পঁচাত্তরে পড়ছেন ইংল্যান্ড-প্রবাসী ‘কলকাতার বাঙালি’ টেস্ট-ক্রিকেটার

পঁচাত্তরে পড়ছেন ইংল্যান্ড-প্রবাসী ‘কলকাতার বাঙালি’ টেস্ট-ক্রিকেটার

বাংলাভাষী ক্রিকেটার, নাকি বাংলাবাসী ক্রিকেটার

আমার পাঁচ-ছ’বছর বয়েস থেকে আজ পর্যন্ত শুনে আসছি যে ভারতীয় টেস্ট-ক্রিকেটে বাঙালি ক্রিকেটারদের প্রতি বহু ‘অন্যায়-অবিচার’ হয়ে এসেছে – ত্রিশের দশকের কার্তিক বসু থেকে শুরু করে হাল আমলের ঋদ্ধিমান সাহা পর্যন্ত। কথাটা কতখানি ক্রিকেটীয় যুক্তিসঙ্গত ও তথ্যনির্ভর, আর কতখানি ‘ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান’ – সেই বিতর্কের মধ্যে যাওয়ার কোন বাসনাই আমার নেই, কারণ সামাজিক-মাধ্যম-অধ্যুষিত চটজলদি-মেরুকরণ-আসক্ত আন্তর্জাল-বিজড়িত এই কালে সেই প্রচেষ্টা একধরণের হঠকারিতারই সামিল।

তবে এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে – ‘বাঙালি ক্রিকেটার’ বলতে কি বাংলাভাষী ক্রিকেটার, নাকি বাংলাবাসী ক্রিকেটার? যদি প্রথমটা হয়, তাহলে ওপেনার অপূর্বকুমার সেনগুপ্ত বা পেসার সুব্রত ব্যানার্জি এঁদেরও কি ধরা উচিত? আর যদি দ্বিতীয়টা হয়, তাহলে ব্যাটার দেবাং গান্ধী ও মনোজ তেওয়ারি বা অল-রাউন্ডার লক্ষ্মীরতন শুক্লা এঁদেরও কি ধরা উচিত নয়? আম-বাঙালির দাপটময় দাবি অনুযায়ী যদি ধরেই নিই যে বাঙালি, বিশেষত ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ কলকাতা শহর. মোটেই ‘প্রাদেশিক’ নয়, তাহলে মহম্মদ শামি-ও হচ্ছেন ঋদ্ধিমান সাহা-র মতনই বাঙালি, তাই তো! … তাই কি!!  

হঠাৎ এইজাতীয় ‘বিভেদকামী’ ভাবনা কেন? একটু বোঝাবার চেষ্টা করি। টেস্ট খেলতে না-পাওয়া শ্যামসুন্দর মিত্র, চুনী গোস্বামী, গোপাল বসু, সমর চক্রবর্তী, সম্বরণ ব্যানার্জি, উৎপল চ্যাটার্জি অথবা ‘যথেষ্ট-সংখ্যক’ টেস্ট খেলতে না-পাওয়া শুঁটে ব্যানার্জি, প্রবীর সেন, সুব্রত গুহ, অম্বর রায় এঁদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা সামাজিক মাধ্যমে যে পরিমাণ হা-হুতাশ দেখেছি/দেখি ও পড়েছি/পড়ি, আর তারই সঙ্গে অতিসফল সৌরভ গাঙ্গুলি ও ঋদ্ধিমান সাহা এঁদেরকে নিয়ে যে পরিমাণ হ-য-ব-র-ল উন্মাদনার প্লাবন চলে (ক্বচিৎ-কদাচিৎ পঙ্কজ রায়-ও যার ‘ভগ্নাংশ’ পেয়ে যান!), তাতে মাঝেমধ্যে মনে হয় বাংলাভাষী ক্রিকেটারদের তুলনায় বাংলাবাসী ক্রিকেটারদের প্রতি আমরা কি একটু কম ‘নেকনজর’ দিই’? লক্ষ্মীরতন শুক্লা ও মনোজ তেওয়ারির সাম্প্রতিক গুরুত্বের কারণটা মূলত ‘প্রশাসনিক’ ব’লেই তো মনে হয়।

[চিত্র-১: ৭৫তম জন্মবার্ষিকীর বছরে বাংলার দুই ক্রিকেট-তারকা]

একটা ছোট উদাহরণ দিই – ২০২২ সালে বাঙলার দু’জন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৭ সালে জন্মানো সেই দু’জন কে কে? Google না ক’রে বা Internet না ঘেঁটে ক’জন বাঙালি ‘Facebook-প্রবাসী’ ক্রিকেট-প্রেমী তাঁদের নাম বলতে পারবেন! সঙ্গের ছবিতেই উত্তর রয়েছে – তাঁরা হলেন গোপাল বসু ও দিলীপ দোশি। গোপাল-কে নিয়ে তাঁর জীবিতকালে এবং অবশ্যই মৃত্যুর পরেও অনেক আলোচনা/লেখালিখি হয়েছে, ‘জনতার আদালত’-এ কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে তৎকালীন কিছু কর্মকর্তাসহ অধিনায়ক মনসুর আলি খান পতৌদি ও (কিয়দংশে) অজিত ওয়াদেকার এঁদেরকেও।
সেই তুলনায় অনেক বেশি সফল ক্রিকেটার দোশি-কে নিয়ে অনেক কম চর্চা হয়। কেন? তিনি এখনও জীবিত, ইংল্যান্ড-প্রবাসী ব’লে, নাকি তাঁকে বাঙলার ক্রিকেটার মানতে আমাদের সদিচ্ছার কিঞ্চিৎ খামতি, নাকি ‘what could have been’-এর প্রতি আমাদের ‘মজ্জাগত’ দুর্বলতা – উত্তরটা খুব সহজ নয়। তাই সে পথ ছেড়ে দিয়ে আসুন একবার নজর দিই দোশি-র ক্রিকেট-জীবনে, টেস্ট-ক্রিকেটে একশ’ উইকেট-নেওয়া প্রথম বাংলাবাসী ক্রিকেটার যিনি বাংলাভাষাটা ভালই জানতেন –১৯৭১-এ দেশপ্রিয় পার্কে তেমনই দেখেছি/শুনেছি – তাই তিনি ‘কলকাতার বাঙালি’ টেস্ট-ক্রিকেটার।

কলকাতায় বেড়ে-ওঠার দিনগুলো

১৯৪৭ সালের ২২শে ডিসেম্বর গুজরাত রাজ্যের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের রাজকোট শহরে তাঁর জন্ম। কিন্তু ব্যবসাসূত্রে তাঁর বাবা রসিকলাল দোশি কলকাতায় চলে আসেন, সপরিবারে। দিলীপের বেড়ে-ওঠার শহর কলকাতা, তাঁর ভাষায়:

It is there (in Calcutta) that I was to spend my formative years, my schooldays and enjoy my early, though, primitive, cricketing experiences. … Those were the golden days of the city, the fifties, when I was in my early teens.

জে. জে. আজমেরা হাই স্কুলে তিনি পড়তেন যেখানে খেলাধুলোর ব্যবস্থা প্রায় কিছুই ছিলনা। ক্রিকেট খেলার জন্য তাঁর ছিল ভবানীপুরের ছোট্ট নর্দার্ন পার্ক আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের বিশাল ময়দান। কেমন ছিল সেই পরিবেশ? তাঁর ভাষায়:

“The surface was pockmarked with the constant movement of cattle, sheep, ponies … It was treacherous stuff, and the ball could shoot towards your face like those crazy hard rubber balls, or it could shoot below your bat with no chance of making contact. In Maidan cricket, there were chuckers galore, plenty of sledging, interruptions, and enough tensions to make it very serious stuff.” ময়দানে ক্রিকেট-খেলা পাঠকরা অনেকেই হয়ত নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছেন পরিবেশটা, তবে এটাই হয়ত “… served to harden one for the years ahead where softness would be frowned upon in the dressing rooms, selectors’ rooms, or under the blazing sun.”

[চিত্র-২: পরিচিত বোলিং-ভঙ্গি]

অল্পবয়স থেকেই তাঁর একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল – হাতে একটা ক্রিকেট-বল (রাবার বা টেনিস বল নয়) নিয়ে আঙ্গুলগুলো দিয়ে সেটাকে ঘোরানো, ফলে সেগুলো বেশ শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে যেটা পরবর্তী জীবনে খেলার মাঠে তাঁকে দীর্ঘক্ষণ একটানা বোলিং করতে সাহায্য করত। আর একটা জরুরি ব্যাপারও তিনি ময়দান-ক্রিকেট থেকে শেখেন – স্টাম্পগুলোর মধ্যে বল করা যাতে ব্যাটারকে বোল্ড-আউট করা যায়, কারণ ফিল্ডিংয়ের ও আম্পায়ারিংয়ের মান বিশেষ সুবিধের না হওয়ায় ক্যাচ বা লেগ-বিফোর আউটের সম্ভাবনা কমই ছিল।

১৯৫৮-৫৯ মরশুমে ইডেনে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলা, বিশেষত রোহন কানহাই-এর অসাধারণ ব্যাটিং, দেখে তাঁর মনে ক্রিকেটার হওয়ার প্রবল ইচ্ছে হয়। পরবর্তীকালে (সম্ভবত ১৯৬১-৬২ মরশুমে) সেলিম দুরানি-র চাতুর্যপূর্ণ বোলিং দেখে তাঁর মনে বাঁ-হাতি স্পিনার হওয়ার বাসনা চেপে বসে। এইসব লক্ষ্য করে তাঁর বাবা ও কাকা তাঁকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের চর্চাও চালিয়ে যেতে। দিলীপের দিনের অনেকটাই কাটত বাড়ির মধ্যে বা আশেপাশে ক্রিকেট খেলে, ক্রিকেট-প্রেমী ছোট ভাই নরেনকে নিয়ে।

১৯৬৪-৬৫ মরশুমে দিলীপ ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক-স্তরে। ফাদার লীমিং-য়ের তত্ত্বাবধানে ও ফাদার জোরিস-এর উৎসাহে কলেজের নেট-অনুশীলনের সময় চোখে পড়ে গেলেন জেভিয়ার্স-ছাত্র ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট-অধিনায়ক শিবাজি রায়-এর, যিনি শীঘ্রই স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের ক্রিকেট-অধিনায়ক হন।

দিলীপকে শিবাজি স্পোর্টিং ইউনিয়ন-এর হয়ে খেলতে ডাকেন আর সেই থেকে কলকাতার মাঠে দিলীপ ঐ ক্লাবের হয়েই বরাবর খেলে গেছেন। সেইসময়ে, ভোর ছ’টা থেকে বেলা দশটা কলেজে ক্লাস করবার পর, তিনি দিনে দু’বার নেট-অনুশীলন করতেন – বেলা সাড়ে-বারোটা থেকে কলেজে. আবার বেলা তিনটে থেকে বিকেল পাঁচটা ক্লাবে। পরিশ্রমের ফল  মিলল – পরের মরশুমে, ১৯৬৫-৬৬ সালে, সর্বভারতীয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে রোহিন্টন বারিয়া ট্রফিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলে জায়গা পেলেন।

ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বভারতীয় আঙিনায় পা রাখার সেই শুরু – ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্ক, সেন্ট জেভিয়ার্সের মাঠ, কলকাতার ময়দান ছাড়িয়ে – ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় অম্বর রায়, অশোক গান্দোত্রা, সুরিন্দর ও মহিন্দর অমরনাথ, সুনীল গাভাসকর, গোপাল বসু এঁদের মতন সহযাত্রীদের সঙ্গে। ১৯৩৫-৩৬ মরশুমে (রঞ্জি ট্রফির পরের বছর থেকে) চালু হওয়া রোহিন্টন বারিয়া প্রতিযোগিতা ১৯৬৭-৬৮ মরশুমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম বার জেতে, অম্বরের অধিনায়কত্বে, দিলীপ ও গোপাল এঁরা ছিলেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে এর পর থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ২০০৪-০৫ মরশুমেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠালাভ ও সাফল্যের খতিয়ান

স্পোর্টিং ইউনিয়ন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলের পর দিলীপ এবার বাংলা দলের হয়ে খেলবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যেই তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে স্নাতক হয়ে ল’ কলেজে আইন পড়তে শুরু করেছেন। কিন্তু ‘ফুটবলের শহর’ কলকাতায় বর্ষাকালে প্রায় মাস-চারেক ক্রিকেট বন্ধ থাকে। অতএব বাবার সঙ্গে পরামর্শ ক’রে তিনি চলে গেলেন বম্বে, কাঙ্গা লিগ খেলতে। সেখানে Cricket Club of India (CCI)-তে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে অনুশীলন করবার ও প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলবার সুযোগ পেলেন – দিলীপ সরদেশাই, হনুমন্ত সিং, অশোক মানকড় এঁদের সান্নিধ্যে – দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস দু’টোই বাড়ল, চলতে লাগল নিজেকে ক্রমশ উন্নত করে তোলবার সাধনা।

সাধনার ফলও পেলেন, ১৯৬৮-৬৯ মরশুমে নির্বাচিত হলেন বাংলা দলে। রঞ্জি-অভিষেক হ’ল ইডেনে উড়িষ্যার বিরুদ্ধে, তাঁর জন্মদিনেই, ১৯৬৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর তারিখে – বোলিংয়ে করলেন ১৬-৭-১৪-০ ও ২০-৯-২৬-২, ব্যাটিংয়ে ন’নম্বরে নেমে ১৬*, একটা ক্যাচও ধরলেন প্রথম ইনিংসে – বাংলা ইনিংসে জিতল। সেই শুরু – তারপর ১৯৮৪-৮৫ মরশুম অবধি টানা ষোল বছর ধ’রে বাংলার হয়ে খেলেছেন। এরপরও তাঁকে ‘বাঙালি ক্রিকেটার’ বলতে দ্বিধা করবেন কোন ক্রিকেট-প্রেমী!

একবার চটপট দেখে নিই ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পরিসংখ্যান। রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন ৬৫টা ম্যাচ, বোলিং করেছেন ২,৬৫০ ওভার, উইকেট নিয়েছেন ৩১৮টা, গড় ১৮.২৭, সেরা বোলিং ২৯ রানে সাত উইকেট – বাংলার হয়ে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৬২ / ২,৫৩৭ / ৩১১ / ১৭.৩৮ – বছরে গড়ে চারটে ম্যাচ খেলে ম্যাচপ্রতি নিয়েছেন পাঁচটা করে উইকেট. যেখানে গড়পড়তা দলীয় ফিল্ডিং বিশেষ যুৎসই ছিলনা। প্রসঙ্গত জানাই যে ১৯৬৯ সালে তিনি Indian Cricketer of the Year-ও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পূর্বাঞ্চলের হয়ে দলীপ ট্রফিতে খেলেছেন ১৮টা ম্যাচ, বোলিং করেছেন ৮২৯ ওভার, উইকেট নিয়েছেন ৬৭টা, গড় ২৮.৬১, সেরা বোলিং ৭৮ রানে ছয় উইকেট। অবশিষ্ট ভারতীয় দলের হয়ে ইরানি ট্রফিতে খেলেছেন পরপর তিনবার – ১৯৮০-৮১, ১৯৮১-৮২, ১৯৮২-৮৩ – বোলিং করেছেন ১৭৭ ওভার, উইকেট নিয়েছেন ১১টা, গড় ৩৭.৩৬, সেরা বোলিং ৬৬ রানে চার উইকেট। ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট ও কাউন্টি ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৮১ টানা এই ন’বছর। কিন্তু ভারতীয় দলে জায়গা পেতে তাঁকে লড়তে হয়েছে প্রায় এক দশক। কারণ? একটু জানবার চেষ্টা করা যাক।   

টেস্ট-দলে ঢোকবার এক দশকের লড়াই

ষাট-সত্তর দশকের ভারতের দু’জন দুর্ভাগাতম বাঁ-হাতি স্পিনারের নাম – ১৯৪২-এ জন্মানো হরিয়ানার রাজিন্দর গোয়েল (১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৮৪-৮৫) ও ১৯৪০-এ জন্মানো বম্বের পদ্মাকর শিভালকর (১৯৬১-৬২ থেকে ১৯৮৭-৮৮) – ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে দুরন্ত বোলিং ক’রেও এঁরা একটাও টেস্ট-ম্যাচ খেলতে পাননি। ভিনু মানকড়-পরবর্তীকালে পঞ্চাশ দশকের শেষদিক থেকে  বাপু নাদকার্নি ও সেলিম দুরানি, এবং ষাটের দশকের শেষার্ধ থেকে সত্তর দশকের প্রায় পুরো সময়টাই বিষেণ সিং বেদি ছিলেন ভারতীয় টেস্ট-দলের বাঁ-হাতি স্পিন-বোলিংয়ের মুখ। ষাটের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী প্রায় দেড় দশক ভারতের spin quartet রাজত্ব করেন যাঁর অন্যতম ছিলেন ১৯৭৫-৭৬ মরশুমে অধিনায়ক-নির্বাচিত-হওয়া বেদি যিনি ১৯৭৯ সালের গ্রীষ্মকাল অবধি জাতীয় দলে খেলে যান। অতএব বাদবাকি সব বাঁ-হাতি স্পিনারদের ছিল পাথরচাপা-কপাল!

এইসব বুঝে এবং সম্ভবত বেদি-র পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে [বেদি ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে নর্দ্যাম্পটনশায়ার কাউন্টি দলে যোগ দেন।] দিলীপ বুদ্ধিমানের মতন ১৯৭৩ সালের গ্রীষ্মে নটিংহ্যামশায়ার কাউন্টি দলের হয়ে English County Championship-এ খেলতে শুরু করলেন। নজরে পড়ে গেলেন ঐ দলেই খেলা ‘পৃথিবীর সেরা ক্রিকেটার’ গ্যারি সোবার্স-এর। একটা ম্যাচে সাতটা উইকেট পাওয়ার পরে করমর্দন ক’রে সোবার্স তাঁকে বলেন: “Well done, son, you’re all right.” – পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীর মুখবন্ধ সোবার্স-এরই লেখা। ১৯৭৮ মরশুম অবধি তিনি নটিংহ্যাম দলের হয়েই খেলেন। ১৯৭৯-তে হার্টফোর্ডশায়ার দলের হয়ে Minor County Championship-এ খেলেন। তারপর ১৯৮০ ও ১৯৮১ মরশুমে ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি দলের হয়ে English County Championship-এ খেলেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া যাক।

[চিত্র-৩: ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে]

প্রথম দু’মরশুমে খুব অল্পসংখ্যক ম্যাচেই খেলবার সুযোগ তিনি পেতেন – পাঁচটা ম্যাচ খেলে ১৮টা উইকেট নেন – কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র তিনি ছিলেন না। অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যান। ১৯৭৫ মরশুম থেকে তিনি অনেক বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান এবং তা কাজেও লাগান, গড়ে প্রতি দু’ম্যাচে নিয়েছেন সাতটা করে উইকেট। এই লড়াকু মানসিকতা ও লেগে-থাকবার জেদই তাঁকে তৈরি করে দিয়েছিল বেদি-পরবর্তী ভারতীয় দলে জায়গা করে নিতে।

আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রবেশ ও বহুবিধ অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও কঠিন প্রচেষ্টার সুফল মিলল, ১৯৭৯-৮০ মরশুমে ভারত-সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে মাদ্রাজের প্রথম টেস্টে আন্তর্জাতিক-ক্রিকেটে অভিষেক হ’ল দিলীপের, তাঁর বয়স তখন ৩২ বছর ছুঁতে চলেছে। নির্বাচিত হওয়ার খবর যখন তিনি পান, তিনি তখন ইংল্যান্ডে। তড়িঘড়ি একাধিক উড়ান বদল করে মাদ্রাজে যখন পৌঁছলেন, তখনও তাঁর সঙ্গের সমস্ত মালপত্র এসে পৌঁছোয়নি। সৌভাগ্যবশত তাঁর খেলার পোশাকের ব্যাগটা তাঁর সঙ্গেই ছিল। অতএব ১৯৭৯ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নেমে পড়লেন মাঠে, প্রথম দিনেই নিলেন তাঁর প্রথম টেস্ট-উইকেট, বাঁ-হাতি ওপেনার গ্রেম উড-কে লেগ-বিফোর আউট ক’রে। পরের দিন নিলেন আরও পাঁচটা উইকেট (কিম হিউজ, গ্রাহাম ইয়ালপ, ডেভ হোয়াটমোর, রডনি হগ, ও অ্যালান হার্স্ট) – ৪৩-১০-১০৩-৬ দিয়ে তৈরি করলেন অভিষেক-টেস্টে যে কোন ভারতীয় স্পিনারের সেরা বোলিং রেকর্ড, যা ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মাদ্রাজেই ভেঙ্গে দেন লেগ-স্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি। পরে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দিল্লিতে এমন কৃতিত্ব অর্জন করেন অফ-স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এ ব্যাপারে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে পথিকৃৎ ছিলেন মিডিয়াম-পেসার আবিদ আলি, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যাডিলেড-এ অভিষেক-টেস্টে ৫৫ রানে ছয় উইকেট নেন। অভিষেক-টেস্টে তাঁর সনাতনী ও নিখুঁত বোলিং-শৈলীর পেছনে নটিংহ্যাম  দলে তাঁর অমূল্য অভিজ্ঞতার হাত ছিল। ঐ টেস্টটা অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয় – দ্বিতীয় ইনিংসে দিলীপ নেন ৪২-১৫-৬৪-২, শিকার আরেক ওপেনার অ্যান্ড্রু হিলডিচ ও আবার ডেভ হোয়াটমোর।

জীবনের প্রথম টেস্ট-মরশুমে একটানা ১৩টা ম্যাচে – অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছ’টা করে ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্বর্ণ-জয়ন্তী টেস্ট – ৫৮৫ ওভার (১৭২টা মেডেন সমেত) বোলিং করে তিনি পেলেন ৪৬টা উইকেট, গড় ২৬,১৫, ছ’ম্যাচের দু’টো টেস্ট-সিরিজেই ভারত ২-০ ম্যাচে জিতল যদিও স্বর্ণ-জয়ন্তী টেস্টটা ইয়ান বথাম প্রায় একা-হাতেই জিতে নিয়ে গেলেন। প্রসঙ্গত এটাও জেনে নেওয়া যাক যে ব্যাটিং-অপটু দিলীপ ঐ মরশুমেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কানপুরে তাঁর টেস্ট-জীবনের সেরা ইনিংসটা (২০ রান, ৪৮ বল, ৬২ মিনিট, ৪x২) খেলেন, শেষ উইকেটে কার্সন ঘাভরি-র সঙ্গে ৪৫ রানের জুটি গড়ে দলকে ১১৭-৯ থেকে ১৬২-১০ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান – ভারত একটা সময় ছিল ৬৯-৮, ইমরান-বিহীন পাক পেস-আক্রমণের বিরুদ্ধে!

এরপর ১৯৮০-৮১ মরশুমের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সফর – ঘোষিত ক্রীড়া-সূচীতে ছিল দু’দেশে তিন-ম্যাচের দু’টো টেস্ট-সিরিজ, অস্ট্রেলিয়াতে অন্তত ১০টা ওডিআই (ত্রিমুখী বেনসন হেজেস প্রতিযোগিতা টাসমান সাগরপারের দুই প্রতিবেশীদের বিপক্ষে) ও নিউজিল্যান্ডে দু’টো ওডিআই – দেশের হয়ে তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। দলে তিনিই ছিলেন প্রধান স্পিন-বোলার, সঙ্গে ছিলেন অফ-স্পিনার শিবলাল যাদব। খেয়াল রাখতে হবে যে ভারত তখনও ওডিআই-ক্রিকেটে রীতিমত অনভিজ্ঞ। আর গ্রেগ চ্যাপেলের নেতৃত্বাধীন প্যাকার-যুগ-পরবর্তী অস্ট্রেলিয়া দল তখন পূর্ণশক্তিমান।
অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট-সিরিজে ১৪২ ওভার (৪০টা মেডেন সমেত) বল করে ১১টা উইকেট নেন তিনি, গড় ৪০.০০, প্রথম টেস্টে উইকেটহীন ব্যর্থতার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্টে তিনি যথাক্রমে ছ’টা ও পাঁচটা করে উইকেট নেন। তাঁর শিকারদের মধ্যে একমাত্র tailender ছিলেন ডেনিস লিলি। ভারত সিডনি টেস্টে পর্যুদস্ত হলেও অ্যাডিলেড-এ রুখে দাঁড়িয়ে ড্র করে, এবং মেলবোর্ন-এ অসাধারণ জয়লাভ করে, সিরিজ ১-১ হয়।

অ্যডিলেড-টেস্টে তাঁর বোলিং নিয়ে বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান বোলার বিল ও’রাইলি লেখেন:

“Doshi has been absolutely outstanding. Taking the new ball against all precept, he turned our top-line batsmen into timid postulance as they tried to score runs quickly at a critical stage. As I watched Doshi tossing the ball high and aiming it with relentless accuracy at the stumps on a position so close to the legendary ‘blind spot’, the whole futility of our present Australian thinking on spin hit me clean amidships. … Doshi taught us by example, refined, thoughtful and brilliantly-executed spin can offer the game an exciting future.

[চিত্র-৪: অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রের খবরের কয়েকটা অংশ]

মেলবোর্ন-এ বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ভাঙ্গা অবস্থায় দু’ইনিংস মিলিয়ে তিনি ৭৪ ওভার বোলিং করেন। ঐ সিরিজে তাঁকে নিয়ে লেখা দুয়েকটা খবর তুলে দিই [চিত্র-৪]-এর ডানদিকের অংশের সংবাদে কপিল দেব-র পাশাপাশি ঐ টেস্ট-জয়ে তাঁর ভূমিকার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। আজও অধিকাংশ ভারতীয় ক্রিকেট-প্রেমীই ঐ ম্যাচের শেষ দিনে কেবল কপিলের বোলিং নিয়েই মাতোয়ারা হয়ে থাকেন – এমনকি তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক সুনীল গাভাসকর পর্যন্ত। দোশি, ঘাভরি. ও যাদব এঁদের বোলিং-ভূমিকা প্রায় উপেক্ষিতই থেকে যায়, কেন কে জানে!

[চিত্র-৪]-এর বাঁদিকের অংশের সংবাদে প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল তাঁর বোলিংয়ের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে যা বলেছেন তার অন্যতম উদাহরণ অ্যাডিলেড-এ দু’ইনিংসেই তাঁর বলে গ্রেগ চ্যাপেলের মতন ব্যাটারের বিভ্রান্ত হয়ে আউট হওয়া। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট-সাংবাদিক গিডিওন হেই-এর একটি লেখায় আছে:

“Greg Chappell collared him in Sydney, but Doshi came back by dismissing him twice in Adelaide, sweeping at a ball that bounced too much in the first innings, then beaten in the air coming down the wicket in the second. Chappell turned on his heel without trying to remake his ground, bowed his head penitently, and stripped off his gloves in his few strides for the pavilion. ‘Too good,’ he seemed to say, ‘too good.

[চিত্র-৫: ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে, ১৯৮০-৮১ মরশুম]

আন্তর্জাতিক ওডিআই ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক ঐ সফরেই, মেলবোর্ন-এ ৬ই ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে – ১০-১-৩২-৩ দিয়ে, শিকার গ্রেগ চ্যাপেল, অ্যালান বর্ডার, ও ডাগ ওয়াল্টার্স – ভারত জেতে ৬৬ রানে। ত্রিমুখী বেনসন হেজেস প্রতিযোগিতায় ১০টা ম্যাচে ৮৯ ওভার বল ক’রে তিনি ১৫টা উইকেট নেন, গড় ২০.৮৬, সেরা বোলিং নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১০-০-৩০-৪ ব্রিসবেন-এ। ঐ প্রতিযোগিতায় তাঁর শিকারদের মধ্যে একজনও tailender ছিলেন না, এটা উল্লেখযোগ্য। ভারত অবশ্য ১০টা ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটে জিতেছিল।
নিউজিল্যান্ডে টেস্ট-সিরিজে দু’ম্যাচে ১৩৭ ওভার (৬৬টা মেডেন সমেত) বল করে পাঁচটা উইকেট নেন তিনি, গড় ৩২.৮০, তাঁর শিকারদের মধ্যে একজনও tailender ছিলেন না। ওয়েলিংটন-এর প্রথম টেস্টে পায়ের আঙ্গুলের চোটের জন্য তিনি খেলতে পারেননি, রবি শাস্ত্রী-র টেস্ট-অভিষেক হয়। ভারত ০-১ ম্যাচে টেস্ট-সিরিজ হারে। দু’টো ওডিআই ম্যাচেও দিলীপ খেলতে পারেননি, ভারত দু’টোতেই হারে।

১৯৮১-৮২ মরশুমে দেশের মাঠে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ছ’-টেস্টের ‘রক্ষণাত্মক’ সিরিজে ভারত ১-০ জিতল। সবক’টা ম্যাচে খেলে তিনি করলেন ২৬৮-১০৩-৪৬৮-২২ – গড় ২১.২৭, সেরা বোলিং ৩৯ রানে পাঁচ উইকেট, বম্বে-তে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড-কে ১০৫-৩ থেকে ১৬৬-১০ করে দিয়ে দলকে ১৩ রানে এগিয়ে রাখেন, ভারত ম্যাচটা জেতে। তিন-ম্যাচের ওডিআই-সিরিজে অবশ্য একটাই খেলবার সুযোগ পান, কারণ ইতিমধ্যেই একদিবসীয় দলে অল-রাউন্ডার ধাঁচের খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়ছে এবং আরেক বাঁ-হাতি স্পিনার শাস্ত্রী ব্যাটিং ও ফিল্ডিংয়ে দক্ষতা অনেক বেশি।

১৯৮২ সালের গ্রীষ্মকালে গেলেন ইংল্যান্ড-সফরে। তিন-টেস্টের সিরিজে ভারত ০-১ হারল। তিন ম্যাচে তিনি করলেন ১৫৭-৩৮-৪৫৫-১৩ – গড় ৩৫.০০, সেরা বোলিং ১০২ রানে ছ’উইকেট। ততদিনে ২৭টা টেস্ট খেলে ৯৭টা উইকেট নিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন এক বড় কৃতিত্বের দোরগোড়ায় – শততম উইকেটের হাতছানি তাঁর সামনে।
১৯৮২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, নিজের ২৮তম টেস্টে, মাদ্রাজে তিনি সেই মাইল-ফলক ছুঁয়েও ফেললেন, শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রণতুঙ্গা-কে আউট করে, সেটা ছিল শ্রীলঙ্কার সর্বপ্রথম টেস্ট-ম্যাচ। ত্রিশোর্দ্ধে টেস্ট-অভিষেক-করা অত্যল্পসংখ্যক বোলারই এই একশো উইকেটের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, আর তাঁদের মধ্যে বিখ্যাততম হলেন অস্ট্রেলিয়ান লেগ-স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট যিনি আবার দিলীপ-এর খুব প্রিয় স্পিনার, যদিও তাঁকে তিনি কখনও খেলতে দেখেননি। সেই ম্যাচে দিলীপ করেন ৬৮-১২-২৩২-৮ – প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৮৫ রানে পাঁচ উইকেট – শিকারদের মধ্যে ছিলেন রয় ডায়াস, দলীপ মেন্ডিস, অর্জুনা রণতুঙ্গা (দু’বার), ও রঞ্জন মদুগালে (দু’বার), ম্যাচটা বেশ উত্তেজনাকর ড্র হয়। টেস্ট-অভিষেকের তিন বছরের মাথায় তাঁর এই কৃতিত্ব অবশ্যই প্রশংসনীয়।

[চিত্র-৬: মাদ্রাজে শ্রীলঙ্কার সর্বপ্রথম টেস্ট-ম্যাচ, ১৯৮২-৮৩ মরশুম]

এরপর ১৯৮২-৮৩ মরশুমে ছ’ম্যাচের টেস্ট-সিরিজ ও চার-ম্যাচের ওডিআই-সিরিজ খেলতে ভারত গেল পাকিস্তান-সফরে। পঁয়ত্রিশোর্দ্ধ দিলীপ-এর ক্রিকেট-জীবনের সূর্যাস্তের শুরু এইখান থেকেই। নবাগত দুই তরুণ স্পিনার, মনিন্দর সিং ও লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণান – বিশেষত বাঁ-হাতি প্রতিভাবান মনিন্দর-কে তো ‘নতুন বেদি’ নামে অভিহিতই করা হচ্ছিল – সফরকারী দলে এলেন, শাস্ত্রী তো ছিলেনই। তার সঙ্গে ছিল ১৯৭৮-৭৯ মরশুমের পাক-সফরে ভারতীয় স্পিন-চতুষ্টয়ের বড় ব্যর্থতার টাটকা ইতিহাস।  দিলীপের আত্মজীবনী অনুযায়ী: “Sunil (Gavaskar) went on to say that left-hand spinners lost their place after a Pak series and that my days were numbered. So much for subtlety from my captain.” – কারণটা কি! এর উত্তর আমার কাছে নেই।

তবে এটাও অনস্বীকার্য যে সেই টেস্ট-সিরিজে প্রথম চারটে ম্যাচের মধ্যে একমাত্র লাহোরের প্রথমটাতেই তিনি কিছুটা কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন – ৩৩-৬-৯০-৫ ও ১৫-২-৫৭-১ – জাহির আব্বাস-এর ধ্বংসাত্মক দ্বিশতরান সত্ত্বেও পাটা-উইকেটে ম্যাচটা ড্র হয়। দিলীপের আত্মজীবনী অনুযায়ী: “I also have some rather mixed memories of captain Gavaskar commenting that those wickets were gathered by Pakistani batsmen going for the slog.” পরের তিনটে ম্যাচেই ভারত বিধ্বস্ত হয়ে হারে – দু’টোতে ইনিংসে পরাজয়, অন্যটা ১০ উইকেটে – সিরিজ ০-৩ হয়ে যায়। ঐ তিনটে ম্যাচে তিনটে ইনিংসে তাঁর বোলিং – ১৮-১-৬৮-১ (করাচি), ২৯-২-১৩০-০ (ফয়জালাবাদ), ও ৪১-৯-১৪৩-১ (হায়দ্রাবাদ) – মোটেই কার্যকরী হয়নি। ওডিআই-সিরিজে একমাত্র মুলতানের দ্বিতীয় ম্যাচটাতে তিনি খেলেন – ৮-১-৫৮-০ – ভারত ৩৭ রানে হারে। সেটাই তাঁর শেষ ওডিআই ম্যাচ।

ঐ টেস্ট-সিরিজে তিনি যে ব্যর্থ – ১৩৬-২০-৪৮৮-৮, গড় ৬১.০০ – তা তো তথ্যই বলছে, তা তিনি যতই অধিনায়কের সমালোচনা করুন না কেন: “So delayed was my call to the bowling in this (Karachi) Test that Asif Iqbal on Pak TV was prompted to say that it had to be something personal to Gavaskar. … It was becoming increasingly clear that he wanted to show the world that I had failed, before he could justifiably drop me.” – ষড়যন্ত্রটা কোথায়! এর উত্তর আমার জানা নেই।

১৯৮৩ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে জায়গা না পেলেও জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের আশা তিনি ছাড়লেন না, ইংল্যান্ডের ডারহাম লিগে থর্নাবি ক্রিকেট ক্লাব-এর হয়ে খেলা ও অনুশীলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার সময় লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে, “Kapil took me (Doshi) aside in a corner and said emphatically, ‘I need you in the side and be prepared to play in the forthcoming Test matches.’” এরপর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ফোন মারফৎ তিনি জানতে পারলেন যে দেশের মাঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিন-ম্যাচের টেস্ট-সিরিজের ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু-হতে-যাওয়া ব্যাঙ্গালোর-এর প্রথম ম্যাচে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তড়িঘড়ি তিনি রওনা দিলেন ব্যাঙ্গালোরের দিকে।

ব্যাঙ্গালোরে দলের হোটেলে, “Kapil Dev (captain) greeted me (Doshi) with warmth and wished me luck, … He (Gavaskar) was the only person in the team who did not wish me or exchange a word with me. The evening before the Test, Bedi (team manager) drew me aside at a private party, and repeatedly told me that I was lucky to be recalled, and that I should react by taking five wickets in justification. … Not a very healthy return to Test cricket.” এমন ব্যাপার তো ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম নয়! তাঁর ৩০-টেস্টের অধিনায়ক গাভাসকর-এর সঙ্গে ১৯৮১ সাল থেকেই তাঁর সঠিক বনিবনা হচ্ছিল না – কারণ কি, বোঝা মুশকিল!

 

বৃষ্টিবিঘ্নিত অমীমাংসিত ম্যাচে পাকিস্তান মাত্র একটা ইনিংসেই ব্যাট করতে পেরেছিল, দিলীপ ২০ ওভার বল ক’রে ৫২ রান দিয়ে একটা উইকেট পান – ওয়াসিম রাজা-কে বোল্ড আউট করেন। ম্যাচ চলাকালীনই জলন্ধর-টেস্টের দল ঘোষণা হয় –

“Bedi came and told me (Doshi), ‘Tough luck, but all in the game’. Soon Kapil came over and said quite unconvincingly, ‘The wicket at Jullundhur is grassy and we will play only one spinner in Venkat. But you’ll be back in Nagpur where the wicket is a turner.

যদিও সেই ম্যাচে বোলিংটা বোধহয় তিনি খারাপ করেননি, অন্তত অভিজ্ঞ ক্রিকেট-সাংবাদিক ডিকি রত্নাগর ও প্রাক্তন ভারতীয় স্পিনার এরাপল্লি প্রসন্ন তেমনটাই মনে করেছিলেন [চিত্র-৭], কিন্তু ঐ ম্যাচটাই তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট হয়ে যায়।

 

[চিত্র-৭: জীবনের শেষ টেস্টে বোলিং-সংক্রান্ত সংবাদপত্রের খবরের কয়েকটা অংশ]

গিডিওন হেই দিলীপের বোলিং নিয়ে লেখেন:

“Although Doshi could turn the ball appreciable distance in responsive conditions, what left the strongest impression was how long he could make it hang in the air, as though suspended in a cobweb. … Doshi’s bowling was full of double-meanings and hidden depths, both inviting and aggressive, patient and probing. … With a ball in his hand, he was never other than poised, setting the field like a finicky host setting the table. He had one of those approaches you could watch all day: a dainty run that turned him exquisitely side on, followed by a delivery stride where his bespectacled eyes would be just visible over his high right arm. His body would pivot into a follow through that brought his left hand below knee level.”

জাতীয় দল থেকে তাঁর বাদ পড়বার কারণ হিসেবে বলা হয়:

“The early days of the proliferation of limited-overs cricket were characterised by formulaic thinking, including the idea that spin was de trop. Doshi gave up fewer than four runs an over in his 15 ODIs but could not keep his place. … Even his pedantic way with field placings was held against him. Didn’t he realise that spin bowlers were there to speed up the over-rate and kill a few hours while the fast men got their breath back?

বাংলার ক্রিকেটের ‘ঘরের কথা’ নিয়ে কিছু সমালোচনা

১৯৮৫-৮৬ মরশুমের আগে বাংলার ক্রিকেট-প্রশাসনের সঙ্গে বড়সড় কিছু মতবিরোধের ফলে ঐ মরশুমে নিজের জন্মভূমি সৌরাষ্ট্র দলের হয়ে খেলে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট-জীবনে তিনি ইতি টানেন। তাঁর সময়কার বাংলার ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি-পরিমণ্ডল নিয়ে কয়েকটা সোজাসাপটা কথা বলতে তাঁর বাধেনি। আসুন একঝলক দেখে নিই তেমন কিছু নমুনা, তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে।

১৯৯১ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী, “Spin Punch” বইতে “Playing for Bengal” শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি সবিস্তারে জানিয়েছেন বাংলা-তথা-পূর্বাঞ্চল দলের হয়ে তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। সেখান থেকেই খানিকটা স্পষ্ট হবে ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধ এই দু’দশকের বাঙলার ক্রিকেটের ভেতরকার ছবি যেটা তাঁর চোখে পড়েছে।

  • বহুবিধ দলবাজি – 1
  • ক্রমবিকাশহীন শিক্ষণ-পদ্ধতি –2
  • দুর্বল মানসিকতা – 3
  • ক্ষমতার অলিন্দ –4
  • সন্দেহজনক বোলিং-ভঙ্গি –5
  • কোচিংয়ের বাড়াবাড়ি – 6

[চিত্র-৮: আত্মজীবনী]

একটা ঘটনার উল্লেখ দিলীপ করেছেন। ১৯৭৬-৭৭ মরশুমের ভারত-সফরকারী ইংল্যান্ড দলের খেলা, গৌহাটিতে পূর্বাঞ্চল দলের বিরুদ্ধে। এমনই ব্যাপার যে ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য, রাজ সিং দুঙ্গারপুর, সেখানে গেলেন না – পরিবর্তে তিনি সফরকারী দলের ম্যানেজার, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন টেস্ট-ক্রিকেটার কেন ব্যারিংটন-কে বললেন “to tell him (Raj Singh) if he spotted anyone talented.” – ঐ ম্যাচে অবশ্য পূর্বাঞ্চল হারতে হারতে সময়াভাবে বেঁচে যায়। দিলীপ দু’ইনিংস মিলিয়ে পান ৫৬-১৮-৮৯-৫, দু’বারই বিপক্ষ অধিনায়ক টনি গ্রেগ-কে আউট করেন। জাতীয় নির্বাচকদের কারো কারো কাছে কখনও কখনও এইজাতীয় ম্যাচের গুরুত্ব কেমন হ’ত, তার একটা আভাস পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীতে।

এইজাতীয় ‘অপ্রিয়’ প্রসঙ্গ থেকেই হয়ত কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে তৎকালীন বাঙলার ক্রিকেটারদের প্রতি ‘অবিচার’-এর কিছু কারণ। আর এইসব ব্যাপার অনেকটা খোলাখুলিভাবেই তাঁর আত্মজীবনীতে সমালোচনা করেছেন বলেই কি আমাদের অনেকের কাছে দিলীপ রসিকলাল দোশি অনেকটাই অপাংক্তেয় হয়ে গেছেন? যুক্তিভিত্তিক আত্ম-সমালোচনা জিনিসটাকে সঠিক মানসিকতা নিয়ে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই যে আজও অপরিণতভাবে অসহিষ্ণু রয়ে গেছি, আমাদের চারপাশের গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম বোধহয় তারই স্বাক্ষর বহন করছে।

 [কৃতজ্ঞতাস্বীকার এবং তথ্যনির্দেশ]:

    1. “Spin Punch” – Dilip Doshi; Ed: 1991; Rupa & Co.
    2. ESPN CricInfo Website
    3. Cricket Country Website
    4. Wikipedia

[ছবির কৃতজ্ঞতাস্বীকার]:

    • ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত – চিত্র ১
    • “Spin Punch” – চিত্র ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮

[End Note]

  1. There are so many imponderables in cricket, and particularly in Bengal cricket, with its intense groupism and club loyalties and the spill-over of football politics. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-9
  2.  In their teens, the Bengal players were high class; but somewhere along the line, something went wrong, and the promises remained unfulfilled. … There was something lacking here (the process of learning) which caused my colleagues to remain stationery while their counterparts around the country were setting the stands on fire elsewhere. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-10
  3. One of the easily identifiable maladies of the game in my state was that it was, and perhaps still is, played too soft. … Also, the softness sometimes showed in the attitude to injuries. Far too many of my colleagues amongst the Bengal cricketers gave in to their injuries and opted out of a match. There have also been accusations by some that there were ‘tactical’ withdrawals on the pretext of minor injuries just ahead of any important selection exercise. … The result of this was quite disastrous when the plater went on to play at a higher level of the game. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-11
  4. Bengal cricket is heavily influenced by the all-powerful clubs. Cricketing talent is largely divided between the four giants – Kalighat, Sporting Union, Mohun Bagan, and East Bengal. … It might be true to say that whichever of the four clubs happens to currently have its big boys in cricket administration or in selector capacities will be in a position to get their cricketers to the Bengal team and the key selection matches like the Irani Trophy, the (Board) President’s XI, at the national level. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-13
  5. A major problem with the Calcutta or Bengal cricket, whichever way you wish to look at it, was the profusion of bowlers with suspect and sometimes downright illegal actions. Let us put it plainly – Bengal cricket has an unenviable number of chuckers. Sadly, few umpires would choose to ‘call’ such bowlers for fear that their career prospects might be severely jeopardized. … These bowlers with illegal action would have the honour of ending up as highest wicket-takers for their respective clubs. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-15
  6. There is another aspect of Bengal cricket which needs looking at. There are just too many coaches, professionals, amateurs, relatives, well-wishers – well-meaning no doubt, but serving to totally confused the youngster. … I do believe that a batsman or bowler constantly pressured to review his stance, or action, or stroke-play, will lose more than he will gain. A policy of letting a player develop naturally might not be such a bad idea after all. – “Spin Punch”, 1991 Edition, Page-17
কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", এই বছর এল “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর লিখেছেন “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *