গোড়ার কথা – প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি-বিলোপ: হঠকারী পদক্ষেপ?
লোকমুখে বহুল-প্রচল কথাটি হল — পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ইস্কুল থেকে ‘ইংরেজি তুলে দিয়েছিল’। সত্যি কথাটি হল, বামফ্রন্ট সরকার বিদ্যালয়শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা প্রত্যাহার ক’রে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তা চালু করেছিল (১৯৮৩-৮৪ সালে) । এবং, এই পদক্ষেপটি বামফ্রন্ট সরকারের অভিনব উদ্ভাবন ছিল না। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবেও এ-কে দেখা যাবে না। তৎকালীন যুগে ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যেই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানো হত না (নিম্নের সারণী দ্রষ্টব্য) ।
১৯৪৮-এর রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন থেকে ১৯৬৬-এর কোঠারি কমিশন পর্যন্ত স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যত জাতীয় শিক্ষা কমিশন হয়েছিল, সব কটিই প্রাথমিক শ্রেণিতে একটি ভাষা পড়ানোর ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য সুপারিশ জানিয়েছিল। আমাদের রাজ্য অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা কমিশনগুলির প্রতিবেদনও ছিল অনেকটা একই রকম।
১৯৪৮ সালে তৈরি হওয়া ‘পশ্চিমবঙ্গ স্কুল এডুকেশন কমিটি’-র প্রতিবেদনে অনুরূপ প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং সেই সুপারিশকে মান্যতা দিয়েছিল রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। বিধানচন্দ্র রায় যতদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ততদিন এই নীতিই বহাল ছিল। পরবর্তী কালে প্রাথমিক শ্রেণিতে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা ফিরে এলেও কংগ্রেস আমলে তৈরি হিমাংশুবিমল মজুমদার কমিশন (১৯৭৫-৭৮) ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে ফের সুপারিশ করে। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে সেই নির্দেশকেই কার্যকরী করে ১৯৮৩ সালে এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ইংরেজি শিক্ষাদানের পুরোনো পদ্ধতি বর্জন ক’রে ‘ফাংকশনাল-কমিউনিকেটিভ’ পদ্ধতি অবলম্বনে ইংরেজি শিক্ষাদানের নতুন নীতি প্রণয়ন করা হয়।
নতুন ভাষাশিক্ষা নীতির সপক্ষে যুক্তি
আমরা দেখতে পেলাম, বামফ্রন্ট সরকারের ভাষাশিক্ষানীতি তৎকালে প্রভূত বিতর্ক সৃষ্টি করলেও এই পদক্ষেপ তৎকালীন সময়ের প্রচলিত শিক্ষা-ভাবনারই প্রতিনিধিত্ব করছিল। বামফ্রন্ট সরকার এই শিক্ষানীতির একটি সদর্থক ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। সমালোচনার প্রত্যুত্তরে বামফ্রন্ট সরকার বলেনি যে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার অবমূল্যায়ন তাদের উদ্দেশ্য। তাদের যুক্তির দুটি দিক ছিল লক্ষণীয়।
প্রথমত, তাদের ভাষ্যটি ছিল, একটি ভাষা ভালভাবে আয়ত্ব করতে পারলে অর্থাৎ মাতৃভাষা-জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা সহজতর হয়। অধিকাংশ শিক্ষাবিদই এই ভাবনার অংশীদার ছিলেন। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে ১৯২৪ সালে লেখা এক চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন,
আমি প্রায় ষোলো বছর পর্যন্ত ইংরেজি না শিখে বাংলা শিখেছিলুম এবং তাতেই আমার মনের ভূমিকা পাকা করে তৈরি হয়েছিল, সেই ভূমিকার উপর অতি সহজেই প্রায় বিনা চেষ্টায় ইংরেজির পত্তন হতে পারল।
‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’ প্রবন্ধে মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আরও বিশদে লিখেছিলেন, বলেছিলেন,
ভালো ক’রে বাংলা শেখার দ্বারাতেই ভালো করে ইংরেজি শেখার সহায়তা হতে পারে।
প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষাদানের বিড়ম্বনা চিহিত ক’রে ‘শিক্ষার হেরফের’ নামক প্রবন্ধে বলেছিলেন,
–– নীচের ক্লাসে যে-সকল মাস্টার পড়ায় তাহারা কেহ এন্ট্রেন্স্ পাস, কেহ বা এন্ট্রেন্স্ ফেল; ইংরেজি ভাষা ভাব আচার ব্যবহার এবং সাহিত্য তাহাদের নিকট কখনোই সুপরিচিত নহে। তাহারাই ইংরেজির সহিত আমাদের প্রথম পরিচয় সংঘটন করাইয়া থাকে। তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি; কেবল তাহাদের একটা সুবিধা এই যে, শিশুদিগের শিখানো অপেক্ষা ভুলানো ঢের সহজ কাজ এবং তাহাতে তাহারা সম্পূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করে।
বামফ্রন্টের শিক্ষানীতির প্রচারকদের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বড়ো সম্বল।
নতুন ভাষা-শিক্ষানীতির সপক্ষে বামফ্রন্ট সরকারের দ্বিতীয় যুক্তি ছিল — কান্তি বিশ্বাসের ভাষায়,
বিশেষজ্ঞগণ বলেন কোন্ শ্রেণি থেকে কত বছর ধরে ইংরেজি পড়ানো হবে ইংরেজিতে দখল তার উপর যতটা নির্ভর করে তার থেকে এই দখল বেশি নির্ভর করে কোন্ পদ্ধতিতে কতটুকু নিষ্ঠা নিয়ে ইংরেজি পড়ানো হচ্ছে তার উপর’ (গণশক্তি, ১৩ মে, ১৯৯৩)। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষার পুরোনো পদ্ধতি (যাকে বলা হত ‘ট্রানস্লেশন মেথড’)-র পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির (যাকে বলা হত ‘ফাংকশনাল-কমিউনিকেটিভ মেথড’) উপর বামফ্রন্ট সরকার বেশি জোর দিতে চেয়েছিল। এই পদ্ধতির আবিষ্কারক অবশ্য বামফ্রন্ট সরকার ছিল না। এলাহাবাদের রিজিওনাল ইন্সটিটিউট অব ইংলিশ দীর্ঘ গবেষণার পরে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল (১৯৭১) এবং এন-সি-ই-আর-টি এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্যগুলিকে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখানোর জন্যে আবেদন করেছিল।
(কান্তি বিশ্বাস, গণশক্তি, ১৩ মে, ১৯৯৩)
নতুন ও পুরোনো পদ্ধতির পার্থক্য
হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুলের প্রাক্তন ইংরেজির শিক্ষক মির্জা রফিউদ্দিন বেগ মহাশয় পুরোনো ও নতুন পদ্ধতির তফাতটি এই ভাবে চিহ্নিত করলেন:
পুরোনো পদ্ধতিতে গ্রামার ও ট্রানস্লেশন শিক্ষার উপর অত্যধিক জোর পড়ত। বাঙলায় বাক্য ভেবে নিয়ে তার ট্রানস্লেশনের মাধ্যমে শুদ্ধভাবে ইংরেজি লেখার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। ইংরেজিতে কথোপথন বা মৌখিক কমিউনিকেশনের উপর আলাদা করে জোর দেওয়া হত না। ক্লাসে শিক্ষক বাঙলা ভাষায় কথা বলেই ইংরেজি টেক্সট পড়িয়ে দিতেন। অন্যদিকে, ‘ফাংকশনাল-কমিউনিকেটিভ মেথড’-এ ইংরেজিতে কথোপকথন ও কমিউনিকেশনের উপর জোর দেওয়া হত; গ্রামারের বিশুদ্ধতা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কমিউনিউকেশনে মনোযোগ দেওয়ার উপদেশ দেওয়া হত। আশা করা হয়েছিল, শিক্ষকেরা ক্লাসে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা ইংরেজির মাধ্যমেই দেবেন। ছাত্ররাও ইংরেজি কথাবার্তা কানে শুনতে শুনতে ও বলা প্র্যাকটিস করতে করতে ক্রমশ ইংরেজি কমিনিউকেশনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। নতুন পদ্ধতিতে ইংরেজি সাহিত্য পঠন-পাঠনের চেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্য-ব্যবহারের ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের কার্যকারিতায় আস্থা রাখা হয়েছিল।
নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসমূহের শিক্ষাঙ্গনে অন্তর্ভুক্তি ও তার অভিঘাত
ইংরেজি ভাষাশিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি ১৯৮০ ও ‘৯০-এর দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও একটা সমান্তরাল পরিবর্তনের দিকে আমাদের লক্ষ রাখা দরকার। এটি হল শিক্ষার ক্রমান্বয়িক প্রসার — সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে অধিক সংখ্যক সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থীর অনুপ্রবেশ। এই প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়েছিল বিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সংস্কার, উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাবার প্রদান (পাঁউরুটি) ইত্যাদি নানাবিধ ব্যবস্থা ও সরকারি উদ্যোগ। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৬-৭৭-এ পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৪২, ৮৮১ এবং ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ৫০.৮৩ লক্ষ। ২০০৪-০৫-এ এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫২, ৪২৬ এবং ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১০১. ৫১ লক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আঙিনায় এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষের অন্তর্ভুক্তি, বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের সিংহভাগই সমাজের পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক জনসমষ্টি থেকে এসেছিল, যারা ছিল প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে খুব ইতিবাচক। কিন্তু এর ফলে শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে একটা জটিলতাও আত্মপ্রকাশ করেছিল। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তানদের স্বাভাবিক চাহিদা হল সন্তানকে এমন ভাবে শিক্ষিত করা যাতে তারা ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলিতে উত্তীর্ণ হয়ে সফল কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারে। স্কুল-শিক্ষা এঁদের কাছে উচ্চতর শিক্ষার ভিত তৈরির ও সরকারি-বেসরকারি চাকরি-বাকরি লাভের সোপান। কিন্তু পিছিয়ে-থাকা ও প্রান্তিক মানুষদের পরিবারগুলির প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে এই সচেতনতা ছিল না, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল অক্ষরজ্ঞান, খানিক পড়তে-লিখতে পারা। বিদ্যালয়-শিক্ষার উচ্চতর স্তর পর্যন্ত এদের ধরে রাখাটাই ছিল সরকারের মুখ্য লক্ষ্য। এই কারণেই নতুন শিক্ষানীতির অঙ্গ হিসেবে প্রাথমিকে ‘নো-ডিটেনশন পলিসি’ গৃহীত হয়েছিল — পাস-ফেল প্রথার পুরোনো মূল্যায়নের পরিবর্তে মূল্যায়নের নতুন মানদন্ড স্থির করা হয়েছিল।
ভাল ছাত্রটিকে আরও ভাল করে তোলার প্রচেষ্টা হল আমাদের ফলিত শিক্ষাদান ব্যবস্থার প্রধান অভিমুখ। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়,
শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, সেই শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসক, সকলেই বিশ্বাস করেন যে শিক্ষা গড়পড়তা স্কুলের পড়ুয়ার জন্য নয়। তাঁদের দৃষ্টিতে স্কুলশিক্ষার উদ্দেশ্য হল সবচাইতে সফল ছাত্রছাত্রীদের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষার জন্য তৈরি করা, যাতে তারা তাদের পরম অভীষ্ট – সরকারি চাকরি, কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে আসন—লাভ করতে পারে।
অথচ সরকারি নীতির একটি প্রধান বিবেচনা হল শিক্ষার পরিমাণগত বিস্তার – পিছিয়ে-থাকা, প্রান্তিক ও শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত সামাজিক শ্রেণিগুলিকে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা এবং তাদের ধরে রাখা। বামফ্রন্ট সরকারের প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষানীতির উদ্দেশ্যও ছিল তাই। বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস ১৯৮৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন,
প্রাথমিক স্তরে ইংরাজি তুলে দেওয়ার ফলে ড্রপ-আউটের সংখ্যা কমেছে, আরও বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়েদের আমরা প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে পেরেছি। যেসব বাড়িতে এর আগে কখনও শিক্ষার আলোক পৌঁছায়নি, তাঁদের সন্তানরাই প্রথম স্কুলে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ইংরাজি-ভীতি তাদের মাঝপথে আগের মতো স্কুল ছাড়তে বাধ্য করছে না। আমাদের তো শুধু সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবলেই চলবে না, নিরক্ষর জনসাধারণের বিপুল অংশকে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। [পশ্চিমবঙ্গ, ৪ আগস্ট, ১৯৮৯]
কান্তি বিশ্বাসের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ড্রপ-আউটের সংখ্যা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় অনেকটা কমেছিল নিঃসন্দেহে, (সর্বভারতীয় গড় এই সময়ে ছিল ৭৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রাথমিকে যত ছাত্র ভর্তি হত তার ৭৩ শতাংশ ক্লাস এইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত না; পশ্চিমবঙ্গে এই গড় ছিল সেই সময় ৬০ শতাংশ) তবে পশ্চিমবঙ্গেও ড্রপ-আউটের সংখ্যা কম ছিল না এবং ড্রপ-আউটের সংখ্যা-হ্রাসের ব্যাপারটিকে শুধুমাত্র ‘ইংরেজি-ভীতি’-র অবলোপ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়তো যায় না। কিন্তু শ্রীবিশ্বাসের বক্তব্য থেকে অন্য একটা জিনিস প্রমাণিত হয় – সেটি হল, সরকার তার নীতিতে প্রাথমিক স্তরে ‘সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের’ থেকে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছিল, যাদের জীবনে ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও বাচনিক দক্ষতার চেয়েও প্রাসঙ্গিক ছিল অন্যান্য কিছু বিবেচনা। সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলির আপাত পরস্পর-বিরোধী অগ্রাধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। অন্য ভাবে বললে, শিক্ষার পরিমাণগত প্রসারের সঙ্গে গুণগত উৎকর্ষের সামঞ্জস্যবিধান।
নতুন ভাষাশিক্ষা নীতির প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতা
শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষের পূর্বশর্ত উন্নত মানের ভাষাশিক্ষা। কেননা ‘ভাষা’-র মাধ্যমেই শিক্ষার্থী যে-কোনো বিষয়ের ‘জ্ঞান’ আয়ত্ব করে ও প্রকাশ করে। বিদেশি কোনো ভাষার চেয়ে মাতৃভাষাই যে জ্ঞানের স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য বাহন হবার উপযুক্ত, এ-নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, বামফ্রন্ট সরকার (অন্যান্য রাজ্যের সরকারও বটে) মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল এবং স্কুলের উচ্চতর শ্রেণিতে ‘লার্নিং ইংলিশ’-এর মাধ্যমে নতুন ভাবে ইংরেজি শেখাতে চেয়েছিল। আমরা নিশ্চয় জানি, ভাল ভাষাশিক্ষার জন্যে প্রয়োজন যোগ্য শিক্ষকের মাধ্যমে অত্যন্ত যত্ন সহকারে নিবিড় শিক্ষাদান পদ্ধতি। অভিজ্ঞতা বলে, মাতৃভাষার পঠন ও লিখন-দক্ষতা অর্জনও সহজসাধ্য নয় এবং বড়ো সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এই দক্ষতা অর্জনেও সফল হয় না। ইংরেজি-ভাষায় দক্ষতা অর্জন নিঃসন্দেহে আর একটু শক্ত কাজ, বিশেষত সেই সমস্ত ছেলেমেয়েদের পক্ষে যাদের সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশে ইংরেজি কথন ও পঠনের পরিবেশ নেই, যারা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী (মনে রাখতে হবে, সময়টা ছিল আটের দশক, যখন গ্রামাঞ্চলে টেলিভিশন প্রবেশ করেনি বললেই হয়; টেলিভিশনেও ইংরেজি প্রোগ্রাম নামমাত্র)। তাছাড়া, একাধিক অভিজ্ঞ স্কুল-শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, বামফ্রন্ট সরকারর নতুন ইংরেজি ভাষাশিক্ষাকে কার্যকরী করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো অধিকাংশ বিদ্যালয়ে ছিল না। শ্রেণিকক্ষে অত্যধিক ছাত্রসংখ্যা ছিল নিবিড়ভাবে ভাষাশিক্ষার প্রদানের প্রতিবন্ধক। সেই সঙ্গে যোগ্য ও যথার্থ ইংরেজি ভাষাশিক্ষকেরও অভাব ছিল। অধিকাংশ মাস্টারমশায়-ই পুরোনো ট্রানস্লেশন মেথডে পড়াশোনাতে অভ্যস্ত ছিলেন; ইংরেজি কমিউনিকেশনে নিজেরাই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। সরকারের তরফ থেকে ইংরেজি-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সামান্য কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ তাঁদের নতুন পদ্ধতিতে কতটা সক্ষম করতে পেরেছিল তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অবশ্য পুরোনো পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখে সমস্ত ছাত্র ইংরেজিতে দিগ্গজ হয়ে যেত, এমন মনে করারও কারণ নেই। সাধারণভাবে যে-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-পরিবারে ইংরেজি নিয়ে সচেতনতা ছিল এবং গৃহশিক্ষক দিয়ে সন্তানদের যত্ন করে ইংরেজি পড়াতেন, তাদেরই একটা অংশ ইংরেজিতে কিছুটা দক্ষ হয়ে উঠত — শুধুমাত্র স্কুলের ক্লাস রুম টিচিং-এর উপর নির্ভর করে কতজনের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান পাকাপোক্ত হত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। নতুন পদ্ধতিতেও ‘বৈপ্লবিক’ কিছু হল না। বরঞ্চ বিপুল সংখ্যাক প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশের ফলে ডিগ্রিধারী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ইংরেজিতে দক্ষ ছেলেমেয়ের তুলনামূলক অনুপাত হ্রাস পেয়েছিল বলেই মনে হয় (যদিও মোট সংখ্যা বেড়েছিল বলেই অনুমান)। ইংরেজির মাস্টারমশায় (এখন অবসরপ্রাপ্ত) শ্রদ্ধেয় মির্জা রফিউদ্দিন বেগ মহাশয় নতুন ভাষাশিক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা চিহ্নিত করে বললেন,
ভাষাশিক্ষার নতুন পদ্ধতি আদর্শ হিসেবে ছিল বেশ ভাল — এমন ভাবেই তো ইংরেজি পড়ানো উচিত। কিন্তু দক্ষ শিক্ষক ও পরিকাঠামোর অভাবে তা ফলপ্রদ হয়নি। আমাদের মতো দেশে, যেখানে ইংরেজি মাতৃভাষা নয়, যেখানে সামাজিক পরিবেশের মধ্যে ইংরেজি কথোপকথন বা পঠন-পাঠনের সংস্কৃতি সেই ভাবে বিকশিত হয়নি… আমি সাধারণ পরিবারের সন্তানদের কথা ভেবে বলছি … পুরোনো মেথড অর্থাৎ গ্রামার শিখিয়ে ইংরেজি শেখার পদ্ধতিটি বেশি কার্যকরী। নতুন পাঠ্যক্রমে গ্রামার শেখানোর পুরোনো পদ্ধতিকে নাকচ করা হল, কিন্তু বিকল্প পদ্ধতিও ঠিক মতো প্রয়োগ করা গেল না, ফলে একটা শূন্যতা তৈরি হল। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, যদি নতুন ফাংশনাল-কমিউনিকেটিভ মেথডের পাশাপাশি গ্রামার শিক্ষার পুরোনো পদ্ধতিটির উপরও জোর অব্যাহত থাকত, তাহলে হয়তো বিষয়টা এমন হত না।
সরকারী নীতির ‘পশ্চাদপসরণ’: প্রাথমিকে ফের ইংরেজি
মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অংশের মানুষের মধ্যে থেকেই বামফ্রন্টের ভাষানীতির বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তিটা এসেছিল। এদেরই চাপে বামফ্রন্ট সরকার শেষ পর্যন্ত তার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালে ‘অশোক মিত্র কমিশন’ ক্লাস সিক্সের বদলে ক্লাস ফাইভ থেকে ইংরেজির পঠন-পাঠন চালুর সুপারিশ করে। ১৯৯৮ সালে ‘পবিত্র সরকার কমিটি’ ক্লাস থ্রি থেকে ইংরেজি শেখানোর কথা বলে। ২০০১ সালের পরে ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা চালু হয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরেনি, কেননা ইতিমধ্যে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের মনোভাব আরও পালটে গিয়েছিল। তাদের কাছে সরকারি পরিষেবার থেকে বেসরকারি পরিষেবার গুণগত মান উৎকৃষ্ট বলে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল; সেই সঙ্গে এ-ও মনে হচ্ছিল যে পরিবর্তিত দুনিয়ায় ইংরেজি-মাধ্যমে লেখাপড়া শেখাই চাকরির বাজারে সাফল্যের চাবিকাঠি। কেন ও কী-ভাবে মধ্যবিত্তের মনোভাব পালটালো, মানসিকতার এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের প্রাথমিক শ্রেণিতে ইংরেজি বর্জনের নীতির অভিঘাত কতটা – এই সব প্রশ্ন সামনে রেখে কিছুদিন আগে আমরা একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। আমাদের সেই সমীক্ষা ও পর্যালোচনার বিবরণ হরিনাভি স্কুল: ইতিহাসে ও স্মৃতিকথায় দেড়শো বছর (প্রকাশক অনুষ্টুপ ও হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুল) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই সমীক্ষার আলোকে এই প্রসঙ্গে আমার মূল্যায়ন উপস্থাপন করব।
মধ্যবিত্তের পরিবর্তিত আকাঙ্ক্ষা ও সরকারি বাঙলা-মাধ্যম স্কুলের ‘সংকট’
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের নতুন মনোভাবের প্রেক্ষাপটে কাজ করেছিল ছিল আট ও নয়ের দশকের কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং অবশ্যই নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়নের অভিঘাত (নয়ের দশকের পর থেকে)। এ ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারেরও একটা ভূমিকা ছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বামফ্রন্ট জমানায় সরকারি চাকুরে, শিক্ষক ও অধ্যাপক সমাজ যেমন আকারে-আকৃতিতে বেড়েছিল, তেমনই বেতন বৃদ্ধির সুবাদে (১৯৮১ ও ১৯৯০ সালে দুটি পে-কমিশন) মধ্যবিত্ত শ্রেণির লক্ষণীয় স্ফীতি ও আর্থিক সামর্থ্যের বিকাশ ঘটেছিল। বামফ্রন্টের আশীর্বাদ-ধন্য এই স্বচ্ছল শ্রেণিটিই বামফ্রন্টের ইংরেজি-নীতিকে সুনজরে দেখেনি। ইতিমধ্যে আরও একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। ভারতে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’-র গোড়াপত্তন ঘটে গেছে। এর সূত্র ধরে নয়ের দশকের গোড়া থেকে সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রে চাকরির বাজার সংকুচিত হতে শুরু করেছে, দেশের বাজার দখল করছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মাল্টি-ন্যাশনাল কর্পোরেট সংস্থা। কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও পরিষেবা-অর্থনীতির প্রসারের পরিণামে ইংরেজি ও হিন্দিতে বাকপটু সপ্রতিভ ছেলেমেয়েদের প্রয়োজন বেশি করে অনুভূত হতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির পুরোমাত্রায় সদ্ব্যবহার করে গজিয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে একের পর এক বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কু্ল, শিক্ষিত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানরাই তাদের ব্যবসা ও পরিষেবার মূল উপভোক্তা। পরিণামে সরকারি ও সরকার-পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিবিন্যাসে লক্ষণীয় রূপান্তর এসেছে। আর্থিকভাবে দুর্বল ও পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলির সন্তানেরাই সেই স্কুলগুলিতে মূলত ভিড় জমিয়েছে। হরিনাভি স্কুলের বইটি লেখার সময়ে আমরা রাজপুর-হরিনাভি অঞ্চলের অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দেখেছিলাম, বাবা-মায়েরা নিজেরা হরিনাভি স্কুলে পড়েছেন এবং এই রকম একটা ঐতিহ্যশালী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে (প্রতিষ্ঠা ১৮৬৬, প্রতিষ্ঠাতা সোমপ্রকাশ-খ্যাত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ) পড়াশোনার জন্যে গর্বও বোধ করেন, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের তাঁরা বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। প্রশ্ন করতে দুটি মনোভাব স্পষ্ট হয়েছিল –
এক – ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে সন্তানকে চলন-বলনে স্মার্ট ও ইংরেজিতে বাকপটু করে তোলা,
দুই – শ্রেণিগত উন্নাসিকতা।
আমরা এমন উত্তর পেয়েছিলাম, –
বাড়ির কাজের মাসির ছেলের সঙ্গে’ একই স্কুলে নিজের সন্তানকে তাঁরা কী-ভাবে পড়ান।
শিক্ষকের সংখ্যাবৃদ্ধি | |||
প্রাথমিক | মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক | মাদ্রাসা | |
১৯৭৭ | ১,২৬,০০০ | ৭৪, ৯৬৪ | ১,৭৮৫ |
২০০৬ | ১,৭৮,০০০ | ১, ৫১, ৮৫৬ | ৭, ৭৬৩ |
সূত্রঃ বামফ্রন্ট সরকার ৩০: আমরা চলি সমুখ পানে, পৃষ্ঠা ১২৫
সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এই রূপান্তরের একটা ব্যাখ্যা আছে। প্রধানত দুটি ঘটমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই রূপান্তরকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন।
একটি, – মধ্যবিত্তের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের বিবর্তনের অনুষঙ্গে।
অন্যটি, – শ্রেণিচেতনার আঙ্গিকে।
তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৬০ ও ‘৭০ দশক পর্যন্ত বাঙালি মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ১৯৮০-র দশক থেকে এটার রূপান্তর শুরু হয় এবং বর্তমানে কমতে কমতে তা প্রায় শূন্যের কাছে পৌঁছেছে — বাঙালি মধ্যবিত্ত শহর ও শহর-সংলগ্ন অঞ্চলে এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুসরণে আমরা ‘হরিনাভি স্কুল’ বইটিতে লিখেছিলাম,
আটের ও নয়ের দশক থেকেই স্বাস্থ্য ও স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি মধ্যবিত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিকল্পের অভাবে এখনও তা হয়ে উঠতে পারেনি, তবে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। লক্ষণীয়, কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে একের পর এক বেসরকারি হাসপাতালের উদ্ভব নয়ের দশক থেকেই। একই ঘটনা ঘটেছে ইংলিশ মিডিয়াম বেসরকারি স্কুলগুলির ক্ষেত্রেও (যদিও শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চল ও গ্রামবাঙলার ক্ষেত্রে এই প্রবণতার তারতম্য আছে) ।
প্রবণতাটির সঙ্গে শ্রেণিগত বিবেচনাটিও ভীষণ ভাবে যুক্ত। একটা সময় ছিল যখন ‘শিক্ষা’ মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ফলে তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জনই ছিল ‘সম্ভ্রান্ত’ ও মধ্যবিত্তের শ্রেণি-স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন, ‘ক্ষমতা’ ও মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে যখন সরকারি শিক্ষা প্রসারিত হতে হতে সমাজের নিচু তলার কাছে পৌঁছে গেল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মধ্যবিত্তের ও ‘সম্ভ্রান্ত ঘর’-এর একচেটিয়া অধিকার বজায় থাকল না, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক প্রমাদ গুণলেন। নতুন পরিস্থিতিতে নিছক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, ইংরেজি বাচন দক্ষতা ও এলিট লাইফ স্টাইল তার শ্রেণি-স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়-চিহ্ন রূপে আবির্ভূত হল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলি হল এই রকম ‘এলিট তৈরির কারখানা’। পার্থবাবুর ভাষায়,
যতই মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার হতে লাগল, ততই উচ্চবিত্ত উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মনে হল, আমাদের ছেলেমেয়েরা কি তাহলে আমজনতার গোয়ালে সকলের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ওদের মতো করে সাধারণ হয়ে যাবে? ওদের যা নেই, সেই বিশেষ গুণগুলি আমাদের ছেলেমেয়েরা পাবে কোথা থেকে? এই তাগিদ থেকেই মনে হয় ইংলিশ মিডিয়ামের ফ্যাশানটা শুরু।
বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মানেই কি উন্নততর শিক্ষা?
ক্রমোচ্চবিন্যস্ত সমাজে সামাজিক চলমানতার অন্যতম পন্থাই হল উচ্চতর স্তরের অনুসৃত জীবনচর্যাকে অনুসরণ ও অনুকরণ। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তকে অনুসরণ ক’রে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষও তাঁদের সন্তানকে তুলনামূলক ভাবে কম দামি সাধারণ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো শুরু করেছে এখন। এই প্রবণতার নেতিবাচক দিক উদ্ঘাটিত করে শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার মন্তব্য করেছেন,
বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বেসরকারি। সেখানে পোশাক-আসাক, জুতো-টাই-ব্যাগ ইত্যাদির কেতা আছে, ফলে অভিভাবকরা ভাবেন খুব ভালো পড়াশোনা হচ্ছে। সাহেবি আদব-কায়দা তো শিখছে, ‘জ্ঞান’ কতটা হচ্ছে তা গৌণ। অবশ্যই তার মধ্যে ভালো [ইংলিশ মিডিয়াম] স্কুলও আছে, যেখানে ভালো পড়াশোনা হয়। কিন্তু রাস্তাঘাটে গজিয়ে ওঠা ‘হেভেন্স-এঞ্জেল্স’ গোছের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলিতে শিক্ষা কী-রকম চলে সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন অনেকটা কাছাকাছি। তিনি জানিয়েছেন,
এটা ঠিকই যে, গড়পড়তা ফল বেসরকারি স্কুলে ভাল হয়। কিন্তু তা থেকে ধরে নেওয়া যায় না, সেখানে শিক্ষকরা আরও ভাল শেখাচ্ছেন। কারণ এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে বেসরকারি স্কুলে যাঁরা পাঠান সন্তানকে, সেই বাবা-মা তুলনায় বিত্তবান, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার প্রতি অধিক মনোযোগী। অনেক ক্ষেত্রে দুটোই সত্যি।
আমরাও হরিনাভি স্কুল নিয়ে আমাদের সমীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে এসেছিলাম,
নতুন ও পরিবর্তিত দুনিয়ায় সন্তানদের উজ্জ্বল কেরিয়ারের আশায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করাই সঙ্গত মনে করছে। তবে সন্তানদের কেরিয়ার-নির্মাণের জন্যে তারা শুধু স্কুল শিক্ষার উপরই নির্ভর করছে বললে ভুল হবে। সেখানেও প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টারের অব্যাহত দাপট। ছাত্রদের নিজস্ব মেধা, পারিবারিক ‘কেয়ার’, প্রাইভেট টিউশন, কোচিং সেন্টার, নাকি প্রাইভেট স্কুলগুলির অভ্যন্তরীণ শিক্ষাদান—সাফল্য ও ভবিষ্যৎ-কেরিয়ার নির্মাণের পথে কীসের নির্ণায়ক ভূমিকা, এ-বিষয়ে অভিভাবকদের নিজেদের ধারণাও খুব পরিষ্কার নয়।
শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ: প্রশ্রয় না প্রতিরোধ?
উপরিউক্ত মূল্যায়নের অর্থ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মানকে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়া নয়। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উৎকর্ষ প্রত্যাশানুরূপ বৃদ্ধি করতে পারলে এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ‘আস্থা’ অর্জনে (বাঙলা-মাধ্যম স্কুলে পড়েও ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া যায়) সফল হলে নিশ্চয়ই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটা সম্ভব। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ মুষ্টিমেয়-র স্বার্থই সিদ্ধি করতে পারে; বিপুল সংখ্যক সাধারণ ও দরিদ্র ঘরের মানুষের পক্ষে তা সমূহ সর্বনাশের কারণ। এই প্রক্রিয়া–শ্রেণি মেরুকরণ–সমাজের ভারসাম্যের পক্ষেও ক্ষতিকর, যার একটা উপযুক্ত একটা মীমাংসা হওয়া দরকার। তবে কাজটা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা এর সঙ্গে মধ্যবিত্তের সামাজিক ও জীবন-দৃষ্টিভঙ্গির বদলের প্রশ্নটিও যুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রতিষেধক হতে পারে সচেতন নাগরিক আন্দোলন।
শেষের কথা- অভিমত
বস্তুত, আমার মনে হয়, আমরা পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষানীতির ভুল জায়গায় সমালোচনা করি। প্রাথমিকে ইংরেজি-বর্জন সমালোচনার মূল অভিমুখ হতে পারে না। বরঞ্চ সমালোচনা হতে পারে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে গুণগত উৎকর্ষের যাথার্থ সামঞ্জস্য-বিধানে অসঙ্গতি এবং সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলির প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের আস্থা অর্জনে বামফ্রন্ট সরকারের ক্রমবর্ধমান অক্ষমতা। আমরা জানি, বাম মতাদর্শ শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণজ্যিকীকরণ সমর্থন করে না – এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ বামপন্থীদের কাছে কাঙ্ক্ষিত। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, রাজ্যে এত বছর ধরে (১৯৭৭-২০১১) বামফ্রন্ট সরকার থাকলেও এবং বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির জোরালো উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও মধ্যবিত্তের সরকারি স্কুল-বর্জনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার মোকাবিলা করতে কেন বামপন্থীরা সক্ষম হল না?
আমরা লক্ষ করেছি, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন-কর্মসূচির তালিকায় বিষয়টি কখনোই ছিল না, বরঞ্চ বামপন্থী দলগুলির মধ্যবিত্ত নেতা ও কর্মীদের একাংশ নিজেদের পরিবারের সন্তানদেরই সরকার-পোষিত বাঙলা মাধ্যম স্কুলগুলির থেকে সরিয়ে নিয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারিকরণের প্রবণতাকে পুষ্ট করেছিল পরোক্ষ ভাবে। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও, যার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।
সেই প্রবণতা বাড়তে বাড়তে এখন বিপদ্সীমায় পৌঁছে গেছে। বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার তাই আশু প্রয়োজন। বাঙলার মতো সমৃদ্ধিশালী একটি ভাষার পঠন ও লিখন দক্ষতা দুর্বল ক’রে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক বনিয়াদ পাকাপোক্ত থাকতে পারে না।
সহায়ক গ্রন্থ
বামফ্রন্ট সরকার ৩০: আমরা চলি সমুখ পানে, প্রকাশক সুখেন্দুকুমার দাস, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শিক্ষা’, রবীন্দ্র রচনাবলী (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) চতুর্দশ খন্ড, প্রবন্ধ, ১৯৯২
কান্তি বিশ্বাস, প্রসঙ্গ: শিক্ষা ব্যবস্থা, (পুনশ্চ: কলকাতা) ২০০৩
কমল কুমার চট্টোপাধ্যায় ও দীননাথ সেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষার রূপ রূপান্তর, (সংস্কৃতি সংসদ: কলকাতা) ১৯৯৯
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য, বিকল্প বিপ্লব যেভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব, (আনন্দ: কলকাতা) ২০১৭
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কথার কথা – তরুণ পাইনের সঙ্গে কথাবার্তা, (তালপাতা: কলকাতা) ২০১৬
মির্জা রফিউদ্দিন বেগ, রাজকুমার চক্রবর্তী, সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, হরিনাভি স্কুল ইতিহাসে ও স্মৃতিকথায় দেড়শো বছর, (হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুল ও অনুষ্টুপ), ২০১৮
এ ছাড়া প্রবন্ধটি লিখতে কিছু টেলিফোন-সাক্ষাৎকারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।