বিগত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস থেকে করোনার বিশ্বব্যাপী দাপটে এই ২০২০ সালে পরপর বাতিল হয়েছে বহু আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান, এমনকি ওলিম্পিক, আর উইম্বলডনের মতো খানদানী প্রতিযোগিতা। তার ছাপ পড়েছে ক্রিকেটের আঙিনাতেও – দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ভারত সফর শুরু হয়েও বাতিল হয়ে গিয়েছে, পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে T20 বিশ্বকাপ, অনেক অনিশ্চয়তার টানাপোড়েনের পর IPL হয়েছে অনেক দেরিতে। জুলাই মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ইংল্যান্ড সফর দিয়ে ‘বলয়-সুরক্ষিত’ ক্রিকেটারদের নিয়ে দর্শকবিহীন মাঠে অনেক সন্তর্পণে আবার শুরু করা গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। ক্রিকেট-দুনিয়া একটু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
এই ‘Cricketing Lockdown’-কালে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ছিলো আর কানে আসছিলো নানারকম খেদ-দুঃখ-বিলাপ – খোলা মাঠে অনুশীলন করতে না পেরে আর প্রতিদ্বন্দিতামূলক খেলায় অংশ নিতে না পেরে কতো ক্রিকেটীয় প্রতিভার কতো না অপচয়-ক্ষয় হচ্ছে। মনে হচ্ছিলো, তাই তো, এই অতুলনীয়, অভূতপূর্ব এবং সবকিছু-বিকল-করা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে যেন অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে খেলাটার এবং খেলোয়াড়দের!
সত্যিই কি অতুলনীয় বা অভূতপূর্ব? এইজাতীয় সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে সত্যিই কি আগে কখনো পড়েনি ক্রিকেট-দুনিয়া। চারপাশে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামের ভনভনানির মধ্যে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে গেলো সদ্য-কেনা টেবিলে-রাখা একটা বইয়ের ওপর [ছবি – ১]।
মনে এলো ১৯৩৯-১৯৪৫-ব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা – হ্যাঁ, প্রায় সাত বছর বন্ধ ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অঙ্গন। তাতে কতোটা ক্ষতি হয়েছিলো ক্রিকেটের? কি অবস্থা ছিলো সেই দুনিয়াজোড়া ধ্বংসের মারণযজ্ঞের মধ্যে তখনকার খেলা এবং খেলোয়াড়দের? কেমন করে খেলাটাকে বাঁচাবার রসদ জোগাড় করা হয়েছিলো? বইটা পড়তে শুরু করে দিলাম – ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট মরশুমের নানা ছবি ভেসে উঠতে লাগলো মনের মধ্যে, স্মৃতিতে ভিড় করে আসতে থাকলেন নানা বইতে-পড়া সেই সময়কার খেলোয়াড়রা এবং তখনকার কিছু ম্যাচের ও ক্রিকেট-মাঠের টুকরো-টুকরো ছবি। মনে হতে লাগলো – কেমন ছিলো সেই যুদ্ধবিভীষিকাময় অন্ধকার দিনগুলো, কি করছিলেন তখনকার খেলোয়াড়েরা?
তারপর থেকেই বিষয়টা মাথায় ঘুরছিলো বেশ কিছুদিন ধরেই। ছোট্ট একটা খেই পেয়ে গেলাম সচিন তেন্ডু্লকরের একটি tweet থেকে – স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বিগত জন্মতিথি (২৭শে আগস্ট, ২০২০) উপলক্ষে করা – “Sir Don Bradman was away from cricket for several years due to World War II yet has the highest Test batting average” – এর পরের মন্তব্যটি আরো ইঙ্গিতময় – “Today, with concerns about athletes’ form due to uncertainties and long breaks, his career stands even taller as a source of inspiration.” সচিন ঠিক কি বলতে চাইছেন সেটা অনুধাবন করতে গিয়ে ডনের খেলোয়াড় জীবনের মূল তথ্যগুলোর দিকে আবার একবার চোখ রাখলাম। ফুটে উঠলো একটা ছবি যেটা এইরকম।
‘ম্যয় হুঁ ডন’
ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর জীবনের প্রথম টেস্ট খেলেন ব্রিসবেনে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে, তাঁর বয়েস তখনো একুশ ছোঁয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনি শেষ টেস্ট খেলেন কেনিংটন ওভালে, সেই ইংল্যান্ডেরই বিরুদ্ধে, ১৯৩৮ সালের আগস্টে, ত্রিশ বছর বয়সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডনের টেস্ট খেলা আবার শুরু সেই ব্রিসবেনেই, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে, তাঁর বয়স তখন আটত্রিশ। তাঁর টেস্টজীবনের শেষ খেলা সেই ওভালেই, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে, চল্লিশ বছর বয়সে। তার মানে স্যার ডনকে টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে সরে থাকতে হয়েছিলো আট বছরেরও কিছু বেশি সময় – আর সেটা কোন বয়সে? ত্রিশ থেকে আটত্রিশ, যার মধ্যে প্রথম চার-পাঁচ বছর (মোটামুটি ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ) বলা হয়ে থাকে একজন ব্যাটসম্যানের জীবনের সবচেয়ে পরিণত সময়।
কৌতূহলবশতঃ স্যার ডনের টেস্ট পরিসংখ্যান নিয়ে একটু খুঁটিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। যা পেলাম তা এইরকম:১৯২৮ থেকে ১৯৩৮ (প্রাক-দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধকালে) – ৩৭ ম্যাচে মোট ৫,০৯৩ রান (২১ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৯৭.৯৪
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ (দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে) – ১৫ ম্যাচে মোট ১,৯০৩ রান (৮ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ১০৫.৭২
মনে হলো, দেখি তো তাঁর সমকালীন অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ালি হ্যামন্ড, এবং দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালের তৎকালীন দুই দিকপাল ব্যাটসম্যান, লেন হাটন এবং ডেনিস কম্পটন, এই ব্যাপারে কেমন করেছেন। যা পেলাম তা এইরকম:
ওয়ালি হ্যামন্ড:
১৯২৭ থেকে ১৯৩৯ (প্রাক-দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধকালে) – ৭৭ ম্যাচে মোট ৬,৮৮৩ রান (২২ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৬১.৪৬
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ (দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে) – ৮ ম্যাচে মোট ৩৬৬ রান (০ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৩০.৫০
লেন হাটন:
১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ (প্রাক-দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধকালে) – ১৩ ম্যাচে মোট ১,৩৪৫ রান (৫ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৬৭.২৫
১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ (দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে) – ৬৬ ম্যাচে মোট ৫,৬২৬ রান (১৪ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৫৪.৬২
ডেনিস কম্পটন:
১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ (প্রাক-দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধকালে) – ৮ ম্যাচে মোট ৪৬৮ রান (২ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৫২.০০
১৯৪৬ থেকে ১৯৫৭ (দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে) – ৭০ ম্যাচে মোট ৫,৩৩৯ রান (১৫ সেঞ্চুরি সমেত), গড় ৪৯.৯০
অর্থাৎ ব্র্যাডম্যান ইনিংস-প্রতি প্রায় আট রান বেশি করেছেন ‘বুড়ো’ বয়সে এবং নানারকম শারীরিক অস্বস্তি-অসুস্থতা নিয়ে খেলা সত্ত্বেও।
আরেকবার আরেকভাবে অনুভব করলাম স্যার ডনের অনন্যতা, তাঁর সময়কার অন্যান্য মহান ক্রিকেটারদের তুলনায় – ‘Bradmanesque’ বা ‘ব্র্যাডম্যানীয়’ বিশেষণটার উদ্ভব কি সাধে হয়েছিলো – বিশ্বযুদ্ধও তাঁকে দমাতে পারেনি – “ডনকো পকড়না সির্ফ মুশকিলহি নহী, নামুমকিন হ্যায়”!
এ যেন আমার ডনরূপী বিন্দুতে ক্রিকেট-দুনিয়ার সিন্ধুদর্শন – সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো ডনের সমসাময়িক, যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধোত্তর, আরো কয়েকজন দিকপাল ক্রিকেটারের কথা – সেই বিশ্বজোড়া ধ্বংসের কালে তাঁরা কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন একটু দেখা যাক্। তবে তার আগে আসুন একবার দেখে নিই সেই বিশ্বজোড়া ধ্বংসের কালে ক্রিকেট-দুনিয়ার কোন দেশে খেলাটির কি অবস্থা হয়েছিলো।
স্তব্ধপ্রায় ক্রিকেট-দুনিয়া
ইংল্যান্ড
১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে স্বাক্ষরিত হয় ‘মলোটভ-রিবেনট্রপ দ্বিপাক্ষিক অনাক্রমণ চুক্তি’ (এর কারণেই রাশিয়া জার্মানিকে পোল্যান্ড আক্রমণ করতে কোনো বাধা দেয়নি), আর এর জেরে প্রথমেই মাঝপথে পরিত্যক্ত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফর। দু’দলের মধ্যে সদ্যসমাপ্ত তিন-টেস্টের সিরিজের পরে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরের খেলা ছিলো হোভ কাউন্টি ক্রিকেট মাঠে, সাসেক্স কাউন্টি দলের বিরুদ্ধে তিনদিনব্যাপী প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ। সে ম্যাচ এবং সফরের বাদবাকি আরো চারটি ম্যাচ বাতিল করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল তড়িঘড়ি দেশে ফিরে যায়। সেইসঙ্গে অবশিষ্ট মাত্র গোটাদশেক প্রথম-শ্রেণীর ঘরোয়া ম্যাচ বাতিল করে সেবারের ক্রিকেট মরশুম শেষ হয়। ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের মে, এই সুদীর্ঘ প্রায় ছ’বছর ইংল্যান্ডে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট বন্ধ ছিলো। বিখ্যাত ‘Cricketer’ পত্রিকায় তৎকালীন একটি লেখায় প্রকাশিত হয়েছিল এই ব্যঞ্জনাময় বাক্যটি – “England has now begun the grim Test match against Germany”.
যুদ্ধপূর্ববর্তী শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলা হয়েছিলো ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে, কেনিংটন ওভাল মাঠে। অচিরেই সেই মাঠ অধিগ্রহণ করে এক যুদ্ধবন্দী শিবির তৈরি হয় [ছবি – ২], যদিও তা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি। তবে সে মাঠ আর খেলার জন্য ব্যবহারযোগ্য ছিলোনা, বলাই বাহুল্য।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তিন তারিখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, ক্রিকেট জায়গা ছাড়তে বাধ্য হলো আরো বড় এক লড়াইকে, ব্যাট-বল ছেড়ে ক্রিকেটাররা যোগ দিতে লাগলেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। নাৎসি জার্মানী যেদিন পোল্যান্ড আক্রমণ করে, সেইদিনই এক প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে হোভ মাঠে হেডলি ভেরিটি ইয়র্কশায়ারের হয়ে দুরন্ত বোলিং করে মাত্র নয় রান দিয়ে সাত উইকেট দখল করেন। সেখান থেকে ফিরেই সেনাবাহিনীতে নাম লেখালেন তিনি, সঙ্গে ছিলেন ইয়র্কশায়ারেরই ফ্র্যাঙ্ক স্মেইলস, হার্বার্ট সাটক্লিফ, মরিস্ লেল্যান্ড ও লেন হাটন [ছবি – ৩ ]। ক্রমে ক্রমে অল্পদিনের মধ্যেই নাম লেখালেন মিডলসেক্সের ডেনিস কম্পটন ও বিল এডরিচ, এসেক্সের কেন ফার্নস, ইয়র্কশায়ারের বিল বাওয়েস (ইনি উত্তর আফ্রিকাতে ১৯৪২ সালে যুদ্ধবন্দী হয়ে ইতালিয়ান ও জার্মান বন্দীশিবিরে তিনবছর কাটান), এবং আরো অনেক ক্রিকেটার।
সুবিখ্যাত লর্ডস্ মাঠের ভোলও বদলে গেলো [ ছবি – ৪ ]। পরিকল্পনা ছিলো সেখানেও এক যুদ্ধবন্দী শিবির করবার কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ সেই ভাবনাকে কার্যকর করা হয়নি, বরং সেখানে যুদ্ধচলাকালীন কিছু চ্যারিটি ম্যাচ খেলা হয়েছিলো। ১৯৩৯-এর ডিসেম্বর মাসে লর্ডসের এক ছোট্ট অথচ তাৎপর্যময় বর্ণনা –
“a sobering experience; there were sandbags everywhere and the Long Room was stripped bare, with its treasures safely stored below ground but the turf was a wondrous green, Old Father Time on the Grand Stand roof was gazing serenely at the nearest (barrage) balloon and one felt that somehow it would take more than totalitarian war to put an end to cricket”
এইসব ডামাডোলের কারণে বাতিল হয়ে যায় ১৯৩৯-৪০ মরশুমে ইংল্যান্ডের প্রস্তাবিত ভারত-সফর। নির্বাচিত বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ থেকে চিরজীবনের মতো বঞ্চিত হন। তার সঙ্গে সঙ্গেই টেস্ট-ক্রিকেটের আঙিনায় সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পথে এক বড়ো ছেদ পড়ে।
১৯৪০ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড মাঠে বোমা পড়ে এবং ক্লাব বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়। লর্ডস্ মাঠেও ১৯৪১ সালে বোমা পড়ে যদিও কেউ হতাহত হননি এবং ক্ষয়ক্ষতিও সামান্যই হয়। তবে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে লর্ডসে ব্রিটিশ স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে এক প্রদর্শনী ম্যাচ চলাকালে কাছেই, মাঠের বাইরে শ’দুয়েক গজ দূরে, একটি জার্মান V-1 উড়ন্ত বোমা (চলতি নাম ছিলো ‘doodlebug’) পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য খেলোয়াড়রা –বোলার বব ওয়্যাট্ রান-আপের মাঝে বল হাতে নিয়ে, এবং [ছবি – ৫] ব্যাটসম্যান জ্যাক রবার্টসন ব্যাটসমেত, উইকেটরক্ষক অ্যান্ডি উইলসন ও স্লিপ-ফিল্ডার বিল এডরিচ্ – মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, দর্শকরাও প্রাণভয়ে যে যেখানে ছিলেন সেখানেই আড়াল খুঁজতে শশব্যস্ত হন। বিস্ফোরণের ধাক্কা সামলে আবার খেলা শুরু হলে ওয়্যাট বল করেন এবং রবার্টসন বিশাল ছক্কা মেরে বল দর্শকাসনে পাঠিয়ে দিলে দর্শকরা উল্লাসে হৈ-হৈ করে ওঠেন।
অস্ট্রেলিয়া
যদিও ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াও জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে, কিন্তু তৎকালীন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেঞ্জিসের ‘দেশব্যাপী যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’ বজায় রাখার একান্ত অনুরোধে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটবোর্ড ১৯৩৯-৪০ সালের প্রথম-শ্রেণীর আন্তঃরাজ্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতা শেফিল্ড শিল্ড চালু রেখেছিলো। পরের মরশুমটি অবশ্য দেশের জন্য তহবিল গড়ার উদ্দেশ্যে খেলা দশটি বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তঃরাজ্য ম্যাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
১৯৪১ সালের মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ক্রমশঃ ঘোরালো হতে শুরু করায় দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাটার টান ধরে। এর কিছুদিনের মধ্যেই জাপ নৌবাহিনী ও বিমানবহরের নিউগিনি ও দেশের উত্তরাঞ্চলের উপকূলবর্তী অংশে আগ্রাসনের কারণে ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাস থেকে সমস্তরকম আন্তঃরাজ্য ক্রিকেট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ পরবর্তী তিন মরশুম দেশে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট সম্পূর্ণ বন্ধ ছিলো। এই সময় ছুটির দিন ও শনিবার মিলিয়ে খেলা হতো কিছু কিছু দু’দিনের ম্যাচ, অংশ নিতো সেনাবাহিনী ও রাজ্যদলগুলো। বেশ কয়েকজন নামী প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটার, যেমন প্রবীণ ওস্তাদ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট, অদূর ভবিষ্যতের টেস্ট-তারকা নিল হার্ভে, রে লিন্ডওয়াল, কলিন ম্যাককুল, এইসব ম্যাচে খেলতেন। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাবসানের পর ১৯৪৬-৪৭ মরশুম থেকে শেফিল্ড শিল্ড প্রতিযোগিতা আবার চালু হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা
যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাতেই প্রথম-শ্রেণীর আন্তঃরাজ্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতা কারি কাপ বন্ধ ছিলো এবং কেবলমাত্র সামান্য কয়েকটি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলা হয়েছিলো।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডও অস্ট্রেলিয়ার রাস্তা অনুসরণ করে, ব্রিটেনের ঠিক পরে পরেই জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে এবং অস্ট্রেলিয়ার মতোই ‘দেশব্যাপী যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’ বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলো। সেদেশর ক্রিকেটবোর্ডও ১৯৩৯-৪০ সালের প্রথম-শ্রেণীর আন্তঃরাজ্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতা প্লাঙ্কেট শিল্ড চালু রেখেছিলো। কিন্তু তারপর ১৯৪০-৪১ মরশুম থেকে সবরকম আন্তঃরাজ্য ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতা বন্ধ রাখা হয়। সুযোগ-সুবিধে অনুযায়ী কিছু কিছু সেনাদলীয় ম্যাচ আয়োজন করা হতো। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাবসানের পর ১৯৪৫-৪৬ মরশুম থেকে প্লাঙ্কেট শিল্ড প্রতিযোগিতা আবার চালু হয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
আগেই জানিয়েছি, ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসের শেষে কিভাবে ইংল্যান্ড-সফরের শেষদিকের বাদবাকি পাঁচটি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ বাতিল করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল [ছবি – ৬] তড়িঘড়ি দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেখানকার ১৯৩৯-৪০ মরশুমের প্রথম-শ্রেণীর আন্তঃরাজ্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতা বাতিল করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাতেই অনিয়মিতভাবে আয়োজিত কিছু কিছু আন্তঃরাজ্য প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলা হয়েছিলো।
ভারত
যুদ্ধের ভ্রূকুটি ও আশঙ্কার মধ্যেও টেস্ট ক্রিকেট খেলে এমন দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতেই বজায় ছিলো প্রথম-শ্রেণীর ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলো। যুদ্ধ চলাকালীন নিয়মমাফিক প্রত্যেক মরশুমেই চলেছে রঞ্জি ট্রফি এবং বম্বে পেন্টাঙ্গুলার প্রতিযোগিতা, যদিও ১৯৪২-৪৩ মরশুমে হয়নি দেশব্যাপী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের কারণে।
সেইসময়ে ভারতের ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলো সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর “ইডেনে শীতের দুপুর” বইতে একটি মন্তব্য করেছেন – “তখন রাত্রে ছিলো নিষ্প্রদীপ, দিনে রানের ফুলঝুরি – মার্চেন্ট, (রুসি) মোদী, মানকড়, মুস্তাক, হাজারে। ডবল সেঞ্চুরিগুলো মার্চেন্ট-মোদী-হাজারে লোভীর মতো লুঠ করেছেন। সৌন্দর্যের দস্যুদের সেইসব কাজ দেখে দর্শকদের মাতামাতির শেষ ছিলোনা।”
আগেই জানিয়েছি, কেন ১৯৩৯-৪০ মরশুমে ইংল্যান্ডের প্রস্তাবিত ভারত-সফর বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ভারতে সেনাবাহিনীর কাজে থাকা বেশ কয়েকজন ইংরেজ ক্রিকেটার মাঝেমধ্যেই প্রথম-শ্রেণীর ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় খেলেছেন – এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডেনিস কম্পটন, জো হার্ডস্টাফ জুনিয়র ও রেগ সিম্পসন।
[ছবি ৭ – ১৯৪৩ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালিতে ইংরেজ গোলন্দাজদের চটজলদি ক্রিকেট]
এইবার আসুন একবার জেনে নিই ডন ও তাঁর সমসাময়িক, যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধোত্তর, কয়েকজন দিকপাল ক্রিকেটারের কথা – সেই বিশ্বজোড়া ধ্বংসের কালে তাঁরা কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন একটু দেখা যাক্।
যুদ্ধসাজে ক্রিকেটার
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান [ ছবি -৮ – সেনাবাহিনীর পোষাকে] ১৯৪০ সালে, তাঁর আরো বহু সাধারণ দেশবাসীর মতোই, অস্ট্রেলীয় সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। বেশ কঠোর এক প্রশিক্ষণ পর্বের শেষে তাঁকে শারীরিক প্রশিক্ষণ আধিকারিকের দায়িত্ব দিয়ে লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। কেমন ছিলো ফ্র্যাঙ্কস্টনের সেই পর্ব? প্রতিদিন সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে-চারটে পর্যন্ত চলতো তার পালা যাতে থাকতো নানারকম শারীরিক কসরত, দৌড়ঝাঁপ, মল্লযুদ্ধ ও মুষ্টিযুদ্ধের চর্চা, আর সঙ্গে থাকতো শারীরিক চোট-আঘাতের প্রাথমিক শুশ্রূষা ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা নিয়ে প্রশিক্ষণ। সেখানেও তিনি রীতিমতো কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এতে তাঁর শরীরের ওপর প্রচুর ধকল যেতো। ঐ বছরের শেষের দিকে এক বিশেষজ্ঞের পরীক্ষায় ধরা পড়ে তাঁর দৃষ্টিশক্তির সমস্যা যার চিকিৎসার জন্য তাঁকে দু’সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিলো। তারপর তিনি ফ্র্যাঙ্কস্টনে ফিরে আবার কাজে যোগ দেন। কিন্তু মাসদুয়েকের মধ্যেই শুরু হয় প্রচণ্ড পিঠের ব্যথা ও ফাইব্রোসাইটিস্ যার জন্য তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এইসময় কিছুদিন তাঁর ডানহাতের পেশীর ও স্নায়ুর এমন খারাপ অবস্থা হয়েছিলো যে নিজের দাড়ি নিজে কাটতে পারতেন না, তাঁর স্ত্রী সেই কাজ করে দিতেন। এর অল্প কিছুদিন বাদে সেনাবাহিনীর এক মেডিক্যাল বোর্ড তাঁকে শারীরিকভাবে অনুপযুক্ত ঘোষণা করলে অত্যন্ত বিমর্ষ অবস্থায় তিনি মিটাগঙে শ্বশুরবাড়ির কৃষিখামারে গিয়ে থাকতে শুরু করেন বিশ্রাম-স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য। তাঁর জীবনীকারের ভাষায়, “At the time of his thirty-third birthday, The Don had reached the lowest ebb of his life.” এই ভগ্নস্বাস্থ্যের জের তাঁকে পরবর্তীকালে সারাজীবনই বহন করে যেতে হয়েছে যদিও তাতে কিন্তু তাঁর ‘run-machine’-কে থামানো যায়নি।
পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের অন্যতম স্যার লেন হাটন [ ছবি – ৯ – সস্ত্রীক হেডিংলির মাঠে হাজির ১৯৪০ সালে আয়োজিত এক চ্যারিটি ম্যাচে] তার মাত্র বছরখানেক আগেই কেনিংটন ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬৪ রানের বিশাল ইনিংস খেলে বিশ্বরেকর্ড করেছেন (যে রেকর্ডটি পরবর্তী পাক্কা দু’দশক বজায় ছিলো)। তিনি তখন ইংল্যান্ডের উজ্জ্বলতম দুই তরুণ ব্যাটিং প্রতিভার একজন (অপরজন ছিলেন ডেনিস কম্পটন)। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৯৪০ সালে তিনি যোগ দিলেন ব্রিটিশ স্থলবাহিনীর শারীরশিক্ষা প্রশিক্ষণ বিভাগের নির্দেশক হয়ে সার্জেন্ট পদে। ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে কম্যান্ডো-প্রশিক্ষণকালে ব্যায়ামাগারে শারীরিক কসরৎ করবার সময় তাঁর শরীরের নিচের গদিটি পিছলে সরে যাওয়ায় মেঝেতে আছড়ে পড়ে তাঁর বাঁহাতের পুরোবাহুর হাড় ভাঙে এবং কব্জির হাড় সরে যায়। তাঁর ডান পায়ের হাড়ের এক অংশ কেটে নিয়ে বাঁ হাতে প্রতিস্থাপন করে অস্ত্রোপচারের ফলে তিনি সেরে ওঠেন বটে, কিন্তু সেই হাত প্রায় দু’ইঞ্চি ছোটো হয়ে যায়। তাই নিয়েই তিনি বাকি জীবনটা কাটান – লিন্ডওয়াল-মিলার, রামাধীন-ভ্যালেন্টাইন, মানকড়-অমরনাথ – এঁদেরকে সামলেই যুদ্ধোত্তর প্রায় দশবছরব্যাপী টেস্টজীবনে করেছিলেন সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি রান, চোদ্দোটি সেঞ্চুরিসমেত, ইনিংসপ্রতি গড় পঞ্চান্ন-ছোঁয়া।
ইংল্যান্ডের সর্বকালের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের অন্যতম ডেনিস কম্পটন [ছবি ১০ – ডানদিকে সেনার পোষাকে, বাঁয়ে ‘মিডলসেক্স যমজদ্বয়’-এর অন্যজন বিল এডরিচ] তার মাত্র বছরখানেক আগেই নটিংহ্যাম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ওরিলি-ফ্লিটউড স্মিথ-ম্যাককরমিকদের বিরুদ্ধে প্রথম আবির্ভাবেই মাত্র কুড়িবছর বয়সে শতরান করেছেন। শতরান করেছেন মাত্র কয়েকমাস আগের লর্ডস টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্সট্যান্টাইন-মার্টিনডেলদের বিরুদ্ধেও। তাঁর সময়কার বহু তরুণদের মতোই তিনিও সৈন্যদলে নাম লেখান এবং ব্রিটিশ গোলন্দাজবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তাঁকে সার্জেন্ট-মেজর পদে মধ্যভারতের মহু সেনাছাউনিতে পাঠানো হয়। ঐসময় তিনি হোলকার দলের হয়ে রঞ্জিট্রফি খেলার অনুমতি পান এবং ১৯৪৪-৪৫ সালের রঞ্জি-ফাইনালে খেলেন বম্বের বিরুদ্ধে। ভারতে থাকাকালীন তিনি পনেরোটিরও বেশি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন। ১৯৪৫ সালে লিন্ডসে হ্যাসেটের নেতৃত্বে সদ্য-যুদ্ধশেষে ভারত-সফরকারী অস্ট্রেলিয়ান সেনাদলের বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চল দলের হয়ে কোলকাতার ইডেনে শতরান করেন। সেই সফরকালেই তাঁর পরিচয় হয় কিথ মিলারের সঙ্গে, পরিচয় থেকে চটপট গড়ে ওঠে আজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব (যা বজায় ছিলো ১৯৯৭ সালে কম্পটনের মৃত্যু পর্যন্ত)। কোলকাতায় সেই ম্যাচ চলাকালীন শহরে-হওয়া দাঙ্গার একদল সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়ে সাময়িকভাবে কিছুক্ষণ খেলার ব্যাঘাত ঘটান – কম্পটন তখন ৯৪ রানের মাথায় ব্যাট করছিলেন, একজন সমর্থক তাঁকে বলেন, “Mr Compton, you very good player, but the match must stop now.” – অবশ্য অপ্রীতিকর কিছুই মাঠে ঘটেনি। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কম্পটন ব্যাট করতে নামলেই মাঠে উপস্থিত মিলার নাকি ঠিক ঐ কথাটাই তাঁকে মনে করিয়ে দিতেন! এই অসাধারণ ‘প্রতিদ্বন্দিতামূলক বন্ধুত্ব’-কে সম্মান জানাতে দুই দেশের ক্রিকেটবোর্ড ২০০৫ সালে সিদ্ধান্ত নেয় অ্যাশেজ সিরিজের নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়কে “Compton-Miller Medal” প্রদান করবার।
পৃথিবীর সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের অন্যতম কিথ মিলার [ছবি ১১ – বিমানবাহিনীর যুদ্ধসাজে, বাঁদিক থেকে তৃতীয়] তাঁর টেস্ট ক্রিকেটজীবন শুরু করেন ১৯৪৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়েলিংটনে, তখন তাঁর বয়স ছাব্বিশের কিছু বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন অস্ট্রেলীয় বায়ুসেনার ফাইটার বিমানচালক হিসেবে। ১৯৪২ সালের এক সপ্তাহান্তে কোনো একটি আমন্ত্রণী ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে গেছিলেন ডালউইচে, তাঁদের বোর্নমাউথের সেনাছাউনি ছেড়ে। সেই রোববারেই ছাউনিতে এক বোমাবর্ষণে তাঁর সাতজন বন্ধু প্রাণ হারান, খেলা না থাকলে হয়তো মিলারেরও একই দশা হতো। একবার মাত্র ঘন্টাখানেক আগেই তাঁর উড়িয়ে আনা বিমানটি চালাতে গিয়ে ভেঙে পড়ে তাঁরই এক সহকর্মী প্রাণ হারান। একবার ফ্রান্স থেকে উড়ান সেরে ফেরার সময় নামতে গিয়ে রাতের অন্ধকারের মধ্যে ইঞ্জিনের গোলমালে তাঁর বিমান রানওয়ে থেকে হড়কে বেরিয়ে যায়, মরিয়া চেষ্টায় এবং কিছুটা ভাগ্যের জোরে [তাঁর নিজস্ব জবানিতে “Miller’s luck”] তিনি কোনোক্রমে নিরাপদে অক্ষতশরীরে নেমে আসেন। আরেকবার জার্মানীর কিয়েল ক্যানাল অঞ্চলে শত্রুপক্ষের এক বিমানঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে বিপক্ষের প্রবল গোলাবর্ষণ এড়িয়ে ফিরে আসার সময় বিস্ফোরকভর্তি একটি বোমা বিমান থেকে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে ঝুলন্ত অবস্থাতেই এবড়োখেবড়ো ঘাসজমিতে তিনি কোনোমতে নিরাপদে অবতরণ করেন – সেই “Miller’s luck”! এইরকম বেশ কিছু মৃত্যুমুখী অভিজ্ঞতা হওয়ার্ কারণেই হয়তো পরবর্তীকালে এক সাংবাদিকের টেস্ট ক্রিকেটের চাপ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় মন্তব্য, “Pressure? There is no pressure in Test cricket. Real pressure is when you are flying a Mosquito with a Messerschmitt up your arse!” – প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি যে ঐ যুদ্ধে মিত্রপক্ষের রাত্রিকালীন ফাইটার বিমান হিসেবে Mosquito ছিলো বহুলব্যবহৃত, আর Messerschmitt ছিলো জার্মান বিমানবাহিনীর বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ফাইটার বিমান।
যুদ্ধ মানেই তো অবধারিত প্রাণহানি। তাই মন চলে গেলো সেইসব ক্রিকেটারদের দিকে যাঁরা ঐ বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন – ন’জন টেস্ট খেলোয়াড় (ইংল্যান্ডের পাঁচজন, দক্ষিণ আফ্রিকার দু’জন, অস্ট্রেলিয়ার ও নিউজিল্যান্ডের একজন করে), এবং শতাধিক প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড় – তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে একটু স্মরণ করা যাক্।
তারা ঘরে ফেরে নাই
[জিওফ্রে লেগি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ-হারানো প্রথম ইংরেজ টেস্ট ক্রিকেটার – ১৯৪০ সালে ডেভনে বিমান দুর্ঘটনা]
মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের ১৯৩৬-৩৭ মরশুমের পঞ্চম তথা শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং স্কোরকার্ডে এক আপাত-সাধারণ লাইন ছিলো – রস গ্রেগরি কট হেডলি ভেরিটি বোল্ড কেন ফার্নস ৮০ – যা কিনা ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসের পরে এক অনন্যতা পেয়ে গেছে। কারণ? এই তিন টেস্ট ক্রিকেটারই [ছবি – ১৩] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান।
ইংল্যান্ডের এসেক্সের তিরিশ বছর বয়সী পেস বোলার কেনেথ ফার্নস [ছবি – ১৪] ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে অক্সফোর্ডশায়ারে রাত্রিকালীন এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান – তিনি যে বিমান চালাচ্ছিলেন, সেটি ভেঙে পড়ে। ১৯৩৪ থেকে শুরু করে পনেরোটি টেস্ট খেলে তাঁর সংগ্রহ ৬০টি উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজ মাঠে ১৭৯ রান দিয়ে দশ উইকেট দখল করে তাঁর টেস্ট জীবনের আরম্ভ। ১৯৩০ থেকে শুরু করে ১৬৮টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে তিনি পেয়েছিলেন ৬৯০টি উইকেট, ২১.৪৫ গড়-সহ। কেমব্রিজের প্রাক্তন ছাত্র, শখের চিত্রকর ও সঙ্গীতপ্রেমী ফার্নসের অকালমৃত্যু ক্রিকেট-দুনিয়ার কাছে এক আকস্মিক আঘাত।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার তরুণ ব্যাটসম্যান রস গ্রেগরি [ছবি – ১৫] ১৯৪২ সালের জুন মাসে আসামে বিমানবাহিনীর এক অভিযান চলাকালীন মারা যান। প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের বয়স তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর। মাত্র একুশ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৩৬-৩৭ মরশুমে অ্যাডিলেডে অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে গ্রেগরির টেস্ট অভিষেক – দুই ইনিংসে রান করেছিলেন ২৩ এবং ৫০ – পরের টেস্টে একবার ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে (অস্ট্রেলিয়া সেই ম্যাচে ইনিংসে জয়লাভ করেছিলো) করেছিলেন ৮০ রান। স্কুলছাত্র থাকাকালেই ভিক্টোরিয়ার রাজ্যদলে সুযোগ-পাওয়া গ্রেগরির এই অকালমৃত্যুতে এক সম্ভাবনাময় ক্রিকেট-জীবন শেষ হয়ে যায়।
ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের বিখ্যাত বাঁ-হাতি স্পিন বোলার হেডলি ভেরিটি [ছবি – ১৬] ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ইতালিতে এক যুদ্ধবন্দী শিবিরে মারা যান। সিসিলিতে এক জার্মান-ঘাঁটি আক্রমণের সময় আটত্রিশ বছর বয়সী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন-পদস্থ ভেরিটির বুকে গুলি লাগে, সেই অবস্থাতেও তাঁর অধীন সৈন্যদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি শত্রুসেনার হাতে বন্দী হন – অস্ত্রোপচার করেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
সেইসময় ঐ যুদ্ধবন্দী শিবির থেকে শ’খানেক মাইল দূরের আরেক শিবিরে যুদ্ধবন্দী ছিলেন আরেক ইয়র্কশায়ারীয় টেস্ট ক্রিকেটার, ডান-হাতি পেস বোলার বিল বাওয়েস [ছবি – ১৭ – বাঁদিকে, পাশে তাঁর প্রিয় সহ-খেলোয়াড় হেডলি ভেরিটি ]। নেহাতই ঘটনাচক্রে যুদ্ধবন্দী এক ক্যানাডিয়ান বৈমানিকের মুখ থেকে একদিন বাওয়েস খবর পান যে ঠিক তার আগের দিনই ইতালিয়ান সেনারা পূর্ণ সামরিক মর্য্যা্দাসহ যুদ্ধবন্দী এক ইংরেজ ক্রিকেটারকে সমাধিস্থ করেছে। খবরটা পেয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া: Bowes staggered into the deserted roadway that ran through the camp. Pain sliced through the pit of his stomach. “The wind was cold, but I did not notice it. For a long while, I walked up and down that road, time stilled, living again the many incidents and hours we had shared together.”]
ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা পাঁচজন বাঁ-হাতি স্পিনারদের অন্যতম ভেরিটি। ১৯৩১ থেকে শুরু করে চল্লিশটি টেস্ট খেলে তাঁর সংগ্রহ ১৪৪টি উইকেট – ১৯৩০ থেকে শুরু করে ৩৭৮টি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে পেয়েছিলেন ১৯৫৬টি উইকেট, ১৪.৯০ গড়-সহ। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোত্তম বোলিংয়ের নজীর – ১৯৩২ সালে হেডিংলিতে ইয়র্কশায়ারের হয়ে নটিংহ্যামশায়ারের বিরুদ্ধে প্রবাদপ্রতিম দশ রান দিয়ে দশ উইকেট (ছবি ১৮) – আজও অক্ষত। মুখোমুখি সাক্ষাতে মোট আটবার তাঁকে আউট-করা ভেরিটি সম্পর্কে ব্র্যাডম্যানের মন্তব্যের অংশ উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গে ইতি টানি, “ … with Hedley I was never sure. You see, there was no breaking point with him. His whole career exemplified all that was best about cricket,” Bradman would say of Verity.
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়, চতুর্দিকে তখন ধ্বংসস্তূপ আর হাহাকার, বিশেষ করে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি আর (সুইৎজারল্যানড ছাড়া) জার্মানীসহ ইউরোপের সমস্ত দেশগুলোতে। এরই মধ্যে অন্য সবকিছুর মতো ক্রিকেটেও আর এক আরম্ভের সূচনা হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংল্যান্ডেরই মাঠে।
শাপমুক্তির পথে ক্রিকেট
ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসার মুখে, ১৯৪৫-এর মে মাস থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে, ইংল্যান্ডে খেলা হয়েছিলো পাঁচটি তিনদিনের প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচের সিরিজ (যা ‘Victory Tests’ নামে পরিচিত হয়), ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের বিরুদ্ধে খেলেছিলো অস্ট্রেলীয় সেনা একাদশ [ওপরের ছবি ] – তিনটি খেলা হয়েছিলো লর্ডসে, একটি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে, আর একটি ইয়র্কশায়ারের ব্রামাল লেন মাঠে – দুই দলই দু’টি করে ম্যাচ জেতে এবং বাকিটি অমীমাংসিত ছিলো।
ওয়ালি হ্যামন্ডের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডের দলে ছিলেন লেসলি এমস, সিরিল ওয়াশব্রুক, অ্যালফ্ গোভার, লেন হাটন, বিল এডরিচের মতো টেস্ট খেলোয়াড়রা – তখনও ভারতে কর্মরত থাকায় ডেনিস কম্পটন বা রেগ সিম্পসন দলে ছিলেন না, ছিলেন না যুদ্ধবন্দীদশা থেকে সদ্যমুক্ত বিল বাওয়েস, অবশ্যই ছিলেন না যুদ্ধে প্রাণ-হারানো হেডলি ভেরিটি বা কেন ফার্নস।
অন্যদিকে ছিলেন লিন্ডসে হ্যাসেটের নেতৃত্বে, অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বিভিন্ন ক্রিকেটাররা, যাদের মধ্যে ছিলেন শেফিল্ড শিল্ডে-খেলা কিথ মিলার, সিসিল পেপার, স্ট্যান সিসমে, রস স্ট্যানফোর্ড, রেগ এলিস, বব ক্রিস্টোফানি, কিথ কার্মডি (‘umbrella-field’-এর আবিষ্কর্তা) – উল্লেখযোগ্য যে সামরিক পদমর্য্যাদায় এঁদের মধ্যে প্রায় সর্বকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও টেস্টম্যাচের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাসেটের অধিনায়কত্ব করা নিয়ে দলের মধ্যে কোনো প্রশ্নই ওঠেনি।
যুদ্ধশেষে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সঙ্কেত হিসেবে ব্রিটিশ জনগণ এই সিরিজকে সাগ্রহে বরণ করে নেয় – দর্শকদের আগ্রহ ছিল প্রচুর। লর্ডসের শেষ তথা পঞ্চম ম্যাচে [ছবি – ২০] দর্শকসমাগম হয়েছিলো মোট প্রায় ৯৩ হাজার। দুই দলে যাঁরা খেলেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন এমন কয়েকজন যাঁরা শুধু ক্রিকেটার বলে নয়, বীর যোদ্ধা হিসেবেও অভিনন্দিত হয়েছিলেন। এঁদেরই অগ্রগণ্য কিথ মিলার চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছিলেন খেলোয়াড়দের সেই মনোভাব – “We were all servicemen, happy just to be alive and fit and well.”
জার্মানদের হাতে কয়েকবছর যুদ্ধবন্দী থাকা সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত তখনো-ক্ষীণকায় অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড় গ্রাহাম উইলিয়ামস্ যখন লর্ডসের মাঠে ব্যাট করতে নামছেন তখন দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে যে কানফাটানো স্বতঃস্ফূর্ত অভিবাদন জানিয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে কিথ মিলার বলেছেন – “It was the most touching thing I have ever seen or heard, almost orchestral in its sound and feeling. Whenever I think of it, tears still come to my eyes.”
২০১৫ সালের মে মাসে ‘Victory Tests’ সিরিজের ৭০-তম বার্ষিকীতে Wisden-এ প্রকাশিত একটি লেখা থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই – “It was a leitmotif for the moment: the joy of peace, of having survived, of realizing that life was to be lived and above all, enjoyed. Cricket was about entertainment, about sportsmanship. And it was supposed to be fun. No cricketer should ever forget that most important tenet.”
তেন্ডুলকরের ২০২০ সালের করা tweet, ২০১৫ সালের Wisden-এর লেখার এই লাইনগুলো, মিলারের ১৯৪৫ সালে লর্ডস মাঠের সেই অনুভূতি আর ওপরের ঐ ২১ নং ছবি– এগুলো সব কোথায় যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে – দিনের পথিকরা যতদিন অন্ধকার রাতে পথ-চলা পূর্বসুরীদের কথা মনে রাখবেন, ততোদিন খেলা চলতেই থাকবে – হেমিংওয়ে সাহেবের কিউবান বুড়ো জেলে স্যান্টিয়াগোর সেই কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিই, (cricket) “can be destroyed but not defeated.”
[কৃতজ্ঞতাস্বীকার এবং তথ্যনির্দেশ]:
- “The Final Innings” by Christopher Sandford
- “The Don: The Definitive Biography of Sir Donald Bradman” by Roland Perry
- “Len Hutton: The Authorized Biography” by Gerald Howat
- “End of An Innings” by Denis Compton
- “Cricket Crossfire” by Keith Miller
- “The Fast Men” by David Frith
- “10 for 10” by Chris Waters
- Wikipedia
- ESPN CricInfo Website
- Cricket Country Website
[ছবির কৃতজ্ঞতাস্বীকার]:
- “The Final Innings” by Christopher Sandford, ২০১৯ সালে প্রকাশিত সংস্করণ – ছবি নং ১, ৪, ৬, ৭, ১০, ১২, ১৭
- “Len Hutton: The Authorized Biography” by Gerald Howat, ২০১৬ সালে প্রকাশিত সংস্করণ – ছবি নং ৩, ৯
- “The Fast Men” by David Frith, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সংস্করণ – ছবি নং ১৪
- “10 for 10” by Chris Waters, ২০১৪ সালে প্রকাশিত সংস্করণ – ছবি নং ১৮
- ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত – ছবি নং ২, ৫, ৮, ১১, ১৩, ১৫, ১৬, ১৯, ২০, ২১
1 Comment