দ্রোহকাল
হিংসা হেনেছে কত অস্ত্র
ধর্ষিতা পৃথ্বীরে করেছে বিবস্ত্র।
ভেঙে পড়ে গান,
ভেঙে পড়ে সৌধ,
ভেঙে পড়ে সুন্দর স্তম্ভ।
নিরীহ শিশুরে মারে নিষ্ঠুরতম,
এই শুধু হিংসার দম্ভ।
(জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, ‘নবজীবনের গান – ১২’)
১৯৪৬-এর রায়ট ও পরবর্তী দেশভাগের পর আমার মা মাসি এই সব গানগুলো গাইতেন। বলতেন, “নবজীবনের গান।” আমি চার বছর বয়স থেকে ‘বহুরূপী’-তে ভর্তি – আমার মাসি-মেসো, তৃপ্তি মিত্র আর শম্ভু মিত্রের সৃষ্ট নাট্যসংস্থা। আমি সেখানে সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। এসব গান আমাদের রিহার্সালের আগে শেখানো হত। আমি গান করতে পারি বলে সহজে এন্ট্রি। এসব কথা ১৯৬০ সালের কাছাকাছি। আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে গানগুলোর কথা ভাবলে মনে হয় আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে আমরা কোন জায়গায় নিজেদের নামিয়ে এনেছি!
আজ পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটে চলেছে তার দিকে রুদ্ধশ্বাস নজর শুধু ভারতেরই নয়, সারা পৃথিবীর বাঙালি/ভারতীয় ডায়াস্পোরা সেদিকে তাকিয়ে আছে। নিজের কথা বলি – কত দিন খাইনি, কত রাত ঘুমোইনি, আর কেঁদেছি হাহাকার করে আমাদের কাদম্বিনীর জন্যে। মনে হয়েছে এই বন্যাধ্বস্ত রাজ্যটায় আর কী কী ঘটতে চলেছে? এ কী কষ্ট যার কোনও কূল নেই, কিনারা নেই! কী করে যুঝছেন সেই সদ্য সন্তানহারা মা-বাপ, যাঁদের কন্যার এই নৃশংস ধর্ষণ ও খুনে সারা বাংলা কেঁপে উঠেছে?
সবাই জানেন সেই ৯ই অগাস্টের দুঃসহ ভোরে একটি তরুণী চিকিৎসকের সঙ্গে কী ঘটেছিল। সে কি আর. জি. কর-এ দুর্নীতির অনেক কিছু জেনে গিয়েছিল? আরও অন্য কিছু…?
- টেন্ডারের দুর্নীতি,
- মেডিকাল আবর্জনা নিয়ে দুর্নীতি,
- ভেজাল ওষুধের দুর্নীতি,
- মৃতদেহ বেচার দুর্নীতি বিভিন্ন কলেজে-
- সেই হতভাগ্য মৃতদেহগুলির সঙ্গে এক নেক্রোফিলিয়াকের উল্লাস দুর্নীতি,
- মহিলা ডাক্তারদের দিয়ে জবরদস্তি অতিথি মনোরঞ্জন করানোর দুর্নীতি,
- মানব-অঙ্গ পাচার করার দুর্নীতি,
- ছাত্রদের দিয়ে ‘তোলাবাজি’ এবং অন্যথা র্যাগিং-এর দুর্নীতি,
- লিঙ্গ-ভিত্তিক নিগ্রহের দুর্নীতি,
- ছাত্রছাত্রীদের পাস-ফেল, অনার্স পাওয়ানোর, রেজিস্ট্রেশন বাতিল করানোর দুর্নীতি, যা এখন ‘থ্রেট কালচার’-এর (Threat Culture) আওতায় পড়ে। যে সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ এতদিন অবহিত ছিল না।
এই সব কথা কি সেই মেয়েটি জেনে গেছিল, যাকে আজ আমরা কাদম্বিনী, তিলোত্তমা, বা অভয়া নাম দিয়েছি?
এমন অনেক তথ্য উঠে এসেছে ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট ডাঃ আখতার আলির অভিযোগ থেকে – ২০২৩ সালে যিনি অনেক জায়গায় অভিযোগ করেছিলেন। রাজ্যের ভিজিলেন্স কমিশন, কপিঃ সন্দীপ ঘোষ, এমনকি স্বাস্থ্য দপ্তর-এ গিয়ে যথাযোগ্য হাতে দিয়ে এসেছিলেন যাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সব কিছু অবগত হন। তিনি ছিলেন ‘হুইসেল ব্লোয়ার,’ অথচ এর পুরস্কার হিসেবে তাঁকে সত্বর দূরে মুর্শিদাবাদ মেডিকাল কলেজে বদলি করে দেওয়া হল। কেন সদর্থক একটা পদক্ষেপ নেওয়া গেল না? কেন মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হল না সেই মুহূর্তে?
পরে তার ও কাদম্বিনীর অভিযোগপত্রের কপি সন্দীপ ঘোষের বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে। ভরসা করে তারা যে সব উচ্চ পদাধিকারীদের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁরাই সেই অভিযোগপত্র সন্দীপ ঘোষের হাতে তুলে দেন। সেই ভরসার সম্মান এঁরা রাখেননি, রাখলে এবং শাস্তি হলে “আজ আমার কোল এভাবে শূন্য হয়ে যেত না” (উক্তিঃ অভয়ার মায়ের)।
কাদম্বিনীর মৃত্যু খুব দুঃখজনক ঘটনা – একটি গণধর্ষণ, অসহ্য অত্যাচার, ও শেষে গলা মুচড়ে দিয়ে মৃত্যু ঘটানো। অভয়ার চোখ থেকে রক্তবিন্দু ঝরে পড়েছিল। কী কষ্ট পেয়েছিল মেয়েটি তা ভাষায় বর্ণনীয় নয়। পরে যাকে আত্মহত্যা বলে সাজানো হয়েছিল – শেষে ‘ধর্ষণ ও খুন’ বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় পুলিশ। যে ঘরে দেহ রাখা ছিল সেখানে নানা লোক ও ‘বহিরাগতদের’ সমাবেশ কেন ঘটেছিল? মা-বাবাকে তিন ঘণ্টা অবধি তাঁদের মৃত মেয়ের মুখ দেখতে কেন দেওয়া হয়নি, কেন? কেন গভীর রাতে টালা থানায় FIR করা হল? এরপর তড়িঘড়ি মায়ের কাছ থেকে দেহ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হল, কেন?
গঙ্গার জলে সব তথ্য প্রমাণ ধুয়ে গেল…
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
এরপর জুনিয়ার ডাক্তারদের প্রশ্ন, কেন খুন হবেন আমাদের সহপাঠী, আমাদের বোন নিজের কার্যক্ষেত্রে, নিজের ডিউটির সময়ে? সরকার জবাব দাও…
“জবাব দাও – জবাব চাই! জবাব দাও – জবাব চাই!”
স্লোগানের পড় স্লোগান! স্লোগান দিয়ে লেখা হতে পারে একটি ইতিহাস…
“অভয়ার রক্ত – যাবে না তো ব্যর্থ!”
“সব মানুষের একটি স্বর – Justice for R G Kar!”
এর আগে যা বললাম সবই পাঠক হয়তো জানেন – শুধু মনে করিয়ে দিলাম। জুনিয়ার ডাক্তাররা ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। জুনিয়ার ডাক্তাররা শান্তি মিছিল করে চলেছেন। হল রাত দখলের আয়োজন, পথে মানুষ নিজের ইচ্ছায় জমায়েত – এ হচ্ছে ১৪ই অগাস্টের রাত। এঁর মধ্যে হঠাৎ বহু দুর্বৃত্ত এসে ভেঙে দিল অনেকগুলি ঘর যেখানে কাদম্বিনী কাজ করছিলেন। হায়! হায়! শেষ তথ্যটুকুও নষ্ট হয়ে গেল। একমাত্র পাওয়া গেছে ৯ই অগাস্টের ভোরে – সঞ্জয় রাইকে – ওই ঘরের বাইরে। সিবিআই তদন্তের ভার পেয়েছে – কিন্তু চার-পাঁচদিন দেরিতে। অসাধু পুলিশ অফিসাররা তার মধ্যেই তথ্যপ্রমাণ-নথি উধাও করে দিয়েছেন।
জুনিয়ার ডাক্তারদের ফোরাম প্রতিদিন পথে নামছে। কিন্তু এঁদের নিরাপত্তা নেই, সুপ্রিম কোর্ট-এর কথা মেনে রাজ্য সরকার কথামত পরিকাঠামো বদলানোর কাজ কতটুকু সারলেন সেই নিয়ে যাচাই হচ্ছে। এঁদের আবেদন পৌঁছেছে সর্বোচ্চ আদালতে। তবে এঁরা আশাবাদী – মনে করছেন একটা বিহিত হবেই।
মিছিলের পর মিছিল চলছে মশাল জ্বালিয়ে, আর মনে পড়ে যাচ্ছে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর নবজীবনের গান…
দামামা বেজেছে – দামামা বেজেছে
চারিদিক রণরঙ্গে মেতেছে
কোটি সিংহের ক্রুদ্ধ কেশর
ফুলে ফুলে ওঠে কালো মেঘে ওই
বজ্র মেতেছে দামামা বেজেছে – দামামা বেজেছে
বিশ্বকর্মা গোপনে জটিল
মন্ত্র পড়ে,
আকাশে মাটিতে, হাজার ঘাঁটিতে
যন্ত্র নড়ে…”
(জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, ‘নবজীবনের গান – ৫’)
কর্মবিরতি…
জুনিয়ার ডাক্তার ফ্রন্টের ডাক্তাররা সমস্ত রাজনৈতিক পার্টিকে ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন, কারণ তাঁরা ক্ষমতা চান না – চান সততা… চান স্বচ্ছতা।
খুব শান্ত, শৃঙ্খলা মেনে পথ চলেছেন। বারবার এঁদের ‘কর্মবিরিতি’ নিতে হচ্ছে, কর্মরত অবস্থায় এঁদের ওপর অন্যায় মারধোর করছেন নানান ধরনের দুর্বৃত্ত শ্রেণীর লোক, কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন সেই ঘটনাগুলি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন মহাসম্মেলনের মিছিলে হেঁটে চলেছেন সাত থেকে নব্বই বছরের নানান নাগরিক। এঁরা নিজেদের ইচ্ছেয় যোগ দিয়েছেন। তবে এই জুনিয়ার ডাক্তাররা আশাবাদী।
হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে।
(কবীর সুমন, ‘হাল ছেড়ো না’)
মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের অভাগ্য রাজাকে, যে সোনা-শ্রমিকদের অবস্থা কিছুই জানত না, অথবা তাকে আমলারা জানতে দিত না। যখন যুদ্ধ বাধল – প্রতিবাদী নন্দিনী দেখল রাজার বর্শার আগে শোভা পাচ্ছে তারই দেওয়া শুভ্র কুন্দফুলের মালা। একটি ইউটোপিয়ান কল্পনা কিন্তু আমি আশাবাদী – মনে করি একটি সদার্থক নিষ্পত্তি হবেই হবে। তবে অনেকে বলেন তাদের স্মরণে এমন দ্রোহ, স্বাধীনতার পরে আর কখনও দেখেননি। মনে পড়ল –
ঝোড়ো হাওয়া আর ওই পোড়ো দরজাটা
মেলাবেন তিনি, মেলাবেন।
(অমিয় চক্রবর্তী, ‘সঙ্গতি’)
আমরা সবাই আশায় আছি।
———-
তথ্যসূত্র
দূরদর্শন সম্প্রসারণ:
এবিপি আনন্দ
Calcutta News
Republic Bangla
TV9
2 Comments