স্বাধীনতার চেতনা : বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা
‘স্বাধীনতা’ শব্দটা আমরা খুব সহজভাবে উচ্চারণ করি ঠিকই, কিন্তু শব্দটার মর্মার্থ সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা আমরা খুব কমই করে থাকি। ‘স্বাধীনতা’ মানে নিজের অধীনে থাকা, পরের অধীনে নয়। পরের অধীনে থাকার অর্থ ‘দাসত্ব’, যা কাম্য নয়; কারণ তাতে ব্যক্তিসত্তা সঙ্কুচিত হয়, ‘আত্মমর্যাদা’ ধূলিমলিন হয়। বেশ। কিন্তু, নিজের অধীনে থাকতে গিয়ে কি ‘দাসত্ব’ অনুশীলিত হতে পারে, না কি পারে না? পারে তো। নিজেই নিজের দাস হওয়া কি অসম্ভব? ইচ্ছের দাস, প্রবৃত্তির দাস, ইগোর দাস, আমিত্বের দাস কথাগুলি তো নতুন নয়। এই সমস্ত কিছু যদি ‘আত্মনিয়ন্ত্রণে’ না থাকে তাহলে সেই ‘স্বাধীনতা’ মস্ত আপদ। বস্তুত, নিজের অধীনতা অনেক বড়, অনেক ব্যাপ্ত ‘দায়বদ্ধতা’র কথা বলে। দিনের শেষে ‘স্বাধীনতা’ একরৈখিক চেতনা নয়, বরং বহুরৈখিক চেতনার কথা বলে। নানা অভিজ্ঞতার নির্যাস আজ এই কূলে বোধের তরীটিকে এনে ভিড়িয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, ‘স্বাধীনতা’র সঙ্গে ‘সংবেদনা’ যুক্ত না হলে ‘দায়বদ্ধতা’ বিলুপ্ত হয়, আর উৎকটভাবে নিজের সমস্ত স্বাধীনতা উপভোগের অপর প্রান্তে অনিবার্যভাবে বিক্ষত হতে থাকে ‘অপর’; অথচ ঠিকঠাকভাবে স্বাধীনতার ব্যঞ্জনা ও স্বাদ উপলব্ধ ও উপভোগ হলে নিজের ভাগে একটু কম পড়লেও অপরে যদি একটু বেশি পেত তাহলে তার ‘সুখ’ কিন্তু অনির্বচনীয়ই হ’ত !
স্বাধীনতা মানুষের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তো কবেই লিখে গেছেন : ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়…!’ স্বাধীনতা হ’ল মানবীয় মর্যাদার রক্ষাকবচ। তবে স্বাধীনতাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের ডোরে বাঁধা না গেলে এই পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়। বস্তুত, স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যবর্তী সীমারেখাটি না বুঝলে মুশকিল। দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাধ্যমে আমরা মানবীয় মর্যাদা লাভ করেছি। সেই মর্যাদার যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন, যা স্বাধীনতার যথার্থ চেতনা ও তার প্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। এই চেতনা শাসক ও শাসিত উভয়েরই আবশ্যক। স্বাধীন দেশের শাসক কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকের মতো নয়। স্বাধীন মানুষের শাসিত হওয়ার অর্থ দাসত্ব করা নয়, বরং তার অধিকার ও কর্তব্যের যথাযথ সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করাই স্বাধীন দেশের শাসকের চরিত্রলক্ষণ। অপরদিকে, নিজের স্বাধীনতাবোধ দ্বারা অন্যের স্বাধীনতা যখন লংঘিত হবে না, বরং সুরক্ষিত হবে, তখনই সেই স্বাধীনতা ইতিবাচক ও সুন্দর। এখানেই আত্মনিয়ন্ত্রণের যৌক্তিকতা। দুঃখজনক ঘটনা হ’ল, নিত্যদিন ছোট ছোট বৃত্তে এটারই ব্যতিক্রম ঘটে থাকে। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট অতিক্রম করে যদি দেখা যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, পিতামাতা সন্তানের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তার উপর ক্রমাগত নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, শিক্ষক ছাত্রকে যন্ত্রবৎ পরিচালনা করতে চায়, যা বিদ্যালয়কে রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘কারাগার’-এ পরিণত করে, স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য দাবি করে, যা কার্যত তার স্বাধীনসত্তাকে অস্বীকার করতে চাওয়ারই নামান্তর। এমন উদাহরণ বিস্তর। এই বিষয়গুলো মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। প্রতিটি মানুষকে, এমনকি একটি শিশুকেও, সম্মান করতে না-জানলে সবার স্বাধীনতার মাধ্যমে মানবীয় মর্যাদার অবাধ বিস্তারও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার সঙ্গে দেশকে ভালবাসার সম্পর্কও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ, যে কাজের দ্বারা দেশের ক্ষতি হয়, সে কাজ স্বাধীনতা আছে বলেই করা যায় না, বরং সেক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতাটা বিসর্জনই দেওয়া উচিত।
একটি ঘটনা বলি, একবার জাপানে এক ট্রেনযাত্রীকে দেখা গেল, তিনি কোনও কারণে ছিঁড়ে যাওয়া ট্রেনের সিটটি নিবিষ্ট মনে সেলাই করছেন। ছেঁড়া অংশটি আরও ছিঁড়ে দেওয়াকে কেউ কেউ স্বাধীনতা ভাবতেই পারে, কিন্তু তাতে কি দেশের উপকার হবে, নাকি ক্ষতি হবে? এখানেই দেশকে ভালবাসার প্রশ্ন এবং উপরে বলা স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে পার্থক্যের প্রশ্ন। ছাত্ররা যদি কাগজের টুকরো বা এটা-সেটা ফেলে শ্রেণিকক্ষটিকে নোংরা করে রাখে তখন ওদের বলা হয় যে, তারা নিজের বাড়ি বা ঘরটিকে কি এভাবে নোংরা করে রাখে? দেশও তো একটা বিশাল ঘর, যাকে সুন্দর রাখা, ভাল রাখা দেশের নাগরিকদের নৈতিক কর্তব্য, দেশের ক্ষতি হয় এমন সমস্ত কাজ থেকে বিরত থাকাও সেই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। আবার বলি, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের একগুচ্ছ মৌলিক কর্তব্যও লিখিত হয়েছে ৫১ এ ধারায়।
এই ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত ও ভারসাম্যমূলক। অধিকার ও কর্তব্যের পারস্পরিক ও অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বোঝার জন্য একটি সহজবোধ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। রাস্তায় স্বাধীনভাবে হাঁটাচলা করতে পারা যেমন একজন নাগরিকের অধিকার তেমনই একজন সহ-নাগরিককেও অবাধে, নির্বিঘ্নে হাঁটতে দেওয়া হচ্ছে কর্তব্য। বস্তুত, অধিকার সচেতনতা ততক্ষণ পর্যন্ত নিরর্থক, যতক্ষণ পর্যন্ত কর্তব্য সচেতনতা বিকশিত না হয়। দুটোই একসঙ্গে বাস্তবায়িত হবে এটাই অভিপ্রেত।
‘স্বাধীনতা’ কেবল বড় প্রিয় এবং আকাঙ্ক্ষিত একটি শব্দ হয়ে থাকলে চলে না। ‘স্বাধীনতা’ কাকে বলে–এই প্রশ্ন যদি করা হয় তাহলে নানা উত্তর পাওয়া যায়। যদিও স্বাধীনতার ‘নানা উত্তর’ হয় না। এর কারণ, বস্তুটা সম্পর্কে আসলে ঠিকঠাক ধারণার অভাব। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষিত থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তিটিকে উচ্চকিত করাটাই দস্তুর। কিন্তু, এর সূচনাটা ব্যক্তিসীমা থেকে–অর্থাৎ, ছোট ছোট বৃত্ত থেকে আগে বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন, মানুষ মানুষের যেমন প্রভু হবে না তেমনই দাসও হবে না। অর্থাৎ, সে স্বাধীন। কিন্তু, বাস্তবে কি সবসময় তা হয়? অফিসের ‘বস’ তার কর্মচারীটিকে মনে করেন ‘দাস’। বাড়ির গৃহপরিচারিকাটিকে মালিক বা মালকিন মনে করেন তাদের ‘দাসী’। ঘরের শিশুটিকে রোজ অন্তত দু’জোড়া রক্তচক্ষুর সামনে থাকতে হয়, তার ‘ইচ্ছে-অনিচ্ছের’ কোনও দাম নেই, সে ‘তেলের শিশি’ও ভাঙলে মুশকিল। এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। যদি বলি পাখিরও স্বাধীনতা আছে, গাছেরও স্বাধীনতা আছে, নদীরও স্বাধীনতা আছে তাহলে তো বোধহয় অধিকাংশ লোকই মূর্ছা যেতে পারে! অন্যদিকে, নিজেই নিজের ‘প্রভু’ হয়ে নিজেকেই ‘দাস’ বানিয়ে ফেলারও ব্যাপারস্যাপার আছে। কীরকম? এখানে নিজের ‘প্রবৃত্তি’ হচ্ছে ‘প্রভু’, আর নিজের মন বা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হচ্ছে তার ‘দাস’। ‘আমার যা ইচ্ছে তাই করব, বাধা দেওয়ার কে আছে বা কী আছে! কারণ, এরই নাম তো স্বাধীনতা’–এই চমৎকার তত্ত্বটা এই খোপে সেঁধিয়ে আছে! মানে, ‘যা ইচ্ছে’ এখানে প্রভু, আর ‘তাই করব’ হল দাস। এই হচ্ছে অবস্থা। দিনের শেষে সবমিলিয়ে যেটা দাঁড়ায় সেটা হ’ল, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে আমরা কেবল গ্রহণ করেছি ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তির একটি প্রক্রিয়া বা পরিণাম হিসেবে। আর কিছু নয়। এ হ’ল আমাদের ভাবনার স্থবিরতা বা জড়ত্ব। অনেকেই ‘চিত্তের স্বাধীনতা’ খুব জরুরি বলেন। জরুরি তো বটেই। কিন্তু, আগে তো ‘চিত্ত’টিকে ঠিকমতো গঠন করতে হবে। স্বাধীনতার পরিধি না বুঝলে ‘চিত্তের স্বাধীনতা’ যা খুশি করার অনিবার্য পরিণাম ডেকে আনতে বাধ্য।
উত্তর-স্বাধীন বাংলাদেশে একটি কথা সবসময়ই খুব চর্চিত হয়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। আমরা এইধরনের কোনও শব্দচয়ন করতে পারিনি। এবং, অনুরূপ চর্চাও তাই এখানে অদৃশ্য। পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা প্রাপ্তি পর্যন্ত যে বিপুল ইতিহাস সে সম্পর্কে নিবিড় চর্চা তেমন একটা হয় না। হয় না বলা যদিও একটু ভুল–হয়, কিন্তু তা মূলত বৌদ্ধিক উচ্চমার্গের বৃত্তেই প্রায় সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষের অবস্থান তার থেকে অনেকটাই দূরে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বলতে মূলত বোঝে কতিপয় স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। আর, টুকরো কিছু ঘটনা। যদিও সেটাও পূর্ণাঙ্গ নয়–ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। এর অনিবার্য ফল হচ্ছে, ইতিহাসের নামে কল্পিত, অসত্য, অর্ধসত্য কিছু গল্পগাছা বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া সহজ হয়ে যায়। ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’–কিন্তু, কে মেলাবেন সেটাও খুব সমস্যার কথা। সাধারণ মানুষের মনে যদি স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস জানার প্রতি আগ্রহটা পল্লবিত হ’ত তাহলেই সমস্যার মেঘ কেটে যেত। তখন ‘স্বাধীনতার চেতনা’র চর্চাও খুব সহজ হয়ে উঠত। খুব জরুরি।