স্বকীয়তায় উজ্জ্বল 'কবি' তারাপদ রায়
বাংলা সাহিত্যে রসরচনার ধারাটি ক্রমশ শুষ্কপ্রায়। ত্রৈলোক্যনাথ, পরশুরাম (রাজশেখর বসু), শিবরাম চক্রবর্তী – বাংলা রসসাহিত্যের তিন দিকপাল। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখাকে ঠিক ‘রসরচনা’ বলা যায় না; তাকে ‘রম্যরচনা’ বলাই শ্রেয়। যদিও রম্যরচনায় রসের উপস্থিতি কোনও অংশেই কম থাকে না, তবুও তার গোত্র আলাদা। বস্তুত, বিশুদ্ধ হাস্যরসে স্নিগ্ধ রচনা বলতে যা বোঝায় তার মরা গাঙে জোয়ার আনার প্রয়াস আর খুব একটা দেখি না! সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সেই ধারা কিছুটা অনুসরণ করেছেন। আরেকজন ছিলেন এই ধারার মুকুটহীন সম্রাট – তিনি প্রয়াত তারাপদ রায়। জীবন যখন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, রুক্ষ বাস্তব, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও ইঁদুর দৌড়ের তীব্র অভিঘাত যে পাথুরে মাটিতে আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছে, সেখানে ‘রসরচনা’ মেঘের ঘনঘটা থেকে একপশলা বৃষ্টির সজীবতা এনে দিতে পারত। কিন্তু কী রসরচনা, কী রম্যরচনা – দুটিরই যেন আকাল চলছে। জানি না, তার অবসান কবে হবে, বা আদৌ হবে কি না! ততদিন আষাঢ়ের জলদগম্ভীর আকাশের মতোই ‘রামগরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা’ হয়েই আমাদের কালাতিপাত করতে হবে!
তারাপদ রায়ের, নাকি আমাদের দুর্ভাগ্য সেটা নিরূপণ করা কঠিন। তিনি বাংলার পাঠক সমাজের কাছে রম্য রচনা বা রসরচনার লেখক হিসেবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতিমান হয়ে রইলেন, অথচ তাঁর যে আরেকটি মুখ্য পরিচয় প্রায় মাটির নীচে জীবন্ত বীজের চাপা পড়ে থাকার মতো হয়ে রয়ে গেল সে খবর আমরা রাখিনি! তা হল ‘কবি’ তারাপদ রায়। তাঁর লেখক জীবনের সূচনা হয়েছিল কবিতা লেখা দিয়েই। লিখেছেন প্রচুর কবিতা। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্যতম কবি ছিলেন। অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থের রচনা করেছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘তোমার প্রতিমা’ (১৯৬০)। ‘নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক,’ ‘ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতে স্বাধীন,’ ‘ভালবাসার কবিতা,’ ‘দারিদ্ররেখা,’ ‘জলের মতো কবিতা,’ ‘ভাল আছো গরিব মানুষ,’ তাঁর কিছু কাব্যগ্রন্থ।
তারাপদ রায়ের কবিতার গঠন ও সৌষ্ঠব সম্পর্কে বলা যায়, তিনি ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো খুব সহজ ভাষায় কবিতা লেখা পথের পথিক। তাঁর কবিতার কথনভঙ্গিটি আধুনিক কবিতার বহু আলোচিত ধর্ম মেনে রূপক-সাংকেতিকতার রহস্যে বা আলোছায়ায় মোড়া নয়। নাথিংনেস বা শূন্যতার বিমূর্ত অবয়বও তিনি রচনা করেননি। তাঁর কবিতা একেবারে গ্রাম্য বধূর মতো সহজ-আটপৌরে, নিরাভরণ ও অমোঘ। তারপরও তাঁর কবিতা রীতিমতো আধুনিক। কারণ, তাঁর কবিতায় আধুনিক জীবনেরই অনুরণন খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর মতো কোনও সুনির্দিষ্ট মতবাদে প্রত্যয় রেখে কবিতা লেখেননি। নাগরিক দিনযাপনের নানা অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, অনুভূতি, উপলব্ধি, অনুষঙ্গ ছিল তাঁর কবিতার বিষয়-আশয়।
তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘দারিদ্ররেখা।’ সেই কবিতায় তিনি লিখছেন:
“আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন।
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
এই যে রেখা দেখছো, এর নীচে
অনেক নীচে তুমি রয়েছো।”
এখানে বিশুদ্ধ বিদ্রুপ ঝরে পড়েছে কবির কলম থেকে! অর্থাৎ, ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিতেই যাদের বড় পরিশ্রম হয়, কপালের ঘাম মুছতে হয়, তারা কি আর বুঝবে দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের কষ্ট?
পাঁচের দশকের কবি তারাপদ রায়ের কবিতায় উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা রঙের জলছবি। সেখানে শুভ্র, অমলিন প্রেমের হিরণ্ময় ছবিও ভাস্বর হয়ে আছে তাঁর অনবদ্য লিখনে:
“ফিরে যাওয়া যায়।
হঠাৎ পথে নেমে, জামতলা পার হয়ে
একপা ধুলো আর হাত-ভরা শাপলার ফুল
তোমার দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি।সন্ধ্যাবেলা।
রান্নাঘরের ফাঁকে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে,
হলুদমাখা হাতে আলগোছে ঘোমটা টেনে তুমি বললে,
‘কতদিন পরে এলে’।
তখন সারা উঠোন ভরে বাতাবির ফুল ছড়িয়ে আছে।
মাঘের স্তব্ধ হাওয়া
পুকুরের জলে জোনাকির ছায়া।
কত দিনের কত ছবি।
তবু কি ফেরা যায়।” (কতদিন পরে)
একঘেয়েমির ক্লান্তি মেশানো সাবেকিয়ানাও কীভাবে রঙিন হয়ে ওঠে এবং অযত্ন সত্ত্বেও কাঠচাঁপার ডালে কুঁড়ি ধরার অলীক সৌন্দর্যের মতো জীবনকে কবি নতুন আনন্দে ফিরে পান নিত্যদিনের আটপৌরে, তুচ্ছ সংসারিকতার মধ্যেই। তারই একটি নন্দিত ছবি তিনি এঁকেছেন এইভাবে:
“পুরানো সুরের গানে মন আর ভরে না।
সাবেকি সংসারের দেয়ালে দেয়ালে
অনেক কালের অনেক কোলাহল জমে রয়েছে।
রান্নাঘরের কোনায়
পিতলের গামলার নীচে ঢাকা ঠাণ্ডা ভাত
রোঁয়া ওঠা বুড়ো বেড়াল ঘুরছে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে
দিনরাত্রির ফাঁকে ফাঁকে/একঘেয়েমির ক্লান্তি।
যদি পালিয়ে যাওয়া যায়।
কিন্তু, ততদিনে হয়তো অযত্নের কাঠচাঁপার ডালে আবার কুঁড়ি ধরেছে
আর ভিন্ন কালের গৃহবধূর মতো
লাল চেলি, রঙিন শাঁখা, আলতা পায়ে
তুমি এই সাবেক দিনের উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছো।” (ভিন্ন কাল)
‘নদীর ভিতর থেকে’ কবিতার শেষে তিনি লিখছেন:
“…নদীর ভিতরে গ্রাম, গ্রামের ভিতরে নদী
দু-এক শতাব্দী কাল কিছু স্তব্ধ ছায়া।”
গভীর বিষাদের মধ্যেও কীভাবে শাশ্বত সুষমা বেঁচে থাকে তারই অনুপম চিত্রকল্প এঁকেছেন তিনি এই কবিতায়। ‘শেষ প্রেমের কবিতা’য় তিনি দুজনেরই ‘দেরি ‘ হওয়াকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে আহবান করছেন, যেখানে উদ্ভাসিত হচ্ছে কেবল নিখাদ ভালবাসার উচ্চারণ:
“…অতএব যদি পারো, একবার শেষবার এসো।
হাত ধরাধরি করে এসো গান গাই, বসি ওই দীঘির সিঁড়িতে..।”
তিনি স্বতন্ত্র শৈলীতে রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন। দলীয় হুঙ্কার, শাসানি ইত্যাদি কবলিত সাধারণ মানুষের জীবনে একটি শব্দবন্ধ বারবার অনুরণিত হয় – ‘দেখে নেব।’ এই নামেই একটি কবিতার শেষে অত্যন্ত শান্ত স্বরে তিনি মানুষকে রাজনৈতিক আস্ফালনের অসারতা সম্পর্কে ‘অভয়’ দিয়েছেন এইভাবে: “…তারা কেউ আর দেখা করতে এলো না।”
মাত্র কয়েকটি কবিতার উল্লেখ ও আলোচনায় তারাপদ রায়ের দুরন্ত কবিসত্তার সম্যক পরিচয় তুলে ধরা বেশ কঠিন। এজন্য প্রয়োজন তাঁর কবিতা পড়া। বিখ্যাত ও বহুল চর্চিত কবিদের ভিড়ে তাঁর কবিতা যে ভিন্ন স্বাদের সৌরভ বয়ে আনে, সেই সত্য কথাটি পাঠক তাঁর কবিতা পড়লেই অনুভব করতে পারবেন। কেবল কবিতা লেখা অথবা ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নয়, তারাপদ রায় সম্পাদনা করেছেন ‘পূর্ব মেঘ’ ও ‘কয়েকজন’ নামে দুটি পত্রিকাও। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় তিনি লিখছেন: “আমার কবিতার সংখ্যা অজস্র। কখনও গুণে দেখিনি, গুণে দেখা সম্ভবও নয়, তবে বোধ হয় হাজার দেড়েক কিংবা তার বেশি হবে। কবিতা লিখতে আমার চমৎকার লাগে, তার জন্যে আমার কোনও পরিশ্রম হয় না। কবিতা লেখায় আমার কখনওই কোন ক্লান্তি হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, আমি যখন ইচ্ছা, যত ইচ্ছা, কবিতা লিখতে পারি। লিখি না তার কারণ লজ্জা করে; আর একেক সময় এ-ও ভাবি, কেন লিখব, কার জন্যে লিখব!
হয়তো কবির কোনও কারণে ‘অভিমান’ হয়েছিল! তবুও তিনি কবিতা লিখে গেছেন! কারণ, সে ছিল তাঁর কাছে প্রথম প্রেমের সুরভির মতো, যার রেশ রয়ে যায় জীবনভর!