অলীক মানুষ
সুজন দাশগুপ্ত।
সুজনদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ …ঠিক আলাপও নয়… বলা ভালো, সুজনদার কথা আমাকে প্রথম বলেছিল ভাস্কর (বসু)। ‘অবসর’ ওয়েব পত্রিকায় লেখা দেওয়া নিয়ে। বলেছিলাম, ‘লেখা চাইছিস, আমি তো ওই পত্রিকার কাউকেই চিনি না!’ তখনই ভাস্কর বলল দুই সম্পাদকের নাম। সুজন দাশগুপ্ত আর সুমিত রায়। সুমিত রায় বিখ্যাত অভিনেতা বিকাশ রায়ের পুত্র। বিকাশ রায়ের নাম আমরা কে-ই বা না জানি! তবে পরবর্তীকালে জেনেছিলাম, সুমিত রায় নিজেও অত্যন্ত গুণী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সুজন দাশগুপ্ত? আরে, এ তো চেনা নাম; আমার বাবার দৌলতে। বাবা ছিলেন গোয়েন্দা সাহিত্যের ‘পোকা।’ অবশ্য পোকা না বলে কুমির বলাই ভালো; কারণ মোটামুটি পাঁচকড়ি দে থেকে মিতিন মাসি …বাবা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই সর্বভুক! তাই বাবার কাছেই প্রথম শুনি একেন্দ্র সেনের নাম। প্রবাসে থাকার কারণে কলকাতায় কী কী বইপত্র বেরোচ্ছে, তার খবরাখবর পুরোটাই পেতাম বাবার মারফত।
যখনই কলকাতায় যেতাম, বাবা একটা বইয়ের তালিকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিনে আনার বরাত দিতেন। আর সেইভাবেই একবার দেখেছিলাম চার পাঁচটা বইয়ের নাম। সবই ‘একেন্দ্র সেন’ নামের এক গোয়েন্দার কাহিনি; লেখক সুজন দাশগুপ্ত। প্রথমে বুঝিনি, সেই বইগুলো জোগাড় করতে কতটা ছুটোছুটি করতে হবে! অথচ বাবার কড়া হুকুম, বইগুলো যতক্ষণ না কেনা হচ্ছে, বাড়ি ফেরা চলবে না!
কলকাতার হাঁসফাঁস করা ঘোর গ্রীষ্মে যারা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার ঘিঞ্জি গলিতে আবর্জনার গাদা সন্তর্পণে পেরিয়ে নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলায় উঠে বই কিনেছে, গ্যাঁট হয়ে দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে দোকানের মালিককে মইয়ে চড়িয়ে মেজানাইন ফ্লোর থেকে বই নামিয়ে সেই বইয়ের রসিদ কাটিয়েছে বা বন্ধ দোকানের তালা খুলিয়ে শাটার তুলিয়ে বাধ্য করেছে পছন্দের বই দেখাতে …আমিও একেনবাবুর বই কিনেছি যখন, এদের প্রত্যেকের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পেরেছিলাম। তখন একেনবাবুর এমন ‘সমগ্র’ মিলত না; সবই বিভিন্ন প্রকাশনার খুচরো বই। তাই অমন গলদঘর্ম হয়ে বই জোগাড় করতে হয়েছিল বলে আমি প্রথমে কিছুটা রাগই করেছিলাম বাবার ওপরে এবং একেনবাবুর ওপরেও। তারপর বইয়ের পাতায় আলাপ হল একেন্দ্র সেনের সঙ্গে; এক হাড়কিপটে, এলোমেলো পোশাক পরা, ক্ষুরধার বুদ্ধিমান অথচ প্রচণ্ড আনঅ্যাশিউমিং মাঝবয়সী গোয়েন্দা। একেনবাবুকে ভালোবাসলাম বটে, কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম কখনও লেখকমশাইকে বাগে পেলে আমাকে দোকানে দোকানে ঘোড়দৌড় করানোর জন্য একহাত নেব! হয়ত সেই ‘একহাত নেওয়া’র লোভেই আমি ‘অবসর’ পত্রিকায় লিখব বলে কথা দিলাম। শর্ত একটাই ছিল। ভাস্করকে বলেছিলাম, সুজন দাশগুপ্তর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে।
তাই যেদিন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল, অর্থাৎ সুদূর আমেরিকা থেকে সুজন দাশগুপ্তর ফোন পেলাম ‘অবসর’ ওয়েবজিনে লেখা দেওয়ার জন্য। অমনি বলেছিলাম, ‘আপনিই কি সেই সুজন দাশগুপ্ত, যিনি একেন সেনের বন্ধু, মানে বাপি? আপনি জানেন, আপনার বই জোগাড় করতে গিয়ে আমার জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে গেছে? আপনি জানেন, আমার বাবা আমাকে হুমকি দিয়েছিলেন বই না কিনতে পারলে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না বলে?’
সুজন দাশগুপ্ত খুব অবাক গলায় বলেছিলেন, ‘তুমি আমার চেয়ে অনেকটাই ছোটো নিশ্চয়ই; তাই “তুমি” করেই বলছি …মানে তোমার বাবা একেনবাবু পড়েন?’
আমি বলেছিলাম, ‘বাবা একাই শুধু নন, এখন বাবার মেয়েও পড়ে!’
তারপর কবে থেকে যে সুজন দাশগুপ্ত আমার ‘সুজনদা’ হয়ে উঠল, আমি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, সুজনদাও চলে এল ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে, আমার ‘ভালো নাম’ থেকে ‘ডাক নামে’… আজ পেছন ফিরে তাকাই যখন…কী জানি কেন, কিছুতেই মনে করতে পারি না!
‘অবসর’ পত্রিকায় লিখতাম নিয়মিত। কখনও লেখা দিতে আলসেমি করলে সুজনদা ফোন করে অনুযোগও করত। তবে এই ‘অবসর’ ছিল সম্পর্ক গড়ে ওঠার একটা দিক মাত্র। মানুষে মানুষে সম্পর্কের নানা দিক থাকে, তাতে নানা রংও থাকে। সাদা-কালো থেকে রঙিন। সুজনদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটা রামধনুর মতো। শুধুই রঙিন! সম্পর্ক অনেক রকমের হয়। নিছক কেজো সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা অথবা বৈরিতারও। কিছু সম্পর্ক আমরা যত্নে লালন করি, কিছু বা ফেলেও দিই। খুব কম এবং হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি সম্পর্কই মানুষের জীবনে রয়ে যায় এমন উজ্জ্বল আর অমলিন উপস্থিতি নিয়ে, যে সম্পর্কের আলো মৃত্যুর মলিন অন্ধকারের মধ্যেও জোনাকির ফুল হয়ে ফুটে থাকে। সুজনদা আর আমার মধ্যে ঠিক তেমনই এক বিনিময়ের জায়গা ছিল।
সুজনদা যেই আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল, অমনি আমাদের মধ্যে বয়সের ফারাকটুকু ঘুচে গেল মন্ত্রবলে! সুজনদার সঙ্গে আড্ডা মারা যেমন ছিল, কারও ওপরে রাগটাগ হলে তা নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে আলোচনার জায়গাও ছিল ওই একই সুজনদা। আসলে সুজনদা এমনই একজন মানুষ, যে একই সঙ্গে অভিভাবক আর অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠতে পারত খুব অনায়াসে। অনেকটা যেন গাছের মতোই। মনে ভালোবাসা আর নির্ভরতার শিকড় বিছিয়ে দিতে জানত যেমন, তেমনই জানত আশ্রয় দিতে। অন্যের সুখে সুখী হতে, দুঃখের শুশ্রূষা হয়ে উঠতে।
সুজনদা কত ভালো বিজ্ঞানী ছিল, কতটা মেধাবী ছিল, কতটা সফল কাহিনিকার ছিল, কতটা রসিক ছিল…সে মূল্যায়ন করার লোকজন অসংখ্য। আমি শুধু জানি এইটুকুই, সুজনদা ‘মানুষ’ হিসেবে তুলনারহিত ছিল। এমনই একজন মানুষ, যে অনেকটা বটগাছের মতো। খুব নিশ্চিন্তির আর নিরাপদ আশ্রয়। বাবা চলে যাওয়ার পরে সুজনদা আর শমীতাদিকে পেয়েছিলাম; দূরে থেকেও যাদের উপস্থিতি অনুভব করে সেই অনুভূতির গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিজেকে দু-দণ্ড জুড়িয়ে নেওয়া যায়! আমার বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। সুজনদা বয়সের ফারাক ভুলিয়ে দিয়ে সত্যিকারের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে জানত বলেই হয়ত ব্যাঙ্গালোর থেকে নিউ জার্সির দূরত্বটা চিরকাল এ পাড়া-ও পাড়া হয়েই রয়ে গিয়েছিল। আনন্দে, বিষাদে, উচ্ছ্বাসে, অবসাদে মুঠোফোনের এ ধার থেকে, মেসেঞ্জারে বা ই-মেলে যাকে অবলীলায় যোগাযোগ করা যায় এক মুহূর্ত দ্বিধা না করেই।
পরিণত বয়সে ‘বন্ধু’ পাওয়া যায় না তেমনভাবে। অধিকাংশই ‘পরিচিত’র লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে মনের ঘরে প্রবেশের অধিকার পায় না। তবুও আচমকা খুব ‘কাছের মানুষ’ হয়ে ওঠে কেউ কেউ। সুজনদা যেমন। আমাদের মুখোমুখি আড্ডায়, দূরভাষের আলাপচারিতায় ঠিক কী কী বিষয়ে কথা হত, বলা মুশকিল। ঠিক যেমন অনেক ভেবেও মনে করতে পারছি না, কী নিয়ে কথা হত না! আসলে কারও মন যখন সক্রিয় থাকে এবং প্রচুর বইপত্রঘেঁষা জীবন থাকে, কথোপকথন চলার সময়ে বিষয়বস্তুতে ঘাটতি হয় না। সুজনদার যাপনও তেমনটাই ছিল। সেই কারণেই আমাদের কথার ঝাঁপি ছিল অনেকটা জাদুকর পি সি সরকারের ‘জাগ অফ ইন্ডিয়া’র মতো। কক্ষনো শেষ হত না। ঝুরো ফুলের পাপড়ির মতো ঝরেই পড়ত, ঝরেই পড়ত! তবুও এখন মনে হয়, অনেক কথা তো বলাই হয়নি! আসলে কখনও ভাবিইনি, হাতে সময় বড়ো অল্প অবশিষ্ট আছে।ধরেই নিয়েছিলাম, আরও অজস্রবার দেখা হবে, কথা হবে, গল্প হবে …। ভেবেছিলাম, সামনে অনেকটা পথ এখনও পড়ে আছে …তাই তাড়াহুড়ো করে সব কথা ফুরিয়ে ফেলতে চাইনি। বুঝতেই পারিনি, এমন হঠাৎ করে কোনোরকম আগাম জানান না দিয়েই পথটা শেষ হয়ে যাবে নিকষ তমসা সমস্ত শরীরে মেখে নিয়ে।
সুজনদা রহস্যকাহিনি লিখত। মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস-অনুবাদ-ছড়া লেখা, ধাঁধা নিয়ে অন্যরকম বই …কিছুই বাদ যায়নি। মুখে বলত নাকি স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। তখন একটা একটা করে ফেসবুকে উদাহরণ টেনে এনে অনুযোগ জানিয়েছি কত! বলেছি, ‘এই যে এত টুকরো টুকরো ছবির মতো স্মৃতিনির্ভর লেখা, এত মানুষজনের সংস্পর্শে এসেছ… সাধারণ এবং অসাধারণ … সকলেরই তো কিছু না কিছু গল্প থাকে! সে সব লিখে রাখো।’ উত্তরে বলেছে, ‘দূর! অত লিখবে কে! এখন একেনবাবুকে নিয়ে লিখতেই হাঁপিয়ে উঠি! মাথায় প্লট আসে না!’ খুব হেসেছিলাম শুনে। বলেছিলাম, ‘কাজ তো ঢের বাকি এখনও। বাপিকে আর কতদিন আইবুড়ো কার্তিকঠাকুর করে রাখবে? ওর বিয়েটা এবার দাও! আর একেন-গিন্নির নামটা অন্তত কোনও নতুন লেখায় ফাঁস করো এবার! নাকি উনি “অনামিকা সেন”? আর শোনো, এসব আগে মিটিয়ে নাও গোটাকয়েক লিখে; তারপর না হয় একেনবাবুকে কোনও গল্পে “খুনি” বা “জালিয়াত” বানিয়ে যাবজ্জীবন ঘানি টানিয়ে দিও! ব্যস, ঝামেলা শেষ আর তুমি তারপর মন দিয়ে একটা “সেপিয়া রঙের অ্যালবাম” লেখার কাজে হাত দিতে পারবে।’
ভাবিনি, একেনবাবু এভাবে নিরুদ্দেশে পাড়ি দেবেন আর সেপিয়া অ্যালবামের পাতায় পাতায় যত ছবি, যত মুখের মিছিল …সব কুয়াশার নৌকো করে ভেসে যাবে দশ দিগন্তের অন্ধকার সমুদ্রে।
সুজনদা আমার কাছে ঠিক কতখানি ছিল? সত্যিই জানি না! ভেবে দেখিনি কখনও। কিছু কিছু মানুষ এমন প্রত্যেকের জীবনেই থাকে, যাদের উপস্থিতি এমনই যে আমাদের মনে হয় তারা অনন্ত আয়ুর আধার! কখনও যে অতর্কিতে এমন বজ্রাঘাত নেমে আসতে পারে, যে সেই উপস্থিতি মিলিয়ে যেতে পারে কোনও দূরতর দিগন্ত পেরিয়ে …তা আমাদের কষ্টকল্পনাতেও আসে না! যে অবশ করা অনুভূতি বাবা চলে যাওয়ার পরে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বা এখনও রেখেছে…তা আবার নতুন করে আছড়ে পড়ল কয়েকদিন আগে। কাকে ‘আত্মীয়’ বলা যায়? যে মানুষ ‘আত্মার প্রিয়।’ সেই অর্থে সুজনদা আমার ‘পরমাত্মীয়’ ছিল। সুজনদার হাত ধরে অনেক কিছু শিখেছি আমি। জীবনের পাঠ। শিখেছি, কেমন করে কঠিন কাজ, কঠিন পরিস্থিতি, দুঃখ এবং দুঃসময় সহজ করে গ্রহণ করে নিতে জানতে হয়। আমার বহু বহু অস্থিরতার মুহূর্তে, বিপর্যয়ের মুহূর্তে আচমকাই অদ্ভুত কোনও ‘টেলিপ্যাথি’র কারণে মুঠোফোন বেজে উঠেছে আমার কুশল জানতে চেয়ে। সেইসব আলাপচারিতা আমাকে স্থিত করেছে, ভরসা জুগিয়েছে, বলেছে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে!’ ঠিক যেমন করে বাবা বলতেন! সুজনদা হয়ত সেই শূন্যস্থান নিজের অগোচরেই ভরিয়ে তুলেছিল!
এই লেখা লিখছি যখন, একটা কথা হঠাৎই মনে এল। আমাকে ‘ডাক’ নামে ডাকার মানুষ কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কমে আসছে! শীতকালে পর্ণমোচী গাছের পাতা কি এমনি হারেই খসে পড়ে? এই কি তবে জীবন ফুরিয়ে আসার গল্প? পরমুহূর্তেই মনে হল, সুজনদার মতো অমন আদ্যন্ত ‘পজিটিভ’ একজন মানুষ কখনও মৃত্যুকে ‘অবসান’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারত না! তাহলে আর আমি এতদিন ধরে, এত বছর ধরে সুজনদার কাছে কী শিখলাম!
বরং এমনটাই ভাবব এখন থেকে …যখন আর নিয়ম করে সপ্তাহের ফোন বা মেসেজ আসবে না, কলকাতার বাড়িতে আড্ডা বসবে না বা বইমেলার মাঠে গল্প হবে না… সুজনদা এমন কোথাও ছুটি কাটাতে গেছে কাউকে না বলে কয়ে…অনেক অনেক দিনের জন্য …যেখানে ধারেকাছে কিচ্ছুটি নেই! না আছে চিঠি লেখার কাগজ-কলম, না ডাকঘর, না মুঠোফোনের টাওয়ার! সেই নির্জন প্রবালদ্বীপে এক আশ্চর্য নরম গোলাপি গোধূলির আলো মেখে আমাদের প্রিয় মানুষজন বসে আছে … আমাদেরই অপেক্ষায়। ঠিক কোনও না কোনও দিন দেখা হবে বলে।
1 Comment