প্রবাসীর বাঙালিয়ানা
আমার শাশুড়িমা ছিলেন রন্ধনে সাক্ষাৎ দ্রৌপদীসমা। সারাজীবন ধরিয়া তিনি নানাবিধ ব্যঞ্জন রাঁধিয়া নিজের সন্তানদের জিহ্বাকে এতটাই ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন যে সাধারণ ব্যঞ্জনে তাহাদের আর কিছুতেই মন উঠিত না! বিশেষ করিয়া শাশুড়িমায়ের মধ্যম পুত্র মানে আমার কর্তামশাইটি স্বাদের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ বা উত্তম খাদ্যশিল্পী বলিয়া খ্যাত । ইহার পিছনে সঙ্গত কিছু কারণও আছে। প্রথম জীবনে তিনি কোম্পানির টাউনশিপের কোয়ার্টারে থাকিতেন। সেখানকার অফিসার্স ক্লাবে নিত্য নানাবিধ পার্টি লাগিয়াই থাকিত। বিশেষ বিশেষ অফিশিয়াল পার্টিতে হেড অফিস হইতে বড় বড় পদাধিকারীদের সমাগম হইত। ক্লাবের বাবুর্চিরা সযত্নে, অতিরিক্ত মনযোগ সহকারে নানাবিধ সুস্বাদু ব্যঞ্জন রাঁধিত। রান্না তো হইল কিন্তু প্রজেক্ট হেডের শিরঃপীড়া তাহাতেও দূর হইত না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার বিশেষ অনুরোধে রায়সাহেব প্রতিটি পদ চাখিয়া সার্টিফাই না করিতেন তিনি শান্তি পাইতেন না। কিছু ত্রুটি থাকিলে তাহাও দ্রুত রেক্টিফাই করিবার উপায় তিনি বলিয়া দিতেন। সকলেই তাঁহার সুচিন্তিত মতামতে চমৎকৃত হইত। ইহার ফলে ধীরে ধীরে রায়সাহেব ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে খাদ্যবিশেষজ্ঞের শিরোপা অর্জন করিয়াছিলেন।
রায়সাহেবের জীবনে সুখাদ্য গ্রহণ ছাড়া আর বিশেষ কোনো শখ-আহ্লাদ নাই। ছুটির দিনগুলিতে তিনি খাদ্য-অভিযানে বাহির হন। অভিযান কথাটি সাধারণত বড় বড় বিষয়ে ব্যবহৃত হয়, যেমন মেরু অভিযান, সমুদ্র অভিযান, পর্বত অভিযান— কিন্তু আমার কর্তার অভিধানে অভিযানের অর্থই হইল কোথায় কোথায় নতুন নতুন খাদ্য বা সর্বোত্তম খাদ্যটির সন্ধান মিলিবে ! অতঃপর তিনি দ্রুত অকুস্থলে গিয়া সেগুলিকে প্রথমে করায়ত্ত পরে উদরস্থ করিবেন! খাদ্য সম্পর্কিত যেকোনো সন্দেশটি একবার তাঁহার কর্ণকুহর দিয়া মরমের মধ্যে প্রবেশ করিলেই হইল! সিধা অভ্যন্তরে ঢুকিয়া সন্দেশটি কুহুতান তুলিতে থাকে, ‘সখা জাগো, জাগো ! অমনি তিনি চারশো চল্লিশ ভোল্ট লাগা যন্ত্রের মত সেইদিকে দ্রুত ধাবিত হন। এই ব্যাপারে কিছু বলিতে ইচ্ছা করিতেছে, শ্বশুরালয় বহরমপুর হইতে ফিরিবার সময় নবপরিণীতা পত্নীকে মালপত্র-সহ বাসে রাখিয়া দিয়া তিনি কৃষ্ণনগরের অথেনটিক সরভাজা, সরপুরিয়ার দোকানের সন্ধানে চলিয়া গিয়াছিলেন। আমরা যে অঞ্চলে থাকিতাম তথায় মোবাইল টাওয়ার না থাকায় ২০০৩-এর পূর্বে আমাদের নিকট মোবাইল ফোন ছিল না। অতএব কলিকাতার পিত্রালয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তাঁহার কোনো খবরও পাই নাই।
একইভাবে তিনি পুরী যাইয়া অথেনটিক খাজার সন্ধানে কাকাতুয়ার খোঁজ করেন। উত্তর কলিকাতা হইল বাঙালি খাবারের পীঠস্থান। বিবাহের পরে সময় ও সুযোগ পাইলেই তিনি পত্নী-সহ গোলাবাড়ির মাংস, বসন্ত কেবিনের কবিরাজি কাটলেট, দিলখুশা হইতে শুরু করিয়া, প্যারামাউন্টের নানাবিধ শরবত এবং মিষ্টির মধ্যে নকুড়, ভীমনাগ কিছুই বাকি রাখেন নাই। যতই তাঁহাকে বুঝানো হউক না কেন দক্ষিণ কলিকাতাতেও ইহাদের শাখা আছে! তিনি উচ্চমার্গের হাসি হাসিয়া বলিতেন, “ওগুলো সব ফ্রাঞ্চাইজি, আসল দোকানের সামনে এরা নস্যি।!”
চেনা-অচেনা কেহ একবার তাহার সামনে একটি কোনো রেস্টুরেন্টের সুখ্যাতি করিলেই হইল, তিনি অমনি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতে সেইসব রেস্টুরেন্টের গুণাগুণ যাচাই করিতে বাহির হইয়া পড়িবেন! কিছু কিছু কার্য আছে যাহা একা করিতে কাহারও মন চাহে না যেমন একা-একা কেহ সিনেমা দেখিতে যাইতে পছন্দ করিবে না তেমনই একাকী রেস্টুরেন্টে গিয়া খাদ্যগ্রহণও চূড়ান্ত অরসিকের পক্ষেই সম্ভব!
আমাদের একমাত্র পুত্রটিও পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে অত্যন্ত ফুডি হইয়া উঠিয়াছে কিন্তু রুচির ব্যাপারে পুত্র ও পিতার তালিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পিতা কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী কিন্তু পুত্রের কোয়ালিটির সহিত কোয়ান্টিটিও প্রয়োজন। পিতার মতে বাঙালিদের রান্নাই হইল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রান্না। অবশ্য তিনি সর্বপ্রকার খাদ্যেরই রস গ্রহণ করেন কিন্তু মনের তারটি বাঁধা থাকে বাঙালিয়ানায়! এদিকে আশৈশব প্রবাসে প্রতিপালিত পুত্রটির বাঙালিয়ানা লইয়া কোনো নস্টালজিয়া নাই।তাহার পছন্দ স্থির নহে। সে অবলীলায় আজ মেক্সিকান তো আগামীকাল ইটালিয়ান, তাহার পরের দিন থাই খাবারের অনুরাগী হইয়া যায়। তাহার পিতার মতে এগুলি অস্থির চিত্ততার লক্ষণ। খাদ্যের বিষয়ে পিতার সহিত বনিবনা না হইবার হেতু সে পিতার অভিযানের সঙ্গী হইতে চাহে না। অতঃপর ‘ছাই ফেলিতে ভাঙা কুলা ‘ আমাকেই সঙ্গী হইতে হয়। পুত্রের পছন্দসই খাদ্য সরবরাহের ভার জ্যোমাটো, সুইগির উপর ছাড়িয়া দিয়া তিনি আমাকে লহিয়া বাহির হইয়া পড়েন। অবশ্য মাঝেমধ্যে দায় দফাই পড়িয়া পুত্রকেও তৈল মর্দন করিয়া সঙ্গী করিতে হয়।
যেমন কয়েকদিন পূর্বেই আমরা গিয়াছিলাম পুরাতন দিল্লির একটি নামকরা রেস্টুরেন্টে। প্রবেশ-মুখেই উর্দিপরা পাহারাদার আমাদের আটকাইল। আগে হইতে টেবিল বুক না করিলে ওই রেস্টুরেন্টে এন্ট্রি মিলিবে না। রায়সাহেব অবশ্য পূর্বেই সকল ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন। ভিতরে প্রবেশ করিয়া মনে হইল কোনো মন্ত্রবলে আঠারো শতকের কোনো সুলতানের প্রাসাদে আসিয়াছি। রেস্টুরেন্টের ভিতরে এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি বাতাবরণ, পা ডুবিয়া যায় এমন গালিচা, উপর হইতে ঝুলিতেছে ঝাড়বাতি, মৃদুসুরে গজলের ধুন চলিতেছে। রেস্টুরেন্টে রহিয়াছে দুই প্রকার বসিবার ব্যবস্থা। ঘেরা ছোট ছোট কিউবকেলে তাকিয়া ঠেস দিয়া মাটিতে বসিয়া নীচু টেবিলে দস্তান বিছাইয়া মুসলমানি কায়দায় খাওয়াদাওয়া আর একদিকে চেয়ার-টেবিল পাতা।
ওয়েটাররা সবাই ইন্ডিয়ার মহারাজার মত শেরওয়ানি পরিয়াছে আর তাহাদের কথাবার্তাও উর্দুঘেঁষা পুরোনো হিন্দি। এই রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানির প্রশংসা শুনিয়াই রায়সাহেব ওখানে গিয়াছিলেন । এদিকে বিরিয়ানি জিনিসটাকেই আমার ওভার হাইপড বলিয়া মনে হয়। মানুষ যে কেন বিরিয়ানি খাইয়া আত্মহারা হয় তাহা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিছুতেই প্রবেশ করে না। আমি বাঙালির মিষ্টি পোলাও অথবা ফ্রায়েড রাইসের ভক্ত।
বসিবা মাত্র ওয়েটার আসিয়া আমাদের জিজ্ঞসা করিল যে আমরা ওয়েলকাম ড্রিংক কী নিব? আমার অল টাইম ফেবারিট হইল গন্ধরাজ লেবু দিয়া ঘোলের শরবত বা আমপোড়ার শরবত কিন্তু ওখানে শিকঞ্জি আর রু-আফজা দিয়া কিছু ফ্রুট মকটেল ছাড়া কিছু নাই ( হার্ড ড্রিংক অবশ্য ছিল) দেখিয়া আমরা সরাসরি স্টার্টারে চলিয়া গেলাম। গরম গরম ফিশ ফ্রাই উইথ মাস্টার্ড সস দিয়া খাওয়া শুরু হইল।
এই রেস্টুরেন্টের খবর দিয়াছিল কর্তার অফিসেরই এক ছোকরা। তাহার মতে রাজধানীতে বসিয়া আসল হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির স্বাদ লইতে হইলে অবশ্যই এখানে আসিতে হইবে, উপরন্তু ইহাদের একটি থালিতেই পরিবারের সকলের পেটপূজা হইয়া যায় বলিয়া রেস্টুরেন্টটি পকেট ফ্রেন্ডলিও বটে। পরিমাণে বেশি দেয় এবং আমরা দু’জনেই স্বল্পভূক বলিয়া পুত্রের পিছনে তৈলমর্দন করিয়া উহাকে সঙ্গে আনা হইয়াছে। তবুও তিনজনের জন্য একটি থালি অর্ডার দিতে লজ্জা লাগিতেছিল। সেইকারণে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “একই কাফি!” আশ্বস্ত হইয়া আমরা শেষ পর্যন্ত তিনজনের জন্য একটাই বিরিয়ানির অর্ডার দিয়াছিলাম।
খানিকক্ষণ পর ওয়েটার যে বস্তুটি লইয়া আমাদের টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল সেটি দেখিয়া আমার ভিতরে থরহরি কম্প শুরু হইল। একটি তিন ফুট ব্যাসের কানা উঁচু ঝকঝকে পিতলের পরাতে ভরিয়া বিরিয়ানি আর বিরিয়ানির উপর শোভা পাইতেছে একটি বৃহৎ মাংসখণ্ড। মাংসখণ্ড দেখিয়া হৃৎকম্প হইবে না এমন সাহসী বীরপুরুষ বিরল! ইহাই বোধহয় ‘দেশে বিদেশে ‘ তে আলী সাহেব বর্ণিত আস্ত দুম্বার রোস্ট। ভীত হইয়া প্রশ্ন করায় ওয়েটার মৃদু হাসিয়া জানাইলেন যে, ‘পুরা রান ( পাঁঠার পিছনের পা) দিয়াছি !’ তাও ভালো, আমি এযাবৎকালের মধ্যে এতবড় মাংসের টুকরা কখনো কোথাও দেখি নাই। বকরাক্ষস ব্যতীত এই বস্তুটি কাহারও পক্ষে গলাধঃকরণ করা অসম্ভব!
বিরিয়ানির সঙ্গে রায়তা দেয় নাই , শুধু দু’টি ক্ষুদ্র বাটিতে লাল আর কমলা রঙের বিশুদ্ধ জল। পুরা টেবিল খালি করিয়া মায় নুন-মরিচদান পর্যন্ত সরাইয়া পরাত রাখা হইয়াছে। টেবিলে আর কিছু অর্থাৎ প্লেট রাখিবার জায়গা পর্যন্ত নাই। তিন ফুট ব্যাসের পরাত হইতে খাবার তুলিয়া নেওয়ার জন্য দু’টো রাক্ষস সাইজের হাতা থুড়ি সার্ভিং স্পুন দিয়াছে। ওয়েটার পরাত রাখিয়াই কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেলেন তাহা খুদাই মালুম! শেষে ‘আপনা হাত জগন্নাথ ‘ ভাবিয়া নিজেই সার্ভ করিলাম ।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে আমি একজন অলমোস্ট ভেজেটেরিয়ান। অন্যের সাথ দিবার জন্য অল্পস্বল্প অবশ্য খাই। বৃহৎ মাংসখণ্ড দেখিয়া আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন করিতেছিল। একটি হিন্দি মুভিতে দেখিয়াছিলাম নিরামিষাশী নায়িকার সঙ্গে ডেটে গিয়াছিলেন নায়ক। বিশাল লবস্টার, টার্কি রোস্ট, আস্ত রোহিত মৎসের কিছু একটা দেখিয়া টেবিলের ভোজ্য বস্তুর উপরই বমি করিয়া দিয়াছিলেন নায়িকা। আমিও যদি এইরকম কিছু করিয়া বসি এই ভয়ে না-খাইয়া, খাওয়ার অভিনয় করিতেছিলাম।
তাও সামান্য বিরিয়ানির ভাতই লইলাম। প্রচুর ঘি ও মশলা দিয়া তৈয়ারি বিরিয়ানি তবুও কেমন যেন শুষ্ক লাগিল। তাহার উপর বিরিয়ানিতে ঢালাও ক্যাওড়া আর আতর দিয়াছে যাহার গন্ধে মাথা ধরিয়া যায়! কর্তাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম লাল আর কমলা রঙের বিস্বাদ জল দুইটি হইল রসম। বিরিয়ানির সঙ্গে রায়তা না দিলে আমার কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে! রায়সাহেব যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত বিশাল হাঁক-ডাক পাড়িতেছিলেন তিনিও ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গিয়াছেন, ফলে তিনিও যৎসামান্যই নিলেন। খাদ্যবীর বলিয়া পুত্রকে পটিয়ে পাটিয়ে সঙ্গে লওয়া হইয়াছিল, সে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও বক রাক্ষসের থালার ওয়ান থার্ডও শেষ করিতে পারিল না। কার্ড সোয়াইপ করিতে আসিয়া ওয়েটার দুঃখ দুঃখ গলায় জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘ প্যাক কর দুঁ? ‘বাপ রে! এখনই খাইতে পারিলাম না আবার এটিকে গৃহে লইয়া যাইব! রীতিমতো ভয় পাইয়া আমরা তিনজন একইসঙ্গে কোরাসে চ্যাঁচাইলাম, ‘নহী-ই -ই!’
ফিরিবার সময় গাড়িতে পুত্র পিতাকে অম্ল-মধুর কিছু শুনাইতেছিল। বেচারিকে দোষ দেওয়া যায় না। সে আসিতে চাহে নাই। জবরদস্তি করিয়া আমরাই তাহাকে টানিয়া আনিয়াছি ফলে তাহার রবিবারের মধ্যাহ্নভোজটি মাটি হইয়া গিয়াছে। সে বলিতেছিল, ‘ লোকের কথায় নাচিয়া এইসব এক্সপেরিমেন্ট করিবার কী প্রয়োজন?’ রায়সাহেব অবশ্য তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া পাথরের মতো মুখ করিয়া গাড়ি চালাইতে লাগিলেন । একবার অবশ্য মৃদু স্বরে বলিয়াছিলেন, “গাড়ি চালাইবার সময় আমি কথাবার্তা বলা পছন্দ করি না।!উট পাহাড়ের নীচে আসিয়াছে ভাবিয়া আমি আর ছেলে উচ্চাঙ্গের হাসি হাসিয়াছিলাম।পুত্রের ক্ষোভ অবশ্য তাহাতে স্তিমিত হয় নাই। সে আরও কিছু বলিলে রায়সাহেব মরিয়া হইয়া একটি বোমা ফাটাইলেন, “বাইরের লোকের কথা নাহয় বাদ দেওয়া যায় কিন্তু এই ব্যাপারে তোমার জননীও ভুলভাল ইনফরমেশন দিতে কম যান না!”
অভিযোগ অস্বীকার করিতে পারি না অতএব আমি নীরব হইলাম।ব্যাপারটি হইল মাস তিনেক পূর্বে একটি জরুরি প্রয়োজনে আমি এবং আমার কর্তা কয়েকদিনের জন্য কলিকাতায় গিয়াছিলাম। প্রবাসীরা কোনো প্রয়োজনে কলিকাতায় যাইলে কাজ মিটিয়া যাইবার পর হাতে সময় থাকিলে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যান, মার্কেটিং করেন। আরও সময় পাইলে সিনেমা-থিয়েটার দেখেন কিন্তু আমার কর্তার সবই উলটোপুরাণ। তিনি কলিকাতায় গিয়া অথেনটিক বেঙ্গলি থালির খোঁজে বাহির হন। এইভাবে আমরা দক্ষিণ কলিকাতার সমস্ত নামকরা বাঙালি রেস্টুরেন্টের খাবার চাখিয়া দেখিয়াছি।
তিনি নতুন কোনো রেস্টুরেন্টের খোঁজ করিতেছেন দেখিয়া আমার মতিচ্ছন্ন হইয়াছিল। ফেসবুকের ফুড গ্রুপে একটি রেস্টুরেন্টের প্রচুর প্রশংসা পড়িয়াছিলাম। মুখ দিয়া হঠাৎই তাহার নাম বাহির হইয়া গেল। বলিবার পরেই আমি বুঝিতে পারিলাম ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় দেখাইয়া ফেলিয়াছি তাই ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে নামিয়াছিলাম কিন্তু ততক্ষণে বন্দুক হইতে গুলি বাহির হইয়া গিয়াছে। রায়সাহেব গুগুল হইতে তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হইয়া গিয়াছেন। বাড়িতে সিদ্ধ ভাত খাইয়া মুভি দেখিতে যাইব বা আত্মীয়দের সহিত সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন বলিয়াও তাহাকে নিরস্ত করা যাইল না।
রেস্টুরেন্টটি গড়িয়াহাট হইতে বেশি দূরে নহে। তবুও ট্যাক্সি চাপিয়া অকুস্থলে পৌঁছাতেই দেড়টা বাজিয়া গেল। কর্তামশাই ফোনে টেবিল বুক করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছিল যে ওইভাবে তাহারা টেবিল বুক করেন না, যে আগে আসিবে সে অগ্রাধিকার পাইবে মানে ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ! কর্তার ইচ্ছা ছিল আরও পূর্বে পৌঁছাইবার কিন্তু বারেবারে এই খাদ্যাভিযানে তিতিবিরক্ত আমার বিন্দুমাত্র যাইবার ইচ্ছা ছিল না বলিয়া ইচ্ছা করিয়াই দেরি করিয়াছিলাম।
