এক অন্যরকম মানুষের গল্প

এক অন্যরকম মানুষের গল্প

জীবন বড় অদ্ভুত। চলার পথে কখন কোন বাঁকে যে কাকে পেয়ে যাব হাত ধরার জন্যে, আর কে যে কখন হাত ছাড়িয়ে ছিটকে চলে যাবে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে, তা কেই বা আন্দাজ করতে পারে? এরকমই এক অজানা অচেনা মানুষের হাত বাড়িয়ে দেবার গল্প আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সময়টা ২০০০ সালের পুজোর ছুটি। সেবার সপরিবারে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে, সঙ্গে শ্বশুরমশাই এবং শাশুড়ি-মাও ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী শ্বশুরমশাইয়ের উদ্যোগেই সেবারের ভ্রমণের সমস্ত পরিকল্পনা হয়েছিল। তখন কি জানতাম আমাদের জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা রয়েছে একদম আলাদা রকম! চেন্নাই, পন্ডিচেরি, মাইসোর ঘুরে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরতি ট্রেনে হাওড়া, এই ছিল প্ল্যান। পনেরো দিনের টানা জার্নির দরুন সবাই খুব ক্লান্ত, দুপুরের খাবার খেয়ে যে যার মতো বিশ্রাম নিচ্ছি ফেরার সময়। বাবা ছিলেন উপরের বার্থে, হঠাৎ তাঁর দিকে লক্ষ্য পড়ল। উঠে বসেছেন তিনি, নিচে নামার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যেন নামতে পারছেন না, মুখের কথাও পরিষ্কার নয় মোটেই। সাহায্য করতে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম বড় কোনো বিপদ হয়েছে। ওঁর মুখ একদিকে বেঁকে রয়েছে, শরীরে কোনো শক্তি নেই। সকলে ধরাধরি করে কোনমতে নিচে নামিয়ে কামরার মধ্যে ডাক্তারের খোঁজ করা হল। কোচবিহারের এক ডাক্তারবাবু ছিলেন পাশের কামরাতে, উনি এসে দেখে বললেন সেরিব্রাল স্ট্রোক এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করার উপদেশ দিলেন।

ট্রেন তখন ছুটছে অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে দিয়ে, পরের স্টেশন রাজামুন্দ্রি। আমরা সবাই তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। আড়াই-তিন ঘণ্টা বাদে বিশাখাপত্তনম পৌঁছবে ট্রেন, ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। ডাক্তার বললেন, “সামনের স্টেশনটা যদি একদম গণ্ডগ্রাম না হয় তো আপনারা নেমে যান। ওনার ইমিডিয়েট মেডিক্যাল সাপোর্ট দরকার, একটু পরেই বমি শুরু হবে।”

আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন কামরার টিকিট এগজামিনার। বললেন, ওঁর ডিউটি শেষ হবে রাজামুন্দ্রিতেই। ওঁর উপর ভরসা করে আমরাও চটপট রেডি হয়ে নিলাম, বাবাকে নিয়ে নামার জন্য। ট্রেন থেকে নামার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্ট্রেচার এসে গেল, কয়েকজন কুলি ওঁকে নিয়ে লাইন পেরিয়ে চলে চলে এল স্টেশনের বাইরে। আমরা অন্য কুলির মাথায় লাগেজ চাপিয়ে বাইরে আসতে আসতে সেই টিকিট এগজামিনার চলে এলেন আমাদের কাছে। রাজামুন্দ্রি অবশ্যই গণ্ডগ্রাম নয়, তবে যথেষ্ট ছোট জায়গা। সাধারণ লোক হিন্দি বা ইংরেজি বিশেষ বোঝে না। সেই অচেনা বন্ধু একটি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করলেন এবং ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বলে দিলেন কোথায় কোন হাসপাতালে যেতে হবে। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দেবার আগেই তিনি স্কুটার নিয়ে উধাও। শ্বশুরমশাই ততক্ষনে বমি করা শুরু করেছেন। আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছলাম। ট্যাক্সি থেকে ওঁকে ধরে ধরে নামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ড্রাইভার ছাড়াও আরো একটি অচেনা হাত আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। দেখলাম সেই টিকিট এগজামিনার।

যাই হোক, বাবাকে ভর্তি করা হল, এবং ভদ্রলোক আমাদের বললেন যে আমার শাশুড়ি, স্ত্রী এবং ছোট্ট মেয়েটা যদি চায় তো ওঁর বাড়িতে গিয়ে রাতটা আশ্রয় নিতে পারে। আমরা অবশ্য রাজি হইনি, সবাই মিলে হাসপাতালে ওয়েটিং এরিয়াতে বসেই রাতটা কাটিয়ে দেব ঠিক করলাম। একটু পরেই বাবাকে হাসপাতাল থেকে সিটি স্ক্যান করতে নিয়ে যেতে হল বাইরে। যতক্ষণ স্ক্যান চলছে তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় পরিচয় করার সুযোগটা পেলাম। ওঁর নাম শ্রীনিবাস, রাজামুন্দ্রিতেই বাড়ি, স্ত্রীর নামে ইনসিওরেন্সের এজেন্সিও আছে। আমায় বললেন, পরদিন এলআইসির গেস্ট হাউসে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করবেন যতদিন না বাবা সুস্থ হচ্ছেন। সেই সঙ্গে আমার কাছ থেকে আমাদের ট্রেনের টিকিটগুলো চেয়ে নিলেন। বললেন, ওগুলো ব্রেক জার্নি নোটিং করিয়ে নিতে হবে।

এসব কথা তাড়াহুড়োতে আমাদের মাথায় আসেনি, আসার কথাও নয়। আরো বললেন, “বুঝতে পারছি আপনারা ট্যুর করে ফিরছেন, হাতে হয়তো খুব বেশি টাকা পয়সা নেই। যদি প্রয়োজন হয়, আমাকে বলতে দ্বিধা করবেন না।” একজন অপরিচিত মানুষের কাছে এতটা আন্তরিকতা আমি কখনোই আশা করিনি। ওঁর হাত দুটো ধরে আমি বললাম, “আপাতত প্রয়োজন নেই, আমার শ্যালককে খবর দিয়েছি, সে কলকাতা থেকে এসে পড়লে কোন অসুবিধা হবে না।”

পরদিন আমরা গেস্ট হাউসে চলে গেলাম। ওখানে থাকার ব্যবস্থা খুবই স্বাচ্ছ্যন্দপূর্ণ এবং ভাড়াও ছিল নামমাত্র। এভাবেই কেটে গেল এক সপ্তাহেরও বেশি সময়। শ্যালক এবং তার বন্ধু এসে পৌঁছনোর আগে সামান্য আর্থিক সাহায্য নিতে হয়েছিল শ্রীনিবাসের থেকে। নিজের লোকজন চলে আসার পর শ্রীনিবাসের সাহায্যের প্রয়োজন কিছুটা কমে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর নিয়মিত আমাদের সঙ্গে দেখা করা আর বাবার খবর নেওয়া কমেনি মোটেই। নিয়ম করে প্রতিদিন দুবেলা আসতে ভুলতেন না। বাবার অবস্থা একটু স্থিতিশীল হলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা ঠিক করলাম যে ওঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরব। সময়টা যেহেতু পুজোর পরে পরেই, তাই হঠাৎ করে ট্রেনের রিজার্ভেশন পাওয়া এক কথায় অসম্ভব ছিল। শ্রীনিবাস‌ই ব্যবস্থা করে দিলেন ইমারজেন্সি কোটায় দুটো টিকিট। কিন্তু বাবাকে নিয়ে আমরা ছয় জন, এবং আমার চার বছরের ছোট্ট মেয়ে। তাই শুধু টিকিট করে দেওয়াই নয়, আমাদের সঙ্গে ট্রেনে উঠে বাকি যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে যতটা সম্ভব ব্যবস্থা করে দিলেন শ্রীনিবাস। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, কথার মাঝপথেই দৌড়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে চলে গেলেন সেই অচেনা অজানা মানুষটি। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দীর্ঘদেহী মানুষটা ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে হাতের ইশারা করে দেখাচ্ছেন ফোন করার ভঙ্গিমা।

ফিরে আসার পর ফোনে কথা হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তারপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, ফোন বদল করতে করতে কখন যে হারিয়ে গেছে তাঁর নাম্বার, খেয়াল করিনি। কিন্তু নাই বা থাকল যোগাযোগ, নাই বা র‌ইল আবার দেখা হ‌ওয়ার সুযোগ, এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে যে জীবনে কয়েকদিনের জন্য‌ও আসতে পেরেছিলাম, এটা হয়তো আমার অন্য কোনো জন্মের কোনো পুণ্যের আশীর্বাদ স্বরূপ। আমরা আজও কেউ সেই দেবদূতসম অচেনা অজানা বন্ধুটিকে ভুলতে পারিনি। এরকম মানুষ সত্যিই বিরল। আমি নিশ্চিত, আজ‌ও হয়তো বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদে পড়া কোনো অচেনা মানুষের কাছে তাঁর অযাচিত সাহায্যের লম্বা হাত ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাচ্ছে বন্ধুর রূপ ধরে। এই অন্যরকম মানুষগুলো আছেন বলেই হয়তো পৃথিবীটা আজ‌ও ঘুরে চলেছে তার কক্ষপথ ধরে।

অরিন্দম ঘোষের জন্ম এবং পড়াশোনা চন্দননগরে হলেও পরবর্তীতে শিলিগুড়ির বাসিন্দা। তবে কর্মসূত্রে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন, বিগত দশ বছর ভুটানের কলেজে অধ্যাপনা করছেন। বাণিজ্য নিয়ে পড়াশোনা ও কর্মজীবন, কিন্তু সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সেই ভালোবাসার কারণে টুকটাক লেখালেখি আর ব‌ই পড়া নিয়েই থাকেন। লিখতে ভালবাসেন ছড়া ও ছোটগল্প।

5 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Somnath Chaudhuri , July 17, 2021 @ 4:09 pm

    Chokher samne puro chobi r moto dekhlam.
    Golper seshe, Bhodroloker ingite phone korar drisotao jno train er janla diye dekhchi mone holo. Lekhok er munsianai ebong sabolil lekhoni te ek adbhut bhalo lagar amej sristi korlo.
    Aro mon bhalo kora golper opekhai thakbo….
    Bhalo Thakben….

  • Arindam Ghosh , July 17, 2021 @ 5:03 pm

    এটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। যদিও নামের মধ্যে ‘গল্প’ কথাটা রয়েছে, কিন্তু একটুকু রং চড়ানো নেই। এত বছর পরও ঘটনাগুলো হুবহু মনে আছে। শ্রীনিবাসের মতো মানুষ আর একজন‌ও দেখিনি এখনও পর্যন্ত।

  • Shawkat Ali , July 25, 2021 @ 3:21 am

    চোখ ভিজে গেল।

  • Khosru , July 30, 2021 @ 8:00 am

    Godliness is the name of humanity in another form. Gautam Buddha resides within us all which however nourishes itself in some of us.
    on 30.07.2021. N14.

    • অরিন্দম ঘোষ , July 30, 2021 @ 2:30 pm

      Absolutely true.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *