‘স্ত্রীধন’ ও ভারতীয় সমাজে নারী: আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান
অলঙ্কার একদিকে যেমন মানুষের সাজসজ্জার উপকরণ, অন্যদিকে তেমনই ধাতু ও রত্নে নির্মিত অলঙ্কার তার মূল্যের কারণে মানুষের কাছে হয়ে ওঠে সম্পদ। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষ ও নারীর উভয়েরই অলঙ্কার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অলঙ্কার ক্রমশ নারীর সঙ্গেই অধিক সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ কর্মবিভাজন। ঘরের বাইরের কাজে পুরুষের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সাজসজ্জার জন্য ব্যয় করার মতো সময়ের অভাবে, সপ্রতিভভাবে কাজ কর্মের সুবিধার্থে এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে পুরুষের অলঙ্কার ব্যবহারের চল কমে যায়। অন্যদিকে আবার শাসক শ্রেণী ও অভিজাত গোষ্ঠীর পুরুষরা দৈহিক পরিশ্রমের বাধ্যতা থেকে মুক্ত ছিলেন। তাঁদের ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও। তাই তাঁদের মধ্যে থেকে যায় অলঙ্কার পরিধানের অভ্যাস। কিন্তু অলঙ্কারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে নারীর জীবন। অলঙ্কারের সঙ্গে তাই সংশ্লিষ্ট হয়ে ওঠে ‘স্ত্রীধন’-এর ধারণাটি।
প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রগুলির মধ্যে মনুসংহিতাতেই প্রথম স্ত্রীধন হিসেবে অলঙ্কারের গুরুত্ব খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও স্ত্রীধন মাত্রই অলঙ্কার –এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। এর আওতায় পড়ে কিছু নগদ অর্থও, যা নারীকে বিবাহে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে বিবাহে নারীকে পরিবার, বন্ধুবর্গ এবং স্বামীর পরিবার যা উপহার দিত তাই হল স্ত্রীধন। এই উপহারে প্রাপ্য ধনই নারীর সবটুকু সম্বল হয়ে উঠেছিল কারণ নারী ও পুরুষের কর্মবিভাজনের পর থেকেই উৎপাদিত সম্পদের ওপর নারীর কোনো অধিকার ছিল না।
ইতিহাসের আলোচনায় আমরা দেখেছি, শ্রমবিভাজনের মধ্য দিয়েই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে এবং নারী অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। পুরুষ নারীকে সন্তান উৎপাদন ও সন্তান প্রতিপালনের যন্ত্রে পরিণত করে রাখে। সম্পত্তির ওপর পুরুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই মালিকানার বিশুদ্ধ রক্তের উত্তরাধিকারকে নিশ্চিত করতে, নারীর একগামিতা বজায় রাখতে, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি হয়। সেই থেকেই শুরু হয় নারীর ওপরের পুরুষের অবদমন। এখান থেকে অনুমান করা যেতে পারে, নারী অন্য কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারত না বলেই তাঁর ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তাটুকু পেতে স্ত্রীধনকেই আঁকড়ে ধরেছিল।
প্রাচীন ধর্মসূত্রগুলিতে স্ত্রীধনের ওপর স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করার প্রমাণ পাই। মনুসংহিতায় নারীর স্ত্রীধনের কতগুলি শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। বিবাহের সময় অগ্নির সামনে নারীকে যা দেওয়া হত তাকে বলা হয়েছে ‘অধ্যগ্নি।’ যা স্বামীগৃহে যাওয়ার সময় তাকে পথে দেওয়া হত তার নাম হয়েছে ‘অধ্যাহবনিক।’ আর যা তাকে স্নেহবশত তার ভাই বা মাতা-পিতা দিত সেই ধনকে বলা হয়েছে ‘অপরে।’ মনুসংহিতায় এও বলা হয়েছে, যদি কোনো কারণে স্বামী বধূকে কোনো স্ত্রীধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার জীবদ্দশায় প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারে, তখন পুত্রদের দায়িত্ব হবে মা’কে সেই স্ত্রীধন প্রদান করার। মনুর স্ত্রীধন বিষয়ক বক্তব্যকে আরও জোরালো করেন যাজ্ঞবল্ক্য। অপরার্ক বলছেন, ‘স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা এমনকি পিতারও অধিকার নেই নারীর স্ত্রীধন কেড়ে নেওয়ার।’ আপস্তম্ভ ও বৌধায়নের মতে অলঙ্কারের উত্তরাধিকার মাতা থেকে কন্যায় হস্তান্তরিত হবে। পারস্কর তাঁর গৃহ্যসূত্রে বলেছেন কেবলমাত্র কন্যাসন্তান না থাকলেই মায়ের মৃত্যুর পর অলঙ্কার পুত্রের কাছে যেতে পারে। বশিষ্ঠও বলেছেন মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের স্ত্রীধন কন্যাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। কৌটিল্যও তাঁর অর্থশাস্ত্রে স্ত্রীধনের ওপর নারীর স্বাধীন অধিকার জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন।
মনু ও যাজ্ঞবল্ক্যের পরবর্তী স্মৃতিকারেরা, যেমন নারদ, বৃহস্পতি, কাত্যায়ন প্রমুখ স্ত্রীধন প্রসঙ্গে আরও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। অধ্যগ্নি, অধ্যাহবনিক ও অপরে ছাড়াও স্ত্রীধনের আরও কয়েকটি বিভাগ উল্লেখ করেছেন কাত্যায়ন। সেগুলি হল, কন্যার ওপর ধার্য মূল্য (শুল্ক), স্বামী ও পিতামাতার পরিবার থেকে প্রদত্ত ধন (অন্বাদেয়), এবং কুমারী অবস্থায় নারীর প্রাপ্য ধন (সৌদায়িক)। স্ত্রীধনের বিলি বন্দোবস্ত বা বিক্রয়ের অধিকার একমাত্র নারীরই থাকবে বলে নিশ্চিত করেছেন কাত্যায়ন। যাজ্ঞবল্ক্যকে অনুসরণ করে নারদ বলেন যে স্ত্রীধনের উত্তরাধিকার মা থেকে মেয়েতে বর্তাবে। আবার, বৃহস্পতি বলেন যে অবিবাহিতা মেয়েরাই তার মায়ের অলঙ্কার পাবেন। বিবাহিতারা পাবেন কিছু নগদ অর্থ।
এখন প্রশ্ন হল, প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রকাররা এত জোরের সঙ্গে স্ত্রীধন হিসেবে অলঙ্কারের ওপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন কেন? এ কি নারীদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতির প্রকাশ? নাকি এর মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্রের স্বার্থ? এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে সেই শাস্ত্রগ্রন্থগুলির প্রতিটি শ্লোকে। মনুসংহিতার শ্লোকগুলিতেই প্রথমে চোখ রাখা যাক। সেখানে বলা হচ্ছে, নারী যদি পোশাক ও অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতা না থাকে তবে তার স্বামী তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। স্বামী যদি নারীর প্রতি প্রীত না হয় তবে সন্তানোৎপাদন সম্ভব হয় না। এও বলা হচ্ছে, যদি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর রুচি না থাকে, তাহলে স্ত্রীর ব্যভিচার দোষ ঘটে। সুতরাং, একথা স্পষ্ট যে নারীকে তার স্বামীর ভোগ্যপণ্য ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই দেখা হয়েছে। নারীকে অলঙ্কারসজ্জিতা করে রাখার কথা বলা হয়েছে যাতে স্বামী তার প্রতি আকৃষ্ট হয় ও তাদের মিলন সম্ভব হয়। এই মিলনের ফলে একদিকে যেমন সন্তান উৎপাদন সম্ভব হবে তেমনই নারী তার স্বামীর কাছ থেকে তৃপ্ত হলে তার একগামিতাও বজায় থাকবে। মনুসংহিতায় এও বলা হচ্ছে, যে পরিবারে স্ত্রীরা বস্ত্র ও অলঙ্কার দ্বারা পূজিত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন। তাই বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্ত্রী’কে পোশাক ও অলঙ্কার উপহার দিয়ে খুশি করতে পারলে পরিবারের কল্যাণ হবে।
যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে বলা হচ্ছে কোনও নারীর স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে সান্ত্বনাস্বরূপ প্রথম স্ত্রীকে কিছু স্ত্রীধন প্রদান করবেন। পুরুষতন্ত্রের নৃশংস প্রবণতা এখানে স্পষ্ট। নারী তার আবেগ ও শ্রম দিয়ে স্বামী ও তার পরিবারের সেবা করবে, সন্তান ধারণ ও পালন করবে। সেই সন্তান পরিবারের কর্ম ও উপার্জনের উত্তরাধিকারী হবে। আবার স্বামী চাইলেই দ্বিতীয় বার বিবাহ করে অন্য নারীর সঙ্গে জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু স্ত্রী চিরজীবনের জন্য স্বামীর প্রতি অনুগত থাকবে। এই সকল বৈষম্যকে একজন নারী যাতে পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে নীরবে মেনে নেয়, তা নিশ্চিত করতে উৎকোচ হিসেবেই স্ত্রীধন প্রদান করার দরকার ছিল। সুতরাং, নারীকে সন্তুষ্ট করতে ও সান্ত্বনা দিতে স্ত্রীধনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সে কেবলমাত্র যন্ত্র নয়। তার আবেগ অনুভূতিও রয়েছে। সেই দিকটিও তো আধিপত্যকামী পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজন।
যে ধর্মসূত্রগুলি স্ত্রীধনের ওপর নারীর অধিকারকে নিশ্চিত করেছে, সেখানেই স্পষ্ট চিহ্নিত আছে এই অধিকারের ওপর পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণরেখাটিও। অপরার্ক লিখছেন দুষ্টা ও অপব্যয়ী নারী স্ত্রীধনের ওপর অধিকার হারাতে পারে। সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট স্ত্রীকে দুষ্ট ও অপব্যয়ী অপবাদ দিয়ে পুরুষ যে কোনও সময়ই তার স্ত্রীধন ছিনিয়ে নিতে পারে। কারণ কোনটা নারীর দুষ্ট চরিত্রের লক্ষণ আর কোনটা তার সদচরিত্রের বৈশিষ্ট্য সেটাও পুরুষতন্ত্রই নির্মাণ করেছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেনঃ
এই ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা মনে করি যে জুয়াখেলে, সুরা ও নারীতে এমনকি কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যকলাপে সম্পত্তি উড়িয়ে দিলেও স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করার স্ত্রীর কোনো অধিকার নেই।
সুতরাং, একথা স্পষ্ট পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের স্বার্থেই স্ত্রীধনের ওপর নারীর অধিকারকে নির্দিষ্ট করেছে, আবার নিজের স্বার্থেই সেই অধিকারের নিয়ন্ত্রণকেও পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছে।
একদিকে নারীর স্বাধীন অধিকার, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ-এই বৈপরীত্যকে অন্তরে নিয়েই স্ত্রীধন হিসেবে অলঙ্কারের ধারণা ভারতীয় সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পারিবারিক ও সামাজিক কিছু রীতিনীতি ও প্রথা তাকে লালন করেছে নারীদের মধ্যেও। আবার, নারী যখন শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে, তখন সে আরও বেশি করে সচেতন হয়ে পড়েছে স্ত্রীধনের অধিকার সম্পর্কে। এই শিক্ষিতা নারী যখন অন্দরমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে নিজেদের ভূমিকা তুলে ধরতে চেয়েছে তখন আবার নতুন প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে স্ত্রী ও স্ত্রীধনের সম্পর্ক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ যুক্তি ও জ্ঞানের যে আলো জ্বালিয়েছিল, তাতে আলোকিত হয়েছিলেন এদেশের মেয়েরা। একদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্র ধরে পাশ্চাত্যের দর্শন ও আধুনিক চিন্তাধারা ভারতীয় সমাজের একটি স্তরে প্রবেশ করে। সেই চিন্তাধারাই জন্ম দেয় নারীস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর ধারণা। তার ফলে তখনকার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে সাধারণ মানুষের কথা, নারীদের প্রতিদিনের জীবনের কথা খুব বেশি করে উঠে আসতে থাকে। অলঙ্কার যেহেতু, মানুষের এই প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের সঙ্গে যেহেতু জড়িয়ে থাকে তাই এই সময়ের সাহিত্যগুলিতে অলঙ্কারের কথা খুব বেশি করে পাওয়া যায়। বিশেষ করে, শিক্ষিতা মেয়েদের লেখালিখিতে ফুটে ওঠে স্ত্রীধন সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের ভাবনা। এই সময়ের আলোকপ্রাপ্ত উচ্চবর্গীয় পরিবারের নারীরা স্ত্রীধনের ওপর তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। কৈলাসবাসিনী দেবীর ডায়েরিতে দেখা যায় নারীরা নিজেদের মধ্যে স্বাধীনভাবে অলঙ্কার বিনিময় করছেন, বন্ধক দিচ্ছেন, এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ও করছেন। পরিবারের পুরুষরা এসবের খবরও রাখছেন না। স্ত্রীধন তাঁদের কাছে যথার্থই স্ত্রীর স্বাধীন অর্থনৈতিক অবলম্বন।
আবার, আকস্মিক কোনও আর্থিক সমস্যার দিনে নারী তার স্ত্রীধন পরিবারের অভিভাবকদের হাতে তুলেও দিতেন। স্ত্রীধনের এই তাৎপর্যের কথা ধর্মশাস্ত্রেও উল্লেখিত আছে। যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতায় বলা হয়েছে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে স্ত্রী তাঁর স্ত্রীধনের অধিকার ছাড়তে পারেন। যেমন, দুর্ভিক্ষ, কোনও বিশেষ কার্যকর ধর্মীয় অনুষ্ঠান অথবা স্বামী ও পরিবারের অসুস্থতায়। কিন্তু শুধু পারিবারিক প্রয়োজনেই নয়। বহু সময় নারীরা সমাজ ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁদের স্ত্রীধন দান করেছেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসেও আমরা দেখেছি বিশাখা অথবা আম্রপালির মতো নারীরা বৌদ্ধসংঘগুলিতে তাঁদের অলঙ্কার দান করেছেন। স্ত্রীধনকে অবলম্বন করে বৃহত্তর জগতে নারীর জায়গা করে নেওয়ার ঐতিহ্য তাই আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন রূপে এই ঐতিহ্যের অনুশীলন পরিলক্ষিত হয়।
দেশের সর্বস্তরের মানুষকে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মঞ্চে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি। তাঁর আহ্বানে দলে দলে নারী এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে। সভা-সমিতি ও সমাবেশে গান্ধিজি নারীর উদ্দেশ্যে আবেদন রাখতেন স্বাধীনতা আন্দোলনের তহবিলে তাঁদের স্ত্রীধন প্রদান করার জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা তাই তাঁদের অলঙ্কার দান করতে এগিয়ে আসেন।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের স্মৃতিতে ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’ গঠিত হলে দেশজুড়ে বহু নারী এই তহবিলে তাঁদের স্ত্রীধন প্রদান করেন, আবার এই তহবিল সংগ্রহের কাজেও যোগ দেন নারীরা। অগ্নিযুগের স্মরণীয় বিপ্লবী বীণা দাসও তাঁর বাল্যকালে এই তহবিলে অলঙ্কার প্রদান করেছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থসংগ্রহের পাশাপাশি নারীদের থেকে অলঙ্কার সংগ্রহ করতেন রেণুকা রায়। তিনি জানাচ্ছেন –
অনেক সময় বাড়ির মেয়েরা বাড়ির পাশের গলি দিয়ে লুকিয়ে তাঁদের কাছে এসে জানান, বাড়ির পুরুষদের অনুপস্থিতিতে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে এলে তাঁরা সাহায্য করতে পারবেন। হাতে নগদ অর্থ না থাকায় অনেকেই তাঁদের গয়না তুলে দেন তহবিলে।
হরিজন আন্দোলনের সময় বাঙ্গালুরুতে একটি জনসভায় গান্ধিজি নারীদের আহ্বান জানান তাঁদের স্ত্রীধন প্রদান করার। তার ফলে মাত্র একদিনের মধ্যে মোট ৯০,০০০ টাকার অলঙ্কার সংগৃহীত হয়। নিজেদের সর্বস্ব অলঙ্কার প্রদান করে সারা দেশের নারীদের পথ দেখান মহীশুরের রাজাম্মা, সুবাম্মা এবং গৌরাম্মা। ১৯৩৪ সালে আরেকটি সমাবেশে মালাবারের ষোড়শী বালিকা কৌমুদি তাঁর বিবাহের জন্য সঞ্চিত সকল অলঙ্কার গান্ধিজিকে দিয়ে দেন। অলঙ্কার ছাড়া তাঁর বিবাহ কীভাবে হবে এমন প্রশ্ন ওঠায় তিনি বলেন, “আমি অপেক্ষা করব সেই পুরুষের জন্য যে আমাকে বিবাহ করবে, আমার অলঙ্কারকে নয়।” গান্ধিজি সেই বালিকাকে বলেছিলেন, “তোমার ত্যাগই তোমার প্রকৃত অলঙ্কার।”
আবার, সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার স্বাধীনতা সংগ্রামের তহবিল গড়ে তুলতেও স্ত্রীধনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনন্ত সিংহের স্মৃতিচারণায় জানা যায় মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রামের বহু নারী এই বিপ্লবীদের হাতে তাঁদের অলঙ্কার তুলে দিয়েছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধিজির মত ও পথের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ ও নারীদের মধ্যে গান্ধিজি যে জাগরণ এনেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতের বাইরে থেকে সামরিক আঘাত হেনে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে যে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, তার তহবিলে এবং নেতাজি গঠিত আজাদ হিন্দ সরকারের তহবিলে বহু নারী তাঁদের অর্থ ও অলঙ্কার প্রদান করেন। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে গঠিত এই বাহিনীর রাণী ঝাঁসি ব্রিগেডে যোগদান করেন বহু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু ধর্ম, বর্ণের নারীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভারতবর্ষকে কোনোদিন দেখেননি। তা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের সর্বস্ব দান করতে প্রস্তুত ছিলেন।
কিন্তু শুধুই আন্দোলনের তহবিলে স্ত্রীধন প্রদান করা নয়, স্ত্রীধনের অধিকার ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি অভিনব ঘটনা জানা যায় কে. এস. গিয়ানি’র স্মৃতিচারণায়। তিনি জানিয়েছেন ১৫ বছর বয়সী একটি মুসলমান মেয়ে রাণী ঝাঁসি বাহিনীতে যোগ দিতে এসেছিলেন। তার পিতা ও মাতা তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে সে ফিরে যেতে অস্বীকার করে। তখন তার অভিভাবকরা তাকে জানায় যে ঘরে ফিরে না এলে তার সমস্ত অলঙ্কার অভিভাবকদের ফিরিয়ে দিতে হবে। মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে এক এক করে সব অলঙ্কার খুলে দিয়ে দেয়। ছোট্ট মেয়েটির এই স্পর্ধা দেখে তার বড় দিদি কঠিন স্বরে জানায় “তোমার এই গয়না ও কাপড় দিয়ে আমরা তোমার নামে তোমার শেষ কার্য সম্পন্ন করব।” এতেও বিচলিত না হয়ে সেই ছোট মেয়েটি উত্তর দেয়, “সত্যিই তো! আজ থেকে আমি তোমাদের কাছে মৃত। দেশ সেবার ব্রতে আমার আজ পুনর্জন্ম হল।”
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন ধারায় নারীদের স্ত্রীধন প্রদানের ঘটনা একদিকে যেমন দেশের মুক্তি সংগ্রামকে শক্তি সঞ্চার করেছে, তেমনই স্ত্রীধনকে অবলম্বন করে ভারতের নারী দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে নিজেদের কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। প্রাচীন শাস্ত্রশাসিত সমাজ পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থ চরিতার্থ করতেই স্ত্রীধনের ধারণাকে নির্মাণ করেছে এবং স্ত্রী ও স্ত্রীধনের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণের অধিকার পুরুষতন্ত্রের হাতেই তুলে দিয়েছে একথা ঠিক। কিন্তু সময়ের পথ বেয়ে নারী যখন পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বৃহত্তর পৃথিবীর অঙ্গনে পা বাড়িয়েছে তখন আবার স্ত্রীধন হয়ে উঠেছে তার ক্ষমতায়ন ও আত্মপরিচয় নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
—–
তথ্যসূত্র
১) কৈলাসবাসিনী দেবী, (১৩৮৮, শারদীয়া)। ‘জনৈকা গৃহবধূর ডায়েরি’ (পুনর্মুদ্রণ)। এক্ষণ (সম্পাঃ নির্মাল্য আচার্য)।
২) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (২০০১)। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ। কলকাতাঃ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
৩) ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (২০১৪)। পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি।কলকাতাঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
৪) ভরতচন্দ্র শিরোমণি (১৩০৪ বঙ্গঃ)। মনুসংহিতা (অনুঃ)। কলকাতাঃ বসুমতী সাহিত্য মন্দির।
৫) সুকুমারী ভট্টাচার্য (২০২০)। প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ (অনুঃ বিজয়া গোস্বামী, নীলাঞ্জনা শিকদার দত্ত, করুণাসিন্ধু দাস)। কলকাতাঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
৬) সৌমেন বসু, মানব বেরা (সম্পা) (২০২১)। অনন্য দেশনায়ক (সং. দ্বিতীয়)। মেদিনীপুর: বিপ্লবী জনমত প্রকাশনা।
৭) Divya Sekhar (2018, October 4). ‘Donate ‘streedhan’: In 1927, Gandhi persuaded women in Bengaluru to make a difference.’ The Economic Times. Available: https://economictimes.indiatimes.com/magazines/panache/donate-streedhan-in-1927-gandhi-persuaded-women-in-bengaluru-to-make-a-difference/articleshow/66065951.cms
৮) Dr. Ram Ponnu (ND). ‘Kaumudi:` A symbol of renunciation.’ Mahatma Gandhi. Available: https://www.mkgandhi.org/articles/kaumudi-a-symbol-of-renunciation.html#.Y9WDJ6-XfHA.whatsapp
৯) Renuka Ray (1982). My Reminiscences: Social Development during Gandhian Era. N. Delhi: Allied Publishers Private Limited.
ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে।