ন হন্যতে – হন্যমানে শরীরে
সময়ের তির, সুমুখ পানেই চলে। কখনো কখনো দুঃখ শোকের ঝড় তাকে বিচলিত করে তোলে, মুহূর্তের জন্য হলেও একবার তার গতি রুখে দিয়ে অতীতের দিকে ফিরিয়ে দিতে চায়। জানি আনন্দ, দুঃখ, শোক, মৃত্যু, এরা জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও প্রিয়জন বিয়োগের অনুভূতিটা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে চায় না। ভালোবাসা তার পথ রুদ্ধ করে রাখে। বিশ্বাস হয় না, যে মানুষটাকে এত ভালোবাসি সে নেই।
বাংলা সংবাদপত্রের খবর সবসময় খুব একটা নির্ভরযোগ্য হয় না, প্রায়শই তাল ও তেল, উদো এবং বুধো, সব গুলিয়ে ফেলে। তাই সুজনদার চলে যাওয়ার খবর পেয়েই সন্দেহের দোলায় দুলতে দুলতে প্রিয় সুহৃদ ভাস্করকে ফোন করেছিলাম, জানতাম ও কোলকাতায় আছে। ভাস্করের কাছে জানলাম এবার অন্তত খবর ভুল বলেনি। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, একটা বিশাল শূন্যতা আর অবিশ্বাস আমাকে ঘিরে ধরেছিল।
সালটা বোধহয় দু’হাজার বারো হবে। একদিন ভাস্করের সাথে কথা হচ্ছিল প্রাচীন ভারত নিয়ে। আমি বলছিলাম ইতিহাস তো রাজা-গজাদের নিয়েই ব্যস্ত, রানিদের খবর কে রাখে। অথচ প্রাচীন ভারতের রানিদের অনেক কাহিনি আছে। সেদিন জেনেছিলাম ‘অবসর’ বলে একটা পত্রিকা আছে, যেটা কেবল প্রবন্ধ ছাপে। জেনেছিলাম সম্পাদকের নাম সুজন দাশগুপ্ত এবং তিনি আমার মতো আমেরিকাতেই থাকেন। ‘রানী কাহিনি’ আমার অবসরের পাতায় প্রথম প্রবন্ধ। তারপর অবসরের পাতায় কত লিখেছি, কতবার সুজনদার সাথে কথা হয়েছে, নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে, কতবার তাঁর কাছে কত কিছু পেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। যত তাঁকে জেনেছি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে এসেছে।
বর্তমান পৃথিবীতে কাঁচাকে পাকা এবং ফকিরকে রাজা বলে চালানোর চেষ্টাই বেশি। কিন্তু প্রকৃত গুণীজন ছাইচাপা আগুনের মতো নিজেদের জ্ঞানের ও গুণের ভাণ্ডার সচরাচর প্রকাশ না করে ফকিরের বেশে রাজার মতো থাকেন, সুজনদা ছিলেন তার অনন্য উদাহরণ। সুজনদার যে কত বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল, দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। পুরোনো অবসর-এর Home Page খুললেই তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বলতাম, ‘দাদা, আপনার সাথে দশ মিনিট কথা বললেই জ্ঞান বেড়ে যায়।’ উনি হাসতেন, বলতেন, ‘কী যে বলিস ছাই।’ আমি সাধারণত ইন্দোলজি, যার ভিত্তি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্য, পুরাতত্ত্ব, প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি, এইসব ব্যাপার নিয়ে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করি। অনেক বার দেখেছি এই সব বিষয়ে ওঁর প্রচুর পড়াশুনো ও নিজস্ব চিন্তাধারা ছিল, যেটা বর্তমানের বেশির ভাগ লোকের মত গুগল-পণ্ডিত বা সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক ছিল না। আমি কোনো জার্নাল বা বইয়ের সূত্র ধরে তাঁর সাথে যখন কথা বলতাম, দেখতাম খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা ধরে ফেলেছেন এবং তাঁর বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে কিছু মূল্যবান মন্তব্য করতেন। আমি কোনো নতুন বিষয়ে হাত দেবার আগে সচরাচর সুজনদার সাথে একবার আলোচনা করে ওঁর মতামত না নিয়ে কাজ শুরু করতাম না।
নির্ভীক, স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। অজস্রবার দেখেছি সুজনদা কোনো রকম গোঁড়ামি অথবা ধর্ম বা সংস্কৃতির নামে দুর্নীতি, নারিদের অপমান দমন-পীড়ন, বিশেষ করে Domestic Violence একদম সহ্য করতে পারতেন না। শমীতাদিকে সাথে নিয়ে সোচ্চারে প্রতিবাদ করতেন। তাঁর কাছে শুনেছি এর জন্য তাঁদের অনেকবার হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মৌন হয়নি, বরাবর মুখরই থেকেছে। বেশ কয়েকবছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
গোরক্ষকদের পেশি আস্ফালন নিয়ে সুজনদার সাথে কথা হচ্ছিল। যেহেতু প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যে গোমাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল, উনি উৎসাহ দিলেন ‘প্রাচীন ভারতে গোমাংস’ লিখতে। আমি একটু ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু উনি নির্ভয়ে লিখতে বললেন। মাস ছয়েক লেগেছিল গবেষণা ও লেখার জন্য। ফোন করে খবর নিতেন কাজ কেমন এগোচ্ছে, কোথাও আটকে আছি কিনা। লেখাটা যখন অবসর-এ পাঠালাম, কৃতজ্ঞতা স্বীকারে যেসব অধ্যাপক পণ্ডিতেরা সাহায্য করেছিলেন তাঁদের সাথে সুজনদার নাম দিয়েছিলাম, উৎসাহ ও পরামর্শদাতা হিসেবে। যখন অবসর বেরোল, ওমা, দেখি নিজের নামটা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রতিবাদ অনুরোধ কিছুই কাজে আসেনি। আসলে যারা সত্যিকারের বৌদ্ধিক স্তরে থাকেন, তাদের কাছে এসব তুচ্ছ ব্যাপার। এমন মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।
তথ্যবিকৃতি করে রাজনৈতিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসাধন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো পিছিয়ে থাকেননি। এই তো গতবছর, খড়্গপুর আই আই টির একটি ক্যালেন্ডারে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনার পর অবসর-এর পাতায় লিখেছিলাম ‘একটি ক্যালেন্ডার ও কিছু বিতর্ক’। তিনি খুশি হয়েছিলেন ও তাঁর ফেসবুকের পাতায় এই প্রবন্ধ নিয়ে কিছু লিখেও ছিলেন, যাতে প্রকৃত তথ্যগুলি সামনে উঠে আসে।
স্মৃতিগুলো বোধহয় বাঁধানো খেরোর খাতায় হিসেবের মতো করে রাখা থাকে না। এক একটা আলগা কাগজে লেখা থাকে, বাতাস এলেই তারা এলোমেলো উড়তে থাকে। সুজনদার কত কথা, কত গল্প যে মনের ভেতর হাতছানি দিচ্ছে, লিখতে লিখতে কেবল স্মৃতিমেদুরতায় ভুগছি। কখনো কথা হত ধাঁধা নিয়ে, উঠে আসতো Martin Gardner, Sam Lloyd – আবার কখনো বোঝাতেন ডিটেকটিভ গল্প লেখার রহস্য। আমরা দুজনেই একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই কোনো এক সাম্প্রতিক প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের কথা উঠলেই দুজনেই উত্তেজিত হয়ে তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতাম।
সুমিতদা চলে গেলেন, তার বছর দেড়েকের মধ্যেই সুজনদার চলে যাওয়া। এঁদের দুজনই ছিলেন আমার Friend, Philosopher and Guide – আমার কাছে মস্ত বড়ো শূন্যস্থান সৃষ্টি হল। কে জানে, হয়তো ওপারে গিয়ে এঁরা দুজনে আবার হাসি ঠাট্টায় রত, হয়তো পরলোকের জন্য অবসর-এর মতো কোনো পত্রিকার কথা ভাবছেন।
পরিশেষে মনে হচ্ছে এই স্মৃতিচারণার শুরুতেই একটা ভুল কথা লিখেছি। কে বলল ভালোবাসার মানুষটা নেই? পঞ্চভূতের মানবশরীর একদিন পঞ্চভূতে বিলীন হবেই, সেটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু শরীর চলে গেলেও মানুষটা থেকে যান বহুদিন। মানুষ বেঁচে থাকে তার সৃষ্টির মাধ্যমে, তার শিষ্য, ভক্ত, ও উত্তরসূরিদের কাছে রেখে যাওয়া ট্র্যাডিশন এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে, তার জীবনদর্শনের মাধ্যমে। কাজেই যতদিন তাঁর একেনবাবু, ধাঁধাপুরী ও অন্যান্য অনবদ্য সৃষ্টিগুলি থাকবে, যতদিন তাঁর গুণগ্রাহীরা থাকবে, সুজন দাশগুপ্ত দীর্ঘদিন জাগরূক থাকবেন আমাদের সবার মাঝে। আমাদের সুজনদা আছেন, সবার মাঝে আছেন, এখনো হৃদয়ে ঠিক ভাবে কান পাতলেই তাঁর আওয়াজ শুনতে পাই, “এই দিলীপ…”