সেই সুর রমণীয়ঃ তপন সিংহ

সেই সুর রমণীয়ঃ তপন সিংহ - জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ

তপন সিংহ – চিত্র ও সঙ্গীত পরিচালক

তপন সিংহ – স্টুডিয়ো জীবনের শুরু যাঁর শব্দযন্ত্রী হিসেবে – পরবর্তীকালে শুধু বিখ্যাত চিত্রপরিচালকই নন, সঙ্গীত পরিচালকও। প্রথম দিকের কয়েকটি ছবি বাদ দিয়ে বাকি সবক’টি নিজের ছবিতেই তপন সিংহ সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর দুটি কালজয়ী ছবি, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এবং ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ওস্তাদ আলি আকবর খান। এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তপনবাবু লিপিবদ্ধ করে গেছেন পাঠকদের জন্য – তবে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নৈর্বক্তিক ও নিরাসক্ত রেখে। এই নিবন্ধের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে চিত্রপরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালকের সেই অনবদ্য যুগলবন্দি।

সঙ্গীতের প্রতি গভীর সখ্য তপনবাবুর সেই বালক বয়েস থেকে – মায়ের গানের মাধ্যমে। তারাভরা আকাশের নীচে শুয়ে যখন শুনতেন মায়ের গলায়, “যতবার আলো জ্বালাতে চাই” বা “কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না” – সুর তাঁর গোটা মনটাকে ছেয়ে ফেলত। ছোটোবেলা থেকেই সুরকে অন্তরে নিয়ে  চলেছেন এগিয়ে – নয়তো কি আর সেই কৈশোরে বীরভূমের গ্রামে পটুয়া গোপাল বৈরাগীর গুনগুন গান “মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না” ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অমন অনবদ্যভাবে “মন বলে আমি মনের কথা জানি না” হয়ে ফুটে ওঠে!

আলি আকবর খান

আলি আকবর খানের পরিচয় নতুন করে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। বিখ্যাত সরোদ বাদক, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সুযোগ্য পুত্র, মাইহার ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাঁর সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করে এই প্রবন্ধের পরিসর বাড়াব না, কিন্তু সরোদ অনুশীলন নিয়ে তাঁর বলা কয়েকটি কথা লেখার লোভ সামলাতে পারছি না।

If you practice for ten years, you may begin to please yourself, after 20 years you may become a performer and please the audience, after 30 years you may please even your guru, but you must practice for many more years before you finally become a true artist—then you may please even God!

আলি সাহেবের গুণমুগ্ধ ছিলেন তপনবাবু। প্রথমে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কিছু গল্প বলে তারপর আসব ছবিদু’টির সংগীতের আলোচনায়। 

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের স্যান রাফায়েল শহরে ‘আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক’ দেখতে গেছেন তপনবাবু। ততদিনে আলিসাহেব বিখ্যাত ম্যাকআরথার ফেলোশিপে সম্মানিত – সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে বিশ্বনাগরিক। কলেজে গিয়ে তপনবাবু দেখলেন প্রায় পনেরো কুড়িজন বিদেশি ছাত্রছাত্রী সরোদ আর সেতার নিয়ে রেওয়াজে বসেছেন। গুরু আলি সাহেব ছোট্ট একটি ডায়াসে বসে সরগম্ বলছেন – বেশ কঠিন সে সরগম্! ছাত্রছাত্রীরা পরম শ্রদ্ধায় প্রাণপণে সেই সুর তাঁদের যন্ত্রে তোলার চেষ্টা করছেন। থেকে থেকেই গুরু একটি কথাই বলছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে, “স্ট্রেচ্ ইয়োর মাসল্ টু ইয়োর হার্ট!” 

সত্যিই তো! হৃদয় দিয়ে না বাজালে কি সত্যিকারের সুর ধরা দেয়? 

ভাবতে ভাবতে স্মৃতির সরণী বেয়ে তপনবাবু পৌঁছে গেলেন অতীতের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বর্ধমানের মহারানি অনুষ্ঠানের সভাপতি – উদ্যোক্তারা সংবর্ধনা দেবেন তপন সিংহ আর আলি আকবর খানকে। তপনবাবু জানতেন না যে তাঁদের সঙ্গে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে। স্বাভাবিকভাবেই আসর লোকে লোকারণ্য। সুচিত্রা সেন অবশ্য আসতে পারেননি শেষ মুহূর্তে কিন্তু উত্তমকুমার এসেছিলেন। সভায় প্রচণ্ড গোলমাল, চিৎকার চেঁচামেচি। অনেক কষ্টে দর্শকদের শান্ত করে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করলেন যে এবার আলি আকবর খাঁ সরোদ বাজাবেন। 

তপনবাবু আর উত্তমকুমার দু’জনেই আপত্তি জানালেন। দু’জনেই ঘোরতর বিরক্ত, এই উচ্ছৃঙ্খল জনতার সামনে এমন শিল্পীর অনুষ্ঠান ঘোরতর অপমানজনক। কেউ কিছুই শুনবে না। মহারানি তো দর্শকদের হালচাল দেখে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছেন। এমন তাণ্ডব তিনি জন্মে দেখেননি!

কিন্তু আত্মবিশ্বাসী সরোদ শিল্পী অবিচল। মুখে মৃদু হাসি। আশ্বস্ত করলেন বন্ধুদের। 

“ভাবছেন কেন? কিচ্ছু হবে না!” বলে স্টেজে উঠলেন। আলিসাহেবের একপাশে তপন সিংহ আর একপাশে উত্তমকুমার। তবলা বাজাবেন মহাপুরুষ মিশ্র। 

পর্দা উঠল। উত্তমকুমারকে দেখেই মুহূর্মুহূ সিটি আর হাততালি। তপনবাবু ফিসফিস করে উত্তমকুমারকে বললেন, “রেডি থাকিস। আলিদাকে লক্ষ করে ইট পাটকেল ছুঁড়লে দুজনে বাঁয়া তবলা দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করব!” শুনে স্টেজের ওপরই আলিসাহেব হেসে গড়িয়ে পড়েন প্রায়। 

তারপর তুলে নিলেন সরোদ। শুরু করলেন আলাপ। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে শান্ত উত্তাল জনতা তরঙ্গ। হঠাৎ করেই দ্রুত ত্রিতালে গত্। দশ মিনিটের মধ্যে এত দ্রুত লয়ের কাজ দেখালেন যে ঘন ঘন হাততালিতে মুগ্ধ জনতা নৈ:শব্দ্য ভেঙে আনন্দে উচ্ছল। 

আলিসাহেবের কাছে এ ঘটনা হয়তো নতুন কিছু নয়, কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনাকে তপন সিংহ নিজে লিখেছেন, “আমার কাছে এক বিরাট ও চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা!”

ক্ষুধিত পাষাণ ছবির নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিটি। প্রথম কাজ আলি আকবর খানের সঙ্গে। তপনবাবু স্মৃতিচারণা করছেন, “অপরাধের মধ্যে তাঁকে বলেছিলাম বাগেশ্রী আর কানাড়া (দুটি ভারতীয় রাগ)র উপর নির্ভর করে ছবির সব মিউজিক করলে কেমন হয়?”

প্রশ্ন শুনে একটু ভেবে নিলেন আলি আকবর, তারপর সরোদ নিয়ে বসলেন আর ঘর থেকে পরিচালক ছাড়া আর সবাইকে চলে যেতে বললেন। তারপর প্রায় মুহূর্তের মধ্যে বাজিয়ে শোনালেন পাঁচ-ছ’খানা বাগেশ্রীর মুখ। বাজানোর শেষে জানালেন যে এই কটির মধ্যে যেটি ছবির পরিচালকের পছন্দ হবে, তিনি কাজ করবেন সেটি নিয়েই। 

সব গুলিয়ে গেছে তখন তপনবাবুর। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে যে চলনটি ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলির’ কাছাকাছি সেটিই নির্বাচন করলেন। মনে মনে কিন্তু জিভ কেটে ভাবছেন, ‘কার কাছে খাপ খুলতে গেছি!’

‘ক্ষুধিত পাষাণে’ রাগ কৌশিকী কানাড়ার ওপর ভিত্তি করে চিরবিরহীর বেদনাবিধুর থিম মিউজিক করা হয়েছিল। দেশে বিদেশে অফুরান অভিনন্দন পেয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক আলি আকবর খান। 

এই ছবির সঙ্গীত নিয়ে আর একটি ঘটনার কথা বলেছেন তপন সিংহ – ঘটনাটি তাঁর কাছে ছিল অবিশ্বাস্য। মিউজিক আর এফেক্ট সাউন্ড লাগিয়ে রি-রেকর্ডিং করার সময় তপনবাবুর মনে হল একটা জায়গা যেন কেমন খালি খালি লাগছে – একটু এফেক্ট মিউজিক দিলে ভালো হয়। 

দৃশ্যটা ছিল এক অনিবার্য স্বপ্নের টানে নায়ক সৌমিত্র চ্যাটার্জি অমোঘ গতিতে পাগলের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। স্টুডিয়ো থেকে তপনবাবু ব্যাপারটা আলিসাহেবকে জানাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাজির সরোদ নিয়ে। একটি কাচের ঘরে বসানো হল তাঁকে, ছবির দৃশ্যটি একবার দেখে নিয়ে ছবির সঙ্গেই ঝঙ্কার দিলেন সরোদে – ঘোড়ার খুরের আওয়াজকে ছন্দ করে গোটাকতক মরমছোঁয়া নোট ছাড়লেন অসাধারণ ভঙ্গিতে – মনে হল যেন পঞ্চাশটা সরোদ একসঙ্গে বেজে উঠল। 

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল চিত্র পরিচালকের – মাথা নিচু করে ভাবলেন এ শুধু আলি আকবর খানের পক্ষেই সম্ভব! 

ঝিন্দের বন্দী ছবির একটি দৃশ্য

‘ঝিন্দের বন্দী’তে একটি দৃশ্য ছিল মদ্যপ রাজা রাজ্যাভিষেকের আগে আকণ্ঠ মদ্যপান করছেন। সাধারণভাবে নেশায় চুর মানুষকে বোঝাতে চারদিক ঝাপসা বা ঝাড়লণ্ঠন দুলছে এই সব প্রতীকী সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জাত খেলোয়াড় তপনবাবু আবদার করলেন আলি সাহেবকে, “আচ্ছা নেশাটা মিউজিক্যালি বোঝানো যায় না?” আলি সাহেব একটু অবাক হলেন, খুব একটা বুঝতে পারলেন না কী চাইছেন ছবির পরিচালক। তপন সিংহ আর একটু ব্যাখ্যা করে বললেন যে মদ্যপানে রাজার মানসিক অসঙ্গতি হচ্ছে, চিন্তা অসংলগ্ন – এই ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য আবহ সঙ্গীত কোনও একটি নির্দিষ্ট রাগে বেঁধে না রেখে চার-পাঁচটা রাগ মিলিয়ে যদি মিনিট দুয়েকের একটা রাগমালা করা যায় তাহলে বার বার সুরের ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে, নেশার তীব্রতা বোঝাতে সুবিধা হবে বলে তাঁর ধারণা।

এতক্ষণে পরিকল্পনাটা পরিষ্কার বুঝতে পেরে আলি সাহেব খুবই খুশি। এবার তাঁর চিন্তার পালা। একটু ভেবে নিয়ে বললেন যেহেতু উৎসবটি অভিষেক, তাই একটি হিন্দু ঘরানার রাগ দিয়ে শুরু করলে খুব ভালো হবে, বিবাহ বা অভিষেকের আভাস পাওয়া যাবে। রাগ মালা শুরু হল বিখ্যাত মুখড়া, “দিন গিন দেরে বামনা” দিয়ে। এই দৃশ্যের আবহসঙ্গীতে দর্শক মুগ্ধ, বিস্মিত হয়েছিলেন। প্রশংসাসূচক অনেক অনেক চিঠি এসেছিল দর্শকদের কাছ থেকে। এই অপূর্ব রাগমালা শুনে অনেক শ্রোতার মনে অতৃপ্তি ছিল, অনেক চিঠিতেই প্রশ্ন ছিল যে এই দৃশ্যটি আরেকটু লম্বা করা যেত কিনা। ইচ্ছে করেই দর্শকদের অন্তরে একটু খিদে রেখেছিলেন পরিচালক। তাঁর নিজের ভাষায়, “সম্পূর্ণতার প্রতি ঝোঁক অনেক সময় রসের হানি ঘটায়!”

স্মৃতিচারণে আলি আকবর খানকে শতাব্দীর শিল্পী বলে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন তপন সিংহ!

—–

তথ্যঋণ

সিংহ, তপন। (১৯৯৫)। মনে পড়ে। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স।

Thomason, R. E. (2009, June 20). “Bengali musician Ali Akbar Khan dies at 87.” The Washington Post. Available: https://www.washingtonpost.com/wp-dyn/content/article/2009/06/19/AR2009061903266.html

ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে। 

অদিতি পেশায় গণিতের অধ্যাপক। নেশা লেখালেখি। বাস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, বাংলা লাইভ, অপার বাংলা, বাতায়ন, শব্দের মিছিল, ও কলকাতা, ড্যাশ পত্রিকা সহ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি নিউ জার্সি' পত্রিকার সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *