মেদিনীপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্প নকশাবড়ি

মেদিনীপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্প নকশাবড়ি

স্মৃতির ঝাঁপিঃ

নকশা বড়ি (ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত)

শীতকাল এলে ছোটোবেলায় তিনটে জিনিসের জন্যে মুখিয়ে থাকতাম। প্রথমটা হল পিঠে, দ্বিতীয়টা হল খেজুর রস, আর তৃতীয়টা হল বড়ি। আর এই তিনটে জিনিসের মধ্যে দুটি জিনিসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যিনি যুক্ত থাকতেন তিনি হলেন আমার দিদিমার মা, মানে আমার ‘বড়মা।’ বড়মা মানেই ওঁর হাতে তৈরি সরুচাকলি পিঠে আর নারকেল কোরা দিয়ে পুলি পিঠে এবং বড়ি। আমার বড়মার বাড়ি ছিল তৎকালীন মেদিনীপুর (বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর) জেলার চণ্ডীপুরে হাঁসচড়া গ্রামে। জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে এসেছি বড়মা প্রতি শীতের শুরুতে একাই হাজির হয়ে যেতেন মেদিনীপুর থেকে আমাদের বাড়িতে, মানে সুন্দরবন অঞ্চলের পশ্চিমপ্রান্তে কাকদ্বীপের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। মেদিনীপুরে বড়মার কোনও পিছুটান ছিল না। বড়মা কম বয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁর বড়ো নাতনিকে, অর্থাৎ আমার মা’কে অনেকদিন কাছে রেখে পড়িয়েছিলেন। তারপর আমার দিদিমাও কম বয়সে প্রয়াত হন। আর তাই সন্তানহারা বড়মা আমার মায়ের টানে বছরে একবার চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। পুরো শীত ও বসন্তকাল কাটিয়ে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি দেশে ফিরে যেতেন।

শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে যখন মাঠ ভরে যেত সবুজ কচি ধানগাছে তখন আমাদের জমির মাঝে আলগুলোতে বাবা বিরিকলাইয়ের দানা ছড়িয়ে দিতেন। কখনও কখনও আমিও ছড়িয়েছি। তারপর ঘাসের মধ্যে থেকে বিরিকলাই গাছ বেরিয়ে এসে আলগুলো ভরিয়ে দিত। অঘ্রাণ মাসে যখন ধান পাকত তখন বিরিকলাইয়ের শুঁটিও পাকত। তখন আল থেকে শেকড়শুদ্ধ বিরিকলাইয়ের গাছ উপড়ে এনে খামারে জড়ো করা হত। তারপর বাড়ির সবাই যে যার অবসর সময়মতো সেই গাছ থেকে শুঁটিগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আলাদা করতাম। রোমশ গাছ থেকে শুঁটি ছেঁড়ার সময় হাত চুলকাত । শুঁটিগুলো ছেঁড়া সম্পূর্ণ হলে সেগুলি রোদে দেওয়া হত। তারপর শুকিয়ে গেলে কিছু শুঁটি আপনাআপনি ফেটে ভেতর থেকে কালো কালো দানা বেরিয়ে আসত। আর বাকি দানাগুলোকে বার করার জন্য কাঠের মুগুর দিয়ে পেটাই করা হত। তারপর প্রথমে কুলোর বাতাস দিয়ে ও পরে কুলোতে পাছড়িয়ে শুঁটি থেকে দানাগুলোকে ঝাড়াই-বাছাই করা হত। পাছড়ানোর মাধ্যমেই পুষ্ট ও অপুষ্ট দানাগুলোকে আলাদা করে নেওয়া হত। ঠিক এই সময়েই হাজির হয়ে যেতেন আমার বড়ি বিশেষজ্ঞ সত্তরোর্ধ্ব  বড়মা।

বড়মা নানা রকমের বড়ি তৈরি করতে পারত যেমন ফুলবড়ি, মশলা বড়ি, বাতাসা বড়ি, চালকুমড়োর বড়ি ইত্যাদি। কিন্তু সবার সেরা বড়ি ছিল নকশাবড়ি। কী অনায়াস দক্ষতায় বিরিকলাইয়ের বাটা দিয়ে বৃদ্ধা হরেক রকম অলঙ্কারের নকশা এঁকে চলতেন কাঁসার থালার উপরে দেখে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকতাম। কখনও কখনও ফুল, পাতা বা পাখির আকারও ফুটিয়ে তুলতেন বড়ির নকশায়। এই বড়ির নকশায় মূলতঃ গয়নার নকশা প্রাধান্য পায় বলে এই বড়িকে অনেকে গয়নাবড়িও বলেন। জোর শীত পড়লে এক সকালে বড়মা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিয়ে পরিষ্কার শাড়ি পরে উঠনে বড়ি দেওয়ার সরঞ্জাম নিয়ে বসতেন। বড়মার প্রধান সঙ্গী হত আমার মা। পাশে বসে সারাক্ষণ কলাইবাটা ফেটিয়ে যেত। তারপর সেইসব অনিন্দ্যসুন্দর নকশার বড়িগুলোকে কয়েকদিন ধরে বড়মা সাবধানে শুকিয়ে নিতেন। তারপর কৌটোবন্দি করতে পারলে বড়মার ছুটি। মা সেই বড়িগুলো মাঝে মাঝেই দুপুরে ভাতের সাথে বা সকালে চায়ের সাথে গরমাগরম ভেজে পরিবেশন করত। যেমন হালকা, তেমন তার স্বাদ। এ স্মৃতি চিরন্তন। বড়মার প্রয়াণের পর আমাদের বাড়িতে নকশাবড়ি তৈরির একমাত্র কারিগর হল আমার মা।

বিস্ময়-শিল্পকলাঃ

নকশাবড়ি জিনিসটি একান্তভাবেই মেদিনীপুরের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা। বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা, ময়না, পাঁশকুড়া, কাঁথি, চন্ডীপুর, ভগবানপুর, নন্দকুমার, হলদিয়া, এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চল নকশাবড়ির জন্য বিখ্যাত। এইসব অঞ্চলের মূলতঃ বনেদি বাড়ির মহিলারাই নকশাবড়ি শিল্পের ধারক ও বাহক। তাঁদের হাত ধরে এই শিল্পকলা দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, ও সাগর ব্লকে এবং হাওড়া জেলার কোথাও কোথাও বিস্তারলাভ করেছে। আর মা-মাসিমা, দিদিমা-ঠাকুরমাদের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় এই অত্যাশ্চর্য শিল্পকলার ব্যবহারিক জ্ঞান প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

১৯৩০ সালে সেবা মাইতি নামে মহিষাদলের লক্ষ্যা গ্রামের এক ছাত্রী শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর মা হিরণ্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবীর হাতে তৈরি নকশাবড়ি উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রথম নকশাবড়ির সাথে পরিচিত হন। আর তিনি এর অনুপম শিল্পকলা দেখে এতটাই আপ্লুত হন যে বলে ওঠেন, “গহনা বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়।” তিনি হিরণ্ময়ী দেবী ও শরৎকুমারীদেবীকে চিঠি লিখে ওই বড়ির আলোকচিত্র শান্তিনিকেতনের কলাভবনে সংরক্ষণ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ার খোটানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে আবিষ্কৃত প্রাচীন শিল্পকলার সাথে নকশাবড়ির শিল্পকলার সাদৃশ্যও খুঁজে পেয়েছিলেন। চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু বলেছিলেন যে এই বড়ি হল বাংলা মায়ের গয়নার বাক্সের এক রত্ন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো নকশাবড়ির কারুকাজকে দেখে এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি এই বড়ি খাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। কারণ তাঁর মতে, এই বড়ির শিল্পকর্ম এতটাই উন্নতমানের যে এই বড়ি খাওয়ার অর্থ শিল্পকলাকে ধ্বংস করা! অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর “আগন্তুক” সিনেমায় ময়নার রাজ পরিবার থেকে পাঠানো নকশাবড়ি দেখিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে কল্যাণীতে আয়োজিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫৯ তম অধিবেশনে নকশাবড়ির প্রদর্শনী হয়।

নকশাবড়ির রসায়নঃ

নকশাবড়ির প্রধান কাঁচামাল হল বিরিকলাই। মেদিনীপুরের কথ্য ভাষায় বিরিকলাই হল শুদ্ধ বাংলায় বিউলির ডাল। অনেক জায়গায় বিরিকলাইকে মাষকলাইও বলা হয়। হিন্দিতে বলে উর্দ। ইংরেজিতে বলে Moth bean। ভাতের সাথে খাওয়ার ডাল হিসেবে অনেকের কাছে খুব প্রিয় বিউলির ডাল। খোসাসমেত এই ডালের রঙ কালো। তবে কালোর উপরে একটা সাদা দাগ থাকে। নকশাবড়ি তৈরি করতে হলে চাই নতুন বিরিকলাই। নতুন ডালের আঠালোভাব বেশি থাকায় এই ডাল থেকে বড়ি ভালো হয়। সাধারণতঃ যাঁদের বাড়িতে এই বড়ি দেওয়া হয় তাঁরা নিজেরাই বিরিকলাই চাষ করেন।

বড়ি দেওয়া হয় সাধারণতঃ অগ্রহায়ণ মাসে যখন শীতের উত্তুরে শুকনো বাতাসের প্রাবল্য বেশি থাকে। তবে সংস্কার মেনে অনেকে কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বড়ি দেওয়ার শুভ সূচনা করে। প্রথমে খোসাযুক্ত গোটা ডাল বাড়িতে ‘চাক’-এ (যাঁতায়) ভেঙে প্রতিটি ডালকে দু’টুকরো করা হয়। তবে কিছু ডাল বেশি ভেঙে যেতে পারে। ভাঙা ডাল কুলোয় পাছড়িয়ে ভালো ডাল থেকে খারাপ ডাল আলাদা করা হয়। বড়ি দেওয়ার আগের দিন রাতে খোসাসমেত আধাভাঙা বিরিকলাই জলে ভিজিয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে জল থেকে ছেঁকে ফুলে যাওয়া বিরিকলাই তুলে চটের বস্তার উপর ঘষা হয় যাতে ডালের উপর থেকে খোসা ছেড়ে যায়। ভালো করে ঘষার পর জলে ফেললে খোসাগুলো জলে ভেসে ওঠে। এইভাবে খোসামুক্ত ধবধবে সাদা ডালকে নোড়া দিয়ে শিলে মিহি করে বাটা হয়। এতে ডালের আঠালো ভাব বেশি হয়। মিক্সার গ্রাইন্ডারে ডাল পেস্ট করলে মিক্সারে উৎপন্ন তাপ ডালের আঠালোভাব কমিয়ে দেয়। ডালবাটা যত আঠালো হবে ততই বড়ি শক্তপোক্ত হবে, সহজে ভাঙবে না। অভিজ্ঞ মহিলারা সামান্য ডালবাটা দু’ আঙুলের মাঝে নিয়ে আঠালোভাব পরখ করে দেখেন।

বাটা শেষ হলে শুরু হয় ডালের মণ্ড ফেটানোর পালা। কিছুটা ফেটানোর পর পরিমাণমতো নুন মেশানো হয়। নুন বেশি মেশালে বড়িতে জল কেটে যায়। আর সেই বাটা দিয়ে তৈরি বড়িকে বলে ‘ফসকানো বড়ি।’ নুন মেশানো অল্প অল্প বাটা একটা গামলায় নিয়ে হাত দিয়ে ফেটাতে হয়। যত বেশি ফেটানো হয় তত ভালো মানের বড়ি হয়। ফেটানোর মাধ্যমে মণ্ডের মধ্যে যথেষ্ট বাতাস প্রবেশ করে। ফলে মণ্ড হালকা হয় ও ফুলে ওঠে। অভিজ্ঞ মহিলারা সামান্য পরিমাণ ফেটানো বাটা জলে ফেলে দেখে নেন ভেসেছে কিনা। যদি ভাসে তবে বুঝতে হবে ভালো ফেটানো হয়েছে। তবে যতটুকু বাটা দিয়ে বড়ি দেওয়া হয় সেটি বড়ি দেওয়ার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত ফেটাতে হয়। ফেটানো বন্ধ করলে বড়ি মুচমুচে হয় না। সাধারণতঃ নকশাবড়ি দেওয়ায় ওস্তাদ যেসব মহিলা তাঁরা ফেটানোর কাজ করেন না। যাদের বয়স কম বা যারা বড়ি দেওয়া শিখতে চায় তাদের ওপর ফেটানোর দায়িত্ব থাকে।

ডালবাটা তৈরির কাজ যখন চলছে ততক্ষণে নকশাবড়ি দেওয়ার অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে রোদ লেগেছে এমন খামারে বা ছাদে বড়ি দেওয়ার আসর বসানো হয়। সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে পোস্ত, ‘পুঁটলি,’ থালা বা ট্রে বা কুলো এবং ঝাঁটাকাঠি বা উল বোনার কাঁটা। পোস্ত ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হল যাতে বড়ি পাত্রের সাথে আটকে না যায়। তাছাড়া এতে বড়ির স্বাদও খুব ভালো হয়। অবশ্য পোস্ত না পেলে তিলের দানাও বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

পুঁটলি হল নকশাবড়ি দেওয়ার আসল ‘যন্ত্র।’ রুমালের সাইজের একটুকরো মোটা কাপড় বা প্যান্টের কাপড় পুঁটলি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই কাপড়ের টুকরোর মাঝে একটা ছোটো গোলাকার ফুটো তৈরি করা হয়। তারপর ফুটোর পরিধি বরাবর ‘বোতাম স্টিচ’ ধরণের সেলাই করা হয় যাতে চাপে ফুটো বড়ো বা বেমানান না হয়ে যায়। অনেক সময় ওই ফুটোতে এক ইঞ্চি লম্বা ধাতব নল লাগিয়ে দেওয়া হয়।

মেদিনীপুরের কথ্য ভাষায় একে বলে ‘চঙ।’ এই চঙ টিন, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, পিতল বা রূপোর তৈরি হতে পারে। চঙের দু’দিকের ব্যাস অসমান হওয়ায় ফুটোর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দিলে মোটা দিকটা পুঁটলির ফুটোয় আটকে যায়। এই ধরণের পুটলিকে বলে ‘চঙ-পুঁটলি।’ পুঁটলি বা চঙ-পুঁটলির মধ্যে ফেটানো ডালবাটা রেখে পুঁটলির উপরের দিক শক্ত করে ধরে চাপ দিলে ফুটো বা চঙ দিয়ে সরু হয়ে ডালবাটা বেরিয়ে আসে। একে বলে ‘পাপড়ি।’

নকশাবড়ি শিল্পী মেঝে বা মাটিতে উবু হয়ে বা পিঁড়িতে বসে ডালবাটা ভরা পুঁটলি হাতে নিয়ে পোস্ত ছড়ানো থালা বা ট্রে বা কুলোর উপর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাঁর শিল্পকলা ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন। প্রথমে তৈরি করেন নকশাবড়ির ‘বাঁধুনি’ বা ভিত। সাধারণতঃ ডানদিকে (Clock-wise) হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধুনি তৈরি করা হয়। তারপর একবার বামদিকে (Anticlock-wise), আর একবার ডানদিকে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করা হয় নানা ডিজাইন। শিল্পীর আসল দক্ষতা এই হাত ঘোরানোয়। জিলিপি তৈরির প্যাঁচের সাথে নকশাবড়ি তৈরির প্যাঁচের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও নকশাবড়ির প্যাঁচ হয় অনেক জটিল ও তার মধ্যে দিয়ে নানা ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয় যা জিলিপিতে থাকে না। বড়িশিল্পীর মন যত সৃষ্টিশীল হয় নকশাবড়ির ডিজাইন তত বৈচিত্র্যময় হয়। মুকুট, নেকলেস, দুল, কানপাশা, মাকড়ি, টায়রা, বাজুবন্ধ, লকেট, ঝরোখা – কী নেই এইসব ডিজাইনে! একজন দক্ষ বড়িশিল্পী একই ডিজাইনের দুটো বড়ি তৈরি করা নিজের শিল্পসত্ত্বার অক্ষমতা বলে মনে করেন। বাঁধুনির উপর নকশা তৈরি হয়ে গেলে চঙের মুখ থেকে একটু একটু করে ডালবাটা কাঠির সাহায্যে কেটে নিয়ে নকশার উপর সেটিং করা হয়। একে বলে ‘বুটি।’ সাদা বড়ির উপর রঙিন বুটি দিলে নকশাবড়ির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। অবশ্য এজন্য রঙ মেশানো ডালবাটা ও আলাদা চঙ-পুঁটলি দরকার।

একটা বড়ি তৈরি হয়ে গেলে বড়ি-শিল্পী তাঁর বাম হাতে ধরা কাঠির সাহায্যে পুঁটলি থেকে পাপড়ি বিচ্ছিন্ন করে দেন। তারপর বিচ্ছিন্ন প্রান্তটিকে তিনি এমনভাবে প্যাঁচের এক জায়গায় মিশিয়ে দেন যে বোঝাই যায় না বড়িটি কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল, আর কোন জায়গায় শেষ হল। যদি বড়ির নকশা তৈরি করার সময় অসাবধানতাবশতঃ পাপড়ি ভুল জায়গায় পড়ে যায় তখন ওই কাঠি দিয়ে পাপড়িকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বড়ি তৈরির কাজ শেষ করতে হয় চড়া রোদ ওঠার আগেই। নকশাবড়ি তৈরি শেষ হলে চলে শুকোনোর পালা। চড়া রোদে নকশাবড়ি শুকোনো নৈব নৈব চ। নইলে বড়ির নানা জায়গায় সূক্ষ্ম ফাটল ধরে যা স্থানীয় ভাষায় বলে ‘চিড় ফাট।’ এইরকম বড়ি সামান্য নাড়াচাড়াতেই ভেঙে যায় বা ভাজার সময় ভেঙে যায়। এই কারণে শীতের সকালের হালকা রোদ বড়ি শুকোনোর জন্য আদর্শ। বড়ির উপরের দিক শুকিয়ে গেলে হাত বা খুন্তির সাহায্যে সাবধানে উল্টে দিয়ে নীচের দিকটিও শুকিয়ে নেওয়া হয়। তারপর বড়িগুলো কৌটোবন্দি করা হয়।

নকশাবড়ির এক শত্রু হল বাতাসের আর্দ্রতা। তাই বাতাস প্রবেশে অক্ষম এমন কাচের বয়ামে বা টিনের কৌটোয় নকশাবড়ি সংরক্ষণ করা হয়। যদি বাতাস ঢুকে যায় তবে বর্ষাকালে বড়িতে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। ফলে বড়ির রং কালচে বা লালচে হয়ে যায়। এই বড়িকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘ছাতানি বড়ি।’ আবার শীতকালে শুকোনোর পর নকশাবড়িকে কৌটোবন্দি না করে বাইরে রেখে দিলে শুকনো বাতাসের প্রভাবে বড়ি অত্যধিক শুকিয়ে যাওয়ায় বেঁকে যায়। এরকম বাঁকা নকশাবড়িকে বলে ‘ধনুকলাগা বড়ি।’ এরকম বড়িকে রাতের শিশিরে সামান্য সিক্ত করে তারপর সামান্য চাপ দিয়ে সোজা করা হয়। এরপর বাড়িতে কোনও অতিথি এলে চায়ের সাথে বা ভাত খাওয়ার সময় ছাঁকা তেলে মুচমুচে করে ভাজা নকশাবড়ি প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। ভাজার সময় খেয়াল রাখতে হয় যাতে বেশি ভাজা হয়ে না যায়। তাহলে বড়ির রঙ কালচে হয়ে যার, আর স্বাদও নষ্ট হয়।

নকশাবড়ির ইতিবৃত্তঃ

নকশাবড়ি কবে থেকে মেদিনীপুর এলাকার ঐতিহ্যবাহী শিল্প হয়ে উঠল তা সঠিক জানা না গেলেও তা যে ভারতে ব্রিটিশ আগমনের আগে তা নিশ্চিত। এই বড়ির উৎপত্তির পেছনে রয়েছে প্রাচীন নারীসমাজের এক সকরুণ কাহিনি। প্রাচীন বঙ্গে বাল্যবিধবাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তাদের মাথা মুড়িয়ে সাদা থান পরতে বাধ্য করা হত। তাদের কোনও শুভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি ছিল না। তাদের কোনও আমিষ খাবার খাওয়ার অধিকার ছিল না। তাদের কোনও অলঙ্কার পরার অধিকার ছিল না। কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে তাদের নিরানন্দময় জীবন অতিবাহিত করতে হত। এই প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয় নকশাবড়ির। ডাল বেটে বড়ি দেওয়ার ও তা নানা তরকারির সাথে খাওয়ার রীতি বহুকাল আগে থেকেই চালু ছিল। মেদিনীপুর অঞ্চলের বাল্যবিধবারা সেই বড়ি তৈরি করার সময় নিজেদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে অলঙ্কারে সজ্জিত হওয়ার অতৃপ্ত বাসনাকে প্রকাশ করত। এভাবেই সৃষ্টি হওয়া নকশাবড়ি কালক্রমে এক অনুপম শিল্পকলায় পর্যবসিত হয়েছে।

নকশাবড়ির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে নানা লোকাচার ও লোকসংস্কৃতি। বড়ি দেওয়ার দিন সকাল সকাল মহিলারা স্নান সেরে পরিষ্কার পোশাক পরে বড়ি দিতে বসেন। বাসি কাপড় পড়ে বড়ি দেওয়ার রীতি নেই। কোথাও কোথাও বড়ি দেওয়ার সময় বারোজন সধবা মহিলা যিনি বড়ি দেন তাঁকে স্পর্শ করে থাকেন। আবার কোথাও কোথাও বড়ি দেওয়ার দিন প্রতিবেশী বয়স্ক বা বিধবা মহিলাদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়। রজঃস্রাব চলাকালীন মেয়েদের নকশাবড়ি দেওয়া বারণ। মেদিনীপুরে অনেক জায়গায় মেয়ের বাড়িতে শীতকালের তত্ত্ব পাঠানোর সময় আইটেম হিসেবে নকশাবড়ি রাখা আবশ্যক।

নকশাবড়ি নিয়ে নানা লোকছড়াও ঘোরে মেদিনীপুরের নানা মানুষের মুখে। যেমন, ‘খুকুর মন কেন ভারী / পাতে নেই যে নকশাবড়ি’। কিংবা ‘উপহারে নকশাবড়ি /  সাফল্য আনে পুরোপুরি’। নকশাবড়ি যে খুব হালকা ও মুচমুচে তারও উল্লেখ থাকে লোকছড়ায়। যেমন, ‘নকশাবড়ি এতই পলকা / তেল জোগাতে পকেট হালকা’। কিংবা, ‘বুড়ো বুড়ির নেইকো দাঁত / মাড়ির চাপে বড়ি কাত’।

তবে নকশাবড়ি তৈরিতে পোস্তর ব্যবহার এ দেশে ব্রিটিশ আগমনের পরে শুরু হয়েছে। বড়ি যাতে পাত্রে জড়িয়ে না যায় সেজন্য পোস্ত ব্যবহার করা হয়। অতীতে এ জন্য তেল বা ঘি ব্যবহার করা হত। দুই শতক আগে কিন্তু বাঙালি পোস্ত চিনত না। পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা চিনে আফিম ব্যবসার এক বিরাট বাজারের হদিস পায়। তখন তারা বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চাষিদের দিয়ে প্রচুর পপি গাছ চাষ করিয়ে তা থেকে আফিম নিষ্কাশন করিয়ে চিনে পাচার করতে শুরু করে। তবে তখন পপি গাছের ফল থেকে সব দানা ফেলে দেওয়া হত। পপির দানাই হল পোস্ত। কালক্রমে এই পোস্তই বাঙালির হেঁশেলে রান্নার এক মহার্ঘ্য উপকরণ হয়ে ওঠে। আর তার পরেই মেদিনীপুরে নকশাবড়ি তৈরির সময় পোস্ত প্রচলন হয়।

বড়ি প্রস্তুতিতে লেখকের মা ও ভাতৃবধূ
পর্যায় ১
পর্যায় ২

 

নকশাবড়ির হালচালঃ

গত তিন দশকে নকশাবড়ির পরিচিতি ও সম্মান যে কিছুটা বেড়েছে এ নিয়ে দ্বিমত নেই। নব্বইয়ের দশকে নকশাবড়ি কলকাতা বইমেলা, খাদ্যমেলা, বিদ্যাসাগর মেলা ইত্যাদিতে প্রদর্শিত হয়েছে। মেদিনীপুরে হলদিয়া উৎসব, তাম্রলিপ্ত উৎসব সহ নানা মেলায় এই বড়ির প্রদর্শনী হচ্ছে। খড়গপুর আই আই টি যে খাদ্য ও কৃষিমেলার আয়োজন করে তাতেও নকশাবড়ি দেওয়ার সুন্দর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ২০০২ সালে বেহালার বড়িশা তপোবন দুর্গাপূজার থিম করেছিল নকশাবড়ি। প্রায় আড়াই কুইন্টাল ডাল দিয়ে বাজকুলের পার্বতী সামন্তের নেতৃত্বে আটজন মহিলা দু’মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বড়ি তৈরি করেছিলেন। মণ্ডপসজ্জা ছাড়াও প্রতিমার গয়না, অস্ত্র ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছিল নকশাবড়ি দিয়ে।

১৯৯৫ সালে নরঘাটের তৎকালীন বিধায়ক অধ্যাপক ব্রহ্মময় নন্দ বিধানসভায় নকশাবড়ি নিয়ে এক দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব আনেন। তিনি এই বড়ি উৎপাদন কেন্দ্র ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানান। শান্তিপুর লোকসংস্কৃতি পরিষদ ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ দিন ধরে বড়ি তৈরির একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে।

শেষ কথাঃ

অবসর বিনোদনের শিল্প হিসেবে নকশাবড়ি সাবেক মেদিনীপুরের পূর্বাংশে বহুদিন আগে আত্মপ্রকাশ করলেও এই অনুপম শিল্প দেশ তো দূর কথা, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাতে ছড়িয়ে পড়েনি। ব্যতিক্রম দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার দক্ষিণাংশ, কারণ এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশের বংশ-শেকড় রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে। অথচ নকশাবড়ির কদর রাজ্য ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে ভিনদেশেও। আসলে এই বিরল শিল্পকর্মটি কোনও অজ্ঞাত কারণে তথাকথিত বিদ্বজ্জন বা রাজনীতির আঙিনার ব্যক্তিদের কাছে গুরুত্ব পায়নি।

এদিকে বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নতির হাত ধরে মানুষ আজ ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা। সেখানে নকশাবড়ির মতো ধৈর্যশীল, চিন্তাশীল ও পরিশ্রমসাধ্য শিল্পকর্মে মানুষের মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? ফলে বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ মেয়ে এই শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এভাবেই এই অসামান্য শিল্পকর্মের সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য ও সূক্ষ্মতা ক্রমক্ষীয়মান। আশঙ্কা জাগে, বিরল এই শিল্প অদূর ভবিষ্যতে চিরতরে হারিয়ে যাবে না তো?

অথচ নকশাবড়িকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত ও বানিজ্যকরণ করানোর প্রভূত সুযোগ ছিল এবং এখনও রয়েছে। বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তার মাধ্যমে উৎপাদিত নকশাবড়ি পৌঁছে দেওয়াই যায় দেশ ও বিদেশের খুচরো ও পাইকারি বাজারে, শপিংমলে। এতে শুধু নকশাবড়ির সম্মান বাড়বে না, গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে।

২০১৬ সালে খড়গপুর আই আই টি-এর মেধা স্বত্ব অধিকার বিভাগ (Intellectual Property Rights Cell) নকশাবড়ির জি আই (Geographical Indications)-এর আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ও মহিলাদের সাথে কথা বলে তথ্য পঞ্জীকরণ করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত জি আই মেলেনি। বাংলার সনাতন ঐতিহ্য হিসেবে অনেক লড়াইয়ের পর রসগোল্লার জি আই মিললেও শুধু পূর্ব মেদিনীপুর নয় বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নকশাবড়ি এখনও স্বীকৃতির প্রহর গুনছে। সবার আশা, বিশ্বের দরবারে নকশাবড়ি স্বমহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। হয়তো সেদিন খুব দূরে নয়।

সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ ছবির সে দৃশ্যটি মনে পড়ে? বহুদিনের প্রবাসী মনোমোহনকে তাঁর ভাগ্নী এই রকম গয়নাবড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করছে, আর মুগ্ধ মনোমোহন বলছেন, “আহারের এত বাহার এই বাংলাদেশেই সম্ভব!” ছবিতে অবশ্য দেখি ভগ্নমনোরথ মনোমোহন নিজের দেশ ছেড়ে আবার বিদেশে ফিরে যেতে মনস্থ করেন। তা সত্ত্বেও, তাঁর শেষ ছবির মাধ্যমে সত্যজিৎ জনমাধ্যমে ‘আহারের এই বাহারের’ কথা প্রচার করে ‘গয়নাবড়ি’কে বেশ মর্যাদা দিয়ে গেলেন, এটাই আমাদের পরম প্রাপ্তি।  

“আহারের এত বাহার এই বাংলাদেশেই সম্ভব!”

তথ্যসূত্রঃ

(১) সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১১১ বর্ষ, ৩-৪ সংখ্যা।

(২) আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।

(৩) গয়না বড়ির ইতিহাস ও গোপন কিস্যা (bifocalism.com)

(৪) খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে শিল্পসংস্কৃতির মিশেলে মেদিনীপুরের সনাতন শিল্পশৈলীঃ গয়না বড়ি (tripoto.com)

(৫) Goyna Bori- Origin, History, Bengal food art (itihaserhaatchani.com)

(৬) পূর্ব মেদিনীপুরের অলঙ্কার! বনেদিয়ানায় ঠাসা শতাব্দীপ্রাচীন গয়নাবড়ি (dailynewsreel.in)

চিত্রঋণ –

একমাত্র প্রথম চিত্র (বড়ি দেওয়া) এবং দ্বিতীয় চিত্র (পর্যায় ১)  লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত। বাকি ছবিগুলি অন্তর্জাল থেকে গৃহীত।  

বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Pradipta Bhattacharya , March 29, 2023 @ 5:55 pm

    জানা-মশায়ের লেখা মানেই নতুন কিছু জানা। স্বভাবজ সাবলীলতার সঙ্গে ব্যক্তিগত ছোঁয়া লেগে লেখাটি গয়নাবড়ির মতোই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *