পূর্ণিমা

পূর্ণিমা

ফতিমা – পূর্ণিমা

“ওঠ, ওঠ, উঠলি? হ্যাঁ ফতিমা, ফাস্ট লোকাল তো বেইরে গেল। কাজ ধত্তে দেরি হপে যে।”

তাড়া দেয় আমিনা। ডাইবিটিস, তায় পেশার। বাঁ অঙ্গটি পড়ে গ্যাছে তার। কিন্তু দিমাগটা ঠিক আচে। অ্যাখুনও।

থাকবে না বেশিদিন।

আমিনা জানে। এমুন পেশেনের আয়াগিরি সে করেচে। পা পচে গেছিল সেই রুগির। আর পিঠময় বেডসো। কী দগ্ধেই না মল্লো সেই দক্ষিণ বারাসতের বুড়ি।

আমিনার খুব চিন্তা হয় নিজের মেয়েটারে নে। এই ফতিমার কল্যাণেই মুখে দু’টো ভাত উঠছে। ফতিমার ছোটো ভাই আনোয়ারের পড়াটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।

পাশের বাড়ির ফেলানি ছেল তাই রক্কে। সেই কাজ জুটিয়ে দেছে। সল্টলেকে এখন ঘরে ঘরে একলা বুড়োবুড়ি। সেকেনে ঘরে ঘরে কাজ।

চার বাড়িতে রান্না ঘরের কাজ সারতে সারতে ফতিমার দুপুর পেরুবে। শেষ বাড়িতে মাইনে কম। শেষ দুপুরের খাবারটা দেয় তো, তাই। বিকেলে আবার দুটো বাড়ি। একটায় রান্না। অন্যটায় ঝাঁটপাট৷ বাসন মাজা। ওরা রাঁধায় না। হোম সার্ভিস।

ফের শেয়ালদা। ভিড়ে ভিড়াক্কার ডাউন ক্যানিংয়ের লেডিজ। কোনো কোনোদিন জেনারেলেই।

এই সময়টা শরীর ছেড়ে দিতে চায়। এট্টু বিশ্রাম। জোটে না। শরীর খারাপের দিন ক’টায়ও তার ছুটি জোটে না।

রান্নার কাজ, বাড়ির কাজে ছুটি নেই। ছুটি চাইতে নেই। ছুটি নিলেই মাইনে কাটবে। আর তা ছাড়া, দুপুরের খাওয়াটা। ওটাও তো কম কথা না।

আসার ট্রেনে কাজে যাবার তাড়া থাকে। কথাবাত্তায় মন থাকে না। বাবুরা ট্রেনটার নাম দিয়েছে ঝি এস্পেশাল। ওই ট্রেনে প্রায় সবাই অবশ্য তাই-ই। হয় বাড়ি বাড়ি কাজের মেয়েরা, নয় কাঁচা সবজি। সমস্ত ট্রেনটাই। দু’একজন ধোপ দুরস্ত বাবু যে না ওঠে তা’ না। কেশনগরের এক ব্যাঙ্কবাবু ওঠে। এই রকমেরই মেন লাইনের অফিস বাবু, ইশকুল-দিদিমণি দু’চাট্টি। কেউ হয়তো বেড়াতে যাচ্চে।

জেনারেল কামরায় ওদের খুব কাছে গেলে দূর দূর করে ওঠে কেউ কেউ।

“অ্যাই, এদিকে অত ঘেঁষে আসবি না। যা, ওপাশে যা!”

প্রথম প্রথম ভয় পেতো। সরে বসত। এদানি ও’রম বললে কড়া চোখে ফিরতি তাকায়। মুখে চোপা? নাঃ, করে না। সামনে সারাটা দিন পড়ে আচে। এখনই সক্কাল সক্কাল কেলান্ত হলে হবে?

ব্যাঙ্ক বাবু, ইশকুল-দিদিকে চোখ টিপে হেসে বলে, “ক্লাস স্ট্রাগল! কী আর করা!”

ফেরবার ট্রেনে রোজকার চেনা মেয়েদের সঙ্গে দেখা হয়। ঘুম কাটাতে ওদের সঙ্গে আমড়াগাছি করে, কলকল করে। কত রকম কতা!

সোনারপুরের সোমাকে শুধোয়, “হ্যাঁ গো, এখন কী বিক্কিরি করচো ফেলাটে ফেলাটে ঘুরে? ধুপকাটি না ইলেকটিরেকের কিচু?”

সোমা নাকি কী সব পাশ। অপ্রসন্ন মুখে বলে, “হাঃ, আমার আবার সেলস। হয় ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি, নয় গেটে বেল বাজালেই খ্যাঁক করছে গিন্নি আর কুকুর। ওই চলে যাচ্চে আর কী। ম্যানেজার বলছে টুরে যেতে ওর সাথে। কী করব। লোকটা বাপের বয়েসি। খারাপ যদি হয়?”

সোনারপুর পেরোলে জায়গা মেলে বসার। এমনি সব আলগা গল্পে কখন ঘুম এসে যায় চোখে। পাশেই বসা ফেলানি ঠেলা মেরে বলে, “মুখ হাঁ করে ঘুমোলি হবে? নামতে হবে না। এসে গেচি তো!”

শশব্যস্ত হয়ে ব্যাগ সামলে সামনে এগোয় ফতিমা। ইস্টেশন থেকে ফেরার পথে আনোয়ারকে মাস্টারের বাড়ি থেকে তুলবে। বাজারের মোড়ের আবদাল্লা মেডিসিন থেকে প্যাল্লাসিস মা’টার জন্যি ওষুদ কিনতি হবে। বাপ তো কপেই গায়েব। মা’খানা মল্লি পরে ফতিমারে ওই মেয়ে দালাল বিনু নিয়ে গিয়ে বারুইপুরে লাইনে নাম্মে দেবে। মায়ের জন্যিই একনো কাচে ঘেঁষতি পারে না ইবলিশের বাচ্চাগুলো।

হুঁঃ, ফতিমারে লাইনে নামানো অত্তো সোজা না।

“অত্তো সোজা না…”

শুনতে শুনতে আমার চটকা ভেঙে যায়। এতক্ষণ ঝিমোতে ঝিমোতে ওর বলা জীবনকথাগুলোই রিওয়াইন্ড করে দেখছিলাম।

সত্যিই কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটা তাইই বলছে, “অত্তো সোজা না…”

আমি সল্ট লেকের এবি ব্লকের কে বি দত্ত। ওই মেয়ে রান্না শেষ করে আমাদের দু’জনকে খেতে দেবে। তারপর নিজেও খাবে। ফের বিকেলে অন্য বাড়ির কাজে যাবে।

তটস্থ হয়ে শুধোই, “কী অত সোজা না রে, মা?”

“দ্যাকো না, বিশ্বেস বাড়ির বউটা বলে নাকি কাজ সেরে বেরোনোর সময় আমার ব্যাগ সাচ করবে। কোনো মাল সরাচ্চি কী না। আমি কি তোর বরের মত অপিস থেকে চুরি করে ধরা পড়া চোর নাকি? আমাকে খারাপ বলা অত সোজা না। এক কতায় কাজটা ছেড়ে এলাম আজ। বুজলে ছোটো ছাওয়াল?”

ছেড়ে দিয়ে এল? এই মাগগি গণ্ডার বাজারে? এত সাহস কোনোদিন আমার নিজের কর্পোরেট পুত্রের হবে? ও অন্য শহরে আলাদা থাকে বউ-বাচ্চা নিয়ে।

মেয়েটা আমাকে ছাওয়াল বলে, বাবু বলে না। বাবা তো বলেই না। গিন্নি কতবার বলেছে।

সে না বলুক। আমার ঘরে না আসা এই মেয়েটাই তো সেই সাহসিনী, যে আমার বুকের ভেতর বসে সেই কবে থেকে রিনরিনে কচি গলায় চিৎকার করে বলে, “নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবার…”

করেছে তো। জয় করেছে। জীবনকে জয় করতেই থাকবে সারা জীবন। করবে এই পূর্ণিমা নামের মেয়েটা।

পূর্ণিমা?

ওঃ, বলা হয়নি।

সভ্য সেকুলার ভানের এই সল্টলেক গ্রামে ঢোকার আগে ফতিমাকে পূর্ণিমা হয়ে যেতে হয় রোজ, কালোবরণ দত্ত আমি যেমন কেবি দত্ত হয়ে গেছি সেই কবেই।

—— 

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আন্তর্জাল 

অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর জন্ম এক বৈশাখের শেষে, হুগলির বাকুলিয়া গ্রামে। ছোটোবেলা কেটেছে খড়দায়, মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় আর বেশিরভাগটা মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায়। মা বাবার বদলির চাকরি ছিল। তারপরে শহর কলকাতা। মেডিকেল কলেজ। অতঃপর চাকরি। নদীয়ায়। বাংলাদেশ সীমান্তে। তারপর বিভিন্ন জেলায়। একদম শেষে পাহাড় ঘুরে সমতলে নেমে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার। সারা জীবনে দেখেছেন অনেক। স্মৃতি থেকে সেগুলো তুলে এনে গাঁথার চেষ্টা করেন এই জীবনপথিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *