অজয় দাস – সু’দূর আকাশে’র মিলিয়ে যাওয়া সুরকার

অজয় দাস – সু’দূর আকাশে’র মিলিয়ে যাওয়া সুরকার

গোড়ার কথা –

২০১৩র এপ্রিল মাস। সুরকার শয্যাশায়ী, একেবারে চলৎশক্তিহীন। ডাক্তারী ভাষায় রোগের নাম – ‘মাল্টিপল অরগ্যান ফেলিওর।’ সুর করা তো দূরের কথা, পাড়ার চায়ের দোকানের রোজকার আড্ডাও বন্ধ। কিন্তু হলে হবে কী, তাঁর উৎসাহ, উদ্দীপনার শেষ নেই। গানের বন্ধুদের ডেকে প্রায়ই ঠাট্টা করেন, তারা তো এখন বেশ ‘উঁচু’ জগতের লোক! এঁদের একজন মনোজিৎ গোস্বামী। ইনি হালিশহর থেকে এসেছেন ‘গুবলু’ নামে একটি ছবির গান শেষ করতে।

মনোজিৎ আর সুরকারের স্ত্রীর একদমই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তাঁর নিজের খুব ইচ্ছে যে! তাঁকে বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। আগের বার গানের স্থায়ী অংশটুকু করা হয়ে গেছিল। অন্তরার জন্য তিনি গীতিকার মনোজিৎকে কয়েকটা সুর বাজিয়ে শোনাচ্ছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গানটি সম্পূর্ণ হয়ে গেল। সুরকারের স্ত্রী তাঁর ইচ্ছেমত, আশা ভোঁসলেকে পাঠানোর জন্য একটা ক্যাসেটে প্রাথমিক রেকর্ডও করে ফেললেন। এরপরের ঘটনা সুরকার নিজে অবশ্য আর কিছুই জানলেন না। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল।

জীবনের গল্প

কলকাতা হাইকোর্টের বেশ নামকরা উকিল ছিলেন শ্রীনাথ দাস। উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে তিনি শামিল ছিলেন। সেই বিখ্যাত পিটিশনে স্বাক্ষরকারী প্রথম কয়েকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বৌবাজারের বাসিন্দা ছিলেন – সেখানে একটি রাস্তাও আছে তাঁর নামে।

তাঁরই বংশধর, ভাইয়ের এক নাতি, ফণীন্দ্রনাথ দাস প্রচুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। এই সম্পত্তির মধ্যে নবদ্বীপের একটি সিনেমা হলও ছিল। ফনীন্দ্রনাথের স্ত্রী অমিয়া দাস সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। বাড়ির সামাজিক অনুষ্ঠানে কখনো সখনো পরিবারের পিয়ানো বাজিয়ে অমিয়া গান করতেন। তিনি কয়েকটি গানের সুরও করেছিলেন, নিকট আত্মীয়মহলে তা বেশ সমাদৃত হয়েছিল। ফনীন্দ্রনাথ ও অমিয়ার তিনটি পুত্র আর দুটি কন্যাসন্তান ছিল। এঁদের দ্বিতীয় পুত্র (এবং তৃতীয় সন্তান) অজয়েন্দ্রনাথ (অজয়) দাসের জন্ম, তাঁর পরিবারের সূত্র অনুযায়ী, ১৯৪১ সালের ২২শে জানুয়ারি।

রক্ষণশীল, যৌথ পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন ফনীন্দ্র। বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল কম। সম্ভবত সেই কারণেই চট করে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আত্মীয়রা ক্রমাগতই তাঁকে ধোঁকা দিয়ে ছিলেন। একসময়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়ে দুই ছেলে অজয় ও সুখেনকে ক্রীক রো-এর একটি অনাথাশ্রমে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনাথাশ্রমটির নাম রামকৃষ্ণ সোসাইটি অনাথ ভাণ্ডার। অবশ্য দুজনকেই সেখানে বেশীদিন থাকতে হয়নি। বৌবাজারের মেট্রোপলিটান স্কুল থেকে পাশ করে সিটি কলেজ থেকে আর্টসে স্নাতক হন অজয়।

ছোটভাই সুখেন ততদিনে দেবকী কুমার বসু আর দেব নারায়ণ গুপ্তর নজরে পড়ে গিয়েছেন। শিশু শিল্পী হিসেবে বাংলা সিনেমাতে বেশ খ্যাতিও পেয়েছেন। অজয়ের অবশ্য সিনেমাতে তেমন উৎসাহ ছিল না। মা’র পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাত্র তের-চোদ্দ বছর বয়সেই গান লিখে সুর করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বড় ভাই মলয় ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য। অজয় তখনকার বিখ্যাত নক্সাল নেতা কাকা, অর্থাৎ অসীম চ্যাটার্জী আর তাঁর শিষ্য শৈবাল বসুর বক্তৃতা আর নেতৃত্বের বড় অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের আদর্শবাদে তিনিও অনুপ্রাণিত ছিলেন।  কিন্তু আদর্শ বাঁচাতেও টাকা পয়সা লাগে। ফলে অজয়কে বাধ্য হয়ে গানের টিউশনি শুরু করতে হল। রোজগার খুবই সামান্য, মাসে মাত্র তিরিশ টাকা। সে টাকাও তিনি পার্টি ফান্ডে দান করতেন।

চিন্ময় লাহিড়ি আর নির্মল সরকারের কাছে অজয়ের সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হল। ১৯৬৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনার পাট একেবারে চুকে গেল। অজয় এবারে পুরোপুরিভাবেই গণআন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী সর্বাণীর কাছে সেই স্মৃতি খুব উজ্জ্বল।

অজয়ের একটি গান, ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই, নক্সাল আন্দোলনের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ওই সময় তাঁর নিয়মিত বিপ্লবীদের সঙ্গে মেলামেশা আর গান রচনা অনেকেরই চোখ এড়ায়নি। কেউ কেউ আবার ব্যাঁকা চোখে কথা শোনাতেও ছাড়েনি। স্ত্রী সর্বাণী জানান, ‘পেটে ভাত নেই আবার গানের শখ,’ এমন কথা বলেছেন অনেকেই। অবশ্য অজয় এই কর্মকাণ্ডের জন্যই কিছু নামী শিল্পীর কাছে সমাদরও পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন উৎপল দত্ত।

উৎপল দত্ত তখন নক্সালবাড়ী আন্দোলনের পটভূমিকাতে ‘তীর’ নামে একটি নাটক রচনা করছিলেন। অজয় ১৯৬৯ সালে মঞ্চস্থ এই নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এরপরেই উৎপল দত্ত জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্য গ্রেপ্তার হন।

ঘটনাচক্রে এই সময় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে অজয় দাসের যোগাযোগ বাড়ে। ছোট ভাই সুখেনের সঙ্গে তিনি তখন টালিগঞ্জে এসেছেন। সুখেন ততদিনে চিত্রপরিচালনার কাজে যোগ দিয়েছেন, দীনেশ চিত্রমের দীনেশ দের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে কথা চলছে। সেই সময় দাদা অজয় সঙ্গে ছিলেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের সুর করা দু’একটা গান তাঁকে শোনাতে বললেন সুখেন। অবশ্য একথাও বললেন, অজয়কে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ওপর কোন জোর নেই। অজয় সেখানে নিজের লেখা ও সুর করা একটি গানটি শুনিয়েছিলেনঃ

“সুখ নামে সুখ পাখি / দুখেরই নাম সারি / সুজন আমার হল না সুখ / দুঃখ আমারই”

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে অবশ্য কথাগুলি পালটে হলঃ

“যেমন শ্রীরাধা কাঁদে / শ্যামের অনুরাগী / তেমন করে কাঁদি আমি / পথের লাগি!”

বাংলা ছবির জগতে অজয় দাসের পদার্পণ ঘটলো ‘পান্না, হীরে, চুনী’ (১৯৬৯) ছবিতে, সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্রের গাওয়া গানের মধ্যে দিয়ে।

এই অডিশনে আরো কয়েকটি গান উনি গেয়েছিলেন। দীনেশ দেকে যে পাঁচটি গান শোনানো হয়েছিল, সামান্য পালটে তার সব কটিই ছবিতে রাখা হল। ‘কে জানে কবে আবার দেখবো পৃথিবীটাকে’ – শ্যামল মিত্রের গাওয়া এই গানের মধ্যে দিয়ে গীতিকার অজয় দাসের আত্মপ্রকাশ ঘটলো।

‘পান্না হীরে চুনী” ছবির মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট করেছিলেন ওয়াই এস মুলকি। অসাধারণ পিয়ানো একর্ডিয়ন বাদক ছিলেন মুলকি সাহেব। তাঁর মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট এর বহু গুণগ্রাহী ছিলেন, এঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই অজয় দাস। পরে তিনি স্বীকার করেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এরেঞ্জার ছিলেন মুলকি। একদিকে মূলকই সাহেবের অসাধারণ সঙ্গীতবোধ, স্মৃতিশক্তি, আবার সহজ সরল ব্যবহার! ফলে মুলকির গুণমুগ্ধ ছিলেন মান্না দে প্রমুখ অনেক স্রষ্টা আর শিল্পী।

মান্নার সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ ছিলেন অজয়। ‘অচেনা অতিথি’ (১৯৭৩) ছবির ‘অনেক দিন কেটে গেল’ গানের মধ্যে দিয়ে সেই অভীপ্সিত যাত্রার শুরু। এই জুটির বহু হিট গানের মধ্যে একটি বহুশ্রুত ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ (চারমূর্তি, ১৯৭৮)। এই গান নিয়ে একটা মজার গল্প আছে।

সর্বাণী দাসের স্মৃতিচারণে জানা যায় –

সেই সময়কার কথা ভেবে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য টেনিদার (ভূমিকায় চিন্ময় রায়) গলাতে একটি দ্বিজেন্দ্রগীতি রাখতে বলেছিলেন। একটু স্বাধীনতার প্রত্যাশায় অজয় দাস দ্বিজেন্দ্রগীতির মতই একটা গান সৃষ্টি করেছিলেন। ভারত আমার ভারতবর্ষ শুনে উমানাথ ভট্টাচার্য রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, ‘এটা দ্বিজেন্দ্রগীতি নয়?’ তবে এই স্বীকৃতির সঙ্গে আর একজনেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। তিনি গীতিকার শিবদাস ভট্টাচার্য। গানটিতে তিনি একটা দ্বিজেন্দ্রসুলভ স্বদেশীয়ানা আনতে পেরেছিলেন।‘কিরীটধারিণী তুষারশৃঙ্গে সবুজে সাজানো আমার দেশ,’ ‘তোমার তুলনা তুমিই তোমা,’ এই শব্দবন্ধগুলির মধ্যে দ্বিজেন্দ্রপ্রভাব সচেতনভাবেই রেখেছিলেন গীতিকার। ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে / উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ – বা ‘কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র / আকাশতলে মেশে এই বিখ্যাত দ্বিজেন্দ্ররচিত পংক্তির সঙ্গে আগের পংক্তিগুলির অসামান্য সাদৃশ্য রয়েছে। পরে অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানটি ভুলবশতঃ দ্বিজেন্দ্রগীতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবেও এটি চালু হয়ে গিয়েছিল।

ধীরে ধীরে অজয়ও টালিগঞ্জে নিজের জমি খুঁজে পাচ্ছিলেন। এই গানটি প্রথমে মান্না দে কোরাসে গেয়েছিলেন। পরে অজয় আবার মান্না দেকে একটা সোলো রিটেক করতে বলেন। একটু আশ্চর্য হলেও, মান্না দে রাজী হন। সিনেমাতে এই একক গলায় গাওয়া গানটিই ব্যবহার করা হয়েছে।

অজয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুগোষ্ঠী সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত ছিল, ফলে তাঁর নিজের সঙ্গীতভাবনাও সেভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। তিনি সঠিক জানতেন ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ বলতে কী বোঝায়। সত্তরের একেবারে গোড়ার দিকে তাঁর সুরারোপিত ‘পালাবার পথ নেই’ ছবি দেখলে বোঝা যায় এই সমৃদ্ধির পরিমাণ। অপর্ণা-শুভেন্দু অভিনীত, নবাগত অমিতাভ ভট্টাচার্য পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তির আলো দেখেনি। কিন্তু এই সিনেমার দুটি গান ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের লেখা বিখ্যাত কবিতার ভিত্তিতে, ‘হে মহামানব’  আর ‘মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল।’ গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম গানটির গঠন বেশ জটিল, প্রত্যেক স্তবকে গানের সুর পালটে যায়। পরের গানটি ছিল অনেকটা স্তবের মত। এর একটি প্রাইভেট রেকর্ডিং ইউটিউবে পাওয়া যায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও এই ছবিতে গানে রূপ পেয়েছিল। গেয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। অজয় নিজেও একটি গান লিখেছিলেন। তাঁর গানের কথায় সুকান্তের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে।

“আমি ঠিকানাবিহীন পথে আমার ঠিকানা জেনেছি

অন্তবিহীন সে পথ ধরে চলেছি শুধু চলেছি

আমি হাজার রাতে অন্ধকারে থামিনি

কত হেরেছি তবু হারার ব্যথাকে মানিনি।

পরবর্তী কালে বামফ্রন্টের রাজত্বকালে সলিল চৌধুরী HMV থেকে এই গানগুলি প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরের মন্ত্রী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যিনি সুকান্তর আপন ভাইপো, তাঁরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ গানগুলি প্রকাশ করা যায়নি। অজয়ের অনেক ঘাম ঝরানো এই সৃষ্টিগুলি তাঁর ষাটের দশকের সংগ্রাম আর হতাশার প্রতীক – এরা কোনদিন দিনের আলোর মুখ দেখতে পায়নি।

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, চিত্র পরিচালকদের কাছে এক বড় অনুপ্রেরণা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এঁদের মধ্যে ছিলেন সুধীর সাহা যিনি ‘অর্চনা’ (১৯৭১) প্রযোজনা করছিলেন। গায়করা সকলেই প্রতিষ্ঠিত – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মৃণাল চক্রবর্তী। ছবির টাইটেল গান ছিল ছবির মূল যোগসূত্র –  সেটি দু’বার ছবিতে থাকার কথা। একবার পুরো যন্ত্রানুষঙ্গের সঙ্গে গানটা গাওয়া হবে, অন্যবার তা অল্প মাত্রায় থাকবে। পরের বারের গানটি একটি খুব পরিচিত মহিলা কণ্ঠে গাইবার কথা ছিল। সুধীরবাবুর প্রচণ্ড বিশ্বাস, একমাত্র আরতি মুখোপাধ্যায় এই গান গাইতে পারবেন। গায়িকা একটু ব্যস্ত ছিলেন। অজয় তারপর বনশ্রী সেনগুপ্তের কথা বলেছিলেন। সুধীরবাবু ঠিক রাজী হচ্ছিলেন না। অজয় তাঁর ফিল্ম ক্যারিয়ারে বড় ঝুঁকি নিলেন। শেষমেশ বনশ্রীর গাওয়া, সেই টাইটেল গান, ‘দূর আকাশে তোমার সুর’  দুর্দান্তভাবে হিট করে গেল। যে কোনো ফাংশনে বনশ্রীকে এটি গাইতেই হত। এই গানটির জনপ্রিয়তার জোরে ‘অর্চনা’ ছবিটিও মাঝারি মাপের হিট হয়েছিল। আগ্রহী শ্রোতাদের উদ্দেশে এটুকু আরো বলা যেতে পারে, এই গানের গোড়াতে পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে যে সুর সারেঙ্গীতে বাজানো হয়েছিল সম্ভবতঃ তা সঙ্গীত পরিচালক লক্সমীকান্ত-প্যারেলালকে তাঁদের ‘বদলতে রিস্তে’ (১৯৭৮) ছবির একটি গানে (মেরে সাঁসো যো মেহক আ রহা হ্যয়) সুরসৃষ্টি করতে অনুপ্রাণিত করে।

অভিনেত্রী গীতা দে’র সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি ছিল দজ্জাল মা বা শাশুড়ি হিসেবে। ‘অর্চনা’ ছবিতে তাঁর একটি ছোট্ট ভূমিকা ছিল। বাস্তব জীবনে পরোপকারী, সহৃদয় এই মহিলার অজয়ের প্রতি ছিল অপার স্নেহ। তাঁর সাহায্যে স্টেট ব্যাংকে অজয়ের একটি চাকরির ব্যবস্থা হল। কিন্তু মাত্র দুমাস পরেই চাকরি ছাড়লেন অজয়। তাঁর জীবনে তখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অন্যরকম স্বপ্ন! অন্যদিকে সুরের জগতের তীব্র আকর্ষণ – সেটাই তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। তবে ভাবার বিষয়, চাকরিটা বজায় থাকলে কি তাঁর অনেক সুবিধে হত না? আর্থিক নিরাপত্তার সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক তাঁদের কর্মীদের অনেক সুযোগ সুবিধেও দিতেন। এর একটি উদাহরণ হলেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে, ভারতের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার এবং পরবর্তী কালে রাজ্যস্তরের উঁচু মানের ক্রিকেটার চুনী গোস্বামী। তিনি স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। অজয়ের মোহনবাগান অন্তপ্রাণ হওয়ার মূল কারণ ছিলেন সম্ভবত চুনীই। অজয়ের একটা প্রিয় বাদামী রঙের পাঞ্জাবী ছিল, সেটা পরে মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ দেখতে যেতেন। ওটা ছিল লাকি পোশাক।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরের কাছেই মল্লিকপুর। ১৯৭৩ সাল নাগাদ, সলিল চৌধুরীর আমন্ত্রণে সেখানে একদল গানপাগল লোকজনের সঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুরারোপের কাজ করতে গিয়ে অজয়ের আলাপ হয় গণনাট্যকর্মী অমিয় ভট্টাচার্যের মেয়ে সর্বাণীর সঙ্গে। গানের জগতে অন্যান্য কাজের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর ‘সেই মেয়ে’ গানের নাট্যরূপ দেওয়ার ব্যাপারেও খ্যাতি ছিল অমিয়বাবুর। ১৯৭২ সালে যাদবপুর থেকে ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স-এ মাস্টার্স শেষ করে, সারাভাই কেমিক্যালস-এর এডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করছিলেন সর্বাণী। অজয়–সর্বাণীর বিয়ে হয় ১৯৭৫ সালের ৬ই জুন। সেইসময়, শ্রীনাথ দাসের বৌবাজারের বাড়ীতে একটা ছোট লাইব্রেরী এপার্টমেন্টে থাকতেন অজয়। তাঁদের একমাত্র সন্তান, শায়েরির জন্ম ১৯৭৭ সালের ৭ই মে। বছর কয়েক পরে, অজয় সপরিবারে মনোহর পুকুর রোডে চলে যান।

এইচ পাল এন্ড কোং থেকে একটা পিয়ানো ভাড়া করেছিলেন অজয়। তাঁর সঙ্গে এটিও নতুন বাড়িতে এল। হারমোনিয়াম আর পিয়ানো, দু’ই ছিল তাঁর প্রিয়। পাল কোম্পানির তখন খুব নামডাক – তাঁদের খদ্দেরদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ভি বালসারাও ছিলেন।
অজয়ের বরাবরের ঝোঁক নতুন কিছু করার। নতুন নতুন কণ্ঠ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে তাঁর বেশ কিছু নতুন বন্ধুবান্ধবও হল। এঁদের মধ্যে একজন হলেন অভিনেতা শুভেন্দু চ্যাটার্জী। শুভেন্দুর রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে কাজের পর তাঁদের আড্ডা বসতো। রবি ঘোষ এবং চিন্ময় রায়ও আসতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে HMV শুভেন্দুর অডিশন নিতে রাজি হলেও অজয়ই স্বেচ্ছায় শুভেন্দুর ১৯৭৩র সালের পুজোর রেকর্ডের সুর করার দায়িত্ব নেন। রেকর্ডের দুটি গান, ‘সেই পলাতক পাখি’ আর ‘আশা নদীর কূলে’ মাঝারি মাপের সাফল্য পেয়েছিল। সুকান্তর কবিতা, ‘একটি মোরগের কাহিনি’ তে সুরনিয়োগ করেছিলেন অজয়। ছ’মিনিটের ওপর এই দীর্ঘ গানটি রেকর্ডের দু পিঠে রাখতে হয়েছিল। প্রায় পাঁচ দশক পরে, আজও এই গানগুলি কলকাতার কুইজ মহলে প্রশ্ন হিসেবে জনপ্রিয়।
শুভেন্দুর গানের এই সাফল্য নতুন এক তত্ত্ব তৈরি করেছিল – ছবির গানের জন্য গায়কের দুর্দান্ত গানের গলা না হলেও চলবে। সেজন্য সুযোগ পেলেই অজয় চরিত্রের প্লেব্যাকের জন্য চরিত্রাভিনেতাকে দিয়েই প্লেব্যাক গাওয়াতেন। শুভেন্দু ছাড়াও রবি ঘোষের ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’(১৯৭৪) ছবিতে রবি ঘোষ আর চিন্ময় রায়কে দিয়ে তাঁদের ডুয়েটটি, ‘তুমি রাজা মোদের রাজা প্রাণের রাজা ভাই’ রেকর্ড করিয়েছিলেন। চিন্ময়ের গলাতে সুর ছিল, কিন্তু রবি ঘোষের গানের গলা ছিল সাংঘাতিক খারাপ। কিন্তু ছবির মজার সঙ্গে তা ভালো মানিয়ে গিয়েছিল। ‘ন্যায়-অন্যায়’ ছবিতে শকুন্তলা বড়ুয়া প্লেব্যাক গেয়েছিলেন আরতি ভট্টাচার্যের ভূমিকার গলায়। এই সময় সাময়িকভাবে শকুন্তলা বড়ুয়া অভিনয় ছেড়ে গানেই মন দিয়েছিলেন।
মনোহরপুকুরের বাড়িতে বড় ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটছিল অজয়ের। প্রচুর ছবির কাজ আসছিল। প্রায় রোজই সঙ্গীত পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। চেন স্মোকার অজয়ের ঠোঁটে সর্বক্ষণ থাকত প্রিয় সিগারেট গোল্ড ফ্লেক। প্রত্যেক সন্ধ্যায় বসার ঘরের কার্পেটের ওপর বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর করতেন, অনেক সময় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তেন।
প্রিয়া সিনেমার পাশেই গানের স্কুল ‘বাণীচক্র’। সেখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক অজয়। তাঁর স্ত্রী সর্বাণীর মনে পড়ে, সেই সময় হাল্কা আধুনিক বা সেমি-ক্লাসিকাল গানে তাঁর কোন জুড়ি ছিল না। সঙ্গীতকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তিও মনে করতে পারেন সর্বাণীঃ “যে ঘরে অজয় গান শেখাতো, তার বাইরে চটিজুতোর সংখ্যা গুনলেই ছাত্রদের মধ্যে ওঁর জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যেত।” অধুনা ব্রিসবেন নিবাসী মঞ্জরী ব্যানার্জি ১৯৯৬-৯৭ সালে গান শিখেছিলেন অজয়ের কাছে। তাঁর কাছে জানা যায় দশ থেকে পনের জনের ব্যাচ ছিল। অবশ্য খুব ভাল কিছু ছাত্র ছাত্রীদের ছোটো ব্যাচে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে শেখাতেন। সপ্তাহে দুটি ক্লাস তো নিতেনই, কখনো আরও বেশী। ছাত্রদের সঙ্গে খুব সহজ ব্যবহার করতেন। সব সময় বেশি করে রেওয়াজ করার জন্য উৎসাহ দিতেন। প্রায়ই মন্ত্রের মত ছাত্রদের কানে বলতেন, “গলা সেধে যাও, এতেই গলা বেশি করে খুলবে। তানপুরার সাথে হলে ভালো, না হলে তানপুরা ছাড়াই। ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেলে, কমিয়ে দাও, কিন্তু কখনো একদম বন্ধ করে দিও না।”
ছায়াছবির জগতে সফল হতে গেলে কলাকৌশল বা কূটনীতির খুব দরকার। এটা অজয় ঠিক আয়ত্ত করতে পারেননি। ভাবপ্রবণ, সহজ সরল, মাটিতে পা রাখা এই মানুষটি ছিলেন একেবারেই বিপরীত। প্রযোজকের কথার বিরুদ্ধে গিয়েও নতুন গায়ক-গায়িকাদের সুযোগ দিতেন। সেজন্যই তো তাঁর সিনেমাতে এত নতুনদের ছড়াছড়ি। এদেরই একজন হলেন কিশোরকণ্ঠী রাজকুমার, যিনি গেয়েছেন ‘সুনয়নী’ (১৯৭৯)ছবিতে। সেই সময় বিরাট হিট করেছিল। রাজকুমার প্রায়ই অজয়ের কাছে আসতেন। তিনি ‘সমর্পিতা’ (১৯৮৩)’ ছবিতেও গান করেন। আর এক ‘কিশোরকণ্ঠী’ উদয়রাজ, কিশোরকুমারের সঙ্গে তাঁর একমাত্র ডুয়েটটি গেয়েছিলেন ‘পাপ-পুণ্য’ (১৯৮৭) ছবিতে। পরিচালক সাই পরঞ্জাপে সম্ভবত ‘অনজানে মেহমানে’ (১৯৭৫) ছবির কথা জানতেন না, নয়তো ‘চশমে বদ্দূর’ (১৯৮১) ছবিতে ‘নবাগতা হৈমন্তী শুক্লা’ কথাটি ব্যবহার করতেন না। ‘অনজানে মেহমানে’ ছবিতেই হৈমন্তী ক’বছর আগে অজয়ের সঙ্গীত পরিচালনাতে তাঁর প্রথম হিন্দী গানটি করেন, ‘আ রে রে রে রে, নটখট তু মান মেরি বাত।’

তবে এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা যে হয়নি, তা নয়। নিজের ছাত্রদের দিয়ে গান গাওয়ানোর প্রবণতায় ১৯৭৯ সালে একবার মুশকিলেও পড়তে হয়েছিল। কিন্তু কথায় বলে না, একটা দরজা বন্ধ হলে অন্যটা খুলে যায়! সর্বাণী একটা ঘটনার কথা বললেন।

সুখেন দাস নতুন একটা ছবির কাজ পেয়েছেন। নায়িকা নবাগতা শকুন্তলা বড়ুয়া। এক প্রধান ভূমিকাতে স্বয়ং উত্তমকুমারও রাজী হয়েছেন। অজয় দারুণ উত্তেজিত হয়ে জুলাইয়ের গরমে ঘামতে ঘামতে এক প্রিয় ছাত্রীর বাড়ি গেলেন। ছাত্রীর মা আদৌ রাজী হলেন না। এমনকি তাঁর মেয়ে এক সিনেমাতে প্লেব্যাক করবে নায়িকার গলাতে, সে ছবিতে খোদ উত্তমকুমার রয়েছেন, এসব কথাতেও তাঁর কোনো ভাবান্তর হল না। হতাশ হয়ে অজয় প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু তিনিও ব্যস্ত ছিলেন। এই সময় সুখেন তাঁকে এক বুদ্ধি দিলেন। সোজা ট্রেন ধরে বম্বে (অধুনা মুম্বাই) গিয়ে আশা ভোঁসলের সঙ্গে দেখা করতে। অজয় বরাবরের লাজুক, প্রায় কাঁপতে কাঁপতে তাঁর সলিলদাকে বললেন আশার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। আশার কিন্তু ‘কেন যে আলো নেই’ গানটি গাইতে কোনো আপত্তি হল না। গানখানি আজীবন অজয়ের বড় প্রিয় ছিল। এই ঘটনার পরেই অজয়ের কাছে বোম্বের শিল্পীদের দরজা খুলে গেল। সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কটির কথা সুবিদিত – কিশোরকুমারের সঙ্গে।

অজয় আগেও কিশোরের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ তে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এরকমঃ

অজয় আর সুখেন বোম্বের হোটেলে বেশ ক’য়েক সপ্তাহ পড়েছিলেন,  কিশোরকুমারের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিশোরকুমারের অজ্ঞাতেই, তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার কথা বলে, তাঁদের টাকা খসানো হচ্ছিল।

শেষে বোম্বে ল্যাবস স্টুডিওতে কিশোরকুমারের সঙ্গে আলাপ হল। ততদিনে কিশোর ক্যাসেটে রেকর্ড করা তাঁর গান পেয়ে গেছেন, রেকর্ডিং-এর জন্য প্রস্তুত। স্টুডিওতে তিনি সুখেনকে গানের পরিবেশটি সবিস্তারে বুঝিয়ে দিতে বললেন। এরপর অজয়কে যে গানটি রেকর্ড হবে সেটি একটু গেয়ে শোনাতে বললেন, যদি সুর বা অভিব্যক্তি কিছু ছোটোখাটো পরিবর্তনের দরকার হয়। এবার কিশোর তাঁর প্রিয় চেয়ারে বসে ভয়েস টেস্ট করলেন। একদিকে এরেঞ্জার উত্তম সিং আর রেকর্ডিস্ট বি এন শর্মাকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন কিশোর, অন্যদিকে অজয় প্রায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন! শেষপর্যন্ত তাঁর স্বপ্নপূরণ হচ্ছে। এ যে তাঁর পক্ষে এক অকল্পনীয় ব্যাপার! ‘প্রতিশোধ’ (১৯৮১) সিনেমার ‘হয়তো আমাকে কারো মনে নেই’’ গানটির চিত্রায়ন নিয়ে অনেক মজা করা হয়। তাহলেও খুব সহজ সরল সুর আর কিশোরের উদাত্ত কন্ঠের গায়কীর জন্য গানটির জনপ্রিয়তায় এই চল্লিশ বছরে এতটুকু ভাটা পড়েনি।

১৯৮১ সালে সেই যে একসঙ্গে পথ চলা শুরু হল, তা কিশোরের মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। তাঁদের মিলিত সৃষ্টির খতিয়ান হল বারোটি ছবিতে কুড়িটি গান, যার মধ্যে ১৮টি একক। কলকাতার কোনো সুরকারের সুরে গাওয়া এটাই কিশোরের সর্বোচ্চ গানের সংখ্যা। অজয়ের সুরে লতা, আশা, এবং দুই বোনের সঙ্গে ট্যানডেম সংও গেয়েছেন কিশোর– লতার সঙ্গে ‘আমি যে কে তোমার’ (অনুরাগের ছোঁয়া, ১৯৮৭), আশার সঙ্গে ‘আমার এ কণ্ঠ ভরে (জীবন মরণ, ১৯৮৩), আর ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি (পাপ পুণ্য, ১৯৮৭)।

বহু সহশিল্পী / সহকর্মীদের মত কিশোরকুমারের কৌতুকের সঙ্গেও ভালোই পরিচয় ছিল অজয়ের। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই অনেক গল্প শোনা যায়। এর মধ্যে একটা হল অজয়ের কুকুর ভীতি। তিনি কুকুর এতটাই ভয় পেতেন যে একদিন কিশোরের বাংলোতে ঢুকতেই দ্বিধাবোধ করছিলেন। কিশোর বেরিয়ে এসে অভয় দিলেন, ‘ভয়ের কিচ্ছু নেই, ওরা ইনকাম ট্যাক্সের লোক ছাড়া কারুকে কামড়ায় না।’ আবার কিশোরের বাইরের আবরণ ভেদ করে সহৃদয়তার পরিচয়ও পেয়েছিলেন যখন তিনি এই তো জীবন, হিংসা বিবাদ লোভ ক্ষোভ, চিতাতেই সব শেষ (অমরকন্টক, ১৯৮৭) গানের জন্য প্রাপ্য দশহাজার টাকা নিতে চাননি। কিশোর সাধারণতঃ টাকা পয়সার ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে ছিলেন, তাই তাঁর এই ব্যবহারে অনেকে আশ্চর্য হয়েছিলেন। অজয় হননি। ‘চিতাতেই সব শেষ’ গানের কথাগুলি সম্ভবত কিশোরকে তাঁর ফেলে আসা অতীত আর জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।

কিশোরের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু অজয়ের কাছে একেবারে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত ছিল। রাহুল দেব বর্মণের মত অজয়ও কিশোরকে মনে রেখেই গান তৈরি করতেন। কিশোরের অনুপস্থিতিতে সেই ম্যাজিকটা যেন আর ফিরিয়ে আনা যাচ্ছিল না। নয়ের দশকে বা একবিংশ শতাব্দীতে অজয়ের গানে সেই ঔজ্জ্বল্য না থাকার কারণ সম্ভবতঃ এটাই।

কিন্তু অজয়ের কিন্তু কাজের স্রোতে আদৌ ভাটা পড়েনি। ছবির গান ছাড়া আধুনিক গান এবং রেডিওতেও তিনি বেশ কিছু কাজ করছিলেন। তখনকার সব শিল্পীরা, এমনকি বাণী জয়রাম এবং অনুরাধা পড়ওয়াল এর মত সর্বভারতীয় শিল্পীরা ও তাঁর সুরে গান গেয়েছেন।

হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওপরে ভিত্তি করে অজয় খুবই সুন্দর সুন্দর গান তৈরি করেছিলেন। তাঁর এই প্রয়োগক্ষমতার ব্যাপারটি সেভাবে আলোচিত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে রয়েছে, ‘মান-অভিমান’ (১৯৭৮) ছবিতে মৃণাল চক্রবর্তী এবং শিপ্রা বসুর গাওয়া শংকরা রাগের ওপর ভিত্তি করে তৈরি ‘বাঁধিতে চেওনা আমায়’ গানটি। এছাড়াও রাগ চন্দ্রানন্দনের ওপর ভিত্তি করে আরতি মুখার্জীর গাওয়া ‘রাত আমার শুধু যে গেছে কাঁদিয়ে’ গানটির কথাও উল্লেখযোগ্য। আলি আকবর খানের তৈরি এই রাগটি তুলনামূলকভাবে নতুন।

আর ডি বর্মণের কথা প্রসঙ্গে আরো একটি কথা মনে পড়ে। বাংলা সিনেমার গানের আলোচনাতে যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যাপারটি অনালোচিত। অজয়ের অনেক গান, যেমন ভৈরবী রাগাশ্রিত ‘ছেড়ে যেওনা’ (জীবন মরণ), ‘কেউ জানে না, চাঁদের কণা’ (তুসি, ১৯৭৮) বা মোহময়ী ‘বৃষ্টি থামার শেষে’ (পারাবত প্রিয়া, ১৯৮৪) খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যন্ত্রানুষঙ্গে। অজয়ের সঙ্গে সবসময়ই গুণী শিল্পীরা ছিলেনঃ ওয়াই এস মুলকি, উত্তম সিং, এবং সমীর খাসনবীশ। তা সত্ত্বেও তিনি নিজে সব কিছু দেখা শোনা করতেন। সব গানের প্রিল্যুড, ইন্টারল্যুড, এমনকি ছবির কোথায় কোথায় কী রকম আবহসঙ্গীত লাগানো হবে, সব কিছুতেই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকতো। অজয় নিজে ক্লাসিকাল সঙ্গীত শিক্ষা পেয়েছিলেন, তাই সময় সুযোগমত সেতার, সরোদ, বেহালা ব্যবহার করতেন। আবার বিদেশী ব্রাস বা হর্ন ও নির্দ্বিধায় জুড়ে দিতেন। যেমন চমৎকার ভাবে তা কাজে লাগিয়েছিলেন ‘এপারে থাকবো আমি / তুমি রইবে ওপারে’ (জীবন মরণ) গানটিতে।

মদনমোহন, নৌশাদ, শচীনদেব বর্মন, সলিল চৌধুরী এঁদের গভীর অনুরাগী হলেও অজয়ের একটি আলাদা স্বকীয় স্টাইল ছিল। অজয় নিজে কবি ছিলেন, তা সত্ত্বেও আগে সুর তৈরি করে গীতিকারকে বলতেন কথা বসাতে। তাঁর বেশীর ভাগ কাজ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হলেও গৌরীপ্রসন্নেরও ভক্ত ছিলেন। মিটার অনুযায়ী গান লেখার ব্যাপারে গৌরীবাবুর জুড়ি ছিল না। ছবির গানের সুরকারকে আবার শিল্প এবং বাণিজ্য, দু’দিকই দেখতে হয়। অজয় তাঁর গ্রুপের সঙ্গে গানে লিপ দেওয়া নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতেন, দরকার হলে অভিনেতার সঙ্গেও। উত্তমকুমারের সঙ্গে যে ছবিগুলি করেছিলেন, তাতে এ ছিল নিয়মিত ব্যাপার। উত্তম শুধু সু-অভিনেতাই ছিলেন না, তাঁর সঙ্গীতবোধও ছিল প্রখর। ‘রাজনন্দিনী’ (১৯৮০) ছবির গানের মহড়া ও রেকর্ডিং-এ উপস্থিত ছিলেন শকুন্তলা বড়ুয়া। তাঁর কাছে জানা যায়, এই ছবির সব গান উত্তমের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছিল।

দুর্ভাগ্যজনক, প্রযোজকদের সামলাতে অপারগ ছিলেন অজয়। সম্ভবতঃ বৈষয়িক ব্যাপারে তাঁর এই দুর্বলতা পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। তাঁর সহজ সরল, চুপচাপ স্বভাবের ফলে অনেক সময়ই বঞ্চিত হতে হয়েছে। ভাবা যায়, তিনি ‘পান্না, হীরে, চুনী’র সঙ্গীত পরিচালক, তা সত্ত্বেও ১৯৬৯ সালে, HMV তাঁকেই বলেন রেকর্ডের দোকানে গানের রেকর্ড গিয়ে দিয়ে আসতে? তাঁর কাজের জন্য প্রাপ্য সাম্মানিকও তিনি অনেক সময়ই পেতেন না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত, এমনকি যখন পাটুলীর ফ্ল্যাটে চলে যান, টাকা পয়সা নিয়ে টানাটানি চলেছিল।

‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ – এই প্রবাদের অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ অজয় দাস। আশির দশকে বাংলা গানের বাজারে আশি শতাংশ তাঁর দখলে থাকলেও তিনি সঙ্গীতবোদ্ধা, সমালোচক, বা সাংবাদিকদের নজর কাড়তে পারেননি। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, তো দূরের কথা, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, রাজেন তরফদার, অসিত সেন, পীযূষ বসু – কারুর সঙ্গে কাজ করারই তাঁর সৌভাগ্য হয়নি। তরুণ মজুমদার তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে ‘সজনী গো সজনী’ (১৯৯১) ছবিতে বেশ কয়েকজন সঙ্গীত পরিচালকের মধ্যে তাঁকেও স্থান দিয়েছিলেন।

তাঁর সুর দেওয়া গানগুলি ‘শুনতে ভাল, দেখতে নয়’ নামেও অভিহিত ছিল। যে ছবিগুলিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন তার দর্শকরা ছিল মোটামুটি গ্রামের বা শহরতলীর খেটে খাওয়া মানুষ। উঁচু শ্রেণীর দর্শকেরা কদাচিৎ তাঁর ছবি দেখতে যেতেন। উৎপল দত্তের ‘তীর’ কে অবশ্যই অন্যধারার ভাবা হত। কিন্তু শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের নাটক ‘অমরকন্টক,’ ‘ব্যভিচার,’ বা জ্যোৎস্না দত্তর যাত্রা ‘রক্তাক্ত প্রজাপতি’তে তাঁর কাজ শহরের সাংস্কৃতিক মহল ভালো চোখে দেখেনি।

দুটি বস্তুই অজয়ের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ছিল – গান আর বন্ধু। শ্যাম্পেন ওড়া পার্টিতে তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। আরামে লেবু চা খেতে খেতে, বাখ–বেটোফেন শুনতে শুনতে বড়বড় আলোচনা করা বিদগ্ধ বোদ্ধাদের মাঝেও তাঁর জায়গা ছিল না। নিজের পাড়ার ‘মহারাণী’ চা স্টলে বসে কাপ কাপ চা খেতে খেতে নিজের গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে তিনি দিব্যি চিন্তামগ্ন হয়ে সময় কাটিয়ে দিতে পারতেন।

তাঁর বন্ধু অভিনেতা শুভেন্দু অর্থোপেডিক ডাক্তার ছিলেন, সেই সুবাদে তাঁর আরো বেশ কিছু ডাক্তার বন্ধু ছিল। ভবানীপুরের ইউবিআই-এর ল্যান্সডাউন ব্রাঞ্চে ডাক্তারদের গানের আড্ডায় তিনি ছিলেন নিয়মিত সদস্য। অজয়ের ‘মশলামুড়ি’ ছিল সব্বার খুব প্রিয়। পাঁচতারা হোটেলের চেয়ে নিজের পছন্দের লোকজনের সঙ্গে মশলামুড়ি খেতে খেতে আড্ডা মারা বেশি পছন্দ ছিল অজয় দাসের।

২০১৩ সালে বাংলা নববর্ষের দিনেই মৃত্যু হয় অজয় দাসের। ২০০০ সালে, স্ট্রোকের পর থেকেই অলজাইমার রোগে ভুগছিলেন। তার মধ্যেও অবশ্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর বন্ধুদের সমবেদনা ছিল একেবারেই আন্তরিক। শুধু সুরকার নয়, মানুষ হিসেবেও তাঁরা এমন একজনকে হারালেন যিনি মনের দিক থেকে ছিলেন একটি ছোট্ট শিশু। মৃত্যুকালে সিনেমা জগতের হাজার হাজার লোক অবশ্য জড়ো হননি। সেটা দুর্ভাগ্যজনক। সম্ভবতঃ অজয় দাস ছিলেন এক আঙ্গিকের বঙ্গ-সংস্কৃতির শেষ প্রতিনিধি – সুরের মাধুর্য, ধ্রুপদী যন্ত্রানুষঙ্গ, নিজস্ব গানের দল ছিল যাঁদের সঙ্গীত সংস্কৃতির মূল কথা। বড়ো পত্রপত্রিকাতেও তাঁর মৃত্যু সংবাদ খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়নি। একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্রের একটি আন্তরিক, সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণ।

না হোক! গ্রাম বাংলাতে, বিশেষতঃ একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে, কুকড়াহাটি থেকে যে স্টিমারগুলো ঢেউ ভেঙে ভেঙে রাইচক বা ডায়মন্ড হারবারে পাড়ি জমায়, তারা কিন্তু অজয়ের গান আজও নিয়মিত বাজায়। ২০১৩ সালেও। ঠিক যেমন বাজাতো ১৯৮৬ সালে।

শেষের কথা

২০১৩ সালের জুন মাসে মনোজিৎ ক্যাসেট হাতে মুম্বাই পৌঁছলেন। আন্ধেরির গীত অডিওক্র্যাফট স্টুডিওতে আশা, ছলছল চোখে, রেকর্ড করলেন অজয় দাসের সুরারোপিত শেষ গান ‘প্রেম ভরা দুই চোখে’ একটি বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল, আশা ভোঁসলেই ছিলেন অজয়ের সুরে গান করা প্রথম বোম্বের শিল্পী, ঘটনাচক্রে তিনিই আবার গাইলেন অজয়ের সুর করা শেষ গান।

দুর্ভাগ্য অজয়ের, তাঁর নিজের আরো অনেক গানের মতো এই গানটিও আর শোনা যায়নি।

 

পাদটীকা

অজয়ের ভাই সুখেনের নথিভুক্ত জন্মতারিখ ২৮শে জুলাই, ১৯৩৮। সুখেনের চেয়ে অজয় বছর দেড়েকের বড় ছিলেন। সুতরাং দুই ভাইয়ের জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্কের কারণ আছে।

১৯৭৩ সালের সুপারহিট মিউজিক্যাল ছবি ‘সমঝোতা’র কথা সর্ব ভারতীয় দর্শকের মনে থাকতে পারে। এটি বাংলা ছবি ‘পান্না, হীরে, চুনী’ অবলম্বনে তৈরী। কাহিনিকার হিসেবে সুখেন দাসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এই ‘ট্যানডেম সং’ কথাটির অর্থ, এক গান যখন দুবার দুভাবে গাওয়া হয় – সাধারণতঃ একবার পুরুষকণ্ঠে অন্যবার নারীকণ্ঠে। স্বর্গত শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক রাজু ভরতন এই শব্দটির প্রবর্তন করেন।

http://archives.anandabazar.com/archive/1130525/25music1.html

 

 

ঋণ স্বীকার – 

 

১ – শর্বাণী দাস ও শায়েরি দাস, অজয়ের স্ত্রী ও কন্যা – যাঁদের ছাড়া লেখাটি অসম্ভব ছিল।

২ – শকুন্তলা বড়ুয়া ও রাজশ্রী বিদ্যার্থী, আরো এক মা-মেয়ে জুটি, যাঁরা সাক্ষাৎকারে অনেক সাহায্য করেছেন এবং অজয় দাসের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন।

৩ – মনোজিৎ গোস্বামী – বাংলা চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার এবং ব্যবস্থাপক

৫ – অর্চিস্মান মজুমদার – মুম্বাই নিবাসী হিন্দস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুরাগী ও গবেষক।

৬ – সর্বজিত মিত্র – লন্ডন নিবাসী গবেষক

৭ – সোমনাথ গাঙ্গুলী – হংকং নিবাসী সঙ্গীতানুরাগী

৮ – সুভাষ ঘোষ – ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য নিবাসী সঙ্গীতানুরাগী

৯ – আবীর ভট্টাচার্য, মিঠুন পাল, ইন্দ্রনীল মুখার্জি, অর্ণব ব্যানার্জি – কলকাতা নিবাসী সঙ্গীতপ্রেমী।

বিশেষ বিজ্ঞপ্তি-

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত cinemaazi website-এ। লেখকের ও ওয়েবসাইটের অনুমতিক্রমে, ‘অবসর’ সম্পাদক কর্তৃক অনুবাদিত এবং ‘অবসর’-এ প্রকাশের পূর্বে অনুবাদিত লেখাটিও লেখকের দ্বারা অনুমোদিত।

 

 

 

পেশায় ইঞ্জিনীয়ার হলেও সঙ্গীত তাঁর রক্তে ও নেশায়। বর্তমানে সপুত্র, সস্ত্রীক ব্যাঙ্গালোরের কর্মরত। সঙ্গীত ছাড়াও অন্য শখ সিনেমা ও কুইজ। বালাজী ভিট্টলের সঙ্গে লেখা তাঁর একটি বই “R. D. Burman: The Man The Music” ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত। বালাজী ভিট্টলের সঙ্গে শচীনদেব বর্মণকে নিয়ে লেখা তাঁর অপর বইটি হল “S. D. Burman: The Prince-Musician।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *