লেখালেখি ও নিছক সাহিত্য-চিন্তা

লেখালেখি ও নিছক সাহিত্য-চিন্তা

আমার লেখালেখির ব্যাপারে ছোটবেলা থেকে সেজবেলার, মানে ইস্কুল-কলেজের গণ্ডী পেরনো পর্যন্ত সময়টার ভূমিকা বেশ গৌণ। আমাদের ইস্কুলের বা কলেজের ম্যাগাজিন বলে কোন কিছু ছিল না – থাকলেও তার খবর কখনো পৌঁছোয়নি আমার ব্যস্ত মগজে। ক্লাসের পড়াশোনার প্রয়োজনে লেখা, কিংবা পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর লেখা এই-হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না – সেগুলো প্রাণের দায়ে, প্রাণের খুশিতে মোটেও নয়! তেমন কিছু লেখার প্রয়োজন বা তাগিদ ভেতর থেকে এসেছে অনেক পরে। আমার আবার আছে এক সমস্যা – তাগিদ আসতে হবে ‘ভেতর থেকে’, বাইরে থেকে নয় – তাই ফরমায়েশি লেখা লিখতে বসলে মন সায় দেয় না, বসে বেঁকে – লিখতে পারি কি না-পারি, সে তো পরের কথা। আর সেই কিংবদন্তীর গল্পে-পড়া কুকুরের লেজের মত, তাকে যে আর কিছুতেই সোজা করা যায় না! ভেতর থেকে তখন যেন শুনতে পাই মন বলছে – ‘ভালবাসা না হ’লে নড়তে পারবো না হে, কলম বাগিয়ে যতই ঠেলাঠেলি করো!’

এই যেমন গানের ব্যাপারে। গান শুনতে ভালোবাসি, তাই হয়ত সেই ভেতর থেকেই গুনগুনুনি উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্ত – ব্যস, ঐ পর্যন্ত! খোদ সুবীর-দা – মানে আমার অত্যন্ত প্রিয় সু-গায়ক শ্রীসুবীর সেন আমার গুনগুনুনি কানে যেতে বলেছিলেন – “বাঃ! তোমার গলা তো বেশ ভালো, গাও না গলা খুলে!”

গান শেখার সদিচ্ছা বা সেইমর্মে পরামর্শও যে কোনোদিন জোটে নি, তাও নয়। হলে কী হয়, ভেতর থেকে মন আবার স্পষ্টস্বরে জানিয়ে দিলে – ‘ঐ সারেগামার চক্করে ঢুকলে কিন্তু তোমার দিল্ থেকে গানের প্রতি ভালবাসা ছুটে যাবে – ভেবে দেখো, তাই কি তুমি চাও?’

সত্যিই, তা তো চাইনি – ঐ ভালবাসাটুকুই যে আমার সম্বল! তাই, সুবীর-দার সেই স্বতঃস্ফূর্ত উক্তিই আমার একমাত্র সার্টিফিকেট হয়ে জমা রইল মনের মণিকোঠায়।

 

সুবীর সেন - আমার সুবীরদা

অভিনয়ের আসরে নামার ব্যাপারেও অনীহা দেখা দিয়েছে ঐ ভেতর থেকে – চেহারার দিক থেকে সুপারিশ মিললেও, কাজে পরিণত করা হয়নি – সেই ইস্কুলে, বোধহয় ক্লাস নাইনে ‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজপুত্র সঞ্জয়ের ভূমিকায় অভিনয়ের পর, আর কখনো। সে-ও হয়ত ঐ মনেরই কারসাজি – কখনো বা তার মর্জি হয়নি রিহার্সালে দীর্ঘ সময় দিতে, কখনো-বা তার পছন্দ হয়নি ডায়ালগ। আমায় চুপিচুপি বলেছে – ‘ইচ্ছে হ’লে আমি এর-চেয়ে ঢের ভাল লিখতে পারি – দেখে নিয়ো একদিন!’ এমন-কী, গত বেশ কিছু বছরে ঐ মনের মন্ত্রণায় লিখেও ফেলেছি গুটি-চারেক নাটক – ছোট, মেজ, এবং বড়দের। প্রথমটির ক্ষেত্রে তবু জুটেছিল বকলমে প্রশস্তি – সেটি নাকি ছোটদের জন্যে ‘বেশী ভালো’ হয়েছিল – বস্তুটি যে ঠিক কী, সে-সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই! অন্যটির মিলেছিল কঠোর সমালোচনা – গুণাগুণ-বিচারে তাদের রায় – ‘গুণের চেয়ে অগুণ বেশী’! বাকীগুলো এরপর আর সঙ্কোচে দেখাইনি কাউকে! তাই, আমার মনে কল্পনায় যে ছবিটা ছিল – আমার নাটক মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে, আর আমি প্রথম-সারিতে বসে হাসিমুখে তা অবলোকন এবং উপভোগ করছি – সে’ছবিটা বেশ ফিকে হয়ে এসেছে। আশাবাদী মন যে আশ্বাস দিয়েছিল, ‘দেখে নিয়ো একদিন’ … দুর্ভাগ্যক্রমে সে-দিন আর আসেনি – অন্তত এখনো পর্যন্ত! এখন তো তারা অসূর্যস্পশ্যা – আছে দেরাজেই তোলা। আপনাদের পক্ষে অবশ্য সেটা সৌভাগ্যের কারণ হলেও হতে পারে।

তা সে যাকগে! কলেজের গণ্ডী পেরনো তো সেই উনিশ-বিশে – সেখানেই শেষ সেজবেলা। সেই-বয়েসে লিখে সুখ্যাতি পেয়েছে যে-কজন ক্ষণজন্মা কিংবা দুর্লভ প্রতিভারা, বিশ্বের মানুষের ইতিহাসেও তারা সুকান্ত-রবীন্দ্রের মত কোটিকে গুটিক। আজ এই পঁচাত্তরে পা দিয়ে নিজেকে ক্ষণজন্মা – কিংবা আপনাদের ঐকান্তিক সাধুবাদ সত্ত্বেও দুর্লভ প্রতিভা বলি কোন্ মুখে! আর লিখে সুখ্যাতি পাওয়ার দুরাশাও ছেড়েছি সেই কোন্ কালে – যখন মেনেছি বাংলা-সাহিত্যজগতের লেখক-মিছিলে এমন-কী ছলে-বলে-কৌশলে লাইন ম্যানেজ করে চুপিসাড়ে ঢোকার এলেমটাও যে আমার অনায়ত্ত। জ্ঞানবৃক্ষের ফল মিলেছে অনেককাল হোলো – তার দৌলতেই এখন জানি – সে-আশায়ও জলাঞ্জলি, কিংবা মুজতবার অনুকরণে – ‘সে বীয়ারে ছাই!’ এখন মনে হয় – সেই-কার অলক্ষ্য অঙ্গুলিহেলনে সেই-কবেই হয়ে গেছে আমার ভাগ্যবিচার; হ্যাঁ, সেই-যেদিন প্রাথমিক স্কুলে আবৃত্তি-করার ডাক পড়তেই থামের আড়ালে স্বেচ্ছায় লুকিয়ে পড়েছিলাম – সেদিন থেকেই! আজ পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে পৌঁছেও অনেকদিন থেকেই আমি মুখ লুকিয়েছি ‘থামের আড়ালে’।
এহ বাহ্য! কীর্তি নয়, খ্যাতি নয় – এখন যে লিখি তা ঐ প্রাণের খুশিতে, লেখার প্রতি ভালোবাসার টানে। আর বিশেষ ক’রে এখন এই শেষকালে, বুড়োবেলার একান্তে – পথ-কুড়নো চিত্রবিচিত্র অভিজ্ঞতার হিসেব-নিকেশ রাখতে – যার তাগিদ আসছে সেই ‘ভেতর থেকে’; যার নির্দেশ মানতে না লিখেই পারছি না ব’লে – কারও কিছু স্বীকৃতির মুখ চেয়ে তো নয়ই – এমনকী নেই কোনো পাঠকেরও অপেক্ষা! আর এই সুযোগে কবুল করে যাই – ‘প্রাণের খুশিতে’ লেখা ব’লে হয়ত অগৌরবে আমার লেখা হয়ে দাঁড়াবে ‘যা-খুশি লেখা’, নেহাৎই অর্থের অবনতিতে – মেনে নেবো ‘সে নিন্দার কথা’। জানি আমি – সত্যিকারের ‘আবোল তাবোল’ লিখতে প্রতিভার প্রয়োজন – সুকুমার রায়ের যা ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে – আমার তার নিতান্ত অভাব!

এই ক’দিন আগে Anna Quindlen নামে এদেশের এক নামকরা লেখিকার সদ্য সাক্ষাৎকারে পড়লাম, লেখার প্রেরণা-সম্পর্কে উনি বলছেন –

Anna Quindlen

“…One hundred years ago, everybody wrote. Everybody wrote letters. Lots of people kept journals. People wrote down the events of the day. Today if you say to somebody you meet, “That’s an interesting story. You should write it down,” their first response is, “I’m not a writer” — and by that they mean that writing now belongs to those of us who do it for a living. I think that’s wrong. I think writing should belong to everybody and I think everybody should write because it’s good for our history and it’s good for our psyche.”

আমি নিজে অবশ্য ওঁর এই মতামত বা মনোভাব জানার অনেক আগে থেকেই লিখছি বা লেখার চেষ্টা করছি – আর তাই নিয়েই এখন লিখতে বসেছি – তবে ওঁর এই বক্তব্যে যেন শুনতে পেলাম আমার নিজস্ব ভাবের সুস্পষ্ট অনুরণন। উনি আরো বললেন –

“What do you really love? Write about that. A friend of mine says her writing prompt is, “I don’t know what to write about but …”  It’s that “but” that gets her writing. …I was online with a group of students a couple of months ago and one of them said, “I’m going to say something that I’m embarrassed to say about writing – I’m afraid.” I said, “So am I.” Her face just lit up. I think that we’ve given people the impression that if you write for a living, it’s easy, and I think that’s a mistake. They need to understand that writing can be really hard, but when you’re done, it can be really valuable and even transformative. … I think that there are people who manage, through writing, to understand themselves in a way that they didn’t understand themselves before. It enables them not only to imagine themselves differently, but to become quite different than they’d been before.”

আমার কাছে কথাগুলি ভীষণ সত্য! লেখার মধ্যে দিয়ে অজান্তেই দেখা পাই নিজের। অকালে মাতৃহারা এই প্রখ্যাতা লেখিকা এরপরে মায়ের স্মৃতিচারণের অবকাশে বলছেন –

“Occasionally, I’ve written a sentence and thought, “Oh my God, that’s my deepest feeling. My deepest secret.” Until I wrote about it, I didn’t realize that one of the things that I’d done for a good part of my life was live for two. I’d carried my mother on my back through all the decades she didn’t get to experience. I probably understood that on a subconscious level, but that’s what writing does: it takes your subconscious, pulls it to the surface, and makes you confront it in a new way. … I think my mother would have wanted me to find joy in all the passages of life, including the ones that she didn’t get to experience. I was keenly aware of the wind of her at my back saying, “Live! This is what I wanted to hold onto, but didn’t get a chance to. Don’t let it slip through your fingers.”

কথাগুলি যেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-লব্ধ মানবাত্মার অমূল্য জীবন-বেদ – সকলের কাছেই একান্ত শিক্ষণীয়।
কালের হিসেব-নিকেশ রাখতে অবশ্য এখানে বলতে হয় জীবনের মেজবেলা আর বড়বেলার কথা – যে-সময়টাতে লুকিয়ে আছে আমার লেখালেখির প্রস্তুতি, সূচনা, ও ক্রমবিকাশের বিবরণ। আগেকার যুগে যাকে বলা হত – ‘প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো’। ‘হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল!’ এখন এ-কালে এ-যুগে অনেক পাঠকের কাছে হয়ত এ-উপমা অর্থহীন, হাস্যকর – কিন্তু আমার কালের মেজবেলায়ও অন্তত, প্রদীপের অস্তিত্ব ছিল চোখের সামনেই দেদীপ্যমান।

পত্র-লেখা

কর্মব্যস্ত সংসারযাপনের অবকাশে জীবনের সেই মেজবেলায় ডাইনে-বাঁয়ে অন্য কিছু করার সময় পেয়েছি একান্ত কম। তবে ঐ যে লেখিকা বলেছেন, কিছুদিন আগে পর্যন্তও “Everybody wrote letters.” – কথাটা যে সত্যি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। অন্তর্জাল বা ইন্টারনেট আসার আগে পর্যন্ত হাতে-ক’রে কাগজে-কলমে চিঠি লেখা এবং সে-চিঠি ডাকবিভাগের কর্মীদের মারফৎ যথাস্থানে পৌঁছনো – মানুষে-মানুষে যোগাযোগ আর ভাব-ভাবনা আদানপ্রদানের এ-ই ছিল মুখ্য উপায়। হ্যাঁ, ঐ লেখিকা যে বলেছেন ‘জার্নাল’ বা ডায়েরীর কথা – লিখেছি তা-ও, চিঠির সঙ্গেই – যখনই মিলেছে সময়। আমার জীবনে ওঁর কথাটা তাই অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি। 

সবার কাছে হয়ত নয় – তবে সেযুগে আমার কাছে অন্তত, চিঠি লেখার মূল কারণ ছিল মন-কেমন-করা। এই প্রবাসী অস্তিত্বে ফেলে-আসা দিন যখনই পেছু ডাকে, তারই মোকাবিলায় হাতে উঠে আসে কলম – দেহ-মনের বিপুল দূরত্বের সামাল দিতে। প্রাপক-অনুযায়ী খবরের আদান-প্রদান হত চিঠির উপাদান, তবে তা-ই মুখ্য নয়! সাধারণভাবে চিঠিমাত্রই প্রাপকের নিজস্ব সম্পত্তি – আর কারো দাবী চলে না সেখানে। একমাত্র ব্যতিক্রম বোধহয়, সে চিঠি যদি কোনো বিখ্যাত মানুষের হয় – তখন সে-চিঠি যেন-তেন-প্রকারেণ ঠিক পৌঁছে যাবে জনতার গোচরে। ব্যাপারটা অন্তত আমার কাছে মনে হয় ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’। সহিতত্ব থেকে সাহিত্য কথাটার উৎপত্তি – কথাটা শোনা আছে আমারও। আর চিঠি জিনিসটা একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন বিশেষ মানুষের যোগাযোগ তথা ‘সহিতত্বে’-র মাধ্যম – তর্কের খাতিরে মেনে নিতে পারি তা-ও। কিন্তু তা-বলে, ন্যায়শাস্ত্রের কোনো সূত্র-মাফিক, সব চিঠিই যে সাহিত্যপদবাচ্য – সে-কথা মানতে পারব না কিছুতেই! অবশ্য আমার না-মানায় আর-কারো কিছু আসে-যায় না – এতাবৎকালের ‘শারদীয়া সংখ্যা’-গুলিই তার প্রমাণ – যেখানে বিভিন্ন নামীদামী মানুষের ‘অপ্রকাশিত চিঠি’ অপ্রত্যাশিত রূপে দেখা দেয় ভূরি ভূরি। সম্পাদক-মহোদয়দের মতে – পাঠকের পাতে তাদের পরিবেশন করলে পাঠক উৎফুল্ল হবে এবং ‘খাবে’। আমার মতে তারা হতে পারে দলিল-মাত্র – তাদের দাম লেখকের নাম-হিসেবে, লেখার মান-হিসেবে নয়।

আর-সব লেখার সঙ্গে চিঠি-লেখার এক মস্ত পার্থক্য হল – চিঠিতে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক আছে। লেখা শেষ ক’রে ডাকে দেওয়ার পর থেকেই মন প্রতীক্ষায় থাকে  উত্তরের – আশায় আশায় চেয়ে থাকে ডাকপিয়নের আসা-পথের। অন্য লেখায় তা নেই – লিখে ফেলার পর, মন হয়ত-বা সন্ধানে থাকে পরের লেখার মাল-মশলার। আরো একটা কথা। সাহিত্য-পর্যায়ে আলোচনায় খেয়াল রাখা প্রয়োজন – অন্য লেখা ছাপা হয়ে আত্মপ্রকাশের আগে কমবেশি ঘষামাজা হয়, সে-তুলনায় চিঠির কিন্তু হয় না সে-সুযোগ!

ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে এখানে বলি – আমার নিজের লেখালেখির সূত্রপাতও বলতে গেলে ঐ – আপন প্রয়োজনে চিঠি লেখার মাধ্যমে। প্রবাসী-জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে – মন-খারাপের তাগিদে আর নিঃসঙ্গতার প্রতিকারে, ফেলে-আসা প্রিয়জনেদের সঙ্গে সে-যুগের সেই বিস্মৃতপ্রায় ফিকে-নীল এয়ার-লেটারের মাধ্যমে চিঠির আদান-প্রদান ছিল ব্যথার প্রলেপের মত একান্ত প্রয়োজনীয়। সেই পত্র-দূতের কল্যাণেই একদিন বিশেষ-একজনের সঙ্গে পত্রালাপ সময়ের তালে তালে স্বল্প-পরিচয়ের অন্তরাল থেকে পৌঁছে গিয়েছিল পরম-চেনার অন্দরমহলে – মন-জানাজানি থেকে মন দেওয়া-নেওয়া পেরিয়ে ভালো-লাগা পরিণত হয়েছিল ভালবাসায় – প্রণয় থেকে পরিণয়ে। তিনিই আজ আমার সেই ‘গৃহিণী-সচিব-সখী-ললিতকলাবিধৌ’! ব্যক্তিগত সে-গল্প এখন এখানে অপ্রাসঙ্গিক লাগবে – আমার জীবনে পত্র-লেখার গুরুত্ব বোঝাতেই আপাতত এর অবতারণা।

 

বিশ্বের পত্রসাহিত্য

এক নবীন কবিকে লেখা প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান কবি রিলকের দশটি মাত্র চিঠির সঙ্কলন নিয়ে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত বই – ‘Letters to a Young Poet’ – বিশ্বের পত্রসাহিত্যে স্মরণীয় স্থান অধিকার ক’রে আছে। রিলকের মৃত্যুর তিন বছর বাদে চিঠিগুলির প্রাপক ফ্রান্জ্ কাপ্পাস্ বইটি প্রকাশ করেন। বইটির ইংরেজি অনুবাদ আমি পড়েছি। ফ্রান্জ্ তার নিজের লেখা কবিতা-সম্পর্কে সাহায্য ও উপদেশ চেয়েছেন রিলকের কাছে। তার উত্তরে, প্রথম চিঠিটিতে রিলকে ১৯০৩ সালে তাকে লিখেছেন – “তোমাকে অন্য কেউ সাহায্য করতে কিংবা উপদেশ দিতে পারবে না – কেউ না। তার একমাত্র উপায় – আপন অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে হবে তোমাকেই।” ঐ চিঠিতে রিলকে আরো বলেছেন – “প্রকৃত শিল্পকর্মকে কখনও কোনো সমালোচনা স্পর্শ করতে পারে না। অন্যের মতামত সর্বদা এড়িয়ে চলবে।”  

প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান কবি রিলকে

ফ্রান্জ্ -এর কবিতা পড়ে পরের একটি চিঠিতে রিলকে লিখছেন – “কবিতার লাইনগুলো তুমি নিজে একবার পড়ে দেখো, এমনভাবে যেন ওরা তোমার অজানা; তখন তুমি আপন অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করবে – ওরা কী ভীষণভাবে তোমার নিজের, একমাত্র তোমারই – আর কারো নয়।” (উক্তি ক’টি ইংরেজি বইটি থেকে – আমার করা বঙ্গানুবাদ।) ঐ দশটিমাত্র চিঠির স্বল্প-পরিসরে রিলকে বুঝিয়েছেন –  প্রকৃত কবি শিল্পজগতে ব্যাপৃত থেকে এই পৃথিবীকে চেনার অবকাশে, তার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার মধ্যে দিয়ে – কীভাবে তা মনে-মনে  উপলব্ধি করবে, তাকে ভালবাসবে, এবং তার মধ্যে সত্যের সন্ধান করবে। এ-শিক্ষা প্রকৃত অর্থেই অমূল্য! বিভিন্ন পশ্চিমী মাপকাঠিতে আর যাঁদের লেখা চিঠি বিশ্বের পত্রসাহিত্যে অগ্রগণ্য, তাঁদের মধ্যে আছেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক সল্ বেলো, ফ্রানজ্ কাফকা, অস্কার ওয়াইল্ড, কার্ট ভনেগার্ট, জর্জ অরওয়েল, অ্যান সেক্সটন, ফ্ল্যানারি ও’কনর, পি.জি. ওডহাউস প্রভৃতি ধুরন্ধর সাহিত্য-শিল্পী এবং জন কিটস, এমিলি ডিকিনসনের মতন ডাকসাইটে কবিরা। স্বভাবতই, এতগুলি স্বনামধন্য মনীষার বোধের সমন্বয়ে লেখা চিঠিগুলির ব্যাপ্তি মানুষের মননের সারা আকাশ জুড়ে – আমাদের মনের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত যত ভাব-ভাবনা, সাবলাইম থেকে রিডিকুলাস্ – বর্ণালীর সব রংই প্রতিভাত হয়েছে সেখানে। যেমন, সল্ বেলো-র বই ‘লেটার্স’-এর মলাটে তাঁর লেখা চিঠিগুলি বর্ণনার প্রয়াসে, একটি ক্রিয়া-বিশেষণের পরে অন্তত ছ’টি বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে – “Saul Bellow wrote marvelously acute, unsparing, tender, ferocious, hilarious, and wise letters throughout his long life (1915-2005).”! সমস্ত সঙ্কলনটি বর্ণিত হয়েছে এই ব’লে – “… a vast self-portrait – indeed, the autobiography Bellows never wrote …”. সত্যি-সত্যিই – জীবনব্যাপী রচিত চিঠিদের আধারে একটি সমগ্র আত্মজীবনী লুকিয়ে থাকতে পারে বৈকি – তাকে খুঁজে পেতে লাগে প্রত্যয়ী পাঠকের নিজস্ব মনন – জহরের খোঁজে জহুরীর চোখ!

বিচক্ষণ পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন, আগের আলোচনায় আমি সজ্ঞানেই উল্লেখ করেছি ‘পশ্চিমী মাপকাঠি’-র। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা – পশ্চিম- দুনিয়ার অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে, পূর্ব-গোলার্ধের মনীষীদের অবদান-সম্পর্কে এদেশ এখনও সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল নয়। এই নিতান্ত একদেশদর্শিতার প্রতিকার অবশ্য অসম্ভব কিছু নয় – শুধু মেনে নিতে হবে, সে-কাজটা দুই গোলার্ধ-সম্পর্কে সাধারণ ধারণা-সম্পন্ন এই আমাদেরই। বিশ্বের পত্রসাহিত্যে অবদান যদি প্রকৃতই বিশ্বজনীন মাপকাঠিতে নির্ণীত হয়, তাহলে সাহিত্যিক উৎকর্ষে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। আমার এ-লেখায় তুলনামূলক বিচারের যোগ্য পরিসর নেই – তাই ওঁর লেখা একটিমাত্র চিঠির দৃষ্টান্ত দিয়ে এখানেই যবনিকা টানি এ-প্রসঙ্গের –

 “…ঐ যে মস্ত  পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালবাসি – ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা-দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশংকা-ভরা অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আদরের ধন কোথা থেকে দিত! আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই-সমস্ত দরিদ্র মর্ত্য-হৃদয়ের ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে। আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে – যেন এর মনে মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে। জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে। এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি – এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সর্বদা চিন্তাকাতর বলেই। …”   

চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে, কালীগ্রাম থেকে – ১৮৯১ সালে। ভাবের ঐশ্বর্যে ভাষার কারুকার্যে এ-চিঠির অনবদ্য সৌন্দর্য এক-কথায় তুলনাহীন।

চিঠির উৎকর্ষের জন্যে প্রাপকের আছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সে-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই একটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি, একান্ত প্রাসঙ্গিক ও শিক্ষণীয় বলেই। ‘ছিন্নপত্রাবলী’-র ভূমিকায়, ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে উনি বলেছেন – “তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি। তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনো কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি। … তোর এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে, এমন একটি সহজ সত্যপ্রিয়তা আছে যে, সত্য আপনি তোর কাছে অতি সহজেই প্রকাশ হয়। সে তোর নিজের গুণে। যদি কোনো লেখকের সব চেয়ে ভালো লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে। আমি তো আরও অনেক লোককে চিঠি লিখেছি, কিন্তু কেউ আমার সমস্ত লেখাটা আকর্ষণ করে নিতে পারে নি। …”

আমার ব্যক্তিগত ধারণায়, এই কথাগুলির অন্তরালে যে দুটি সত্য লুকিয়ে আছে, তা হচ্ছে – ১) আন্তরিক অভিব্যক্তি-প্রকাশের নিরিখে চিঠি কোনো লেখকের সর্বোৎকৃষ্ট লেখা হতে পারে; আর ২) অন্তত রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রে, এ-কথাটা ধ্রুবসত্য।

প্রাচ্যদেশীয় অন্য যে পত্রগুচ্ছ পুস্তকাকারে প্রকাশিত এবং বিশ্বের পত্রসাহিত্যের জগতে স্থান পাবার যোগ্য – সেটি ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত নেহরুর লেখা, তাঁর দশ বছরের কন্যা ইন্দিরাকে – বইটির নাম “Letters from a Father to His Daughter”. যদ্দূর জানি, চিঠিগুলি ১৯২৮ সালে লেখা – ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-লাভের অনেক আগে – মোট মাত্র ত্রিশটি চিঠির সঙ্কলন নিয়ে বইটি প্রকাশিত। ঐটুকু মেয়েকে লেখা হলেও চিঠিগুলির বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি বিস্ময়কর – জীবন, প্রকৃতি, পৃথিবী – সমাজ-সংসার, দর্শন-বিজ্ঞান, ভূগোল-ইতিহাস, নীতিবোধ, সৌন্দর্যবোধ – কী নেই তাতে? আপন শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, আর জীবন-দর্শন নিঃশেষে ঢেলে দিয়েছেন তিনি চিঠিগুলিতে, কিছুমাত্র কার্পণ্য না ক’রে। সবার ওপরে পিতৃহৃদয়ের অপর্যাপ্ত স্নেহ-মাখা এই চিঠিগুলি ছোট-বড় সকলের কাছেই একান্ত শিক্ষণীয়। ইংরেজিতে লেখা হওয়ায় বইটি শুধু ভারতে নয় – বৃহত্তর বিশ্বেও আদরণীয়, সমগ্র বিশ্বের সম্পদ। পত্রসাহিত্যের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে ক্লাসিকের পর্যায়ে পড়ে।

ভাষা-প্রসঙ্গে মনে আসছে একটা কথা। কথিত আছে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র একবার ইংরেজিতে কোন একটি চিঠি পেয়ে সেটি না খুলেই নাকি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে পত্রলেখককে তিনি জানান – নিজে বাঙালী হয়ে আর একজন বাঙালীর থেকে তিনি বাংলা চিঠি আশা করেন। ‘বন্দে মাতরম্’ রচয়িতার কাছে আমরাও নিশ্চয় সেইরকমই আশা করব, স্বাদেশিকতা তথা মাতৃভাষাপ্রেমের সার্থক নিদর্শন-রূপে। তবে অন্যভাষাভাষীদের লেখা বুঝতে অনুবাদের দ্বারস্থ হতে হয় সকলকেই – অন্যথা নেই তার – শুধু বহির্বিশ্বেই নয়, এমনকী আমাদের এই ‘নানা ভাষা নানা মত’-এর দেশেও! অক্ষরপরিচয়ের অভাবে প্রিয়জনের চিঠি ‘পড়িয়ে নিতে’ যেমন তৃতীয়-ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হয়, সেই-কারণেই প্রাচ্য-জগতের অন্য ভাষায় সীমিত জ্ঞানের ফলে – ভালো অনুবাদের অভাবে, প্রাচ্যের অন্য দেশের পত্রসম্পদ-সম্পর্কে আপন-অজ্ঞতাও সকাতরে কবুল করে যেতে হয় এখানে।

অথ-অনুবাদ-কথা

চিঠির প্রসঙ্গের শেষে অনুবাদের কথা যখন উঠলই, তখন এই-ফাঁকে লিখে যাই ব্যক্তিগত দু-চার কথা। এ-লেখাটা ঠিক কী যে হয়ে দাঁড়াচ্ছে জানিনা – তবে মাঝে মাঝে যেমন স্মৃতিচারণ তথা ‘মেমোয়ার’-এর দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন এতে যে ‘আমি-আমি’ গন্ধ থাকবে, সে আর আশ্চর্য কি! তার জন্যে সাড়ম্বরে ক্ষমা চাওয়াটা কৃত্রিম ভদ্রতা হয়ে দাঁড়াবে – সেটা আমার বিলকুল না-পসন্দ! আসলে অনুবাদ-ব্যাপারটা আমার কাছে খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এই বড়বেলায় – লেখালেখির এক অবিচ্ছিন্ন অঙ্গস্বরূপ। তার কারণটা বলি তাহলে।
অনুবাদের সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা ঘুরে-ফিরে আবারও সেই রবীন্দ্রনাথ – সেই যে কথায় বলে, ‘কানু ছাড়া গীত নেই’! নিঃস্বের পরমধনের মত কোথায় যে রাখি তারে, আমার ভেতরে মনের তারে তারে সদাই বেজে চলে তার ঝঙ্কার আর অনুরণন। পরমধন-স্বরূপ সেই কমল-হীরে অন্তরে-বাহিরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যতই দেখি – ততই তার আলোর বিচ্ছুরণ আমায় মুগ্ধ করে। তার মাঝখানে কখন-যে এক স্থির প্রতীতি মনকে অধিকার করে নিয়েছিল আমি জানিনা – যে এ-সম্পদ আমার বা বাঙালীর একার নয় – বিশ্বকবির এই অনবদ্য সৃষ্টির ডালি ভাগ করে নিতে হবে বিশ্ব-সাথে। দেখলাম, সাধ্যের কথা না ভেবে মন সাড়া দিল সানন্দে। অনুবাদই সে-কাজের একমাত্র মাধ্যম। বাংলা থেকে ভাষান্তরে ইংরেজির দাবী মানতেই হল আমাকে, প্রধানতঃ দুটি কারণে – ইংরেজি ভাষা বিশ্ব-মাঝে সর্বজনস্বীকৃত না হলেও বেশ কিছু মানুষের আয়ত্তে, আর দ্বিতীয়ত সাধ্যের কথাটা ভাবতে বসে মনে হল, ভাষাটা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার চেয়ে আমার একটু বেশী জানা, তাই এ-ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প নেই। কাজটাকে দায়িত্ব ব’লে মেনে নিয়ে কোনো একদিন লেগে পড়েছিলাম একমনে – এখন সেটা দাঁড়িয়েছে প্যাশন থেকে মিশনে।
রবীন্দ্রনাথের গান আমার সবচেয়ে প্রিয় – তাই দিয়েই আমার অনুবাদে হাতেখড়ি। সে আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। এখনো মনে আছে, সেটি ছিল – ‘জানি গো দিন যাবে এ’দিন যাবে’। প্রথম থেকে একটা ধারণা আমায় পেয়ে বসেছিল – অনুবাদের ইংরেজি লাইনগুলোও মিলনান্তক হতে হবে, বিশেষত কবিগুরু নিজে যদি বাংলা গানে তাই-ই ক’রে থাকেন – যেমন প্রথম পংক্তিশেষে ‘যাবে’-র সঙ্গে দ্বিতীয় পংক্তিশেষে ‘চাবে’। মনে হয়েছে, অনুবাদক-হিসেবে সেটা আমার তর্কাতীত দায়িত্ব। কবির প্রতি শ্রদ্ধা বা কাব্যের আনুগত্যের কারণেই শুধু নয়, কবিতা বা গানগুলির কাব্যগুণ বজায় রেখে ইংরেজি অনুবাদগুলির নিজস্ব উৎকর্ষ বা মান বাড়াতেও বটে – যাতে তারা অদূর ভবিষ্যতে কখনো না কখনো, সঠিক-হাতে প’ড়ে সুরের সংযোগে নিজেরাই গান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের গানের ইংরেজি অনুবাদ আরও অনেকের আছে – মনে হয় তাঁরা সবাই এভাবে ভাবেন নি। আমি মনে ভাবি, রবিঠাকুরের অনবদ্য ভাব বুকে নিয়ে ইংরেজি ভাষায় সুরহারা কবিতা-রূপে, এরা এখন ডানা-ভাঙা পাখীর মতন। কবে এরা সুরের ছোঁয়া পেয়ে ডানা মেলে দেবে মুক্তির আকাশে – আনন্দ দেবে শ্রোতাদের – হয়ত তা আমি একদিন দেখে যেতে পারবো – আপাতত আমি রইলাম সেই অজানার আশায়।

গান ছাড়াও আমি ওঁর কবিতা, চিঠিপত্র, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি অনুবাদ করেছি, ও এখনও করে চলেছি – বাংলাভাষা আর সাহিত্যের এ’সব মণিমুক্তো অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে। এমনকি আমাদের ছেলেমেয়েদের আর তাদেরও পরবর্তী প্রজন্মের – যারা বাংলার পরিবেশ, সংস্কৃতি বা চর্চা থেকে নানা কারণে ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে – তাদের হাতে তুলে দিতে, জানিয়ে যেতে এ-সংবাদ – যে পৃথিবী রেখে যাচ্ছি ওদের হাতে আমাদের এই-প্রজন্মের অজস্র ভুলে-ভরা কাজের ফলশ্রুতি-হিসেবে – সেই আগামী পৃথিবীতে এইসব অমূল্য সম্পদেও ওদের আছে ন্যায্য উত্তরাধিকার।
বিশ্ব-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করেছি – অনুবাদের মাধ্যমে ভিনদেশী সেইসব মণি-মুক্তোও বাঙালী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। এ যেন ঐ একই পথ ধরে সজ্ঞানে উল্টোমুখে হাঁটা। আর পাথেয় তো সেই একই – ইংরেজি আর বাংলা দুটোতেই অল্পবিস্তর জ্ঞানের সম্বল। অন্য কোনো ভাষায় অজ্ঞতার দরুন, সে-সব ভাষার মণি-মুক্তো শেয়ার করতে গেলে অবধারিত-ভাবে আমার প্রয়োজন হয় ইংরেজির দৌত্য বা মধ্যস্থতা – তাতে মানের ব্যাপারে হতে হয় কিছুটা পরমুখাপেক্ষী – হয়ত দুধের স্বাদ মেটাতে হয় ঘোলে! আমি নিরুপায়, শুধু মনে হয় – যথা লাভ। যাহোক, দু-নৌকোয় পা-দেওয়া আমার এই এখনকার অস্তিত্বে এটাও মনে এসেছে – সংস্কৃতি-বিনিময়ে ‘বেস্ট অব্ বোথ ওয়ার্ল্ড’-এর স্বাদ সবাই মিলে উপভোগ করতে গেলে, আমার সাধ্যের মধ্যে যেটুকু করণীয়, ক’রে যাবো তাই – তাতে লাভ ছাড়া লোকসান নেই, কারো জন্যেই। তারই প্রেরণায়, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি টলস্টয়, চেখফ্, মোপাসাঁ, ও’হেনরি, মিল্টন, নেরুদা, সাবিনেস্, ঈডুয়ো, আরসু, বোদলেয়ার্,স্ট্রোড্, বাশো, সাফো (যথাক্রমে রাশিয়ান, রাশিয়ান, ফরাসী, ইংরেজি, ইংরেজি, চিলিয়ান, স্প্যানিশ, চীনা, রুমানিয়ান,ফরাসী, ইংরেজি, জাপানী, জাপানী) ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় দিকপাল লেখকদের লেখা যখন যা পেয়েছি অনুবাদ করেছি বাংলায়, এবং যেখানে পেরেছি যথাসম্ভব প্রকাশের প্রয়াস করেছি – গল্প ও কবিতা দুই-ই – সবই অবশ্য প্রয়োজনমত সেই চেনা ইংরেজি-মাধ্যমের সাহায্য অবলম্বনে।

অনুবাদ-সাহিত্য সম্বন্ধে লিখতে বসে শ্রদ্ধেয় শ্রীমুজতবা আলী মন্তব্য করেছেন –

“অনুবাদ-চর্চা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশি সময় নষ্ট করেননি বলেই বোধ করি বাঙলা সাহিত্য অনুবাদের দিক দিয়ে এত হীন। … বাঙলা সাহিত্যের মত অদ্ভুত এবং বেতালা সাহিত্য পৃথিবীতে কমই আছে। গীতিকাব্যে যেন সে পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে বিশ্ব-ব্রম্ভাণ্ডময় ঘুরে বেড়ায়, আর অনুবাদ-সাহিত্যের বেলা সে যেন এঁদো কুয়োর ভেতরে খাবি খায়।”

সৈয়দ মুজতবা আলী

নির্দয় উপমা, সন্দেহ নেই, এবং নিশ্চয় সঠিক – বিংশ-শতকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। ঊনবিংশ-শতকের শেষ থেকে বিংশ-শতকের শুরু পর্যন্ত শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতুলনীয় অনুবাদ-কর্মের ভূয়সী প্রশংসা করার পরে, পরবর্তী-যুগের অনুবাদ-কর্মের অপকর্ষ লক্ষ্য করেই তাঁর এই খেদোক্তি, যা একান্ত প্রণিধানযোগ্য। তার কারণটা হয়ত এখানে অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

অনুবাদ-সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলায় – পড়তে শেখার পরের কয়েক বছরেই – কথাটার সংজ্ঞা-সম্বন্ধে তখনো আমি সংজ্ঞাহীন! ততদিনে আমার পড়া হয়ে গেছে বিদ্যেসাগর-মশায়ের ‘কথামালা’ – শিশুমনে দাগ কেটেছে তারা গল্প-হিসেবে। প্রতিটি গল্পের শেষে উপদেশগুলোর কথাও মনে পড়ে – জানতাম না তখনো যে তারা ইংরেজি ‘ঈশপস্ ফেবলস্’ থেকে নেওয়া; নিজের অজান্তে, তারাই ছিল আমার অনুবাদ-সাহিত্যে হাতেখড়ি! তারপরে, কিশোর-মনের সঙ্গে একে একে পরিচয় হল নৃপেন্দ্রনাথ-সৌরীন্দ্রমোহন-কামাক্ষীপ্রসাদ প্রমুখ বাংলার প্রথম-সারির যত অনুবাদক তথা লেখকদের অনূদিত বিদেশী-সাহিত্যের যত ঝলমলে বর্ণোজ্জ্বল মণি-মুক্তোর। তাদের অনুপম সৌকর্যে ভরে উঠল মন, চোখের সামনে যেন খুলে গেল একের পর এক জানলা – সে এক অপরূপ অনুভূতি! ছোটদের মন বুঝে তখন তাঁরা করেছেন ক্লাসিক গল্পগুলির সার্থক ভাবানুবাদ, আক্ষরিক অনুবাদ নয়। ছোটবেলায় সেখান থেকে আহরণ করেছি শুধুই গল্পরসের মধুর আস্বাদ – তাতেই মজেছে মন। সে-মন প্রশ্ন তোলেনি কোনো, আনেনি কোনো অভিযোগ – বিদেশী স্থান-কাল-পাত্র আপন হয়ে উঠেছে পঠন-পাঠনের অবসরে, ক্যালেন্ডারের ছবিতে দেখা সুইৎজারল্যানডের দৃশ্য যেমন ভালো লেগেছিল স্বতঃই সেদিন, ঠিক তেমনিই!
ছোটবেলার সেই উদার মন আর নেই – যখন চর্মচক্ষে আর মর্মচক্ষে দেখার পার্থক্য ছিল না কোনো। বড় হয়ে ওঠার পর, মন আর মোহিত হয়না নিছক গল্প-রসাস্বাদনে – ছুটে বেরোয় সে গল্পের উৎস-সন্ধানে। অনুবাদের কদর এখন কমল যে কীসে তা কে জানে – বিদেশী-গল্পের ঘ্রাণ কি সয় না আর তার প্রাণে? মানুষের ইতিহাসে এটা তো সর্বজনবিদিত, যে অনুবাদ-গল্প মৌলিক বা indigenous গল্প নয় – বাণিজ্য-যাত্রার পথ ধ’রে বয়ে-আনা দূরদেশী রূপ-রসের সদাগরি পণ্য – অচিনঘরের মিতা যখন আমাদের দুয়ারে এসে ডাক দেয় নতুন চেনা-সাজে। তাই কি তার জাত গেল পাঠকের বিচারে, বৃথা হল যত কাজ, সাহিত্য-জগতে অনাদৃতই রয়ে গেল সে? তাহলে বলব – সাহিত্য-মানের ন্যায়সঙ্গত বিচার তা নয় মোটেই ! পাঠকের নিরর্থক bias-ই তবে তার জন্যে দায়ী – সে-দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে হবে আমাদের সকলকে। সৎ অনুবাদকের উদ্দেশ্য নিছক খ্যাতি কুড়নো নয় – বিশ্বজোড়া রসের আয়োজনে যোগ দিয়ে, উপযুক্ত উপাদান সন্ধান, আহরণ, ও পরিবেশন। সে-দায়িত্ব মেনে নিয়ে নিষ্ঠা, কল্পনা, আর ভাষাজ্ঞান সম্বল ক’রে এগিয়ে আসতে চাইবেন যাঁরা, চর্চা আর সময়ের সঙ্গে চেষ্টার সার্থক মিশেলে তাঁরা হতে পারবেন শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরী, ঘোচাতে পারবেন বাঙলা সাহিত্যের এই ‘বেতালা’ অপবাদ। তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে, আন্তরিক সহমর্মিতা জানিয়ে বলছি, আজকে এই বিশ্বায়নের যুগে সেই তো প্রকৃত সাংস্কৃতিক-বিনিময় – অন্তরে অন্তরে সার্থক বিশ্বজনীনতা, মুক্তমনের সত্য প্রকাশ। তাই, এ’কথা আমি বলব জোর-গলায় – আজকের এই দিনে-দিনে ছোট-হয়ে-আসা পৃথিবীর ভূগোলের বেড়া ভাঙতে যুদ্ধবাজি নয়, চাই পরকে আপন করে নিতে শিশুর সরল উদারতা। সাময়িক উত্তেজনার ফল-স্বরূপ পরকীয়ার রোমাঞ্চ নয়, এর মধ্যে আছে অন্তরঙ্গ পত্র-বন্ধুত্বের মধুর মিতালী। টক আমের আচার না আমসত্ত্ব – কোনটা যে বেশী ভালো, তাই নিয়ে তর্ক চলুক না কেন ভোজন-রসিক মহলে – ততক্ষণ আসুন, মর্মে মর্মে উপভোগ করি – আমাদের এই ‘আমরি বাংলা-ভাষায়’ জারিয়ে-নেওয়া, আর নাগালের-মধ্যে হাতে-পাওয়া বিদেশী মণিমুক্তোগুলো – তা পরম সৌভাগ্য মেনে!

আলী-সাহেবের মন্তব্যটিকে কেন্দ্র করে কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা পেশ করতে চাই এখানে। প্রথমত, অনুবাদ যে রবীন্দ্রনাথ একেবারে করেননি, তা তো নয়; হ্যাঁ, আমরা সকলেই জানি তা সীমিত। তবে, কিমাশ্চর্যম – বলতে গেলে তাঁর আখেরী অনুবাদ-কবিতাগুলি ‘গীতাঞ্জলি’-রূপে প্রকাশিত এবং নোবেল-পুরস্কারে বিভূষিত! বাঙালী হয়ে জন্মে সেটা অন্তত ভুলি কীকরে? ভাগ্যিস, জাহাজে চড়ে বিলেত যাবার পথে অতিক্রান্ত সময়টির তিনি সদ্ব্যবহার করেছিলেন – না, কিছুতেই বলা যাবে না যে সময়টা উনি ‘নষ্ট’ করেছিলেন! দ্বিতীয়ত, ‘পঞ্চতন্ত্র’ বইটি থেকেই সালতারিখ ঘেঁটে যা মালুম হল, লেখাটি ১৯৫০-এর কাছাকাছি লেখা – বই হয়ে প্রকাশের আগে রবিবারের ‘বসুমতী’, নয় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় হয়েছিল প্রথম আবির্ভাব (তথাকথিত জার্নালের বেশে বোধহয় ‘সুনন্দ-র জার্নাল’-এর পূর্বসূরি এরা!)। পূর্বে উল্লেখিত আমার ছোটবেলায়-পড়া ঐ বিদেশী ক্লাসিকের বাংলা অনুবাদগুলির প্রকাশ-কাল আমার অজানা – অনুমান করা যায় ওরই সমসাময়িক। তবে এটুকু হলফ করে বলতে পারি – ও-সব বই পড়বার বয়েস তখনো আমার হয়নি, আমি পড়েছি তার প্রায় দশ বছর পরে। তাই কালের হিসেবে হয়ত সেই বইগুলি আলী-সাহেবের নজরে পড়েনি – অথবা তাদের গুরুত্ব রেখাপাত করেনি ওঁর মনে – যতখানি করেছিল পরবর্তী কালে আমার মত আরও অনেক শিশু-মনে। তাছাড়া, ওঁর এই লেখাটির প্রেক্ষিত ছিল অন্য – মূল ফরাসী থেকে শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাংলা অনুবাদটির মূল্যায়ন – ও তার উৎকর্ষের legacy রক্ষায় পরবর্তী অনুবাদকদের অক্ষমতা-প্রসঙ্গে তাঁর এ-আক্ষেপোক্তি। প্রসঙ্গত, পঞ্চতন্ত্র-বইটির দ্বিতীয় পর্বে ‘অনুবাদ সাহিত্য’ নিয়ে আর একটি লেখায় পূর্বোক্ত মন্তব্যটির কিঞ্চিত সংশোধন এবং সম্প্রসারণ করেছেন তিনি – সেখানে পরবর্তী কালের অনুবাদকদের সম্পর্কে আশার বাণী দিয়েছেন। কৌতূহলী পাঠক সেটি পড়ে নিতে পারেন – আমার বাগাড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন, পুনরুক্তির দায় বাঁচে!

এ-প্রসঙ্গে আমার শেষ কথা হল – সেই কবে, স্মরণকালের প্রায় সূচনা থেকেই বাঙলা-সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে’ টলমলে পায়ে ‘হাঁটি হাঁটি পা-পা’ করে’ এগিয়েছে তার পথে। তার পাশাপাশি জোড়াসাঁকোর ঐ ঠাকুর-বাড়ী থেকে প্রায় শতাব্দী-কাল জুড়ে বেরিয়েছে এক অভূতপূর্ব প্রতিভার মিছিল – যার বিদ্যুচ্চমক ক্ষণে ক্ষণে আলো হয়ে দেখা দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে তাকে। দিন আগত ঐ – যখন সেই অসামান্য legacy-র মান রাখতে, সেই সৌভাগ্যকে মূলধন করে’ – প্রতিভার বিকল্পে প্রেরণা আর অধ্যবসায় সম্বল করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, পূর্বসূরিদের শক্ত হাতের আশ্রয় ছেড়ে, স্বনির্ভর সাবালকত্বের পথে – নান্য পন্থাঃ!

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর জ্যোতিদাদা

সাহিত্য-চিন্তা
দেশ-বিদেশ জুড়ে ছড়িয়ে-থাকা সাহিত্যের এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর নব-রসের সব ক’টির চর্চা বা অনুশীলনের জন্যই প্রশস্ত, তাতে সন্দেহ নেই। তাই বলে পাঠকদের হাতের সামনে তাদের সব্বার দেখা যে মিলবেই, তার কোনো স্থিরতা নেই – সেটা নির্ভর করছে লেখকদের মর্জির ওপর। অবশ্য চোখ-কান খোলা রাখলে সাহিত্য-বিপণীতে দেখাশোনা হয়ে যেতে পারে সব ক’টির সঙ্গেই – ‘বুঝ মন যে জান সন্ধান’ – সেখানে তো আছে পাঠকের পূর্ণ স্বাধীনতা – ‘আপরুচি খানা’। আশাবাদী মন বলে – ‘অসীম সময় আছে, বসুধা বিপুল’ – অতএব, মা ভৈঃ!
লেখালেখির ক্ষেত্রে গদ্য-পদ্যের বাছ-বিচার পেরিয়ে এলে, শুধু গদ্যের তথাকথিত জাতবিচারে লেখার শ্রেণী-বিভাগ করা আছে – যেমন, গল্প-উপন্যাস (বা fiction), প্রবন্ধ-নিবন্ধ (বা non-fiction), ও আত্মকথা-জীবনী (বা memoir, biography, etc.)। গল্প আবার পরিসর-অনুযায়ী ছোট-বড় বলে চিহ্নিত হয়, আজকাল তার সঙ্গে মিলেছে অনু-গল্প – লুচির পাশে ফুচকা-হেন nano-sizeএর। এটা হয়েছে কালের সঙ্গে তাল রেখে, যে-কালের পাঠক-কুলের হাতে সময় এক দুর্লভ সামগ্রী – অ্যালিস্ ইন্ ওয়ান্ডারল্যান্ডের সেই খরগোশটার মত ‘I am late, I am late’ বলতে-বলতে সর্বদা ছুটতে হচ্ছে যাদের ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়িমরি। সাহিত্য পাঠের অবকাশে ছোটগল্প আমার সবচেয়ে প্রিয় – তার বিস্তারিত কারণ-বিশ্লেষণে যাবো না এখানে। তাছাড়া, নিছক ‘ভালো-লাগার’ কারণের খোঁজে যাওয়া বৃথা – তার তো কোনো ব্যাখ্যা চলে না। তবে সেই ভালো-লাগার প্রেরণায়, মহাজনদের দেখানো পথ অনুসরণ ক’রে, আর কিছুমাত্র না জেনে নিজে ছোটগল্প লেখায় প্রবৃত্ত হয়েছি কখনো। ঐ-যে কথায় ব’লে – ‘দেবদূতরা যেখানে যেতে ভয় পায়, নির্বোধ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেখানেই’ – আমারও হয়েছে সেই দশা। মিউজ্ তথা জীবনদেবতার দেখা মেলেনি এখনও – কিংবা হয়ত চিনতে পারিনি – যা হয়েছে তা হয়ত কিছুটা ঠেকে শেখা। অন্য কোনোরকমের শেখায় আবার আমার একান্ত অনীহা – না আছে আগ্রহ, না বিন্দুমাত্র স্পৃহা, না সময়। আমি শুধু মজেছি ঐ ভালো-লাগার মজায়!
বাংলা ও বিদেশী ছোট-গল্প এতাবৎ যা পড়েছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলি – আমি বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে বাংলা গল্পের মান বেশ উঁচুতে – তার জন্যে করি গর্ববোধ। তুলনামূলক সাহিত্য-আলোচনা আমার সাজে না – এ’লেখায় নেই তার সুযোগও; তবে শৈলীর দিক থেকে আর ঐ ভালো-লাগার নিরিখে, আমার মনে হয় বাংলা গল্প সহজবোধ্যতার গুণে হৃদয় স্পর্শ করে যত নিশ্চিত লক্ষ্যে, বিদেশী গল্প সবসময়ে তেমন ক’রে নয় – সেটার জন্যে হয়ত দায়ী এখনো আমার এই নির্ভেজাল বাঙালী মনন আর সেইসূত্রে কিছুটা সহমর্মিতা। বিদেশী গল্পের রসগ্রহণে আমার কখনো-সখনো বোধের অভাব ঘটে, যার তুলনা আমি পাই ভাষা-নির্বিশেষে আধুনিক কবিতায় – কিন্তু বাংলা-গল্পে কখনো নয়, সেই তার এক মস্ত গুণ!

বাঙলা-সাহিত্যে আরো অনেক কিছুর মতই ছোটগল্পের সূচনাও তো রবীন্দ্রনাথের হাতে – এবং শুধু সূচনাই নয়, তাঁর যাদু-কলমের দৌলতে চরম উৎকর্ষ-সাধনও করে গেছেন তিনিই। প্রিয় কথা-সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় পাই তার অপূর্ব বিশ্লেষণ – “রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের যে-কোনো কথাসাহিত্যের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে। … রবীন্দ্রনাথের গল্প মোপাসাঁ চেখফ্ দুজনের গল্পকেই হার মানায় তার গীতিরস দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্পটি কেমন যেন সঙ্গীতের কোনো এক রাগে বাঁধা।… রবীন্দ্রনাথ শেষের দিকের গল্পগুলিতে কী যেন এক অনির্বচনীয়ের প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মানব-চরিত্রের আলো-অন্ধকারের আবছায়া আঁকুবাঁকু, মানব-চরিত্রের যে-দিক দৈনন্দিন জীবনে আমাদের চোখে পড়ে না, মানুষকে যে সবসময় তার বাক্য আর আচরণ দিয়েই চেনা যায় না, মানুষের সেই দুর্জ্ঞেয় অন্তঃস্থল রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন আধা-আলোরই ভাষা এবং ভঙ্গী দিয়ে প্রকাশ করতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ একা, মোপাসাঁ চেখফের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র সেখানে সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।”
বিষয়-বৈচিত্র্যে এবং ব্যাপ্তিতে প্রবন্ধের আঙিনাটি বিশাল। লেখা-ব্যাপারটিকে যদি আমরা বাস্তব ও কল্পনার বিচিত্র ও অনন্ত-সম্ভাবনাময় এক অপূর্ব মিশেল ব’লে ভেবে দেখি – তাহলে অনুভব করতে পারি যে প্রবন্ধে কল্পনার ঠাঁই নেই, সেখানে বাস্তবেরই একাধিপত্য। যুক্তি-তর্কের ক্ষুরধার তরবারি-চালানোর কুরুক্ষেত্র-মাঝে গল্পের দেখা নেই কোথাও, যেন কোনমতে প্রক্সি জোগাড় করে পালিয়ে বেঁচেছে সে। ন্যায়-, তর্ক-, ইত্যাদি গুরুগম্ভীর শাস্ত্র ও শস্ত্রের অবাধ প্রতিপত্তি প্রবন্ধের প্রান্তরে। তাই প্রবন্ধের ভাব ও ভাষা স্বতঃই জ্ঞানগর্ভ এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সাহিত্যজগতে তার স্থান নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত। তবে তার মধ্যে জ্ঞানবুদ্ধির সন্ধান পাঠকের কাছে যতটা সম্ভব, রসের সন্ধান ততটা নয় – সেক্ষেত্রে তাকে যেতে হবে নিবন্ধের কাছে। এটা আমার নিজস্ব ধারণা, নিবন্ধ হল প্রবন্ধের নাবালক অনুজ – প্রবন্ধকে কিছুটা হাল্কা করে’ একই বা অনুরূপ কাঠামোয় লঘুরস পরিবেশন-মানসেই সাহিত্য-গগনে নিবন্ধের উদয়। কাজটা খুব সহজ নয় – উপযুক্ত অনুশীলন ও প্রস্তুতির প্রয়োজন।
গল্প আর প্রবন্ধের মাঝে আর আছে রম্যরচনা ও ভ্রমণ-কাহিনি – নামের মাঝেই তারা নিজগুণে স্ব-প্রকাশ। রম্যরচনা রচিত হবে সুরম্য ভাষার সঙ্গে চিত্তাকর্ষক ভাবের সুন্দর সমাহারে লঘুছন্দে সহজিয়া রসের পরিবেশন-কল্পে। বাংলা-সাহিত্যে রম্যরচনা প্রাণ পেয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলী-র হাতে; তবে পেছন ফিরে তাকালে বঙ্কিমের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, আর কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম-প্যাঁচার নক্সা’ তার পূর্বসূরি বলা যায় কি না – সে-ব্যাপারে রায় দেবেন বিদ্বজ্জন। তবে মুজতবার সঙ্গী-হিসেবে যাযাবর, আর উত্তরসূরী-হিসেবে যে রঞ্জন, রূপদর্শী, হিমানীশ, তারাপদ-র নাম উল্লেখ করা যায় এখানে – সে-ব্যাপারে তাঁরা হয়ত হবেন একমত।
ভ্রমণ-কাহিনির উদ্দেশ্য আরো সহজ-সরল – সেখানে থাকবে ভ্রমণ-বিষয়ক কাহিনি – যা সংবাদ-সর্বস্ব না হয়ে বর্ণনা, চিন্তাধারা ও ঘটনাপ্রবাহে স্বতঃই চিত্তাকর্ষক হয়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পাঠককে – হাত ধরে নিয়ে যাবে তাকে ঘর ছেড়ে পথে। বাস্তবে হয় হোক, নয়ত নিছক কল্পনায় – লেখার গুণে সাহিত্য হয়ে উঠবে তা পাঠকের কাছে – হয়ে উঠবে মনের জানলা, অবাক চোখে মনের কোণের বাইরে তাকানোর ! বাংলা-সাহিত্যে এ-বিষয়ে উমাপ্রসাদের অবদান ভোলার নয় – তার পরে আছেন সঞ্জিৎ, মহাস্থবির, প্রবোধ, নারায়ণ, সুনীল প্রমুখ আরো অনেকেই। তবে, প্রথম যে ভ্রমণ-কাহিনিটি পড়ে আমার মন ভ’রে উঠেছিল কানায়-কানায় – সেটি হল শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায়-এর লেখা ‘পথে প্রবাসে’। আশ্চর্য লেগেছিল আরো, যখন জেনেছি সেটি ওঁর লেখা প্রথম বই! লেখার স্টাইল আর মনন মিলিয়ে ওঁর লেখা আমার প্রিয়; প্রবন্ধের জগতেও তাঁর অবাধ বিচরণ। মুজতবার ‘দেশে-বিদেশে’ অনন্য – ওঁর স্টাইল একান্ত মনোগ্রাহী ব’লে ধাঁধা লাগায় বইটি ভ্রমণ-কাহিনি নাকি রম্যরচনা! জিনিয়াসের লক্ষণই যে তাই – সংজ্ঞায় বেঁধে বাক্সবন্দী করা যায় না তার সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি! 

Anna Quindlen তাঁর উক্তিতে উল্লেখ করেছেন জার্নাল বা ডায়েরী-র – ভুলিনি সে’কথা। হ্যাঁ, বিশ্বসাহিত্যে তাদের স্থানও সুনির্দিষ্ট এবং নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরী’। খ্যাতির ছোঁয়া না থাকলে, ডায়েরী বলতে সাধারণভাবে আমরা যা জানি তা হোলো, সে পর্দানশীন – একমাত্র নিজের জন্যে, আর কারো নয়। সাধারণ লেখক সদা-সতর্ক থাকেন – তাঁর ডায়েরী যেন আর কারো হাতে না পড়ে! জার্নাল যেন ঠিক তা নয় – সে শুধু মনের আকাশে স্বচ্ছন্দ পাখা-মেলা, যে দেখে দেখুক! সে যতটা নিজের জন্যে, প্রাণের খুশিতে – ততটাই হয়ত অন্যের জন্যে। মানব-মনের বিবিধ চিন্তার রসাত্মক, দার্শনিক, তথা নান্দনিক প্রকাশ ঘটে সেখানে – গতানুগতিক প্রবন্ধের চেয়ে আটপৌরে-বেশে – সাদাসিধে অথচ গভীর তার রূপ। পস্টারিটির জন্যে ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা মুক্তছন্দে রেখে যাওয়ার জন্যেই যেন জার্নালের সৃষ্টি। সাহিত্যের যথাযথ সংজ্ঞা মানতে গেলে যা দাঁড়ায় – ‘জীবনে জীবন যোগ করা’ – তাই বুঝি জার্নালের প্রকৃত কাজ। সারা পৃথিবী জুড়ে মানবতার ইতিহাসে চিঠির স্থান যেমন ব্যাপক, প্রচারের অভাবে ডায়েরী বা পরিচয়ের অভাবে জার্নাল ততটা নয় – তাই সংখ্যাতত্বের খাতিরেও বিশ্বসাহিত্যের আঙিনাতে দেখি তাদের সীমিত আবির্ভাব। তবু যে-ক’টি আমার গোচরে এসেছে, তাদের মধ্যে শিল্পতত্ব ও দর্শনশাস্ত্রের সুইস্ অধ্যাপক হেনরি এমিয়েল-এর ‘এমিয়েলস্ জার্নাল’, স্বয়ং টলস্টয়-রচিত জার্নাল, সেই-কবে রবিবাসরীয়-তে ধারাবাহিক-ভাবে পড়া শ্রীনারায়ণ গাঙ্গুলির ‘সুনন্দ-র জার্নাল’, এবং আমাদের কবি-সাহিত্যিক শ্রীশঙ্খ ঘোষের লেখা ‘জার্নাল’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শুনেছি লেখা-অনুশীলনের প্রয়োজনে, সত্যিকারের লেখকেরা অনেকসময় বলে থাকেন রোজ অন্তত দু’পাতা ক’রে লিখতে – সেইভাবেই হয়ত হয় জার্নাল লেখার সূত্রপাত। এ-অবশ্য আমার একান্ত নিজস্ব ধারণা – হতে পারে নিতান্ত ভিত্তিহীন। তবে লেখক-ভেদে তা সত্য বা অসত্য – ‘যে পারে, সে-ই পারে গো ফুল ফোটাতে’।
বিস্তারিত বিশ্লেষণে আর না গিয়ে, মোটের ওপর বলা যায় – উপন্যাস হতে পারে বিপুলা ও পৃথুলা, ধীরগামী ঘটনা- ও কাহিনিবহুল – ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তা নিছক বিলাস – তাকে হতে হবে দ্রুতগামী ও একনিষ্ঠ, পরিণতিমুখী, পরিমিত, ও ক্ষীণাঙ্গী। কবিতা পাঠককে আকর্ষণ করবে ছন্দ-যতি-মিলের আলিম্পনে পরিবেশিত ভাবের অলঙ্কার-ছটায়। প্রবন্ধ গুরুগম্ভীর, তথ্যবহুল গুরুপাচ্য হলেও কারো কিছু বলার নেই, শিক্ষা হতে পারে দু-অর্থেই – তবে রম্যরচনা রমণীয় ও সরস-সুপাঠ্য না হলে কারো ঠিক রোচে না। ভ্রমণকাহিনিতে স্বাভাবিকভাবেই ওতপ্রোত জড়ানো থাকতে হবে ভ্রমণের সঙ্গে মুখরোচক কাহিনি – নইলে সবার মুখ ভার। আরো আছে গোয়েন্দা-গল্প আর তার মাসতুতো ভাই ‘থ্রিলার’ বা রহস্য-গল্প – দুটোতেই আছে গল্প, তাতে যথাবিহিত রোমাঞ্চের খোরাক; প্রথমটির কেন্দ্র-বিন্দুতে থাকবে এক দুঁদে গোয়েন্দা, সব পরিস্থিতিতে মাথা খাটিয়ে সম্ভাব্য সব সমস্যার সমাধান করা যার সাজে – আর দ্বিতীয়টির কেন্দ্র-বিন্দুতে থাকবে কোনো অসম্ভাব্য দুরূহ সমস্যা, আর তাকে ঘিরে একাধিক-জন, ছল-বল-কৌশল খাটিয়ে দুঃসাহসিক দস্যিপনার কাজে। চিঠির মধ্যে পাওয়া যাবে ব্যক্তিগত পরিস্থিতির পরিমণ্ডলে লেখার গুণে সার্বজনীন সত্যের উদঘাটন, আর জার্নালের ঘরোয়া বাতাবরণে লেখকের মুনশিয়ানায় দার্শনিক ভাব-ভাবনা রূপ পরিগ্রহ করবে সহজ-কঠিন দ্বন্দ্বে-ছন্দে। অলমিতি বিস্তরেন।
অবশ্য এ-সবের যথাযথ বিন্যাস অনুসৃত হলেও হামেশাই লেখককে পড়তে হতে পারে সমালোচনার মুখে। ঐ সমালোচনা কথাটাতে আমার আবার আছে আপত্তি; আমার মতে কথাটা হওয়া উচিত ‘বিষমালোচনা’। কেননা, তথাকথিত সমালোচনা যাঁরা করেন – তাঁরা পণ্ডিত বা পণ্ডিতম্মণ্য, সভ্য বা বন্য, বিপক্ষ-সম্পাদকের চামচা বা কৃপাধন্য, বা আর যা-ই হোন্ না কেন – মূল লেখকের সম-আসনে বসার যোগ্য নন্ – এবং সেই যুক্তিবলে ‘সমালোচনা’ করার এক্তিয়ার নেই সেই তাঁদের। ন্যূনতম সম্মান যদি দিতেই হয় তো বলব – তাঁরা করেন ঐ ‘বিষম-আলোচনা’ (‘ব্যাকরণ মানি না’!)। কাজেই লেখকের এক্তিয়ার আছে তাঁদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন! তা সে-নাহয় হোলো তাঁদের পারস্পরিক সমঝোতা। পাঠকের এক্তিয়ারে যা আছে, তা হোলো – নিজেদের রুচি অনুযায়ী লেখা বা বই হাতে তুলে নিয়ে, তাদের সময় বা মর্জিমত চোখে দেখার পর চেখে দেখা, আর সেইসঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে কবিগুরুর স্রেফ দুটি আপ্তবাক্য মনে রাখা। প্রথমটি তাদের উদ্দেশ্যেই লেখা – “সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে!” আর দ্বিতীয়টি – “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না” – শুধু পাঠক নয়, কেবলমাত্র লটারির টিকিটের ক্রেতা নয়, আশাভঙ্গের শিকার সবার ক্ষেত্রেই এটি সমানভাবে প্রযোজ্য।

নিতান্ত ব্যক্তিগত
আমার সত্যিকারের লেখার চর্চা অবশ্য হয়েছে এ-দেশের বাঙালী সংস্থা ‘প্রবাসী’-র প্রকাশিত ‘শঙ্খ’ পত্রিকাটির মাধ্যমে। আসলে আমেরিকায় বাঙালীর বসতিস্থাপনে – সংখ্যার বিচারে এবং বনেদিয়ানায়, নিউইয়র্ক বা টরোন্টোর স্থান সানফ্রানসিসকোর আগে – ওসব জায়গা থেকে বাংলা ম্যাগাজিন বের হচ্ছে আমাদের এখানের চেয়ে বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই। আমি নিজেও তো লেখা দিয়েছি সেখানে। এখানে প্রবাসী-র জন্ম-ই ১৯৭৪-এ – তার ম্যাগাজিন ‘শঙ্খ’ ভূমিষ্ঠ হয়েছে তারও বছরকয়েক বাদে। কিছুদিন পর থেকেই আমি তার সঙ্গে বিশেষ জড়িত ছিলাম – নামটাও আমারই দেওয়া। আর সেই সুবাদে তার গড়ে ওঠার প্রথম কয়েক বছর আমার কাজ ছিল সেই যাকে বলে ‘জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ – মানে প্রায় সব-কিছুই! শুধু মনের সাধ মিটিয়ে নিজে লেখা নয় – সেই সঙ্গে লেখা জোগাড় করা এবং প্রয়োজনে তাদের সংশোধন বা সাজিয়ে-গুছিয়ে দাঁড় করানো, ছবি আঁকা, নির্বাচন ও সামগ্রিক অলংকরণ, তদুপরি পত্রিকাটির সম্পাদনার ভারও ছিল আমারই ওপর। কম্প্যুটার ব্যবহারের আগে হাতে লিখেও বেরিয়েছে ‘শঙ্খ’ – সে-সময়ে হাতের লেখাও ছিল বেশীর ভাগ আমার। ছাপাখানার মোকাবিলাতেও ‘এই-আমি’ – সব মিলিয়ে ‘শঙ্খে’র পাতায়-পাতায় নির্ভেজাল ‘আমি-আমি’ গন্ধ! এক-কথায় কাজটা প্যাশনে দাঁড়িয়েছিল – ভীষণ জড়িয়ে পড়েছিলাম তার সঙ্গে!
মনে আছে, হয়ত সারাদিন কাজের পর বাড়ী ফিরে, খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমের পকেট মেরে ‘শঙ্খে’র অন্তিম প্রুফ-রিডিং ক’রে উঠে চোখ তুলে দেখেছি, বাজে রাত তিনটে – অফিস যেতে হবে ভোর হতে না হতে! প্রায় প্রতি সংখ্যার বেলায়ই ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি। ছাপা হয়ে বেরোবার পর নির্দিষ্ট দিনে সভ্য-সভ্যাদের হাতে তুলে দিয়ে তবে আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি – মনে করেছি সার্থক হল খাটুনি।
আর তারপর, যখন দেখেছি তাদের একটি পাতাও উল্টে না দেখে, কেবল ব্যবহার করা হয়েছে প্রেক্ষাগৃহে জায়গা রাখার প্রতিযোগিতায় – কখনো সীটে, কখনো-বা মাটিতে – তখন মুখে কাউকে কিছু না বললেও, মনে বেজেছে বৈকি! মনে আছে, একবার আমরা দুই কর্মী-বন্ধু অনুষ্ঠানের পর প্রেক্ষাগৃহ পরিষ্কার করতে গিয়ে, সীটগুলোর আশপাশে ফেলে-যাওয়া পত্রিকাগুলো তুলতে তুলতে রীতিমত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বন্ধুটি তার মাঝেই আমার দিকে তাকিয়ে রসিকতাচ্ছলে হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল – “তোমার ‘শঙ্খ’ ধূলায় পড়ে, কেমন করে সইব?” আমরা দুজনেই আবার রবীন্দ্র-ভক্ত! তাই শুনে আমিও বানিয়ে বানিয়ে চটজলদি ওকে শুনিয়ে দিলাম – “বলতে পারিস কদ্দিন আর ভূতের ব্যাগার বইব?” কুড়নোর ফাঁকে ও বলে উঠল – “আমার তো নয় সাধের বোঝা, কেমন করে কইব?” কাজ শেষ হলে, সেই ‘সাধের বোঝা’ মাথায় ক’রে হল থেকে বেরতে বেরতে আমরা দুজন সমস্বরে গেয়ে উঠলাম বেসুরোয় – “রাখবো এখন মাথায় তুলে, ধন্য হয়ে রইব।”
লেখার উৎসাহে একবার আমি প্রবাসীর এক প্রবীণ সভ্যকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম – “এবারের শঙ্খে আমার লেখাটা পড়েছেন?” চাবুকের মত জবাব পেলাম – “এদেশের লাইফে অত সময় কোথায় মশাই? কাজকম্মো, সংসার, সব কিছু সামলে আর কিছুর জন্যে সময় পাওয়া – সে তো যাকে-বলে লাক্সারি। আর তাই যদি পাই – তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবিঠাকুর – এনাদের লেখা পড়ব, তারপরে আর আপনার লেখা পড়ার … এঃ, হেঁ হেঁ …” বলতে বলতে ঠোঁটের কোণ থেকে একটি বাঁকা হাসি উপহার দিয়ে এগোলেন তিনি। আমি ভাবতে বসলাম – সত্যিই তো, এই অসম প্রতিযোগিতায় আমি তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ – আমার লেখা উনি বা আর কেউ পড়বেনই বা কেন। বিনাপয়সায় শিক্ষালাভ হোলো যাহোক্। এমনি অনেক অভিজ্ঞতা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য ক’রে এগিয়েছি সেদিন এ-কাজে – এখন ভাবতে বসলে মনে হয় কতটা সময় দিয়েছি পত্রিকাটিকে! তখন ভাবিনি কিছুই, নিছক ভালো-লাগার বশে – শুধু এক দুরন্ত ব্যাকুলতা ছিল বুকে।

দুঃখ এই – আমার মত স্বল্প ধৈর্যের লোকেদের ভালো-লাগার রেশটা ফিকে হয়ে আসে ধীরে ধীরে – ভালোবাসা ছুঁয়ে নেমে আসে নিছক ঔদাসীন্যে। বয়সের ভারে উধাও হয়েছে চলনের ক্ষিপ্রতা, উৎসাহের ব্যগ্রতা, অনুভূতির তীব্রতা – অভিজ্ঞতার নিষেকে গত হয়েছে বর্তমান অস্তিত্বকে আঁকড়ে থাকার আকুলতা, বিদায় নিয়েছে ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে ধরে রাখার ব্যাকুলতা। তার বদলে হয়ত পেয়েছি এক সার্বিক নিরাসক্তির প্রশান্তি – সব কিছুকে মনে নেওয়ার জায়গায় মেনে নেওয়া। একেই কি বলে স্থিতধী – সেই ‘দুঃখে অনুদ্বিগ্ন, সুখে বিগতস্পৃহ’ অবস্থা? ঠিক জানিনা। ভেতরে ভেতরে হয়ত চলছে তার সাধনা, একদিন পৌঁছব সেখানে – এখন শুধুই প্রতীক্ষা!
লেখালেখির সূত্রপাতের ব্যাপারে, ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অবশ্য প্রবাসীর সেই আদিকালের একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করতে হয় এখানে। প্রবাসীর আয়োজিত প্রথম দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণ-পত্র লেখার ভার দেওয়া হয়েছিল আমাকে। শ্রদ্ধাসম্ভ্রমের সঙ্গে মাথা পেতে নিয়েছিলাম সে গুরুদায়িত্ব। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, কাগজ কলম বাগিয়ে, মন দিয়ে সময়মত লিখে ফেললাম সেই নিমন্ত্রণ-পত্র – নির্ভেজাল সাধুভাষায়। না, কেবল আটপৌরে সাধু নয়, একেবারে বঙ্কিমী – বিবিধ অলঙ্কারে সুসজ্জিতা! প্রবাসীর ঘরে-ঘরে তো ‘সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’ – ডাকবাক্স মারফৎ হাতে হাতে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু হলে হবে কী – শুভদিন সমাগত হলে দেখা গেল, যত লোক আশা করা হয়েছিল, তার অর্ধেক অনুপস্থিত। কর্মকর্তাদের মাথায় হাত, প্রচুর খাবার নষ্ট – ইত্যাদি, ইত্যাদি। কারণটা ঠিক বোঝা যায়নি তখন – গবেষণা আর জল্পনা-কল্পনা চলছিল মুখে মুখে। শেষমেশ সেটা বাৎলাল বার্কলেতে আমারই এক বিশেষ বন্ধু। ৺পুজোর পর একদিন রাস্তায় দেখা ওর সঙ্গে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল সে – “আচ্ছা অমি, ওটা তুই কি লিকেছিলি বলতো চিঠিতে? কীসব আস্সিন মাস, সরৎকাল, কাসফুল, মেঘ্-টেঘ্ – পড়ে তো বুঝতেই পারবে না কেউ কিসের চিটি! সোজা কতায় লিকবি – ‘পুজো হচ্ছে, আসবেন’ – তবে না! তোর ঐ লেকা পড়ে লোকে বুজতেই পারেনি – আসবে, না চলে যাবে। হুঁঃ, উল্টোপাল্টা যত কতা খালি।” যাক, অর্ধেক লোকের অনুপস্থিতির কারণটা যেন পরিষ্কার হল আমার কাছে – বুঝলাম বাকী অর্ধেকও এসেছিল অন্যের কাছে শোনা মুখের কথায় ভরসা ক’রে – চিঠি পড়ে কেউই বোধহয় নয়! কারণটা শোনার পর সঙ্গত-কারণেই আমি আর সেটা পাঁচকান করিনি। প্রসঙ্গত, আমার এই বন্ধুটি শ্যামবাজারের ছেলে – আঠেরো বছর বয়েসে দেশ ছেড়ে গিয়েছিল জার্মানি, সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার্থে বার্কলে-আগমন। স্বভাবে প্রায় জার্মান, উচ্চারণে পুরোপুরি ‘সসীবাবুুু’ – দিলটা এক্কেবারে সাচ্চা, মনে-মুখে এক। ও হ্যাঁ, এর পরের বছর থেকে আমাকে আর নিমন্ত্রণ-পত্র লিখতে দেওয়া হয়নি – ক্ষতি সামলাতে অন্য ব্যবস্থা নিয়েছে ‘প্রবাসী’। ক্ষতি হয়নি আমারও – বিশেষ ভাঁটা পড়েনি লেখার উৎসাহে।

সেই ছোটবেলা থেকেই লেখার চেয়ে পড়ার যে আগ্রহ – সেটাও কমে নি এখনো। তবে, তার পাশাপাশি নিজে থেকে লেখার যে ইচ্ছে, যার প্রেরণা আসতে হবে ‘ভেতর থেকে’ – সেটা দেখা দিয়েছে মেজবেলা থেকে বুড়োবেলায়। মিউজ্-এর মর্জির ওপর আমার হাত নেই – ভাগ্যক্রমে এখনও তা আছে অব্যাহত। তবে তিনি কৃপা করেন তাঁর নিজের খুশিমত খামখেয়ালে; যখন চাই তখন তো নয়ই, যা চাই তাই যে মিলবে, তারও স্থিরতা নেই কোনো। এই যেমন, নিজের লেখার বেলায় লক্ষ্য করেছি – বিশুদ্ধ কল্পনা-বাহিত গল্পের প্লট আমার মনে দেখা দেয় না সহজে – সে-ব্যাপারে মিউজ্ তথা কল্পনা-দেবীর ভারী কার্পণ্য। তাই যখন আমার গল্প-লেখার প্রবাহটাকে একবার পিছু ফিরে দেখি, সব মিলিয়ে গোটা-পঁচিশেকের বেশী তো কৈ চোখে পড়ে না। অথচ গল্প লিখতে আমি ভালবাসি – ভালো পারি কিনা সে-খোঁজে না গিয়েও বেশ বলতে পারি – কিন্তু যুৎসই প্রেরণার সিঞ্চন না হ’লে যে মাঠেই মারা যায় ফসল, শীষ-টুকু ওঠার আগেই – গোলায় ওঠা তো দূর অস্ত্! আর, বোধহয় অভিজ্ঞতার অভাবে, কল্পনাদেবীকে তোয়াজ করার উপায় বা পুজো দেবার মন্ত্র, কোনটাই আমার জানা নেই – অগত্যাই, সীমিত ক্ষমতায় যেটুকু পেরে উঠি তাই নিয়েই চেষ্টা করি খুশী থাকার। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পসংগ্রহের ভূমিকায় উনি বলেছেন – “চেষ্টা – এই শব্দটাই আমার সম্পর্কে যথার্থ শব্দ।” ওঁরই লেখায় পেয়েছি, “‘চেষ্টা’ কথাটা আমার খুব মনোমত। …এই চেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার একটুখানি বেঁচে থাকা।” কথাটা আমারও বিশেষ মনোমত। সত্যিই, আমরা শুধু ঐ চেষ্টাটুকুই করতে পারি – ফল আমাদের হাতে নেই। বলতে গেলে গীতার ভাষ্যও তো ঐ একই! আর তাই সান্ত্বনা পাই ভেবে, শীর্ষেন্দুবাবুর মতন বাংলা-ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প-লেখকেরও যখন চেষ্টাই সম্বল, তখন আমি তো কোন্ ছার!
তাই বলছিলাম – ভেতর থেকে প্রেরণা আর তার প্রসাদ না মিললে, বাইরে থেকে আসা লেখার তাগিদের ফল শুধু আমা-হেন লেখক নয়, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ক্ষেত্রেও ভালো হয় না – তাঁদের সে ফরমায়েশি লেখার নিকৃষ্টতা, আর তা প্রতিরোধ করার অক্ষমতা প্রাণে বাজে। শারদীয়া পত্রপত্রিকায় তার নিদর্শন জোটে ভুরিভুরি। সাধের চেয়ে সাধ্য কম থাকার বেদনার আমি সমব্যথী, কিন্তু সাধনার অভাবে দায়-সারা কাজের সাক্ষী থাকার বেদনা পাঠকের কাছে আরও পীড়াদায়ক। তাছাড়া, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে এখন তো জানি – ওসব পড়ার ‘সময় কোথায় মশাই?’
লেখার ফল ভাল হল না মন্দ – মাপকাঠিটা কি? বাজারে কী ‘খায়’ – শুধু তাই কী? পাঠকের ভালো-লাগার কাছে কি বিকিয়ে যেতেই হবে লেখকের ভালো-লাগা? যেখানে জনতার হাততালির জন্যে কোনো প্রতীক্ষা নেই, প্রকাশকের প্রশস্তির প্রত্যাশা নেই, বা অর্থের অনর্থও যেখানে অনুপস্থিত – শুধুমাত্র আত্মপ্রকাশের আকুতিতে যিনি লেখেন – তাঁর উৎকর্ষের মাপকাঠি কেমনতর – কীসে তাঁর পরম আত্মপ্রসাদ? মনের আয়নায় যখন তিনি কেবল নিজের মুখোমুখি, তখন কি তিনি যত মাপকাঠিকে তুচ্ছ ক’রে তাঁর সেই মনোলোকের চাবিকাঠিটির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না – এক্ষেত্রে আমার ‘আমি’ অনুপস্থিত!
মনে প্রশ্ন আসে আরো – যে কোনও লেখকের কাছে লেখালেখির সার্থকতা বলতে তাহলে কি বোঝায়? লেখক কখন মনে-মনে সন্তুষ্ট হন একটা লেখা লিখে? উত্তর হতে পারে জনে জনে বিভিন্ন। এ-প্রসঙ্গে জনৈক লেখকের একটি চিঠি পড়ে ভাল লেগেছিল; আন্তরিক সততার সঙ্গে তিনি লিখছেন – “যখন এইরকম লিখতে লিখতে লেখা বেড়ে যায়, এবং প্রতিদিন সকালে বিছানা থেকে উঠেই মনে হয় কাল সেই লেখাটা কোথায় ছেড়ে দিয়েছিলুম এবং আজ কোথা থেকে আরম্ভ করতে হবে, তখন ভারী ভালো লাগে – দিনগুলিকে বেশ লেখায় পরিপূর্ণ করে ভরা কলসির মতো সন্ধেবেলায় ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলি, এবং সেই-সব লেখার ধ্বনি প্রতিধ্বনির রেশ সমস্ত শরীর মনের মধ্যে বাজতে থাকে।” ভালো-লাগার কী পরিচ্ছন্ন প্রতিচ্ছবি! মনে হল, যেন সবটা মিলিয়ে আমার অনুসন্ধিৎসার বা প্রশ্নের উত্তরের একটা প্রচ্ছন্ন আভাস পেলাম। চিঠিটির আরেক অংশে রয়েছে আমার পক্ষে বিশেষ শিক্ষণীয় কয়েকটি কথা – “ … আসল কথা হচ্ছে, অনুভব করাতেই আমাদের হৃদয়ের ক্ষমতা প্রকাশ হয় – আমি যখন একটা প্রাচীন স্মৃতির জন্য হৃদয়ের মধ্যে ব্যথা পাই তখন সেই ব্যথার মধ্যে আনন্দ এইটুকু যে, স্মৃতিটুকুকে আমি উপলব্ধি করতে পারছি, সেটা আমার কাছে আসছে – প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষ অবধি, বর্তমান থেকে অতীত পর্যন্ত আমার হৃদয়ের বোধশক্তি প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে।… নিজের মনের কথাও আমাদের নিজের কাছে ভারী দুরূহ – আমরা ঠিক কী ভাবছি তা আমরা সম্পূর্ণ জানতে পারিনে, তার অর্ধেক কথা কেবলমাত্র অন্তর্যামীই জানেন। আমি নিজের কথা প্রকাশ করে বলতে গিয়ে নিজের কাছ থেকে নিজে শিক্ষা লাভ করি – আমার অধিকাংশ শিক্ষাই এমনি করে হয়েছে …”।

অপূর্ব এই উপলব্ধি। একটু খেয়াল করে দেখি, Anna Quindlen যে তাঁর পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বলছেন –
“… writing can be really hard, but when you’re done, it can be really valuable and even transformative. … I think that there are people who manage, through writing, to understand themselves in a way that they didn’t understand themselves before. It enables them not only to imagine themselves differently, but to become quite different than they’d been before.” 

এ’যেন ঠিক ঐ একই কথার বিদেশী অনুরণন। দেশ-কালের ব্যবধান পেরিয়ে লেখার জগতের স্রষ্টাদের মধ্যে উপলব্ধির কী চমকপ্রদ মিল! আমি আবার শিক্ষালাভ করি এইসব অমূল্য চিঠি পড়ে – যেখানে গুরু-প্রতিম লেখকদের লেখার দর্পণে চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁদের মানসলোক – আবিষ্কার করি নিজেকে। উদ্ধৃত চিঠিটি যে কার, তা বোধহয় এখানে আর বলার অপেক্ষা রাখে না এখন।

শেষ-কথা
প্রাথমিক যুগের সহজ পাঠের পালা পেরিয়ে, পড়ার আগ্রহে রবীন্দ্রনাথ পড়তে ব’সে ওঁর অফুরান সাহিত্যকর্মকাণ্ডের স্রোতে ভেসে গিয়ে দেখলাম – উনি তো স-বই লিখে গেছেন! আপামর বাঙালী-লেখক সব্বার সেই একই উপলব্ধি হয় কিনা আমি জানিনা, সেটা অনুমানসাপেক্ষ। আর তার গুণ-বিচার? সে তো আমরা সঠিক করে উঠতে পারিনি এখনো – সে-বিচারের ন্যায্য অধিকার কারো না-থাকার অক্ষমতায় – যা করা হয় তা অধিকাংশ স্থলে হয়ে দাঁড়ায় ‘অন্ধের হস্তীদর্শন’-এর মতই ভ্রান্ত ও উদভ্রান্ত – নিতান্ত অসার। ওঁর সাহিত্যসৃষ্টি শুধু যে অফুরান তা তো নয়, সে যে অমৃতসমান – তুলনা মিলবে কীসের সঙ্গে! বাংলা লেখার ক্ষেত্রে এক দুর্লভ আদর্শ হিসেবে ওঁকে সামনে পাওয়া আমাদের পরম সৌভাগ্য। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের আর কোনো লেখক সে-সৌভাগ্যের অংশীদার হতে পারবে না কখনো। তাঁর ‘পঞ্চতন্ত্র’ বইতে মুজতবা আলী যেমন লিখেছেন – “ রবীন্দ্রনাথ গান আর কবিতা দিয়ে যে বাঙলা গীতিসাহিত্য রচে গিয়েছেন তার কাছে এসে দাঁড়াতে পারে, এমন গীতিসাহিত্য পৃথিবীতে আর নেই বললেও চলে। মেঘদূতের মত গীতিকাব্য পৃথিবীতে নেই – রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান অনেক স্থলে কালিদাসের মেঘদূতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিকাব্য দিয়ে বাঙলা সাহিত্যকে যেন একসঙ্গে তেইশটা ডবোল প্রমোশন পাইয়ে দিয়েছেন।” (জনান্তিকে বলি – লেখাটা পড়ার পর থেকেই ঐ ‘তেইশ’ সংখ্যাটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, গেঁথে গেছে মনে – তবু অঙ্কের উপপত্তিটা কিছুতেই মালুম হয়নি! অঙ্কের মাষ্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করলে উত্তরের বদলে নির্ঘাৎ জুটত কানমলা – তাই সে-চেষ্টায় ইস্তফা দিয়েছি। শেষ উপায় ছিল ওঁকে সাক্ষাতে জিজ্ঞেস করা – ততদিনে ওঁকে হারিয়েছি – বড়ী আফসোস কী বাত্! তবে আমার নিজস্ব ধারণা – বাংলা নিয়ে যাঁরা উচ্চশিক্ষা করে’ উচ্চতম ডিগ্রী আহরণ করেন, তাঁদের অন্তত অর্ধেক থিসিস্-ই তো হয় রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কে – তাঁদের মধ্যে কেউ যদি এ-বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন – সেই আশায় রইলাম।)
অনেকটা সাবালক হওয়ার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা আমার মনপ্রাণ জুড়ে ছিল – বলতে গেলে একরকম অধিকার করে নিয়েছিল, তার সর্বব্যাপী গভীরতায় আর সৌন্দর্যে। একান্ত ইচ্ছে থাকলেও ওঁর সব লেখা এখনো পড়ে উঠতে পারিনি, কোনদিনও পারব কিনা জানিনা। মানব-মনের সব অনুভূতির মুখেই তিনি ভাষা জুগিয়েছেন – নতুন কিছু লেখার আর প্রয়োজন কী – এই চিন্তাটাও এসেছিল মনে। আর তাই কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লিখতে বসে বারবার দেখেছি – কলম সরতে চাইছে না কিছুতেই! তার কারণ ঠিক ভয় নয় – সৎসাহসের একান্ত অভাবও নয় – ঐ পরম-সৌভাগ্যজনিত এক অভিভূত অনুভূতি মনকে সম্পূর্ণ অধিকার ক’রে রেখেছিল ব’লে। কাজেই, এ আমার অভিযোগ নয় – বরং সেই সৌভাগ্যের উত্তরাধিকার-সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি। উত্তরাধিকার থাকলেও সে-সম্পদ ফলপ্রসূ হয়নি।
দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নাহক অনেক দেখে-শুনে এখনও আমি প্রবাসী। এখানে বসে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কতবার ভেবেছি, প্রবাস-জীবন নিয়ে লেখার রয়েছে কত কিছু। আমার বিশেষ পরিচিত একজন নামী লেখক আমায় দ্ব্যর্থ-বিহীন ভাষায় বলে গিয়েছেন – “তোমাদের অভিজ্ঞতা, তোমাদের ভাব-ভাবনা নিয়ে লিখতে হবে তোমাদেরই – এই প্রথম-প্রজন্মের প্রবাসীদের – নইলে আমাদের অন্য কারো লেখায় সেটা হবে নেহাৎ ‘সৌখীন মজদুরি’। খেয়াল রাখতে হবে – ‘শুধু ভঙ্গী দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ’!” ওঁর এই কথাতে উঁকি দিল ‘ঐকতান’ কবিতা থেকে রবিঠাকুরেরই সেই অমূল্য উক্তি। প্রথিতযশা কিছু লেখকের বিদেশ-সম্পর্কে লেখার সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিতে গিয়ে ‘সৌখীন মজদুরি’-র সুস্পষ্ট পরিচয় পেয়েছি – তার পরিপ্রেক্ষিতে উক্তিটির যাথার্থ্য উপলব্ধি করেছি মনে মনে।

যাহোক, কথাটা নিঃসন্দেহে ভেবে দেখবার। তাই হয়ত একদিন কাঁপা হাতে কলম ধরেছিলাম, অক্ষমতাকে চোখ ঠেরে। এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নিজের কথা নিজেকেই লিখতে হবে – ব’লে যাওয়ার, রেখে যাওয়ার জন্যে – কেউ পড়ুক বা না পড়ুক – কারো কাজে লাগুক কি না লাগুক। সেই কবে স্বনামধন্য শ্রীপ্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন কৌতুক-ছলে –

“আমার বই বাজারে কাটে কম, কাটে বেশী পোকায়!”

তাই বলে কিন্তু তিনি লেখা ছাড়েন নি – ভাগ্যিস! এখন তিনিই আমার প্রেরণা। দেখা যাক, কোথায় গিয়ে যে ভিড়বে এ-তরী – আর কবেই-বা। বাকী থাকে প্রশ্ন শুধু – ‘শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষের পথে।’ শেষের সে-কথা তো জানা নেই কারো – এখন থেকে তা ভেবে মরি কেন – কার কী উপকার হবে তাতে?

 

প্রমথ চৌধুরী
জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়েয়। কর্মসূত্রে দেশত্যাগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন। লেখালেখির শখ বরাবরই। ‘শঙ্খ’-নামে পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। তবে অবসর জীবনে চুটিয়ে লেখালেখি করে সেই শখ পূর্ণ হচ্ছে। বেশকিছু লেখা - ‘মাতৃশক্তি’, ‘উৎসব’, ‘সাংবাদিক’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রকাশিত গ্রন্থ - ১৫১টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইংরেজী অনুবাদ - "Lyrics to Love"। আরো অনুবাদ নিয়ে আর একটি বই বেরোবে খুব শীঘ্রই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *