সংগীতশিক্ষার সাতকাহন  

সংগীতশিক্ষার সাতকাহন   
ভূমিকা

সংগীতশিক্ষা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে হবে। শোনার পর থেকেই তথ্যসংগ্রহের জন্যে একে-ওকে তিতিবিরক্ত করে মারছি। গায়কভ্রাতা তো আছেই – তার মুখনিঃসৃত বাণী নোট করা আছে। আরো ‘নানামুনি’র কাছে ‘নানামতে’র প্রত্যাশায় ধর্ণা দিচ্ছি। চল্লিশবছর গুরুর কাছে সংগীতশিক্ষা করেছি তো কী হয়েছে, আরো কত অমূল্য রতন রয়ে গেছে চারিদিকে। কুড়িয়ে নেবো না? পুত্রকেও ছাড়িনি, সে বেশ কিছুদিন পাশ্চাত্যদেশীয় ধ্রুপদীসংগীতে তালিম নিয়েছে। বারংবার প্রশ্নে তার ফুটবল ম্যাচ দেখায় বিঘ্ন ঘটছে, সে যারপরনাই বিরক্ত। এমত সময়ে পরিত্রাতা হয়ে এলেন একেনবাবু-স্রষ্টা। তাঁর ঝুলির ওপর আমার অগাধ আস্থা। সেখান থেকেই পেলাম একটি ‘কমলহীরে’।

ঘটনাটি সত্যি, তাঁর কলম্বাস বসবাসকালের কথা। তাঁর ভাষাতেই বলি।

তাঁর এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু (নামটা গোপনই থাক) তাল জিনিসটা কি বোঝার জন্য এক সংগীতজ্ঞ বন্ধুকে ধরল।

“দাদরা আর কাহারবার তফাৎ কি?” ইঞ্জিনিয়ারের প্রশ্ন।

সংগীতজ্ঞ তাল দিয়ে দিয়ে বলল, “এক-দুই-তিন! এক-দুই-তিন – এটা হল দাদরা। সমপদী তাল। মাত্রা সংখ্যা ছয়! ছন্দ বিভাজন তিন-তিন – ধা ধি না! না তি না। মনে রেখো মাত্রা হল, সময়ের ক্ষুদ্রতম একক।”

‘আর কাহারবা?’

“কাহারবা হল এক-দুই-তিন-চার/এক-দুই-তিন-চার। এটাও সমপদী তাল। মাত্রা সংখ্যা আট, ছন্দ বিভাজন চার-চার।”

“একটা গান দিয়ে বোঝাও।” ইঞ্জিনিয়ার থিওরি শিখেই সন্তুষ্ট নয়, বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখতে চায়।

“ঠিক আছে,” সংগীতজ্ঞ দাদরা আর কাহারবা তালে দুটো গান হাতে তাল দিয়ে দিয়ে শোনাল।

সব শুনে ইঞ্জিনিয়ার বলল, “বুঝলাম না, এটা তো এক-এক-এক-এক … শুধু এক মাত্রা দিয়েও দিব্বি তাল দেওয়া যায়।”

ঠিক কথা। এক তো সবসময়ই সবার গুণিতক। আটবার এক বললে কাহারবা, ছ’বার বললে দাদরা। তফাৎটা হচ্ছে কোথায় তাহলে?

সংগীতজ্ঞ রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। কথোপকথনের শ্রোতা হিসেবে একেনবাবু-স্রষ্টার উপলব্ধি – ‘সবাইকে বোধহয় সংগীত শেখানো যায় না।’ এই একটি কথাতেই সোজা পাখির চোখটি বিঁধল। সংগীত এমনই একটি বিদ্যা যার জন্যে কোনো একটি বোধ বা চেতনা দরকার হয়। শ্রুতির, তালের। ঐজন্যেই একটা কথা সংগীতমহলে চালু আছে – ‘যার কান নেই, তার গানও নেই।’ কথাটা খারাপ শোনালেও সত্যি।

তাল-বেতাল

তাল নিয়েই কথা শুরু হোক তাহলে।

পাঠক খেয়াল করুন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দাদরা-কাহারবা-র তফাত করতে না পারলেও, একটা জিনিস কিন্তু সার বুঝেছেন। সেটি হল মাত্রা, তালের সবচেয়ে ছোট একক বা ইউনিট। এক-এক-এক-এক করে তাল দিয়ে যে গানকে ছন্দে বাঁধা যাচ্ছে – সে উপলব্ধি হয়েছে। এখানেই এলো ছন্দের বোধ। সুরের আগে আসে ছন্দ বোঝার ক্ষমতা। বিজ্ঞান বলে, ভ্রূণ অবস্থায় ছন্দবোধ জন্মায়। হৃদস্পন্দন শুরু হয় নিয়মিত ছন্দে, সেই অনুভূতি মস্তিষ্ক ধরে রাখে। খেয়াল করে দেখুন, আমাদের সারাদিনের কাজকর্মে ছন্দবোধ আছে। হাঁটা, চলা, চোখের পাতা ফেলা তার উদাহরণ। এই ছন্দবোধের বাস্তবের রূপটিই তাল। তালের সঙ্গে চাঞ্চল্য জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে উত্তেজনা। মানুষের মধ্যে বেসুরো বেশি, বেতালা কম। জাতে মাতাল হলেও আমরা তালে ঠিক।

গুপী-বাঘার কথা মনে আছে? বেতাল, বেসুরো? ভূতের রাজা তাদের গান গেয়ে বর দিয়েছিলেন। সে গানটি একটু মনে করে দেখুন -শুধুই তাল, সুরহীন। কিন্তু তার আবেদন অস্বীকার করবে কে?

প্রসঙ্গত বলি, বিভিন্ন মাত্রার কম্বিনেশনে বিভিন্ন তালের ধারণা শুধু ভারতীয় সংগীতে। অন্যত্র শুধুই বিট – অর্থাৎ মাত্রা। ইঞ্জিনিয়ারের ভাষায় ‘এক-এক-এক-এক’। তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতশিক্ষায় তালের শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও আছে লয়। একটি তালে ঠিক কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে মাত্রাগুলির পুনরাবৃত্তি হবে, তাকেই বলে লয়। গুরু তাল চেনান, লয় চেনান, তৈরী হয় শিক্ষার্থীর ফাউন্ডেশন।

সুর-বেসুর

এবার নিজের ঝাঁপিটি একটু খোলা যাক।

সে ছিল এক-একটা স্বপ্নের রবিবার, গানের রবিবার। সাপ্তাহিক গান শেখার দিন। গুরুর বাসস্থান বালিগঞ্জে। তাই সাতসকালে উত্তর কলকাতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। নিজের ক্লাসটিই তো শুধু নয়, তার ঠিক আগেই শেখে একঝাঁক পুরোনো ছাত্রী। সংগীতের যাত্রাপথে তারা অনেকটাই এগিয়ে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বেতার আর দূরদর্শনে নিয়মিত তাদের শোনা যায়। গুরুর উপদেশ, “ওদের ক্লাসটা শুনবে। সংগীতশিক্ষা মানে সত্তরভাগ শোনা, তিরিশভাগ শেখা।” অমূল্য উপদেশ। পরে বুঝেছি। কান তৈরী হয় শুনতে শুনতে।

সংগীতশিক্ষার গোড়ার কথা এটাই। কান তৈরী করা। সুর নাহয় কানের পর্দায় গিয়ে ঢেউ তুললো, সেই ঢেউকে প্রসেস করবে মস্তিষ্ক। সুরকে আত্মীকরণ করবে। বিভিন্ন নোটের তফাৎ ধরতে পারা চাই। সুরে বাজলো না বেসুর – সেটিও ধরতে পারা চাই। তবেই তার ওপর শিক্ষার সৌধ বানানো চলে। ব্যাপারটা অনেকটা রং চেনার মতো। রঙের তফাৎ না বুঝলে যেমন ছবি আঁকা যায় না, সুর আর বেসুরের তফাৎ যদি মস্তিষ্কের কোষে ধরা না পড়ে, তাহলে হাজার চেষ্টা করেও তাকে গান শেখানো যাবে না।

এবার তাহলে প্রশ্ন, এই সুর-বেসুর চেনাচিনির ব্যাপারটা কী করে হয়?

এ নিয়ে গবেষণা হয়েই চলেছে। বাচ্চারা সুর পছন্দ করে। তার সাক্ষ্য দেবে ঘুমপাড়ানি গান। ঘুম পাড়াবার মোক্ষম ওষুধ। ঘ্যানঘ্যানে বা কাঁদুনে বাচ্চাটিকে ভোলাতে গান তো আমরা হরদমই গেয়ে থাকি। এভাবেই ছোটবয়স থেকে সুর ছড়িয়ে যায় মস্তিষ্কের কোষে কোষে। ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো’। বাচ্চাদের সুরবোধ তাই পরিবেশগত ও জেনেটিক। তবে ঠিক কতটা ‘আকুল করিবে মনপ্রাণ’ – তার ওপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

এই সুরচেতনার ভিত্তির ওপর পরবর্তীকালের সংগীতশিক্ষা দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু সুরের চেতনাই যার নেই? তাও সম্ভব। বাস্তবে দেখেছি। একটি মেয়ে এলো আমার কাছে শিখতে। তার দীর্ঘদিনের বাসনা সে বলিউডি সংগীত গাইবে। আসরে-টাসরে নয়, অতো উচ্চাশা তার নেই। ঘরোয়া জমায়েতে, পার্টিতে সে ওই গান গাইতে চায়। চেষ্টার ত্রুটি করলাম না। সাধারণ সা রে গা মা দিয়ে শুরু করলাম।

তাকে বলি, “বলো ‘সা’। আমার গলার সঙ্গে মেলাও দেখি?”

সে তিন ধাপ উপরে উঠে গায় ‘সা’।

গান থামিয়ে আমি বলি, “মিললো না তো? ‘সা’ তে মেলাও”।

পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে সে বলে, “কেন? ‘সা’-ই তো গাইলাম।”

আমি হতবাক। ভুলটাই যে বুঝতে পারছে না, তাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ভুল বুঝলে তবেই না ঠিক সুরটা গাইবার চেষ্টা করতে পারবে!

ভাগ্যক্রমে দু-তিনটি ক্লাস করে সে নিজেই অদৃশ্য হল। আমিও হাঁফ ছাড়লাম।

সংগীতশিক্ষার এক-দুই-তিন

বিশ্বব্যাপী সংগীতের মহাসমুদ্রে সাঁতরাতে গেলে পথ হারাবার সম্ভাবনা একশোভাগ। তাই আগে কম্পাস দিয়ে দিকনির্ণয় করে নিতে হয়। ঠিক কোন সংগীতটি আমি শিখবো। এখানে বাদ্যযন্ত্রকে আলোচনা থেকে বাদ রাখছি। কণ্ঠে ধারণ করা সুর কী করে সংগীতে উত্তীর্ণ হয়, সেটিই এখানে আলোচ্য। বৃত্তটা আরও ছোট করে নিয়ে বলি, এ লেখায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশেষ একটি ধারা, যার নাম খেয়াল – সেটির শিক্ষাপদ্ধতির ওপর আলো ফেলতে চেয়েছি। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আমার চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করতে চাই।

আবার সেই গুরুর কথাতেই ফেরত আসি। ভারতীয় সংগীতে গুরুর স্থান, তাঁর অবদান, অমূল্য। তিনিই হাতে ধরে স্বরের সঙ্গে পরিচয় করান। সাধনার পথ দেখান। সংগীত সাধনার ধন। তাই একেবারে শুরুতেই সঠিক গুরুর নির্বাচন দরকার। যিনি শুদ্ধ স্বরে, ব্যাকরণ মেনে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গান শেখাবেন। গলার আওয়াজকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাবেন, সঠিক স্বর ব্যবহার করে রেওয়াজ করতে শেখাবেন। ঘষে মেজে গলায় অলংকরণ আর মূর্চ্ছনা আনতে শেখাবেন। সাধারণত আমাদের শিক্ষা শুরু হয় পাড়ার শেফালীকাকিমা বা অতসীদি-র কাছে। মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবান পরিবারের মধ্যেই প্রথম গুরুকে পেয়ে যায়। উভয়ক্ষেত্রেই যদি গুরু সঠিক পথে না চালান, তাহলে গলা ও গানের সর্বনাশ হয়। সে বিপত্তি থেকে উদ্ধার পাওয়া সময়সাপেক্ষ।

দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় তথ্যটি হল – আগ্রহ, আরো পরিষ্কার বললে তীব্র আগ্রহ। মন আকুল না করলে গান হয় না। এখানেই প্রথাগত পড়াশোনার সঙ্গে গানের তফাৎ। এমন মহাপুরুষ দুনিয়ায় কমই আছে যে ভালোবেসে পড়াশোনা করে (আমি তো কখনই করিনি)। কিন্তু সবাই মোটামুটি পরিশ্রম করলে পাশ করবে – এটুকু গ্যারান্টিড। সংগীতে কিন্তু সে গ্যারান্টি নেই। যার গানে উৎসাহ নেই, তাকে গান শেখানো যাবে না। এ একেবারে পরীক্ষিত সত্য। এ বিদ্যার জন্যে প্রকৃতিগত কিছু প্রবণতা চাই। সংগীতে আগ্রহ থাকতে হবে। স্রোতের অনুকূলে ভেসে সংগীত শিখতে হয়, জোর করে হয় না।

ধরে নিচ্ছি উপরের দুটি সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে। সঠিক গুরুর খোঁজ পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীও মনোযোগী, শিখতে চায়। এইবার আসে তৃতীয় কথাটি। রেওয়াজ, ভয়েস ট্রেনিং, স্বরশিক্ষণ। একটু ভেবে দেখি যদি, সংগীত দাঁড়িয়ে আছে বাইশটি শ্রুতির ওপর। এর মধ্যে বারোটি শ্রুতি হল প্রধান স্বর – সাতটি মূল স্বর (সা রে গা মা পা ধা নি সা), আরো পাঁচটি কোমল বা তীব্র স্বর। যেন বারোভূঁইঞা। বিশ্বের যে কোনো গান এই বাইশটি শ্রুতি তথা বারোটি স্বরের কম্বিনেশন। এই বারোটি স্বরের সম্যক জ্ঞান যে কোনো সংগীতশিক্ষার গোড়ার কথা। তার মানে প্রতিটি স্বরকে আলাদা করে ধরে ধরে গলায় বসানো। অর্থাৎ ‘সা রে গা মা পা ধা নি সা’ নিয়ে গলা সাধা। সেটিই ভয়েস ট্রেনিংএর প্রথম ধাপ।

ব্যাপারটা যদি ফিজিক্সের সূত্র দিয়ে দেখা যায়, তাহলে ভালো বোঝা যাবে। বারোটি স্বরের প্রতিটিরই একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি আছে। ওই ফ্রিকোয়েন্সিতে গলা মিলিয়ে একটানা ধরে রেখে গাওয়াকেই সুরে গাওয়া বলে। নির্ধারিত ফ্রিকোয়েন্সি থেকে সরে গেলেই (যা হামেশাই হয়) তা বেসুরো হয়ে যায়। মানুষের গলায় একশো শতাংশ ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করানো খুব কঠিন। লতা মঙ্গেশকর ষাটের দশকে পারতেন, তাই কিংবদন্তী হয়ে আছেন। যন্ত্রে ফ্রিকোয়েন্সি মেলানো অপেক্ষাকৃত সোজা। যে গায়কের গলা ওই ফ্রিকোয়েন্সির যত কাছে থাকে, তার গলা ততই সুরেলা হয়ে আমাদের কানে বাজে। এখনকার দিনে স্টুডিওতে সফটওয়্যার দিয়ে গলার পিচ কারেকশন করা হয়। অর্থাৎ ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে দিয়ে কৃত্রিমভাবে সুরেলা গলা তৈরী করা হয়।

বারোভূঁইয়াতে ফেরত আসি। এই বারোজনের মধ্যে আবার ‘সা’ হচ্ছে রাজাধিরাজ। নিখুঁত একটা ‘সা’ লাগানো সংগীতসাধকদের সারাজীবনের উচ্চাশা। একঘন্টা রেওয়াজ করলে পনেরো মিনিট ‘সা’-তে গলা ধরে রাখতে হবে। স্থির, নিষ্কম্প ‘সা’। গলা যেন এক চুলও স্বর থেকে না সরে। সে যে কী কঠিন, ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।

হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের সাধকরা তাঁদের শিষ্যদের ‘সা’ স্বরটিতেই বন্দী করে রেখেছেন বছরের পর বছর। ‘সা’ ছেড়ে অন্য স্বরে যাওয়ায় চলবে না। যে গলা নিখুঁত ‘সা’ গাইতে পারে, তাতে বারোটি স্বর এমনিই খেলা করবে। তার জন্যে আর আলাদা করে পরিশ্রম করতে হবে না।

আমার গুরুর কাছে এসব শোনা। তিনি অবশ্য আমায় এমন কড়া আদেশ দেননি। দিলে আমি রেওয়াজের ইচ্ছে হারিয়ে ফেলতাম, বুঝেছিলেন তিনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটু অদল-বদল চায়। দিনের পর দিন ‘সা’ নিয়ে ‘পায়ে ধরে সাধা’ কী সোজা কথা? তারপর যদি ‘রা নাহি দেয় রাধা’, তাহলে তো বিপদ!

ভয়েস ট্রেনিংএর দ্বিতীয় ধাপটি হল গলার স্বরের নিয়ন্ত্রণ (মডুলেশন), আওয়াজকে ইচ্ছামতো কমানো ও বাড়ানো। তাতে গলা নরম হবে, নমনীয় (ফ্লেক্সিবল) হবে। এমন নমনীয় গলায় যে কোনো গান খুব সহজে গাওয়া যাবে। যার জন্যে বলা হয় শাস্ত্রীয় সংগীত যে শেখে, আলাদা করে না শিখেও সে সবরকম গান গাইতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে – যেমন রবীন্দ্রসংগীত। এ গানের নিজস্ব একটি ধারা আছে, সেটি না শিখে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যায় না।

তৃতীয় ধাপে আসবে অলংকরণ, মুড়কি, তান। স্বরতন্ত্রীর (ভোকাল কর্ড) সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কম্পন গানে অন্য মাত্রা নিয়ে আসবে। তাকেই বলে গলার কাজ। সূক্ষ্ম কাজের জড়োয়া গয়নার সঙ্গেই তার তুলনা চলে। এর জন্যে চাই তানের রেওয়াজ। সাপাট তান, গমক, হলক তান – এ সবই স্বরশিক্ষণের অঙ্গ।

গানের অনুভূতিপ্রবণতার শিক্ষা – শ্রুতিজাতি

‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পের ‘আঃ’ কথাটা মনে পড়ে? সত্যজিৎ রায় পটলবাবুকে দিয়ে এই একটি কথাই নানান সুরে বলিয়েছিলেন। গল্পের পটলবাবুর উপলব্ধি – “চিমটি খেলে মানুষে যেভাবে আঃ বলে, গরমে ঠাণ্ডা শরবত খেয়ে মোটেই সেভাবে আঃ বলে না।”

একই কথাকে নানাভাবে ব’লে মনের বিভিন্ন অবস্থা বোঝানো যায়। সংগীতের গায়কীতে এটিই শ্রুতিজাতি। একই সুর বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করতে গেলে বদলে বদলে যায়। সংগীতশিক্ষার এই স্তরে গুরু শেখান কোন স্বরকে কীভাবে গেয়ে কোন ভাবটি বোঝানো যাবে। ঠিক যেমন আমরা একই কথা অনেকভাবে বলতে পারি:

‘ভূতো, এদিকে আয়’

‘অ্যাই ভূতো, আয় এদিকে’

‘বাবা ভূতো, এদিকে আয় না রে’

‘ভূতোদা, এদিকে আসবে একবারটি?’

ভূতোর প্রতি আহ্বান বদলে বদলে যাচ্ছে প্রতিটি কথায়।

তেমনি বিভিন্ন অনুভূতিকে প্রকাশ করতে গেলে একই স্বরের স্বরক্ষেপণ বদলে বদলে যায়। তাকে বলে শ্রুতিজাতি। সুরটা একই কিন্তু বিভিন্ন ভাবে বলা। গানের অনুভূতিপ্রবণতা পাঁচটি শ্রুতিজাতি দিয়ে বোঝানো যায়:

  • আয়তা – ইনি বিস্তারিত (এক্সটেন্ডেড), এক স্বর থেকে শুরু করে অন্যস্বরে গিয়ে মিশে যান, যেমন মারবা রাগের ঋষভ।
  • মৃদু – আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া স্বর, যেমন কামোদের ধৈবত বা কড়ি মধ্যম।
  • মধ্যা – এঁর স্থান মাঝামাঝি, সাধারণত সম্বাদী স্বর, যেমন ইমনের নিষাদ।
  • করুণা – গড়িয়ে নেমে যাওয়া স্বর, সাধারণত অবরোধ গতির, ইমোশন আনতে জুড়ি নেই, যেমন বেহাগ রাগের প-হ্ম-গ কম্বিনেশন।

গান শুধু সুরে গাইলেই হবে না, শ্রুতিজাতির শিক্ষা অপরিহার্য।

খেয়াল গানের কথা – বন্দিশ

তাল হল, সুর হল, শ্রুতিজাতি দিয়ে আবেগও নাহয় আনা গেল, বুদ্ধিমান পাঠক লক্ষ্য করেছেন, গানের কথা নিয়ে এখনো আমার মুখে কথাটি নেই। কথা হচ্ছে গানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাকে বাদ কি দিতে পারি? গানের কথা না বুঝে গাইলে যে কী বিপত্তি হতে পারে তা নিয়ে একটা গল্প শোনাই। আমার গুরুর মুখে শোনা। খাসা গল্প।

এক গুরু তাঁর ছাত্রকে ধ্রুপদ শেখাচ্ছেন। গানটি গণেশবন্দনা। প্রথমেই বলা হচ্ছে ‘পার্বতীসূত লম্বোদর’।

ছাত্র নিজের মতো বুঝে নিয়ে কোনো এক অদেখা পার্বতীর উদ্দেশ্যে গাইলো ‘পার্বতী সুতো লম্বা করো’। সেই ছাত্রেরও শিষ্য-শিষ্যা আছে। এবার তাদের গানটি শেখানো হল। তাদের মধ্যে একজন ব্যাপারটা আরও প্রাঞ্জল করে দিল – ‘পাক দিয়ে সুতো লম্বা করো’। ভেবে দেখুন একবার, কী ট্রান্সফরমেশন!

এবার আসি কাজের কথায়। মানে ‘কথা’র কথায়।

খেয়ালে বরাবরই সুর আর তালের দিকেই সবটা মনোযোগ। কথা নিয়ে কেউই খুব মাথা ঘামায়নি। যে কারণে আমিও আমার প্রবন্ধে ও দুটি জিনিস নিয়েই পাতা ভরাচ্ছি। কিন্তু গানের কথা তো একটা আছে? নেই নেই করে হলেও বিলম্বিত খেয়ালের দুলাইন ও দ্রুত খেয়ালের চারলাইন – এটুকু আছে। এদের পোশাকি নাম বন্দিশ। গানের খাতায় সেগুলি সযত্নে লেখা থাকে। কোনটা কোনটা আবার গুরুর হস্তাক্ষরে।

জনান্তিকে জানাই, গুরুর মুক্তো-ঝরা হাতের লেখায় বন্দিশটি লিখিয়ে নেবার জন্যে গুরুভাইবোনদের মধ্যে একটা অদৃশ্য রেষারেষি চলতো। নতুন বন্দিশ শেখার দিন সব্বাই তাদের নিজ নিজ খাতাটি গুরুর পানে বাড়িয়ে আছে, কার কপালে শিকে ছেঁড়ে! আমার খাতায় বেশিরভাগ বন্দিশ তাঁর হাতের লেখায়, আমার খাতাটি সত্যিই অমূল্য।

একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখি খেয়াল এসেছে কাওয়ালি থেকে। প্রখ্যাত কাওয়াল আমির খুসরু খেয়ালের জন্মদাতা। তাঁর গুরু ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। আমির খুসরুর বেশিরভাগ বন্দিশেই তাঁর গুরুর উল্লেখ আছে। তাঁর শিষ্যরা নিজেদের বলতো ‘কাওয়াল-বাচ্চে’।

সেই জন্মলগ্নে খেয়ালের বন্দিশ ছিল প্রধানত প্রফেট মোহাম্মদ বা মহান আল্লার গুণকীর্তন। ‘লা ইলাহী ইল্লাল্লা’, মতান্তরে ‘লা হি লা ইল্লাল্লা’।  একই গান যখন রাজদরবারে  গেল বা সাধারণ শ্রোতার কাছে পৌঁছল, তখন একঘেয়েমি কাটাতে তার সঙ্গে বিভিন্ন কথা যুক্ত হল। ধর্ম সরে গেল, এলো প্র্রাকৃতিক ও সামাজিক শব্দবন্ধ। তবে ওস্তাদরা কেউ খুব একটা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, তাঁরা মূলত সুর ও তালের কারবারী। কাব্যিক বা উচ্চভাবের কথা খুব বেশি পাওয়া যায় না।  উর্দু, ফার্সি বা হিন্দিতে লেখা বন্দিশগুলি খুব আহামরি নয়। আমার গুরু বন্দিশের মানে বলে বলে দিতেন। তাঁর নজর থাকতো শুদ্ধ শব্দ ও শুদ্ধ উচ্চারণ ব্যবহারের দিকে। তিনি তো শুধুই সংগীতজ্ঞ নন, তাত্ত্বিকও বটে, সংগীতের নান্দনিকতা নিয়ে তাঁর গবেষণা সংগীতশিক্ষার্থীদের কাছে একটি মাইলস্টোন।

তাঁর প্রশ্রয়ে ও স্নেহচ্ছায়ায় আমি উপলব্ধি করলাম, পাটোয়ারী বা পেশাদারি খেয়ালের বন্দিশ সাধারণত এই বিষয়গুলি নিয়ে তৈরী হয়:

শাশুড়ি-ননদকে হয় গাল দিয়ে নয়তো ভয় পেয়ে – ‘সুন পাবে মোরি সাস-ননদিয়া’

সতীনের সংসার নিয়ে প্রবল অশান্তি ক’রে – ‘কৌন সৌতন সঙ্গ জিয়া ভরমায়ে’

প্রিয়কে ঘরে আসার জন্যে আকুল ডাকাডাকি – ‘মোরে ঘর আ যা সুরজন সাঁইয়া’

কাক, কোকিল ইত্যাদি পাখপাখালি নিয়ে – ‘যা যা রে যা কাগবা, ইতনি সন্দেশ মোরে কহিও যাকে’

শেষোক্ত বন্দিশটি নিয়ে আমার বরাবরের আপত্তি ছিল। এতো পাখি থাকতে কাককে দিয়ে খবর পাঠাবার কথা আমি কল্পনাতেও আনতে পারতাম না। গুরু এক ধমকে আমার বাচালতা তখনকার মতো নিবৃত্ত করেছিলেন। তবে ‘কাগবা’ দিয়ে তান বা বিস্তার করতে আমার চিরটাকাল আপত্তি, সযত্নে পরিহার করি ওই কুচ্ছিত পাখিটিকে।

তুলনায় ধ্রুপদের বন্দিশ, যাকে প্রবন্ধগীতি বলা হয়, অনেক সমৃদ্ধ, কাব্যিক। তানসেন নিজে সংস্কৃত চর্চা করতেন। তাঁর রচিত একটি ধ্রুপদ ‘সঘন বন ছায়ো বেলি মাধো ভুবনঅতিপ্রকাশ’ – অসামান্য প্রকৃতিবর্ণনা, ফুলবন্ত ধ্রুপদ। পরের দিকে প্রবন্ধগীতির সঙ্গে বিজাতীয় শৈলী মিলেমিশে গিয়ে খেয়ালের বন্দিশ অনেক উন্নত হয়। শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পন্ডিত রতনজনকার, ধ্রুবতারা জোশিরা উচ্চমানের বন্দিশ লেখেন। আমার গুরুর রচনা অসাধারণ কাব্যিক বন্দিশ আছে। অনুষ্ঠানে আমরা সেগুলি গেয়ে থাকি।

গান শেখার সেকাল-একাল – গুরুগৃহ না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা?

আমির খুসরুকে যদি খেয়ালগানের স্রষ্টা হিসেবে ধরা হয় তাহলে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বয়স সাতশো বছর। তার শিক্ষাপদ্ধতিও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। উনিশশো শতকে বালক রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নাড়া বাঁধলেন বুন্দিপ্রসাদ মিশ্রের কাছে। গুরু যেমন খেয়ালি, তেমনই রাগী। ছেলে দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে রামকুমার তালিম নিতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তালিম, কখনো কখনো সকাল সন্ধে মিলিয়ে দশ-বারো ঘন্টা। তাঁর নিজের কথায়, “অনেক সময় সকালে আমার তালিম শুরু হত, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে, পন্ডিতজির হুঁশ নেই। তিনিও অভুক্ত, ছাত্রও অভুক্ত। হঠাৎ হয়তো আমার করুণ মুখ দেখে ওঁর মনে হল, ছেলেটির খাওয়া হয়নি, এমনকি নিজেও খাননি, তখনই তিনি তালিম বন্ধ করে দিতেন। বলতেন, ‘এখন তালিম বন্ধ। আগে খাও, অনেক মেহনত হয়েছে’।” প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতেন, পরে গুরুর বাড়ির ছেলে হয়েছিলেন রামকুমার। গুরুর মেজাজ ঠান্ডা করার জন্যে হাত-পাও টিপে দিয়েছেন।

গুরুগৃহে এটাই ছিল রীতি। শিক্ষার্থী গুরুর সঙ্গেই দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতো। গুরুগৃহে যা রান্না হতো তাই খেত। বাড়ির আর পাঁচটা ছেলের মতোই জল তুলে, ঘর ঝাড়ু দিয়ে গৃহকর্মে সাহায্য করত। সেইসঙ্গে চলতো ট্রেনিং। কোনো রাগ বা রাগিনী নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা, তার আশপাশের রাগগুলোর চর্চা করে দিন শেষ হয়ে যেত।

বিংশ শতকে বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের মাইহার গুরুকুল বিখ্যাত হয়ে আছে। বাবা আলাউদ্দিন খান ছিলেন মাইহারের রাজার সভাগায়ক। মধ্যপ্রদেশে ছোট্ট একটি জায়গা মাইহার, প্রিন্সলি স্টেট। সেখানে ততোধিক ছোট একটি বাড়ি। সেই ছোট্ট বাড়িটিতে ভিড় করেছিল একঝাঁক নক্ষত্র। বাবা আলাউদ্দিনের পক্ষপুটে। এমন সমাবেশ ভারতীয় সংগীতে খুব কমই দেখা গেছে। গুরুগৃহে গুরুর পায়ের তলায় বসে সারাদিন চলতো সাধনা। গুরু ছিলেন খুব কড়া, কোনো বেচাল সহ্য করতেন না। রেওয়াজে এতটুকু এদিকওদিক হওয়া চলতো না। বলে গেছেন তাঁর অন্যতম ছাত্র শ্রী নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের ছাত্ররা পরে সংগীতের একেকজন দিকপাল হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছেন। রবিশঙ্কর, আলী আকবর, অন্নপূর্ণা দেবী, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বাহাদুর খান – সবাই মাইহার গুরুগৃহে তৈরী হয়েছেন।

কালের নিয়মেই একদিন গুরুগৃহে বাস করে সংগীতশিক্ষা অসম্ভব হয়ে গেল। স্কুলে, কলেজে লেখাপড়া, চাকরি এই নিয়েই জীবন বাঁধা সড়কপথে এগোতে লাগলো। তার মধ্যেই সংগীতপিপাসু বাবা-মা ছেলে বা মেয়েকে বগলদাবা করে গুরুর সাপ্তাহিক গানের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। শাগিরদি বদলে গেল গানের ক্লাসে। বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে শেখা অথবা সপ্তাহান্তে গুরুগৃহে উপস্থিত হয়ে গানের ক্লাস করা। সংগীতশিক্ষার বিদ্যালয়ে অনেক গুরুর ও শিষ্যশিষ্যার সমন্বয় হল। সংগীতের তাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ডিগ্রি কোর্স চালু হল। আক্ষরিক অর্থেই গুরুগৃহ থেকে বেরিয়ে সংগীত আর পাঁচটা বিদ্যার মতোই প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা হল।

এপ্রসঙ্গে পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকারএর কথা বলতেই হবে। খেয়াল গানকে দরবার ও গুরু-নির্ভর ঘরানার গন্ডী পার করে রাগসংগীতের তত্ত্ববিন্যাস বা প্রথম স্ট্রাকচারটি করেছিলেন পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে। ভারতের প্রথম মিউজিকোলজিস্ট তিনিই। রাগ-রাগিনীর বিরাট ভান্ডারকে সুসংবদ্ধ করে তিনি ঠাট অনুযায়ী তাদের শ্রেণীবিভাগ করলেন। প্রতিটি রাগের ব্যাকরণ ও চলন নথিবদ্ধ করলেন। তাঁর শিষ্য পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকার কর্মজীবনে ছিলেন মরিস মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। অল ইন্ডিয়া রেডিও, আকাশবাণীতেও তিনি উচ্চপদে কাজ করেছেন। ঋষিতুল্য এই ভদ্রলোকটি তাঁর গুরুর নির্দেশমত সংগীতশিক্ষার প্রসার ঘটাতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁদের এই মহাজাগতিক কাজের জন্যই পরে প্রাতিষ্ঠানিক সংগীতশিক্ষা সম্ভব হয়েছে।

কর্পোরেট গুরুকুল – সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি

উনিশশো একাত্তর সালে আইটিসি সংস্থাটি দিল্লিতে একটি সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করে। কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় সংগীত সম্মেলন – দিল্লিতে আলোড়ন পড়ে যায়, বহু শ্রোতার সমাগম হয়। সম্মেলন থেকে ভালো আর্থিক লাভ হয়। সে টাকা দিয়ে আইটিসি দুঃস্থ সংগীতজ্ঞদের সাহায্য করে। প্রতি বছরই এই সম্মেলন চলতে থাকে। অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে আইটিসি এবার আরো বড় একটা কাজে নামে।

সে সময় রাজারাজড়াদের দিন শেষ। তাঁদের অনুগ্রহে লালিত উচ্চাঙ্গসংগীত ধুঁকছে। গভর্নমেন্ট কিছু সাহায্য করে, তবে সে অতি সামান্য। উচ্চাঙ্গসংগীতকে বাঁচিয়ে রাখতে আইটিসি কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। এমন উদ্যোগ আগে কোনোদিন ভাবাও যায়নি, দেখা তো দূরের কথা। তৈরী হয় সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি। প্রথমে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসেবে গোড়াপত্তন। একবছরের মধ্যেই উনিশশো আটাত্তর সালে কলকাতার টালিগঞ্জে নতুন বাড়িতে শুরু হয় কর্পোরেটের ব্যবস্থাপনায় সংগীতচর্চার কেন্দ্র।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবে গুরুকুল পদ্ধতিতে গুরুগৃহে শিক্ষার অতীত ধারাটি মেনে চলে। কর্পোরেটের আর্থিক সাহায্য নিয়ে তৈরী সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ওপর জোর দেওয়া হয়। নিয়মিত সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করে অ্যাকাডেমির ছাত্রছাত্রীদের পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে ধরেন এঁরা। প্রতি ডিসেম্বরে আয়োজিত আইটিসি সংগীত সম্মেলন শুনতে ভারতের সব প্রান্ত থেকে বোদ্ধা শ্রোতারা কলকাতায় হাজির হন, এমনই তার উৎকর্ষ। এছাড়াও এঁদের একটি বৈজ্ঞানিক রিসার্চ ডিভিশন আছে। এখনকার প্রতিষ্ঠিত রাগসঙ্গীত শিল্পীদের অনেকেই এই অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়েছেন।

 

সংগীতশিক্ষার  স্বগুণাত্মক দিক

গান শিখে সংগীতের মাধ্যমে নিজের ও অন্যের আনন্দের ঝুলিটি ভরে নিই আমরা। কিন্তু শুধু গানই নয়, গান গাওয়া ছাড়াও রাগসঙ্গীত শিক্ষার অনেকগুলো সুফল আছে।

রাগসঙ্গীত পুরোটাই তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন (ইম্প্রোভাইজেশন)। গায়ক বন্দিশকে আশ্রয় ক’রে বিস্তার, তান ও সরগমের মাধ্যমে রাগের রূপটি ফুটিয়ে তোলেন। পুরো গানটির মধ্যে একমাত্র বন্দিশ বাদ দিলে, পুরোটাই গায়কের তাৎক্ষণিক সৃষ্টি। পূর্ণ মনোযোগ ছাড়া এ গান গাওয়া যায় না। রাগসঙ্গীত রেওয়াজে মনঃসংযোগ বাড়ে, ধ্যান বা মেডিটেশনেরই মত। তার সুফল পাওয়া যায় পড়াশোনা ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে।

তান বা সরগমের বিশেষত্ব হল, এক একটি তান বা সরগমের আবর্তনের পর বন্দিশের মুখে ফিরতে হয়। অঙ্কের মতো ক্রমবৃদ্ধি (প্রোগ্রেশন), শেষে কিন্তু বন্দিশে মেলাতেই হবে। গুণী শিল্পীরা মাঝে মাঝে কূট তেহাই দিয়ে ঠিক বন্দিশের মুখটিতে এসে মিলিয়ে দেন। একটি মাত্রারও এদিক ওদিক হয় না। পাল্টা সাধনার সময় স্বরের বিন্যাস-সমন্বয় (পার্মুটেশন-কম্বিনেশন) কাজে লাগাতে হয়। প্যাটার্ন তৈরীর খেলা, যার সবটাই তাৎক্ষণিক, স্টেজে বসে করা। কিছুই পূর্ব-পরিকল্পিত (স্ক্রিপ্টেড) নয়। এগুলো মগজের খুব ভালো ব্যায়াম, যুক্তিপূর্ণ চিন্তার (লজিক্যাল রিজনিং) ক্ষমতা বাড়ায়, অঙ্কের ভিত পোক্ত হয়।

খেয়ালের বিস্তার, তান, সরগম করতে দম লাগে। শ্বাসবায়ু বুকে ভরে নিয়ে লম্বা সময় ধরে স্বরক্ষেপণের মাধ্যমে একটু একটু করে ছাড়া – এটি রাগসংগীত শিক্ষার অঙ্গ। এই শ্বাস প্রক্রিয়া প্রাণায়ামের সমতুল্য। ফুসফুস ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ভালো রাখতে এর জুড়ি নেই। গানের সাধনা বা রেওয়াজ আসলে একটি দৈহিক এক্সারসাইজ। আধঘন্টা রেওয়াজ করলে শীতেও গা গরম হয়, রেওয়াজ শেষে অনেক সময়ই খিদে পায়। রেওয়াজের ফলে শরীর সুস্থ থাকে। আমার গুরু চুরানব্বই বছর বয়েসেও ফিট, তাঁর গলার সপাট তান এখনো শ্রোতাকে সোজা করে বসিয়ে দেয়। তাঁর সুস্থ শরীরের রহস্য হল নিয়মিত রেওয়াজ।

তাছাড়াও সংস্কৃতিযাপন করলে বিবিধ সদগুণের বিকাশ ঘটে। মানুষ ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, দয়াশীল হয়। অনুষ্ঠানে বা স্টেজে সংগীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে জড়তা কেটে যায়। এত শ্রোতার সামনে গাইতে গাইতে শিল্পী স্টেজ-ফ্রি, অর্থাৎ নির্ভীক ও সাহসী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে।

সংগীত জীবনে মুক্তি আনে। সংগীতের রসগ্রহণ করলে যে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়, তা পরীক্ষিত সত্য। পেশাদার গাইয়ে না হলেও, সাধারণ মানুষও সংগীতশিক্ষার মাধ্যমে মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারে।

আর সংগীতের রোগ উপশম ক্ষমতা তো সবারই জানা। ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা, শরীরে মোটর ও কগনিটিভ ফাংশনগুলো ঠিক করা – সর্বত্রই সংগীতকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সুফলও মেলে। মনের ওপর সংগীতের সদর্থক প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত সত্য।

অতএব বুদ্ধিমান পাঠক, নিজে ভালো থাকার জন্যেই রাগসংগীতের সঙ্গে জানপহচান করে নিন, এখনো যদি না করে থাকেন।

উপসংহার

কথায় বলে, ‘গুরু মেরে লাখ, চেলা মেরে এক’। আমরা শিক্ষা নিই সবার কাছে, মানুষ, প্রকৃতি, পশুপাখি – সবাই কিছু না কিছু শেখায়। কিন্তু শিষ্য একমেবাদ্বিতীয়ম। সঠিক গুরুর কাছে শিষ্য একটাই।

গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সম্পর্কটিও একেবারে অন্যরকম, ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা। যে কোনো সম্পর্কের থেকে আলাদা। মা,বাবা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে – কোনো সম্পর্কের সঙ্গেই গুরুর তুলনা হয় না। এ সম্পর্ক সহজে গড়ে ওঠে না, কিন্তু একবার গড়ে উঠলে ভাঙেও না। গুরুর সঙ্গে সেই অচ্ছেদ্যবন্ধন আমি অনুভব করেছি। এটি আমার সঙ্গীতশিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তিনি এখনো আমায় ধরে রেখেছেন। যখনই অনিয়মিত হয়ে পড়ি, তাঁর নিত্য অনুযোগ আবার আমায় ঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনে। তিনি স্বপ্ন বুনে দেন মনে, আমি উৎসাহ পাই।

অতিমারীর সময় দুনিয়াটাই চোখের সামনে বদলে গেল। সংগীতের শিক্ষার মাধ্যমেও বদল এলো। অনলাইনে শিক্ষা এখন জলভাত। সামনাসামনি গান গেয়ে শোনানোর বদলে অন্তর্জালে গানের আসর বসলো। এবং আমরা, গাইয়েরা অবাক হয়ে দেখলাম একঝটকায় পুরো পৃথিবীটা উন্মুক্ত হয়ে গেল। বিশ্বের সবখান থেকে মানুষ গান শুনতে আসেন, রাগসংগীতের এক একটি অন্তর্জালিক অনুষ্ঠানে আশাতীত শ্রোতার সমাবেশ ঘটে। এগুলো সবই এই দুঃসময়ের মধ্যে আশীর্বাদসম।

আমরা মানিয়ে নিচ্ছি পরিস্থিতির সঙ্গে, সংগীতও পথ খুঁজে নিচ্ছে। গুরু সর্বদাই আছেন পাশে। সুখে-দুঃখে-আনন্দে-বিরহে-বিষাদে ধ্রুবতারা হয়ে সুরের আকাশে তিনি আলো ছড়ান। আমার এ লেখাটি তাঁকেই উৎসর্গীকৃত। আমার ‘গোষ্পদে সিন্ধুদর্শন’।

ঋণস্বীকার:

আমার গুরু সঙ্গীতাচার্য ডঃ অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রী সুজন দাশগুপ্ত

শ্রী সম্বুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়

‘পুরাতনী’ – শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়

‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’ – শ্রী কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

চিত্রঋণ

 

 

বিদ্যায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কনসালট্যান্ট, নেশায় লেখিকা। নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বাসিন্দা । শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শিল্পী।

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Subrata Goswami , January 16, 2021 @ 7:16 pm

    অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। নিঃসন্দেহে ভালো লাগার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *