অনলাইন ‘অন’

অনলাইন ‘অন’

মুখবন্ধঃ

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। অতিমারীর পর দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় নয়, নয়টি মাস। চোখ আটকে গেল একটি খবরে –

বেঙ্গালুরু হাইকোর্ট কর্ণাটক সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে কর্পোরেট অর্থাৎ, নিগমবদ্ধ সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলিকে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার (Corporate Social Responsibility) তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধ্য করতে যাতে সেই তহবিলের টাকায় ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, অন্যান্য কমপিউটার ও যন্ত্রপাতি দরিদ্র পড়ুয়াদের মধ্যে বিলি করা যায়[i]

খবরটা পড়েই একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। অবশ্য বিগত বেশ কিছুদিন চিন্তাটা রয়েছে। এটা করতে আমাদের হাইকোর্ট লাগল! শিক্ষিত বিবেচনায় স্বাভাবিক দাবী উঠল না। কেন? অনলাইন শিক্ষা নিয়ে কেন এই সমস্যা? এত বিতর্ক?

অতিমারী, লকডাউন আর পড়াশোনা-

কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল। ভারতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করা হয়েছিল তার অন্তত দশ দিন আগেই। বিগত ২৫শে মার্চ, শেষপর্যন্ত, লকডাউন ঘোষিত হল। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি নির্দেশিকায় বলা হল ১০ই জুন অবধি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ, প্রায় তিন মাস। তারপরও কি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত পাঠাভ্যাস চালু হবে?

অনেকেই সন্দেহপ্রকাশ করলেন। কারণ, লকডাউন সত্ত্বেও দেশে তখন সংক্রমণের দৈনিক হার বেড়ে চলেছে। কোনও নিঃসংশয় প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। যদি আগামীতে আবিষ্কৃত হয়ও, ভারতের মতো জনবহুল অথচ অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সম্বলিত দেশে সবাইকে সেই প্রতিষেধকের আওতায় আনা এবং তজ্জনিত ব্যয়ের অর্থসংস্থান করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। মোটের উপর, লকডাউন উঠে গেলে সংক্রমণ ফিরে আসার সমূহ আশঙ্কা থাকে। সুতরাং, ১০ই জুনের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়মিত স্বাভাবিক পঠনপাঠন চালু হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সেক্ষেত্রে, যেটা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ভাবাল তা হল লকডাউন-কালে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বিষয়ে কর্তব্য কী? কারও কারও মনে হল, ‘হাতে রইল পেনসিল’ – একটাই উপায় থাকে – অনলাইন লেখাপড়া।

শুরু হয়ে গেল বিতর্ক। মুখ্যত দুটি মত।

  • হ্যাঁ। প্রতিষ্ঠানগুলির তরফে অনলাইন মাধ্যমে লেখাপড়া চালানো হোক;
  • না। অনলাইন লেখাপড়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করবে এবং তাই সেই উদ্যোগ বর্জনীয়।

“হ্যাঁ” বনাম “না”

না” – এই এক মহৎ উচ্চারণ, এক মহতী অভিব্যক্তি যা সর্বতো প্রণিধানযোগ্য।

সবেতেই “হ্যাঁ”- বলে কারা? ভেড়ার পালের মতো যাদের নিজস্ব চিন্তাধারা নেই, যারা স্রোতে গা ভাসাতে চায়, যারা কোনও কর্মসূচীর দায়দায়িত্ব নিতে রাজি নয়, যারা আম্মো আছি বলেই ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। ‘হ্যাঁ’-এর দলে ভিড়টাও তো বেশি, লুকোনোর কত সুবিধে।

উল্টোদিকে বুকের পাটা লাগে ‘না’ বলতে। “না” বললেই বোঝা যায় না-এর শক্তি। আলোচনা হবে, এজেন্ডা আগে থেকে ঠিক করা আছে। শুরুতেই একজন বললেন, “না।” এখন বাকিদের কাজ হবে ‘না’-বক্তাকে ‘হ্যাঁ’-এর দিকে নিয়ে যাওয়া। এই কাজে শক্তিক্ষয় হবে বিস্তর। হয়তো, একটি আলোচনাসভায় কুলোবে না। যদি তিনি শেষপর্যন্ত একসময় ‘হ্যাঁ’ বলেনও, ক্লান্ত আলোচকেরা সেদিন আর ‘হ্যাঁ’ কার্যকর করার পন্থানির্বাচনের উদ্যোগে আগ্রহী হবেন না। সভা আবারও মুলতবি হবে। আগামীতে বিষয়টি আবার দেখা যাবে। অসংখ্য বাস ও ট্রেন ইতিমধ্যে মিস হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে ভাবা যাবে, … “কিন্তু, কেন যাব?”

সারা ভারতবর্ষের কথা বলতে পারা মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে চিত্র পরিষ্কার। শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাই প্রোফাইল উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্রমবিন্যাসে বিভিন্ন ধাপে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকেই সোচ্চার ‘না’ বলেছেন। আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, এই রাজ্যে বুকের পাটাওয়ালা প্রতিবাদীরাই, বরাবরের মতোই, সংখ্যাগরিষ্ঠ। – অনলাইন লেখাপড়া? – ‘না!’

অনলাইন বনাম ক্লাসরুম – চারটি মূল কথা

এই দুটি মত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে রাখা ভাল –

  • অনলাইন লেখাপড়া বলতে শুধু লাইভ কনফারেন্সিং গোত্রের ক্লাসের মাধ্যমে পড়াশুনো বোঝায় না। অফলাইনে নির্মিত ভিডিয়ো আপলোড-ডাউনলোডের মাধ্যমে পড়াশুনো, নোট্‌স ও অন্যান্য স্টাডি মেটেরিয়ালের আদানপ্রদান, ছাত্রছাত্রীর লিখিত প্রশ্নের লিখিত জবাব, ইত্যাদি যাবতীয় বিদ্যাচর্চা বিষয়ক উদ্যোগ যা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রের পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতে ঘটে থাকে তা-ই অনলাইন লেখাপড়া;
  • অনলাইন লেখাপড়া শ্রেণিকক্ষে প্রত্যক্ষ পঠনপাঠনের বিকল্প বলে আজও প্রমাণিত নয়, তবে এই ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ পঠনপাঠনের পরিপূরক হতে পারে;
  • অনলাইন লেখাপড়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থা একধরণের সংস্কৃতিও বটে যা এদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠতে সময় লাগে। সুতরাং, তার ভিত্তি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে অবিলম্বে মনোযোগ দেওয়া দরকার;
  • অনস্বীকার্য যে, যেসব বিষয়গুলিতে শিক্ষার্জন গবেষণাগারভিত্তিক সেই সব বিষয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন লেখাপড়ার পরিধি সীমিত।

উপরে লিখিত সীমাবদ্ধতাগুলি মাথায় রেখে ফিরে আসা যাক অনলাইন পড়াশুনোর ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত দুটি মতের প্রসঙ্গে।

মূল বিতর্ক –

প্রথম মতের পক্ষে বলা যায়, অনলাইন লেখাপড়ার মাধ্যমে সীমিত হলেও, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাচর্চা স্রোতস্বিনী ও ধারাবাহিক থাকে। ভগ্নাংশের হারে হলেও, বিদ্যা অধীত এবং অর্জিত হয়। এটা কম কথা নয়। একেবারে নেই-রাজ্যের তুলনায় অনলাইন রাজ্য ভাল। এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৈনিক কর্মসূচী ও শিক্ষকশিক্ষিকাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছাত্রছাত্রীদের অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লকডাউন যত দীর্ঘ হবে এই সম্ভাবনাও ততই বাড়বে। করোনাজনিত লকডাউনের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘোর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি ছাত্রদল অনলাইন লেখাপড়ার মাধ্যমে দৈনিক পাঠাভ্যাসে নিযুক্ত থেকে এই অবসাদের আক্রমণ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারে। মোটের উপর, অনলাইন পড়াশুনো একধরণের পড়াশুনো। আপৎকালে ছাত্রছাত্রীদের এই পড়াশুনোর সুবিধে দেওয়া কর্তব্য। স্বাভাবিক বিবেচনায় এক্ষেত্রে আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না।

কিন্তু, না। থাকে। অনলাইন পঠনপাঠনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মতের মূল যুক্তি একটিই। এই পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। ডিজিটাল ডিভাইড। ভারতবর্ষে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষম নয়। তাদের হাতে কমপিউটার বা স্মার্টফোন নেই। থাকলেও, ডেটা কেনার সামর্থ্য নেই। সেই আর্থিক সংগতি নেই। অন্যদিকে, কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সেই সংগতি আছে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে মূলে যে বৈষম্য উঠে আসছে তা হল আর্থিক বৈষম্য।

বৈষম্য – আর্থিক ও ডিজিটাল

প্রথমত, আর্থিক বৈষম্য তো সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। অন্তত, ১৯৮০ থেকেই এই বৈষম্য বিপজ্জনক গতিতে বাড়ছে।[1] দ্বিতীয়ত, অনলাইন পঠনপাঠন বন্ধ রাখলে কি বৈষম্য রুখে দেওয়া যাবে? না কি, এর ফলে বৈষম্য আরও বাড়বে?

এই প্রশ্নগুলির প্রসঙ্গে পরে আবার ফিরে আসা যাবে। দ্বিমতের জায়গাই নেই যে, অনলাইন পড়াশুনোর সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। এটা প্রাইমারি। সেক্ষেত্রে, অনলাইন লেখাপড়ার ফলে বৈষম্য বাড়বে কি না, বাড়লে কত বাড়বে, সে-সব প্রশ্ন তুলনায় সেকেন্ডারি। সেই কারণেই বোধহয়, এ-বিষয়ে নিঃসংশয় গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ এখনও অমিল। প্রাইমারি বিষয়ে আগেই দেশের শিক্ষামহল জুড়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। হয়নি। সেই বিতর্কই সম্ভবত লকডাউনের পর শুরু হল। কিন্তু, শুরু হয়ে ফুরিয়েও গেল।

ডিজিটাল ডিভাইডের চিন্তায় আমরা তখন, এই ধরুন এপ্রিল-মে-জুন মাসে, ভয়ানক শঙ্কিত। অর্থাৎ, ধরে নিতে হয় এই ডিভাইড তখনও তেমন নেই, কিন্তু অনলাইন লেখাপড়ার চল হলে ভয়ানক বাড়বে। সকলেই সম্ভাব্য বৈষম্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গে তৎকালীন বৈষম্যেরই উল্লেখ করলেন অর্থাৎ, প্রাইমারি বৈষম্যই তুলে ধরলেন। বিতর্কগুলিতে ব্যবহৃত হল কিছু তথ্য যেমন,

  • ভারতে পড়ুয়াদের মাত্র ১৭.৭ শতাংশ পরিবারে কমপিউটার আছে, মাত্র ২৭ শতাংশ পরিবারে কিছু সদস্যের ইন্টারনেট সংযোগ আছে।
  • গ্রামীণ পরিবারগুলির ১৬ শতাংশ এবং শহুরে পরিবারগুলির ৪৯ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।[2]
  • যেসব পরিবারের ইন্টারনেট সংযোগ আছে তাদেরও মাত্র ৪৭ শতাংশের কাছে কমপিউটার বা স্মার্টফোন আছে।
  • ভারতের ছাত্রকুলের মাত্র ১২.৫ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। সেক্ষেত্রেও শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আছে। শহরে ছাত্রদের ২৭ শতাংশের বাড়িতে এবং গ্রামাঞ্চলে ছাত্রদের মাত্র ৫ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ আছে, ইত্যাদি।

 প্রসঙ্গত, এই তথ্যগুলির সূত্র ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে-এর ২০১৪ সালের ৭১তম সমীক্ষা।[3] আজ ২০২০। প্রযুক্তিগত বিস্তৃতির ক্ষেত্রে ছ’টা বছর দীর্ঘ সময়।

দেখা যেতে পারে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে-এর ২০১৭-১৮ সালের ৭৫তম সমীক্ষা কী বলছে। বলছে, ভারতে ১০.৭ শতাংশ পরিবারে কমপিউটার আছে। গ্রামীণ পরিবারের ৪.৪ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ২৩.৪ শতাংশ পরিবারে কমপিউটার আছে। সারা ভারতে ২৩.৮ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট সংযোগ আছে। এরমধ্যে গ্রামীণ পরিবারের ১৪.৯ শতাংশ এবং শহরে ৪২ শতাংশ পরিবারে ইন্টারনেট সংযোগ আছে।[4]

 

ভারতে কমপিউটার ও ইন্টারনেট-সংযুক্ত পরিবার (জনসংখ্যার শতাংশ)
সূচক শতাংশ
গ্রামীণ শহুরে গ্রামীণ+শহুরে
২০১৪ ২০১৭-১৮ ২০১৪ ২০১৭-১৮ ২০১৪ ২০১৭-১৮
কমপিউটারের মালিক পরিবার ৪.৪ ২৯ ২৩.৪ ১৭.৭ ১০.৭
ইন্টারনেট-সংযুক্ত পরিবার ১৬ ১৪.৯ ৪৯ ৪২ ২৭ ২৩.৮
  • স্মার্টফোন কমপিউটার হিসাবে গ্রাহ্য নয়
  • ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে স্মার্টফোন গ্রাহ্য

অদ্ভুত ব্যাপার না! এটা প্রত্যাশিত যে, সময়ের সঙ্গে কমপিউটার এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়বে। অথচ, দেখা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০১৭-১৮, এই তিন-চার বছরে ঠিক উলটোটাই ঘটেছে! এর ব্যাখ্যা?

আছে, ব্যাখ্যা আছে। NSSO-এর তথ্য সংগ্রহ এবং উপস্থাপনের পদ্ধতি ২০১৪ সালে যা ছিল তার তুলনায় ২০১৭-১৮’তে বদলে গেছে। ২০১৪ সালে পড়ুয়াদের জনসংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়ঃসীমা ছিল ১৪ বছর, কোনও ঊর্ধ্বসীমা ছিল না। কিন্তু, ২০১৭-১৮’তে প্রাসঙ্গিক জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়ঃসীমা ছিল ৫ বছর, ঊর্ধ্বসীমা এক্ষেত্রেও ছিল না।

সুতরাং ৫ থেকে অনূর্ধ্ব ১৩ বয়সীরা ২০১৪-এর প্রতিবেদনে ছিল না। ২০১৭-১৮’তে তারা অন্তর্ভুক্ত। এরা প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির স্কুলপড়ুয়া। সরকারিভাবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি অবধি প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়াদের বয়ঃসীমা ৬ থেকে ১০+ বছর।[5] সুতরাং, ২০১৭-১৮’তে শতাংশের প্রাসঙ্গিক অনুপাতগুলি কমে গেল। নিউ নর্মালের আগে ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সীরা কমপিউটার, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি কমই ব্যবহার করত, অভিভাবকেরাও সেটাই অভিপ্রেত জ্ঞান করতেন। ২০১৭-১৮ সালের হিসাবে এদের অন্তর্ভুক্তি গড় হিসাবকে নামিয়ে দিল।

মোট জনসংখ্যা (হর–denominator) বাড়ল, কিন্তু কমপিউটার, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদির ব্যবহারকারী (লব – numerator) কম। ফলে লব/হর অনুপাত তো কমবেই। তাহলে, বোঝাই যাচ্ছে, –

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শেষকথা বলা যায় না। কারণ প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে নাও পারে।

দুটি হিসাবেই বয়সের ঊর্ধ্বসীমা রাখা হয়নি। বয়স্করাও স্মার্টফোন, কমপিউটার ইত্যাদি কমবয়সিদের তুলনায় কমই ব্যবহার করেন। কাণ্ডজ্ঞান বলে, যদি শুধুমাত্র ৬-২৩ বছর বয়সীদের (স্কুলশিক্ষায় ৬-১৮, উচ্চতরশিক্ষায় ১৮-২৩) ধরা হত, কমপিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অনুপাত সম্ভবত বেশিই দেখাত।

এবার কিছু বেসরকারি প্রতিবেদন ও সমীক্ষায় চোখ রাখা যেতে পারে। গত ছ’বছরে বহু সমীক্ষা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জানা যাচ্ছে,

  • ২০১৩ সালে ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪ কোটি।[6]
  • ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা তিনগুণ, ১২ কোটি ৩৩ লক্ষ।[7]
  • ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই সংখ্যা দাঁড়ায়, বারোগুণ, ৫০ কোটি ২২ লক্ষে।[8]
  • এই তথ্যগুলি সরকারি সূত্রেও মোটের উপর সমর্থিত।[9]

 ইতিমধ্যেই উল্লিখিত Nielsen প্রতিবেদন বলছে,

২০১৩ সালের চার কোটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৪৮ শতাংশ (১ কোটি ৯২ লক্ষ) ১৮-২৪ বয়ঃশ্রেণির অর্থাৎ, যে বয়সে মানুষ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

Talkwalker প্রতিবেদন অনুযায়ী[10],

  • ২০১৮ সালের শেষদিকে ভারতে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩২ কোটি ৬১ লাখ।
  • এর মধ্যে ২৪ কোটি ১০ লাখ ছিল সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী।
  • এই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে আবার ৯ কোটি ৭২ লক্ষ ছিল ১৮-২৪ বয়ঃসীমার মধ্যে।
  • সমস্ত সোস্যাল মিডিয়া ধরলে এই বয়ঃসীমায় সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ কোটি। ১৮-২৪ হল সেই বয়ঃসীমা যেখান থেকে আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পাই।

২০১৩ সালে দেশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ৫০ শতাংশের বয়স ছিল ২৫ বছরের কম। বর্তমানে এই অনুপাত ৮০ শতাংশের কাছাকাছি হতে পারে।[11]

২০১৪ সালে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি ৩১ লক্ষ।[12]

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ কোটি ৬০ লক্ষ।[13]

অর্থাৎ চার বছরে সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশী। আরো বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় এই সর্বাত্মক বৃদ্ধির খবর। তা ঘটেছে ভারতের শহরে এবং গ্রামেও। এসব বিষয়ে আরও তথ্য ‘Mobile Marketing Handbook 2019’-এ পাওয়া যাবে।[14]

এইসবের কারণ?

  • স্মার্টফোনের দামে গুরুতর পতন। গত দশ বছরে স্মার্টফোনের দাম গড়ে অন্তত ১৬ শতাংশ কমেছে।[15] ২০০৯-১০ সালে ভারতে স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছিল ২০ লক্ষ। ২০১৭-১৮ সালে বিক্রি হয় ১১ কোটি ৭০ লক্ষ স্মার্টফোন।

 ডেটা প্যাকের দামে পতন। ২০১৪ সালে ডেটার দাম ছিল গড়ে ২৬৯ টাকা প্রতি জিবি। ২০১৮ সালে এই দাম দাঁড়ায় গড়ে প্রায় ১২ টাকা প্রতি জিবি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনকি, এক টাকা পঁচাত্তর পয়সা প্রতি জিবি।[16]

সুতরাং, ২০১৪ সালের NSSO-এর একটা ‘প্রাচীন’ সমীক্ষা, যার তথ্যভিত্তি ২০১৭-১৮-এর NSSO-এরই সঙ্গে তুলনীয় নয়, তার ভিত্তিতে অনলাইন পড়াশুনোর বিষয়ে মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও জোর করে এর ভিত্তিতে অনলাইন লেখাপড়ায় ‘না’ বললে সেটা ন্যায্য হবে না।

আমরা অন্য একটা কৌতূহলোদ্দীপক ক্ষেত্রে তাকাতে পারি। ২০১৮ সালের একটি চর্চা বলছে যে, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং সাক্ষরতার হারের মধ্যে ধনাত্মক পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতে পারে।[17]

২০১৮ সালে স্মার্টফোনের ব্যবহার সর্বাধিক ছিল কেরালায়, আবার সাক্ষরতার হারেও কেরালা সর্বাগ্রে। অন্যদিকে, ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষরতার হারে ১৯তম, স্মার্টফোনের ব্যবহারে ২০তম।

সাক্ষরতার হার যদি স্মার্টফোনের ব্যবহার প্রভাবিত করতে পারে, হয়তো স্মার্টফোনও শিক্ষা বিশেষত, অনলাইন শিক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, ভারতে স্মার্টফোনের ব্যবহার মোটের উপর বেড়েছে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯৭ শতাংশই সেটা করেন স্মার্টফোনের মাধ্যমে। প্রসঙ্গক্রমে, এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে। শিক্ষাগত প্রগতি কি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর উপরেই নির্ভর করে?

শিক্ষাখাতে পারিবারিক খরচ – সামর্থ্যর বৈষম্য

চলুন, আর একটু হাঁটি। একই সূত্র অনুসারে অর্থাৎ, NSSO ২০১৪, শিক্ষাখাতে প্রতি পড়ুয়ার মোট খরচের ১২ শতাংশ যায় প্রাইভেট টিউশনে। এ-ব্যাপারে গ্রাম ও শহরে বিশেষ প্রভেদ নেই। প্রাইভেট টিউশনে ত্রিপুরা সবার আগে, পড়ুয়াদের ৮১ শতাংশ প্রাইভেট টিউশন নেয়। পশ্চিমবঙ্গ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাসফেলা দ্বিতীয়, ৭৮ শতাংশ। নিরক্ষরশূন্য প্রবল শিক্ষিত কেরালার ৫৫ শতাংশ প্রাইভেট টিউশন-নির্ভর!

NSSO ২০১৪ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে,

“Uniformly, it was seen that students attending government institutions were spending proportionately more on private coaching than students attending private institutions.”

প্রশ্ন, প্রাইভেট টিউশনে এত খরচা কেন? সেখানে কি বৈষম্য নেই? প্রশ্ন আরও, যদি প্রাইভেট টিউশনে এত পয়সা খরচ করা যায়, অনলাইন লেখাপড়া কীসে আটকায়?

  • পড়ুয়াদের মাত্র ২৬ শতাংশ প্রাইভেট টিউশন নিতে পারে, বাকি ৭৪ শতাংশ পারে না।

অনলাইন-পূর্ববর্তী বৈষম্য খুব কম দেখাচ্ছে? বৈষম্য ‘কম পড়িয়াছিল’? কারা যেন বলে, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ! স্বর্ণালী স্তব্ধতা এবং নির্বাচিত বাগ্মিতা!

সত্যিই কি আমরা বুঝতে পারিনি করোনার তাণ্ডব সময়ের পথে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে কত বিস্তৃত হতে পারে! মার্চে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ভাবা গিয়েছিল জুন মাসে স্কুল-কলেজ খুলবে। খুলল না। জুলাই গেল, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর … ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন হাজির। রাজ্যেও ভোটের ঢাক বেজে গেছে। আপাতত নতুন কোনও ভাবনার প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল শিক্ষাক্ষেত্র। করোনা এইটুকু অন্তত বুঝিয়েছে যে, এমন ভাইরাসের আক্রমণ ভবিষ্যতে আবারও ঘটবে। আবারও লকডাউন হবে। শিক্ষা থেমে থাকবে?

অনলাইন শিক্ষার অপরিহার্যতা

অনলাইন শিক্ষা ছাড়া উপায় নেই। আপৎকালে তো বটেই, করোনাপূর্ব পরিস্থিতির মতো ‘স্বাভাবিক’ দুনিয়ায় যখন ফিরে যাওয়া হবে, যদি হয়, অনলাইন শিক্ষা কিন্তু এসে গেছে থাকার জন্য, সে তখনও থাকবে। এতে লাভ ছাড়া লোকসান হবে না। প্রত্যক্ষ ক্লাসরুম পঠনপাঠনের পরিপূরক হিসাবে অনলাইন পঠনপাঠন শিক্ষাজগতের উপকারই করবে। পরিবর্তন মানতে হবে।

উপরোল্লিখিত সমস্ত তথ্য উপস্থাপন এবং যুক্তি বিস্তারের উদ্দেশ্য এমন কিছু সাব্যস্ত করা নয় যে, দেশে ডিজিটাল বৈষম্য নেই। বরং, প্রবল আছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য যেহেতু আছে, ডিজিটাল বৈষম্যও আছে। সুতরাং, অনলাইন পড়াশুনোর পথে সমস্যা আছে বিস্তর। কিন্তু, নোবেলজয়ী অর্থবিজ্ঞানী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা ধার করে বলা যায় সেই সমস্যা “scalable” ।[18]

আমাদের উচিত ছিল শুরুতেই ‘না’ না বলে, বরং এই স্কেলেবিলিটি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা। বহু হাই প্রোফাইল শিক্ষাবিদ তো বটেই, তাবৎ শিক্ষকসমিতি ও সংগঠনও সব শিয়ালের এক রা দিলেন, “না”, অনলাইন পড়াশুনো ডিজিটাল ডিভাইড ঘটাবে। এই নেতিবাচক অবস্থান গত প্রায় বছর খানেকে শিক্ষাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে তার পরিমাপ একদিন কোনও-না-কোনও ভাবে হবে। সোচ্চার, নিরুচ্চার, অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে সেদিন। শিক্ষার স্বার্থে অনলাইন পরিকাঠামো নির্মাণ সরকারের দায়িত্ব। আমাদের “না” অবস্থানের ফলে সরকার নিশ্চেষ্ট থাকার সুযোগ পেয়ে গেল। “হ্যাঁ” অবস্থান নিয়ে, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষক সংগঠনগুলি একযোগে আন্দোলন করে সরকারকে চাপ দিলে কিছু কাজ হতে পারত।

অনলাইন শিক্ষার পরিকাঠামো গঠন

দুস্থ ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রবৃত্তির অঙ্গ হিসাবেই স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কমপিউটার, ডেটা প্যাক ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারত। সরকার বিভিন্ন মোবাইল ফোন, কমপিউটার ইত্যাদির নির্মাতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তি করে এই কাজটা সহজ করতে পারত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই আমরা জানি, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতেই কয়েক বছরের ব্যবধানে পুরনো মোবাইল ফোন, পুরনো কমপিউটার এসব বদলে নতুন যন্ত্র নেওয়া হয়। এমনকি, রদ্দিওয়ালার কাছেই বেচে দেওয়া হয় পুরনোগুলি। সরকারি অফিস এবং কারখানাতে তো বটেই, বেসরকারি সংস্থাগুলিও এই জাতের পুরনো যন্ত্রপাতি নিয়মিত বদলায়। কমপিউটার-নির্ভর কারবার বিশেষত সফ্‌টওয়্যার কোম্পানিগুলিও তাই করে। সদুদ্দেশ্যে সাংগঠনিক উদ্যোগে পুরনো যন্ত্রগুলিকে ব্যবহারযোগ্য করে পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।

আরো একটা খুব দরকারি কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। সেটা হল Infrastructure (Power and Bandwidth)-এর সমস্যা। বড় বড় দুয়েকটা শহর বাদ দিলে  পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাতেই এই সমস্যা আছে। শুধু কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন থাকলেই হবে না,  নির্ভরযোগ্য  ব্রডব্যান্ড নেট-কানেক্টিভিটি  অনলাইন শিক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।

ফিরে যাচ্ছি, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই কর্ণাটকে হাইকোর্টের উপদেশ প্রসঙ্গে। অনলাইন শিক্ষার কাঠামো গড়া এমন কিছু অসম্ভব নয়, বৈষম্য একেবারে না ঘোচালেও কমানো খুবই সম্ভব। আর অন্য যে কোন পরিকাঠামো গড়ার মতই এখানে চাই, সরকারী ও বেসরকারি মিলিত উদ্যোগ।

দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অনলাইন লেখাপড়ার বর্তমান পরিস্থিতি –

ঘটনা এমন আদপেই নয় যে, অনলাইন লেখাপড়া ব্যাপারটা একেবারে নতুন কিছু। একেবারেই নয়, এমনকি ভারতেও নয়। অনলাইন কোচিংয়ের অজস্র পোর্টাল আছে, বিনামূল্যে ইউটিউব চ্যানেলে অনেক স্টাডি মেটিরিয়াল পাওয়া যায়। বিদেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওয়েবসাইটে গিয়ে বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনে নেওয়া যায়। এতে তো উপকারই হয়। ভারতেও তো বহুদিন ধরেই স্বয়ম, ই-পাঠশালা এবং NPTEL-এর মতো সরকারি মঞ্চও আছে অনলাইন লেখাপড়ার। এগুলির সূত্র ধরে অনলাইন শিক্ষাকাঠামোকে প্রয়োজনানুগ করে তোলা অসম্ভব কিছু নয়। বস্তুত, এই মঞ্চগুলি ব্যবহার করে গবেষণাগার-ভিত্তিক পাঠ্যক্রমও অনেকাংশে চালু রাখা যায়। তা করাও হচ্ছে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আসলে, চাই সদুদ্দেশ্য এবং সৎ উদ্যোগ। ‘না’ কোনও সমাধান নয়। ‘না’ কোনও বিকল্প দেয় না। সবটা পাওয়া যাবে না বলে কিছুই নেব না বললে, রাস্তা কানাগলিতে পৌঁছায়।

এবার আসা যাক সেই প্রশ্নে যার উল্লেখ আলোচনার শুরুতে করা হয়েছিল। চলতি অর্থনৈতিক বৈষম্যে E-পঠনপাঠন কী প্রভাব ফেলবে? কেমন ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি হবে? অনলাইন লেখাপড়া চালালে কি এটা বাড়বে? ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলে, অনলাইন লেখাপড়া যদি বন্ধ থাকে, এই বৈষম্য কিংবা ডিভাইড কমবে, অপরিবর্তিত থাকবে, বাড়বে?

বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী[19], ভারতে মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ ধনীতম ১০ শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত, ৫৩ শতাংশ ধনীতম এক শতাংশের। অন্যদিকে, দরিদ্রতম ৬০ শতাংশের হাতে দেশের ৫ শতাংশ সম্পদ। একেবারে হতদরিদ্র ১০ শতাংশের হাতে দেশের ০.২ শতাংশ সম্পদ। এই পরিস্থিতিতে দেশ একদিনে পৌঁছায়নি। ভারতে সম্পদ এবং আয়ের বৈষম্য বিপজ্জনক গতিতে বাড়ছে অন্তত গত শতকের আশির দশক থেকে।

দেশে আয় ও সম্পদের বৈষম্যের যে চেহারা কিছুটা দেখলাম তাতে একটা সাধারণ স্মার্টফোনের মালিকানা থাকলেই এবং একটা ডেটা প্যাক কেনার সংগতি থাকলেই সেই পড়ুয়াকে প্রিভিলেজ্‌ড বা সুবিধাপ্রাপ্ত বলা চলে না। অনলাইন ক্লাস চললে সে যতটুকু শিখতে পারত, অনলাইন ক্লাস বন্ধ থাকার ফলে তাও পারবে না।

অন্যদিকে, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জোর কদমে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, অনলাইন কোচিংয়ের পোর্টালও কম নেই। বস্তুত, তেমন অনেকগুলিই আছে করোনার আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই। এরমধ্যে আবার বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলি, অনেক ক’টিই বেশ নামী, ভারতের পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাসে ভর্তি করতে শুরু করেছে। উপরিল্লিখিত ধনীতম ১০ শতাংশের সন্তানরা চুপ করে বসে থাকবে না। তারা এদেশে, বিদেশে ই-পঠনপাঠনের সুযোগ নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে। তাদের শিক্ষা এগিয়ে যাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনলাইন লেখাপড়া বন্ধ থাকলে, বাকিরা বেশিরভাগই পিছিয়ে থাকবে, থমকে থাকবে ‘স্ট্যাটাস কুয়ো’র কুয়োয়। এর ফলে ডিজিটাল ডিভাইড বরং বাড়বে। কারণ, ডিজিটাল বৈষম্যের মূলে আছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। অথচ, সরকারি ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অনলাইন লেখাপড়া চালু থাকলে ধনীতম ১০ শতাংশের অনেক নীচের দিকের পরিবারের পড়ুয়ারা শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগোতে পারত, ফলত অর্থনৈতিক নিরিখেও। সেক্ষেত্রে বৈষম্য বরং কমতেও পারত, অন্তত বাড়ত কম।

অভিমত

বোঝা খুব শক্ত যে, অনলাইন শিক্ষা, ই-পঠনপাঠনের বিরোধিতায় কার লাভ! এটা যদি যুদ্ধ হয়, সে যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে! এই যুদ্ধের যুক্তি কী! আত্মসম্ভ্রম রক্ষার্থেই এই প্রশ্ন তোলা অনুচিত যে, প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কর্ণধার এবং হাই প্রোফাইল শিক্ষাবিদদের সন্তানরা গত কয়েক মাসে শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে কোন পথে কীভাবে হেঁটেছে।

সর্বোপরি, অনলাইন শিক্ষার অডিয়ো, ভিডিয়ো এবং অন্যান্য নথি থাকে। মেজাজে ভুল পড়িয়ে বা যেমন তেমন পড়িয়ে পার পাওয়া মুশকিল। এবং, আচরণের নথি থাকে বলেই ক্লাসে অযথা বকাঝকা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যাকে বলে ডার্ক সারকাজম, এগুলি থেকে ছাত্রছাত্রীরা রেহাই পেতে পারে।

মোটের উপর, অনলাইন পড়াশুনো থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পাওয়ার আর উপায় নেই। এটা এসেছে এবং থাকতেই এসেছে। ফল ভালই হবে। সুখের কথা এটাই যে, মাস কয়েক আগের প্রতিবাদীরাও সে-কথা বুঝেছেন, তাঁরা পথে আসছেন। মানে, বিদ্যাচর্চায় অনলাইন হচ্ছেন। হাল না ছাড়াই ভাল।

পরিশেষে আর একটা কথা। অনলাইন শিক্ষায় এমন কিছু সম্ভব যা অন্যভাবে আদৌ সম্ভব নয়। সুদূর গ্রামের কোন ছাত্র অনলাইনে ভারতবর্ষের, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনামূল্যে বিতরিত কোর্সের পাঠগ্রহণ করতে পারে। ইউটিউবে (youtube) এমন বহু পাঠ উপলভ্য। এটির ক্ষেত্রে কিন্তু কোন বৈষম্য নেই। শহর, গ্রাম, মফস্বল, প্রত্যন্ত গ্রাম – বৈষম্যহীন ভাবে যে কোন ছাত্র ছাত্রী এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে।

দরকার উপযুক্ত পরিকাঠামোর। প্রযুক্তির কল্যানে সুলভে এই পরিকাঠামো সম্ভব। ঠিক সেইখানেই প্রয়োজন সরকারী বেসরকারি সচেতনতার আর উদ্যোগের।

[1] https://www.wider.unu.edu/sites/default/files/Events/PDF/Slides/Himanshu-Murgai-Inequality-in-India.pdf

[2] https://www.ideasforindia.in/topics/macroeconomics/covid-19-online-classes-and-the-digital-divide-during-the-times-of-corona1.html; https://analyticsindiamag.com/why-online-education-may-not-be-a-sustainable-solution-in-india-despite-free-courses/; https://thewire.in/education/online-education-students; https://www.livemint.com/news/india/will-online-education-work-in-india-11587571461484.html; https://scroll.in/article/960939/indian-education-cant-go-online-only-8-of-homes-with-school-children-have-computer-with-net-link

[3] http://mospi.nic.in/sites/default/files/publication_reports/nss_rep_575.pdf

[4] http://www.mospi.gov.in/sites/default/files/NSS75252E/KI_Education_75th_Final.pdf

[5] http://udise.in/Downloads/Publications/Documents/U-DISE-SchoolEducationInIndia-2015-16.pdf

[6] https://www.nielsen.com/wp-content/uploads/sites/3/2019/04/Featured20Insight_20Indian20Smartphone20User.pdf

[7] https://www.emarketer.com/chart/174974/mobile-phone-smartphone-users-india-2014-2019

[8] https://techarc.net/techinsight-at-502-2-million-smartphone-users-its-time-for-smartphone-brands-to-turn-towards-services-in-2020/

[9] https://trai.gov.in/sites/default/files/presentations_&_cv/Day-2_24Aug2017/Session2_Nnal%20Bband%20Plan/Digital_India_Premjit_Lal.pdf

[10] https://www.talkwalker.com/blog/social-media-statistics-in-india

[11] https://www.vserv.com/smartphone-adoption-india-going-beyond-age-income-barriers/ ; https://www.ericsson.com/assets/local/news/2015/4/ericsson-consumerlab-the-changing-mobile-broadband-landscape-india.pdf

[12] https://www.internetlivestats.com/internet-users/india/

[13] https://imrbint.com/images/common/ICUBE%E2%84%A2_2019_Highlights.pdf

[14] https://www.thedmti.com/wp-content/uploads/2019/03/India_Mobile_Marketing_Handbook_2019.pdf

[15] https://www.outlookindia.com/newsscroll/smartphone-prices-down-16-in-10-years-report/1503740

[16] https://www.business-standard.com/article/pti-stories/mobile-data-price-down-by-95-but-revenue-up-2-5-times-in-5-yrs-trai-119082101291_1.html ; https://www.indiatoday.in/business/story/mobile-call-internet-to-become-costlier-by-up-to-50-from-december-3-1624261-2019-12-02

[17] https://www.business-standard.com/article/pti-stories/mobile-data-price-down-by-95-but-revenue-up-2-5-times-in-5-yrs-trai-119082101291_1.html ; https://www.indiatoday.in/business/story/mobile-call-internet-to-become-costlier-by-up-to-50-from-december-3-1624261-2019-12-02

[18] https://www.financialexpress.com/economy/abhijit-banerjee-online-education-j-pal-digital-learning-coronavirus-lockdown-digital-india-online-education/1949631/

[19] https://www.oxfam.org/en/india-extreme-inequality-numbers; https://www.huffingtonpost.in/2017/04/27/1-of-indians-own-53-of-countrys-wealth-un-report_a_22059240/

 [i] https://timesofindia.indiatimes.com/city/bengaluru/hc-to-state-tap-csr-funds-to-provide-laptops-to-govt-students/articleshow/79616319.cms

 

লব্ধ প্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক। ওঁর গোয়েন্দা কাহিনী "গজপতি নিবাস রহস্য ধারাবাহিক ভাবে "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । "অন্য কোনোখানে" দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর আরেকটি ধারাবাহিক কাহিনী। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বৈবস্বত, জিয়ন নদী, অনিকেত, জন হাওয়ার্ড পেনের ডায়রি ইত্যাদি। প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থ - On the Trail of a Woman

Related Articles

13 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *