মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাস: ওপার-বাংলার ক্রিকেটের পুরনো এক ঝলক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ও শেষ ১৬ই ডিসেম্বর, অন্তত সরকারিভাবে। সেই সময় আমি সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি – খবরের কাগজের খেলার পাতা ছাড়া অন্যান্য পাতাগুলো অনিয়মিতভাবে পড়লেও রেডিওর খবর ও চারপাশে গুরুজনদের আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝতে পারতাম যে আমাদের উপমহাদেশে একটা বড়সড় ওলটপালট শুরু হয়েছে। তারপর মে মাসে গ্রীষ্মের ছুটিতে এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে গেলাম আমাদের ‘দেশের বাড়ি’ – যশোর-সীমান্ত থেকে মাইল-দুয়েক দূরে নদীয়া জেলার এক গ্রামে।
সেখানে দেখা দু’টো দৃশ্য আমার আজও মনে পড়ে – একদিকে গ্রামের সীমানার বিশাল বিলের ওপার থেকে বহুদূরাগত গুলি-বোমার শব্দের মধ্যে বাক্স-পোঁটলা মাথায় নিয়ে সাঁতরে পার হয়ে আসা বেশ কিছু গৃহহারা মানুষজনের হাহাকার-কান্নাকাটি-ভরা অসহায়তার ছবি, আর উল্টোদিকে গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে আদুড়-গা বা হাতকাটা-ফতুয়া-গায়ে মালকোঁচা-দেওয়া-খাটো-ধুতি-পরিহিত মিলিটারি-বুট-সজ্জিত কাঁধে-আগ্নেয়াস্ত্র-ঝোলানো বুকে-কার্তুজের মালা-দোলানো মুক্তিবাহিনীর কিছু জওয়ানের দৃপ্তভঙ্গীতে হেঁটে যাওয়ার লড়াকু মনোভাবের চিত্র। এই বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়েই প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম চাক্ষুষ পরিচয়। পরে কলকাতায় ফিরে প্রত্যক্ষ করি শহরের রাস্তায় শরণার্থীদের চরম দুর্দশা। তার বহু বছর পরে, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, এক সপ্তাহের জন্য কর্মোপলক্ষ্যে ঢাকা গেছিলাম – সেখানে একমাত্র ছুটির দিনটা পেয়ে দেখেছিলাম ধানমন্ডির মুজিব-নিবাসের সংগ্রহশালা, কিনেছিলাম এই বইটা [চিত্র-০১ক]। সদ্যবিগত ফেব্রুয়ারি মাসে পড়লাম বাংলাদেশের সেই লড়াই নিয়ে লেখা এই বইটা [চিত্র-০১খ]। তারপর থেকেই বাংলাদেশ-সংক্রান্ত একটা ক্রিকেট-বিষয়ক রচনা লেখবার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিচ্ছিল – তারই ফলাফল আমার এই প্রয়াস। এখানে বাংলাদেশ-পূর্ববর্তী সময়ে ওপার-বাংলার ক্রিকেটের কথা লিখেছি।
দেশভাগের আগে পূর্ব-বাংলা [১৯৪৭-এর আগে পর্যন্ত]
অধুনা মানচিত্রে যেই অংশটা বাংলাদেশ, তার ক্রিকেট-ইতিহাস দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোনো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেই, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দু-তিন দশকে, ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে এই খেলাটা চালু করেন। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব (CCC)-এর সূচনা নাকি ১৭৮০ সালে, অর্থাৎ মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (MCC)-র ১৭৮৭ সালের প্রতিষ্ঠাবর্ষেরও সাত বছর আগে। জেমস অগস্টাস হিকি-র বেঙ্গল গেজেট পত্রিকার ১৭৮০ সালের ১৬ই থেকে ২৩শে ডিসেম্বরের ৪৮তম সংখ্যায় CCC-র প্রথম উল্লেখ পাওয়া নাকি যায়, যদিও উইজডেন-এর তথ্য অনুযায়ী CCC-র প্রতিষ্ঠাবর্ষ ১৭৯২ সাল।
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ১৭৯২ সালে প্রথম ক্রিকেট-ম্যাচ হয়েছিল ব’লে জানা যায়। ব্যারাকপুর ও দমদম এই দুই অঞ্চলে বসবাসকারী ইংরেজরা CCC-র বিরুদ্ধে এই ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন ব’লে ১৭৯২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখের ম্যাড্রাস ক্যুরিয়ার পত্রিকায় লিপিবদ্ধ আছে। এই ম্যাচটা খুব সম্ভবত রাজ ভবনের উল্টোদিকের ময়দানে খেলা হয়েছিল। ১৮০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ওল্ড ইটোনিয়ান দলের বিরুদ্ধে CCC-র খেলা ম্যাচটাও সেই মাঠেই হয়, এবং ওল্ড ইটোনিয়ানের রবার্ট ভ্যানসিটার্ট-এর শতরানটাই নাকি ভারতীয় উপমহাদেশে-করা প্রথম শতরান।
১৮৭৭ সালের মেলবোর্নে ক্রিকেট-ইতিহাসের সর্বপ্রথম টেস্ট-ম্যাচের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকা অঞ্চলের নাম। কেমন করে?
ঐ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া দলের এগারো জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ছ’জন অস্ট্রেলিয়ার বাইরে জন্মেছিলেন – চারজন ইংল্যান্ডে, একজন আয়ারল্যান্ডে, ও একজনের জন্মস্থান তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ঢাকা – ডানহাতি ব্যাটার [ঐ ম্যাচে দু’ইনিংসেই পাঁচ নম্বরে ব্যাট ক’রে ১৫ ও ৩ রান করেছিলেন এবং প্রথম ইনিংসে দু’টো ক্যাচ ধরেছিলেন] ব্র্যানসবি কুপার [চিত্র-০২], যাঁর জন্মতারিখ ১৫ই মার্চ ১৮৪৪।
উনি পরে এমসিসি, কেন্ট, মিডলসেক্স ও ভিক্টোরিয়া দলের হয়ে গোটা-পঞ্চাশ প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলেন, ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৮ এই সময়কালে। ওঁর বাবা ব্রিটিশ সেনাদলে ছিলেন এবং ঢাকা অঞ্চলে থাকতেন।
ঢাকা: বাঙালিদের প্রথম ক্রিকেট ক্লাব
১৮৮০-র দশকে ঢাকায় ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অশ্বেতকায়দের মধ্যেও এবং পরবর্তী দশকে ‘পল্টনের মাঠ’ সেখানকার প্রধান ক্রিকেট-মাঠ ব’লে গণ্য হ’ত।
এইখানে বলতেই হবে “বাংলা ক্রিকেটের জনক” কিশোরগঞ্জের সারদারঞ্জন রায়-এর [চিত্র-০৩] কথা। প্রবল ক্রিকেটোৎসাহী এই তরুণ যখন ঢাকা-তে কলেজে পড়েন, ১৮৭০ দশকের মাঝামাঝি নাগাদ, তখন তিনি ও তাঁর চার ভাই – উপেন্দ্রকিশোর (সুকুমার রায়ের বাবা), মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন (লীলা মজুমদারের বাবা) – মিলে ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তোলেন। এই ক্লাবের এক দল কলকাতায় ইডেনের মাঠে ১৮৮৪ সালের এক ম্যাচে হারিয়ে দেয় প্রেসিডেন্সি কলেজকে। সারদা, কুলদা ও প্রমদা এরা তিন ভাই ঐ ম্যাচে ঢাকার দলের হয়ে খেলেন। এই ম্যাচ নিয়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। চেহারায় সাদৃশ্যের জন্য সারদারঞ্জন “বাংলার ডবলু জি গ্রেস” নামেও পরিচিত ছিলেন।
সারদারঞ্জন ছাড়া আরেকজন বাঙালি খেলোয়াড় এই সময় বেশ নাম করেন – বজ্রযোগিনী জমিদারবাড়ির জামাই বসন্ত কুমার গুহ। জানা যায় যে, কৃষ্ণনগর কলেজকে এক ম্যাচে হারিয়ে দেওয়ার পর বসন্ত-কে তৎকালীন প্রশাসক-প্রধান লেফটেন্যান্ট গভর্নর টমসন উপহারস্বরূপ একটা রৌপ্যখচিত ক্রিকেট-ব্যাট দেন। জানা যায় যে ১৮৯১ সালে ঢাকা কলেজ কলকাতায় এক দু-দিনের ম্যাচে শিবপুর কলেজকে হারিয়ে দেয়।
সারদারঞ্জন ও বসন্ত দুজনেই ঢাকা কলেজ ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা – জমিদার, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক – এঁরা মাঝেমধ্যেই অর্থসাহায্য করতেন, বিশেষত দল যখন ‘বাইরে’ খেলতে যেত। কোচবিহার, নাটোর, ময়মনসিং, ও রংপুরের মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯১০ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল জিমখানা ক্লাব, যারা ১৯১১ সালে ক্রিকেট খেলতে ঢাকা ও ময়মনসিং সফর করেছিল। কলকাতা থেকে কিছু কিছু ক্রিকেট দল খেলতে যেত ময়মনসিং, যেমন ১৯১৬ সালেও ময়মনসিং মহারাজার আমন্ত্রণে বেঙ্গল জিমখানা দল সেখানে খেলতে গিয়েছিল।
ময়মনসিং: প্রথম বাঙালি টেস্ট-খেলোয়াড়
ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে অবিভক্ত বাংলার ক্রিকেটে ময়মনসিং অঞ্চলও এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। সেখানকার পণ্ডিতপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবে একসময়ে খেলতেন পরবর্তীকালের প্রথম বাঙালি টেস্ট-খেলোয়াড় প্রবীর (খোকন) সেন [চিত্র-০৪]।
ভারতের আন্তঃরাজ্য ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অবিভক্ত বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী তিন বাঙালি ক্রিকেটারের অন্যতম হেমাঙ্গ বসু খেলতেন এই পণ্ডিতপাড়া ও ঢাকার ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে। পণ্ডিতপাড়ার ফখরুদ্দিন ছিলেন ময়মনসিং অঞ্চলের নামী ক্রিকেট-প্রশিক্ষক। ঐ অঞ্চলের ইলিয়াস-উদ্দিন চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকে কোচবিহার মহারাজার একাদশের বিরুদ্ধে ময়মনসিং একাদশের হয়ে খেলেন, এবং ঐ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ দলের ক্রিকেট-অধিনায়ক ছিলেন ও কলকাতা মহামেডান স্পোর্টিং দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন।
অবিভক্ত বাংলা: বিদেশি দলের ভারত-সফর ও ঘরোয়া ক্রিকেট
১৯২৬-২৭ মরশুমে আর্থার গিলিগ্যান-এর নেতৃত্বে সফরকারী এমসিসি দল কলকাতায় একটা বেসরকারি ‘টেস্ট’ সমেত দু’টো ম্যাচ খেললেও সেখানে কোনও বাঙালি ক্রিকেটার অংশগ্রহণ করেননি, যদিও সর্বভারতীয় ‘টেস্ট’ দলে সিকে নাইডু, ওয়াজির আলি, নাজির আলি ও জামশেদজি এই চার ভারতীয় ছিলেন।
১৯৩৩-৩৪ মরশুমে ডগলাস জার্ডিন-এর নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সরকারী সফরে এসে কলকাতায় একটা (দ্বিতীয়) টেস্ট-ম্যাচ ছাড়াও আরো তিনটে ম্যাচ খেলে – ২৭শে ডিসেম্বরের একদিনের ম্যাচ বাংলাবাসী ব্রিটিশ একাদশের বিরুদ্ধে, ২৮শে ডিসেম্বরের একদিনের ম্যাচ ভারতীয় ও ইঙ্গ-ভারতীয় একাদশের বিরুদ্ধে, এবং ৩০শে ডিসেম্বর থেকে তিনদিনের ম্যাচ (বেসরকারি) ভারতীয় একাদশের বিরুদ্ধে – দ্বিতীয়টায় সফরকারী দল ৮ উইকেটে জেতে, বাকি দুটো অমীমাংসিত থাকে। দ্বিতীয় ম্যাচে খেলেন ছ’জন বাঙালি – জে ঘোষ, কার্তিক বসু [চিত্র-০৫], গণেশ বসু, অর্ধেন্দু দাস, শুঁটে ব্যানার্জি ও অধিনায়ক নীরজা রায়। এঁদের মধ্যে অর্ধেন্দু দাস জন্মেছিলেন সিলেটে, ১৯১০ সালে। তৃতীয় ম্যাচটায়ও খেলেন দুই বাঙালি ভাই – কার্তিক বসু ও গণেশ বসু, যাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ময়মনসিং।
১৯৩৫-৩৬ মরশুমে জ্যাক রাইডার-এর নেতৃত্বে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দল কলকাতায় একটা বেসরকারি ‘টেস্ট’ সমেত দু’টো ম্যাচ খেলে। যদিও ভারতীয় ‘টেস্ট’ দলে কোনও বাঙালি ক্রিকেটার অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু ২৭শে ডিসেম্বর থেকে তিনদিনের ম্যাচে বাঙলা একাদশে ছিলেন শুঁটে ব্যানার্জি, কমল ভট্টাচার্য ও জিতেন ব্যানার্জি, এই তিন বাঙালি।
১৯৩৪-৩৫ মরশুমে শুরু হয় রাজ্যস্তরের বাৎসরিক ঘরোয়া প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফি এবং ১৯৩৫-৩৬ মরশুম থেকেই বাংলা অংশগ্রহণ করে। তবে এইসময় বাংলা দলে পূর্ব-বাংলা থেকে বিশেষ কেউ খেলেছেন ব’লে জানা যায়না, পুরো ব্যাপারটাই মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যে রাইটার্স বিল্ডিংস-এর অলিন্দ-যুদ্ধের শহীদ বিনয়-বাদল-দীনেশ বিপ্লবী-ত্রয়ীর অন্যতম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয় বোস-এর ভাই বিমল বোস [চিত্র-০৬] ১৯৪০-৪১ মরশুম থেকে দু’দশকেরও বেশি সময় বিহারের হয়ে রঞ্জি-ক্রিকেট খেলেন, বিহার দলের অধিনায়কত্বও করেন।
দেশভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তান [১৯৪৭—১৯৭১]
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, বাংলার পূর্ব অংশের অঞ্চলগুলো নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়। এ যাবৎ ফুটবলই ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলগত খেলা, কিন্তু ইংরেজ-রাজ চলে গেলেও ‘সাহেবি’ খেলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়াতে কূটনৈতিক সক্রিয়তায় সঙ্গীত-চলচ্চিত্রের সঙ্গে ক্রিকেটের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
ঘরোয়া ক্রিকেট ও পরিকাঠামো
১৯৪৭-এর পরে, যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রিকেটের প্রসার চলছিল বেশ দ্রুতগতিতে, পূর্ব পাকিস্তান বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ছিল উৎসাহী নেতৃত্বের অভাবে। ফুটবল হয়ে উঠেছিল খুবই জনপ্রিয়। এইসময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটের হালচাল ও পরিকাঠামোর দিকে দ্রুত একঝলক নজর দেওয়া যাক।
ক্রিকেটের ক্লাবভিত্তিক শীতকালীন লিগ প্রতিযোগিতা, খানিকটা এলোমেলোভাবে হলেও, চলছিল। ১৯৪৮ সালে এই লিগ চালু হয় – ম্যাচগুলো শনিবার দুপুরে শুরু হয়ে রবিবার শেষ হ’ত, উভয় পক্ষ ৭৫ ওভার করে খেলত, খেলা হ’ত প্রধানত ঢাকা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন (DSA), ওয়াড়ি ভিক্টোরিয়া, ইস্ট এন্ড, রমনা রেস-কোর্স [চিত্র-০৭] ও ইস্ট পাকিস্তান (EP) জিমখানা/গ্যারিসন মাঠগুলোতে। এছাড়াও ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঈদগাহ, দিলখুশা. শাহবাগ এইসব মাঠও।
হয়ত এইসব কারণের জন্যই ১৯৪৮-৪৯ মরশুমে ভারত সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতে গেলেও তারা পূর্ব পাকিস্তানে আসেনি।
অন্তর্দেশীয় ক্রিকেটের প্রসার ও অংশগ্রহণ
১৯৫১ সালে, এক পাঞ্জাবি জমিদার (পরবর্তীকালে দেশের প্রধানমন্ত্রী) ফিরোজ খান নুন পূর্ব পাকিস্তানে একটা ক্রিকেট সংস্থা তৈরি করতে উৎসাহ যোগালেন। সঙ্গে সহায়তা করলেন এক প্রাক্তন ক্রিকেটার মাসুদ সালাহউদ্দিন, যিনি জ্যাক রাইডারের বেসরকারি ভারত-সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে ১৯৩৫-৩৬ মরশুমে খেলেছিলেন, এবং তখন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করছিলেন। সেই ১৯৫১ সালেই, পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ব্যবসায়ীর আর্থিক সহায়তায় বার্মা থেকে এক ক্রিকেট দল ঢাকাতে এল। দেশভাগের পর সেই প্রথম কোন বিদেশি দলের সফর। তারা DSA মাঠে কয়েকটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলল এবং স্থানীয় দল তাদের সহজেই হারিয়ে দিল। যদিও এই সফরকারী দলটা তেমন সুবিধের ছিল না, কিন্তু জনমানসে ফুটবলের যাবতীয় উৎসাহের মাঝখানে ক্রিকেটও খানিকটা জায়গা পেল।
১৯৫৪-৫৫ থেকে ১৯৭০-৭১ এই মরশুমগুলোয়, পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে পূর্ব পাকিস্তানের দলগুলো নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। এমন ডজনখানেক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট পাকিস্তান গ্রীনস, ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটস, ইস্ট পাকিস্তান ‘এ’ ও ‘বি’। ১৯৫৪-৫৫ মরশুম ও ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬৯-৭০ মরশুম অবধি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক দলগুলো পাকিস্তানের প্রথম-শ্রেণী ক্রিকেট-প্রতিযোগিতা কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত।
ভাষা আন্দোলন ও জাতীয় ক্রিকেটের ছোঁয়া
এল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন – পূর্ব পাকিস্তান জেগে উঠল সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার এঁদের আত্মবলিদানে। বাংলাভাষার পতাকার তলায় গোটা পূর্ব পাকিস্তান এক হ’ল, জন্ম নিল এক নতুন একাত্মতা, আত্মসম্মানময় এক প্রগাঢ় স্বাতন্ত্র্যবোধ।
১৯৫২-৫৩ মরশুমে, প্রথম ভারত-সফর অন্তে, আব্দু্ল কারদার-এর নেতৃত্বে পাকিস্তানী ক্রিকেট দল খেলতে এল পূর্ব পাকিস্তানে – চট্টগ্রামে একটা ও ঢাকাতে দুটো ম্যাচ। পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন (EPSF) তাদের ১৬ জনের দল ঘোষণা করল, অধিনায়ক এ.টি.এম.মুস্তাফা, যিনি পেশায় ব্যারিস্টার ও পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভার নেতা। দু-দিনব্যাপী ম্যাচগুলোর প্রথমটা ও তৃতীয়টা অমীমাংসিত থাকল এবং দ্বিতীয়টা সফরকারী দল সহজেই জিতল। স্থানীয় কয়েকজন খেলোয়াড় অবশ্য কিছুটা দক্ষতা দেখালেন। এরপরই জাতীয় দলের বার্মা-সফরে দু’জন আহত খেলোয়াড়ের পরিবর্তে মাজহারুল ইসলাম দামাল ও মহসিন কাজী এই দুজন স্থানীয় খেলোয়াড়ের জায়গা হয়। এই সফরের কিছুদিন পরে, ১৯৫৪ সালে, করাচির খ্যাতনামা Dawn পত্রিকার এক রচনায় কারদার জানান যে ঐ ম্যাচগুলোর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রিকেটের বীজ রোপিত হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত EPSF দল গঠন করে পাকিস্তানের জাতীয় লিগ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করল। প্রথম ম্যাচে, ঢাকা ক্লাবের মাঠে, কারদার, ইমতিয়াজ আহমেদ, সুজাউদ্দিন, মীরন বখস এমন টেস্ট-খেলোয়াড় সম্বলিত পাকিস্তান সার্ভিসেস দলকে EPSF ২০০ রানে খতম করে দিল। অভিজ্ঞতা ও সঠিক মানসিকতার কমতির কারণে EPSF ম্যাচটা হেরে গেল বটে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেটের আসল শিক্ষার পালে হাওয়া লাগল।
১৯৫৫ সালে ঢাকা পেল এক নতুন স্টেডিয়াম [চিত্র-০৮], যা পরে হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, যেখানে ক্রিকেট-ম্যাচের ব্যবস্থা আছে। এর ফলে নামী ক্রিকেটারে ভরা আন্তর্জাতিক দলগুলো পূর্ব পাকিস্তানে আসতে শুরু করল এবং সেখানকার ক্রিকেটে আরো উদ্দীপনা এল।
১৯৫৫ সালের ১লা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটে এক লাল তারিখ – প্রবল উৎসাহের মধ্যে ঢাকা দেখল প্রথম টেস্ট-ম্যাচ, বিপক্ষ ভারত। দুই অধিনায়ক, কারদার ও ভিনু মানকড়, টস করতে মাঠে ঢুকলে গ্যালারিভর্তি হাজার-পনেরো দর্শক দাঁড়িয়ে উঠে তাঁদের অভিনন্দন জানান। ম্যাচটা অমীমাংসিত থাকে। ভারতীয় দলের ম্যানেজার লালা অমরনাথ স্টেডিয়াম, আয়োজকগণ ও দর্শকদের প্রভূত প্রশংসা করেন। সব মিলিয়ে স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং কিশোর-যুবক সমাজে ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেল, ব্যাট ও বলের বিক্রি বাড়ল, আরো অনেক ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নেওয়া শুরু করল। ঐ দশকের শেষের মধ্যে ক্রিকেট হয়ে দাঁড়াল, ফুটবলের পরেই, সবচেয়ে জনপ্রিয় দলীয় খেলা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রভাব
ঢাকার নতুন স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে খেলা ছড়িয়ে পড়ল ঢাকা শহরের কোণায় কোণায় – DSA, ওয়াড়ি, ভিক্টোরিয়া, ওয়্যান্ডারার্স, ঈদগাহ, রেস কোর্স, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইস্ট এন্ড, গান্ডারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, জিমখানা – সব মাঠেই ক্রিকেটের পদচিহ্ন পড়তে থাকল। তরুণ ক্রিকেটাররা নিজেদের ক্রিকেট-দক্ষতা উন্নত করে তুলতে চেষ্টা করতেন সবুজ উইকেটে খেলে, যেমন উইকেট তখন ঢাকার কয়েকটা ক্রিকেট-মাঠেই ছিল। এঁরা চাইতেন ওয়েস হল (১৯৫৮-৫৯ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সফর), রে লিন্ডওয়াল ও অ্যালান ডেভিডসন (১৯৫৯-৬০ মরশুমে অস্ট্রেলিয়া দলের সফর) এঁদের মতন পৃথিবী-বিখ্যাত পেসারদের বিরুদ্ধে দাপট নিয়ে ব্যাট করতে। এই সব বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পেসাররা ঢাকাতে টেস্ট-ম্যাচ খেলে গেছিলেন এবং তাঁদের বোলিং দিয়ে দর্শকদের মন টেনেছিলেন।
এই বছর পাঁচ-ছয় সময়কালে ঢাকাতে টেস্ট-ম্যাচ খেলে যাওয়া বিখ্যাত বিদেশি ব্যাটারদের মধ্যেও ছিলেন: ভারতের বিজয় মঞ্জরেকর ও পলি উমরিগর (১৯৫৪-৫৫ মরশুম), নিউজিল্যান্ডের বার্ট সাটক্লিফ ও জন রিড (১৯৫৫-৫৬ মরশুম), MCC-র কেন ব্যারিংটন (১৯৫৫-৫৬ মরশুম), ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স ও রোহন কানহাই (১৯৫৮-৫৯ মরশুম), অস্ট্রেলিয়ার নীল হার্ভে [চিত্র-০৯] ও নর্ম্যান ও’নীল (১৯৫৯-৬০ মরশুম)। তাঁদের দক্ষতার প্রভাবও স্থানীয় ক্রিকেট-প্রেমীদের মনে যথেষ্টই পড়েছিল।
১৯৬১-৬২ মরশুমে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ঢাকার মাঠে উভয় ইনিংসেই শতরান করেন (১১১ ও ১০৪) হানিফ মহম্মদ [চিত্র-১০]। বিপক্ষ ব্যাটারদের মধ্যে ছিলেন টেড ডেক্সটার ও কেন ব্যারিংটন। ১৯৬৮-৬৯ মরশুমে সফরকারী ইংল্যান্ড দলে ছিলেন জন এডরিচ, টম গ্রেভনি, কলিন কাউড্রে, কিথ ফ্লেচার, বেসিল ডি’ওলিভিয়েরা, অ্যালান নট, জন স্নো, ডেরেক আন্ডারউড প্রমুখ।
১৯৬৯-৭০ সালে সফরকারী নিউজিল্যান্ড দলের গ্লেন টার্নার ও মার্ক বার্জেস-এর শতরান খচিত ম্যাচই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কালে ঢাকার মাঠে শেষ টেস্ট-ম্যাচ।
স্থানীয় প্রতিভার বিকাশ
এরই মধ্যে খোঁজ মিলল আব্দুল হালিম (জুয়েল) চৌধুরি ও রাকিবুল হাসান এঁদের মতন তরুণ ক্রিকেট-প্রতিভাবানদের। ষাটের দশকের মাঝামাঝি জুয়েল ও ঐ দশকেরই শেষদিকে রাকিবুল এই দু’জনের খেলা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রিকেট-বোদ্ধাদেরও নজর কাড়ে। এঁদেরই পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় আব্দুল লতিফ, দৌলত জামান, মাহমুদ বকুল, ইসমাইল গুল, সুকুমার গুহ এমন কয়েকজনের নামও। করাচিতে জন্মানো অলরাউন্ডার ইসমাইল গুল ছিলেন ঢাকা ওয়্যান্ডারার্স দলের জনপ্রিয় অধিনায়ক এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান দলেরও অধিনায়ক হন। ইনি নিয়মিত অনুশীলন ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে দলের মধ্যে এক বাড়তি উৎসাহের সঞ্চার করেছিলেন।
এখানে মনে করাই মুশতাক [চিত্র-১১ক] নামে এক প্রকৃত ক্রিকেট-প্রেমীর কথা যিনি গড়ে তোলেন আজাদ বয়েজ ক্লাব, যেখানে স্থানীয় তরুণ প্রতিভাদের অনেক সুযোগ দেওয়া হ’ত। ঢাকা-র অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো সঙ্গে যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ ক’রে তিনি ম্যাচের আয়োজন করাতেন। স্থানীয় ক্রিকেটের প্রচারে ও প্রসারে এই ক্লাবের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জুয়েল [চিত্র-১১খ] এই ক্লাব থেকেই উঠে আসেন।
একটা কথা এখানে বলে রাখা উচিত। পূর্ব পাকিস্তানের এইসব প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড়দের কিন্তু পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট-মহলের কর্তাব্যক্তিরা, বিশেষত অত্যন্ত প্রভাবশীল কারদার, খুব একটা যে গুরুত্ব দিতেন এমন নয়। একমাত্র নিয়াজ আহমেদ ছাড়া আর কেউ জাতীয় দলে নির্বাচিত হননি, তাঁর কথা একটু পরেই বলছি।
১৯৫৪-৫৫ মরশুম ও ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬৯-৭০ মরশুম এই ডজনখানেক মরশুমের গোটা বিশেক প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে প্রায় ৭০ জন ক্রিকেটার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই ম্যাচগুলোর মধ্যে কায়দ-ই-আজম ট্রফি ছাড়াও আছে আইয়ুব ট্রফি ও সফরকারী আন্তর্জাতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচগুলোও। তবে এই ম্যাচে অংশগ্রহণকারী ক্রিকেটাররা প্রায় সবাই অপেশাদার ছিলেন এবং দলগঠনে অনেক সময়ই ধারাবাহিকতার অভাব ছিল।
এই জনা-সত্তর খেলোয়াড়দের মধ্যে জনা-পঁচিশেক মাত্র একটা করে ম্যাচ খেলেন, মাত্র দুজন গোটা-দশেক বা তার বেশি ম্যাচ খেলেন। এঁরা হলেন: আব্দুল লতিফ, সর্বোচ্চ রান-সংগ্রহকারী (১৫ ম্যাচে ৮৬৫ রান দুটো শতরান সমেত, ১৫ উইকেট ও ১০টা ক্যাচ – গোটা-দশেক ম্যাচে অধিনায়কও ছিলেন), এবং দৌলত জামান (১১ ম্যাচে ২১ উইকেট)। এছাড়া নিয়মিতদের মধ্যে ছিলেন: মাহমুদ বকুল (৮ ম্যাচে ২৬৭ রান), শামিম কবীর (৮ ম্যাচে ১৪৫ রান ও ৮টা ক্যাচ – উইকেটরক্ষক ছিলেন), ইসমাইল গুল (৭ ম্যাচে ১৮০ রান ও ২২ উইকেট একটা পাঁচ-উইকেট সমেত), সুকুমার গুহ (৭ ম্যাচে ৩২৫ রান ও ১২ উইকেট), জাভেদ মাসুদ (৭ ম্যাচে ৬০৮ রান একটা দ্বিশতরান, একটা শতরান সমেত), মহম্মদ সাদিক (৭ ম্যাচে ২৮১ রান ও ২৭ উইকেট দু’টো পাঁচ-উইকেট সমেত)।
এঁদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন। যেমন: ব্যাটার-উইকেটরক্ষক রাকিবুল হাসান (১৯৭৯-তে ICC ট্রফিতে অধিনায়ক, ১৯৮৬-তে দুটো ওডিআই), অফ-স্পিনার আশরাফুল হক (১৯৭৭-এ সফরকারী MCC-র বিরুদ্ধে, ১৯৭৯-তে ICC ট্রফিতে ফিজি-র বিরুদ্ধে ম্যাচ-জেতানো বোলিং ৭-২৩), ও ব্যাটার-উইকেটরক্ষক শফিক-উল-হক (ICC ট্রফিতে ১১টা ম্যাচ, ১৯৭৯-তে উইকেটরক্ষক ও ১৯৮২-তে অধিনায়ক) [চিত্র-১২]। এঁরা তিনজনেই বাংলাদেশের ক্রিকেট-প্রশাসনিক পদেও ছিলেন।
তখন একটা প্রথা চালু ছিল – পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন ক্রিকেটার চাকরি বা ব্যবসার কাজে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে এলে তাঁরা তখন পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলতেন। এইভাবে ছ’জন পাকিস্তানি টেস্ট-খেলোয়াড় পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে খেলেছেন: পেসার মাহমুদ হুসেন (২৭ টেস্ট), পেসার মহম্মদ মুনাফ (৪ টেস্ট), বাঁ-হাতি পেসার মুফাসির-উল-হক (১ টেস্ট), বাঁ-হাতি স্পিনার-অলরাউন্ডার নাসিম-উল-গণি (২৯ টেস্ট), ওপেনার-উইকেটরক্ষক নৌশাদ আলি (৬টা টেস্ট) ও পেসার নিয়াজ আহমেদ (২ টেস্ট)।
এখানে নিয়াজ [চিত্র-১৩] সম্বন্ধে একটু বিশেষ উল্লেখ করি। যখন ১৯৬৭ সালের ইংল্যান্ড সফরে পাকিস্তানের জাতীয় দলে জায়গা পান, তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে খেলেন – তাই তাঁকে বলা হয় প্রথম পূর্ব পাকিস্তানি টেস্ট-খেলোয়াড়, যদিও তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে উত্তরপ্রদেশের বেনারসে, এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হ’লে ১৯৭২ সালে তিনি করাচি চলে যান ও বাকি জীবনটা (পশ্চিম) পাকিস্তানেই কাটান।
ক্রিকেটের দিন হ’ল যে অবসান
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাক্তন ইংরেজ টেস্ট-ওপেনার মাইক স্টিউয়ার্ট-এর [ইনি পরবর্তীকালের ইংরেজ টেস্ট-অধিনায়ক অ্যালেক স্টিউয়ার্ট-এর বাবা] অধিনায়কত্বে এক কমনওয়েলথ দল, যার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ইংরেজ খেলোয়াড় – ইউনিস আহমেদ ও ওয়াহিদ ইয়ার খান (পাকিস্তান) এবং নীল হক (অস্ট্রেলিয়া) এমন অল্প কয়েকজন ছাড়া – পাকিস্তান সফরে আসে তিনটে চারদিনের ম্যাচ খেলতে, করাচি-ঢাকা-লাহোর এই তিন শহরে।
সেই সময় গোটা পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রবল বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা সামলাতে নাজেহাল। তার উপর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লিগের বিপুল নির্বাচনী-জয়কে জাতীয় সরকারের স্বীকৃতিদানে অসম্মতির কারণে প্রবল অসন্তোষ অব্যাহত। সব মিলিয়ে ঢাকা শহর তখন অগ্নিগর্ভ। জাতীয় সরকারের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণসামগ্রীর অব্যবস্থা ও জনমতের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে প্রবল জনরোষ চলছে।
এর মধ্যেও দ্বিতীয় ম্যাচের তিনদিন (২৬শে, ২৭শে ও ২৮শে ফেব্রুয়ারি) ধরে বহু দর্শক মাঠে গেছিলেন। কারণ? পাকিস্তান দলে ছিলেন ঢাকার আঠারো-বছরের তরুণ কলেজ-ছাত্র রাকিবুল হাসান, যাঁর কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। তিনিই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার যিনি ঐ সিরিজে পাকিস্তান দলে খেলেন। ঐ ম্যাচে তিনি দু’ইনিংসেই ব্যাটিং ওপেন করেন কিন্তু ব্যর্থ হন (১ ও ১) – তা সত্ত্বেও তাঁর উপস্থিতিই স্থানীয়দের প্রচুর উৎসাহিত করেছিল।
ঠিক এই সময়েই পাক-রাষ্ট্রপতি ঢাকাতে শুরু হতে যাওয়া নবনির্বাচিত জাতীয় বিধানসভার উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করে দিয়ে সামরিক শাসন জারির নির্দেশ দেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকা শহরের পথে পথে জনস্রোত নেমে আসে। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ম্যাচের চতুর্থ দিনের দর্শকদের মধ্যেও এই প্রবল বিক্ষোভ সংক্রমিত হয়। মাঠে অস্থায়ী বেড়াগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ও দর্শকরা মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়েন। অবস্থা বেগতিক বুঝে অল্পক্ষণ পরেই ম্যাচটা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ততক্ষণে ক্রোধান্বিত দর্শকদের অধিকাংশই ধোঁয়া-ভরা স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে দলে দলে রাজপথের গণবিক্ষোভে শামিল হন।
রাকিবুলের কথায়: “The student politicians were livid. They set fire to the stands, and burned down the marquees as we fled back to our hotel. Right then we knew that was the end of it.” কমনওয়েলথ দলের উইকেট-রক্ষক প্রাক্তন ইংরেজ টেস্ট-খেলোয়াড় জন মারে-র বক্তব্য অনুযায়ী একদল সেনার পাহারায় এক প্রায়ান্ধকার রাস্তা ধরে তাঁদেরকে কোনওমতে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে লাহোরগামী বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়। Wisden এই ঘটনা সম্পর্কে লেখে: “The match was abandoned on the fourth and final day, when the crowd invaded the field” – বোধহয় এই ব্যাপক গণবিক্ষোভের কথা জানাতে না চেয়ে।
সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই সেনাদল বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে-গ্যাস প্রয়োগ করতে থাকে। পরদিন সকালে বিমানবন্দরের পথ-অবরোধকারী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয় এবং বেশ কয়েকজন হতাহত হন। এক বিশাল ধর্মঘটে ঢাকা শহর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং শহরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা (খুনোখুনি-ধরপাকড়-হানাহানি) শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ক্রিকেট-খেলোয়াড়রা
এসে পড়ল ১৯৭১ সাল, মার্চ মাসে শুরু হ’ল স্বাধীনতার যুদ্ধ, পাক-সেনাদল ছেয়ে ফেলল ঢাকা-সহ পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ অংশ। আরো হাজার হাজার তরুণদের সঙ্গে সঙ্গে রাকিবুল, জুয়েল, মুশতাক এঁরাও যোগ দিলেন মুক্তিসেনার দলে। পূর্ব পাকিস্তানের গোটা একটা তরুণ-প্রজন্মের জীবনগুলো সব ওলট-পালট হয়ে গেল। রাকিবুল-এর পরিবারের ছ’জন সদস্য সেই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান, প্রাণ হারান পূর্ব পাকিস্তান দলে তাঁর সহ-খেলোয়াড় জুয়েল, যুদ্ধে প্রাণ দিলেন ক্রিকেট-সংগঠক মুশতাক-ও।
রাকিবুল অবশ্য মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আবার ক্রিকেট-খেলা গড়ে তোলবার কাজে যোগ দেন, জাতীয় দলের অধিনায়ক হন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথ-চলা নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু সে এক নতুন কাহিনী – আমার কথা আপাতত এখানেই শেষ।
তথ্যসূ্ত্র:
1. https://www.cric-life.com/article/history-of-cricket-in-bangladesh/
2. http://www.banglacricket.com/html/history/timeline.php
3. https://www.cricketsoccer.com/2018/12/21/history-of-cricket-in-bangladesh-during-pakistan-era/
4. http://bdnewsexpress.com/2020/12/17/the-cricket-history-of-mymensingh/
5. https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_East_Pakistan_first-class_cricketers
6. https://www.espncricinfo.com/cricketer/content/story/135968.html
7. https://www.espn.in/cricket/story/_/id/23075248/the-dhaka-born-aussie-rameez-rare-dismissal
8. https://www.espncricinfo.com/story/rewind-cricket-while-dhaka-burned-797195
চিত্রসমূহ:
লেখকের ব্যক্তিগত পুস্তকসংগ্রহ ও অন্তর্জাল থেকে