দেবতা – যুগে যুগে
যদি বলি সনাতন ধর্মের দেব-দেবীদের চেহারা ও চরিত্র যুগে যুগে বদলে গেছে, তাহলে অনেকেই ভুরু কোঁচকাবেন। যদি আরও যোগ করি যে হাজার হাজার বছর ধরে অনেক দেবতা হারিয়ে গেছেন ও নবীন দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে, তাহলে হয়তো অবিশ্বাস্য লাগবে। কিন্তু যদি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রগুলি খুঁটিয়ে দেখি আর তার সঙ্গে ইতিহাস ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি বিশ্লেষণ করি, আমাদের দেবতাদের বিবর্তনের রূপরেখাটি ধরা পড়তে বাধ্য।
ভারতের প্রাচীনতম শাস্ত্র ও সাহিত্য ঋগ্বেদ আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে লেখা। ঋগ্বেদের দেবতা গোষ্ঠী বর্তমানের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ঋগ্বেদে আমাদের পরিচিত দেবতাদের যা বর্ণনা পাই, তার সঙ্গে বর্তমানের কোনো মিল নেই। মুখ্য পুরাণগুলি, যেমন, বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ইত্যাদির রচনাকাল তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দী ধরা হয়। পুরাণগুলিতে দেখি ঋগ্বেদের দেবতাদের চেহারা ও বৈশিষ্ট্য দুই-ই বদলে গেছে, কিছু নবীন দেবতার আবির্ভাব হয়েছে, আর ঋগ্বেদের অনেক প্রাচীন দেবতাদের পুরাণে আর খুঁজে পাই না।
বিবর্তনের বিষয়টি গভীর ও বিস্তৃত, তাই খুব সংক্ষেপে এর একটি রেখাচিত্র তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। বিবর্তনের কারণ, পদ্ধতি, সময়কাল ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এই প্রবন্ধের অন্তর্গত করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন বৈদিক ও পৌরাণিক উপাখ্যানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।
ইন্দ্র
বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র। ঋগ্বেদের ১০২৮টি সূক্তের মধ্যে ইন্দ্রের নামে প্রায় ২৫০টি সূক্ত[i] আছে। তাঁর অনেক নাম এবং বৈদিক ঋষিগণ তাঁর স্তুতি ও প্রার্থনার শেষ রাখেননি। বেদে তিনি প্রচণ্ড শক্তিশালী দেবতা, নেতা স্বরূপ, বিরাট যোদ্ধা। তিনি তেজোদৃপ্ত অশ্বচালিত রথে চড়ে ঘুরে বেড়ান। তীর-ধনুক ও অজস্র মুখযুক্ত বজ্র তাঁর অস্ত্র, শত্রুরা তাঁকে ভয় পায়, রাজারা যুদ্ধ জয়ের জন্য তাঁর স্তব করেন। তিনি বৃত্রকে বধ করে পর্বতের বুক চিরে জলরাশি উন্মুক্ত করে দেন। আর হ্যাঁ, তিনি খেতে পারতেন বটে! তাঁর প্রিয় খাবার মহিষ বা বৃষের মাংস, যা তিনি একাই কয়েকশো খেয়ে ফেলতে পারেন। আর পান করেন কেবল জালা নয়, পুকুর ভরতি সোমরস। বেদে তাঁর স্ত্রীর নাম ইন্দ্রাণী। ইন্দ্র বেদের প্রধান দেবতা হলেও কিন্তু দেবরাজ আখ্যা পাননি।
বেদের ইন্দ্র তাঁর শ্রেষ্ঠ দেবতার জায়গাটি হারিয়েছেন পরবর্তী দেড়-দুই হাজার বছরের মধ্যে। বৈদিক ইন্দ্র থেকে পৌরাণিক ইন্দ্রের বিবর্তনে ফলে ইন্দ্রের চেহারা ও চরিত্র দুই-ই অনেক বদলে গেছে।
পুরাণের ইন্দ্র দেবরাজ। কিন্তু বিষ্ণু ও শিবের জনপ্রিয়তার কাছে ইন্দ্র অনেক পেছনে। পুরাণে তাঁর স্ত্রীর নাম শচী। ঐরাবত নামের হাতি তাঁর বাহন, বজ্র তাঁর অস্ত্র, তিনি নৃত্য-গীতের অনুরাগী এবং স্বর্গের ইন্দ্রপুরীতে অপ্সরাদের নাচ দেখতে ভালবাসেন। পুরাণের ইন্দ্র বৈদিক ইন্দ্রের মতো অপরাজেয় দেবতা নন ও মাঝে মধ্যে অসুরদের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে বিষ্ণু বা শিবের শরণাপন্ন হন। আবার রামায়ণে দেখি ইন্দ্রের চরিত্রদোষ এবং অহল্যার স্বামী গৌতম ঋষির অভিশাপ। ইতিহাসে রাজা অজাতশত্রুকে (৪৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) বৃজিদের সাথে যুদ্ধের আগে ইন্দ্রের পুজো করার কথা পাই।
অগ্নি
ঋগ্বেদের প্রথম সূক্ত ‘অগ্নিমীলে পুরোহিতং…’ ঋগ্বেদের দ্বিতীয় প্রধান দেবতা অগ্নির উদ্দেশে নিবেদিত। অগ্নির একার নামে ঋগ্বেদে প্রায় ২০০ সূক্ত আছে। অগ্নি যজ্ঞের মাধ্যমে ঋষি ও দেবতাদের যোগাযোগের সেতু। যখন ‘স্বাহা’ বলে অগ্নিকে আহ্বান করে ঋষিরা যজ্ঞে হবি আহুতি দেন, তখন অগ্নি তাঁর লকলকে সাতটি শিখাস্বরূপ জিভ দিয়ে যজ্ঞের আহুতি দেবতাদের কাছে পৌঁছে দেন, তাই তাঁর অনেক নামের একটি হল হব্যবাহন। তিনি পবিত্র করেন তাই তিনি পাবক। বেদে অগ্নির আরো একটি নাম ‘জাতবেদ।’ বেদসকল তাঁর থেকে জাত, অথবা তিনি জন্ম থেকেই সর্বজ্ঞ, তাই তাঁর অন্য নাম জাতবেদ।
বৈদিক অগ্নি থেকে পৌরাণিক অগ্নির অনেক তফাৎ। পুরাণেও অগ্নির হব্যবাহন চরিত্রটি বজায় আছে, কিন্তু তাঁর বৈদিক প্রাধান্য আর নেই। অগ্নির নিজস্ব অগ্নিপুরাণ লেখা হয়েছে, যেটা সব দেবতার কপালে জোটেনি। অগ্নি অষ্ট দিকপালের একজন, অষ্ট বসুর একজন ও পঞ্চভূতেরও একজন। পুরাণে অগ্নির স্ত্রী স্বাহা। বেদ-পুরাণ ছাড়াও অন্যান্য শাস্ত্রে অগ্নি বিশেষ স্থান পেয়েছে। যেমন আয়ুর্বেদে জঠরাগ্নি খাবার হজমে সাহায্য করে, ধাত্বাগ্নি শরীরের বিপাকে সাহায্য করে। গীতাতে ভগবান নিজেকে বৈশ্বানর (অগ্নি) বলেছেন (গীতা ১৫.১৪) ও অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনের সময় ভগবানকে অগ্নিস্বরূপ দেখছেন।
মিত্র-বরুণ
ঋগ্বেদ ও অন্য বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দেবতা মিত্র ও বরুণ। তাঁদের নামে বেশির ভাগ সময় মিত্র-বরুণ একসঙ্গে এবং আলাদা আলাদা ভাবেও প্রচুর সূক্ত লেখা হয়েছে। বেদের বরুণ ছিলেন দেবতাদের দেবতা, দেবতা ও মানুষ সকলের রাজা। বরুণের নিবাস স্বর্গের ওপরে উচ্চতম স্বর্গে, হাজার স্তম্ভ ও হাজার দরজাযুক্ত বিশাল স্বর্ণমণ্ডিত প্রাসাদে। তিনি সর্বদর্শী। সূর্যের রশ্মি এসে জগতের ভালোমন্দ, কে সত্যের পথে আছে, কে নেই, এই সব তথ্য তাঁকে পৌঁছে দিয়ে যায়। তাঁর নিয়মে আকাশ ও পৃথিবী আলাদা হয়ে আছে, রাতের চন্দ্র তারকা নিয়ন্ত্রিত হয়, ঋতু পরিবর্তন হয়। বাতাস হচ্ছে তাঁর নিশ্বাস। তিনি ‘মায়িন্’ অর্থাৎ মায়াধীশ।
মিত্র ও বরুণকে বেশির ভাগ মন্ত্রে একসঙ্গে উল্লেখ করা আছে। মিত্র দিনের দেবতা, তিনি একাধারে আদিত্য, সূর্যের প্রতিরূপ, বরুণের সঙ্গে ধর্মের রক্ষক। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় মিত্র ও বরুণকে যথাক্রমে দিন ও রাত বলা হয়েছে।
পুরাণে বরুণ তাঁর বৈদিক গৌরব হারিয়ে কেবলমাত্র জলের দেবতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর মিত্র? তিনি বর্তমান দেবতাকুল থেকে উধাও হয়ে কেবল প্রাচীন মন্ত্রের মাঝে বেঁচে আছেন।
ব্রহ্মা
আমরা যে পিতামহ ব্রহ্মাকে চিনি, তিনি অনেক সময় অসুরদের বর দিয়ে পরে ফ্যাসাদে পড়েন কারণ তাঁর বরে বলীয়ান অসুরদের কাছে দেবতাদের নাকানিচোবানি খেতে হয়। কিন্তু সেই ব্রহ্মাকে বেদে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদের শেষে দশম মণ্ডলে প্রজাপতি নামে এক দেবতাকে পাওয়া যায়, যিনি সকল জীবের পালক, যদিও ইন্দ্র অগ্নি সহ আরো অনেক দেবতাকে এই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ঋগ্বেদে হিরণ্যগর্ভ নামে যার স্তব-স্তুতি (সূক্ত ১০.১২১) করা হয়েছে, সেই দেবতাকে অনেকে ব্রহ্মার সঙ্গে তুলনা করেন, যদিও হিরণ্যগর্ভের আরো বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ঋগ্বেদে বিশ্বকর্মাকেও জগতের সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে। মোটকথা ব্রহ্মা নামে কোনো দেবতা ঋগ্বেদে নেই।
বেদোত্তর ব্রাহ্মণ[ii] সাহিত্যের যুগে আমরা প্রজাপতি নামে এক দেবতার উত্থান দেখি, সেখানে রোহিণী তাঁর স্ত্রী ও ঊষা তাঁর কন্যা। তিনি পরে পুরাণে ব্রহ্মা হয়ে যান।
পুরাণের প্রজাপতি ব্রহ্মা জগতের সৃষ্টিকর্তা, দিব্য ত্রিমূর্তির একজন। তিনি চতুর্মুখ ও তাঁকে পিতামহ বলা হয়। তাঁর নিবাস ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুর নাভি থেকে উৎপন্ন পদ্ম তাঁর আসন। তাঁর নিজ শরীর থেকে গায়ত্রীর উৎপত্তি। ব্রহ্মার এক দিন মানুষের সহস্র চতুর্যুগ, তাঁর সৃষ্টিতে চৌদ্দ জন মনুর রাজত্ব ও দিন শেষে ব্রহ্মার রাত্রি হলে মহাপ্রলয়ে জগত লয় হয় ও ব্রহ্মা আবার নতুন জগত সৃষ্টি করেন। যজ্ঞের প্রধান পুরোহিতকেও ব্রহ্মা বলা হয়। রামায়ণে একাধিক প্রজাপতির নাম আছে ও মহাভারতে প্রজাপতি হচ্ছেন ব্রহ্মার সহকারী।
বিষ্ণু
বর্তমানের অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা বিষ্ণু ঋগ্বেদের প্রধান দেবতাদের মধ্যে গণ্য নন, সেটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগবে। বিষ্ণুর নামে ঋগ্বেদে কেবল পাঁচটি সূক্ত আছে। বৈদিক বিষ্ণুকে ‘সৌর’ দেবতার গোষ্ঠীতে রাখা হয়, অর্থাৎ বেদে তাঁকে সূর্যের প্রতিরূপ বলে মানা হত। বেদে বিষ্ণু ইন্দ্রের সখা, তাঁর অস্ত্র তীর-ধনুক। তিনি তারুণ্য-উচ্ছল, তাঁর চেহারা বিশাল। সম্ভবত তাঁর উপাসনা বৈদিক যুগে ফসল ও উর্বরতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁকে এক জায়গায় বলা হয়েছে তিনি বিশ্বের রক্ষক, অনতিক্রম্য, এবং তিন পদক্ষেপে ধর্মকে রক্ষা করছেন। বিষ্ণুর দুই পদক্ষেপ মানুষের গোচর হলেও, তাঁর তৃতীয় স্বর্গীয় পদক্ষেপ সমস্ত জীবের অগোচর। কেবল সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ তাঁর ‘পরম পদ’ সূর্যালোকিত উন্মুক্ত আকাশের মত স্পষ্ট দেখতে পান (ঋগ্বেদ ১.২২.১৭-২১)। পণ্ডিতদের মতে বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপ, পৃথিবী, আকাশ, ও স্বর্গের প্রতীক।
বৈদিক যুগের শেষের দিক থেকে বেদোত্তর শাস্ত্রে আমরা বিষ্ণুর গুরুত্ব বাড়তে দেখি। পুরাণের বিষ্ণু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় দেবতা এবং ব্রহ্মা ও মহেশ্বর, এই দুজনের সঙ্গে দিব্য ত্রয়ী হিসেবে মান্য। ব্রহ্মা জগত সৃষ্টি করার পর জগত পরিপালনের দায়িত্ব বিষ্ণুর। তিনি অবতাররূপে জীবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন ধর্মরক্ষা ও জগত কল্যাণের জন্য। পৌরাণিক বিষ্ণু চতুর্ভুজ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী। তাঁর প্রধান অস্ত্র সুদর্শন চক্র। তাঁর বাহন গরুড় পক্ষী। বিষ্ণুপুরাণ ছাড়াও, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন ইত্যাদি অন্য পুরাণে ও সংস্কৃত সাহিত্যে বিষ্ণুর প্রচুর উপাখ্যান দেখতে পাই। ঋগ্বেদে বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপ পরবর্তী কালে পুরাণে বামন অবতারের ত্রিপাদ ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুরুতে বিষ্ণু, নারায়ণ, ভাগবত-বাসুদেব ও কৃষ্ণ এই চারজন আলাদা আলাদা দেবতা হিসেবে গণ্য হতেন। পরে পুরাণের বিষ্ণুর মাঝে আমরা এদের একত্রিত হতে দেখি।
বেদের সংহিতা অংশে উল্লেখ না থাকলেও, নারায়ণের প্রথম উল্লেখ পাই শতপথ ব্রাহ্মণে। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে নারায়ণ সম্ভবত শুরুতে অ-বৈদিক দেবতা ছিলেন।
ভাগবত-বাসুদেবের উল্লেখ পাই প্রাচীন তৈত্তিরীয় সংহিতা, অর্থশাস্ত্র, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, ও বৌদ্ধ জাতকের গল্পে। গীতাতে ভগবান নিজেকে আদিত্যের মধ্যে বিষ্ণু (গীতা ১০.২১), বৃষ্ণিদের মধ্যে বাসুদেব বলেছেন (গীতা ১০.৩৭)। প্রাচীন ভারতের গুপ্ত রাজাদের (খ্রিঃ চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দী) মুদ্রায় গরুড় চিহ্ন থেকে তারা ভাগবত উপাসক ছিলেন বলে মনে করা হয়।
সম্ভবত প্রাচীন কালে একাধিক কৃষ্ণ ছিলেন। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৩.১৭.৬) ও ঋগ্বেদের কয়েকটি সূক্তের রচয়িতা এক ঋষি কৃষ্ণের উল্লেখ পাই। মহাভারতের কৃষ্ণ একজন যদু বা বৃষ্ণি/আভীর গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। পরে তিনি আদিপুরুষ কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর অবতারে রূপান্তরিত হন। মূলত ভাগবত পুরাণ ও হরিবংশে কৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রাধা-কৃষ্ণের লীলা, সাহিত্যে বা কলায় জনপ্রিয় বিষয় হলেও মহাভারতে, ভাগবতে, বা হরিবংশে কিন্তু রাধার কোনো উল্লেখ নেই। রাধার আবির্ভাব কৃষ্ণের অনেক পরে, প্রায় এক হাজার বছর বা তারও পরে। এখানে স্বল্পপরিসরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কৃষ্ণের বিবর্তন নিয়ে পরে বিশদ বলার ইচ্ছা রইল।
শিব
রুদ্র, শিব, মহেশ্বর, ভোলানাথ, যে নামেই ডাকি না কেন – যুগে যুগে এই দেবতার চেহারা ও চরিত্র এত বদলে গেছে যে চেনাই দুষ্কর। এই দেবতার আমূল বিবর্তন দেখলে মনে হয়, আমরা কি একই দেবতার কথা বলছি, নাকি এঁরা ভিন্ন ভিন্ন দেবতা।
বৈদিক রুদ্র বেদে গৌণ দেবতাদের মধ্যে পড়েন। ঋগ্বেদে তাঁর নামে তিনটি মাত্র সূক্ত। কিন্তু তিনি ধ্বংসকারী, রীতিমত ভয়প্রদ দেবতা। তাঁর অস্ত্র ধনুর্বাণ ও সেই ধনুক থেকে নির্গত তীর মানুষ ও পশুর মড়ক আনে, মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর জটাযুক্ত কেশ, গায়ের রং তাম্রাভ-রক্তবর্ণ, তিনি কোথাও নীলগ্রীব, কোথাও শিতিকণ্ঠ (শুভ্রকণ্ঠ)। শিবের যে শান্ত সমাহিত চেহারার সঙ্গে আমরা পরিচিত, বেদে সেটা মোটেও দেখতে পাই না। যজুর্বেদে তাঁর স্তব করা হচ্ছে যাতে তিনি তাঁর হাতের তীরগুলি সামলে রাখেন, তাঁর তীরগুলি যাতে শুভকারী হয়। তিনি যাতে আমাদের মাতা, পুত্র ইত্যাদি আত্মীয় এবং গো, অশ্ব, মেষ ইত্যাদি পশুগুলিকে আঘাত না করেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে ‘মা হিংসী’ – হে রুদ্র, আপনি আমাদের হিংসা করবেন না, সদয় হোন।
বিষ্ণুর মতোই বৈদিক যুগের শেষের দিক থেকে শিবের গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং পুরাণে তা পূর্ণতা পায়। পুরাণে শিবের হাতে ডমরু ও ত্রিশূল, তাঁর বাহন নন্দী, তাঁর এক, তিন, বা পাঁচ মুখ। পুরাণে ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে শিব গায়ে ভস্ম মেখে শ্মশানে বিচরণ করেন, তাঁর পরনে বাঘছাল, সর্প তাঁর অঙ্গভূষণ। তিনি ক্রুদ্ধ হলে তাঁর তৃতীয় নেত্র থেকে ক্রোধ-বহ্নি মুহূর্তে সব ভস্ম করে দেয়। তিনি নটরাজ, তাঁর প্রলয় নৃত্যে সৃষ্টির অন্ত হয়, ব্রহ্মা নতুন সৃষ্টির সূচনা করেন।
একটু খুঁজে দেখলে পৌরাণিক অথবা মহাকাব্যের শিবের সঙ্গে রুদ্রের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের যোগসূত্র দেখতে পাওয়া যায়। যেমন রামায়ণের হরধনু বৈদিক রুদ্রের ধনুর্বাণকে মনে পড়ায়। পৌরাণিক শিবের ভীতিকর বর্ণনার মাঝে বৈদিক রুদ্রের ভীষণ রূপের ছায়া। শিবহীন দক্ষযজ্ঞের কাহিনির মাঝে লুকিয়ে আছে বৈদিক রুদ্রকে যজ্ঞ থেকে দূরে রাখার রীতি।
তবে শিবের সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে বোধহয় মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের হাতে, তাঁরা শিবকে দিয়ে জমি চাষ করিয়েছেন, সাপ খেলিয়েছেন ও এক নেশাড়ুতে পরিণত করেছেন। আর বাঙালির কল্পনায় দুর্গার স্বামী শিবকে নিয়ে তো কতই কাব্য সাহিত্য রচিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি যে মহেঞ্জোদারোর বিখ্যাত যোগীর সীলের মূর্তি, যাঁকে অনেকে ‘পশুপতি শিব’ বলে মনে করেন, সেই ধারণার বিরুদ্ধে কিছু জোরালো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে (Srinivasan, 1984) এবং এই প্রবন্ধের লেখকও তাঁর সঙ্গে একমত। এর বিশদ আলোচনা এই প্রবন্ধের সুযোগের বাইরে।
দুর্গা
সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দুর্গা বৈদিক দেবতা নন। দুর্গা, চণ্ডী, কালী বা শক্তি উপাসনার কোনও দেবতাকেই বেদে পাওয়া যায় না। দুর্গা পুরাণের দেবী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩ অধ্যায়, যা সাধারণত দেবী মাহাত্ম্য, দুর্গা সপ্তশতী, বা বাংলায় চণ্ডী নামে পরিচিত, তাতে আমাদের পরিচিত সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দুর্গার সম্পূর্ণ উপাখ্যান পাওয়া যায়। এছাড়াও মৎস্য, বরাহ, শিবপুরাণ এবং বিশেষ করে দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরাণে দুর্গার অসুরবধের উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে সরস্বতী ও লক্ষ্মী দুজনেই দুর্গার থেকে কম পক্ষে এক হাজার বছর বড়ো। কিন্তু বাঙালি কল্পনায় তাঁরা দুর্গার কন্যা। তেমনি, পার্বতী ও দুর্গা মূলে আলাদা দেবী হলেও বিভিন্ন প্রার্থনায়, প্রচলিত বিশ্বাসে, ও কবির কল্পনায় শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ এক পরিবারে রূপান্তরিত হয়েছেন।
সিংহবাহিনী দুর্গা মূর্তির উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ভারতের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় পৌঁছে যেতে হয়। এই সম্বন্ধে আমি আগে অবসর পত্রিকায় ও অন্যান্য পত্র পত্রিকায় লিখেছি (দিলীপ দাস, ২০১৪, ২০১৯), তাই এই নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনা বাহুল্য।
অসুর
কেবল দেবতাদের নয়, সনাতন ধর্মে অসুরদেরও বিবর্তন দেখা যায়। ঋগ্বেদের প্রাথমিক যুগে অসুর কথাটির অর্থ ছিল মহান। ঋগ্বেদের শুরুর দিকে অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ ইত্যাদি বিভিন্ন বৈদিক দেবতাদের ‘অসুর’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু পরের দিকে দেখি অসুররা দেবতা বিদ্বেষী এবং ইন্দ্রের বৃত্রাসুর বধের উপাখ্যান পাই। এর কারণ বা সময়রেখা এই প্রবন্ধের সুযোগের বাইরে। কিন্তু একটা ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করব, প্রাচীন পারসিকদের ধর্মে ‘দৈব’ হচ্ছে মন্দ এবং অসুর ভালো লোক।
হারিয়ে যাওয়া দেবতা
প্রবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম কিছু দেবতার হারিয়ে যাওয়ার কথা। বেদের দেবতা মিত্রের কথা আগেই বলেছি। এবার আরো কিছু উদাহরণ দেব। ঋগ্বেদে দ্যৌ নামের এক আকাশের দেবতাকে আটত্রিশ বার উল্লেখিত হতে দেখি তারপর আর দেখা পাই না। সেই রকম অপাম-নপাৎ, মাতরিশ্বা, অজ-একপাদ, পুষণ, ব্রহ্মনস্পতি, রভু, এদেরও পুরাণে দেখা মেলে না। নতুন দেবতা? মনসা, শীতলা এঁরা নবীনের দলে। আর ১৯৭৫ সালে এক নবীন দেবী দেখা দিয়েছিলেন, সারা ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়েছিল তাঁর আগমন বার্তা, কোটি কোটি ভক্ত তাঁর শরণ নিয়ে বলেছিল জয় সন্তোষী মাতার জয়।
পরিশিষ্ট
সনাতন ধর্মের একটি মহান বৈশিষ্ট্য হল যে যুগ ও কালের বিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, সর্বজনের নাগালের মধ্যে থাকা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্যেও সনাতন ধর্মের কেন্দ্রের মূল অমরবাণীগুলি যুগে যুগে অপরিবর্তিত থেকে গেছে। অবিচল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন ঋষিদের বাণী আমাদের যুগে যুগে ধ্রুবতারার মতো পথ দেখায়।
———-
[i] এক বা একাধিক শ্লোক নিয়ে হয় একটি সূক্ত। বৈদিক সূক্তগুলি এক বা একাধিক ঋষির দ্বারা এক বা একাধিক দেবতাদের উদ্দেশে রচিত।
[ii] বৈদিক সাহিত্যকে চার ভাগে ভাগ করা হয়, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ।
———-
তথ্যসূত্র
Bhattacharjee, S. (1978). The Indian Theogony. Calcutta, India: Firma KLM.
Das D. (2019, Oct-Dec). “Origin and Evolution of Durgā.” Bulletin of the Ramakrishna Mission Institute of Culture Kolkata, India.
Flood, G. (2003). The Blackwell Companion to Hinduism. Oxford UK: Blackwell Publishing.
Jaiswal, S. (1967). The Origin and Development of Vaiṣṇavism. New Delhi, India: Munshiram Mahoharlal.
Keith, A. B. (1925). “The Religion and Philosophy of Veda and Upanishads Part-I.” Harvard Oriental Series, 31. London Harvard University Press.
Renou, L. (1957). Vedic India (Trans. Philip Spratt). Calcutta, India: Susil Gupta (I).
Srinivasan, D. (1984). “Unhinging Shiva from the Indus Civilization.” Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, 1, pp. 77-89.
দাস, দিলীপ (২০১৯, অক্টোবর)। “দুর্গা যুগে যুগে।” দেশ। কলকাতাঃ আনন্দবাজার পত্রিকা।
দাস, দিলীপ (২০১৪, সেপ্টেম্বর)। “দুর্গা।” অবসর। প্রাপ্তিস্থানঃ https://abasar.net/abasarold/abasar/Pujodilip.htm
ছবিঃ লেখক