“দাদা আমার একটু জ্বর জ্বর লাগছে। গলায় ব্যথা। আজ অফিস ছুটি নিয়েছি গিন্নীর জ্বর এসেছে বলে। বিছানা ছেড়ে আজ উঠতে পারেননি। তাই, ইয়ে, বুঝলেন তো, ঘরের নানারকম কাজ আছে। অফিস যেতে পারিনি। হেঁশেলটাও আমাকেই সামলাতে হয়েছে। কাল যদি আবার জ্বরে পড়ে অফিস না যেতে পারি, তবে চাকরী রাখাই দায় হবে। দেখুন তো, কোনও আ্যান্টিবায়োটিকস্ সাজেস্ট করতে পারেন কিনা!”
চটজলদি উত্তর আসে দাদার, “Amoxicillin দিনে দু’বার করে পাঁচদিন খাবেন। আর গলায় ব্যথা খুব বেশী হলে Zythromax দিনে একটা করে তিন থেকে পাঁচদিন।”
এরকম কথোপকথন কলকাতার ওষুধের দোকানে আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। সমস্যা হলো অকারণে অতিরিক্ত আ্যান্টিবায়োটিকস্ নিলে আমাদের শরীরে আ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরী হয়। তখন কোনো গুরুতর অসুখে সেই প্রকারের আ্যান্টিবায়োটিকস্ দিলে, তা অনেক সময়ই আর কার্যকরী হয় না। আজকাল হামেশাই গরু, বাছুর, ছাগল, বা অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের খাবারদাবারে আমরা নানারকম আ্যান্টিবায়োটিকস্ মেশাই। ইদানীং শস্যফলনে বা চাষবাসেও নানাবিধ আ্যান্টিবায়োটিকস্ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে। গরুর দুধ, পাঁঠা বা মুরগীর মাংস, সবজি ইত্যাদি খাবারদাবারের সঙ্গে এইসব আ্যান্টিবায়োটিকস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলস্বরূপ আমাদের শরীরে আ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ক্ষমতার বৃদ্ধি হয়। আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধী ক্ষমতা হলো, যখন আ্যান্টিবায়োটিকস্ দেওয়া সত্ত্বেও একটি বিশেষ প্রকার ব্যাকটেরিয়া শরীরে বৃদ্ধি পাওয়া। অর্থাৎ এই আ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটি এই বিশেষ প্রকার ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে আর সক্ষম নয়।
হাসপাতালে সংক্রামিত রোগের সঙ্গে এই আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধী ক্ষমতার একটা খুব গভীর যোগাযোগ আছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অন্ততঃ আটচল্লিশ ঘন্টার পর রোগী যদি অন্য আরেকটি রোগে সংক্রামিত হয়, তবে তাকে হাসপাতালে সংক্রামিত (Hospital Acquired Infections, HAI অথবা Nosocomial Infection, NI) রোগ বলে। হাসপাতালের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, বা ভাইরাস, ইত্যাদি থেকে HAI মূলতঃ সংক্রামিত হয়। স্বাস্থ্যসেবকদের স্বাস্থ্যবিধি পালনে গাফিলতি হলে এবং তারপর তাঁরা রোগীদের সংস্পর্শে এলে রোগীদের শরীরে HAI সংক্রামিত হতে পারে। এছাড়াও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, যেমন ventilator অথবা catheter জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলেও এই প্রকারের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই জাতীয় সংক্রমণের জীবাণুর সত্তর শতাংশেরও বেশী একাধিক আ্যন্টিবায়োটিক ওষুধকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এদের বলে Multi-drug Resistant Pathogens (MDR)। একাধিক আ্যান্টিবায়োটিকস্ কাজ না করায় অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং কখনও কখনও এর থেকে মৃত্যুও হতে পারে।
২০১৪ সালে ওয়ার্ল্ড হেল্থ্ অরগানাইজেসন্ (WHO) এই প্রসঙ্গে একটি বিস্তৃত রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় সমগ্র বিশ্বের জনস্বাস্থ্যে এই সমস্যা এখন বিশেষ প্রকট। আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধী ক্ষমতা মানুষের রোগ নির্মূলে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিশেষতঃ বয়স্ক বা দীর্ঘমেয়াদী রোগীদের সুস্থ করে তোলায় বাধার সৃষ্টি করছে। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক সমস্যাও তৈরী হচ্ছে। আমেরিকাতে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর HAI এ সংক্রামিত হয়। প্রতি বছরে আনুমানিক ১.৭ মিলিয়ন রোগী HAI তে আক্রান্ত হয় এবং এর সমস্যাজনিত অসুস্থতার মোকাবিলায় আনুমানিক পাঁচ থেকে দশ বিলিয়ন ডলার খরচা হয়। সেই কারণেই WHO বিশ্বের সব দেশকে একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে, এই সমস্যার সমাধানের জন্য সুগঠিত, সুসংবদ্ধ কিছু প্রয়াস নেওয়ার আবেদন জানায়।
তবে আশার কথা, আমেরিকার Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর মতানুযায়ী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য সেবক সেবিকারা সচেতন হলে এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি পালন করলেই কিছু বিশেষ প্রকার HAI সত্তর শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন প্রত্যেক রোগী দেখার আগে স্বাস্থ্যসেবক এবং সেবিকারা সাবান জলে হাত ধুয়ে নিলে এই সংক্রমণ অনেকাংশেই হ্রাস পেতে পারে। এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য হাসপাতালের নার্স বা অন্যান্য সেবক সেবিকারা, যারা সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসেন তাদের নিয়মিত নানাবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে সচেতন করার প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে। সাধারণ জনসাধারণকেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলির তরফ থেকে নানারকম প্রচার মাধ্যম, যেমন টিভি, রেডিও, বা রাস্তাঘাটে বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের দ্বারা সচেতন করা যেতে পারে। উচ্চবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও ছাত্রছাত্রীদেরও বিভিন্ন ক্লাস প্রজেক্টের মাধ্যমে অবগত করার প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে। এইসব প্রচেষ্টা বা কর্মশালা অবশ্য এককালীন হলে হবে না – সুদূরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদী ফলের জন্য নিয়মিত করতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে দৃষ্টান্তস্বরূপ নিউ ইয়র্ক সিটি কলেজ অফ্ টেকনোলজির কিছু ছাত্রছাত্রীর একটি প্রজেক্টের (Study of Healthcare-Associated Infections and Multi-Drug Resistance in Brooklyn: An Integrative Approach) কথা উল্লেখ করছি। বেশ কিছু বছর যাবৎ আমি এই কলেজে অঙ্ক পড়াই। আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধে সচেতনতা আনার জন্য আমাদের কিছু ছাত্রছাত্রী ছোট একটা প্রজেক্ট করে আমার দুইজন সহকর্মী এবং আমার তত্ত্বাবধানে। ছাত্রছাত্রীরা নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের পনেরোটি হাসপাতাল থেকে HAI সম্পর্কিত সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করে। বিশেষ করে Stephylococuus aureus, Klebsiella pneumoniae, Pseudomonas aeruginosa, Acinetobacter baumannii, আর Clostridium difficile ব্যাকটেরিয়াগুলি নিয়েই ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল আ্যান্টিবায়োটিকস্ Amikacin (AK), Gentamicin (GEN), Ceftazidime (CAZ), Piparacillin-Tazobactam (Pip-Taz), Ciprofloxin (Cip), এবং Imipenem (Imi) এইসব ব্যাকটেরিয়া বিনাশে কতটা কার্যকরী তা নির্ণয় করা। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় Acinetobacter baumannii ব্যাকটেরিয়া Ciprofloxin-কে প্রায় ১০০ শতাংশ প্রতিরোধ করে। অর্থাৎ Ciprofloxin ওষুধটি Acinetobacter baumannii জীবাণুকে ধ্বংস করতে তেমন কার্যকরী নয়। তদুপরি Klebsiella pneumoniae ব্যাকটেরিয়ার AK, CAZ, Cip, এবং Imi কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতার যে বৈষম্য পনেরোটি হাসপাতালের মধ্যে দেখা যায়, তা পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ হাসপাতালগুলির মধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতার এই বৈষম্যকে কাকতালীয় একেবারেই বলা যায় না। সুতরাং বিভিন্ন হাসপাতালের একই জীবাণুর বিশেষ কিছু আ্যান্টিবায়োটিকস ওষুধের প্রতিরোধ ক্ষমতায় কেন এই তারতম্য, তার আরো গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে বয়স্ক লোকেরা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগীরা আ্যান্টিবায়োটিকস্ বেশী ব্যবহার করে থাকেন। ফলস্বরূপ এইসব রোগীদের মধ্যে আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধী ক্ষমতা বেশী থাকাটাই স্বাভাবিক। তদুপরি যেসব হাসপাতালগুলি অপেক্ষাকৃত গুরুতর রোগী সামলায়, সেখানেও অতিরিক্ত আ্যান্টিবায়োটিকস্ ব্যবহৃত হওয়াতে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী হওয়াই সম্ভব। কোনো কোনো হাসপাতালে আবার বিশেষ কিছু আ্যান্টিবায়োটিকস্ বেশী ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে সেই হাসপাতালের দীর্ঘস্থায়ী রোগীদের শরীরের মধ্যে এই জাতীয় আ্যান্টিবায়োটিকসে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। HAI শুধু রোগীদের মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতাকে দীর্ঘমেয়াদী করে তোলে তাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও চাপের সৃষ্টি করে। তাই আ্যান্টিবায়োটিকস্ ওষুধের অকারণ বা অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আমাদের সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
আজকে Covid-19 অতিমারীর প্রকোপে জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি পালনে সচেতনতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বাইরে থেকে এসে সাবান জলে অন্ততঃ কুড়ি সেকেন্ড হাত ধোওয়া। সাবান জলের মাহাত্ম্য যে এতোটাই, তা এই অতিমারী না হলে হয়তো উপলব্ধি হতো না। সাবান জলে হাত ধোওয়া এবং অকারণে আ্যান্টিবায়োটিকসের ব্যবহারের আধিক্য কমালেই এই আ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধী HAI এর সংক্রমণ অনেকাংশেই সম্ভবত কমানো সক্ষম।