রেস্টুরেন্টটি বড় রাস্তা হইতে একশো গজে দূরে অবস্থিত।বাহির হইতে রেস্টুরেন্টের চেহারা এবং সামনে অপেক্ষারত জনতাকে দেখিয়া বিশেষ ইমপ্রেসড না হইবারই কথা। তথাপি ফুড গ্রুপের প্রশংসা মনে করিয়া বুক বাঁধিয়াছিলাম। রেস্টুরেন্টের সামনে একটি ছোটখাটো জনারণ্য! অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম ইহারা সকলেই নাম লিখাইয়াছেন কিন্তু এখনও প্রবেশাধিকার পান নাই। রেস্টুরেন্টের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ, মাঝেমধ্যে দরজার পাশের একটি বন্ধ জানলা খুলিয়া একটি হেঁড়ে গলার বৃদ্ধ হাঁক পাড়িতেছিলেন, ‘কে কে নতুন আসিয়াছেন? নাম লিপিবদ্ধ করিতে চাহিলে সামনে আসুন।’ রায়সাহেব গিয়া নাম লিখাইয়া আসিলেন। শুনিলাম আমাদের ক্রমিক সংখ্যা ৯৯ এবং ১০০।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিবার পরে দরজা খুলিতে বুঝিতে পারিলাম প্রথম ব্যাচের খাওয়া সমাপ্ত হইয়াছে এবং তাঁহারা বাহিরে আসিতেছেন। অপেক্ষারত জনতার কেহ-কেহ অতি কৌতুহলী হইয়া বর্হিগত প্রথম ব্যাচের ধাবমান ব্যক্তিদের নিকট হইতে তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। রেস্টুরেন্টের ভিতরে বসিবার বন্দোবস্ত কেমন জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহারা বুঝিবার চেষ্টা করিতেছিলেন তাহাদের সংখ্যা আসিতে কত বিলম্ব হইবে!তালিকা হস্তে কটকটে নীল টেরিকটের পাঞ্জাবি পরিহিত একটি খর্বকায় যুবক বাহির হইয়া আসিয়া নাম হাঁকিয়া দ্বিতীয় ব্যাচকে ভিতরে যাইবার প্রবেশ অধিকার দিল।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি অনেকক্ষণ হইতেই পড়িতেছিল, এইবার প্রবল বর্ষণ শুরু হইল। অপেক্ষারত মানুষজন তৎক্ষনাৎ ফটাফট ছাতা খুলিতে শুরু করিলেন। সরু ছয়-সাত ফুটের ফুটপাতের উপর প্রায় একশোজন মানুষের ভিড়। বৃষ্টির ছাঁট হইতে বাঁচিলেও ছাতার খোঁচা খাইয়া অনেকেই ‘বাবাগো-মাগো’ রব তুলিলেন। অনেকক্ষণ ফুটপাতে দাঁড়াইয়া থাকিয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া, ছাতার খোঁচা খাইয়া রায়সাহেব অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি অস্ফুটে বলিলেন, “মনে হইতেছে এই রেস্টুরেন্টটি তেমন সরেস নহে। চল, অন্য কোথাও গিয়া খাইয়া আসি!” কিন্তু ততক্ষণে আমার জিদ চাপিয়া গিয়াছে।
এমনিতে আমি চুপচাপ থাকিতেই পছন্দ করি কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন জিদ চাপিয়া বসে তখন আমি বাপের কুপুত্র থুড়ি কন্যা হইয়া যাই। বাহিরে খাইবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না, রায়সাহেবের জিদের জন্য আসিতে হইয়াছে অতএব আমি লেডি ভীষ্ম সাজিয়া বলি, “খাইলে এইখানেই খাইব নতুবা চল বাড়ি ফিরিয়া যাই।” রায়সাহেব আবার তাহাতে রাজি নন, অতএব অন্তহীন প্রতীক্ষা চলিতেই থাকে। এদিকে এতক্ষণ দাঁড়াইয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া প্রবল ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল। ফিসফিস করিয়া সঙ্গীকে সেকথা জানাইতে চাহি কিন্তু পার্শ্ববর্তী জনতার একজন শুনিয়া ফেলেন এবং তিনিই পরামর্শ দিলেন যে আরও বহুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে কাজেই অল্পস্বল্প কিছু খাইয়া লওয়া উচিত। তাঁহারাও নাকি খানিক পূর্বে মনজিনিস হইতে খাইয়া আসিয়াছেন। আমরাও লেক ভিউতে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান হইতে বেশ কয়েকটি মিষ্টি খাইয়া আসিলাম। দাঁড়াইয়া থাকিয়া পা ব্যথা করিতেছিল তাই সামনেই একটি পার্ক দেখিয়া সেখানে গিয়া বসিলাম। কর্তা জলের বোতল কিনিতে গেলেন। আমি যেখানে বসিয়াছি তাহার সামনেই একটি বৃদ্ধ দম্পতি বসিয়াছিলেন। বৃদ্ধা নিজ হইতেই আলাপ করিলেন। শুনিলাম তাঁহারাও ওই রেস্টুরেন্টে নাম লিখাইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। তাঁহাদের ক্রমিক সংখ্যা আমাদেরও অনেক পরে। বৃদ্ধাই বলিলেন, বসিয়া বসিয়া হাওয়া খাওয়া যাক কারণ সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বে তোমরা ভিতরে ঢুকিতে পারিবে না।
আমার অবশ্য বিশ্বাস হয় নাই তাই দরজা খুলিয়া যেই সেই টেরিকটের পাঞ্জাবি বাহির হইয়াছে তৎক্ষনাৎ তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম। যুবক আমতা আমতা করিয়া জানাইল, অত দেরি নাও হইতে পারে। বিরক্ত হইয়া কিছু মানুষ অবশ্যই চলিয়া যাইবে। সত্যিই তাহাই ঘটিল। বিকেল পাঁচটায় আমরা মধ্যাহ্ন ভোজন করিতে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
আমাদের পূর্বেই ছিল একটি দল যাঁহার সদস্য সংখ্যা অন্তত এক ডজন তো হইবেই। তাহারা ঢুকিতে গিয়াও বাঁকিয়া বসিলেন। তাহাদের দাবি যে তাঁহারা শুনিয়া আসিয়াছেন রেস্টুরেন্টের নিয়ম প্রথমে বরণ করিয়া অতিথিদের প্রবেশ করানো হয়। বরণ না করায় তাহারা ‘ পাদমেকং ন গচ্ছামি ‘ মনোভাব নিয়া প্রবেশপথে স্থির হইয়া রহিলেন। তাহাদের কারণে আর কেহই ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিতেছিল না। হঠাৎ সেই দাড়িওয়ালা টেরিকটের পাঞ্জাবি বলিয়া উঠিল, বরণ করিতেই হইবে! ঠিক আছে আমিই বরণ করিয়া দিতাছি। ‘বন্ধ জানালার নীচে একটি ছোট কুলুঙ্গিতে একটা মাটির প্রদীপ টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছিল। যুবক খপ করিয়া প্রদীপ তুলিয়া তাহার হাতটিকে প্রপেলারের মত দ্বাররোধকারীদের নাকের সামনে ঘুরাইয়া দিল।অবরোধকারীরা সন্তুষ্ট হইলেন না। তাঁহাদের মধ্য হইতে রব উঠিল— দাঁড়ান দাঁড়ান সেলফি তুলছি। ফেসবুকে পোস্ট দিতে হইবে। বেচারা যুবককে আবারও রিপিট করিতে হইল।
এই ঘটনায় শ্রান্ত, ক্লান্ত, বাধাপ্রাপ্ত আমার প্রচণ্ড হাসি পাইয়াছিল। কখনো দেখা দূরে থাকুক, কানেও শুনি নাই শ্মশ্রুগুম্ফওয়ালা একটি মুষ্কো জওয়ান বরণের থালা ব্যতীত শুধু প্রদীপ ঘুরাইয়া বরণ করিতেছে। অতঃপর আমরা প্রবেশাধিকার পাইলাম। অত্যন্ত অপরিসর একটি সিঁড়ি ঘরের মধ্যে তিনটি ক্ষুদ্র টেবিল পাতিয়া দুই-দুই করিয়া ছয়জনের খাইবার বন্দোবস্ত। তাহাদের শরীরের সঙ্গে প্রায় শরীর লাগাইয়া একদলকে উপরে মূল খাইবার জায়গায় যাইতে হইবে। এছাড়া আছে মেজেনাইন ফ্লোরে মাটিতে চাদর বিছাইয়া তাহার উপর গদিতে বসিয়া সামনে জলচৌকি রাখিয়া খাইবার বন্দোবস্ত। বড় পরিবার মানে অন্তত ছয়জনের পরিবার না হইলে দোতলার চেয়ার-টেবিল পাতা ডাইনিং হলে খাওয়া যাইবে না। দুই সদস্যের পরিবারকে হয় সিঁড়ি ঘরে নয় মেজেনাইন ফ্লোরেই খাইতে হইবে।
মেজেনাইন ফ্লোরে খাইতে হইলে জুতা খোলা আবশ্যক। আমাদের পূর্বের ওই ফেসবুকে বরণ পোস্ট করিতে আগ্রহী দল ততক্ষণে সেইখানে আসন গ্রহণ করিয়া ফেলিয়াছে। বেগতিক দেখিয়া আমিও দ্রুত গিয়া একটি আসনে উপবেশন করিলাম। ঝামেলায় পড়িলেন খোদ রায়সাহেব, মেজেনাইন ফ্লোরের ছাদ অত্যন্ত নীচু, মেরেকেটে ছয়ফুটের বেশি না। জুতা খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতেই মাথায় ঠোক্কর খাইলেন। এক ডজন দলের একটি খুদে সদস্য তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “বাবারে লোকটা কী লম্বা রে! কী বলো মা, সাতফুট তো হবেই!” বলাবাহুল্য রায়সাহেব এইরূপ মন্তব্যে অত্যন্ত অপ্রসন্ন হইয়া মুখখানিকে তোলাহাঁড়ির মতো করিলেন। মুশকিল হইল, তিনি মেঝেতে বসিতেই পারিতেছিলেন না। গদি আসনের সামনে রাখা জলচৌকির সহিত গদির দূরত্ব কম। অত অপরিসর জায়গায় রায়সাহেবের পক্ষে পা মুড়িয়া উপবেশন করা কঠিন। তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠেই আমাকে বলিলেন, “তোমার চক্করে পড়ে এখানে আসিতে হইয়াছে। এইভাবে বসিয়া খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই। চল বাসায় ফিরিয়া যাই নতুবা চেয়ার টেবিলের জন্য পরের ব্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করি।”
‘পাগল না ছন্ন! এতক্ষণ বাদে সুযোগ পাইয়াছি বসিবার চক্করে আমি তাহা হারাইতে রাজি নই। অবশেষে পরিবেশনকারী এক ছোকরা ‘হেঁইয়ো হেঁইয়ো’ করিয়া সেই ভারী কাঠের জলচৌকি টানিয়া রায়সাহেবকে পা মুড়িবার সুযোগ করিয়া দিলেন। আমার এক পার্শ্বে রায়সাহেব আর এক পার্শ্বে একটি যুবক তাহার বান্ধবীকে লইয়া বসিয়াছিল। তাহারা সুদূর বারাসাত হইতে বাইকে করিয়া আসিয়াছে। শুনিলাম তাহারা ইহার পূর্বেও একবার এই রেস্তোরাঁয় আহার করিয়াছে। সেইবার তাহাদের প্রবেশের সময় ছিল সন্ধ্যা সাতটা।
আমি অবাক হইয়া বলিলাম, “বাপ রে! তাহা হইলে তোমরা সেদিন লাঞ্চের বদলে ডিনার করিয়াছিলে। এই রেস্টুরেন্টের খাওয়াদাওয়া কি এতটাই ভালো যে তোমরা তেল খরচা করিয়া অত দূর হইতে এইখানে আসিয়াছ!” ছোকরাটি বলিল, “না তা অবশ্য নয়। আমাদের লেক মলে ইভিনিং শো-এর টিকিট কাটা আছে। বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে রাত হইয়া যাইবে, তাই একইসঙ্গে লাঞ্চ আর ডিনার সারিয়া লইতেছি।” এক ডজন সদস্যের পরিবারটিকে তেমন পরিশীলিত লাগিল না! মনে হইল দুই বিবাহিতা বোন নিজেদের স্বামী-সন্তান-সহ খাইতে আসিয়াছে। দু’টি পরিবারের বাচ্চাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লাগিয়া গেল। মায়েরা নিজেদের সন্তানকে সামলাইবার পরিবর্তে অপর পরিবারের বাচ্চাদের দোষারোপ করিতে লাগিলেন। তখন আসরে অবতীর্ণ হইলেন দুই বোনের বিধবা মা। মায়ের ধমকে আপাতত শান্তি ফিরিয়া আসিল।
রায়সাহেবের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখি তিনি মুখখানাকে তোলা হাঁড়ির মতো করিয়া রাখিয়াছেন। রাগ অবশ্য হইবারই কথা! লোকে রেস্টুরেন্টে গিয়া প্রথমেই সেখানকার অ্যামবিয়েন্স দেখে! সেখানে এই রেস্টুরেন্টের না আছে কোনো সাজসজ্জা, না সহখাদকের সভ্যতা-ভব্যতা! আমি এইসব লইয়া ভাবিতে চাহি নাই। আমার মাথায় শুধু ঘুরিতেছিল কখন খাওয়াদাওয়া শেষ হইবে আর আমি এই অপ্রীতিকর খাদ্য-অভিযান হইতে মুক্তি পাইব।
দেখিতে দেখিতে ওয়েলকাম ড্রিংক আসিয়া পড়িল! আমার ফেবারিট সেই গন্ধরাজ লেবু দিয়া ঘোলের শরবত। একটু বেশি মিষ্টি তবুও ঠান্ডা শরবত পান করিয়া শ্রান্ত ক্লান্ত শরীর জুড়াইয়া গেল। তাহার পর আসিল স্টার্টারের ছোট্ট থালি। মাটির ডিশে কলাপাতায় করিয়া ফিশ ফ্রাই, একটি ভেজিটেবল চপ এবং একটি আধহাত লম্বা বেগুনি। সবই গরম এবং ধুঁয়া উঠিতেছে। সারাদিনের অভুক্ত মানুষের রসনা লালায়িত হইয়া উঠিল। তাহার পর আসিল মেন ডিশ। এইখানে আসিয়াই খাবার উড়ান গোঁত্তা খাইয়া ভূপতিত হইল।
বাঙালি থালি খাওয়ার অভিজ্ঞতা হইতে আমরা জানি ইহারা সাধারণত ভাত, বাসন্তী পুলাও আর দুইটি গরম লুচি দিবে, সঙ্গে বাঙালিদের শুক্তো, ডাল, ভাজা, তরকারি, মাছ মাংস, মিষ্টি। শুক্তো দিয়া মানুষ কীভাবে বাসন্তী পুলাও খাইতে পারে তাহা ইহারা ভাবিয়াও দেখেন না! আমরা যেকোনো জায়গায় খাইতে গেলেই পূর্বেই বলিয়া দিই বাসন্তী পুলাওয়ের বদলে আমাদের যেন চাট্টি সাদাভাত বেশি দেওয়া হয়। সেইমতো আমাদের ইহারা বাসন্তী পুলাও দেয় নাই কিন্তু ঘরের অন্য সদস্যদের থালায় শুধুই বাসন্তী পুলাও ছিল। অবেলায় বাসন্তী পুলাও দিয়া শুক্তো মাখিয়া খাইতে গিয়া সহ-ভোক্তারা নাকানিচুবানি খাইতে লাগিলেন। হঠাৎ বড় দলটির একটি শিশুর নজর আমাদের থালার দিকে পড়িলে সে সোচ্চার হইল। “দেখ দেখ ওদের শুধু ভাত দিয়েছে” বাচ্চার চেঁচানিতে অন্য সদস্যরাও আমাদের থালার দিকে তাকাইয়া পরিবেশনকারীদের উপর হম্বিতম্বি শুরু করিলেন। পরিবেশনকারীরা ঝামেলা হইতে বাঁচিতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করিল। ইহাদের পরিবেশনের কায়দাটি অদ্ভুত! শরীরটিকে নাইন্টি ডিগ্রি এংগেলে বাঁকাইয়া বাম হাতে সার্ভিং থালি আর ডানহাতটিকে নীচু করিয়া ঝাড়ু দিবার ভঙ্গিতে তাহারা ঘরের মধ্যে চলাফেরা করিতেছিল। এককালে ভিড়ভাট্টার যজ্ঞিবাড়িতে এইরকমভাবেই পরিবেশন করা হইত কিন্তু এই ডাইনিং হলে তাহাদের বাধা দেবার কোনো ব্যক্তি বা বস্তু না থাকিলেও তাহারা কাকে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন তাহা সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝিলাম না।
ডালটি খাইতে অবশ্য ভালোই লাগিল, সঙ্গে গরম পাঁপরভাজা এবং ঝুরি আলু ভাজা। গন্ধরাজ লেবু দিয়া সোনামুগের ডালটি অমৃত লাগিল।ইহার পর ছানার ডালনা যেটিতে ছানা কম, ময়দা বেশি বলিয়া কেমন একটা লতলতে ভাব আসিয়াছে। ইহার পরে থালির প্রধান আকর্ষণ পরপর আসিতে লাগিল । সর্ষে দিয়া পাবদার ঝাল ( আমি মাছ খাই না বলিয়া লই নাই।), চিংড়ি মাছের মালাইকারি, খাসির মাংস। চিংড়ি মাছগুলির জামাকাপড় খোলা মানে খোসা ফেলিয়া দিবার পরে তাহাদের সাইজ কনিষ্ঠা অঙ্গুলির চেয়ে বড় নয়। তাহার উপর মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের রান্না মানে সম্পূর্ণ স্বাদহীন। মালাইকারির ট্যালট্যালে বিস্বাদ ঝোল দেখিয়া অন্ধও বুঝিতে পারিবে উহাতে বিশুদ্ধ জল মিশ্রিত করা হইয়াছে। মাংস ছিবড়া এবং এতটাই শক্ত যে মনে হয় দাঁত দিয়া ছিঁড়িতে গেলে দাঁত ভাঙ্গিয়া যাইবে।
খাইবার ইচ্ছা চলিয়া গিয়াছিল কিন্তু সহ-ভোক্তাদের ফেলিয়া উঠিয়া যাওয়া অভদ্রতা বলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিলাম। ইহার পরে আসিল চাটনি যেটিকে ঠিকঠাক বলাই যায়। তাহার পর এক ভাঁড় দই যেটি খেতে অসাধারণ লাগল। শুনিলাম ইহারা নিজেরাই দই জমাইয়া থাকেন। তাহার পর একটি পাশবালিশের আকারের লেডিকেনি। রসের মিষ্টি দেখিলেই গা কিড়কিড় করিয়া ওঠে বলিয়া আর ওইদিকে হাত বাড়াইলাম না। পাশের ছেলেটি বারবার ভাত চাহিয়া লইয়া একইসঙ্গে লাঞ্চ আর ডিনারের খোরাক উঠাইয়া লইল। আমরা হাতে মশলার প্যাকেট লইয়া দ্রুত ওই জায়গা ত্যাগ করিলাম।
বাহিরে আসিয়াই রায়সাহেব আমার উপর ফাটিয়া পড়িলেন। কাহার কথায় নাচিয়া এত অখাদ্য জায়গার সন্ধান আমি পাইয়াছি তাহা জানিতে চাহিলেন। ততক্ষণে আমি বুঝিয়া গিয়াছি ফেসবুকের ফুড গ্রুপের এইসব প্রশংসাকারীরা আসলে ছদ্মবেশী ফুড ভ্লগার। ইহারা হয়কে নয়কে করিতে ওস্তাদ এবং ইহাদের কথা বিশ্বাস করিলে তাহার পরিণাম আমাদের মতনই হইবে। এইসব কিছু হইতে একটি ভালো জিনিসই শুধু হইয়াছে রায়সাহেব প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন কলিকাতায় গিয়া তিনি আর বাঙালিয়ানার ধারক ও বাহক হইবার জন্য এইসব রাজবাড়ির মহারাজা থালির সন্ধান কখনো করিবেন না।
1 Comment