বধ্যভূমিতে একা

বধ্যভূমিতে একা

সাহসিনী একা

সাহসিনী শব্দের ব্যাপ্তি কতো বড়ো, এর পরিমাপ করা দুঃসাধ্য! ছোটবেলা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত যে নীরব সোচ্চার সাহসিনীদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তা বলে শেষ করা যায় না! মেয়েদের সাহসের অভাব নেই। গল্প-ইতিহাস-উপন্যাসের চরিত্র নয় বাদই থাকলো।

রিপাবলিক টিভির যে মেয়েটি পোল্যান্ডের বর্ডার থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধের বিবরণ দিচ্ছিল, যাই বলুন, আমার তাকে খুব সাহসিনীই লেগেছে। অনেকদিন বাদে মনে হল, ‘নাহ, জার্নালিজম বিষয়টা তাহলে বেঁচে উঠল কালবৈশাখী পেরিয়ে।’ কাশ্মীর ফাইলস দেখার পর জে-ইউ’র নিবেদিতা মেননের চরিত্রটাকে খুব অদ্ভুত লেগেছিল। হ্যাঁ, নেগেটিভ শেডস কিন্তু সাহসিনী না হলে একটা নেগেটিভ আইডিওলজি কী ভাবে তামাম মেধাবী ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পুঁতলেন! সাহসের গায়ে কিন্তু সাদা এবং কালো, দুটো রঙ লাগা থাকে। তাই না? কী সাহস! বললেই আগে ভুরুটা কুঁচকায়! আমাদের ছোটোবেলায় ডিটো সিমি গারেওয়াল, সিন্ধু মাসি যখন বিড়ি ধরাতো, মা, কাকিমাদের এমনিই ভুরু দেখতাম, ‘কী সাহস!’ এখন দেখলে বলতাম মা’কে, ‘খাবার জিনিস, খেয়েছে! বকো কেন!’ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে প্রকাশ্যে বিড়ি ধরানো সহজ ছিল না কিন্তু! সিন্ধুমাসি অক্লেশে বলতো, ‘তোমরাও তো পান জুর্দা খাউ, উটা ন্যাশা লয়!’ অকাট্য যুক্তি। যাই হোক, বুকের পাটা ছিল।

আমার দেখা সেরা সাহসিনী রুমু বউদি। মফস্বলের অখ্যাত মহিলা, যিনি এই মুহূর্তে পৃথিবীতেই নেই। আমার কন্যা আর বউদির ছেলে সামান্য ছোটো বড়ো ছিল এক স্কুলে। ছুটির পর বউদি প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসতেন ছেলে নিতে, রোজই দেরি, ছেলের কান্নাকাটি। আমি দেখতাম দিদির হাতে লাগা হলুদ, চুলে গুড়ো গুড়ো নুন। বুঝতাম বাড়িতে পরিস্থিতি ঠিক নয়। শাশুড়ি, স্বামী, সবই চাপের! এদিকে স্বামী জেলা কাঁপানো চিকিৎসক, কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা! দিদির সবুজ শিরা বের করা হাত আর ঠোঁটের উপরের তিলটি খুব মনে পড়ে।

ছেলে ছোটো, মেয়ে বড়ো। ছুটির সময় আলাদা। এরকম দেখে ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আমিই অপেক্ষা করতাম। দিদির চোখে কৃতজ্ঞতা আজও মনে আছে। কানাঘুষোয় অনেক কথাই কানে আসত। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে তো বটেই, মফঃস্বল এতো স্মার্ট ছিল না! কর্তাকে চেপে ধরতে শুনলাম, ওঁর স্বামী অন্য দিকে আসক্ত এদিকে শাশুড়ির ব্যবহার আরো অসহ্য! এই ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল আর দিদির চোখের কোণে জমছিল গাঢ থেকে গাঢতর কালি! কিন্তু দিদির চোখে অসহায়তা দেখিনি। রোগা পাতলা চেহারায় কী এক সেল্ফ ডিটারমিনেশন কাজ করত। ক্লাস ফাইভে ছেলেটিকে পরিবারের সবার সঙ্গে যুদ্ধ করে বোর্ডিং-এ দিল দিদি। আমাকে শুধু বলেছিলেন, ‘আর কোনো উপায় দেখছি না, রে! দূরে গেলেই মানুষ হবে। পাকাপাকি বন্দোবস্ত করলাম।’

স্কুল ছাড়ার পর, আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেল। তার বছর তিনেক বাদে রুমিদি এক রাতে সুইসাইড করল গায়ে আগুন দিয়ে। দুই সন্তানই তখন বোর্ডিংয়ে। সেই সময় বিস্তর কাটা ছেঁড়া চলেছিল। আসল গল্প সেখান থেকেই শুরু। জেলা শহরে নামি লোকের স্ত্রীর আত্মহত্যা, তার সঙ্গে বেরিয়ে এলো আরো নানান বিশিষ্ট লোকের যোগ, সদর হাসপাতালের চক্র, চাকরিতে ট্রান্সফার – সোজা কথায় ক্ষমতার জঘন্য অপব্যবহার!

মাতব্বর স্বামীর আর উপায় ছিল না। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোটে সব লিখে গিয়েছিল দিদি। নোট পাঠিয়েছিলেন সব বড় বড় অর্গানাইজেশনে। হ্যান্ড পোস্ট! ছেলেমেয়ের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘বড় হলে বুঝবি, শিকড় তুলে টান দিতে হলে কাউকে না কাউকে স্যাক্রিফাইস করতেই হয়!’

উনি আর ফেরেননি, কিন্তু স্বামীকে পথে বসাতে পেরেছিলেন! সব কী ধামাচাপা পড়ে! সেই অবৈধ সম্পর্ক, চাকরি, প্রাকটিস, রবরবা, তলানিতে এসে ঠেকল। একজন চিকিৎসকের জীবনে রেপুটেশনই সব! ডিগ্রি টিগ্রি বলি বটে, কিন্তু যশ বিনা শূন্য! দিদি চলে গিয়ে আসল জায়গায় নিঃস্ব করে গেল স্বামীকে। উনি কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারলেন না!

অনেকেই বলবেন মৃত্যু আবার কিসের সাহস! এ তো কাপুরুষের কাজ! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে একজন ডিপেন্ডেন্ট মহিলা দুই বাচ্চাসহ সহজে বেরিয়ে যেতে পারত না। অবশ্য এখনো পারে না। দিদি বুঝেছিল মনে হয়, যে সিস্টেমে বসে লোকটা সব চালাচ্ছে সেটাতে চরম আঘাত ছাড়া উপায় নেই! মারা অথবা মরা।

আত্মহত্যা কাপুরুষোচিত, শব্দটি ক্লিশে হয়ে গেছে। ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে যে গুলি খায় সে বীর, তবু সে নিজে ট্রিগার দাবায় না! তাহলে নিজের হাতে নিজেকে শেষ করা কী করে কাপুরুষোচিত হয় বলুন তো! দুটি সন্তানকে রেখে নিজের গায়ে পেট্রল ঢালার যে কষ্ট একজন মা হয়তো বুঝবেন – কিন্তু সেই সময়ে শাস্তি দেবার জন্য এই সাহসটা ছাড়া আর কোন উপায় নিশ্চয়ই ছিল না। উনি বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি৷ মরে শাস্তি দিয়েছিলেন। থানা, পুলিশ, হাজতবাস! অনেক দূরে বদলি হতে হলো। সিস্টেমকেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। বহুজন সমঝে গেছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহার। হিস্ট্রি রিপিটস, বুঝেছিলেন কেউ কেউ! নারীদের লড়াই সবই কী মহিমার আত্মত্যাগের! সময় পাল্টেছে, ধরন বদলেছে।

রুমিদির ছেলে মেয়ে এখন দুজনেই ডাক্তার। রুমিদির সেই তিলটা এখন মেয়ের ঠোঁটে…। রুমিদি মুছে যাননি। সবাই এখনো বলি – ‘রুমি চলে গেছে বটে, কিন্তু চরম শাস্তি দিয়ে গেছিল। সাহস বটে মেয়েটার!’

কতজন পারে! প্রতিবাদ বৃহত্তর ত্যাগ ছাড়া আসে কি?

———-

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আন্তর্জাল 

শুভশ্রী সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। লেখালেখি বরাবরের পছন্দ, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর গল্প, কবিতা, মুক্তগদ্য এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই 'আমি সে ও সখা', লিখেছেন যৌথভাবে। একক বইটি মুক্তগদ্য সংকলন, 'ফেরিঘাটে একা'। এছাড়াও বইমেলা ২০২২তে প্রকাশিত হয়েছে অণু গল্প সংকলন, 'মায়াগাছ'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *