পুরুলিয়ায় মাইকেল

পুরুলিয়ায় মাইকেল

মাইকেল মধুসূদন

মহাগ্রন্থ রামায়ণ আর মহাভারত ভারতের আত্মার কাহিনী, যা আপামর ভারতবাসী শুনে আসছে যুগ যুগ ধরে। মহাকাব্য রামায়ণের নায়ক অযোধ্যা রাজপুত্র দাশরথি রাম নররূপে নারায়ণ, বিষ্ণুর অবতার, সর্বজনমান্য পুরুষশ্রেষ্ঠ। কোনও সনাতন ধর্মবিশ্বাসী ভারতবাসী এহেন রামচন্দ্রের চরিত্রে একফোঁটা কালিমা লেপনের দুঃসাহস দেখাতে পারেন না, সর্বগুণান্বিতরূপে তাঁর পূজা করা হয়। কিন্তু এমনই এক সময় এদেশেরই এক কবি লিখলেন একটি কাব্য, তার নায়ক……না, রাম নন, মেঘনাদ- পিতৃব্য বিভীষণকে বলছেন-

“কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস, পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে হে বীরকেশরি সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে?” (ষষ্ঠ সর্গ)

কবির নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের একান্ত ব্যতিক্রমী সত্ত্বার পরিচয় দিয়ে রাবণ-পুত্র ইন্দ্রজিৎকে নায়ক বানিয়ে তিনি রচনা করলেন বিশ্বের শেষ মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই কবির (২৫শে জানুয়ারি,১৮২৪ – ২৯শে জুন,১৮৭৩) সমস্ত জীবন ব্যতিক্রম আর বৈপরীত্যে ভরা, যশ পেয়েছেন, বিভব পাননি। ভালবাসা পেয়েছেন, কুখ্যাতি তারও বেশি; অপরিমিত অর্থ উপার্জন করেও বেহিসেবী আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে সঞ্চয় তো দূরের কথা, চরম অর্থকষ্ট আর অস্বাচ্ছল্যের মধ্যে অসময়ে শেষ হয়েছে তাঁর হ্রস্ব জীবনকাল।

লক্ষ্মীদেবী করুণা না করলেও বাণীদেবীর কৃপাবৈভব তিনি লাভ করেছেন। তাঁর প্রতিটি রচনা কালোত্তীর্ণ হয়ে স্থান নিয়েছে বাংলার মানুষের হৃদয়ে, কবির প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি বসিয়েছে তাঁকে মহাকবির আসনে, বহু জীবনীকার তাঁর জীবনের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন সযত্নে। তবু বলব, মধু-কবির স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়ি, কলকাতা, মাদ্রাজ, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ডের খবর অনেকে রাখলেও, তাঁর হ্রস্ব জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যে বাংলার স্বল্পখ্যাত, প্রায় ব্রাত্য পুরুলিয়ায় কেটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রায় কোন জীবনীকারই সুসংহতভাবে লিপিবদ্ধ করেননি। মধু-কবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু (১৯০৫) , পরের দিকে গোলাম মুরশিদ (আশার ছলনে ভুলি- ১৯৯৪) ও মানভূম-বিশেষজ্ঞ গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামী (২০১৩) এই নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য উপস্থিত করেছেন। দিলীপবাবুর সাহায্য নিয়ে এখানে কিছু আলোচনা উপস্থিত করছি।

পুরুলিয়া ও পঞ্চকোট রাজ্য

১৮৩৩ সালে পুরুলিয়া ও ধানবাদ-সহ আরো পাঁচটি মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছিল আধুনিককালের মানভূম জেলা, তবে তার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বাঙালি আত্মবিস্মৃত ইতিহাসবিমুখ জাতি, রাখালদাস ও স্যার যদুনাথের পর আধুনিককালের বাঙালি ইতিহাসবিদরা সাহস করে কলকাতার দূরবর্তী দুর্গম অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করে তেমন কাজ করে দেখাননি। ইংরেজ প্রত্নতত্ববিদ J.D. Beglar ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে পূর্বভারতের মন্দির ও পুরনো দিনের নিদর্শনগুলি নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল, পুরুলিয়ার পাঞ্চেত, তেলকুপি গ্রাম, বরাকর এসব ঘুরে প্রায় দু’হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন এক সভ্যতার উল্লেখ করে ‘A Tour Through Bengal Provinces’ নামে একটি বই লেখেন আর শাসকদলের প্রতিনিধি Herbert Coupland ১৯১১তে ‘Manbhum- Bengal District Gazetteer’ বইয়ের দ্বারা এই অঞ্চলের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার মূল উপাদানগুলি সংগ্রহ করেন। তারপর অবশ্য ডাঃ সুকুমার সেন, দেবলা মিত্র, তরুণদেব ভট্টাচার্যের মত খ্যাতিমানরা এগিয়ে আসেন। পঞ্চকোট রাজবংশের রাজপুরোহিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী ১৯৩৩এ লেখেন মানভূম-পুরুলিয়ার ইতিহাস-চর্চার দিগন্ত উন্মোচনকারী গ্রন্থ ‘পঞ্চকোট ইতিহাস’।

সাঁওতাল-মুণ্ডা-আদিবাসী অধ্যুষিত এক বিস্তীর্ণ রাজ্য বা সুবা(Division) যাকে ‘জঙ্গল-মহাল’ (বা মহল) বলা হত, আজ তারই এক অংশ পুরুলিয়া জেলা। একসময় সম্রাট আকবর সেনাপতি বীর মানসিংহকে খুশি হয়ে এই সুবা দান করেন। শাসনের সুবিধার জন্যে সমগ্র রাজ্যটিকে তিনটি পরগনায় বিভক্ত করা হয় বীর মানসিংহ কথাটি ভেঙ্গে- বীরভূম, মানভূম ও সিংহভুম। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে মোগল-সম্রাট শাহ আলম এই সুবাটি ‘দেওয়ানি’ হিসেবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে দান করেন। এই বিশাল সুবাটিকে বনাঞ্চলে শাসনের সুবিধার জন্যে ব্রিটিশরা অনেক ভাঙ্গাগড়া করে। ১৭৭৩ সালে গঠিত হয় পঞ্চকোট (Pachet) জেলা ও ১৮০৫ সালে মানভূম ও সিংভুমের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে জঙ্গল-মহল জেলা, সদর হয় বাঁকুড়া, তখন তা ছিল বাঁকুড়া-বর্ধমান-ধানবাদ-ধলভূম-খারসোয়ান-সরাইকেলা মিলিয়ে এক বিশাল জেলা। ১৮৩৩এর ১৩ই নভেম্বর তৈরি হল মানভূম জেলা, সদর প্রথমে হয় মানবাজার, পরে স্থানান্তরিত হয় পুরুলিয়ায়। তারপর আরো অনেক ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে ১৯১২তে মানভূম জেলা বাংলা থেকে নবনির্মিত বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশে মেলানো হয়। ১৯৩৬এ উড়িষ্যা আলাদা রাজ্যের মর্যাদা পায়, কিন্তু স্বাধীনতার পরও বাঙালিপ্রধান এই জেলা রয়ে যায় বিহারে। তারপর মানভূমে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ৪৪ বর্ষব্যাপী রক্তক্ষয়ী ভাষা-আন্দোলনের ফলে ১৯৫৬তে খণ্ডিত মানভূমের পুরুলিয়া জেলা গৃহীত হয় পশ্চিমবঙ্গে, কয়লাঞ্চল ধানবাদ থাকে বিহারে(অধুনা ঝাড়খণ্ড), তবে সে অন্য কাহিনী। 

পুরুলিয়ার পঞ্চকোটের শিখর-বংশ ভারতের অন্যতম প্রাচীন রাজবংশ। মন্দিরনগরী তেলকূপি বা তৈলকম্পা অসংখ্য মন্দিরসমেত এখন পাঞ্চেত ড্যামের নীচে জলমগ্ন, স্বাধীন দেশের সরকারের ঔদাসীন্যে মন্দিরগুলি সংরক্ষিত হয়নি। রাজ্য সম্বন্ধেও বিশেষ কিছু জানা যায় না, এক রাজা রুদ্রশেখরের নাম পাওয়া যায় একটি শিলালিপিতে, ওই পর্যন্ত। তারপর খ্রীস্টজন্মের ৮০ বছর পর মধ্যভারতের ধার রাজবংশের ভ্রমক্রমে পরিত্যক্ত ও পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচজন আদিবাসী সর্দারদের হাতে পালিত সন্তান দামোদরশেখর পাঁচ-সর্দার ও কনৌজী ব্রাহ্মণ গুরু বনমালী পণ্ডিতের সাহায্যে শিখর রাজবংশের পত্তন করেন। পরে এই বংশের রাজারা ‘সিংদেও’ উপাধি গ্রহণ করেন। সেই সময় থেকে স্বাধীনতার পরে রাজন্যপ্রথার অবসান পর্যন্ত সুদীর্ঘ ঊনিশ শতাব্দী ধরে একই রাজবংশের একটানা রাজত্ব করে যাওয়া মনে হয় ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম। পত্তনের পর সাতবার পরিবর্তিত হয়ে ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে পঞ্চকোটের শেষ রাজধানী কাশীপুরে স্থানান্তরিত হয়। তৎকালীন মহারাজা নীলমনি সিংদেওএর আমন্ত্রণে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার হিসেবে এস্টেটে নিযুক্ত হন ও ১৮৭২ সালের মার্চ থেকে প্রায় সাড়ে-পাঁচ মাস কাল পুরুলিয়ায় পঞ্চকোট রাজধানী কাশীপুরে অতিবাহিত করেন। তার আগে অবশ্য সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই সপ্তাহের জন্যে একবার অন্য একটি মোকদ্দমার কাজে তিনি পুরুলিয়া আসেন, তখনই রাজা নীলমণি তাঁকে কাশীপুরে আমন্ত্রণ করেন। এরপর কলকাতা ফিরে তিনি আর বেশিদিন বাঁচেন নি, ১৮৭৩এর ২৯শে জুন প্রয়াত হন।

রাজা নীলমণি ও কবি মাইকেল

ব্যারিস্টার-কবি মাইকেল মধুসূদনের পুরুলিয়া বাস-পর্বের মূল হোতা ছিলেন পঞ্চকোট মহারাজা নীলমণি সিংদেও, পুরুলিয়ার সংস্কৃতি-জগতের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয় পঞ্চকোটের তৎকালীন রাজধানী কেশরগড়ে, রাণীমার ইচ্ছে ও প্রয়োজনানুসারে ১৮৩২এ রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কাশীপুরে। রাজ্যাভিষেকের দিন থেকে মৃত্যুকাল (১৮৫১-১৮৯৮) পর্যন্ত তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সগৌরবে সিংহাসনে বিরাজিত। নিজে সঙ্গীত ও সাহিত্যের সমঝদার গুণী ব্যক্তি, কলকাতা সংস্কৃতি ও নাট্যজগতের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ সুহৃদ। তিনি ছিলেন মাইকেলের ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ গ্রন্থের মুদ্রণের সহায়ক ও ১৮৫৮তে বেলগাছিয়া থিয়েটারে  ৫০০ টাকা খরচ করে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করান। হয়ত সেই সূত্রেই নীলমণি মধুকবির প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হন। পঞ্চকোটের রাজসভা তখন বিক্রমাদিত্য আর আকবরের সভার মতই রত্নখচিত। বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতসাধক জগচ্চন্দ্র গোস্বামী, মৃদঙ্গবাদক হারাধন গোস্বামী, বংশীবাদক পূরণ সিংহ চৌতাল, কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী, নবদ্বীপের ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, নৈয়ায়িক পার্বতীচরণ বাচস্পতি, কেদার ন্যায়রত্ন প্রমুখ গুণীজনে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর রাজসভা। বিষ্ণুপুর ঘরানাখ্যাত মধুসূদন ভট্টাচার্য আর তাঁর পুত্র যদুভট্টও তাঁর সভায় ছিলেন কিছুকাল, পঞ্চকোটে সে সময় এঁদের দানে সমৃদ্ধ হয়ে ‘বেতিহা’ নামে একটি নতুন সঙ্গীত ঘরানার উন্মেষ হয়। পুরুলিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ‘ভাদু-গান’ লোকগীতির ধারার প্রাণপুরুষ নীলমণি, এই গান তাঁর একক সৃজন। ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে চৈতন্যদাস মণ্ডল ‘বৃহৎ মনসামঙ্গল’ রচনা করেছিলেন, ১৮১৯এ রচিত ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ প্রকাশিত-মুদ্রিত হয় তাঁর সময়ে- এই ছিল তাঁর রাজত্বকালীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। এছাড়াও ১৮৮২ সালে এফ-এ পরীক্ষায় সংস্কৃতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্রকে ‘পঞ্চকোট সংস্কৃত পুরস্কার’ দানের প্রবর্তন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০০০ টাকা দান করেন তিনি।

এমন একটি পরিবেশে এসে মুগ্ধ হলেন মাইকেল। পঞ্চকোটের সাহিত্য নিশ্চয়ই মিল্টন-হোমার-সেক্সপীয়ারের মত ক্লাসিক নয়, তবু কলকাতা মহানগরী থেকে বহুদূরের এক সামন্তরাজার রাজধানীতে এসে সৃজনের এই প্রয়াস অবাক করেছিল মহাকবিকে। মধুসূদনের সঙ্গে নীলমণির ব্যক্তিজীবনেরও কিছু দুর্লভ সাদৃশ্য আছে। দুজনেই প্রায় সমবয়সী, জন্মেছেন এক রাজ্যে, পরে দুজনেরই কর্মস্থল অন্যত্র হয়। এই স্থানান্তরণের ক্ষেত্রে উভয়েরই মাতাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মধুসূদনকে মহাকাব্যের সঙ্গে ও নীলমণিকে রাজকার্যে দীক্ষা দেন তাঁদের জননীরা, আবার দুজনেই একসময় প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে মাতৃদেবীর অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার কারণ হন। নীলমণি সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নিয়ে রাজরোষে পড়েছিলেন, ‘নীলদর্পণ’ অনুবাদ করে মাইকেল অল্পের জন্য শাস্তি এড়ান। দুজনেই অনুরাগী ছিলেন রাজা যতীন্দ্রমোহনের, সর্বোপরি দুই ব্যক্তিত্বের জীবনে একসময় আশীর্বাদ-রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক দয়াময়ী নারী, কাশিমবাজারের রাণী স্বর্ণময়ী- সে অন্য প্রসঙ্গ।

এই রচনার উদ্দেশ্য কিন্তু মহাকবির পুরুলিয়াবাসের বিশদ বিবরণ জানানো নয়, তাঁর এই ছয়-সাতমাসের বাসকাল বাংলা সাহিত্যকে কিভাবে আর কতটা পুষ্ট করেছে সেটুকুই আমাদের আলোচ্য এখানে। এই সময়কালে কবি সর্বমোট সাতটি চতুর্দশপদী কবিতা (সনেট) ও অন্য কবিতা লিখেছেন যা তাঁর একটি স্থানের উপরে লেখা সর্বাধিক। পুরুলিয়ার GEL Mission দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সঞ্চালিত GEL Church কবির প্রথম প্রবাসেই তাঁকে সম্মানিত করে ও একটি যুবকের ধর্মান্তরণ অনুষ্ঠানে তাঁকে যুবকটির অন্যতম ধর্মপিতার দায়িত্ব নিতে বিশেষ অনুরোধ জানায়। এই সম্মানে অভিভূত হয়ে তিনি দু’টি কবিতা লেখেন- একটি পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে, অন্যটি সদ্য ধর্মান্তরিত ধর্মসন্তান কৃষ্ণদাসের (নব-নাম ‘খ্রীষ্টদাস’) প্রতি আশীর্বাণী। এছাড়া ‘পরেশনাথ গিরি’ নামে তিনি একটি সনেট লেখেন যদিও পঞ্চকোট থেকে প্রায় ১০০ কিমি পশ্চিমে পরেশনাথ দূর থেকেও দৃশ্যমান হয় না, আর সেখানে কবির যাত্রার কোন উল্লেখও পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়বার পুরুলিয়ার স্থিতিকালে তিনি আরও চারটি সনেট লেখেন, সবগুলির সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করি এখন।

কবির পুরুলিয়া-সংক্রান্ত কবিতাগুচ্ছ

(১) ‘পুরুলিয়া’

পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে
বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?
কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,
হে পুরুল্যে! দেখাইয়া ভকত-মণ্ডলে!
শ্রীভ্রষ্ট সরস সম, হায়, তুমি ছিলে,
অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে;
এবে রাশি রাশি পদ্ম ফোটে তব জলে,
পরিমল-ধনে ধনী করিয়া অনিলে!
প্রভুর কী অনুগ্রহ! দেখ ভাবি মনে,
(কত ভাগ্যবান তুমি কব তা কাহারে?)
রাজাসন দিলা তিনি ভূপতিত জনে!
উজলিলা মুখ তব বঙ্গের সংসারে;
বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি,
ভাসুক সভ্যতা-স্রোতে নিত্য তব তরী।

এই সনেটটি পুরুলিয়ার খ্রীষ্টান-মণ্ডলীকে লক্ষ্য করে লিখিত। কবি-রচিত চতুর্দশপদী কবিতাবলির এটি ১০৫ নং সনেট, পুরুলিয়ার German Evangelic Lutheran Mission সংস্থা প্রকাশিত ১৮৭২এর এপ্রিল সংখ্যা ‘জ্যোতিরিঙ্গন’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

পুরুলিয়ার মাটি পাষাণময় ও অনুর্বর। এ মাটিতে বীজ পড়লেও শস্য ফলে না। তবু আজ সেই অহল্যাভূমি পুরুলিয়া কবিমনে প্রভূত আনন্দসঞ্চার করেছে! এই অরণ্যভূমি শ্রীভ্রষ্ট হয়ে অজ্ঞান-তিমিরে ডুবে ছিল, এখন এখানকার জলাশয়ে রাশি রাশি পদ্ম ফুটে বাতাসকে সুবাসিত করে (‘পরিমল-ধন’ বলতে হয়ত কবি নিজের নাম ইঙ্গিতে বুঝিয়ে কিছুটা আত্মশ্লাঘাও করে নিয়েছেন, এ আমার ধারণা)। প্রভুর কৃপায় এদেশের ভক্ত-মণ্ডলী হতাশাদীর্ণ ভূপতিত কবিকে রাজাসনে বসিয়ে সম্মানিত করায় বঙ্গভূমিতে পুরুলিয়ার মুখ উজ্জ্বল হল। এর সৌভাগ্য বৃদ্ধি পাক। পুরুলিয়ার ভাগ্যতরী সভ্যতার স্রোতে চির-ভাসমান থাকুক।
১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিভিল কোর্টে বাদীপক্ষের হয়ে একটি মামলা লড়তে কবি প্রথম পুরুলিয়া এসেছিলেন, তখনও পঞ্চকোট রাজা বা রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেনি। সেই মাসেরই মাঝামাঝি পুরুলিয়ার খ্রীষ্টান সমাজ, যাঁরা মধুসূদনের কবি-খ্যাতি সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন ছিলেন, কবিকে GEL Church-এ একটি সম্বর্ধনা দেন। ‘হতাশাগ্রস্ত জীবনের গোধূলিবেলায় এই আশাতীত সম্মান কবির প্রাণে সঞ্জীবনী সুধার সঞ্চার করেছিল’, কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে কবি সনেটটি রচনা করেন।
কবিতাটির ভাষা সরল, তবু মনে করি কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। পুরুলিয়ার লৌকিক উচ্চারণ ‘পুরুল্যা’। এই শব্দের সংস্কৃতকৃত সম্বোধনে ‘পুরুল্যে’- এখানে এই লৌকিক শব্দটি এক অলৌকিক মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মহাকাব্য রচয়িতা কবি (হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’ বা নবীনচন্দ্রের ‘কুরুক্ষেত্র-রৈবতক-প্রভাস’ নিয়ে বিতর্ক থাক) মধুসূদন এই কবিতায় নিজেকে ‘ভূপতিত জন’ বলেছেন। উন্নাসিক মানসিকতার জন্যে পরিচিত মধুকবির ব্যক্তিগত বিনয়ের এই প্রকাশ বিস্ময়কর নয় কী? এই মানসিক পরিবর্তন কি শুধু অবস্থার ফেরে? এ কি শুধু মৌখিক বিনয় না কবির সম্বন্ধে আপাত-মনোভাবকে ভুল প্রমাণিত করে? কবিতাটিতে পুরুলিয়াবাসীর প্রতি অজস্রধারে কবির শুভেচ্ছা ও আশীর্বাণী বর্ষিত হয়েছে যা তাঁদেরকে চিরকাল রোমাঞ্চিত করবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে পুরুলিয়া যাত্রার সামান্য পূর্বে ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কবি একটি মামলার কাজে ঢাকা যান। এই সুযোগে ঢাকাবাসী সাহিত্যপ্রেমী মানুষ কবিকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে কবি লিখেছিলেন ঢাকাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি সনেট

“নাহি পাই নাম তব বেদে কি পুরাণে
কিন্তু বঙ্গ-অলঙ্কার তুমি যে তা জানি
পূর্ব-বঙ্গে।……”

বঙ্গভূষণ মধু-কবির চরণধুলিতে ঢাকা শহর পবিত্র হয়েছিল। এবার বঙ্গের প্রত্যন্তপ্রদেশের অবহেলিত উপেক্ষিত পুরুলিয়া সেই গৌরবের অধিকারী হল।

(২) ‘পরেশনাথ গিরি’

হেরি দূরে ঊর্দ্ধ্বশিরঃ তোমার গগনে,
অচল, চিত্রিত পটে জীমূত যেমতি।
ব্যোমকেশ তুমি কি হে, (এই ভাবি মনে)
মজি তপে, ধরেছ ও পাষাণ মূরতি?
এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে?
তবে যদি নহ তুমি দেব উমাপতি,
কহ, কোন্‌ রাজবীর তপোব্রতে ব্রতী-
খচিত শিলার বর্ম্মকুসুম-রতনে
তোমার? যে হর-শিরে শশীকলা হাসে,
সে হর কিরীটরূপে তব পুণ্য শিরে
চিরবাসী, যেন বাঁধা চিরপ্রেমপাশে!
হেরিলে তোমায় মনে পড়ে ফাল্গুনিরে
সেবিলে বীরেশ যবে পাশুপত আশে
ইন্দ্রকীল নীলচূড়ে দেব ধূর্জ্জটিরে।

(লক্ষণীয় যে বাংলা বানান সংশোধনের আগে লেখা বলে প্রাচীন রীতি- যেমন ঊর্দ্ধ্ব, বর্ম্ম, ধূর্জ্জটি লেখা হয়েছে, এগুলো সংশোধিত করার স্পর্ধা আমার নেই।)

পটে আঁকা মেঘরাশির মত দূরে উচ্চশৃঙ্গ এক পর্বত দেখি। তুমি কি হে মহাদেব, তপোপ্রভাবে পাষাণরূপ ধরেছ? এই পৃথিবীতে তোমার মত ভীষণমূর্তি আর কার আছে! তুমি যদি উমাপতি শিব না হও, তবে তুমি কোন তপোব্রতী রাজবীর? তোমার অঙ্গে শিলার বর্ম কুসুম-রতনে শোভিত। যাঁর মস্তকে চন্দ্রকলা শোভা পায়, সেই মহেশ তোমার মাথায় মুকুটরূপে শোভিত- এ যেন উভয়ের এক শাশ্বত বন্ধন। ফাল্গুনি অর্জুন পাশুপত অস্ত্রলাভের জন্যে হিমালয়ের ইন্দ্রকীল পাহাড়চূড়ায় শিবের সাধনা করেছিলেন, তোমাকে দেখলে এই উপমাটি মনে আসে।

এক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক হিসেবে নিজের কিছু মত সংযোজন করি। কবি মধুসূদন ১৮৭২এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার পুরুলিয়া আসেন বরাকর-পুরুলিয়া রোড ধরে দামোদর পার করে। এই রাস্তা থেকে ছোটনাগপুর অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পরেশনাথের (সমুদ্রতল থেকে ৪৫০০ ফুট) ন্যূনতম রৈখিক দূরত্ব অন্ততঃ ৮০ কিলোমিটার। আজকের দিনে আকাশ পরিষ্কার না থাকলে পর্বতশৃঙ্গ এতদূর থেকে দেখা যায় না, তবে সে যুগে এত ধুলো-ধোঁয়া বাড়ি-ঘর না থাকাতে বুঝি তা সম্ভব হয়েছিল। হয়ত ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যময় বলেই কবি এই পর্বতের সম্পর্কে এতটা আনুকূল্য দেখিয়েছেন। কবির দেওয়া নাম ‘পরেশনাথ গিরি’ না হলে যে কোন পাহাড় সম্পর্কেই কবিতাটি প্রযোজ্য হতে পারত। অনেকের ধারণা পঞ্চকোট পাহাড় দেখে ভ্রমক্রমে পরেশনাথ ভেবে কবি এটি লিখেছিলেন। সে ভাবনা অমূলক, কারণ পরে পঞ্চকোট পাহাড়ের সঙ্গে তিনি সম্যকভাবে পরিচিত হয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে ‘পরেশনাথ’ নামটি বদলে ফেলাই স্বাভাবিক ছিল।

এটি কবির সনেটমালার ১০৬ সংখ্যক সনেট, সেক্সপীয়ারীয় ও পেত্রার্কীয় রীতির সংমিশ্রণে এটি গঠিত।

(৩) ‘কবির ধর্ম্মপুত্র’ (শ্রীমান খ্রীষ্টদাস সিংহ)

হে পুত্র, পবিত্রতর জনম গৃহিলা 

আজি তুমি, করি স্নান যর্দ্দনের নীরে

সুন্দর মন্দির এক আনন্দে নির্ম্মিলা

পবিত্রাত্মা বাস হেতু ও তব শরীরে;

সৌরভ কুসুমে যথা, আসে যবে ফিরে

বসন্ত, হিমান্তকালে। কি ধন পাইলা-

কি অমূল্য ধন বাছা, বুঝিবে অচিরে,

দৈববলে বলী তুমি, শুন হে, হইলা!

পরম সৌভাগ্য তব। ধর্ম্ম বর্ম্ম ধরি

পাপ-রূপ রিপু নাশো এ জীবন-স্থলে

বিজয়-পতাকা তুলি রথের উপরি;

বিজয় কুমার সেই, লোকে যারে বলে

খ্রীষ্টদাস, লভো নাম, আশীর্বাদ করি,

জনক জননী সহ, প্রেম কুতূহলে।

২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭২, GEL Churchএ কবি মধুসূদন স্থানীয় কাঙালিচরণ সিংহের পুত্র কৃষ্ণদাসের ধর্মান্তরণ (baptism) অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে অন্যতম ধর্মপিতার(God Father) দায়িত্ব পালনকালে এই সনেটটি উপহার দেন। কবির সাথে আরো একজন ধর্মপিতা ছিলেন ধর্মপ্রকাশ সাগর ও ধর্মমাতা ছিলেন কৃষ্টপ্রসন্ন সাগর। গির্জার রেকর্ড অনুযায়ী কৃষ্ণদাসের বাড়ি ছিল Chorea গ্রাম, সম্ভবতঃ সেটি পুরুলিয়া-সংলগ্ন ছড়রা হবে।

জন দি ব্যাপ্টিস্ট জেরুজালেম ও ইস্রায়েলে প্রবাহিত পবিত্র যর্দ্দন নদীর(জর্ডন) জলে স্নান করিয়ে প্রভু যিশুকে ধর্মগ্রহণ করান। পরবর্তীকালে যে কেউ খ্রীষ্টকে গ্রহণ করতে চায় তাকে জর্ডনে স্নান বা তার পবিত্র জল শরীরে ছিটিয়ে ব্যাপ্টাইজ করা হয়। কবি খ্রীষ্টদাসের উদ্দেশ্যে লিখছেন যে তাকেও এভাবে খ্রীষ্টের সঙ্গে একাঙ্গীভূত করা হল। পবিত্রাত্মাকে (ঈশ্বর, যিশু ও ধর্মগ্রহীতার আত্মা- খ্রীস্টধর্মে তিনের এই সমাহারকে ত্রিত্ববাদ বলে) ধারণের জন্যে সে যেন দেহমধ্যে এক মন্দির তৈরি করল, যেন শীতের শেষে ফুলের সৌরভ প্রকৃতিতে ফিরে এল। সৌভাগ্যক্রমে কী ধন সে পেয়েছে তা সে অচিরেই বুঝবে। তাকে কবি আশীর্বাদ করছেন যেন এই ধর্মের বর্ম পরে সে পাপ-রূপী রিপুর নাশ করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে পিতামাতা নিয়ে সুখে জীবন কাটায়।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে কবির নিজের জীবনে ধর্মান্তরণের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবীর জীবন এই ধর্মান্তরণের ফলে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, সাজানো সংসার তছনছ হয়ে যায়। তাঁরা উন্মাদবৎ হয়ে অকালে প্রয়াত হয়েছিলেন। এই কৃষ্ণদাস সিংহ কিন্তু মাতা-পিতার আশীর্বাদ নিয়েই খ্রীস্টধর্মগ্রহণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তাই ধর্মপুত্র খ্রীষ্টদাসকে তিনি আশীর্বাদ দিচ্ছেন পিতামাতা-সমভিব্যহারে প্রেমময় জীবন উপভোগ করার।

সনেটটির ক্রম ১০৭, ১৮৭২ নভেম্বর সংখ্যা জ্যোতিরিঙ্গন পত্রিকায় এর প্রথম প্রকাশ।

(৪)পঞ্চকোট গিরি’

কাটিলা মহেন্দ্র মর্ত্ত্যে বজ্র প্রহরণে
পর্ব্বতকুলের পাখা; কিন্তু হীনগতি
সেজন্য নহ হে তুমি, জানি আমি মনে,
পঞ্চকোট! রয়েছ যে,- লঙ্কায় যেমতি
কুম্ভকর্ণ,- রক্ষ, নর, বানরের রণে-
শূন্যপ্রাণ, শূন্যবল, তবু ভীমাকৃতি,-
রয়েছ যে পড়ে হেথা, অন্য সে কারণে।
কোথায় সে রাজলক্ষ্মী, যাঁর স্বর্ণ-জ্যোতি
উজ্জ্বলিত মুখ তব? যথা অস্তাচলে
দিনান্তে ভানুর কান্তি। তেয়াগি তোমায়
গিয়াছেন দূরে দেবী, তেঁই হে! এ স্থলে,
মনোদুঃখে মৌন ভাব তোমার; কে পারে
বুঝিতে কী শোকানল ও হৃদয়ে জ্বলে?
মণিহারা ফণী তুমি রয়েছ আঁধারে।

পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে শিখরবংশের তৃতীয় রাজধানী ৯৬২ খ্রীঃ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর ধরে বিরাজিত ছিল। তারপর আভ্যন্তরীণ গৃহবিবাদের ফলে রাজবংশ প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়, রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী বালক রাজপুত্র মণিলাল এক রাজকর্মচারীর সহৃদয়তায় প্রাণে বাঁচেন। মণিলাল বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে রাজ্য পুনরুদ্ধার করে রাজধানী পঞ্চকোট থেকে মহারাজনগর হয়ে রামবনি নিয়ে আসেন। তাঁর পুত্র ভরতশেখর রামবনি থেকে কেশরগড়ে ও ভরতের পৌত্র জগজীবন সিংহের বিধবা রানী ১৮৩২ সালে শিখররাজ্যের শেষ রাজধানী কাশীপুরে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তী রাজা নীলমনি এই জগজীবনেরই সন্তান।

ব্যারিস্টার-কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পুরুলিয়ার সেশন কোর্টে একটি মামলা লড়তে বাদীপক্ষের আইনিজীবী হয়ে পুরুলিয়া আসেন। সেসময় মহারাজা নীলমণি সিংহদেও কাশীপুরে শিখরবংশী শাসক ছিলেন। তিনি মাইকেলের কবিখ্যাতি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। এবার আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি শুনে কবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে তিনি পুরুলিয়ায় লোক পাঠান, কিন্তু ততদিনে তিনি কলকাতায় ফিরে গেছেন। ফলে তার কিছুদিন পরে কলকাতায় লোক পাঠিয়ে একটি মামলার পরামর্শ দিতে আইন-উপদেষ্টা করে রাজা তাঁকে কাশীপুরে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেসময় ঋণভারে জর্জরিত, জীবনযুদ্ধে প্রায় পরাজিত ও হতোদ্যম। এই অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণে হতাশাগ্রস্ত কবির জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়, আর্থিক সমস্যারও সাময়িক সুরাহা হয়। তিনি ১৮৭২এর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কাশীপুর রাজসভায় এসে কাজে যোগদান করেন। অকস্মাৎ এই ভাগ্য পরিবর্তনে উচ্ছ্বসিত কবি এসেই পঞ্চকোট রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন, আর এই রাজ্যের গৃহদেবতা বা রক্ষক-প্রহরীর মত শায়িত পঞ্চকোট গিরিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে এই সনেটটি লিখে ফেলেন।

যদিও কবির হতাশ ভাব তখনও তাঁকে তাড়া করে চলেছে, এই সনেটে তা প্রকট নয়। তাঁর প্রতিটি কাব্যে ও সাহিত্যে প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি তাঁর জ্ঞান আর আকর্ষণের প্রমাণ দেখা যায়। পুরাণ-মতে পর্বতের এককালে পাখা থাকত, তারা উড়তে পারত। দেবরাজ ইন্দ্র একদিন ক্রোধবশে সব পর্বতের পাখা কেটে ফেলেন, শুধু হিমালয়-পুত্র মৈনাক সমুদ্রের গর্ভে লুকিয়ে রক্ষা পান। তবে কি সুপ্ত কুম্ভকর্ণের মত বিশাল পঞ্চকোটও পক্ষহীন বলেই হীনবল আজ? কবি তা মনে করেন না। তাঁর মতে পঞ্চকোট একদা রাজলক্ষ্মীর স্বর্ণজ্যোতিতে উজ্জ্বল হত। সেই লক্ষ্মী পঞ্চকোটকে পরিত্যাগ করেছে বলেই পঞ্চকোট পর্বতের আজ এই ম্লান দশা, মনোদুঃখে মৌন হয়ে মণিহারা নাগের মত একাকী অন্ধকারে সে বিরাজিত। তার হৃদয়ের শোকানল প্রবল দহন সৃষ্টি করেছে, একথা কেউ বুঝতে পারছে না।

এটি ১০৮ নং সনেট, পুরুলিয়া বিষয়ে কবির চতুর্থ, অবশ্য রচনার সঠিক তারিখের কোনও উল্লেখ নেই।

(৫)পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী’

“হেরিনু রমারে আমি নিশার স্বপনে;
হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে-
পদ্মাসন উজলিত শতরত্ন-করে,
দুই মেঘরাশি-মাঝে, শোভিছে অম্বরে,
রবির পরিধি যেন। রূপের কিরণে
আলো করি দশ দিশ; হেরিনু নয়নে,
সে কমলাসন-মাঝে ভুলাতে শঙ্করে
রাজরাজেশ্বরী, যেন কৈলাশ-সদনে।
কহিলা বাগ্‌দেবী দাসে (জননী যেমতি
অবোধ শিশুরে দীক্ষা দেন প্রেমাদরে),
“বিবিধ আছিল পুণ্য তোর জন্মান্তরে,
তেঁই দেখা দিলা তোরে আজি হৈমবতী
যেরূপে করেন বাস চির রাজ-ঘরে
পঞ্চকোট; পঞ্চকোট- ওই গিরিপতি।”

পঞ্চকোটের গৌরবময় ইতিহাসের কাহিনী শ্রীমধুসূদনের কবি মনে এক রোমান্টিসিজমে ঘেরা কল্পলোক তৈরি করেছিল। কাশীপুরের স্বল্পসময়ের বাসেও তিনি যেন শয়নে-জাগরণে স্বপ্নের মত সেই অতীতকে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতেন। এই সনেটের মধ্যেও একটি উৎকৃষ্ট কবিকল্পনা আছে। পঞ্চকোট রাজবংশের আরাধ্যা দেবী রাজরাজেশ্বরী কবিকে যেন রাজ্যের প্রাচীন গৌরবময় কোন এক মুহূর্তসহ দেখা দিয়েছেন।

কবি ‘নিশার স্বপন’ কথাটির এখানে উল্লেখ করেছেন। তবে আমার মনে হয় নব বর্ষার মেঘমালায় ঈষৎ আচ্ছন্ন পঞ্চকোট শীর্ষকে তার নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে প্রত্যক্ষ করে কবির মনে এই অদ্ভুত ভাবের সমাবেশ হয়। কালিদাসের ‘মেঘদূতম্‌’ কাব্যে বর্ণিত আছে এরকম একটি মুহূর্ত-

‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং।
বপ্রক্রীড়া পরিণতং গজপ্রেক্ষনীয়ং দদর্শ।।’

কাল্পনিক হস্তীযূথের এই বপ্রক্রীড়া সাধারণ মানুষের মনে তেমন কোন ভাবের সঞ্চার না করলেও, কবির রোমান্টিক মনে তার গভীর প্রভাব ফেলতেই পারে। শোনা যায় কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পর্যন্ত এধরণের অলৌকিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ভাব-সমাহিত হতেন। আর মধু-কবি এই মেঘময় হস্তীযূথের শুঁড়ে শুঁড় মিলিয়ে খেলার মাঝে ভাববিভোর হয়ে প্রত্যক্ষ করলেন দেবী লক্ষ্মীকে, মহেশের রূপে সাক্ষাৎ মূর্ত গিরিপতি পঞ্চকোট পর্বতের কোলে তিনি বিরাজিত। মেঘরাশির মাঝে দূর আকাশে তাঁর রূপমাধুরী শোভা পাচ্ছে, তাঁর রূপে দশদিক আলোকিত। পঞ্চকোট-রাজ্যের আরাধ্যা দেবী রাজরাজেশ্বরী রূপে দেবী হৈমবতী ভোলানাথ শঙ্করের মনোলোভনের জন্যে যেন কৈলাসে উপস্থিত। বাগদেবী সরস্বতী যেন জননী যেমন অবোধ শিশুকে আদর করে বোঝান সেভাবে তাঁকে জানাচ্ছেন যে কবির জন্ম-জন্মান্তরের অর্জিত অসীম পুণ্যবলে তাঁর মানসপটে এই দৃশ্য আজ ধরা পড়েছে।

এই কবিতাটি ১১০ নং সনেটরূপে প্রকাশিত।

(৬)পঞ্চকোট-গিরি বিদায় সঙ্গীত’

হেরেছিনু, গিরিবর! নিশার স্বপনে,
অদ্ভূত দর্শন!
হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে,
কনক-আসন এক, দীপ্ত রত্ন-করে
দ্বিতীয় তপন!
সেই রাজকুলখ্যাতি তুমি দিয়াছিলা,
সেই রাজকুললক্ষ্মী দাসে দেখা দিলা,
শোভি সে আসন!
হে সখে! পাষাণ তুমি, তবু তব মনে
ভাবরূপ উৎস, জানি উঠে সর্ব্বক্ষণে।
ভেবেছিনু, গিরিবর! রমার প্রসাদে,
তাঁর দয়াবলে,
ভাঙা গড় গড়াইব, জলপূর্ণ করি
জলশূন্য পরিখায়; ধনুর্ব্বাণ ধরি দ্বারিগণ
আবার রক্ষিবে দ্বার অতি কুতূহলে।

কাব্য বিচারে এটি সনেট নয়, সনেট-কল্প কবিতা।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পুরুলিয়ার কাশীপুরে পঞ্চকোট মহারাজার নীলমণি সিংদেওয়ের রাজসভায় সম্মানিত রাজকর্মচারী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসকাল তিনি সেখানে অবস্থান করেন। এই অবসরে কবি পঞ্চকোট রাজ্য ও রাজবংশের ইতিহাসের সম্যক চর্চা করেন। পঞ্চকোটের গৌরবগাথা শুনে তাঁর মনোরাজ্যে তৈরি হয় এক কল্পলোক। ইতিহাসের উজ্জ্বল কালের যে খণ্ডগুলি তাঁর মনে ফেলেছে গভীর প্রভাব, শয়নে-স্বপনে সেই কল্পলোকের হাতছানি তাঁর মনোভূমে দোলা দেয়। এক নিশীথে অদ্ভূত এক দৃশ্যপট কবির সামনে মূর্ত হয়। পঞ্চকোট পর্বতের পশ্চাদ্‌পটে দুটি হাতি যেন শুঁড়ে শুঁড়ে ধরাধরি করে রাজসিংহাসনে উপবিষ্টা রাজলক্ষ্মীর সম্মুখে বসে রয়েছে, রাজ্যের কুললক্ষ্মী দেবী রাজরাজেশ্বরী যেন অসীম করুণা-বশে কবির মনশ্চক্ষে ধরা দিয়েছেন।

এই কয়েকমাসের মধ্যে এই পঞ্চকোট পাহাড়, এই রাজ্য কবির সঙ্গে যে সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, কবির মনে তাদের সান্নিধ্য নানা ভাবের উৎস ছিল। তিনি আজ তাদের বিদায় জানাচ্ছেন। কবির স্বপ্ন ছিল গড়পঞ্চকোটের গৌরবময় ইতিহাসকে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাজ্যের প্রাচীন গড়টিকে নতুন করে গড়াবেন, ১২ বর্গমাইল-ব্যাপী রাজধানীর তিনদিক ঘিরে যে পরিখা ছিল সেগুলিকে আবার জলপূর্ণ করবেন। রাজধানীতে চারধারে চারটি তোরণ ছিল, (দুয়ারবাঁধ, বাজারমহল-দুয়ার, খড়িবাড়ি- দুয়ার আর আঁখ-দুয়ার) তাদের সামনে আবার ধনুর্বাণ নিয়ে দ্বারীরা পাহারা দেবে।
কিন্তু বাস্তব অতি নির্মম। কঠিন বাস্তব এসে স্বপ্নকে আঘাত করে, কল্পলোক চুরমার হয়ে যায়। তবু কবির এই স্বল্পকালের প্রবাসে তিনি তিনটি কবিতায় পঞ্চকোটের কালজয়ী মহিমাকে কাব্যে অমর করে রেখেছেন, মহিমান্বিত করেছেন এখানকার মাটি, বাতাস, পাহাড়, জল, আকাশ ও মানুষকে। এই গৌরব পুরুলিয়ার, পঞ্চকোট রাজ্যের। এই ভূমিখণ্ড তাঁর লেখনীর জাদুস্পর্শে চিরজীবি হয়ে আছে।

(৭)হতাশা-পীড়িত হৃদয়ের দুঃখধ্বনি’

ভেবেছিনু মোর ভাগ্য, হে রমাসুন্দরি,
নিবাইবে সে রোষাগ্নি,-লোকে যাহা বলে,
হ্রাসিতে বাণীর রূপ তব মনে জ্বলে;-
ভেবেছিনু, হায়! দেখি, ভ্রান্তিভাব ধরি!
ডুবাইছ, দেখিতেছি, ক্রমে এই তরী
অদয়ে, অতল দুঃখ সাগরের জলে
ডুবিনু; কি যশঃ তব হবে বঙ্গ-স্থলে?

এটিও সনেট নয়, একটি সনেটকল্প কবিতা। এতে কবি মধুসূদনের বিড়ম্বিত জীবনের যন্ত্রনাময় ছবি প্রতিভাত হয়েছে। শেষ জীবনে প্রায় ঋণভারে জর্জরিত কপর্দকশূন্য অবস্থায় কবি কাশীপুর মহারাজা নীলমণি সিংদেওএর এস্টেটে আইন-উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। সেখানে একজন ব্যারিস্টার রূপে তাঁকে এস্টেটের জটিল মামলাগুলি দেখতে হত। এমনি একটি মামলায় মহারাজ কলকাতা হাইকোর্টে পরাজিত হন। আইনের চোখে রাজার তরফে কেসটি দুর্বল ছিল, তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেও মধুসূদন মামলা জেতাতে পারেন না। এতে রাজার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে যার ফলস্বরূপ কবিকে চাকরি খুইয়ে পঞ্চকোট রাজ্য ছাড়তে হয়। এই চাকরিকে ঘিরে কবির অনেক প্রত্যাশা ছিল যে তিনি ঋণমুক্ত হয়ে আবার সম্মানের জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। ভাগ্যদোষে সে স্বপ্ন তাঁর পূরণ হল না।

এই কবিতাটি সাত পংক্তির, আমার মনে হয় এটি অসম্পূর্ণ, কেমন যেন মধ্যখান থেকে শুরু হয়েছে। গঠনে একেবারে সনেটের মত, হয়ত পরিপূর্ণ সনেটই ছিল যার প্রথম সাতটি চরণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য কবির হতাশা অবশিষ্ট সাত পংক্তিতেই পরিস্ফুট। বেশ বোঝা যায় লক্ষ্মীর সঙ্গে বাগ্‌দেবী সরস্বতীর বিবাদ নিয়ে কবিতার শুরু। কবি মনে করছেন, তিনি বাণীর সাধনা করেন, তাই বুঝি ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রমা তাঁর প্রতি চিরকাল রুষ্ট, জীবনে তিনি কোনদিনই লক্ষ্মীর কৃপা পান নি। তবে কাশীপুরের রাজসভায় চাকরি আর রাজ-অনুগ্রহ পেয়ে তাঁর মনে আশা হয়েছিল এবার হয়ত সেই রোষ শান্ত হবে, ভাগ্যের অনুগ্রহে তাঁর জীবনজুড়ে নেমে আসা বিপর্যয়ের অন্ত হবে। কিন্তু তা হয়নি, কবির ভাগ্যতরী দুঃখের সাগরজলে নিমজ্জিত হল। এই বঙ্গভূমিতে যাঁর প্রাপ্য ছিল অসীম যশ, মর্যাদা আর বৈভব, সেই মহাকবির জীবনে ঘনিয়ে এল দুর্বিপাক। তিনি যশ-মান-বিত্ত-স্বস্তি কিছুই পেলেন না।

শেষকথা

 মাইকেল মধুসূদন দত্তের পুরুলিয়া-কাশীপুর প্রবাসকাল আর সেসময়ে লেখা সাতটি কবিতা ও তার বিষয়বস্তু পড়ে কবি-চরিত্র আর তাঁর সমগ্র জীবনজুড়ে বহু অসাধারণোচিত আচরণের যেন একটা সামগ্রিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সর্বজনমান্য একটি ধারণা আছে যে জীবনের শেষবেলায় মানুষের একটা আত্মানুভূতি আসে, সমস্ত জীবনটা একত্র হয়ে মানসপটে মূর্ত হয়। মাইকেল ছিলেন অত্যন্ত অনুভূতিশীল, প্রতিভাবান অথচ ভাবপ্রবণ, বাস্তবতাজ্ঞানবিহীন ও কল্পনাবিলাসী একজন উচ্চমানের কবি। তাঁর মনোজগত এই পৃথিবীর নির্মম বস্তুবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল, তাই তিনি উচ্চমেধার অধিকারী হয়েও ব্যবহারিক জীবনে সফল হতে পারেননি। ফলে যখনই তাঁকে কোন স্থূল কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা এড়িয়ে থাকতে ডুব দিয়েছেন সুরাপাত্রে। দেশে ফিরে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আর অনেকগুলি সফল গ্রন্থ লেখার পর যখন নিজের উপর ধীরে ধীরে বিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছিলেন, গলায় চেপে বসল ঋণের ফাঁস। সাধারণতঃ নেটিভ থেকে খ্রীস্টান হওয়া মানুষকে খ্রীস্টান-সমাজ আপন করে নেয়, কিন্তু বোধকরি নেটিভ হয়ে পরপর দু’জন শ্বেতাঙ্গিনী রমণীকে বিবাহ করার স্পর্ধা শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা মেনে নিতে পারেনি, তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে- এমনকি মৃত্যুর পর তাঁর কবরের জমি পাওয়া নিয়েও হয়েছে চুড়ান্ত বিরোধিতা, স্ত্রী হেনরিয়েটার শেষকৃত্যে যদিও কোন সমস্যা হয়নি। তবু তিনি আজীবন রয়ে গেছেন ভাবপ্রবণ, স্বপ্নপরায়ণ। আশা ছাড়েননি। ফল পাননি, তবু আশার ছলনায় বার বার ভুলেছেন।

সেই মাইকেল যখন ঋণভারে জর্জরিত কপর্দকশূন্য অবস্থায় পঞ্চকোট রাজদরবার থেকে ডাক পেলেন, মন আবার সুদিনের আশায় ভরে উঠল, স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন ঋণমুক্ত হয়ে জীবন আবার গোড়া থেকে শুরু করছেন। পঞ্চকোট রাজ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশে স্বপ্ন দেখছেন, ভাঙা গড় আবার গড়ে তুলবেন, পরিখা দিয়ে আবার জলের স্রোত বইবে। তাঁর এই মানসিক অবস্থার ক্রমবিবর্তন দেখা যায় প্রথম থেকে শেষ কবিতাগুলি ক্রমান্বয়ে পড়ে গেলে, যেন তাঁর জীবনজুড়ে অলীক সুখের স্বপ্ন আর মোহভঙ্গের ইতিহাস, আত্মবিলাপের মত বারবার ফুটে ওঠে কবির লেখনীতে-

“নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে।
ক্ষণপ্রভা প্রভা-দানে বাড়ায় মাত্র আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!”

 

 

 

 

শিক্ষা- ইঞ্জিনিয়ারিং, কর্মসূত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম তৈলখনি অঞ্চলে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখি শুরু হয় ২০১১তে কম্প্যুটারে বাংলা ফন্টের আমদানির সূত্র ধরে, ‘অবসর’ সমেত বিভিন্ন নেট-পত্রিকা ও বম্বে ডাক, পশ্চিমঘাট ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত ২০২২ থেকে তিনটি ছোটগল্পের ও একটি প্রবন্ধের সঙ্কলন প্রকাশিত হয় এযাবৎ। দুটি নেট পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • দিলীপ দাস , January 23, 2021 @ 5:36 pm

    সুন্দর লেখা। যাঁর জীবনটাই একটি মহাকাব্যের মতন, সেই কবির জীবনের একটি অল্পখ্যাত অধ্যায়, সুচারুরূপে পরিবেশনের জন্য ধন্যবাদ।

    – দিলীপ দাস

    • পল্লব চট্টোপাধ্যায় , January 24, 2021 @ 4:42 pm

      অনেক ধন্যবাদ, দিলীপবাবু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *