক  ভাঙনের। একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত সংসারের ভাঙন, একদলীয় সরকার গড়ায় ভাঙন। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন ও তার পতন, নকশাল আন্দোলন, এমার্জেন্সি, নানান দিক থেকে প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়মকানুনগুলির, প্রথাগুলির ভাঙনও শুরু হয়ে গেছে। সালামুনের জীবন অভিজ্ঞতা আর তুষার চৌধুরীর যাপন অভিজ্ঞতা আলাদা হলেও, টালমাটাল সময়ের ছাপ তাঁদের মধ্যে ভৌগোলিক এবং জীবনযাপনের দূরত্বকে এক নিবিড় বন্ধনে বেঁধেছে। কবিতার সুরে তাই বিশেষ সাদৃশ্য।

তুষার চৌধুরীর লেখায় প্রভাব খুঁজে পাবেন ফরাসি কবি আর্তুর র‍্যাঁবোর (Arthur Rimbaud) কবিতার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের লেখার, বিশেষ করে “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি” কাব্যগ্রন্থের কবিতার, এবং এমনকি জন লেননের গানের (“আমি স্বপ্ন দেখি”)। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, সালামুনের কবিতাতেও র‍্যাঁবোর ছাপ দেখা যায়, জন লেননের গানেরও আর তার সঙ্গে আরো অনেক কবির বিশেষ করে আমেরিকান কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স এবং জন অ্যাশবেরির, এবং রুশ কবি ভেলিমির ক্লেবনিকভের (Velimir Khlebnikov)।[৩]

কবিতা শূন্য থেকে আসে না, মহাকবিদের কাঁধে দাঁড়িয়েই আরো দূরত্বে ফোকাস করা যায়। দুই কবির ওপর অন্য কবির প্রভাবগুলি একই ধরনের হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে যেটা অবাক করা মনে হয়, এতদূরে থেকেও সময়ের ছোপে এত নিবিড় হয়ে গেছে তাঁদের দূরত্ব।

একদিকে “আমি কবি এবং শকুন” কবিতার তুষার চৌধুরী বলেনঃ 

আমি কবি গুপ্তচর চিরযুবা এবং শকুন
আবেগের পলকাপাতা আমি পোকা নাশকতাকারী
গ্রন্থের উত্তুরে হাওয়া সমুদ্রের মারাত্মক নুন
নীরক্ত শহীদ আমি ঝলমলে রঙের দলত্যাগী

অন্যদিকে সালামুন লেখেন Eclipse (II) কবিতায়ঃ 

I”ll take nails,
long nails
And drive them into my body.
….
Then I’ll set fire to everything.
It’ll burn a long time,
it’ll burn for seven days.
Only the nails will remain,
soldered, all rusty.
So I’ll remain.
So I’ll survive everything.

সালামুনের কবিতা নানান অপরিচিত সম্পর্ক এবং অজ্ঞাত অনুভূতিকে নিপুণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। The Guardian এর পাতায় আইরিশ প্রাবন্ধিক Colm Tóibín লেখেন, সালামুনের কবিতা
“makes you sit up and not think, which is perhaps the real point of poetry” [৪]. সালামুন লেখেন History কবিতায়ঃ 

Tomaž Šalamun is a monster.
Tomaž Šalamun is a sphere rushing through the air.
He lies down in twilight, he swims in twilight.
People and I, we both look at him amazed,
we wish him well, maybe he is a comet.
Maybe he is punishment from the gods,
the boundary stone of the world.
Maybe he is such a speck in the universe
that he will give energy to the planet
when oil, steel, and food run short.

এই চমক তুষার চৌধুরীর কবিতায় ‘মহা সমারোহে’ আসে, ‘প্রবল বিদ্রোহে’ আসে। যেমন,
তনুশ্রীশঙ্কর কবিতায় –

উনিশ শ’ আটাত্তরে প্রেম কিংবা কবিতার আর কোনো সম্ভাবনা নেই
স্বভাবত অনুভূতি হৃদয়বেদনা নামে কিছু অবশিষ্ট নেই আর
আমার তরুণ কবিবন্ধুদের প্রশ্ন করি: লেখো নাকি প্রেমের কবিতা
তারা সমস্বরে হো হো হাসে:
প্রেম সে কেমন বস্তু চলো যাই চামেলির কাছে
মধ্যবিত্ত যৌবনের যকৃত ফুসফুস রক্ত মূত্রাশয়ে মন্থর দূষণ ঘটে গেছে
চুম্বনের অভিজ্ঞতাটা এতটাই দুর্ভাগ্যজনক
এর প্রতিকার কোনো টুথপেস্ট জানে না

গভীর রাজনৈতিক চেতনা দুই কবির কবিতাতেই তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি মেলে ধরে। একদিকে তুষার চৌধুরী লেখেন –

একটি গণতান্ত্রিক ফতোয়া

আমি অনুমোদন করি গুমখুন আর বিতরণ করি পাশবালিশ
আর শুধু সমুদ্রের কথা মনে পড়ে
হাঙর মন্ত্রীসভা বাতিল না করে মুলতুবি রাখা হলো
বিধানসভার কিচিরমিচির
আমার পছন্দ টেলিফোনমন্ত্রণা ও পরিবারতন্ত্র
অনেক বেড়াল বৈষ্ণব কুকুর খেকুড়ে আর কুমীর তুলতুলে পুষেছি আমি …

আর অন্যদিকে সালামুন আসেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শ্লেষ নিয়ে –

I write everything down, all the deaths.
I see that you recognized me.
I’m gilded under people’s eyelids,
My hands float.
My fear killed
you, the avalanche
collapsed.

পুঁথিগত বিদ্যার বিরোধিতা দুই কবিরই বৈশিষ্ট্য। তুষারের কবিতায় আসে –

পুঁথি ২

পুঁথি তুমি প্রায়শ নির্জীব তবু কোনো
কোনো পুরুষের হাতে হয়ে ওঠো সোনালি বিদ্যুৎ
যুবা বাতাসের স্বাস্থ্য চেটেপুটে তোমার শরীর
হয়ে উঠবে মক্ষিরানি জলজ্যান্ত স্থাপত্যে অদ্ভুত
প্রাপ্ত বয়স্কের তুমি পাখি সব করে রব …

আর সালামুনের ভাষায় – 

Sonnet of Motion

Stories that have a first scene, a second
scene, a first border, a second border, surrender like
a lump of meat. The brain slips and smacks its lips.
Radical light is always muscular,
it eliminates situations where you can look back. …

তুষার চৌধুরী বা সালামুন কেউই নৈরাশ্যবাদী কবি নন, কিন্তু সময়ের জটিলতা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের কবিতায় মাঝে মাঝেই নিরাশা বা ব্যর্থতার ছবি আঁকে।[৫]

কবিদের ভবিষ্যৎ

বহুদিন পদেপদে অপমান অবজ্ঞা তামাশা চড়চাপড়
খেয়ে অভিমানে গেছি পার্কে একা ময়দানে বেশ্যার পাশ দিয়ে
                                                               হেঁটে গেছি নিরুদ্দেশ
ঘরে ফিরে ভাতের থালায় দীর্ঘ পিঁপড়ের মিছিল দেখে
                                                জল খেয়ে শুয়েছি বিছানায়
শুয়ে শুয়ে প্রার্থনা করেছি, মর্ফিয়ুস,
যদি অনুমোদন করেন
কিছু রোমহর্ষক স্বপ্ন – যথা, হত্যাকাণ্ড অভ্যুত্থান
আজন্ম কুকুর হয়ে থেকে যাব আপনার ডেরায়
আপনার নুন খাব আর গুণ গাইব অবসরমতো

সালামুনঃ 

I sense the gatekeeper of heaven and earth, I sense the mills
I sense the third day of the flood, the karst burns
the arc of trimmings, network of dusty roads
I sense you and look at you, enchant and submerge you

where the wall will crumble, we crucify dreams
I crucify my lamb, a golden purse
I crucify the blazing eyes of the buried, the burning vine
I crush hope and footsteps, the gestures of the meek

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সময়কাল, দ্বন্দ্ব, যাপনের অভিশাপ পেরিয়ে ভালোবাসাই আঁকড়ে ধরে দুজনকেই।
একদিকে মানুষের প্রতি ভালোবাসা – 

সামান্য মানুষদের প্রতি

সামান্য মানুষ ওগো সামান্য মানুষ
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমরা যে সমস্ত স্বপ্ন দ্যাখো তার
দলিল কোথায় – স্বপ্ন আদৌ দ্যাখো কি
সম্ভবত ডানা মেলে উড়ে যাও শূন্যে পেঁজাতুলোর মতন
ওড়াউড়িকরা ডাল রুটি সব্জি কাবাবের দিকে
আর ঠিক তখুনি পেটে ঘাই মারে রাক্ষুসে গজাল

Hymn of Worldwide Responsibility

I proclaim the brotherhood of natural, strong, sacred people.
A bond of incandescence, a bond of blazing lightning, bright labor,
the mind and soul of the planet, we are, like you,
a conspiracy of delight, smaller than a drop of blood.

অন্যদিকে কবিতা, শিল্পের জীবনের প্রতি ভালোবাসা – 

The Life of a Poet

Love tore apart all my theories.
The stars devoured me.
I’m anonymous, what I always wished for so badly.
I am light, a tiny strand of light.
It’s truly fantastic how the stars eat me.

পিগমি সভ্যতা

সূর্যের হলুদ কবল থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি
আমার শরীর ঘিরে প্রচুর কমলা আলোর রহস্য
মায়ের মুখ স্মৃতির ভিতর পীতবর্ণ
আর স্মৃতির ঘিলুর ভেতর গলে যায় শরীর পায় গলে যায় শরীর পায়

আর এই ভালোবাসার কাব্যিক সুগন্ধ দিয়েই দুই কবিই লিখে গেছেন এক জটিল সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বৃত্তান্ত।

পাদটীকা

[১] চৌধুরী, তুষার। (২০১৭)। শ্রেষ্ঠ কবিতা। কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।

[২] Šalamun, Tomaž. (2024). Kiss the Eyes of Peace, Selected Poems 1964-2014,
Brian Henry (Trans. and Ed.) Translated from Slovanian. Milkweed Editions (Independent Publ.).

[৩] সালামুনের বইটির একটি দুর্দান্ত মুখবন্ধ লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান কবি ইলিয়া কামিন্সকি (Ilya Kaminsky)। মুখবন্ধটি পাওয়া যাবে এইখানে –
https://www.poetryfoundation.org/articles/162630/like-the-thinking-of-trees

[৪] Tóibín, Colm. (2004, May 29). “The comet’s trail,” (Book review). Guardian. Available:  https://www.theguardian.com/books/2004/may/29/featuresreviews.guardianreview33

[৫]  দে, রমিত। (২০১৩)। “তুষার চৌধুরীঃ ফানুসের আত্মা।” সাহিত্য কাফে। প্রাপ্তিস্থানঃ 
https://www.sahityacafe.com/?p=6480

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩), এবং “ভুলটা ছিল উপপাদ্যে, প্রমাণেতে নয়” (ই-বুক ২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" অনলাইন কবিতা পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *