সুজনদা স্মরণে

সুজনদা স্মরণে

২০২৩-এর জানুয়ারি মাসে বেঙ্গালুরু থেকে ভাস্করের ফোন পেলাম- “ফ্রি থাকলে ১লা ফেব্রুয়ারি কলকাতা বইমেলায় চলে এসো বিকেল তিনটে নাগাদ। জব্বর আড্ডা হবে ক্যাফে টেবলের স্টলের সামনে।” সোজা কথা, বইমেলা উপলক্ষ। আসল লক্ষ্য আড্ডা। সুজন দাশগুপ্তের একেনবাবু সিরিজের ছয় নম্বর সঙ্কলনটির উদ্বোধন আর সেই সঙ্গে অমিতাভের আনা মাইসোর পাক সহযোগে পরিবেশিত হবে সুজনকথা। ভাস্কর জানাচ্ছে সেদিন সুজনদার বেটার হাফ শমীতাদিও সঙ্গ দেবেন, তাঁর ‘দ্বন্দ্ব’ উপন্যাসের প্রকাশ উপলক্ষে। হয়তো থাকবেন সস্ত্রীক ভাস্কর বোস ও অমিতাভ প্রামাণিক, শিবাংশু দে, সুজাতা বেরা, ঈশানী রায়চৌধুরী, শেখর বসু, রাজা ভট্টাচার্য, ও আরো অনেকে। সুজনদা আমেরিকা থেকে আসছেন, আমরা মুম্বাই-বেঙ্গালুরু-দিল্লি-কলকাতা থেকে এসে যোগ দিতে পারব না?

বিধাতাপুরুষ কি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন সেদিন? সেই আমরা গেলাম, একত্রিত হলাম। এলেন না শুধু সুজনদা। তিনি তখন মর্তবাসীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন চিরকালের জন্যে। ফলে সেদিন সেই শিবহীন যজ্ঞে আমরা যুক্ত হয়েছিলাম, তবে আড্ডার বদলে হয়েছিল শুধু স্মৃতিচারণ। ক্যাফে টেবিলের কর্ণধার অভিষেক আইচ স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে শোনাল সেই বহুশ্রুত কাহিনী কীভাবে সে প্রকাশনার কাজে প্রায় নতুন নেমে সুজনদার একেনবাবুর কাহিনীগুলিকে একের পর এক সংকলিত করে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। অবাক সুজনদা, ‘কে কিনে পড়বে ওসব? তোমার নতুন ব্যবসা, এত শিগগির লালবাতি জ্বালতে চাও!’ তবু নাছোড়বান্দা অভিষেক আর তার জুড়িদার অরিজিৎ- আক্ষরিক অর্থে ‘ভদ্র!’ শেষে এক শুভলগ্নে ঘনাদার (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল) মধ্যস্থতায় তাঁর দমদমের বাসায় কীভাবে এর চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হল তার খবর অনেকের কাছে না থাকলেও সে কাহিনি আজ বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের ইতিহাসে ঢুকে পড়েছে। এরপর একেনবাবু এসেছেন ওয়েব-সিরিজে, সিনেমায়, ইউ-টিউবের গল্পপাঠে, বাংলার অপরাধ-সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটেছে এক নতুন ধারার নায়কের যিনি স্বভাব-ভঙ্গিমা-চলাফেরা-কথাবার্তায় মোটেও সেই খ্যাতিদীপ্ত শ্রেণীর মধ্যে একাসনে স্থান পান না। অথচ দিনের শেষে দেখতে পাই তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর ক্ষুরধার ঘটনা-বিশ্লেষণের জয়জয়কার।

২০২০র বইমেলাতে - অমিতাভ আর আমার মধ্যমণি 'সুজনদা'

এসব কী লিখছি, কেন লিখছি? সুজনদাকে আমি কিন্তু মনে রাখব না ধাঁধাপুরীর গোলকধাঁধার মত রহস্য-উপন্যাস, ছড়া-স্রষ্টা বা অপরাধজগতের খুঁটিনাটি নিয়ে ছেলেখেলা করা একেন সেনের জন্মদাতা হিসেবে। এটাও সত্যি যে তিনি প্রযুক্তিবিদ্যায় ডক্টরেট করে বেল ল্যাবে আজীবন কর্মরত ছিলেন- যেখানে আকাশে ঢিল ছুঁড়লে ভয় হয় বুঝি কোন নোবেল-লরিয়েটের মাথায় পড়ল সেটা। আত্মপ্রচারে অনাসক্ত সুজনদা তাঁর অগ্রজপ্রতিম সুমিত রায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুদূর আমেরিকায় বসে যে বাংলাভাষার উন্নতি, প্রচার আর প্রসার নিয়ে কাজ করে গেছেন, নেট-জগতের গোড়ার দিকে বাংলা ফন্টের উপর কাজ করে সেই ভাষায় ওয়েব-ম্যাগাজিন ‘অবসর’-এর প্রতিষ্ঠা আর সফল সঞ্চালন করে গেছেন- এহ বাহ্য।

আমি কে? আমরা কী? যে পৃথিবীতে কারো মাথা চারপাশের অন্যদের চেয়ে আধ ইঞ্চি ছাড়িয়ে গেলে তিনি আর পার্শ্ববর্তীদের দিকে তাকিয়ে দেখেন না, সেখানে তিনি আর সুমিতদা অকাতরে মিশেছেন আমাদের সঙ্গে, আড্ডা দিয়েছেন, আমাদের কাঁচা হাতের লেখার তারিফ করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন ভাল লিখতে। ২০২০র বইমেলায় মনে আছে, আমাদের রস-রসায়নজ্ঞ বন্ধু অমিতাভ সবাইকে বেঙ্গালুরু থেকে আনা বিখ্যাত রসালো মাইসোর পাক বিতরণ করছে, আর ডাক দিচ্ছে আপামর ক্রেতাবৃন্দকে- “আসুন, একেনবাবু কিনলে মাইসোর পাক ফ্রি।” অন্যদিকে সুজনদা মৃদু হেসে ধমক দিচ্ছেন- “আরে এভাবে বিক্রি করলে বইগুলো আমার লেখার দৌলতে না মাইসোর-পাকেচক্রে বিক্রি হচ্ছে সেটা কিভাবে বুঝব?” বিল কাটতে ব্যস্ত অভিষেক মুখ না তুলেই বলে- “যেভাবেই হোক, মেশোমশাই, লাভটা আমারই।” ও সুজনদাকে মেসো ডাকত কী সূত্রে সেটা নাকি একেনবাবুও খুঁজে পাননি!

সেই দিনগুলো আজ গত। প্রথমে গেলেন সুমিতদা, আর সেদিন সুজনদা। আমেরিকার বাংলা-শিবিরের ভীষ্ম আর দ্রোণাচার্য। “সুজনকথা” এখনও আমার প্রিয় বই, ইচ্ছে ছিল উনি দ্বিতীয় খণ্ডটা লিখুন। সেই এক কথা- ‘কে পড়বে?’ এবারের ক্যাফে টেবলের স্টলের ভিড় কি আপনি সুদূর অমর-লোক থেকে তাকিয়ে দেখেননি সুজনদা?

শিক্ষা- ইঞ্জিনিয়ারিং, কর্মসূত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম তৈলখনি অঞ্চলে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখি শুরু হয় ২০১১তে কম্প্যুটারে বাংলা ফন্টের আমদানির সূত্র ধরে, ‘অবসর’ সমেত বিভিন্ন নেট-পত্রিকা ও বম্বে ডাক, পশ্চিমঘাট ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত ২০২২ থেকে তিনটি ছোটগল্পের ও একটি প্রবন্ধের সঙ্কলন প্রকাশিত হয় এযাবৎ। দুটি নেট পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Ishani , March 19, 2023 @ 9:01 am

    যে সুজনদাকে আমরা চিনেছি, ভালোবেসেছি… সেই মানুষটিকে এই লেখাতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এই সংখ্যাটিতে প্রত্যেকের লেখাই মনে হচ্ছে একেবারে হৃদয় নিংড়ে নিয়ে লেখা !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *