‘আছে যে গান সে গায়ক নাই, সুরের আকাশে সে ‘অনুপ’ নাই’
তিনি যখন গাইতেন, ‘অন্নদা সে তো ভিক্ষা চায়, কী কহিব এরে কপাল বই, কই সে আগের মানুষ কই,’ আমার কিশোর মনে সেই দরদী নিবেদন এক অদ্ভুত ধাক্কা দিত। কিন্তু সে অনেক পরের কথা! ‘গানে গানে’ ‘প্রাণের আলাপ’ হয়েছিল অনেক আগেই, যখন আমাদের ছিল কোলাহলেরই বয়স।
আমাদের কৈশোরে শিশু ও কিশোর সাহিত্য এক অসাধারণ উচ্চতায় বিরাজ করত। তখন আনন্দমেলার জন্ম না হলেও শুকতারা, সন্দেশ ও কিশোর ভারতী মন জুড়ে থাকত। তখনো বয়স দুই অঙ্কে পৌঁছায়নি। সেভাবে সিনেমা দেখা হয়নি, আমাদের কাছে সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় ছিল সাহিত্যিক হিসেবেই। সবে ফেলুদা এসেছে। এর আগে আমাদের পরিচয় ঘটেছে উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার রায়ের সঙ্গে। আমার ছোটপিসির কাছে টুনটুনির গল্প শুনে মুখস্থ হয়ে গেছিল। উপেন্দ্রকিশোরের সব গল্পই পড়া হয়ে গেছিল।
হঠাৎ একদিন শোনা গেল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমা হচ্ছে। আমাদের সিনেমা দেখাতে বড়দের সেই উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মত। বিশেষকরে আমার বাবা বা কাকার, যাঁরা ছিলেন ঐ রায় পরিবারের একনিষ্ঠ অনুরাগী।
তা সেই সিনেমা দেখা হল। আর পরিচয় ঘটল গুপীর গলায় গাওয়া অনুপ ঘোষালের গলার সঙ্গে। একেবারে যাকে বলে ভেসে গেলাম। সেটা ছিল কৈশোরের এক অনাবিল, সরল মুগ্ধতা। এক একটি গান এক এক রকম। ‘মুণ্ডু গেলে খাব টা কী / মুণ্ডু গেলে বাঁচব নাকি’ বা ‘কী বাহার, কী বাহার, দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার’ কিংবা ‘দুঃখ যাবে কি / বিরস বদনে রাজা ভাবে কি!’
আমরা তখন বাংলা গানই শুনতাম। আমাদের মফস্বলে হিন্দি বা ইংরেজি গান শোনার প্রচলন ছিল না। দাদারা লুকিয়ে হয়তো হিন্দি গান শুনতেন। আমরা ঐ ‘অনুরোধের আসর’ বা ছায়াছবির গান’ শুনেই তৃপ্ত থাকতাম। পুজোর প্যান্ডেলেও হিন্দি গানের খুব চল ছিল না। আধুনিকে আর ছায়াছবির গানে হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, কিশোর, তরুণ, লতা, আশা, আরতি, সন্ধ্যা, প্রতিমা! রবীন্দ্রসঙ্গীতে দেবব্রত, হেমন্ত, দ্বিজেন, সুচিত্রা, কণিকা – ঐ পর্যন্তই ছিল আমাদের দৌড়! হঠাৎ করে ঢুকে গেলেন এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ! আর ঢুকেই মাত আর কাত করলেন আমাদের।
হিন্দি গান না শুনলেও একটা আধো হিন্দি বাংলা গান বেশ বাজত রেডিওতে – ‘ছোটিসি পঞ্ছি, ছোট্ট ঠোঁটে রে, মিষ্টি ফুলের মধু লোটে রে’! দারুণ লাগত। জানলাম আরতি মুখার্জির সঙ্গে এই গানটি গেয়েছে গুপী অনুপ ঘোষাল। একটু বড় হয়ে হলে অন্য সিনেমা দেখার অনুমতি পাওয়ার পর দেখেছিলাম মর্জিনা-আবদাল্লা! তাতেও ঐ অনুপ ঘোষালের – ‘না, না, না মর্জিনা! তার চেয়ে তুই বল ছি, ছি এত্তা জঞ্জাল’ ও দারুণ আমোদ দিয়েছিল। আর ছিল ফুলেশ্বরীর সেই সাংঘাতিক গান – ‘হ্যাদে এ গো পদ্মরাণী!’ বাপরে বাপ! সামনে অনুপকুমার আর পিছনে অনুপ ঘোষাল! কী অনুপম, দুর্দান্ত সমন্বয়! ফুলেশ্বরীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ভীষণ জনপ্রিয় হলেও পাশাপাশি অনুপের এই গানটি একটি আলাদা স্থান করে নিয়েছিল। ‘জংশন স্টেশন থেকে এনে দেব চিরুনি / তাই দিয়ে বেঁধ তুমি গাই গরুর ল্যাজের মত বিনুনি।’ আহা! এই গানটি শোনানোর লোভ সামলানো মুশকিল।
এরপরে দূরদর্শনের আগমন। সেখানে ছদ্মবেশী ছবিতে মান্না দের দারুণ গানের পাশে জায়গা করে নিলেন অনুপ। ভাবা যায়, জহর রায়ের লিপে গান গাইছেন অনুপ ঘোষাল! আর কী গান রে বাবা! ‘ছো ছো ছো – কেয়া শরম কী বাত / ভদ্দর ঘরকা লড়কি ভাগে ডেরাইভার কা সাথ!’ পুরো ফাটাফাটি! তার আগে আবার ‘মেরে সামনে ওয়ালে খিড়কি’র ও কিয়দংশ ছিল বেশ মনোগ্রাহী।
মনে পড়ে তখন ছায়াছবির বিজ্ঞাপন হত রেডিওর বিবিধ ভারতীতে। আমরা খুব উন্মুখ হয়ে শুনতাম সেই সব অনুষ্ঠান। এমনই এক অনুষ্ঠানে একটি ছবির গান খুব বাজত আর আমাদের একেবারে যাকে বলে কাঁপিয়ে দিত। গানটি – ‘ফুলে ফুলে বধূ দুলে দুলে অলি বাজায় সানাই।’ উফফ! আমি তো গানের বিরাট, বিদগ্ধ শ্রোতা কিছু নই, তাও ঐ গানের স্বর আর গায়কী আমাকে একেবারে মোহিত করে ফেলত। তখন অল্পবিস্তর তবলা শিখতাম, ওই গানের সঙ্গে টেবিল বাজাতে গিয়ে বুঝতাম যে বেশ শক্ত ব্যাপার! আরও একটি গান জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিল – ‘এক যে আছে কন্যা।’ বিশেষ করে ‘যখন রাগ করে সে তাকায়, তার ভুরুর ধনুক বাঁকায়’ – প্রায়ই সেই সময়কার রকে বসে থাকা তরুণদের টিপ্পনী হয়ে উড়ে যেত পথ চলতি তরুণীদের উদ্দেশে। মনে রাখতে হবে ঘটনাক্রম সত্তর দশকের মাঝামাঝি! তখন ঐ হাত চিঠি, চিরকুট আর বাংলা গানের টুকরোই ছিল সাধারণ বাঙালি প্রেমিকদের হাতিয়ার। মান্না দের ‘আবার হবে তো দেখা,’ ‘সেই তো আবার কাছে এলে’ বা ‘বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও’ এর সঙ্গে ‘মন ক্যামেরার’ ছবি তোলার ঘটনাও খুবই জনপ্রিয় ছিল। আবার রাগিয়ে দিয়ে, ‘সে রাগলে আমি খুশি, জানি মনটা যে তার মৌভরা মৌটুসি’ – এমন গুনগুনও বেশ জনপ্রিয় ছিল।
নায়কের কণ্ঠে না হলেও পার্শ্বচরিত্রের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন অনুপ ঘোষাল। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতে নাতিবাবু বিয়ে করে বউ নিয়ে টিনের সুটকেস হাতে, আলপথ বেয়ে দাদুর বাড়ি আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যে ‘ওরে ওরে এক অচিন পাখি উড়ে উড়ে এল বুকের ভাঙা খাঁচাতে’ – এই দৃশ্য আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। মফস্বলের ছেলে, ঐ আলপথ দিয়ে আমি নিজেই বহু হেঁটেছি। দৃশ্যটি তাই বড় কাছের মনে হয়েছিল।
তখন অনুপ ঘোষাল নজরুল গীতিতেও ধীরে ধীরে নাম করে ফেলছেন। ১৯৭৬ সালে কাজি নজরুলের মৃত্যুর পর তাঁকে রেডিওতে খালি গলাতে গাইতে শুনেছিলাম। গানটি ছিল – ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয় ফিরে আয়।’ ভীষণ মর্মস্পর্শী লেগেছিল। বিশেষ করে ‘তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ, পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ’ – ঐ জায়গাটা!
এরপরেই সম্ভবতঃ তাঁর একটি বড় এলপি প্রকাশ পায় – ১২টি গান ছিল। প্রথম গান ছিল – ‘গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা।’ যে গানটির কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। এই রেকর্ডটির গানগুলি ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়। ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম,’ ‘সন্ধ্যা মালতী যবে,’ ‘ভোর হল ওঠ জাগ মুসাফির আল্লা রসুল বোল’ – ইত্যাদি গানগুলি আমাদের ভীষণভাবে মন কেড়ে নিয়েছিল।
মনে পড়ে আমরা অনেক সময় ভোরবেলা সদলবলে দৌড়তে বেরোতাম। তখন সকালে রেডিওতে একটি গানের অনুষ্ঠান হত, নাম সম্ভবতঃ প্রভাতী। সেখানে ঐ দৌড়নোর সময় ‘ভোর হল ওঠ জাগ মুসাফির’ গানটি মাঝে মাঝেই কানে আসত কোন বাড়ির রেডিও থেকে। এইভাবেই আস্তে আস্তে আমার মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন অনুপ ঘোষাল।
আশির দশকের শুরুতেই আবার এল ‘হীরক রাজার দেশে।’ আবার এক অন্যরকমের মুগ্ধতা – বিশেষ করে ‘তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?’ গানে –‘বাঘাদা, হীরা নিলে কত শুনি?’ আমার মনে হয় গানে এই ধরনের সংলাপে যে অভিনয়ের সুযোগ ছিল, তাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। হয়তো প্রথম ছবিতেই সত্যজিতের শিক্ষা তাঁকে এই ব্যাপারে বেশ দীক্ষিত করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ ‘মর্জিনা-আবদাল্লা,’ ‘ছদ্মবেশী,’ ‘সাগিনা-মাহাতো,’ বা ‘ফুলেশ্বরী’ ছবির গানগুলি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সত্যজিৎ থেকে শুরু করে তপন সিংহ, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – সব সঙ্গীত পরিচালকই তাঁর এই স্বাভাবিক দক্ষতাকে সুন্দর ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। এ বড় কম অর্জন নয় – যে সময় তিনি এসেছিলেন তখন বাংলা সঙ্গীত জগতে কিন্তু প্রতিভার বেশ ছড়াছড়ি ছিল।
১৯৮৩ সালে আমি বাংলা ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে হিন্দি সিনেমাতে তাঁর গান শুনলাম। সিনেমার নাম ‘মাসুম।’ গানটি লতাও গেয়েছিলেন, কিন্তু আমাকে অনুপ ঘোষাল অনেক বেশি মুগ্ধ করেছিলেন। বিশেষ করে ঐ জায়গাটা – ‘–– যৈসে হোঁট পে দর্দ লাগতা হ্যয়।’ আবার ফিরে – ‘তুসে না রাজ—!’ ক্যাসেটে চালিয়ে বারংবার ঐ জায়গাটা শুনতাম। গায়কী আর অভিনয়ের অনবদ্য সংমিশ্রণ।
দুঃখের বিষয় সামনে বসে তাঁর গান শোনার অভিজ্ঞতা একবারই হয়েছিল। ২০০৮ সালে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে। কেন জানি না একেবারেই সুখকর হয়নি সেই অভিজ্ঞতা। সম্ভবত তাঁর কোন সমস্যা ছিল, ঠিক যেন খুলছিল না গানগুলি।
শেষের দিকে বেশ অনেকদিন তিনি গানের জগতে ছিলেন না। সেভাবে আর তাঁকে পাইনি। কিন্তু আজও আমার মন টানে তাঁর গীত গুপীর গান, নজরুলগীতি বা ওপরের ঐ আধুনিক বা সিনেমার গানগুলি। মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত আছে।
শেষ জীবনটা শুনি তাঁর বেশ কষ্টেই কেটেছে – ‘কী কহিব এরে কপাল বৈ!’
1 Comment