অর্জুন চরিতমানস
অর্জুনরাম ছিল কাচ কারখানার ব্যাচহাউসের কর্মী। ছোটোখাট চেহারা। গায়ে ছিল তাকলাগানো জোর। বাইরে থেকে বোঝা যেত না। কিন্তু দরকার পড়লে মালুম হত। পরনে থাকত হাফপ্যান্ট আর গায়ে কোম্পানির দেওয়া আপার। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক, অর্জুনরামকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আর সমস্যা থাকবেই বা কেন? সে ছিল অসম্ভব ভালো কর্মী। ওর ক্ষমতার একটি দুটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে ব্যাপারটা।
কোম্পানির বাউন্ডারি ওয়াল তোলা হচ্ছে। সাতফুট উঁচু। তখন পর্যন্ত লম্বায় প্রায় পঁচিশফুটের মতো পাঁচিল গাঁথা হয়েছে। হেডমিস্ত্রি রমজান আলি ওর লোকজন নিয়ে প্রস্তুত। মাপজোক হবে। অর্জুন কোথায় যাচ্ছিল। সব দেখেশুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। একমুখ হেসে বলল, “এই সব ফালতু জিনিসের জন্যে আবার পয়সা! এ পাঁচিল তো আমার একধাক্কায় কাত হয়ে যাবে!” শোনামাত্র রমজান রেগে কাঁই। বলে কী? এতবড় অপমান? এমন শক্তপোক্ত পাঁচিল অর্জুনের একধাক্কায় ভেঙে যাবে? পুরোদস্তুর ইজ্জত কা সওয়াল! সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ল রমজান, দু’শো টাকা বাজি। পাঠক মনে রাখবেন, গত শতকের আটের দশকে দু-দু’শো টাকা মানে অনেক টাকা।
ভিড় জমে গেল। উৎসাহী দর্শক মজা দেখার অপেক্ষায়। অনেকে অর্জুনকে বাজি লড়তে বারণ করতে লাগল। বাজিতে হারলে বড়সড় গাঁটগচ্চা যাবে। কিন্তু অর্জুন অকুতোভয়! মহাভারতের চরিত্র সে। এ সবে থামলে তার চলে না। হাতা গুটিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে মারল এক ধাক্কা। এবং আমাদের সকলকে অবাক করে রমজানের গর্বের পাঁচিল তৎক্ষণাৎ পপাত ধরণীতলে। জমা হওয়া জনতা অর্জুনের কেরামতিতে মুগ্ধ। সবার চোখের সামনে সঙ্গে সঙ্গে কড়কড়ে দুটো একশ টাকার নোটের হাতবদল ঘটল।
আর একদিনের ঘটনা। দুপুর হয়েছে, লাঞ্চ-এ যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি। খবর এল, লাঞ্চের একটু দেরি হবে। কেন দেরি, কী ব্যাপার, সে সবে মাথা না ঘামিয়ে কাজ নিয়ে আবার বসে গেছি। সময়টা সদ্ব্যবহার করতে হবে। কিছুক্ষণ পরে গেস্ট হাউস থেকে তলব এল। রওনা হলাম। যাবার পথে দেখি পেয়ারা গাছের তলায় একটি ছোট জটলা। আর যাকে ঘিরে জটলা সে পড়ে আছে ডিমভর্তি ইলিশ মাছের মত। কাছে গিয়ে দেখি আর কেউ নয়, স্বয়ং তৃতীয় পান্ডব! বিস্ময়ের চরম সীমায় আমরা। কার হাতে অর্জুনরামের এমন দুর্দশা হতে পারে, ভেবে কূল পাচ্ছি না।
ভিতরে গিয়ে জানা গেল আসল ঘটনা। গেস্ট হাউস-এর কুক হীরার সঙ্গে বাজি ধরেছে অর্জুনরাম। সে নাকি কাঁচা দালদা খেয়ে অবলীলায় হজম করতে পারে। হীরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে, পাঁচশো টাকা বাজি। অর্জুন দমবার পাত্র নয়। এক টিন কাঁচা দালদা একাই খেয়ে নিয়েছে। বিস্ময়ে হীরার মুখে আর কথাটি নেই। হাতেহাতে নগদ বিদায় পাঁচশো টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে সে। খেলা শুরু হয়েছে তার পরে। কাঁচা দালদার সঙ্গে খোদ অর্জুনরামও যুঝতে পারেনি। অতঃপর তার ঐ অবস্থা। চোখ উল্টে গাছতলায় শয়ান। এহেন অর্জুন একবার কেঁদেকেটে একশা। সেই কাহিনি শোনাই।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি-ভাইয়ের কথা মনে পড়ে? ঠিকই ধরেছেন, সেই বিখ্যাত স্বমূত্রপায়ী। আজ থেকে একচল্লিশ বছর আগে তিনি হাজার টাকার নোটবন্দি করবার আদেশ জারি করেছিলেন। কালো টাকার মোকাবিলায় de-moneytisation, ঠিক এখনকার মতই।
এইসময় একদিন ব্যাচহাউসের অফিস লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ইনচার্জ রতন আইচের সামনে বসে হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে অর্জুন। পাশে রাখা একটি চটের বস্তা। সমবেত জনতা উত্তাল। কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। রতনবাবু ওকে বললেন, “কী রে, বল বাবুকে?” হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে কিছু না বলে পাশে রাখা চটের বস্তার মুখ খুলে হাতের ইশারায় সেদিকে দেখিয়ে দিল অর্জুন। উঁকি মেরে দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! চটের বস্তাভর্তি হাজার টাকার নোট!
সে যুগে হাজার টাকার নোট সহজলভ্য ছিল না। স্বচক্ষে দু’দশটি হাজার টাকার নোট দেখেছি মাত্র। বস্তাভর্তি নোট দেখে আমার চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে ব্রহ্মতালু ছোঁবো ছোঁবো করছে। মুখে কথাটি নেই। এমন দৃশ্য এ জীবনে একবারই দেখেছিলাম। তাও তৃতীয় পাণ্ডবের দৌলতে।
রতনবাবু কী ভাবে যে নোটবন্দির শেষদিনে অর্জুনকে বাঁচিয়েছিলেন তা তিনিই বলতে পারবেন। তবে আমি যে অজ্ঞান হইনি সেকথা হলফ করে বলতে পারি। সে কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন হল। শেড ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে কবেই। সাপখোপ আর আগাছার জঙ্গলে ঢেকে আছে বিরাট এক ডাইনোসর কারখানা। অর্জুনরামের মত অসংখ্য মানুষের দীর্ঘশ্বাস সহ্য করতে পারব না বলে সেদিকে আর যাই না।
2 Comments