রণথম্ভোর ফোর্টে কিছুক্ষণ

রণথম্ভোর ফোর্টে কিছুক্ষণ

কলকাতাতে থাকতেই শুভ’র সঙ্গে কথা হয়েছিল, “দু’বছর তোমাদের পুজো দেখলাম। এবার যখন আসব তখন কোনো ফরেস্টে যাওয়ার কথা ভাবব।“
শুভ বলেছিল, “সে তো ভালো কথা। আমাদের এখান থেকে রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কে যাওয়া যেতে পারে। তবে সময়টা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলে হবে না।“
বললাম, “সে তো হবেই না। সেটা করতে গেলে বোধহয় মার্চ-এপ্রিল মাস মনে হচ্ছে খুব ভালো সময়। কিন্তু সেসময় তোমার সুবিধে হবে কি?”
“সেটা ঠিক। ওই সময়টা ফিনান্সিয়াল ইয়ার-এনডিং-এর সময়। কাজের প্রচুর চাপ। তবে সত্যিই তেমন হলে প্ল্যান করতে হবে ভেবেচিন্তে।“
উত্তরে বললাম, “দ্যাখো, আমি বেকার মানুষ। বহুদিন হল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। যখনই বলবে, সুস্থ থাকলে এবং অন্য কোনোরকম অসুবিধা না থাকলে চলে যাব যেকোনো সময়।“ 

শুভ ফরিদাবাদ থাকে। একসময় আমার কম্পিউটারের ছাত্র ছিল ও। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহু বছরের। একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি অনেক জায়গায়। ফরিদাবাদেই ওর বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে দুর্গাপুজো কাটিয়েছি দু-দু’বার। সুতরাং ফরিদাবাদে আর দুর্গাপুজো নয়। এবার জঙ্গল। জঙ্গল আমাকে টানে খুব। তাই রণথম্ভোরের কথা উঠতেই ভেতরটা নেচে উঠল ভীষণ রকম।

ভেবেচিন্তে চার-পাঁচ মাস আগের থেকেই সাফারি বুকিং- এর জন্য প্ল্যান করা হল মার্চের ১৫ থেকে ১৭ তারিখ। ফরিদাবাদ থেকে রওনা দেব শুভ’র সঙ্গে। এবার আমার অত্যন্ত ব্যস্ত সিডিউল। সময় হাতে খুব কম। তিন মাস আগে রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হল। কলকাতা টু নিউ দিল্লি। শুভ আসবে ফরিদাবাদ থেকে নিউ দিল্লি আমাকে রিসিভ করতে।

দেখতে দেখতে দিনটা এসে গেল। যথারীতি শিয়ালদা থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে নিউ দিল্লি পৌঁছলাম মার্চের ১৩ তারিখে। শুভ এসেছিল স্টেশনে। একটা ক্যাব বুক করে শুভ নিয়ে গেল আমাকে ওর ফরিদাবাদের বাড়িতে। ওর বাড়িতে দু’টো কুকুর থাকে। একটা খুব রাগি, সবসময় বাঁধা থাকে। অন্যটা দারুণ ফ্রেন্ডলি। আগেও দেখেছে আমাকে। ফলে চিনতে পেরে ওর লাফালাফি তুঙ্গে। একটু আদর করে দিলাম ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে।

একটা পুরো দিন শুভ’র বাড়িতে কাটিয়ে ১৫ তারিখ ভোর পাঁচটা পঞ্চাশ নাগাদ আমরা রওনা দিলাম রণথম্ভোর। প্রথমে ঠিক হয়েছিল একটা ক্যাব বুক করে ফরিদাবাদ থেকে নিউ দিল্লি যাওয়া হবে। কিন্তু কী ভেবে সেটা ক্যানসেল করে নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ঠিক করল শুভ। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় হলেও শীত শীত ভাব রয়েছে ফরিদাবাদে। দিল্লি পৌছে শীতটা আরও বেশি করে মালুম পেলাম। ভাগ্যিস একটা হাফহাতা সোয়েটার পরে বেরিয়েছিলাম। ভেতরে একটা হাফহাতা গেঞ্জি এবং ফুলহাতা জামা। নইলে এই শীতের হাওয়ায় একটু অস্বস্তি ভোগ করতাম।

নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল ঠিক সকাল সাতটা দশে। থ্রি-টিয়ার এসি। ফাঁকা ট্রেন। বেশ আরাম করেই গেলাম। শুভ আগের দিন রাতে ব্রেকফাস্ট-এর জন্য বুক করে রেখেছিল। ন’টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট দিল। ট্রেন সওয়াই মাধোপুর স্টেশনে পৌঁছল দুপুর বারোটা নাগাদ। একটা অটো ধরে রণথম্ভোর গ্রান্ড রিসর্টে এসে পৌঁছলাম। বেশ ঝকঝকে হোটেল। দেখেই মন ভরে গেল। হোটেল থেকে একটা ছবি তুলে নিলাম বাইরের।

হোটেল থেকে বাইরেটা

দুপুর আড়াইটা নাগাদ আমরা খাওয়া-দাওয়া সারলাম। যে-অটো করে আমরা সোয়াই মাধোপুর স্টেশন থেকে হোটেলে এসে পৌঁছলাম তার ড্রাইভারের সঙ্গে শুভ’র কথা হয়ে গিয়েছিল, বিকেলের দিকে সে গাড়ি পাঠাতে পারে রণথম্ভোর ফোর্ট যাওয়ার জন্য যদি আমরা চাই। এসেছি বেড়াবো বলে, সুতরাং আমরা ঠিক করলাম রণথম্ভোর ফোর্ট যাব এবং সেটা সাড়ে তিনটে নাগাদ। শুভ সেই অটো ড্রাইভারের (দীনেশ) সঙ্গে কথা বলল সেইমতো।

নির্দিষ্ট সময়ে একটা একটা ডিজায়ার গাড়ি এসে হাজির হল আমাদের হোটেলের সামনে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিকেল তিনটে পঁয়তাল্লিশ নাগাদ। হোটেল থেকে বেরিয়েই রাস্তাঘাট অপূর্ব। পাহাড়ি রাস্তার মতো উঁচু-নীচু তবে মসৃণ। গাড়ি চলল তীব্র গতিতে। কিছুটা চলার পর লোকালয় ছাড়িয়ে আমরা জঙ্গল এরিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সরু উঁচু-নীচু এবড়োখেবড়ো রাস্তা। মাঝেসাঝে ফিরে আসা গাড়ি এবং মোটরবাইক দেখা যাচ্ছিল। কোনো মানুষজনকে দেখা যাচ্ছে না হেঁটে আসতে বা যেতে। গাড়ির ড্রাইভার মাঝেমধ্যে গাড়ির গতি কমিয়ে দিচ্ছিল বা দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। বলে উঠছিল, ডানদিকে বা বাঁ-দিকে তাকান। আমরা সেইমতো কখনো ডানদিক কিংবা বাঁ-দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। এক ঝাঁক স্পটেড ডিয়ার দেখতে পেলাম একটা জায়গায়। শুভ এবং আমি দু’জনেই ক্যামেরা বার করলাম। রাস্তার ওপরে কিংবা দু’পাশে বিভিন্ন সাইজের হনুমানের দল দেখা যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে বড় শিংওয়ালা হরিণ চোখে পড়ছিল।

বড় শিংওয়ালা হরিণ

গাড়ির ভেতর থেকে ছবি তোলা মুশকিল। ড্রাইভার সাহেবকে বললাম, আমরা কি গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুলতে পারি? ড্রাইভার ভদ্রলোক বললেন, ওটা না করাই ভালো, কারণ, জঙ্গল এরিয়াতে আমরা ঢুকে পড়েছি। কখন কোন জন্তু চলে আসে তার ঠিক নেই। একসময় হঠাৎ করে ময়ূরের দেখা মিলল। আমরা গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ভেতর থেকেই ছবি নিলাম। আমার কাছে ছিল একটা ক্যাননের ডিএসএলআর এবং নিকনের ডিজিটাল ক্যামেরা। কিছুক্ষণ ডিএসএলআর-এ ছবি তুলে মন ভরল না। কারণ, অল্প সময়ে বিভিন্ন প্যারামিটারের ম্যানুয়াল এডজাস্টমেন্ট করে ছবি তোলা কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমি ডিএসএলআর ছেড়ে ডিজিটাল হাতে তুলে নিলাম।

জঙ্গলে ময়ূর

একসময় আমরা রণথম্ভোর ফোর্টের কাছে পরপর পার্ক করানো গাড়ির কাছে চলে এলাম। সবাই নামলাম গাড়ি থেকে। তখন আর তাড়াহুড়োর ব্যাপার নেই। আমি ডিজিটাল ছেড়ে আবার ডিএসএলআর ধরলাম। শুরুতেই একাধিক ছবি নিলাম ফোর্টের।

দুর্গ শুরু

 রণথম্ভোর ফোর্ট বা দুর্গ রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে অবস্থিত, যা একটা সময় জয়পুর রাজবংশের মহারাজাদের শিকারের জায়গা ছিল। রাজস্থানের অ্যাম্বার ডেভালপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটির মতে, দুর্গটি নিরাপত্তার কারণে ১০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। (গুগল তথ্য অনুযায়ী – [http://www.tourmyindia.com)]www.tourmyindia.com) 

আমার ধারণা ছিল, ফোর্টের পাদদেশে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি নিয়ে ফিরে আসব। কিন্তু না, ফোর্ট ভালোভাবে দেখতে গেলে আরও ওপরে উঠতে হবে! দেখলাম, সামনেই লম্বা লম্বা পাথরের চওড়া সিঁড়ি। বহু লোক সিঁড়ি ধরে উঠছে, কিংবা ফিরতি পথে নামছে। আমরা যেতেই বেশ কিছু অল্পবয়সি ছেলে আমাদের পেছনে পড়ে গেল গাইড হওয়ার জন্য। তারা ফোর্টের নানারকম গল্প শোনাবে, ফোর্ট দেখাবে। শুভ এবং দীপাকে ধরল তারা। বলা হয়নি আগে, শুভ’র স্ত্রী দীপা এবং ওদের মেয়েও আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল। আমাকেও ধরেছিল ওই গাইড ছেলেগুলো। কিন্তু কথা বাড়াইনি আমি, ইগনোর করে সিঁড়ি ধরে উঠছিলাম। শুভকে আর দীপাকে নাছোড়বান্দার মতো ধরল তারা। শুভ যথারীতি ‘না’ ‘না’ করে চলেছে, দীপাও তাই। কিন্তু শুভরা না না ছাড়াও আরও কিছু কথা চালিয়ে যাচ্ছিল। মজার ব্যাপার হল,  ওদের সঙ্গে যত কথা বলা হবে, তত ওদের কথার জালে জড়িয়ে পড়তে হবে। মাঝে মাঝে নানারকম সেন্টিমেন্টাল কথাও বলছিল ছেলেগুলো। মানে, এইভাবেই ওদের রোজগার, আমরা যদি ওদেরকে গাইড হওয়ার সুযোগ না দিই, তাহলে…। একসময় একজন ওইরকম সো-কল্ড গাইডের সঙ্গে কথাতে দারুণভাবে  জড়িয়ে পড়ল দীপা। ছেলেটির কোনো একটি কথার উত্তরে দীপা বলল, “কত?”

“সাড়ে ছশো।“
“ওরে বাবা, না না, দরকার নেই।“
“তাহলে কত দেবেন ম্যাডাম?”
“তিনশো।“
“না না, ম্যাডাম কী করে এত কম বললেন!”
শুভ হয়তো ওদের কথোপকথন শুনতে পেয়েছিল। বলল, “ওই তো,  ম্যাডাম যা বলেছে তাতে রাজি হও ভালো,  নাহলে দরকার নেই।“

চলল বার্গেনিং।  আমরা সিঁড়ি ধরে উঠে চলেছি ওপরে. সঙ্গের সো-কল্ড গাইডরা একে একে কমতে শুরু করেছে। কিন্তু একজন একেবারে ছিনে জোঁকের মতো লেগে ছিল দীপার সঙ্গে, আর, ঘ্যানঘ্যান করে কিছু বলেই যাচ্ছিল যাতে তাকে গাইড করা হয়। একসঙ্গে শুভ আর দীপা দু’জনেই ছেলেটির সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। আমি কখনো সামনে বা কখনো পেছনে থেকে ব্যাপারটা দেখে চলেছি এবং ছবি তুলে চলেছি ফোর্টের বিভিন্ন অংশের। মাঝে মাঝে সামনে সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছি, ওরা পেছনে আবার উলটোটাও হয়ে চলেছে। একসময় শুভ আর আমি পাশাপাশি চলে এলাম। আমি তখন উঠছিলাম অত্যন্ত ধীরে। বোধহয় আমাকে দেখে শুভ’র তখন কিছু মনে হল, বলল, “স্যার, সব ঠিকঠাক তো? অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

সেই মুহূর্তে আমার ডান হাঁটুতে একটু যেন ব্যথা অনুভব করছিলাম। কারণ, আমার ডান হাঁটুতে একটু সমস্যা হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। বলতে বাধ্য হলাম শুভকে, “হ্যাঁ, ঠিক আছে। তবে আমার হাঁটুতে একটা সমস্যা আছে, একটু মালুম পাচ্ছি যেন।“ শুভ জানত না কিছুই এ-ব্যাপারে।  বলল, “সেকী! কবে থেকে?”
আমি বললাম, “তা প্রায় এক বছর হয়ে গেল। তবে ব্যায়াম করে মোটামুটি সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।“
“ওহো! এটা তো জানতাম না।“
আমি একটু হাসলাম। কিছু বললাম না। ফোর্টের এক একটা বাঁক ঘুরে চলেছি, আর ভাবছি, শেষটায় পৌঁছব কখন!

ছবি তুলে আশ মিটছিল না। কখনো ডিএসএলআর, আবার, কখনো ডিজিটালে ফটো তুলে চলেছি (ছবি ৭, ৮)। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাশাপাশি অনেকে চলেছি, কাউকে চিনি না। হাসি পেল একটা কথা ভেবে। কেউ কাউকে সত্যিই চেনে কি? চিনতে পারে? দশ-পনেরো-বিশ কি তারও বেশি কত মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে চলেছি, কাজ করেছি, থেকেওছি কত কত দিন, তবুও কত চেনা মানুষকে আজও বড় অচেনা মনে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলে যায়, তার দেখার চোখ পালটে যায়। সারাজীবনেও হয়তো চেনা যায় না অনেককেই! 

দুর্গচত্বর
দুর্গচত্বর

শুভ-দীপাদের সামনে উঠে যেতে দেখছি। ফিরে আসছেও অনেকে। হয়তো কেউ কেউ ফোর্টের শীর্ষ ছুঁয়ে নামছে। আবার, কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত না পৌঁছেই। শুনলাম, ওপরে নাকি একটা মন্দির আছে। অনেকে পুজো দিয়ে নামছে মনে হল। কারণ অনেকের কপালে লাল তিলক। আমার পুজো দেওয়ার কোনো বাসনা নেই। আমি শুধু দেখে চলেছি চারপাশের বিভিন্ন ধরনের মানুষদের। দেখে চলেছি ফোর্টের সু-উচ্চ সব দেওয়াল।  আর, সেইসঙ্গে নিজের সক্ষমতা বা অক্ষমতা নিখুঁতভাবে যাচাই করে চলেছি প্রতি মুহূর্তে।

একসময় কিছুটা অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছলাম। শুভ-দীপাদের গাইড তাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে ওর সাজানো বক্তব্য নিয়ে নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত গাইড নিতে বাধ্য হল ওরা। সামনের দিকে একটা সরু পথ চলে গেছে। সেখান থেকে আবার খাড়াই। বাঁ-দিকে দেখলাম একটা মন্দির। তার সামনেটাতে কিছু রাজমিস্ত্রিদের কাজ চলছে। আমি শুভকে হাঁক মেরে বললাম, “শোনো, আমি আর যাব না তোমাদের সঙ্গে। আমি এখানেই থাকলাম। তোমরা তো ফিরবেই এই পথে, তখন একসঙ্গে ফিরব।

গাইড শুভদের এগিয়ে নিয়ে গেল ওই সরু পথটা ধরে। জানি না, আরও কত উচ্চতায় ওরা উঠবে! আমি তো আর পারলাম না, মানে সাহস করলাম না হাঁটুর কারণে। সবাই সব কিছু করে উঠতে পারে না এক জীবনে। আমার হাঁটুর কথা চিন্তা করে আমি থেকে গেলাম ওই সমতল জায়গাটায়। আমাকে তো আবার ফিরতে হবে নীচে ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভেঙে। ওঠার সময় আমি তেমন কষ্ট অনুভব করি না কিন্তু নামতে গেলে একটা ঝাঁকুনি হয়, তখন ব্যথা অনুভব করি হাঁটুতে।  নিজের ওজন বা সামর্থ্য নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, যদিও নাকি কথায় আছে, সামর্থ্যের কোনো উর্ধ্বসীমা রাখতে নেই। পঙ্গুও গিরিলঙ্ঘন করতে পারে। অকপটে স্বীকার করি, আমি সেই উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারিনি বা পারলাম না এ যাত্রায়। তাছাড়া রণথম্ভোর ফোর্টের অনেক ছবি তুলে ফেলেছি একরকম আশ মিটিয়ে নতুন করে তোলার কিছু খুঁজে পেলাম না।

শুভরা চলে গেল আমাকে ছাড়িয়ে। আমি বসার উপযুক্ত একটা  জায়গা খুঁজছিলাম, কিন্তু পেলাম না। বিকেল তখন সাড়ে চারটে। অগত্যা একটু হাঁটাহাঁটি করলাম সমতল জায়গাটাতে। তারপর দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশটা দেখতে থাকলাম। প্রচুর লোক তখন নীচ থেকে ওপরে উঠছে আবার নেমেও চলে যাচ্ছে অনেকে। কারুর কারুর কপালে সিঁদুর রঙের তিলক। সম্ভবত মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরছে তারা। সেই দলের মধ্যে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ এমনকী শিশুরাও আছে। একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম, সোফায় বসে আছেন আরাম করে, চারজন যুবক তাঁকে বহন করে নীচে নেমে চলেছেন কাঁধে চাপিয়ে। বৃদ্ধার কপালে লাল তিলক। পূণ্য সঞ্চয়ের এমন দৃশ্য খুব স্বাভাবিক মনে হল। 

আমি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে দূরে জঙ্গলের দৃশ্য দেখছিলাম। নীচে তাকিয়ে দেখছিলাম সারিসারি দাঁড়িয়ে থাকা অনেক গাড়ি। তারই একটা হবে আমাদের গাড়ি। ভাবতে অবাক লাগে এই জঙ্গলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দশটি জোন। তারই মধ্যে বিশেষ কিছু কিছু জোনে বাঘের দেখা মিলতে পারে, যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে। পরবর্তীতে সেসব নিয়ে লেখা যাবে বিস্তারিত।

বসার জায়গা ঠিকমতো না পাওয়াতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সময় কাটছিল রণথম্ভোর ফোর্টের ওই সমতল ভূমিতে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই অজস্র কাঠবিড়ালি ছুটেছুটি করছিল চারপাশে। মোবাইল বার করে ওদের ছবি তুললাম কয়েকটা। আসলে নেই কাজ তো খই ভাজ। একসময় দেখি, দু’-একটা কাঠবিড়ালি খুব কাছে চলে এল আমার। কাঠবিড়ালিরা খুব নিরীহ এবং ভীতু প্রাণী। মানুষকে সম্ভবত ওদের খুব ভয়। ফলে আমার থেকে চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে থেকে ওদের খেলাধুলা বেশ উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ দেখি, একটা কাঠবিড়ালি আমার কেডস-এর সামনেটাতে মুখ দিয়ে ঠোকা মারল। বোধহয় কোনো খাবার জিনিস ভেবে থাকবে। কোনো কাঠবিড়ালি কোনো মানুষকে স্পর্শ করতে পারে, এমন অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। যেন আদর করছিল। প্রায় স্বর্গসুখ উপভোগ করার মতন। তখনও কাঠবিড়ালিটা আমার পায়ের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দু’-একটা ছবি নিলাম। আমার মনে হল, বন্ধুত্ব করতে হয় তো এমন সব প্রাণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করাই ভালো, মানুষের চাইতে। কিছুটা ভালো সময় কাটল এই নিরীহ প্রাণীটির সঙ্গে।

সময় থেমে থাকে না  কখনো। রণথম্ভোর ফোর্টের সেই সু-উচ্চ সমতলভূমিতে তখন বিকেল ফুরোতে শুরু করেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎ দেখলাম, সামনের মন্দির-চত্বরের সামনে যেসমস্ত শ্রমিকরা কাজ করছিল তারা আর নেই। হয়তো ওদের ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষদের আনাগোনা কমতে শুরু করেছে। জায়গাটা ক্রমশ নির্জন থেকে নির্জনতর হচ্ছে। একটা সময় দেখলাম, আমার চারপাশে একটা মানুষও নেই।  আমি একা তখন। একটা অজানা ভয় যেন ঢুকে পড়ল আমার মধ্যে। একটা ভয়ঙ্কর ইন্সিকিওরিটি আমাকে গ্রাস করল যেন। শুভকে ফোন করলাম তক্ষুনি। কোনো আওয়াজ নেই। নেটওয়ার্ক স্তব্ধ। আবারও চেষ্টা করলাম ওকে ধরার। পারলাম না। ঘড়িতে তখন পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। কলকাতায় আমার ভাইকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। প্রথমে নরমাল ফোন করলাম। পেলাম না। তারপর হোয়াটস্যাপ কল। তিন-চার বারের চেষ্টায় কোনোমতে একটু সময়ের জন্য কথা বলতে পারলাম, কিন্তু কেটে যাচ্ছিল কথা। তারই মধ্যে মোটামুটি বুঝতে পারলাম, ও নাকি অনেকবার চেষ্টা করেছে আমাকে। পায়নি। আমি তখন ফোনটা কানে লাগিয়ে।  পাশ দিয়ে একটি লোক চলে গেল। কানে মোবাইল চেপে আছি দেখে লোকটি বলল, এখানে নেট পাবেন না।

কথাটা বলে লোকটি চলে গেল দ্রুত।  সত্যিই তাই! কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি মরিয়া। শুভকে ধরার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।  দিনের আলো কমে আসছে।  আর, ভয় ক্রমশ চেপে ধরছে আমাকে। প্রায় দিশেহারা লাগছে তখন। মোবাইল পকেটে রেখে শুভরা যে-পথে ফোর্টের আরও ওপরের দিকে চলে গিয়েছিল সেই পথ ধরে চলা শুরু করলাম। খাড়াই পথ। যত ওপরে উঠছি, সুদূর চলার পথে একটা মানুষও নজরে এলো না। বেশ খানিকটা ওঠার পর হঠাৎ মনে হল, শুভরা যদি অন্য পথ ধরে ওই সমতল ভূমিতে এসে পড়ে এবং আমাকে যদি দেখতে না পায় তখন আরেক সমস্যা তৈরি হবে। ওরা কী করবে তখন? হয়তো নীচে নামতে শুরু করবে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে আরও। কারণ, মোবাইল সংযোগ এমনিতেই  বিচ্ছিন্ন।

আমি দ্রুত ফেরার রাস্তা ধরলাম। তাড়াতাড়ি নামার ফলে হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করছিলাম খুব। তা সত্ত্বেও হাঁটার গতি কমালাম না।  সমতল ভূমিতে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছানো খুব দরকারি, সেইটাই  একমাত্র লক্ষ্য ছিল তখন।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমার চেনা সমতল ভূমিতে চলে এলাম। ফলে, আবার সেই নিঝুম অবস্থা। আবার ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম শুভকে। কয়েকবারের চেষ্টায় যদিও বা ধরতে পারলাম, কিন্তু ওপ্রান্তের কথা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ফোন কেটে কেটে যাচ্ছিল। তবে একটা ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম, শুভরা হয়তো এখনই ফিরে আসবে, কারণ, প্রায় দেড় ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পথে তখন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল শুভ, শুভ’র স্ত্রী এবং ওদের মেয়ে। আমরা নীচে নামার পথ ধরলাম। ওরা দ্রুত নামছে। আমি পেছন পেছন ধীরে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম। বাঁ-দিকে তাকালাম। কয়েকটা ময়ূর নিশ্চিন্তে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছবি তুললাম একটির। চোখ জুড়িয়ে গেল।

ফোর্ট এলাকায় ময়ূর

ঘুরে ঘুরে নেমে চলেছি। খাড়াই সিঁড়ি ধরে নামবার পথে হাঁটুর ব্যথা মালুম পেলাম। আফশোস হচ্ছিল, এইসব ওঠানামা একসময় জলভাত ছিল আমার কাছে, আর, এখন কত কঠিন! সুখ-দুঃখ নিয়ে এইভাবেই বুঝি গোটা জীবনটা কেটে যায়। শুভ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল আমার সিঁড়ি দিয়ে নামার ধরন দেখে। পেছন ফিরে একসময় কাছাকাছি এসে একটু হেসে বলল, “আপনি বোধহয় বুড়ো হয়ে গেলেন।“

কথাটা শুনে একটু দুঃখ পেলাম ভেতরে। তবে কিছু বললাম না। বরং নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম— জীবন তো এমনই! চিরকাল কি একইরকম থাকে মানুষ! তবে চেষ্টা তো করতেই হবে, যতটা সম্ভব সচল রাখা। ঈশ্বর আমার কপালে কী লিখে রেখেছেন কে জানে!

রণথম্ভোর ফোর্ট দেখা আমাদের প্রোগ্রামের মধ্যে ছিল না। কিন্তু হয়ে তো গেল! উপরি পাওনা বলা যেতে পারে! আর, না-চাইতেই যদি দুর্লভ জিনিস মেলে, তখন আনন্দে একেবারে ভরে ওঠে ভেতরটা। আমাদের আসল অভিযান রণথম্ভোর ফরেস্ট সাফারি। সেটার অভিজ্ঞতা নাহয় ভবিষ্যতে বলা যাবে। এইসব সুখ-চিন্তা নিয়েই সেদিনের রাতটা কেটে গেল ঘুমের মধ্যে।

৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • অরুণ দে , April 20, 2024 @ 8:53 am

    চমৎকার লেখা !
    ভ্রমণকাহিনী এমন গল্পচ্ছলে লেখা পড়তে কার না ভালো লাগবে । পড়তে পড়তে শেষের দিকে বেশ রোমাঞ্চকর ।
    লেখক যেখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন হাঁটুর ব্যথার জন্য। না পারছেন ওপরে উঠতে , না পারছেন নিচে নামতে । সেই সময় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, মোবাইলে টাওয়ার নেই কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না । এক অভূতপূর্ব গা ছমছমে পরিবেশ ।
    লেখকের বয়স আমি ছুঁয়ে আছি তাই ভীষণভাবে ওই ভয়ংকর পরিবেশকে অনুধাবন করতে পেরেছি ।
    তপন বাবুর লেখা এর আগেও পড়েছি হাত ভীষণ মজবুত ।
    এমন লেখককে হাজার বার কুর্নিশ জানানো যায় ।
    পত্রিকায় এরকম লেখা থাকলে পত্রিকার মান আরো উচ্চতর হয়ে যায়।
    পত্রিকার সম্পাদক পত্রিকার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই ।
    এমন লেখার জন্য তপনবাবুকে জানাই অশেষ অভিনন্দন।

  • তপন রায়চৌধুরী , June 18, 2024 @ 3:35 pm

    ধন্যবাদ গল্পকার অরুণ দে। ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *