কিছু স্মৃতি – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
২০২০ আর ’২১ আমাদের জীবনে বহু ক্ষতি বয়ে এনেছে – তার মধ্যে একটি হল কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণ। জীবনে ৭৭টি বছর পার হয়ে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু শেষে শরীর সহযোগিতা করল না। জুন মাসের ১০ তারিখে ঘুমের মধ্যে পৃথিবীকে বিদায় জানালেন। বিদায় জানালেন তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, আর অসংখ্য গুণগ্রাহীকে।
বুদ্ধদেব কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে – কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সরে গেছেন চলচ্চিত্র তৈরির কাজে। ১৯৬৮তে একটা দশ মিনিটের ডক্যুমেন্টারি দিয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল, আর তার দশ বছর বাদে প্রকাশ পেয়েছিল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, ‘দূরত্ব।’ এর পর থেকে একে একে পরিচালনা করেছেন ‘নিম অন্নপূর্ণা,’ ‘গৃহযুদ্ধ,’ ‘ফেরা,’ ‘বাঘ বাহাদুর,’ ‘তাহাদের কথা,’ ‘উত্তরা,’ ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান,’ আরও কত ছবি। ১৯৮৪ সালে নক্সালবাড়ি আন্দোলনকে নিয়ে তৈরি করেন হিন্দি ছবি, ‘অন্ধি গলি’ আর তারপর ‘আনোয়ার কা অজিব কিসসা’ (২০১৩)। এছাড়া টেলিভিসনের জন্যে তথ্যকেন্দ্রিক ও স্বল্পদৈর্ঘের ছবিও করেছেন বেশ কিছু। বিদেশে পুরষ্কার পেয়েছেন – গ্রিসে ‘গোল্ডেন অ্যাথিনা’ (২০০৭) আর মাদ্রিদে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ (২০০৮)। তাঁর একাধিক ছবি বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। ভারতে বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে ‘দূরত্ব,’ ‘বাঘ বাহাদুর,’ ‘চরাচর,’ ‘লাল দরজা,’ ‘মন্দমেয়ের উপাখ্যান,’ আর ‘কালপুরুষ।’ শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্যে পুরষ্কার পেয়েছে ‘উত্তরা’ আর ‘স্বপ্নের দিন।’ এছাড়াও পেয়েছেন দেশে বিদেশে আরও অনেক পুরষ্কার।
চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি বুদ্ধদেব ছিলেন কবি। বেশ কিছু কবিতার বই লিখেছিলেন। একবার নিজের হাতে সই করে আমাকে একটা কবিতার বই দিয়েছিলেন। সেই কথা একটু বলি।
১৯৮৩ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাড়ি গিয়েছিলাম সাক্ষাৎকার নিতে। তখন তাঁর পরিচালক জীবনের প্রথম পর্যায় – তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করে বাঙালি দর্শকমহলে হই চই ফেলে দিয়েছেন। দক্ষ পরিচালক বলে খ্যাতি পাচ্ছেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম নারী সম্পর্কিত কেমন ভাবনা উনি সমাজকে উপহার দিচ্ছেন? মেয়েদের সম্পর্কে কোন সত্য লোকচক্ষে তুলে ধরছেন? মেয়েরা তাঁর ছবিতে কী আশা করতে পারে?
গম্ভীর মানুষ, কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর উৎসাহভরে আমার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টা দুই এই নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁর মতে ভারতবর্ষে নারীকে মাতৃরূপে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে। এই দমনের সত্যি কি কোনো প্রয়োজন আছে? যা স্বাভাবিক তা পুরুষ এবং নারী, দু’জনের জীবনেই ঘটবে। কিন্তু নারীর জীবনে মাতৃত্বই একমাত্র এবং মুখ্য ভূমিকা মেনে নেওয়ার কারণ নেই। মাতৃত্ব গৌরবের হতে পারে কিন্তু এর মধ্যে কোনো স্বর্গীয় মূল্য লুকোনো নেই। কেউ যদি এই ভূমিকা না চায় তাহলে তা বিকৃত ইচ্ছা ভাবব কেন! সেই সঙ্গে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘এই কঠিন সামাজিক নির্দেশনামা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সমাজ বিশ্বাস করে মাতৃত্বের পূর্ণ বিকাশ একমাত্র জৈবিক সন্তানের ফলেই সম্ভব। দত্তক সন্তান আজকের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এই ভারতীয় সমাজেই প্রাচীনকালে শুধু দত্তক নয়, ক্ষেত্রজ সন্তানেরও প্রচলন ছিল।’[i] শুধু এই একটি মন্তব্যেই বোঝা যায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নারী ও তার সামাজিক ভূমিকা নিয়ে কতটা প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী ছিলেন।
সেদিন শুধু গ্রাম্ভারী আলোচনা হয়নি, সেই সাক্ষাৎকারের সময় একটি মজার ঘটনাও ঘটে।
কথা বলার মাঝখানেই বেশ কয়েকবার ফোন এল। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই বুদ্ধদেব ফোন ধরে দু’একটা কথা বলে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। একজনের ফোন রেখে হঠাৎ উনি প্রাণখোলা হাসলেন। “এক বন্ধু ফোন করেছিল। কী বলল জানেন?”
ওঁর ফোন আমি কী করে জানব!
“বলল, ‘বুদ্ধদেবদা, শুনলাম চোখ নাকি কানে গেছে?’”
আরেক দফা হাসি।
আসলে সেইদিন ঘোষণা করা হয়েছিল, পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ছবি ‘চোখ’ কান চলচ্চিত্র উৎসবের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে।
একজন অমায়িক, ভদ্র, আন্তরিক মানুষকে কিছুক্ষণের জন্যে চিনেছিলাম। এক চিন্তাশীল, বুদ্ধিদীপ্ত, কুশলী চলচ্চিত্রকারকে পৃথিবী হারাল।
——–
[i] বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি ‘আন্তরিক’ পত্রিকায় ‘তিন চলচ্চিত্র পরিচালিকের চোখে নারী’ শীর্ষকে প্রকাশিত হয়েছিল।