অনন্য ক্রিকেটার বিলি মিডউইন্টার
ক্রিকেট জগতে সব থেকে চর্চিত ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ টেস্ট সিরিজের ক্ষুরধার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে ক্রিকেটপ্রেমীমাত্রই অবহিত আছেন, কিন্তু যদি বলি একজন ক্রিকেটার এই দুই যুযুধান দেশের হয়েই টেস্ট ক্রিকেটে অপর দেশের বিরুদ্ধে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তবে অনেকেই চমকে যাবেন। হ্যাঁ, অলরাউন্ডার, ‘উইলিয়াম ইভান্স মিডউইন্টার’ যিনি, ‘বিলি মিডউইন্টার’ নামে ক্রিকেট বিশ্বে অধিক পরিচিত ছিলেন, তিনিই এই অনন্য কৃতিত্বের একমাত্র অধিকারী। ১৮৭৭-১৮৮৭ সাল অবধি বিস্তৃত সময়কালের ১২ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে বিলি দু’দফায় অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আটটি টেস্ট ম্যাচ এবং এই দুই দফার মধ্যবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চারটি টেস্ট ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
১৮৫১ সালের ১৯ জুন, ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ার কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করলেও বিলির ন’-বছর বয়সে তার পরিবার বসবাসের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়।
১৮৭৭ সালে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে, আর ১৮৭৭-এর সেই যুগান্তকারী সফরের ঐতিহাসিক অভিষেক টেস্ট ম্যাচে নিজ জন্মভূমি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দুই দলের অন্যান্য সদস্যদের মতো বিলি মিডউইন্টারেরও টেস্ট অভিষেক হয়। মেলবোর্ন টেস্টের প্রথম ইনিংসে মিডিয়াম পেসার বিলি, ৫৪ ওভার বল করে ৭৮ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট দখল করে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ৪৫ রানে জয়ের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত সেই সময় ৪ বলের ওভার হত।
দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড, প্রত্যাঘাত করে ৪ উইকেটে ম্যাচ জিতলে সিরিজ অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। সেই টেস্টে ইংল্যান্ডের অ্যালেন হিলের দুরন্ত বোলিংয়ের সামনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংস মাত্র ১২২ রানে গুটিয়ে যায়। ব্যাট হাতে বিলি প্রতিরোধ না গড়ে তুললে আরও বড় লজ্জা অস্ট্রেলিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। ছ’-নম্বরে ব্যাট করতে নেমে বিলি ইনিংসের সর্বোচ্চ ৩১ রান করেন। টাইমলেস (অর্থাৎ, মীমাংসা না হওয়া অবধি খেলা চালানো হবে।) এই সিরিজের দু’টি টেস্টই মেলবোর্নে খেলা হয়েছিল।
দুই টেস্টের এই সিরিজে মোট ৮ উইকেট দখল করে বিলি অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর মর্যাদা লাভ করেন। এই টেস্ট সিরিজ যদিও অ্যাশেজ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত নয়। অ্যাশেজ সিরিজ চালু হয়েছিল ১৮৮২ সালে।
১৮৭৭-এর টেস্ট সিরিজের পরে, বিলি প্রবাদপ্রতিম ইংরেজ ক্রিকেটার স্যার ডব্লিউ জি গ্রেসের নেতৃত্বাধীন গ্লস্টারশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ১৮৭৮ সালের ইংল্যান্ড সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের পক্ষে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়ে বিলি কয়েকটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে অংশগ্রহণও করেন। এই সফরের এমনই একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে, মিডলসেক্স কাউন্টির বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার খেলা ছিল ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিলি ওই ম্যাচে মাঠে নামার আগেই, স্যার ডব্লিউ জি গ্রেস, বিলি মিডউইন্টারকে আক্ষরিক অর্থেই অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে দি ওভালে, গ্লসটারশায়ারের পক্ষে সারে কাউন্টির বিরুদ্ধে ম্যাচে মাঠে নামিয়ে দেন। কিংবদন্তি, স্যার ডব্লিউ জি গ্রেসকে নিয়ে ক্রিকেটের বহু লোকগাথার সম্ভবত সবথেকে বিতর্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে এভাবেই যুক্ত হয়ে আছে বিলি মিডউইন্টারের নাম। ক্রিকেটের ইতিহাসে ক্রিকেটীয় কারণে অপহৃত হওয়ার আর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। সেই মরশুমে বিলি আর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে মাঠে না নেমে গ্লস্টারশায়ার কাউন্টির হয়ে খেলা চালিয়ে যান।
সেটা স্যার ডব্লিউ জি গ্রেসের ভয়ে না তাঁর প্রতি ভক্তিতে, সেটা বলা এখন আর সম্ভব নয়।
১৮৮১-৮২-এর অস্ট্রেলিয়া সফরকারী ইংল্যান্ড দলে নির্বাচিত হয়ে বিলি চারটি টেস্ট ম্যাচে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৮৮২-৮৩ মরশুমে বিলি অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়ে ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলা আরম্ভ করেন এবং একটি টেস্টে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পান। ১৮৮৪ সালে বিলি মার্ডকের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে বিলি মিডউইন্টার ইংল্যান্ড সফরে যান। এই সফরের প্রথম টেস্টে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তিনি নিজের টেস্ট জীবনের সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেন।
বিলি, ১৮৮৭ সালে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন। পরবর্তীকালে ক্রিকেটার, জে. জে. ফেরিস অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড উভয় দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেললেও, তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে একটিমাত্র টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেছিলেন, অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে নয়।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভিক্টোরিয়া ও গ্লসটারশায়ারের হয়ে বিলির রেকর্ড ছিল রীতিমতন ঈর্ষণীয়। মোট ১৬০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে অলরাউন্ডার বিলি মিডউইন্টার, ব্যাট হাতে ৩টি শতরান এবং ১২টি অর্ধশতরান সহ মোট ৪,৫৩৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন, সর্বোচ্চ রান ছিল অপরাজিত ১৩৭ এবং বল হাতে তিনি ইনিংসে ২৭ বার ৫ উইকেট এবং ম্যাচে ৩ বার ১০ উইকেট সহ মোট ৪১৯টি উইকেট দখল করেছিলেন, সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ছিল ২৭ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট দখল।
এই বর্ণময় ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ১৮৮৯ সালে বিলির স্ত্রী এবং দুই সন্তান মারা যায়। পেশাগত জীবনেও ব্যবসাক্ষেত্রে বিলির ভরাডুবি ঘটে। সেই উভয় ধাক্কা বিলি সামলে উঠতে পারেননি।
১৮৯০ সালে সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায় বিলিকে প্রথমে বেন্ডিগো হসপিটালে এবং পরে মেলবোর্নের Kew lunatic asylum-এ স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই একদা দুরন্ত অলরাউন্ডার বিলি মিডউইন্টার মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মেলবোর্ন জেনারেল সেমেটারিতে বিলির নশ্বর দেহ শায়িত আছে।
জীবন যুদ্ধের ট্র্যাজিক নায়ক, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ফাইফার অর্থাৎ পাঁচ উইকেট দখলের কৃতিত্বের অধিকারী বিলি মিডউইন্টারের স্থান ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় অনস্বীকার্যভাবে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
তথ্যঋণ : Billy Midwinter and the dawn of test cricket by Pradip Dhole
ESPN CRICKET