কমল এক ফেনোমেনন
আমি বিপন্ন— এ প্রতিপন্ন হয়েছে আজ। সোনাঝুরি শাখা – মেলে অগ্নিপাখা চিতাসজ্জা আজ।
ওই দেহ খানি— জান, কতখানি আমারও রাজ! শুধু দেহ নাকি! পরম নহে কি? এ দহন সাজ!!
তুমি জ্বলে যাবে— বেশ তাই হবে, হে মহারাজ। তুমি কেন এত— নাটক সাজাতে মেটাতে কাজ!!
তুমি বললেই – আকাশ পানে ওই, আমি গৃহবাজ । চক্কর দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হিয়ার চূড়ায় তাজ।
তবু দাউদাউ – অগ্নি বেহায়া তোমার রাজ। তোমার কাজ – আমায় দিওনা তোমার কাজ
আমি পারব না হে মহারাজ।।
ওপরের লেখা টুকুর ভাব সম্প্রসারণ করলেই আমার সঙ্গে কমল চক্রবর্তীর সম্পর্কটা স্বচ্ছ হয়ে যাবে। নিজেকে সরিয়ে দিয়েও লেখা যেত। কিন্তু, প্রবন্ধের লৌহপ্রতিমতায় এই মানুষটাকে ধরা সমীচীন হবে না।
দাউ দাউ করে চিতা জ্বলতে শুরু করল। অরণ্যমধ্যে সবুজ এক প্রান্তর। ততটুকু বাতাসই বইছিল যা আগুনকে উস্কে দিতে পারে। এই অরণ্য একজন কবির অবিরাম উন্মাদনায় খর ও দূষণের বিরুদ্ধে নয়নাভিরাম। সেই কবিই তাঁর একান্ত আপন সোনাঝুরি বনে এই দৃশ্য নিজেই আয়োজন করে রেখেছেন। হ্যাঁ, এই দৃশ্য তাঁরই আয়োজিত। এর আগে মূলনিবাসী কিশোররা বহন করে এনেছে তার শবদেহ— জয় বৃক্ষনাথ ধ্বনি দিতে দিতে। কিছু কিশোর বৃক্ষ তাদের কাণ্ড, ডালপালা দান করেছে কবির সঙ্গে সহমরণে যাবার জন্য। কমল বলতেন, ওরা আমার গল্প শুনে বড়ো হয়েছে। জানিনা, কোনও কবি অতীতে এরকম ভাবে তাঁর সত্কার আয়োজিত করে গেছেন কি না! এই অনন্যতার আয়োজন— এটাই হল মানুষটার মনস্তত্ত্ব। কমল আজন্ম ব্যতিক্রমী হতে চাওয়ার এক দুরূহ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চেয়ে এসেছেন।

১৯৪৪ সালে জামশেদপুরে ঝাড়খণ্ডের সেরা এই বাঙালি কবির জন্ম হয়েছিল টাটার কারখানার এক শ্রমিকের গৃহে। না। পরিবেশ কখনোই কাব্যময় ছিল না। সাত ভাই-বোনের সংসারে সবচেয়ে বড়ো ভাইয়ের ওপর চাপ ছিল দ্রুত রোজগেরে হবার। আদ্যন্ত সাহিত্যানুরাগী হওয়া সত্ত্বেও করতে হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা। টাটা বাবার বদান্যতায় চাকরি পেতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি সেই উদভ্রান্ত যুগেও। এই চাকরি কবিকে যে নিরাপত্তা দিয়েছিল, তা কবি বর্ণনা করেছেন তাঁর কবিতায়—
“আমি কারখানায় ফিরে যাব…গবরিয়া অরণ্যের দাঁতাল শুয়োর পথ রুখে দাঁড়াল রাস্তায়…পাহাড়ি শিউলির টানে যদি ভাসে ওই আকরিক লোহা…যদি মাথায় করোগেট ডোবে আষাঢ়ে ঝরনায়…তবু ফেরা নয়…মজদুরের ফেরা মানে আগুনের ফার্নেস থেকে বৈদ্যুতিক বিছানায়, গাঢ় ঘুম…তবু জ্যেষ্ঠ ভাই-এর মতো পাহাড়ের ছায়া কাঁধে পড়ে…রক্ষিত দুঃখের কাছে রিজার্ভ ফরেস্ট কত অগভীর…সে শুধু মজদুর জানে যে শুনেছে ভোরের হুটার।”
কমল অনেক কষ্টে সাহিত্যের কাছে যাবার পরম আকুতিতে চাকরি বজায় রেখেই রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতে ভর্তি হয়ে গেল বাংলায় এমএ পড়তে। তখন সে সাতাশ বছরের যুবক। প্রায় একই সময় জুটে গেছিল সমমনস্ক কয়েকজন কবি। পুরোধায় বারীন ঘোষাল, সুভাষ ভট্টাচার্য, অরুণ আইন প্রমুখ। প্রকাশ হতে শুরু হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী বাংলা পত্রিকা। হ্যাঁ। কৌরব। নামটা কার দেওয়া— তা সঠিক জানা নেই। তবে, কমলের মধ্যে যে ব্যতিক্রমী মনন ছিল তার সঙ্গে এই নাম নির্বাচন খুবই মেলে। কৌরব হয়ে উঠল এই যুবকগোষ্ঠীর ভালোবাসা, বন্ধুতা ও নব রীতির পদ্য-গদ্য নির্মাণের আঁতুড়ঘর। কৌরবকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার আপ্রাণ প্রয়াস ছিল সব আয়োজক বন্ধুদের মধ্যেই। কিন্তু, কমলের পরিশ্রম ও একাগ্রতা ছিল দেখবার মতো। এমনটা বারীন ঘোষালের কাছ থেকেই শোনা। কৌরবের মাধ্যমে দমবন্ধ হওয়া কমল পেল মুক্তির আশ্বাস। কমল তার সখাদের সঙ্গে যাপন চিত্র বেঁটে নিচ্ছিল—
“আমরা ক’জন যারা কালিমাটি রোড ধরে হাঁটি…বুকের গভীরে খুঁজি তাজা খরকাই…শিফট ডিউটির পর তাদেরও কদম বেচাল…কখন সন্ধে হয় বুক বরাবর নামে তেজি স্টেপ-ড্রিল… আশেপাশে ফলমূল সাজানো দোকান…কোকোমল্ট কিনে নেয় স্ফীতকায় সাহেবের বৌ…তবু সব গতিহীন…যেন গোলচাক্কির পাশে সেই পাপেট পুলিশ…অবিরত হাত তোলে…জানেনা নিজেই কখন দুখানা হাত কাটা গেছে তার…তবু আমরা রোজ কালিমাটি রোড ধরে হাঁটি…পলাশের চারা ফিরি করি…এসব বৃক্ষ জানে মহীরুহ হতে…অশুভ বাতাস মুছে শীতল ছায়ায় ঢেকে দেবে।“

শিল্পনগরী জামশেদপুর কমলের কবিতায় ওতপ্রোত ছিল। টাটানগরের রূপকার ও অন্নদাতা টাটার প্রতি কবির ছিল অপরিসীম সমীহ আবার সঙ্গে কিছু অনির্বচনীয় ক্ষোভ। এই ক্ষোভের কারণ নিহিত ছিল অরণ্যর প্রতি নিবিড় প্রেমে।
“তুমার ডেরায় টাটা বাবা…তিন পুরুষের উঠা বসা খাওয়া…সাঁঝের বেলা কুঁকড়া লড়াই…রেত বিরেতে মহুয়া বনে শুয়া। কেঁদ গাছেতে লাইগল আগুন…রানীক্ষেতে দুখার মায়ের বুক…পটম্দার হাটের দিনে…চালের সাথে বিকে দিলে সুখ। টাটা বাবা, আগুন দিলে…লোহা লিলে…দুখার মায়ের বুকের থিকে…মহুয়া গাছে ছায়া লিলে কেন?…বিয়ান বেলায় উঠে দেখি…পালক মেলা পইড়ে আছে…কুঁকড়া দুটা নাই সেঠিনে কেন?”
জামশেদপুরের পরই যদি কোনও মহকুমা নগরীর নাম কবি কমলের পছন্দের তালিকায় রাখতে হয়, তবে তা অবশ্যই— চাইবাসা।
“ডাক-বাংলোর বন্ধ বিষণ্ণতায় জেগে উঠলো রোরো…কাননপথের অভিমান…পয়েন্টস্ম্যানের ভাঙা খাট্টা মুখ, কবেকার জাল-শেওড়াফুলি। আদর্শ হাওয়া বেড়ে টপ্পা গেয়েছিলে, মহাশয়…প্রাতরাশে আণ্ডাভাজা, সিঙাড়া পোকড়ি, মনে পড়ে? ভয়ংকর শব্দে বাজে সাড়ে নটা বিবিধ ভারতী। এ ভুখা কাননপথে রবীন্দ্রসঙ্গীত জমে না…কালোর চায়ে কি কিছু কম চিনি ছিল? রঘুর দোকানে এসো। হাত গরম ত্রি-কোণ চাইবাসা। আঁচলের ঝরনা খুলে দাঁড়ালো যুবতী, ভিস্তিওয়ালা মাংসের ফোয়ারায় নাচে দেশোয়ালি চাঁদ বনভোজনে এসো। ফিরে এসো দুঃখী মানুষের কার্বন কপি।”
কমল চক্রবর্তীর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান মানুষটি ছিলেন পূরবী মুখোপাধ্যায়। উদভ্রান্ত এক প্রতিভাকে কী করে বাঁধতে হয় এবং একই সঙ্গে ছাড় দিতে হয় সৃজনের উন্মীলনে সচ্ছল করতে— তা এই মহীয়সী জানতেন। কৌরবের সূচনা পর্বে পূরবী মুখোপাধ্যায় কতটা ওতপ্রোত ছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে, পূরবীদেবীর কলকাতা নগরীর পরিচিত অসংখ্য বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে কমলকে মিলিয়ে দেবার দায়িত্বে ছিলেন তিনি সুনিপুণা। অযোগ্য পাত্রে পূরবীদেবী তাঁর পরিচিতির সম্ভার তুলে দেননি। বর্তমানে জামশেদপুর নগরীটি গড়ে উঠেছিল সাকচি নামের এক গ্রামকে কেন্দ্র করে। সেই সাকচির বিখ্যাত মুখার্জি পরিবারের গৃহবধূ ছিলেন পূরবী। পূরবীদেবীর স্বামী ও শ্বশুর দুজনেই ছিলেন শহরের প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক। কৌরব পত্রিকা ষাটের দশকের শেষে শুরু হলেও গতি পায় সত্তরের দশকে এসে। এবং এই সময় কমলের সামনে কলকাতা নগরীর গুণীজনদের দরজা খুলে দেন এই পূরবীদেবী। বহুবার শুনেছি কমলদার মুখে— এই মানুষটা না থাকলে আমি কিছুই করে উঠতে পারতাম না। পূরবীদেবীকে কমলদা মেন্টর বলে উল্লেখ করতেন জনসমক্ষে। পরিণত বয়সেও কমলদা পূরবীদেবী সম্পর্কে কোনও আলোচনায় একটা অদ্ভুত ঘোরে থাকতেন।

যে উপন্যাস আমাকে ঔপন্যাসিক কমল-এ মুগ্ধ করেছিল, সেটি হল— ব্রহ্মভার্গব পুরাণ। ১৯৯৩ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বলাই বাহুল্য যে, কমলদা নিজের অর্থে কৌরব প্রকাশনীর ব্যানারে বইটি ছেপেছিলেন। এর প্রচ্ছদ ও ভেতরের স্কেচ করেছিলেন শ্রী যোগেন চৌধুরী। বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা ছিল— কমল চক্রবর্তী প্রণীত, যোগেন চৌধুরী চিত্রিত। এরপর, ২০০২ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করি আমি ও সাগরদা। এবারও কৌরব প্রকাশনীর ব্যানারেই। সেই সংস্করণের ভূমিকায় লেখক লিখলেন—
“ধূর্জটি চ্যাটার্জী এবং সাগর মিত্রের মনে হয়েছে এই গ্রন্থটি আরও অনেকের পড়া দরকার। আরও সুন্দর ছাপা। আমরা কোনমতে বই প্রকাশ করতে পারলেই আনন্দিত। তারপর একবার যখন বই শেষ, বাঁচা গেল! কে আর ফের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে! তাও আবার হিজড়ে! না, এরা কি যে পেল কে জানে! ‘দ্বিতীয় সংস্করণ’ আক্ষরিক অর্থেই করে ফেলল। এতো রাশি রাশি বই কাকে গেলাবে কে জানে! তিরিশ বছরে এইটুকু বুঝেছি, আর যাই হোক এই গ্রন্থের বিষয়, বিবেচনা, বিস্তার, বিবরণ বাঙালি পাঠকদের আহ্লাদের বস্তু নয়। তবু কাদের জন্য এই পুরাণ! কোন আস্তাকুঁড়ে যাবে দ্বিতীয়বারের ছাপা! এতো হাজার হাজার টাকা লজ্জায় মাথা কাটা যাবার জোগাড়।”
ব্রহ্মভার্গব পুরাণ-এর তৃতীয় সংস্করণ করা হল— ২০১২ সালের মে মাসে। এবারে পেপার ব্যাক। প্রকাশকের বক্তব্যতে লিখেছিলাম— প্রেম কমল চক্রবর্তীর প্রধান বিষয়। লেখক নিজেই হয়তো এই তথ্য সম্পর্কে অবহিত নন। এই না জানাই কমলকে নিয়ে গেছে মানুষকে অতিক্রম করে- যৌনতাকে অতিক্রম করে এক অযোনিসম্ভব প্রেমে। বিষয় হিজড়ে। কিমপুরুষ, নপুংসক এইসব নামে এরকম মানুষদের ডাকা হয়। কিন্তু পুরুষ বা নারীই যেন মানুষ হবার একমাত্র রেফারেন্স! হিজড়ে কে নিয়ে এমন প্রেমের উপন্যাস বিশ্বের অন্য কোনো সাহিত্যে লেখা হয়েছে? তৃতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। খবর এল, লেখক বঙ্কিম পুরস্কার পাচ্ছেন। পেপার ব্যাকে পাঠকদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে বইটি পুনর্মুদ্রিত হল। কমলদা একটা দু লাইনের ভূমিকা— কিম্পুরুষ জীবনতরণী হে। তৃতীয় সংস্করণ! অসম্ভব আঁধার ও তলানির শব্দ-শৃঙ্খলা। সময় যত গড়াচ্ছে তত সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে অপূর্ণ। অথবা আমরা অপূর্ণ অভিসারী। যেভাবেই হোক, হে পাঠক শুভেচ্ছা। কমলদা তোয়াক্কাই করতনা কে প্রকাশক! ঝকঝকে একটা বই প্রকাশ হলেই শিশুর মতো আনন্দ! স্বল্পে খুশি হওয়াটা ছিল আর একটা মোহন গুণ যা মানুষটিকে মহান করেছিল আমার কাছে। অনেক বই ছাপা হল কমলদার। ব্রাহ্মণ নবাব, শামু জোনকো, ভালোবাসার গদ্য, প্রিয় ফরেস্টার (দ্বিতীয় মুদ্রণ), কুকুর, ধান, একশো কমল, মদের দোকানের সেই ছেলেটি।

কমলদার একটা স্থায়ী আবাস হয়ে উঠল আমাদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘর। ওটা গেস্টরুম নয়, কমলদার ঘর। অন্য কেউ থাকত না সেই ঘরে। লাগোয়া একটা ছাদ ছিল। তক্তাপোশের নিচে রাশি রাশি বই, মানুস্ক্রিপট, ভালোপাহাড়ের ফাইল, দস্তাবেজ। মেয়েরা বলত— ঘরে একটা জেঠু জেঠু গন্ধ। এই ঘরের নিচের ঘরটি ছিল আমার পিতৃদেবের। রাত তিনটে অবধি চলত পিতৃদেবের বেহালা ও বাঁশি। কমলদা যেন এ বাড়িরই ছেলে। সবটাই যেন জানা। প্রথমদিন থেকেই কোনও কুণ্ঠা বা জড়তা ছিলনা। রাতে যদি ঘুমের অসুবিধা হয়! আমরাই কুণ্ঠিত হতাম। কুণ্ঠা ভেঙে দিল কমলদা স্বয়ং একদিন সকালে চায়ের টেবিলে। বাবা রসিকতা করে— কি কমল, রাতে ঘুম ঠিক হচ্ছে তো! কমলদা— না মেসোমশাই, কাল আপনার বেহালা শুনতে পাইনি। আজকাল জামশেদপুরে ফিরে গিয়েও ঘুম আসেনা বেহালা না শুনে। কী যে বদ অভ্যাস হল!
হো – হো – হো— বাবা এইভাবেই উচ্চস্বরে হাসতেন। আমার বাবাকে— মেসোমশাই কিন্তু মা কে— মা বলেই সম্বোধন করতেন কমলদা। আমিও কমলদার মাকে— মা। যদিও কমলদার এগ্রিকো বাগানের বাড়িতে আমি মোটে চার-পাঁচ বার। সেই তুলনায় কমলদা অনেক অনেক গুণ বেশি আমাদের বাড়িতে। এটা ছিল কমলদার দ্বিতীয় গৃহ। কমলদা নিজেও তা বলতেন। বাবার সঙ্গে কমলদার একটা ভিন্ন ধরনের সখ্য তৈরি হয়েছিল। পরে, কমলদার ছোট গল্প ‘মহীতোষ বাবুর মিউজিয়াম’— আমার বাবাকে নিয়ে। প্রকাশিত হয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর। আমার ব্যাচেলর কাকা ছিলেন কমলদার ভাষায়— কমলদার আপ্ত শিক্ষক। এই বয়ানে ‘ভালোবাসার গদ্য’র উত্সর্গও আমার কাকাকে করেছিলেন। আমার কাকা ছিলেন আদ্যন্ত এক অনুবাদক। ইংরাজি, হিন্দি ও বাংলা — এই তিন ভাষাতেই তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল অগাধ। কাকার সবচেয়ে বড় কাজ ছিল ভারতের সংবিধানের অনুবাদ। কাকা কমলদার গল্পের কনটেন্ট খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু, কমলদার ভাষার সমালোচক ছিলেন। কমলদার গুরুজনদের সঙ্গে ব্যবহার ছিল শেখবার মতো। যার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করা উচিত ঠিক সেরকম। যেরকম ফ্লেভারের আড্ডা দরকার, ঠিক সেই ফ্লেভার।
একটা দিনের কথা স্মরণে আসছে। দিনটা ছিল ২রা মার্চ, ২০০২। আনন্দবাজার খুলে একটা পাতায় চোখ আটকে গেল। শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর লেখা— “মনে পড়ে গেল প্রিয় কমলবাবুকে” শীর্ষকে একটি উপন্যাসের সমালোচনা। উপন্যাসটির নাম— ব্রাহ্মণ নবাব। লেখক— কমল চক্রবর্তী।
“কমল চক্রবর্তীর উপন্যাস ব্রাহ্মণ নবাব পড়তে পড়তে আমার…না, পাঠক আমার মতিভ্রম হয়নি! …মনে পড়ে গেল প্রিয় কমলবাবুকে, কমলকুমার মজুমদার। কমলবাবুর ঈশ্বরপ্রাপ্তির পর এত সাধু, ঋজু, কাব্যিক গদ্যে কেউ বঙ্গীয় উপন্যাস প্রয়াস করেছেন বলে জানি না। …ধর্ষণ ও শীৎকারের কোলাহলের মধ্য থেকে তিনি কান্না, উদ্ধার করেছেন। বিনোদিত হতে হতে আমরা, পাঠকরাও, লজ্জায় প্রবেশ করছি।”
লেখাটি পড়েই কমলদাকে ফোন। জানিয়েছিলাম যে, সমালোচনা গরম গরম থাকতে বইটি কলেজস্ট্রিট পাড়ায় দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। কমলদা উত্তেজিত। আমার একটা মারুতি জেন গাড়ি ছিল। কমলদাই বলেছিল— বাবাই, একটা লং ড্রাইভ। শুধু, আমি আর তুই। তাই, ফোনটা শেষ হতেই গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম খড়গপুরের উদ্দেশ্যে। কমলদা জামশেদপুর থেকে লোকাল ট্রেন। ব্যাপারটা এরকম— কৌরবের সব সংখ্যা থেকে শুরু করে কমলদার সমস্ত বই তখন থাকত শিবপুরে জনৈক সিদ্ধার্থ বসুর বাড়িতে। আমাদের কাছে উনি জনপ্রিয় চণ্ডী নামে। তাই, যাতে সময় নষ্ট না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সিদ্ধার্থ বসুর বাড়ি থেকে রাতেই সব বই তুলে আমরা গাঙ্গুলিবাগানে আমাদের বাড়িতে আসব। কমলদার অবর্তমানে কোন পেটিতে কোন বই কটা আছে জানা আমার বা সিদ্ধার্থ বাবুর পক্ষেও সম্ভবপর ছিল না। খড়গপুর স্টেশনে কাঁধে ব্যাগ, উল্লাসে উজ্জ্বল কমলদাকে সেদিন অসম্ভব তৃপ্ত লাগছিল।
আহা! কী অল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন তখন কমল চক্রবর্তী। আনন্দবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা কমলদাকে বরাবর বেদনা দিয়েছে। সেই আনন্দবাজারের ক্রোড়পত্রে, তাও শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর মতো বিদগ্ধ জনের এই উচ্চকিত প্রশংসা কমলদাকে যেরকম আনন্দ দিয়েছিল, তা ২০১১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পাবার সময়ও দেয়নি। কমলদা বসে পড়লেন আমার পাশের সিটে। বসেই একটা বড় লিমকার বোতল খুলে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বেশ কিছুটা তরল ফেলে দিলেন। আমাকে গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করাতে হল। কমলদা একটা ভদকার বোতল খুলে পুরোটা লিমকার বোতলে মিশিয়ে নিল। এবার ফরমান— আমি যেটুকু দেব, শুধু সেটুকু খাবি। একবারে এক ঢোঁকের বেশি খাবিনা। ছোঁকছোঁক করবিনা একদম। ভুলে যাসনা যে তোকে এতটা পথ চালিয়ে যেতে হবে। বলেই নিজে একটা বড়ো ঢোঁক। কমলদার যখন মুড শীর্ষমুখী হত, তখন কিছু পেটেন্ট গান ছিল যা গাইত। “কয়লার মতো ময়লা ছোঁড়া মুজিয়ে গেল মন, সে যে মুশলমন ছিল…সে যে মুশলমন।” বেসুর নয় মোটেই, তবে সুরধারায় ভেসে যাবার মতনও নয়। কমলদার পেটে সুরা পড়লেই ক্রন্দন গ্রন্থি লিক করে যেত। ফলত, ঘন ঘন চশমার কাঁচ মোছা এবং আমার দিকে লিমকার বোতলটির আসার সম্ভাবনার ক্ষয়প্রাপ্তি। ড্রাইভারের পেটে কম পড়েছিল বলেই দুই ভাই সেদিন বেঁচে ফিরেছিলাম। শিবপুর হয়ে কয়েকশো ব্রাহ্মণ নবাব নিয়ে রাত ন’টায় গাঙ্গুলিবাগানের বাড়িতে। খাবার টেবিলে আমাদের রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার ও কলেজস্ট্রিট অপারেশনের প্ল্যান শুনে মা বইটি রাতে পড়ার জন্য নিলেন।

সে রাতে আমরাও গপ্পো-আড্ডায় শেষ রাতে শুতে গিয়েছিলাম। পরের দিন বেলা করেই ঘুম ভাঙল আমার। কমলদা কিন্তু যত রাতেই ঘুমোতে যাননা কেন, ভোরে উঠে পড়তেন। বলতেন— ভোর বেলায় আমার টাটা বাবার বায়ো সাইরেন বেজে ওঠে। ছাদের রৌদ্রোজ্জ্বল ঘরে ইজিচেয়ারে অনুজ্জ্বল মুখে কমলদা। শুনলাম, আমার মায়ের কাছে সকালে ধুম বকুনি খেয়েছেন কমলদা। লাল মলাটের একটি ব্রাহ্মণ নবাব আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন— দ্যাখ কী দুরবস্থা! দেখি, বইটিতে অজস্র লাল কালির দাগ এবং বইটির শেষে ভাঁজ করা একটি দুই ফোল্ডের ফুলসক্যাপ কাগজে লাল কালিতে সংস্কৃতে পিএইচডি আমার মায়ের হাতের লেখায় একটা শুদ্ধিপত্র। বানান ভুলের। শুদ্ধিকৃত বানানের সংখ্যা প্রায় দু’শো। কমলদাকে মা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন যে— শুদ্ধিপত্র ছাড়া এই বই বাজারে ছাড়া যাবে না। বিশেষত, এত সুন্দর সমালোচনা প্রকাশিত হবার পর। সেদিনই কলেজ স্ট্রিটে ডিটিপি করিয়ে বন্ধু চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তর সহায়তায় শুদ্ধিপত্র জুড়ে পঞ্চাশটি বই বিভিন্ন দোকানে।
হ্যাঁ, বিক্রি মন্দ হয়নি। কিন্তু, কমলদার লেখার একটা বিশেষ পাঠককুল আছে। সম্ভবত, তারাই। কিছু ফোন এসেছিল, এই ধারণা সেই সব ফোন থেকেই। কমলদা নিজে বানানের খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না। কমলদার গদ্যের নিজস্বতায় সেইসব ত্রুটি চাপা পড়ে যেত। কিন্তু, মা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ নবাবের গদ্য সম্পূর্ণ পৃথক, কমলদার অন্যান্য গদ্যপ্রবাহের চেয়ে। “ইত্যাকার অভয়বাণী প্রদানান্তে বঙ্গীয় আঁধার আলোকিত করিয়া দেবী শীতলা শূন্যে মিলাইলেন। দেবী আলো রহিল। পূর্ববত্ অন্ধ তমিস্রা নাই। আকাশে চন্দ্রকিরণ। কিরণে বৃক্ষের ছায়া নড়াচড়া করে।” কমলদার সব লেখাই প্রায় তুরীয় দশায় উত্পন্ন। এত গতিতে লিখতে কাউকে দেখিনি। লেখার পর পড়েও দেখতেন না, অধিকাংশ সময়। নিজেই বলতেন— সব ট্রান্স-এ লেখা। আমি কি আর ভেবেচিন্তে লিখি! দীর্ঘকাল আজকাল পত্রিকায় লেখার সুবাদে কমলদার একটা আন্দাজ ছিল— ক’পাতায় কটি শব্দে থামতে হবে। ব্যস, ওইটুকুই অঙ্ক। বাকিটা প্রবল গতিতে ঘসঘস। ব্যক্তি কমলদার চরিত্র সম্পর্কে পরিচিত নাগরিক সমাজ অস্পষ্ট ধারণার বশবর্তী। কমলদা নিজেও এমনটাই চাইতেন। বেড়াতে বেরোলে— কোথায় আছ? জানতে চাইলে, সচরাচর সত্যি বলতে শুনিনি।
জীবনের শেষ কয়েকটি বছর যদিও স্থানাঙ্ক নির্দিষ্ট হয়ে গেছিল। ভালোপাহাড়। সেলসম্যান কমল চক্রবর্তী সম্পর্কে অনেকের মধ্যেই এক সমীহ মিশ্রিত সন্দেহ ছিল। প্রথম জীবনে, কৌরবের বিজ্ঞাপন যোগাড় করা দিয়ে এই সেলসম্যানগিরির শুরু এবং ভালোপাহাড়ের অর্থসংগ্রহ করতে গিয়ে এই মেধার চূড়ান্ত বিকাশ। বলতে বলতে কেঁদে ফেলা, কাঁদতে কাঁদতে বলা এবং অন্য শ্রোতাদের এই অশ্রুপাতে শরিক করে ফেলা— কমলদার কাছে জলভাত ছিল। ম্যাজিক দেখতে গিয়ে মানুষ যেমন বোকা বনে আনন্দ পায়, কমলদার শ্রোতাদের অবস্থাও হত তথৈবচ। মনে আছে, ভদ্রেশ্বরে এক অনুষ্ঠানে কমলদা বক্তৃতা দিতে মঞ্চে উঠতেই ফিসফাস শোনা গেল— এইরে আবার কাঁদতে হবে। সত্যি সত্যিই দর্শকরা সেদিন কেঁদেছিল। মঞ্চকে মঞ্চজ্ঞান করতেন না কমল। কোনোদিন কোনও পরিবেশে মানুষটাকে নার্ভাস হতে দেখিনি। বক্তৃতায় আক্ষরিক অর্থে ওজস্বিতার প্রয়োগ করে সফল হতে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজ ছাড়া কাউকে জীবদ্দশায় দেখিনি। ঝাড়খণ্ডের বাংলাভাষী সমাজ একবার কমলদাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। সংবর্ধনা দিতে উপস্থিত ছিলেন রাঁচি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ এক সন্ন্যাসী। সৌম্য প্রবীণ সেই সন্ন্যাসী জানালেন যে তিনি কমল চক্রবর্তীর লেখার এক মুগ্ধ পাঠক। ‘টাটা বাবা’ কবিতাটির দুটি পংক্তিও তিনি আবৃত্তি করেছিলেন। এরপর, কমলদার হাতে মাইক গেল। কমলদা যখন বিনয় করে কথা বলতেন, তখন একটু চিবিয়ে চিবিয়ে সুললিত করতেন নিজস্ব প্রকাশ। বোধহয়, একটু ভেবেও বলতেন যা তাঁর নিজস্বতা ছিলনা আদপেই। এই ব্রেক মেরে মহারাজকে ধন্যবাদ দেবার পর্ব শেষ করেই স্বমূর্তি ধরলেন কমলদা। একটু ভাঙা ভাঙা অথচ সুরে চড়া গলায় সিংভূমের মেলার গান। সামিয়ানার তলায় ভিড় জমে গেল। ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা সাদা দাড়ি চুলের সন্তসদৃশ কমলদার মুখে এরকম প্রচলিত চটুল গান শুনে চাইবাসার নব প্রজন্ম বিস্ময়ে হতবাক। কেন যে সেদিন পুরো প্রোগ্রামটা রেকর্ড করিনি! এরকম ছিল শুরুটা, স্মৃতি থেকে— আজও মনে হয় রোরো নদীর ধারে লেম্বো আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। কী যে ছলাত্ ছিল লেম্বোর ! সেদিনের রোরো নদীর মতোই। সকালে, দুপুর, বিকেল, রাতে একেক রকম রঙ। মাঝে মাঝে কাছ থেকেও চিনতে পারতুম না। ভেবেছিলুম, প্রেমে আপ্রাণ হয়ে লেম্বোকে নিয়ে লাপাংগুটুর লুকোনো ঝরনার ধারে এই জীবনটা। কত ছেলেপুলে! গায়েপিঠে! তাদের বাংলা শেখাব। আর আমি ততদিনে অনেক সাঁওতালি গান শিখে নেব। লেম্বোর গলায় সাঁওতালি গান শুনলে আর অন্য কোনও গান শুনতে মন চায়না। সেই সাধ পূরণ করতে এই বুড়ো বয়সে ভালোপাহাড়ে সাঁওতালি শিশুদের জন্য ইস্কুল খুলে বসেছি। আমার কিন্তু ইচ্ছে ছিল— এই চাইবাসাতেই…। বক্তৃতা চলেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা। বক্তৃতা শেষ হবার পর, বহু মানুষ ঘিরে ধরেছিল কমলদাকে। মহারাজও বাঙালি সমাজের মাথাদের বলেছিলেন— কমলদাকে চাইবাসায় একটা জমির ব্যবস্থা করে দিতে। কমলদার বাকজাদুতে মুগ্ধ হয়ে বহু মানুষ অনেক অনেক দান করেছেন ভালোপাহাড়ে। এই দানের মাপ একেক সময় এত বেখাপ্পা রকমের অতিরিক্ত হয়ে যেত যে তা বেশ দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ত। কিন্তু, কমলদার জীবনে এই দান প্রাপ্তি বেশ এক শ্লাঘার ব্যাপার এবং শেষে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিল।
কমলদার কথা বলার কয়েকটি বিশেষ আঙ্গিক ছিল। বিনয়ের সময়— চিবিয়ে চিবিয়ে একটু ন্যাকা ন্যাকা শ্লথ, ফচকেমি করার সময়— উচ্চকিত পূর্ববঙ্গীয়, আবহ মেদুর করতে— মিঠে গলায় উত্তর কলকাতা, সংরাগে সম্মোহিত করতে— স্বাভাবিক চিন্ময়। এই শেষোক্ত স্টাইলটি কমলদার স্বাভাবিক ও শ্রোতাসংপৃক্ত। কমলদাকে ছোঁয়া ছিল খুব সহজ। এই সহজিয়া ভাবের জন্য কোনও ভান করতে হত না। বরং, কখনোসখনো জনগণের উপরোধে একটু সেলিব্রিটিদের মতো আচরণ করতে গেলেই তাঁকে অসম্ভব আড়ষ্ট ও মেকি লাগত।
সেবার, আমরা দুইজন বাংলাদেশ যাচ্ছি। সঙ্গে আর কেউ ছিল না। দীর্ঘ ভ্রমণসূচী। একটা ব্যাপারে আমাদের দু’জনের এক বিরাট মিল ছিল। প্ল্যান প্রোগ্রাম করে কোথাও যেতে খারাপ লাগত। তো, সেবার যাত্রার দিন ঠিক। ভিসাও হয়ে গেছে। আমাদের দুজনের কাছেই আমন্ত্রণ পত্র ছিল। কিন্তু, থাকার ব্যবস্থা বা কবে কোনদিন কোথায় কিছুই জানা ছিল না আর আমরা দু’জন এ বিষয়ে কোনও আলোচনাও করিনি। কমলদা সরাসরি জামসেদপুর থেকে বিমানবন্দরে, দেরিতে পৌঁছে ছিলেন। ফ্লাইটেও এটা সেটা আলোচনায় ঢাকায় থাকার ব্যাপারে কোনও কথা হল না। কারেন্সি পরিবর্তন করে এবার শহরে বের হবার পালা। কমলদা প্রশ্ন করলেন— কোন হোটেল বুক করেছিস? আমি ভ্যাবাচ্যাকা। কমলদাকে অপ্রতিভ হতে কোনও পরিস্থিতিতেই দেখিনি। সেদিনও না। কমলদার মানিব্যাগের মধ্যেই একটা পাতলা শতচ্ছিন্ন টেলিফোন ইনডেক্স থাকত। বিমানবন্দরের বাইরে এসে এসটিডি বুথ থেকে একটা ফোন করলেন কমলদা। আর তারপর ফোন বুথের একটা কাগজ ছিঁড়ে একটা নম্বর লিখলেন। জানলাম, কবি বেলাল চৌধুরির সঙ্গে কথা হল। উনি অসুস্থ। তবে একজন আসছে বিমানবন্দরে। তারই নম্বর লিখলেন কমলদা। আধাঘণ্টা চা খেয়ে গপ্পো করে সেই বুথ থেকে আর একটা ফোন করতে না করতেই একজন যুবক এসে ঢিপ করে কমলদাকে প্রণাম করে বলল— চলুন কমলদা। কমলদার জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অথচ, মানুষটার সেই প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণ। আমরা প্রথমে কবি সন্তোষ ঢালির বাড়িতে ও পরে জনাব জাকির হোসেন নামক এক জনদরদী মানুষের আতিথেয়তায় ছিলাম বাংলাদেশে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, বগুড়া হয়ে লালমনির হাট। সঙ্গে কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মাহমুদ কামাল। প্রখ্যাত সাংবাদিক আয়ুব হোসেন।
আহা, কী অপরূপ স্মৃতি! প্রত্যেকটি জেলা সদরের অতিথিশালায় কমলদার জন্য অপেক্ষা করতেন গুণমুগ্ধ নবপ্রজন্ম। কমলদার জনপ্রিয়তা সেই সময় পশ্চিমবঙ্গেও এতটা দেখিনি। পরে অবশ্য কমলদা হয়ে উঠেছিলেন এক ফেনোমেনন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নবপ্রজন্মের পাঠকের কাছেও। কমলদা নিজেও বিস্মিত হয়ে ছিলেন বাংলাদেশে তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে। রাতে আড্ডার সময় অনেক আলোচনা করেও এই জনপ্রিয়তার উত্স আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। কমলদা বলেছিলেন, একমাত্র কারণ হতে পারে— কলকাতা বইমেলা ও এই মেলায় কমলদার রঙিন উপস্থিতি। বাংলা বাজারের গলিয়াথরা কমলদার জীবনে ও বইমেলায় কমলদার পাগলামিতে ওতপ্রোত ছিলেন। এই তালিকায় ছিলেন— সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মতি নন্দী, পূর্ণেন্দু পত্রী, গৌরকিশোর ঘোষ, তারাপদ রায়, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, শরত্ মুখোপাধ্যায়, উত্পল কুমার বসুর মতো উজ্জ্বল তারকারা। এই তারকাদের সবার সঙ্গেই পরম আত্মীয়তা ছিল কমলদার। এইসব তারকাদের ভিড়েও কমলদাকে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে দেখেছি। অথচ, সেইসময়ে জনপ্রিয়তার মানদণ্ড দেশ পত্রিকা বা আনন্দবাজারে কমল চক্রবর্তী লিখতেন না বা লেখার সুযোগ পাননি।
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে ‘প্রকৃতি ভালোপাহাড়’— নামে একটি পত্রিকা চালু করেন কমলদা। দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। এটা কমলদার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। চার কালারে ছাপা হতে হবে। পরিবেশের ওপর একটা ব্যতিক্রমী পত্রিকা। প্রথম সংখ্যার উদ্বোধন হয় জামসেদপুরে বারীনদার সোনারির বাসভবনে। বারীনদা ছিলেন কমলদার জীবনে সবচেয়ে বড়ো স্তম্ভ। এই উদ্বোধনে, শেষবারের মতো শঙ্কর লাহিড়ীদা ব্যতীত কৌরবের প্রায় সব কুশীলব একত্র হয়েছিলেন। জামসেদপুরের বহু গুণীজনের সমাবেশে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল। এই সংখ্যা কীভাবে প্রকাশিত হবে, কে কে লিখবেন— তার একটা আবছা ধারণা দেওয়া ও আমাকে চার্জআপ করা ছাড়া কমলদা যে আর কিছুই করে উঠতে পারবেন না, এটা আমাকে বারীনদা ডেকে বলেছিলেন। বারীনদা আরও বলেছিলেন যে— দ্যাখ বাবাই, কমলের সম্পাদনা করার স্কিলটা শিখে নিবি। কমল এখন অনেক বড়ো টার্গেট নিয়ে ফেলেছে। অর্থাত্, ভালোপাহাড়। ওর থেকে বেশি সময় পাবিনা। এটা তোকেই চালাতে হবে। তাই, চালিয়ে এসেছি।
এখনও চলছে সেই পত্রিকা। কমলদা শুরু করেন, ধারাবাহিক ‘আবার প্রিয় ফরেস্টার’। ‘প্রকৃতি ভালোপাহাড়’ পত্রিকায় লেখা যোগাড় করতে গিয়েই লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়। পরে, সমরেশদা জানান যে— সম্পাদকের নাম কমল চক্রবর্তী দেখেই উনি উত্সাহিত হয়েছিলেন। যৌবনে, কমলদার সঙ্গে সমরেশদার একবার আলাপ হয়েছিল সাহিত্যসভায়। এরপর, যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। দেখেছিলাম, এক প্রথিতযশা সাহিত্যিকের কমল চক্রবর্তীর প্রতি আগ্রহ। সমরেশদা এরপর হয়ে ওঠেন আমাদের দু’জনেরই অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মানুষ। আহা! কত স্মৃতি! সমরেশদা লিখেছিলেন— কমলের গদ্য অসাধারণ। আমাদের সমসাময়িক যে কোনও লেখকের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। একটা গোটা উপন্যাসও লিখে ফেলেন কমলদার জীবনকে কেন্দ্র করে।
কৌরব ব্যতীত, কমলদা মূলত লিখতেন আজকাল পত্রিকায়। আজকাল পত্রিকা অফিসে কমলদার সঙ্গে কয়েকবার গেছি। সেই সূত্রেই অলোকপ্রসাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আমার। আজকাল দপ্তরে দেখেছি কমলদার জনপ্রিয়তা। এর পর, এই সময় ও প্রতিদিন কাগজে কমলদা লিখেছেন। কিন্তু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া বাংলা সাহিত্যের তত্কালীন গলিয়াথরা প্রায় সবাই তখন বিগত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অত্যন্ত স্নেহ করতেন কমলদাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং তদ্বির করেছিলেন, কমল চক্রবর্তীর ‘আমার পাপ’ উপন্যাস যেন আনন্দ পাবলিশার্স ছাপে। কিন্তু তা হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কমল চক্রবর্তীর সখ্যতা ছিল হোমারিয় পর্যায়ের। অ্যাকিলিস যেমন চেয়েছিলেন পেট্রোক্লাসের দেহের ছাই যেন তাঁর দেহের ছাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তেমনি কমলদাকেও বলতে শুনেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কমল চক্রবর্তীকে নিয়ে কয়েকটি পদ্য লিখেছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জবানিতে— কমল মানে জামসেদপুরের পাগল কমল চক্রবর্তী। কৌরব কাগজটা সুন্দরভাবে রক্তপাত শেষে চালিয়ে যাচ্ছে। গদ্যটা লেখে ভালো। ভালো মানে বেশ ভালো। কেমন এলোমেলো, তেমনি গভীর। প্রগাঢ় পদ্য। জীবন যাপনের মধ্যে সাহিত্য ছাড়া, বাকিটুকু উড়নচণ্ডীপনায় ভর্তি। বেশ লাগে ওকেও যেন যেমন এলেই নানাদিকে রহস্যময় পথ খুলে যায়। জল জঙ্গলের ছায়া ওর চোখে মুখে।
১৯৭৮-এ পূরবী দেবীর মৃত্যুর পর কমলদা, বারীনদা সহ কৌরব গোষ্ঠী নিজেদের কবিতা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-এ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুও কমলদার জীবনে ছিল এক দুঃসহ বেদনা। শিবাজী রায় নামের জনৈক এক কাব্যোত্সাহী মানুষের উত্সাহে আয়োজিত এক আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলতে শুনেছি— কমল, কবিতা লেখা ছেড়ে দিলে! ওটাই ছিল তোমার প্রধান শক্তি! বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে কমলদা উত্তর দিয়েছিলেন— শক্তিদা ছিলেন আমার পদ্যের শক্তি। স্যামসনের চুল। শক্তিদাই আমার পদ্যর শুরু ও শেষ। অন্তিম ও চূড়ান্ত পাঠক। শক্তিদা গেলেন, আমার পদ্যও গেল। আপনি তো আর আমার পদ্য পড়েন না! সুনীল ছিলেন কমলদার সম্বোধনে— আপনি। কিন্তু, শক্তি— তুমি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলদার গদ্যরও গুণমুগ্ধ ছিলেন। লিখেছিলেন— সমকালীন সকল লেখকদের মধ্যে কমল একমাত্র লেখক যে তার লেখার ধরন ক্রমাগত ভাঙছে, পরিবর্তন করছে বাক্যবিন্যাসরীতি। কীভাবে এটা সম্ভব হয়?
সত্যি ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কীভাবে এটা সম্ভব হয় ? এটাই কমল ফেনোমেনন। প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্ট করতেন এই লেখক। তিনি সত্যই গদ্য ও পদ্যের মধ্যকার যে অলিখিত নিয়ন্ত্রণ রেখা, তা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন বারবার। আমার মতে তাঁর স্বীকৃত দীর্ঘতম কবিতা ‘মদের দোকানের ছেলেটি’র চেয়েও দীর্ঘতর কবিতাটি উপন্যাস বেশে প্রকাশিত। নাম— ‘মারাদোনা’। লেখকের মতে, শিল্প শিল্পই। কেউ কি দেখতে এসেছিল, দা ভিঞ্চি কোকেন খেয়ে মোনালিসা! যদি তাই বা হত, ক্ষতি কী! আর একটা মোনালিসা হোক দেখি!

কমল চক্রবর্তীর মতো রঙিন মানুষের অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকা থাকবে, এমনটা বিস্ময়ের নয়। কিন্তু, জীবনে ও নির্মাণে কমল অনেকটাই ব্যর্থ প্রেমিকাদের বিষয়ে। মাতৃরূপ ব্যতীত— কী গল্পে, কী জীবনে, কী উপন্যাসে নারীরা কমলের জীবনে নিষ্ঠুর। আপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও কমলকে তছনছ করে দিয়েছে তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা। অসহায় হয়ে দেখতে হয়েছে লেখকের চশমা দু টুকরো। ছিন্নভিন্ন হয়ে ভালোপাহাড়ের বাতাসে উড়ছে বাংলা সাহিত্যের মারাদোনার স্বপ্নিল নীল পাণ্ডুলিপি। ‘জানলার কাঁচে শুকনো জিং জিং ফুলের পাপড়ি। একেকটা উধাও। একেকটা বেদনা-বকুল গাছ, আর কোনোদিন ফুল ফুটবেনা ভাবনায়— শেষবারের মত হাজার হাজার ফুল ঝরিয়ে, শূন্য। মারাদোনা কফিনের ডালা তুলে, ক্রমে ডুবে যাচ্ছে। সে, নিথরে যাচ্ছে, নিশীথে যাচ্ছে, নিশ্ছিদ্র হাহাকারে। কফিনের ডালা, হ্যাঁ—ক্লাউদিয়া—ক্লা—উ—দি…ক্লাউদিয়া, একটা স্বপ্নের ফুটবল শূন্যে ভাসিয়েছি। দুঃখী মানুষের মধ্যে এক আনন্দের আর্জেন্টিনা। তোমার কখনো মনে হয়নি; একটা একরোখা মানুষ, লড়তে লড়তে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উত্তাল করেছে; বিহ্বল করেছে…চতুর্দিক, নীরব, চূর্ণ আন্ডিজ। ডাকে বুজুর পাখির ঝাঁক, বাতাস—খাওয়া—মাটে, দূর দিগন্তের পালক হাওয়ায় উড়িয়ে। ওর চোখ থেকে অনবরত, হেরো মানুষের অসহায়—সমীক্ষা।’